লোকটাকে মাছি তাড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে কে তা জানি না। কিন্তু তাকে আমরা দেখতে পেলাম একটা ভাঙা কাঁঠালের সামনে বসে থাকতে। কাঁঠাল থেকে মো মো গন্ধ ছুটছে। গন্ধ ছুটে দূরে চলে যাচ্ছে। আর মাছি আসছে প্রচুর। নীল নীল মাছি। গন্ধ আর মাছির অনুপাত ভাবনার ভেতর আসার পর অন্য চিন্তাও মাথার ভেতর এলো। আচ্ছা গন্ধগুলো দূরে গিয়ে ঝোপের আড়ালে গিয়ে দেহ পরিবর্তন করে, পোশাক পরিবর্তন করে কি মাছি হয়ে ফিরে আসছে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম একটা লোক একরকম হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আর বাড়ি থেকে অন্য পোশাকে, দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে একেবারে ভিন্নরূপে বের হয়ে যাদের সামনে দিয়ে ঢুকেছিল তাদের সামনে দিয়েই বের হয়ে গেলো কেউ তাকে চিনতেই পারল না এমন। ওই গন্ধগুলোও তেমনই। কাঁঠালের গন্ধ কাঁঠালের ভেতর থেকে বেরিয়ে পাশের ঝোপগুলোর আড়ালে গিলে নীল নীল মাছি হয়ে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে কাঁঠালের কাছে। নইলে এতক্ষণ মাছিগুলো ছিল কোথায়? হঠাৎ করে কোথা থেকে বের হয়ে এলো। সুতরাং কাঁঠালের গন্ধ কাঁঠালের ভেতর থেকে বের হচ্ছে, কাঁঠালের গন্ধগুলো মাছি হচ্ছে আর মাছি হওয়া কাঁঠালের গন্ধ এসে কাঁঠালের উপর বসছে আর কাঁঠাল খাচ্ছে। গন্ধ, মাছি, কাঁঠাল। মানে চক্রটা হলো কাঠালের ভেতর থেকে কাঁঠাল বের হচ্ছে, সে বের হওয়া কাঁঠাল আবার কাঁঠাল খাচ্ছে। কাঁঠালের এই একবার গন্ধে রূপান্তর তারপর, গন্ধের আবার মাছিতে রূপান্তর আবার সেই মাছির কাঁঠালের কোয়ায় বসে কোয়া খাওয়া ব্যাপারটার সাথে বেশ জমে গেলাম আমরা। নাহ্ এটা আরও বহুক্ষণ দেখা যেতে পারে। মানে দেখবো।
বিশাল কাঁঠাল। লোকটাকে দেখলাম মাছি তাড়াচ্ছে আর এদিক-ওদিক দেখছে। একসময় দেখা গেলো, মাছি তাড়াতে তাড়াতে নিজেই মাছি হয়ে গেছে আর বসে আছে কাঁঠালের ওপর। এবার আরও একটা লোক এলো আর মাছি তাড়িয়ে বসে গেলো নিজে। সেও মাছি তাড়াতে তাড়াতে নিজেই মাছি হয়ে গেলো আর কাঁঠাল খেতে শুরু করলো। অদ্ভুত ব্যাপার। এভাবে চলতেই আছে ব্যাপারটা। কিছুক্ষণ পরই আমরা আলা চোরকে দেখলাম। ততক্ষণে কাঁঠালঘটনা দেখার ইচ্ছে উবে গেছে। আমরা কাঁঠালের ওখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পেছন ফিরে একবার দেখলাম, দেখতে পেলাম আমরা দেখি বা না দেখি কাঁঠাল ঘটনা ঘটমান আছে, চলমান আছে। আমরা একেবারে সেখানে যদি চলে যায় যেখানে আর কাঁঠালের গন্ধও পাব না, তবু, তখনো কাঁঠাল ঘটনা ঘটবে। আমরা আলা চোরের হাঁটা দেখতে দেখতে কবরের ফালাটি ঠেলে ভেতরে ঢুকে যাবো তখন আর কিছু দেখতে পাবো না। তবু সবই চলবে।
বউটা বলে—তুমি চুরি করা বাদ দাও। অন্য কিছু কর। আলা চোর বলে—দুনিয়ায় সবাই চোররে বউ। চোর ছাড়া নেই। আমি ছোট চোর বলেই এত নাজেহাল হতে হয়।
থালা নাকি খাদ্যের পোশাক আর খাবারগুলো পেটের পোশাক। একথা বলে মজি দফাদার আলা চোরকে ধরে আনতে ঢুকে যায় তার বাড়ি। আলা চোর তার পেটের ভেতর লুকিয়ে বসে আছে মজি দফাদারের আসার টের পেয়ে। আলা চোরের বউ ফুলন। কাঁথা সেলাই করছে। আর কী সুন্দর তার চোখ, তার হাতের আঙুল। সুচের সুতো শেষ হয়ে গেছে। নতুন সুতো পরাতে হবে সূচে। ফুলন সুতোর মাথা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে থুথুতে ভিজিয়ে সুতোর ন্যাতানো মাথা খাড়া করে। এভাবে খাড়া না করলে সূচের ফুটোয় সুতো ঢোকানো যায় না। ফুলনের সামনে আলাচোরের পেট পড়ে আছে। আলাচোর ওই পেটের ভেতর মজি দফাদারের ভয়ে লুকিয়ে বসে আছে। ফুলন যখন সুতোর মাথা সুচের ভেতর ঢোকাতে যাচ্ছিল এসময় মজি দফাদার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।
গতরাতে লছমনপুরের মিয়াদের কাঁসার থালা চুরি হয়েছে। সেটা আলা চোর চুরি করেছে বলে সন্দেহ করেছে তারা। তারাই পরিষদে এসে অভিযোগ দিয়েছে। সেই জন্যেই মজি দফাদারকে পাঠিয়েছে চেয়ারম্যান মেম্বাররা ধরে আনার জন্য। মিয়াদের অভিযোগ খতিয়ে না দেখলে সমস্যা আছে। তারা ক্ষমতাবান। অন্য ক্ষমতারাও তাদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ালের মত। ক্ষমতা একটা চমৎকার জিনিস। জলের মতো একবার একেবারে একেবারে হালকা, উড়ে বেড়ায় ঘুরে বেড়ায়। একবার তরল, যেখানে রাখবে তারই মতো, চারকোনা পাত্রে রাখলে চারকোনা, গোল পাত্রে রাখলে গোল, বালিতে রাখলে একেবারে শুষে নেবে। একবার কঠিন, পাথরের মতো ঠিকমত মাথায় মারতে পারলে মাথা ফেটে মরেও যেতে পারে। যেমন পুলিশ প্রশাসনের ক্ষমতা। মিয়াদের কাছে ওটা বিড়াল আর যার জমি দখল করে নিল তার কাছেই বাঘ। মিয়ারা জলিলের যখন জমি দখল করে নিয়েছিল তখন জলিল গেছিল থানা। থানা থেকে বের হওয়ার সময় দেখে তার পেছনের এক খাবলা মাংস নেই। থানার ক্ষমতা বাঘ বা শেয়াল হয়ে তার পাছার মাংস খুবলে ছিঁড়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে জলিলও কবরের ফালাটি ঠেলে বের হয়ে আসে। কাঠাল ঘটনা দেখে। মাছি ঘটনা দেখে।
মিয়াদের বিঘার বিঘা জমি। পাইক পেয়াদা। গুণ্ডা মাস্তান রয়েছে। শুধু জলিল নয় কতজনের জমি যে তারা জাল করে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য তারা ভালোও বটে। চেয়ারম্যান তাদের ওপর খুশি। মিয়ারা তাকে সাপোর্ট না দিলে তার চেয়ারম্যান হওয়া হতো না। ইউনিয়নের সবচে বড় মসজিদটাই তাদের মাটিতে তাদের টাকাতে গড়ে উঠেছে, সাধারণ মানুষ আর কটাকা দান করেছে। সব স্কুল কলেজগুলোয় তারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয়। তাই চেয়ারম্যান দেরি করেনি।
রাতকে দিন মনে করা মানুষ আছে। তারা জোর করে রাতকে দিন মনে করে। দিনকে রাত মনে করা মানুষও আছে। তারা জোর করে দিনকে রাত মনে করে। কিন্তু আলা চোর এতটা গোয়ার না। সে রাতকে রাত মনে করে আর চুরি করতে বেরোয় আর দিনকে দিন মনে করে আর ঘুমায়। কিন্তু মাঝে মাঝে তার সঙ্গে সূর্যটাই গোয়ার্তুমি করে। জোর করে রাতের বেলায় উঠে পড়ে। এরকম একদিন হয়েছিল। সন্ধ্যা হতেই সূর্যটা জোর করে আবার উঠে পড়লো। তখন সে কেবল ঢুকেছিল এক গেরস্থের বাড়ি। ফলে ধরা পড়ে যায়। আবার একদিন এমন হয়েছিল ভোর হতেই দারুণ নিকষ সন্ধ্যা লেগে গেলো আর সে তার বউকে আদরে আদরে ভরে দিলো। প্রচুর আদর। তারপর চুরি করতে বের হয়েছিল। চুরি করে আসার পর সে তার বউয়ের কাছে গল্প করে। গল্প করতে করতে হাসে। যেদিন মার খেয়ে ফেরে সেদিন মুখ আন্ধার হয়ে থাকে। বউটা বলে—তুমি চুরি করা বাদ দাও। অন্য কিছু কর। আলা চোর বলে—দুনিয়ায় সবাই চোররে বউ। চোর ছাড়া নেই। আমি ছোট চোর বলেই এত নাজেহাল হতে হয়।
মজি দফাদার আলা চোরের বউকে বলে—তোর চোর কোথায় গেলো রে ফুলন পেট রেখে দিয়ে। ফুলন বলে—সে তার পেটের ভেতর লুকিয়ে পড়েছে দফাদার। দফাদার বলে, থাক সে পেটের ভেতর লুকিয়ে। তুই আয়, তোকেই ধরি। তোর কাছে চোর হওয়া শিখি। দফাদার ফুলনের হাত ধরে টান দেয়। হাত নিয়ে খেলা করে। আলা চোর তার পেটের ভেতর লুকিয়ে বসে আছে। দফাদারের শ্বাস ঘন হয়ে আসে। ফুলন কিছু বলে না। দফাদার ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলতে থাকে, ফুলন আমারে চোর হওয়া শেখা। সে তার মুখে হাত দেয়, ঠোঁটে হাত দেয়, বুকে হাত দেয়। ফুলন কিছু বলে না।
এত চোরের সে জন্ম দেবে কী? গর্ভকাল প্রায় পুরে এসেছে। সে মনে মনে তার মৃত্যু কামনা করে চোখ বুঁজলো। সে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।
আলাচোর প্রতিদিন নিজের পেট বানান শিখতে, বউয়ের পেট বানান শিখতে বেরিয়ে যায়। মজি দফাদার রোজ রাতে চোর হওয়া শেখে ফুলনের কাছে। ফুলন তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মজি দফাদারকে কিছু বলতে পারে না।
চেয়ারম্যানের কানের ভেতর ছারপোকা ঢুকলে সে মজি দফাদারকে ডেকে পাঠায়। মজি দফাদার এলে তাকে জিজ্ঞাসা করে মিয়াদের কাঁসার থালা উদ্ধার হলো কিনা। আলা চোরকে সে ধরে আনতে পারছে না কেন? মজি দফাদার আমতা আমতা করে। চেয়ারম্যান একদিন নিজে গিয়ে হাজির হয়—কই রে আলা, বাড়িতে আছিস। আলা চেয়ারম্যানের কণ্ঠস্বর শুনে আবার পেটের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। ফুলনের পায়ের কাছে আলার পেট পড়ে আছে। তার ভেতরে সে লুকিয়ে আছে। ফুলন কাঁথা সেলাই করছে। চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসা করে—কই রে ফুলন তোর স্বামী পেট ফেলে রেখে কোথায় পালালো? ফুলন বললো—চেয়ারম্যান সাব, সে তার পেটের মধ্যে লুকিয়ে আছে গো। চেয়ারম্যান ফুলনের কাছে বসে, তার হাত ধরে বলে, আমাকে চোর হওয়া শেখা ফুলন। চেয়ারম্যানও ফুলনের কাছে চোর হওয়া শেখে। যে মিয়াদের কাঁসার থালা হারিয়ে গেছিল তাদের কখনো বড় ছেলে আসে, কখনো মেজ ছেলে আসে কখনো ছোট ছেলে আসে তারা ফুলনের কাছে চোর হওয়া শেখে। থানার দারোগা আসে। তারাও তার কাছে চোর হওয়া শেখে। আলা চোর তার পেটের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে।
এর কিছুদিন পর আলাচোরের বউয়ের পেট বড় হতে থাকে। যতদিন যাই তার পেট বড় হতে থাকে। পৃথিবী দখলের খেলায় মাতে, পৃথিবীর সমান হবার প্রতিযোগিতা করে। তার পেট এত বড় হয়ে ওঠে যে ঘরে আর তার জায়গা হয় না। তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে। বাড়ির বাইরেও তার থাকা হয় না। পথ আঁটকে যায় তার পেটে পথ দিয়ে মানুষ হাঁটতে পারে না। আশপাশের কয়েকবাড়ির মানুষও তাদের বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। তার পেট তাদের বাড়ির গেট বন্ধ করে দিয়েছে। শেষে তাকে একটা মাঠের ভেতর রাখে। আরও বড় হতে থাকে তার। মাঠ ছাড়িয়ে নদী, নদী ছাড়িয়ে ওপারের মাঠ দখল করে ফেলে তার পেট। সূর্যটাও ঢেকে ফেলে একসময়। চাঁদটাও আর দেখা যায় না। বৃষ্টি হলেও বিশাল এলাকায় বৃষ্টির জল পড়তে পায় না। ফলে এখানের মানুষ দিন রাতের আর ফারাক বুঝতে পারে না। অনাবাদে, অনাহারে মানুষ মরতে লাগলো।
ফুলনের পেট পুরো পৃথিবী ঘিরে ফেললো। কোটি কোটি মানুষ আছে তার পেটে। এরা সবাই চোর হবে মনে মনে বললো ফুলন। এত চোরের সে জন্ম দেবে কী? গর্ভকাল প্রায় পুরে এসেছে। সে মনে মনে তার মৃত্যু কামনা করে চোখ বুঁজলো। সে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।