ভাদুমিয়ার চায়ের স্টলে গপ্পো মেরে সারাটা বেলা কাটে ফেকুর। দিনে তার কোনো কাম নেই। ফেকু বুক ফুলিয়ে বলে, সাধু আর চোরের ল্যাগা রাইত। তুমাদের মতো সাধারণ মানুষের দিন। বর্ডার পার হয়ে চুরির জন্য এত্ত বড় কোলিজা লাগে মিয়া! ফেকু তার হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বড় কলিজার সাইজ দেখায়। বলে, ঝুক্কি বেশি, লাভ বেশি। আরে মিয়া কলিজা লাগে, কলিজা! এ কাম সবার না। এ কামের পুঁজি সাধের এই জীবনটা—নিজের বুক চাপড়ায় সে। যেহেতু বর্ডারের ওপারে সে চুরি করে, তাই স্থানীয় থানায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আসলে বেলুপুরের অনেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এখানকার মেম্বার বাড়িতে তো চার-পাঁচ জন চোর পালে এ কামের জন্য। মেম্বার ওদের গরু বিক্রির টাকার সঙ্গে মাসোহারাও দেয়। তাছাড়া বর্ডারের দুই পারেই তাদের জানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেয়।
মেম্বার ফেকুকে অনেকবার ডেকেছে তার হয়ে কাজ করার জন্য কিন্তু সে রাজি হয়নি। তার কথা হচ্ছে, হামি স্বাধীনভাবে কাম করব। চুরি করব তো কারও গোলামি করে কেনে? ফেকু বিখ্যাত চোরের ছেলে। ফেকুর বাপ হারু চোরের মতো দক্ষ গরু চোর এ তল্লাটে আর একটিও ছিল না। হারু তার চুরির জীবনে একটিবারও বিএসএফের হাতে ধরা খায়নি। হাতে পায়ে দুই চারটে গুলির শুকনো ক্ষত চিহ্ন ছিল। তবে আধিকাংশ ক্ষতচিহ্ন পেশা জীবনের শুরুর দিকের। মরার আগে সে বেটাকে তার হুনারিটা দিয়ে গেছে। হারু তার নিজের বাপ নয়, নয় পালক বাপ। তবে ফেকু জানে না কে তার আসল বাপ। ফেকু অবশ্য হারুকে জিজ্ঞেস করেছিল, কে তার আসল বাপ?
উত্তরে হারু বলেছে, বাপধন, হামি তোর বাপ। কী আর কহোব তোকে। শিশু পাচারের একটা বড় চালান থেকা তোকে হামি উদ্ধার করেছিনু। তোকে দেখা বড় মায়া লেগেছিল। রাজপুত্রের মতো চেহারা। দামি কাপড় চোপড় পরেছিলি। তোর মুখের কথাগেলাও ছিল বড় মধুর। তুই অনেক বড় ঘরের বেটারে।
—তো তুমি হামাকে হামার ঘরে দিলা না কেনে? পুলিশকে খবর দিলেই পারতা।
—বাপধন, পুলিশ হামার কথা বিশ্বাস করতো? হামাকেই ছেলেধরা ভেবে জেলে ভোরত। বাপ তুই আফসোস করিস না। গরিব হতে পারি, তোকে নিজের বেটার কম ভেবেছি বল? বড় আদরে তোকে পেলেছি। নিজের ছেলার মতো বুকে আগলে মানুষ করেছি। তোকে ছেড়ে হামি থাকতে পারতাম?
একবছর ঘর করার পর হারুর বউ ওকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর ফেকুকে নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিলো হারু। ফেকু ছাড়া দুকুলে তার কেবা আপন ছিল? হারুর বউটা বড্ড ভালো মানুষ ছিল। দোষ বলতে ওই একটাই—হারুর পেশা নিয়ে ওর ছিল গতরজ্বালা। ওই একবছরের ঘরকান্না। ওটারই স্মৃতির জাবর কেটে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলো হারু! সত্যি, লোকটা আজব। পেয়ারের বউ ছাড়ল কিন্তু চুরি ছাড়তে পারলো না। বউয়ের শর্ত ওই একটাই তো ছিল, হয় চুরি ছাড়ো নাহিলে হামাকে। গরু চুরি শুধু তার পেশা ছিল না, নেশাও।
বর্ডারের এ এলাকার মানুষের জীবন শিলার মতো কঠিন, চৈত্রের রোদ্রের মতো উত্তপ্ত। এখানে জীবনধারণের জন্য কর্মব্যবস্থা খুবই সীমিত। বিদ্যুৎ নেই, নেই কোনো কলকারখানা অথবা অন্য কোনো কর্মক্ষেত্র। চোরাকারবার এদের প্রধান পেশা। সরকারি প্রতিনিধিরা ভোটের আগে অতি কষ্টে কাদা-খিঁচের রাস্তা মাড়িয়ে দুয়েকবার এলেও পরে আর তাদের মাখন সদৃশ চেহারা ভগবানের মতো অন্তরেই জপতে হয়—চাক্ষুস করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা এই এলাকার জনগণ পায় না। আশেপাশে নেই কোনো পুলিশ ফাঁড়ি অথবা থানাও। জরুরি চিকিৎসার জন্যও গরুগাড়িতে ভাঙতে হয় তিন ঘণ্টার এবড়োখেবড়ো পথ। এরা জানে বাঁচার অন্য নাম যুদ্ধ। বেঁচে থাকতে হলে অন্যেরটা ছিনিয়ে নিতে শিখতে হবে। শৈশবে তাদের বর্ণ পরিচয়ের বদলে এ শিক্ষাটাই দেওয়া হয় এ খটাস অঞ্চলে। এখানে সময়ের সূর্য এখনো তার কিরণ ফেলেনি। ফেকু এখন এ ভূমির সন্তান। তার পূর্বপরিচয় এ ভূমি মুছে ফেলেছে। তাকে নিজ সন্তানের মতো করেই গড়ে নিয়েছে সে। ফেকুর ছেলেবেলার সেই ফর্সা চকচকে দেহে রুক্ষ ধূসর বর্ণ ধরেছে। কোমল হৃদয় শিলার মতো কঠিন-কঠোর হয়েছে। আপন মা-বাবার কিছু ঝাপসা স্মৃতি মাঝে মাঝে উঁকি দেয় তার মস্তিষ্কের কোষে। কিন্তু তা শ্রাবণের মেঘের মতো বড়ই গোলমেলে এলোমেলো। তার কতটা স্মৃতি, কতটা কল্পনা ফেকু বুঝতে পারে না—বলতে পারে না। তার ফেকু নামের আড়ালে জাতকের দেওয়া নামটি হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে। এসব কথা আগে অতটা মনে হতো না, এখন হয়—তার আব্বা হারুর মৃত্যুর পর।
আজ ফেকু ভীষণ উত্তেজিত। সকাল থেকে তিন বোতল ডাইল মেরেছে। তবু নেশা ধরে না যেন। গত তিন দিন ধরে ভারতের বর্ডার এলাকার ছোট্ট গ্রাম বেহুলা ডাঙ্গায় রেকি করেছে সে। সবাই এখন সতর্ক হয়ে গেছে। চার-পাঁচ বাড়ির গরু ওরা এক জায়গায় রাখে। পালা করে রাতে পাহারা দেয়। তবে এক বাড়ির খবর সে পেয়েছে—বুড়ি একা থাকে। ছেলে কলকাতায় চাকরি করে। দুর্গা পুজোর সময় সে বাড়ি আসে। এছাড়া বুড়ি সারাবছর একাই থাকে। ওর গোয়ালে হৃষ্টপুষ্ট এক গাভী আছে। কদিন আগে বাচুর দিয়েছে। দুধাল গরুর দাম বাজারে বেশি। গত দুরাত ধরে সে ঝোপের আড়ালে বিএসএফের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বর্ডারের তারকাঁটার নিচে গর্ত খুঁড়েছে। সেখান দিয়ে অনাসে সে গরু নিয়ে আসতে পারবে। আঁধারে কেউ টের পাবে না। এভাবেই সে এত দিন গরু চুরি করে আসছে। তার বাপও এভাবে চুরি করতো। তার বাপের একটা কথা সে সবসময় মনে রাখে, বাপধন চুরির আগে দুই দেশেরের অবস্থা সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর লিবি। বর্ডারের হাবভাব বুঝার চেষ্টা করবি। উৎসব-টুৎসব ছুটি-ছাটার দিন হলে বেশি ভালো। বড়সড়ো কোনো চালান-টালানের খবর থাকলে তার আগে পরে চুরি করতে যাবি না। আর বেশি লোভ করবি না। আরেকটা কথা, চুরির সময় মগজের কথা শুনবি মনের কথা শুনবি না। আজ ওই দেশে সরকারি ছুটি। বিএসএফের নজরদারি একটু কম থাকবে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্যাঁচাগুলো যখন বুব বুব, পুব পুব করে ডেকে ওঠে। ফেকু তখন লাঠি আর রাম দা হাতে বেরিয়ে আসে। আম গাছের ডালে বসা প্যাঁচা যুগল চোখ রাঙিয়ে—গুলগুলিয়ে ফেকুকে ভেংচি কাটে। রাতে প্যাঁচা ডাকা ভালো লক্ষণ না। ফেকু জানে, প্যাঁচার ডাক মৃত্যুর বার্তা নিয়ে আসে। বেদনার সুরে কোথায় একটা ডাহুক ডেকে ওঠে। নাহ ভয় কী? প্যাঁচা আর ডাহুক আসলে তার মনের মাঝেই ডাকছে। চুরিতে বেরোনোর আগে ফেকু এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। ভয়-মিশ্রিত আতঙ্ক-মিশ্রিত সেই অনুভুতিকে সে ভালোবাসে। এই ব্যাপারটিই ফেকুকে বারবার চুরি জন্য উসকে দেয়। সফল চুরির পর সে নেশার ঘোর থাকে বেশ কয়েক দিন। সে নেশার আনন্দ বলে বোঝানোর নয়। লুঙ্গির ওপর দিয়ে গরুর দড়িটা শক্ত করে মাজায় বাঁধে ফেকু। রামদাটা মাজায় আটকে রাখে। রাবারের স্যান্ডেলটার এক দিক ছিঁড়ে গেছে। কদিন হলো হাটতে তাই কষ্ট হচ্ছে ওর। গরু বিক্রি করে প্রথমে সে একজোড়া স্যান্ডেল কিনবে। গত একমাস সে বসে খেয়েছে। ধার দেনা হয়েছে কিছু, শোধ করতে হবে। লায়ন সার্কাসের সুরভির জন্য এক বোতল সুগন্ধি তেল আর স্যানাল কোম্পানির আলতা কিনবে। শালী ঘোরাচ্ছে খুব। নাও বলে না—হ্যাঁও বলে না। গত তিন বছর ঝুলিয়ে রেখে ফেকুকে চরকির মতো ঘুরাচ্ছে। বয়স বাড়ছে ফেকুর—সংসার করতে হবে না? ছুঁড়ির কি বয়স কমছে? মন ওতে আঁটকে আছে না তো, এ তল্লাটে বিয়া করার জন্য মেয়ে মানুষের অভাব। তবে হ্যাঁ, সুরভির মতো এমন ছলাকলা রসিকতা জানা মেয়ে আর একটিও দেখেনি ফেকু। ওর সঙ্গে সময় কিভাবে কেটে যায় টেরই পায় না সে। সুরভিকে বউ করে পেলে সংসার জীবন হেঁসে খেলে কেটে যাবে। টেরই পাবে না দুঃখ কাহারে কহে। নাহ! এবার গরু বিক্রির টাকা নিয়ে সে সুরভির কাছে যাবে। লায়ন সার্কাস এখন কানসাটে। সুরভি, আজি চল। তোকে আজি বিহা করব। তোর কোনো মানা হামি শুনব না। আর যদি না কহে, রামদা দিয়ে শালীকে কোপাব। ফেকু রামদা বের করে হাতে নেয়। আম গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্ডারের অপারে বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যাচ্ছে। আলোর বিন্দুগুলো বেশ কাছে, এদিক ওদিক নড়াচড়া করছে। বর্ডারগার্ডরা হাঁটাহাঁটি করছে। ফেকু কালো কাপড় দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে নেয়। মাটিতে শুয়ে সরিসৃপের মতো বুকের ভরে চলা শুরু করে। ভীষণ আস্তে, ধীরে ধীরে এগোই সে। তারকাঁটার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কালো কাপড়টা তারে আঁটকে যায়। ভীষণ বিরক্ত সে। এত সতর্কতার পরও কেন যে এমন হয়। তারকাঁটা পার হয়ে খুব সাবধানে সে কাপড়টা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তারকাঁটার বেড়া সামান্য নড়ে উঠলেও গার্ডরা টের পেতে পারে। নোম্যান্সল্যান্ডে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে জোনাকি। ভারতে কখনো বাংলাদেশের গাছের পাতায় পাতায় বসছে ওরা। ওদের কোনো দেশ নেই। সমস্ত পৃথিবী ওদের আপন—সবাই ওদের আত্মীয়। মশার কামড়ে ফেকুর বেহাল দশা। তবু নড়াচড়া করে না সে। আলোর বিন্দুগুলো যতক্ষণ না স্থির হচ্ছে বা নিভে যাচ্ছে সে একটুও নড়বে না। আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ বাতাসে। এ সময় মশার উপদ্রব খুব বেড়ে যায়। মুকুলের মধু খেতে সব ধরনের কীট-পতঙ্গ ভিড় করে আমের বাগানে। একটা বাদুড় ফড়ফড় করে উড়ে এসে বর্ডারের তারকাঁটায় বসে। বেড়াটার সঙ্গে সঙ্গে ফেকুর কলিজাটা কেঁপে ওঠে। শালা দোষ করবে বাদুড় আর ধরা খাবে সে। ফেকুর সময় যেন এক বিন্দুতে এসে থেমে গেছে—এগুতেই চায় না। এভাবে ঘণ্টাখানেক কাটার পর আলোর বিন্দু দুটো আঁধারে মিশে গেলো। ফেকু সামান্য ঘাবড়ে গেছিল—এত দিনের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায় নাকি! যাক এবার এগোতে পারে সে। খুব সাবধানে এগোয় ।
বুড়ির বাড়ির উঠোনে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফেকু। বয়স্ক মানুষের ঘুম ভীষণ পাতলা হয়। সাবধানে কাজ করতে হবে তাকে। মাটির একটি কুড়ে ঘর। পাশে উদোম গোয়ালঘর। গরুটি বাচুর নিয়ে শুয়ে আছে। চাঁদের আলোয় সাদা বাচুরটা ধবধব করছে। বাচুর সে সঙ্গে নেবে না। এখানেই বেঁধে রেখে যাবে। বাচ্চা নিলে ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো বলে। গরুটার মুখে কাপড় পুরে ঠুসি পরাতে হবে। যেন জোরে চিৎকার দিতে না পারে। গরুটার কাছে ফেকু যেই এগিয়ে গেলো ওটা হাম্বা বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ফেকু কী করবে বুঝে ওঠার আগেই বুড়ি ডেকে ওঠে, কী রে মালতি। ডাকিস কেনে? হারিকেন হাতে বুড়ি বেরিয়ে আসে উঠোনে। এদিকে ফেকুর গরু দড়ি খোলা সারা। এই বুড়ি চুপ করে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আর আগাবি না। ফেকু রামদা বের করে দেখায়।
—বাবা গো, গরুটা নিয়ো না। এটা আমার সন্তানের মতো। মালতির বাচ্চাটা মা হারা হয়ে যাবে। বাবা আমার। বুড়ি প্রায় দৌড়ে এসে গরুর গলা জড়িয়ে ধরে। গলার রশিটাও সে আঁকড়ে ধরে। আমার ঘরে যা আছে নিয়ে যাও।
—তুই ছাড়বি না গলার ওপর দা দিয়ে কোপ দিব? কী বিপদে পড়লো ফেকু। এ বুড়ি একেবারে নাছোড় বান্দা। ভয় ডর কিচ্ছু নাই। রামদা উঁচিয়ে সে ভয় দেখায়।
—না বাবা আমাকে তুমি মেরে ফেল তবু আমার মালতিকে আমি নিয়ে যেতে দিব না। বুড়ি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এ জগৎ সংসারে মালতি ছাড়া হামার আপন কেউ নাই। বেটা থেকেও নাই। মালতিকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছি। বড় আদরে আপন সন্তানের মতো লালন পালন করেছি।
ফেকু আতঙ্কে হিম ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আর একটু দেরি হলে জানাজানি হয়ে যাবে। তাকে আর জীবন্ত দেশে ফিরতে হবে না। হুঙ্কার ছাড়ে সে—ছাড়বি তুই?
—মালতি আমার, মারে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বুড়ি।
এবার ফেকু অস্পষ্ট আলোয় অনুমানের ওপর বুড়িকে লক্ষ করে রামদা দিয়ে কোপ মারে। বুড়ি ছিটকে পড়ে। গরু নিয়ে ফেকু হনহনিয়ে হাঁটা দেয়। আল্লায় জানে বুড়ির কোথায় লেগেছে? বাঁচবে কি মরবে? এছাড়া অন্য কোনো পথ কি খোলা ছিল তার?
দুই.
গরুটা বড়ই বেকুব। গো ধরে কাঁচা মাটিতে পা গেঁথে দাঁড়িয়েছিল। বুড়ির মতো তার গরুটাও গোঁয়ার। বট গাছের মতো থাম মেরেছে। বড় কষ্টে টেনে হিঁচড়ে ওকে ঘরে নিয়েছে ফেকু। ফেকুর দেহে যেন প্রাণ ছিল না। এমন ডর সে আগে পায়নি—যাক বাবা বাঁচা গেলো। অবশেষে নিরাপদে ফিরেছে সে। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস বেরুলো তার। কিন্তু স্বস্তির সঙ্গে এক ধরনের আনন্দ আবেশ প্রতি সফল চুরির পর ফেকুকে আচ্ছন্ন করে। এবার এমনটা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? ফেকু বুঝে উঠতে পারে না।
চুরির পর বেশ কদিন কেটে গেলেও সে একটা প্রশ্ন অস্থিরতা নিয়ে ওর চোখের ছটফট করছে। প্রশ্নটা ভাবনার বুদবুদ পাঁকিয়ে হৃদয়কে ভারী করে চলেছে। অথচ প্রশ্নটা কী, তাও ফেকুর কাছে স্পষ্ট নয়। বুড়ির কিছু কথা তার ঘিলুর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে—এ জগৎ সংসারে মালতি ছাড়া আমার আপন কেউ নাই। মালতি আমার…মারে…এটা আমার সন্তানের মতো। চাঁদের আলোয় আম বাগানের বুকে পড়া তার অস্পষ্ট ছায়াটিকে ফেকুর কেমন বিভৎস মনে হয়। মানুষ তার মতো এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? আজ তার ধূসর অতীতে হারিয় যাওয়া মা-বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। পালক বাবা তার চোখের সামনে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সে কি সারাটা জীবন তার বাবার কাছে নিষ্ঠুরতার শিক্ষা পেয়েছে? সে কি তাকে স্নেহ, বাৎসল্য, প্রেম, ভালোবাসার কোন দীক্ষা দেয়নি? বাবার জীবন তাকে কিছুই শেখাইনি? এ মুহূর্তে ফেকু তার পালক বাবার কিছু কথা বারবার মনে হচ্ছে—বড় আদরে তোকে পেলেছি। আপন সন্তানের মতো বুকে আগলে মানুষ করেছি। সত্যি তো তাই। শত অভাবেও ফেকুকে সে মা-বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। হঠাৎ বুড়ির একটি কথা ফেকুর অনুভবে মরু ঝড়ের মতো ঘূর্ণি তোলে—বড় আদরে আপন সন্তানের মতো লালন পালন করেছি। ফেকু গরুটির দিকে তাকায়। চাঁদের আলোয় ওটার চোখ দুটো ছল্ছল্ করছে। ওদুটো চোখ বড় মানবিক মনে হয় ফেকুর। সে থমকে দাঁড়ায়।
তোর চোখ খুব সুন্দর তো! ফেকু নিজের মধ্যে বলে ওঠে। মুচকি হেসে সে একটা তামাক পাতার বিড়ি ধরায়। অতপর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পুটপুট শব্দে বিড়ি টানে। পাগলার তীরে মড়া পোড়ার মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে বিড়ির আগুন। বুড়ির কথা তার বারবার মনে পড়ে। ভেদু মিয়ার স্টলে গিয়ে বসলে ভেদু বলে, কী রে ফেকু এ ক’দিন তোরে দেখি না।
—শরীরটা ভাল নাই ভেদু ভাই।
—শরীর ক’দিনের? নষ্ট হবেই। তাই বলি ভালো হয়ে যা। পাপ কারও বাপকেও ছাড়ে না।
—দিলা তো মনটা খারাপ করে। আইলাম মনটা ভালো করতে। খারাপ করে ছাড়লা। হনহনিয়ে হাঁটা দেয় ফেকু।
—আরে আরে, কুনঠে যাচ্ছিস? তোর জন্য তো চা বানাচ্ছি।
ফেকু শুনেছে অপরাধ করে গির্জায় গিয়ে মানুষ ফাদারের কাছে অপরাধ স্বীকার করে। মনটা হালকা হয়। কিন্তু সে তো খ্রিস্টান নয়। তার পালক বাবা হারু ছিল মুসলমান। তবে তার জন্মগত ধর্মপরিচয় কী, ফেকু জানে না। ধর্মের ব্যাপারে হারু তাকে কোনো নসিহত করে যায়নি। ফলে সে এ ব্যাপারে একেবারে স্বাধীন। কোন ধর্ম মানবে, কোনটি নয়, সেটা একান্ত তার নিজের সিদ্ধান্ত। সে মনটা হালকা করতে গির্জায় যায়। বর্ডার এলাকার শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা ও দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য তারা কাজ করে। গির্জার পাশের স্কুল থেকে শিশুদের বর্ণমালা পাঠের সমবেত উচ্চারণ ভেসে আসছিল। গির্জার ভেতরে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তির দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ফেকু তাকিয়ে ছিল। ফাদার গোমেজ কখন যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে টেরই পায়নি। কী বাবা, ফেক্কু—ফেকুর ঘাড়ে হাত রাখেন রাখেন।
—আচ্ছা ফাদার যিশুকে ক্রুশে উঠানো হয়েছিল কেন?
—আমাদের পাপের শাস্তি তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ছিলেন।
—তিন ঈশ্বর তার পিতা হয়েও তাকে বাঁচালো না কেন?
—কারণ যিশু আমাদের ভালোবাসেন। যিশুও তোমার মতো পিতৃপরিচয় হীন ছিলেন। তার পিতা স্বয়ং ঈশ্বর।
ফেকুর কাছে ফাদারের কথাগুলো বড় গোলমেলে শক্ত মনে হয়। সে মূর্খ মানুষ এসব তার জন্য নয়। আমি যাই ফাদার।
ফেকু চলে এলে পেছন থেকে ফাদার ডেকে বলে, ফেক্কু তোমার কাছে কোনো প্রশ্ন আছে? তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো।
—ফাদার, আমি পরে আসব।
—শোনো ফেকু, আমাদের সকলের পিতা ঈশ্বর। তিনি জগতের পিতা। এই আত্মায় সবর্দা তিনি জাগ্রত। তাই বলি, মনের কথা শোনো। এ মন তোমাকে পথ দেখাবে।
কাজটা খুব রিস্কের। ঝুঁকি অনেক। ফেকু মনে মনে বলে। সে জানে, পাপের চেয়ে প্রায়শ্চিত্ত অনেক—অনেক কঠিন। তবু সে করবে। তার আত্মা হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। সে তাকে শয়নে স্বপনে বারবার একই কথা বলছে। ফিরে যাও বুড়ি মাকে গরুটা ফেরত দিয়ে এসো। ফেকু গরুটা বুড়ি মাকে ফেরত দেবেই। সে তার হাতের বিড়িটা পায়ের নিচে নিভিয়ে ফেলে। সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে সাথে একটা অজানা প্রশান্তি তাকে শীতল পরশে জড়িয়ে ধরে। ভয়-ডর মুক্ত নির্ভীক হয়ে ওঠে ওর মন। ভালো কাজের মধ্যে যে অন্য রকম অনন্দ আছে আজ সে অনুভব করতে পারছে। বর্ডার পার হয়ে সে ভারতে ঢুকে পড়ে। গরুটা সে বুড়ির বাড়ির আশেপাশের জঙ্গলে ছেড়ে দেবে। নিশ্চয় গরুটা পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারবে। কিন্তু কিছু দূর এগোনোর পর সে একটা গুলির শব্দ শুনতে পেলো। কানের পাশ দিয়ে ভীষণ গতির ধারালো বাতাস বয়ে যায়। আরেক রাউন্ড গুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা গুলি ওর হৃদপিণ্ড ভেদ করে হাওয়ায় উড়ে যায় ঠিক জোনাকিদের মতো।