এক.
একটানা পাঁচ দিন বৃষ্টির পরে ঝড়ের প্রস্তুতি চলছে বাইরে। যদিও এখন বসন্তকাল। ঋতুর এমন বিরূপ আচরণে গ্রামের প্রায় সব খেটে খাওয়া মানুষের মুখে সন্ধ্যার কালো ছায়া নেমে এসেছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারও পেঁয়াজের জমিতে হাঁটু পানি, কারও বাঙ্গি ক্ষেত পানিতে ভাসছে। কাঁচা হলুদরঙা গম ক্ষেত মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। পাঁচদিন ধরে নামছে এই বৃষ্টি। একটু থামে, যেন ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। এরপর দ্বিগুণ গতিতে শুরু হয় আবার।
পাটকাঠির বেড়ায় বাঁশের দোড়ের নিচে দুই ইঞ্চির মতো ফাঁকা। উইপোকার ভয়ে মাটি থেকে একটু দূরত্বে রাখা হয়েছে পাটকাঠির বেড়াকে। সেই ফাঁক গলে কেঁচো উঠে আসছে ঘরে। ছোট, বড়, চিকন, মোটা; সবরকমের কেঁচো দল বেঁধে যেন ফুলবানুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে আসছে। ফুলবানু দরজার পাশে পাটের বস্তার ওপর বসে আছে সতর্ক হয়ে। হাতে ধরে আছে পুরনো ঝাড়ুটা। কেঁচোগুলো একটু এগোতেই ঝাড়ুর মাথা দিয়ে গতিপথ বদলে দিচ্ছে সে। মাটির ঘর ভিজে উঠেছে, জায়গায় জায়গায় গর্ত করে কেঁচো বেরিয়ে আসছে। গতবছর লিয়াকত মেম্বারের দেওয়া পুরনো ছেঁড়া কাঁথা, বস্তা যা ছিল, ঘরে মেঝেতে পেতে দিয়েছে সে।
ঘরভর্তি কেঁচো হাঁটাচলা করলে বমি আসতে চায় তার। সারামনি, সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বই বের করে দরজা থেকে একটু দূরে বসে আছে। ঠিক বসে আছে, তা নয়; বাংলা বইয়ের একটি ছবি বের করে দেখছে আর মনোযোগ দিয়ে তাই আঁকার চেষ্টা করছে খাতায়। মেয়েটার আঁকার হাত খুব ভালো, স্কুলের সবাই বলে। সেবার একটা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে শহরে গিয়েছিল, পুরস্কারও নিয়ে এসেছিল। ফুলবানু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একা একাই যে কী করে শিখলো ছবি আঁকা, বুঝে উঠতে পারে না সে। মেয়েটা বড় হচ্ছে, একটু ভালো খাবার-পোশাক কিছুই দিতে পারে না মেয়েকে!
ছেলেটা বাপের পাশে ঘুমাচ্ছে। দুই বছরের ছেলেটা কবে বড় হবে, আর কতদিনেই তার দুঃখ দূর হবে! ফুলবানুর কথা বলার মানুষ বলতে একজনই আছে, মেয়ে সারামনি। আর সারার বন্ধু বলতে তার মা। স্কুলে কোনো বন্ধু নেই, তেমন কেউ মিশতেও চায় না ওর সঙ্গে। আর সারাও কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না। পড়াশোনায় ভালো বলে শিক্ষকরা ওকে খুব ভালোবাসে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পেরে নতুন জীবন পেয়েছে যেন ফুলবানু। না হলে মানসিক প্রতিবন্ধী স্বামীর সঙ্গে কী কথা বলবে সে!
—মা, ও মা, সামনে স্কুলে একটা কম্পিটিশন আছে, এক প্যাকেট রঙ-পেন্সিল কিনে দিবা মা?
—কইছিলাম তো মা তোরে এইবার রঙ করবার পেন্সিল কিইনা দেবো। তা দেওয়া যে হারে নামতেছে, কামে যাবার পারতেছি না চাইর-পাঁচ দিন। ঘরের নুন, ত্যাল ও প্রায় শ্যাষ। সুলাইমানের কাশের ওষুধও ফুরাইয়া গেছে কাইল। কী যে অবে ভাইবা পাইতেছি না রে মা।
সারামনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা মা, কয়দিন পরে কিইনা দিও, অহনি লাগবে না। ফুলবানু ধরে আসা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে। আজ দুবছর হয়ে গেলো মেয়ে তার এক প্যাকেট রঙ-পেন্সিলের আবদার করে আসছে। অপারগ মা সে, পারেনি আজও মেয়ের শখ পূরণ করতে। খুব অভিমান হয়, নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে থাকে। কষ্টের জীবন কি তার কখনোই শেষ হবে না? সেই ছোট বেলা থেকে যন্ত্রণার শুরু। সে মনে মনে ভাবে—কোনোদিন কি একটু সুখের মুখ দেখতে পারবো না আমি?
দুই.
আজ তার ভেতরের সব কষ্ট চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চারপাশের মেয়েগুলো কি সুখী সুখী চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়! ফুলবানুর সামনে এসেই যেন ইচ্ছে করে ভালো থাকার গল্প, স্বামীর সোহাগের গল্প শোনাতে থাকে বেশি বেশি করে। গা-টা জ্বলে যায় ফুলবানুর। কারও চেয়ে চেহারা, গা-গতরে কোনো অংশেই কম নয় ফুলবানু। এক পাপিষ্ঠের বিষ দাঁতের কমড়ে আজ তার এমন জীবন ভোগ করতে হচ্ছে। কেঁপে ওঠে ফুলবানু আজ এত বছর পরেও, সেদিনের কথা মনে করে।
ফুলবানু তখন শুধু ফুল। ধবধবে ফর্সা, পাতলা গড়ন ছিল তার। লাল ফ্রকটা পরেই কাটিয়ে দিতে চাইতো সারাবেলা। বাড়ির ঠিক পেছনে খালের পাশে ছোট একটা দোকান ছিল বাবার। পান, বিড়ি, সিগারেট, গুল, দুই টাকা আর চার টাকা দামের বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি, কেরোসিন, চরকি—আরও কতকিছু যে থাকতো বাবার দোকানে! চায়ের পানি একটা কেটলিতে ফুটতেই থাকতো সবসময়। বাবার হাঁপানির রোগটা বাড়াবাড়ি হলে স্কুল কামাই করে ফুল দোকানে বসতো সেদিন। সারক্ষণ লোকজন আসতে থাকতো দোকানে। দোকানের সামনে জগভর্তি পানি আর গ্লাস বাবার কথামতো রেখে দিতো ফুল। জমির কাজ সেরে ফেরার সময় কৃষকরা দুই চার টাকা দামের বিস্কুট আর টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খেয়ে, দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে জিরিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতো।
বাবা রফিক মিয়া সারাবছর একটা সাদা রঙের ফুলতোলা কাঁথা মুড়ি দিয়ে আধ শোয়া হয়ে থাকতো। ফুল যখন দোকান চালাতো, রফিক মিয়া তখন জিনিসপত্রের দাম জিজ্ঞাসা করে মেয়েকে পরীক্ষা করে নিতো। কোনোটার দাম ভুলে গেলে সস্নেহে বলে দিতো। ফুলের খুব ভালো লাগতো বাবার কাছে পরীক্ষা দিতে। এ যেন দারুণ কোনো খেলা, জয়ী হয়ে গর্বে বুক ফুলে উঠতো তার।
—বড় হয়ে গেছি বাবা আমি, তোমার আর কোনো কষ্ট নেই। বাবাকে বুঝিয়ে দিতো হাবভাবে সে। এলাকার মাতবর চাচা রফিকের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে দরবার সালিশ করতো, বেচাকেনাও সেদিন খুব ভালো হতো। কেটলির পর কেটলি চা চলতো, সমান তালে চলতো পান-বিড়িও। মাতবর চাচাকে খুব কদর করতো ফুলের বাবা, শ্রদ্ধা করতো ফুলও৷
সেদিনও এমনি ঝড় বাদল ছিল, টানা তিন চারদিন ধরে শুধু বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া ছিল। দোকানে বৃষ্টির ছাঁট লাগার ভয়ে ঝাঁপিটা নামিয়ে দিয়েছিল রফিক মিয়া। মাতবর চাচা কোথা থেকে ভিজতে ভিজতে এসে হাজির হয়েছিল ঝড়-বাদল মাথায় করে। রফিক মিয়ার হাঁপানি রোগটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছিল সেদিন। রোগা লম্বা শরীরের বুকের পাঁজরের হাড়গুলোর ওঠানামা দেখা যাচ্ছিল শুধু। কালো তাগিতে নানা আকৃতির তাবিজ সেই পাঁজরের হাড়গুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠানামা করছিল। মাতবর চাচাকে গামছা এগিয়ে দিয়ে বাবার মাথার কাছে এসে বসেছিল ফুল। বাবা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ফুল দোকানের ঝাঁপিটা তুলে দিতে যায়, পেরে ওঠে না শক্তিতে। দোকানের পেছনে চার পাঁচ হাতের ছোট কামরা। সেখানেই তাসের আসর বসে প্রতিদিন। এখানে টাকা জমা দিয়ে তাস খেলতে দেখেছে ফুল সবাইকে, চা-বিড়ি দিতে গিয়ে। লোকে বলে জুয়া খেলা। ফুল বোঝে না তাস খেলাকে মানুষ কেন জুয়া খেলা বলে! সেই তাস খেলার জায়গায় শুয়ে পড়েছিল মাতবর চাচা। ফুলকে ডেকে বলেছিল—মা, বুকের ব্যথাটা বেড়েছে, একটু সরিষার তেল মালিশ করে দিবি?
বড্ড কষ্ট হচ্ছেরে মা। ফুল মনের আনন্দে মাতবর চাচার বুকে তেল মালিশ করতে গিয়েছিল সেদিন। ফুলের সামনে হঠাৎ করে ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকার দিনে মাতবর চাচার মুখটা পাল্টে যেতে থাকে। মাতবর চাচার মুখের কাছে কুকুরের মতো একটা কিছু দেখতে পায় ফুল। মহি দাদার বউকে যে কুকুরটা কামড়ে জলাতঙ্ক করে দিয়েছিল। ফুল দেখেছিল, মহি দাদার বউ মরে আকাশের তারা হয়ে যাওয়ার আগে কুকুরের মতো সব আচরণ করত। আজ মাতবর চাচার মুখের জায়গায় সেই কুকুরটা!
ধারলো চিকন সুঁচের মতো দাঁতদুটো ফুটিয়ে দিয়েছিল সদ্য অস্তিত্ব জানান দেওয়া বুক দুটোতে। ছিঁড়ে ফেলেছিল পবিত্র নামের শব্দটিকে। কলঙ্কের রক্তে ঢেকে গেছিল ফুলের মুখ। সমাজের লোকেরা অপবিত্র নাম দিয়েছিল ফুলের! বিশ হাজার টাকার একটা চকচকে বান্ডিলের জোরে পরদিন থেকে সেই রক্তেভেজা খেজুর পাটির ওপর বসেছিল রোজকার তাসের আসর।
তিন.
—মা, ও মা, ছবিটা দেহনা একটু! কেমন আঁকছি!
ফুলবানু মেয়ের ডাকে ফিরে আসে পাটকাঠির বেড়ায় ঘেরা বাস্তবতায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে। মেয়েটা সত্যিই বড় ভালো আঁকে। ফারিয়া ম্যাডাম ওর আঁকা শেখানোর ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছেন। সত্যিই মানুষটা এত ভালো। অথচ তারে নিয়েও এলাকায় কত রকম রঙ-বেরঙের কথা হয়!
মানুষ যে কত কথা শোনাতে পারে, মানুষের মুখে যে কত বিষ, তা কি আর ফুলবানু জানে না? মাতবর চাচা যেদিন এই বুদ্ধিহীন মানুষটার সঙ্গে বিয়ের সকল খরচ বহন করেছিল, তার পরের দিন থেকেই শুনতে হয়েছে কত রকমের ইঙ্গিত। প্রথম দিকে ফুলবানুকে কেউ সরাসরি কিছু বলতো না, বলতো বাবলুকে। গ্রামে পরিচিত বলদা বাবলু নামে। ফুলবানুকে সামনে রেখেই এক একজন বলতো, কী রে বাবলু! তোর তো দেহি ফাডা কপাল! কী সুন্দর বউ তোর! আমার কপালটা দেখ, পুইড়া অঙ্গার হয়া গেছে। যেমন বউয়ের তামার চামড়া, তেমন চোপা! আমাগো ভাগ দিস তোর বউয়ের। ভাত খাওয়ার টাহা দিমুনে, বড় মাছ দিয়া ভাত খাবি, অসুবিধা নাই তো কিছু।
বলেই হাসতে শুরু করতো, নোংরা হাসি। হাসতে হাসতে মুখ দিয়ে থুথু ছিটতো। ফুলবানুর গায়ে কাটা দিতো, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতো। মনে হতো কুকুরগুলোর জিভ দিয়ে বুঝি এই লালা ঝরে পড়বে।সবার অলক্ষে পাথরের মূর্তি হয়ে উঠতো ফুলবান। স্বামীটা তার এতই বোকা যে, ভালোবাসার মুহূর্তগুলোর কথাও কেউ জানতে চাইলেই গড়গড় করে বলে দিতো, ঘর থেকে বেরুতে পারতো না ফুলবানু মানুষের হাসি তামাশার ভয়ে। কতদিন যে গলায় রশি দিতে গেছে, পারেনি। জীবনের মায়া বড় মায়া, বেঁচে থাকার লোভ সামলানো যে বড় কঠিন!
বিয়ের কয়েক মাসের মাথায়, সেদিন ঘর লেপছিল ফুলবানু। গায়ের কাপড় সরে গিয়ে কোমর উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফুলবানুর মামা শ্বশুর কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর।
—বাবলু কি এত সুন্দর বুনো ফুলের সুবাস একাই নেবে? আমরা কি ছিটেফোঁটাও পাবো না? বাগানে ফুল ফুটলেতো সবাই পায়, তাই না?
ফুলবানু এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়েছিল। ধাক্কা খেয়ে মামা শ্বশুর যেন আরও মরিয়া হয়ে উঠেছিল ফুলকে পেতে—আরে বাবলুতো একটা বলদ, ও কিছু বুঝতেই পারবে না। তোমার কোনো অভাব থাকবে না ফুলকুমারী। এমন আগুনের মতো রূপ এই সস্তা ছেঁড়া কাপড়ে কি আড়াল করা যায়?
মাইয়া মানুষ আবার স্বামী তালাক দেয়? কী গুনাহর কাম জানোস? চাকরির অহঙ্কারে মাটিতে পাও পড়ে না, উইড়া উইড়া হাঁটে। বিয়ার কতা নিয়া কেউ কাছেও ঘেঁষপার পারে না, খাই খাই হইরা ধরে। হাদিস কোরান না মইন্যা চললি আল্লাহ নারাজ অয়, হেইয়াও বোঝে না।
চোখের সামনে আবার সেই মহি দাদার বউকে কামড়ানো কুকুরটাকে দেখতে পায় ফুলবানু৷ এবার আর সেই কুকুরটাকে ভয় পায় না সে, কুকুরের মতো হিংস্রভাবেই কুকুরের গায়ে কামড় বসিয়ে দেয় ফুলবানু৷ কামড় খেয়ে ফুলবানুর কোমর ছেড়ে গোঁৎ গোঁৎ করতে করতে পালিয়ে যায় বুড়া ছোলা কুকুরটা। যাওয়ার আগে সে বলে, জানি না ভাবছ? মাতবর কবেই নষ্ট কইরা থুইচে, তার আবার সতী সতী ভাব! নষ্ট মেয়ে মাইনষের ভাব দেখলি পিত্তি জ্বইলে যায়, থিয়েটার করো গিয়া, ভালো মানাইবো তুমারে।
ফুলবানু বুঝতে পারে এ শরীরটাই তার সমস্যা। শরীরটাকে অসহ্য মনে হয় তার, নিজের শরীরকে নিজেই ঘেন্না করতে শুরু করে। কেন তার সঙ্গেই এমন হয়? এখানেই শেষ নয়, থেমে থাকেনি মানুষ। যখন তার প্রথম সন্তান, সারামনির জন্ম হলো, লোকে বাবলুকে দেখলেই বলতো, ‘অ্যারে বাবলু, তুই বলদা বইলা তোর বউ তোরে এমনে ঠগাইলো? এই মাইয়্যা তো তোর নারে! দেহস না কি মেমের মতো সোন্দর অইছে। কার মাইয়ারে তুই নিজের বইলা ভাত দিয়া পালবি?
বোকা বাবলু অমনি বাড়ি এসে ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র আছড়াতে থাকতো। ফুলবানু থামাতে গেলেই ইচ্ছেমতো পেটাতো। কখনো কখনো ফুলবানুর কোল থেকে মেয়েকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে চাইতো। বোকা হলেও বউকে পেটানোর কথা কিন্তু শিখিয়ে দিতে হয়নি তাকে। মেয়েটাকে যেদিন স্কুলে ভর্তি করা হলো, সেদিন থেকে শুরু হলো আরেক অশান্তি! ক্লাসের বাচ্চারা সারক্ষণ সারামনিকে ক্ষেপাতে শুরু করলো।
—ও, সারামনি তোর বাপের নাম কী?
—বাবলু শেখ।
—হা হা হা! কী কস এইগুলান, বাপের নাম জানোস না? তোর বাপের নাম তো বলদা বাবলু!
মেয়ে স্কুল থেকে ফিরা কান্নায় ভেঙে পড়তো। স্কুলে যেতে চাইতো না কিছুতেই। জোর করে পাঠিয়েছিল ফুল একদিন, গ্রামের বাচ্চারা এসে খবর দেয় তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে স্কুলে। হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে গিয়েছিল সেদিন। তার মেয়েকে লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে, ঘিরে আছে অনেক বাচ্চা। ফুলবানু লাইব্রেরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন ছাত্র চিৎকার দিয়ে ওঠে—আপনার মাইয়া আমাগো ক্লাসের মহিবুলরে রক্ত বাইর কইরা দিছে।
ফুলবানুর বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। কী করেছে তার মেয়ে। শান্তশিষ্ট মেয়েটা তার এমন কাজ করতে পারে! মহিবুলের বাবা উত্তরপাড়ার পয়সাওয়ালা লোক, তার ছেলেকে কলমের খোঁচার রক্ত বের করে দেওয়া! কী যে হবে আল্লাহই জানে। প্রধান শিক্ষক বললেন, আপনার মেয়ের নামে হাজারো নালিশ, ও সবাইকে মারে। এমন হল তো ওকে স্কুলে রাখা সম্ভব নয়।
—স্যার, আমার মাইয়াডাতো ঠাণ্ডা! ওরে কেউ চেতায়ছে নাইলে…
ধমক দিয়ে ফুলবানুর কথা বন্ধ করে দেয় মহিবুলের বাবা—চেতায়ছে মানে? চোরের মার বড় গলা। মাইয়ারে ভালো বানা, মাইয়ার হইয়া সাফাই গাইস না। তোগো মারলে তো হাতের জাইত যাইবো, তাই মারলাম না। মাইয়ারে ভালো বানা, নাইলে এই স্কুলের বারান্দায় যেন না দেখি তোর মাইয়ারে। পড়াবি তো এক দুই ক্লাস। না পড়লেই বা কী! কাম কাইজ শিখা বাড়ি রাইখা।
সেদিন মেয়েকে হাজার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পায়নি ফুল—কেন মহিবুলকে কলমের খোঁচায় রক্তাক্ত করেছিল! চরকান্দার ইদ্রিসের ছেলে এসে জানিয়েছিল সত্যিটা।
—মহিবুল ওরে খালি চেতায়, বাপের নাম ধইরা ভ্যাঙ্গায়। কাইল মহিবুলগো বাড়ির কয়জন মিইল্যা ওর জামা ধইরা টানাটানি করে আর ওর বাপরে নিয়া হাসাহাসি করে। হেইজন্যি তো সারামনি ক্ষেইপ্যা গেছিল। ক্ষেপবো না কেন, আমার বাপরে নিয়া কইলে আমি তো ওর নাক ফাটাইয়া দিতাম!
এরপরে মেয়েকে বাড়ির পাশে ব্র্যাক স্কুলে পাঠায় ফুল। সমাপনীতে ভালো ফল করে এখন হাই স্কুলে পড়ছে। ও কারও সঙ্গে মেশেনা, নেই ওর কোনো ভালো বন্ধু! সব গল্প জমা রাখে মায়ের জন্য। ছোট্ট বেলার ঘটনাটা সারামনি এভাবে মনে রাখবে ভাবেনি ফুলবানু।
মানুষ আদতে কতটা মানুষ? তা পৃথিবীতে মস্ত বড় একটা ধাঁধা ফুলবানুর কাছে। ফারিয়া ম্যাডাম অথবা ফুলবানু—সমাজের মানুষ মেয়েদের জন্য সবসময় যেন জিভে শান দিতে থাকে।
—ফুলবানু, মাইয়্যাডারে কামে দেসনা কিসের জন্যি? কতবার কইলাম তোরে আমার ভাগনি ঢাকা থাকে, কত্ত বড় ফ্লাটবাসা তার। বেশি কোনো কাম করা লাগবো না। ভাগনির মাইয়্যাডারে নিয়া সারাদিন খেলবো।
—তুমারে তো আমি কইছি খালা, আমি কামের মানুষ অইছি, মাইয়্যারে আমার লাহান অইতে দিবার চাই না। ওরে আমি পড়াবার চাই। এই কতা ক্যান বারবার কইতে থাকো?
—ভালোর জন্যি কই। গরিব মাইনষের বড়লোকের ভাব ধরলি হয়? মাইয়্যারে তো আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাবার পারবি না। দুই-এক কিলাস পড়াইয়াই বিয়া দেওন লাগবো। ২ হাজার টেকা নগদ দিতে চাইছিল। তেল,সাবান, জামা, কাপড় সব তাগো দায়িত্ব। ভাইব্বা দেখ আরেকবার।
—আমার ভাবাভাবি শ্যাষ। ওরে আমি কামে দিমু না। ফারিয়া ম্যাডামে কইছে, আমার সারামনির মাতা খুব ভালো। উনি আমারে সব রকম সাহায্য করতি চাইছে। আমি ওরে না পাইরলেও ম্যাট্টিক পর্যন্ত পড়াবো। নিজেতো পারলাম না!
ফারিয়া ম্যাডামের কথা শুনে জ্বলে উঠলো কুলসুম। মুখে বিষ উঠে গেছে যেন! তীব্র ঘৃণা নিয়ে বলতে শুরু করলো—থাম, থাম। ফারিয়া মাস্টারের কতা কইস না আর। বেশি লেখাপড়া শিখলি ওমনই হয়। হাদিস কোরানের ধার ধারে না। মাইয়া মানুষ আবার স্বামী তালাক দেয়? কী গুনাহর কাম জানোস? চাকরির অহঙ্কারে মাটিতে পাও পড়ে না, উইড়া উইড়া হাঁটে। বিয়ার কতা নিয়া কেউ কাছেও ঘেঁষপার পারে না, খাই খাই হইরা ধরে। হাদিস কোরান না মইন্যা চললি আল্লাহ নারাজ অয়, হেইয়াও বোঝে না।
—থামো তুমি। ধমক দিয়ে ওঠে ফুলবানু। বলে, পশু, জানোয়ার অইলি, ওমুন স্বামী সংসার না করাই ভালো। একলা থাহা অনেক শান্তির।
—মাইয়াডারে ওই মাস্টারের কাছে পড়াইয়া নষ্ট বানাইস না রে ফুলবানু। যা কই হোন। ২ হাজার টাহা নগদ। তেল-সাবান-খাওয়া।
চার.
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ফুলবানু আর কুলসুম। লাইন কমে এলে ফুলবানুর ডাক পড়ে। কার্ড জমা দিয়ে চাল আনতে রহিম দফাদারের কাছে এগিয়ে যায় ফুলবানু। ২০ কেজি চালের বস্তা কোমরে তুলে দিতে গিয়ে ইচ্ছে করেই বাপের বয়সী দফাদারের হাত ছুঁয়ে যায় ফুলবানুর স্তন। হঠাৎ করে এমন ঘটনায় অপ্রস্তুত হয় ফুলবানু, চমকে ওঠে, কথা বলতে পারে না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে চাল নেওয়ার লম্বা লাইনজুড়ে চিৎকার। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকায় দফাদার কাকার দিকে, নোংরা ইঙ্গিত আর কুৎসিত হাসি সেখানে। এই ইউনিয়ন পরিষদে দাঁড়িয়ে ফুলবানুর বোকা স্বামীটার জন্য গর্ব হয়, মায়া লাগে খুব। যে বুদ্ধি থেকেও মানুষ কুকুর হয়ে যায় সময়ে সময়ে, মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াতে হয়, সে বুদ্ধি না থাকাই ভালো। কুকুর থেকে বোকার সংসার করা অনেক সম্মানের। মনটা হঠাৎ করেই হালকা হয়ে যায় ফুলবানুর। চালের বস্তাটা কোমরে তুলে বাড়ির পথ ধরে সে।