তার ফুঁ ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না এ অঞ্চলে। এর কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। গা গরম হলো বা ব্যথা হলো বুকে অথবা ঋতুস্রাব দেরিতে হচ্ছে কিংবা প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া—সবকিছুরই সমাধান এই ফুঁ। বাবার দৃষ্টিও শক্তি ধরে ভীষণ। চোখ বুজেই তিনকাল একাকার দেখতে পান। চুরি কে করেছে, মাল কোথায় আছে, বলে দিতে পারেন। কাউকে একনজর দেখেই বলে দিতে পারেন তার ধর্মকর্ম-ইতিহাস! কে কবে কার সঙ্গে কিভাবে পালাবে, কাকে কে কিভাবে ঠকাবে, স্পষ্ট দেখতে পান। ফুঁ’র জোরে বাচ্চা যার না হওয়ার, তারও হয়।
ইতিহাস জন্ম নিলো যেদিন, তার আগে থেকেই এই ফুঁ’র রাজত্ব। ছোট্ট ইতিহাস তারপর বড় হলো, জোয়ান ইতিহাস হলো বুড়ো। থুত্থুড়ে কেউ মরলো যখন, তাদের মাটিচাপা দিলো মানুষ, দিলো পুড়িয়ে, কাউকে দিলো ভাসিয়ে। তারপর কতই না ঘটনা! এর ইতিহাস কেড়ে নিলো ও, তারটা আবার চাপিয়ে দিলো তাদের ওপর। কত ‘নেই’ ‘আছে’ হয়ে গেলো, ‘আছে’ হয়ে গেলো ‘ছিল’! আবার জ্বলজ্বলে যে ‘ছিল’, দেখা গেলো সে বেমালুম হয়ে গেছে ‘নেই’। দিনে দিনে এমন করেই বদলে গেছে দিনের রঙ, রাতের রূপ। এর মধ্যে শিখতে শিখেছে মানুষ, শিখেছে বুঝতে। চারপাশে তাই বিজ্ঞতার ছড়াছড়ি। উঠোন থেকে শুরু করে পুরোনো শ্মশানঘাট—সব এখন নতুন ধুলোয় ঢাকা। টাট্টিখানা থেকে শুরু করে স্বর্গের টিকিটঘর, সব এখন রঙিন। রঙেই হোক বা ঢঙে, পুরনো কিছুই আর পুরনো নেই, ঐশী আজব এই ফুঁ ছাড়া। প্রকৃত বিশ্বাসী যারা, তাদের রোগ সব ওই ফুঁ নিয়েই সারে। আর চিকিৎসকদের চটকে নড়বড়ে যারা, সত্য সোজা পথ ভুলে তারা ডাক্তারের কাছে যায়। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে ওষুধ নিয়ে আসে। তবে ঘরে ফেরার আগে ঠিকই বাবার কাছে যায়। তার ফুঁ-ভেজা ওষুধ খেয়েই কেবল নিরাময়। না হলে না। ফলে যে গাছটা বেয়াড়া খুব, বেয়াড়া হওয়া সত্ত্বেও সে পাতা নাড়ানোর আগে বাবার অনুমতির অপেক্ষা করে। আর যে বেয়াড়া না সে তো করেই।
বাবার কথার সঙ্গে কাজের সঙ্গে ইঙ্গিতের সঙ্গে তাই বেশ একটা বেতার-বাঁধা-সম্পর্ক এলাকাবাসীর। তিনি হাসলে এলাকা হাসে, না হাসলে থোতা মুখ ভোঁতা করে বসে থাকে সবাই। প্রায়ই মাথা দোলান তিনি। দোলাতে দোলাতে গোঙান। তার অনুসারীরাও গোঙাতে থাকে। ঘাড় মাথা দোলাতে থাকে। তাদের সঙ্গে দুলতে থাকে ঘরবাড়ি গাছপালা। ঘাস-লতা-পাতা। সঙ্গে পুরো এলাকা। সঙ্গে পুরো পৃথিবী।
প্রবল এই শক্তিমান বাবাকেই কি না অস্বীকার করে নুরু! শুধু কি অস্বীকার? বলে বেড়ায়, বাবার যত কেরামতি যত ক্ষমতা সব নাকি বানোয়াট। মিথ্যে। কথায় কথায় বাবাকে ধুয়ে দেয় গাধাটা। সমাজ তাই ভয়ঙ্কর বিরূপ ওর প্রতি। ফলে নুরুর প্রধান শিষ্যের মৃত্যু হলে বেশ একটু খুশির আবহ তৈরি হলো। খুশি ঠিক না, মৃত্যুটা যেন স্বস্তিই দিলো সবাইকে। উঠোনে দোকানে এখানে ওখানে শুরু হলো আলোচনা। আলোচনাও ঠিক না, ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপের সমাহার।
সকালের চায়ে চুমুক না দিয়েই একজন বললো, ‘পালে যাবু কোটে বাছাধন? যতদূরত যাইস না ক্যা, ঘুরিফিরি খুঁটের গোরত আসিরে নাগবে।’
চুলোর ভেতর লাকড়িটা আরেকটু ঠেলে দিল বিক্রেতা। ‘মাতা তো নামালুই শ্যাষত! খালি খালি পরকালডাও খায়া ফ্যালালু!’
খরিদ্দার বললো, ‘দুই লাইন নেকাপড়া শিকি এক্কেরে বিদ্যাসাগর হয়্যা গেলু, আছুলু তো হাবার হদ্দ।’ আরেকজন বলে, ‘হাবা না হইলে আর চ্যাংড়া নেজে জিব্বা হয়া দাঁতক ওল্টে ফেলবার চায়?’ সামনে রাখা বাঁশের বেঞ্চে বসে ধোঁয়া খেতে থাকা লোকটা দিল উপসংহার, ‘এইবার বুজিবু গোরের ঠেলা কাক কয়!’
ঠেলা বোঝানোর তোড়জোড় যদিও দেখা গেলো না তেমন। এমনকি মৃত্যুপরবর্তী সবচে’ সস্তা যে চোখের পানি, তাও ফেললো না কেউ। সাজুর ব্যবহার এমনিতে খারাপ ছিল না, ছিল মিষ্টভাষী। এলাকার একমাত্র স্কুলের শিক্ষক সে, মান্যও তাই করতো লোকেরা। কিন্তু নুরুর পাল্লায় পড়লো যেদিন থেকে সেদিন থেকেই উল্টোস্রোত। তাদের নিয়ে নানান উল্টোপাল্টা কথা শোনা যায়। নুরুর জন্যই নাকি শেষপর্যন্ত বিয়ে করলো না সাজু, অথচ তার নারী কেলেঙ্কারি আছে! পান বিষয়ক রটনা আছে। ফলে লোকে ইদানীং খুব একটা ঘেঁষতো না তার গায়ে। এমনিতে বহিরাগত। তার ওপর নুরুর ঢাকের বায়া। বাবার বিরুদ্ধে কখনো কখনো ওস্তাদের চেয়েও উচ্চকণ্ঠ। গ্রামবাসীর কাছে তাই উটকো ঝামেলাই সাজু।
খুব স্বাভাবিকভাভেই ওর মৃত্যু নুরুকেই কাতর করলো শুধু।
ঘরের কোনায় পেয়ারা গাছ। গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নুরু। ভয় পাওয়া মলিন মুখ। প্রথমে বলেছিল, ‘এইডা বাবার লোকেরই কাজ। যুক্তি-বুদ্ধির জোরত না পায়া মারি ফ্যালাইল।’ তবে ধরা গলার ওই বিলাপ খুব একটা পাত্তা পায়নি। কেউই সায় দেয়নি তার কথায়। তার মা বউ পর্যন্ত বলেছে, নিষ্পাপ বাবার ওপর এমন মিথ্যার বোঝা চাপানোর জন্য তার বিচার করা উচিত। ফলে একা বোকা দাঁড়িয়ে থাকা হেলে পড়া নুরুকে অসহায় লাগে খুব। দেখে ভাবাও যায় না এই হ্যাংলা পাতলা ছেলেটাই কদিন আগে হুঙ্কার দিয়ে আকাশ কাঁপিয়েছে।
বছর শেষের বাতাস। বাতাসে নতুন শুরুর ঘ্রাণ। পাতায় পাতায় নতুন রোদ, নতুন প্রাণ। হাটে মাঠে বোশেখের আহ্বান। শোভাযাত্রার আয়োজন চলছে। মেলা হবে। নাটক করবে নুরুর দল। মহড়া করছে। সেখানেই হামলে পড়েছিল মুরিদরা। বর্ষবরণের নামে এইসব চটকদার হিন্দুয়ানি বরদাস্ত করবে না তারা। করতে দেবে না মেলা, নাটক তো না-ই। নুরুরাও ঘোষণা দিলো, বর্ষবরণ তারা করবেই। নাটকও করবে। পারলে কেউ ঠেকাক! ঘরফেরতা পাখিরাও তখন কেঁপে উঠেছিল নুরুর আওয়াজে। পালানো ছাড়া উপায় পায়নি বাবার লোকেরা। তবে তারা যে ছেড়ে কথা বলবে না, অতীতই তার প্রমাণ।
বছর দুয়েক আগের কথা।
পড়তে পড়তে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এসেছে নুরু। বাবার জমি জায়গার অভাব ছিল না। বাজারের দোকান সব তাদের, ভাড়ার টাকাই খরচ করে পারে না। বাড়তি রোজগারের চিন্তা করে কী লাভ! তবে বসে তো খাওয়া যায় না, ব্যবসা খুললো। বইয়ের দোকান, সঙ্গে ফটোকপি ছবি বাধাই প্রিন্টিং হাবিজাবি। ভেতরে পাঠাগার আছে, চাইলেই বই নিয়ে পড়া যাবে, না কিনে চলেও যাওয়া যাবে। চা কফির ব্যবস্থা আছে, সিঙ্গাড়া সমুচা আনলেই জমে ওঠে আদর্শ আড্ডা। সারাদিন তার ওখানেই কাটে। এলাকার শিক্ষিত ছেলেপুলে বড়পুলের নিয়মিত যাতায়াত। এই আসতে যেতেই সাজু মাসুম পোল্লাদরা সাগরেদ বনে গেলো তার। সময়ে অসময়ে শেকড় ছড়ায়, ডালপালা বাড়ায় আড্ডা। আলাপে আলাপে ধরা পড়ে, এলাকার ছেলেরা মেয়েরা বড় বইবিমুখ। তাদেরকে বইবন্ধুর সন্ধান দিতে হবে। বইমেলা করতে হবে। এখান থেকে বাঁশ ওখান থেকে লাঠি ওর কাছ থেকে এটা তার কাছ থেকে সেটা নিয়ে নিয়ে চলতে থাকে আয়োজন।
বাজারের কাছেই মস্ত এক বুড়ো অশ্বত্থ। গাছটা চারদিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছে, যেন আশ্বস্ত করছে, তার ছায়ায় যারা আসে তাদের দায়িত্ব তারই। একটু ডানে ঈদগাহ। দুইয়ের মাঝখানে বেশ প্রশস্ত একটা খালি জায়গা। ওখানেই হবে মেলা। বাবার লোকেরা বলে, ‘হবার নয়। ইংকা পাক জায়গাত মুরতাদগুলার ধর্মবিরোদী বইয়ের মেলা বসাইবে আর এইল্যা বই পড়ি পড়ি চ্যাংড়া-চেংড়ি সব নষ্ট হইবে ভ্রষ্ট হইবে, তা হবার দিবা যাবা লয়। হইলে উরসই হইবে, অন্য কিছু হবার লয়।’
এবারের মতোই গো ধরে নুরুর দল, মেলা হবেই।
হয়ও।
কোনো এক কবি এসে উদ্বোধন করে যায়। শহর থেকে প্রকাশকরা আসে। বিকেল সন্ধ্যেয় নাচগান হয়, লোকসমাগম মন্দ না। বই যতটা কেনে মানুষ তারচে’ বেশি দেখে। মেয়ে পুরুষ বিচার নেই, গায়ে গায়ে ঘষে, আর নিজেদের দেখায়। তবু আয়োজকরা খুশি। এর মধ্যেই একরাতে তছনছ হয়ে পড়ে থাকে মেলাচত্বর। মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়—টাকা পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলার কারণে নুরুরাই পণ্ড করেছে সব। নুরুরা বলে বাবার লোকেদের কাজ। ফলে বেশ একটা লেগে যায় অশ্বত্থ আর ইদগাহর মধ্যে। তুমুল সে লড়াইয়ের চারপাশে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস লাগে এলাকাবাসীর।
শত্রুতার সেই শুরু।
বাবার মুরিদরা বলে বেড়ায়, ‘ওমরা ব্যাবিচারী। চ্যাঙড়া চেঙরি কোনোই মানামানি নাই। অ্যালা অবিশ্বাসই কয় ওমার বিশ্বাস। বান্দর হইল্ ওমার বড়বাপ, আর বিজ্ঞান ওমার ধর্ম!’ ঘৃণাভরে এসব শোনে লোকে। আর বাক্যের দাঁড়ির পর কমার পর কোলনের পর তওবা তওবা নাউজুবিল্লার ফেনা তোলে।
জুম্মার নামাজে নুরুদের পাশে বসতে চায় না কেউ। উঠে যায়। একঘরে করার কথাও তোলে কেউ কেউ। কিন্তু হোতাটা নুরু বলেই এঁটে ওঠে না কেউ।
যাই হোক, পাটকেল মারতে নুরুরাও ছাড়ে না।
লোকজনকে ধরে ধরে বলে, ‘বাবা নারীবাজ, ভণ্ড, ধাপ্পাবাজ। অর ফুক, মাজিজা, সবগুলাই ভাওতামি!’
বলে, ‘বাঁচি থাকির গেইলে শিখির নাগবে, প্রশ্ন করির নাগবে। আর মাতা হেট করা যাবার নয়।’ এ কানে শুনে যারা ও কান দিয়ে বের করে দিতে পারে কথাটা, তারা বেঁচে যায়। আর যারা ‘ক্যাঁ কী হইছে? মাথা হেট করা যাইবে কী যাইবে না সেইডা কবার নুরু কায়?’ জানতে চেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, বিদ্রোহ করে, তাদের নিয়ে শুরু হয় তাৎক্ষণিক কর্মশালা!
নুরুরা বলে, ‘তোর মাথাখানের ওজন কত জানিস?’
জানে না লোকেরা।
‘কাহারো চাইর কেজি, কাহারো ফির পাঁচ। আচ্ছা কও তো, পাঁচ কেজি ওজনের এটটা ব্যাগ তুমি কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবা?
লোকটা দেখা যায় এই প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না। অথবা দেয় না।
‘বেশিক্ষণ পাবার নাইস, হাত লাগি যাইবে। নোয়াই? অন্তন অতট্টা ওজনেরই এই মাথাখান আটকি আচে হালকা পলকা কিছু হাড্ডিার সাথ, নরম কয়খান শিরাত। বোঝেক অ্যালা তাইলে ঘটনা।’
লোকেরা তখন তাকায় নুরুদের দিকে। চোখে বিষ্ময়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানা।
নুরুরা দেখে যে বাগে আসছে কাতল। জালটা আরেকটু ছড়াতে হবে।
‘এই মাথাটা একনা সামনত নামে নে। ধরেক তুই মুবাইল চিপিছিস মনে মনে। হ্যাঁ এই মতো করিয়াই (হাতে ধরে নিচু করে দেয় মাথাটা। কখনো কখনো মোবাইলও ধরিয়ে দেয় হাতে) দেখিছিস তো? দ্যাখ ক্যানে গলার পেছনত হাঁড় আর শিরার উপরও কেমন চাপ পড়িছে। টান নাগেছে, বুঝির পাইছিস? এর কারণ কী? কারণ হয়সোল মাথাখানার ওজন এবার বাড়ি গেইছে।’
লোকেদের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নুরুরা তখন একটু চুপ করে থাকে। পানি নাড়ার পর তাকে থিতিয়ে যেতে যে সময় দিতে হয়, তা দেওয়া হয়েছে মনে হলে জাল গুটায়।
‘মাতখান যদিকাল আরো একনা হেট করা গ্যাল হ্যায়, ওজন আরো বাড়িল হ্যায়। যত নিচু তত ওজন। (সামনে থাকা কাগজে কলম বা পেন্সিল দিয়ে কিম্বা কাগজ না থাকলে মাটিতে গাছের ডাল দিয়ে বাংলা দ এঁকে বলে) এই যে বাঁক, এমন পরিমাণ বেঁকে থাকলি মাথার ওজন বাড়ি হয় সাতাইশ কেজি!’
লোকেরা বিস্ময় প্রকাশ করে। বিস্ময়টুকু হালকা হয়ে গেলে আবার কথা বলে নুরু। ‘অ্যালা ভাবি দ্যাখ্ সবসুমায় জি হুজুর, জি হুজুর করবু কি না। না, মাথা তো নামাবারে পারিস, কিন্তুক কারণ থাকির নাগবে। যুক্তি থাকির নাগবে।’
কাতলেরা তখন পীরবাবার কাছে যায়।
পীরের প্রাসাদে তখন হয়তো দুপুর বেলার ঘুম। বা সন্ধ্যার মজমার প্রস্তুতি। কিংবা সকালের দরবার। বাবা তখন হয়তো সোনার চেয়ারে বস। সামনে রুপোর রেকাবিতে ইরানি জর্দা পাকিস্তানি পান। হয়তো তিনি ধ্যানে আছেন, চোখ বুজে দেখছেন কার ঘরে কী ঘটছে, বা এটা মামুলি বিশ্রাম। বা হয়তো কোনো বিশেষ রোগী দেখছেন অন্দরমহলে। লোকেরা বসেই থাকে অধীর। সময় হলে বাবা এগিয়ে আসেন ধীর পায়ে। পায়ে সৌদি চামড়ার জুতো। চোখে ঐশী ঘোর। ঘোর লাগা চোখদুটো কিছুক্ষণ বুজেই থাকেন তিনি। তারপর অভিযোগ শোনেন, ফরিয়াদ শোনেন। আর হাসেন। হাসতে হাসতে পিক ফেলেন পিকদানে। পিক ফেলতে ফেলতেও হাসেন। শান্ত হতে বলেন মুরিদদের। বলেন ‘ওমরা মুরতাদ। ওমরা কিছুই জানে না, বোজেও তো কচু! না জানাগুলোক ঢাকবার নাগিই ওমরা অহেতুক ফ্যাতলা পারে। কিন্তুক ওইটা যে ওমার না জানাটাকই বেশি করি প্রকাশ করি দ্যায়, বোঝে না। তারও কারণ আছে। ওমরার ক্বলবে শয়তানের ছিল মারা। ওমরা তাই বুঝবে নাই।’ খুব আপশোস করেন তিনি। দোয়া করেন বিপথগামীদের হেদায়েত চেয়ে।
হেদায়েত কিন্তু হয় না। উল্টো দলে ভারী হয়ে ওঠে নুরুরা। দিনে দিনে তারা পাল্টে দিতে থাকে সব। গানের দল করে। নাচের দল গড়ে। ঢোল তবলা সেতার শেখার ব্যবস্থা করে। ক্লাব বসায়।
ডিশ আসে বাজারে। চাখানায়, ভিসিআর হলে, দোকানে দোকানে সিডি।
ডাক্তারখানা বসে। ওষুধ হয়ে ওঠে মানুষের প্রিয় পথ্য। কিছু হলেও তারা প্যারাসিটামল হিস্টাসিনে ভরে ফেলে গলা এস্তেক, না হলেও তা-ই। কিছু হতে দেরি হলে ওষুধ খায়, তাড়াতাড়ি হলেও খায়।
নাচে গায়, স্কুলে কলেজে যায়, গল্প নভেল পড়ে মেয়েরা। পিল খায়। বাচ্চা ফেলে।
শহর থেকে এখান থেকে ওখান থেকে ছেলে মেয়ে আসে নুরুর কাছে। একসঙ্গে ওঠে বসে। কেমন যেন হয়ে ওঠে নুরুরা। রাতবিরেতে তাদের গলায় খল খল করে দেশি বিদেশি বোতল। শোয়াশুয়ি ছোঁয়াছুঁয়িতে বাছবিচার থাকে না। মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না তারা। রাখঢাক নেই, লাগাম নেই কথায়। যা মুখে আসে বলে দেয়, কথায় কথায় ছোট করে।
তাদের দেখাদেখি বেআব্রু হয়ে ওঠে গাছগুলোও। মাঝেমাঝে বাবার ফুঁ ছাড়াও নড়ে।
ফলে ফুঁ-রাজত্বে চিন্তার ভাঁজ।
বাবা যদিও খোশমেজাজেই থাকেন। খান দান। এবাদত বন্দেগী করেন। ওয়াজ নসিহত করেন। এটা সেটা চমৎকারি দেখান। তিনি জানেন, দিনশেষে সত্যটাই বাঁচে; সত্য যা না তা যতই সত্যের মতো হোক, টেকে না। ফলে রাজত্ব কিছুটা কমলেও, রাজা থাকেন রাজার হালেই। দাঁতের ওপর বালির মতো কিচকিচ করে শুধু নুরুরা।
নতুন নতুন গল্প নিয়ে আসে তারা। লোক জমিয়ে শোনায়। গ্রামের ময়মুরুব্বি তার বিরোধিতা করে। বাপ দাদার এতদিনের বিশ্বাসের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় জোরগলায়। তখন বেশ একটা ঝগড়ার পর্যায়ে যায় তর্কটা তাদের। নাটকটা হবে না হবে এ নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সেদিনও আগুন ঝরছিল।
‘বাপ পীর আছিল, তাই বলি কি বেটাও পীর হইবে! কেন? জ্ঞানের কথা কওং বা যোগ্যতার কথা কওং, এইলা কি পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া যাইবে?’ বাবার শেকড় ধরে টান দেয় সাজু।
‘না তা কি?’ বাঁশ লাঠির প্যালা দিয়ে গাছটাকে সোজা রাখার চেষ্টা করে দেলোয়ার হোসেন। ‘অ্যালা খুব যে আধুনিকতার বুলি ফুটাইচিস, তুমার ওই আধুনিক রাজনীতি আর আধুনিক অভিনয় জগৎ সব জাগাতেই তো এই রক্তের সম্পক্কের ভেলকিবাজি।’
‘রাজনীতি আর অভিনয়ের সাথ তুমি ধর্ম মেলাতি চান বাহে? ওইল্ল্যা ব্যাপারত মেধা যোগ্যতা বলি এটটা কথা থাকে, যোগ্য হবার না পাইলে লোকে ভোট দিবার নয়, দক্ষ না হইলে লোকে অভিনয় দেকপার নয়। আর পীর মরলো তো পীরের বেটা পীর! তার যোগ্যতা থাকিল্ কি না, চরিত্র বা ক্যামন কোনো দ্যাকাদেকি নাই। আর অইও ধাপ্পাবাজ, ভড়ং ধরি বসি পইেল্ মসনদে।’
রবিচা’ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অমনি থামিয়ে দেয় সাজু। ‘পীরবাবার বাপ তায়ও তো ভ-ই আছিল্, তার বাপ দাদাও তা-ই আছিল। ওমারগুলার পূর্বপুরুষ হয়তো ইরান তুরানের কোনো পলাতক আসামি আছিল, হবার পায় কারো উট চুরি করি ধরা পড়িছে, বা রাজার বেটিক চোখ মারি বা রানির সাথ নষ্টামী করি, বা অন্য কোনো ভয়ে পালে আসছিল এই দেশত। অশিক্ষিত বাঙালি ওমার পাগড়ি আর খড়ম দেখি ভুলি গ্যাল, দরবেশ মানল, পীর বানাইলো! ঐলা গ্রামের অলি গলি এখন রাজপথ, গ্রাম এল্যা শহর, তবু ওমার ভণ্ডামির খবর কাও করিল না! ঐল্ল্যা যে সব ভণ্ডামি, বোঝো না?’
‘যা বুঝিস না, তা নিয়া তর্ক করিস না মিয়া। দুদিনগের বৈরিগি, ভাতক কও অন্ন। বিদেশি লোক, এলাকার হাল তুই কি জানবু? বাবার সবকিছু ভাঁওতাবাজি হইলে আশপাশের দশগ্রামের কতজনক যে অস্বীকার করির নাগবে তার খিয়াল আছে?’
কী একটা বই পড়ছিল নুরু। কথাটা শুনে মুখ তুলে তাকায়। চোখে কৌতুক এঁকে বলে, ‘গ্রামবাসীরে ফির টানিছিস ক্যান এর মদ্যি। ওমরা ফির কী ভণ্ডামি করিল্?’
‘কাউকো কি টানির নাগে ভাতিজা! মানষি তো হইল্ বিড়ির ধুমা, না টানলিও নাকের ডগাত আসি খাড়া হয়! তুই হয়তো মানবের চাবু না, কিন্তুক পীরবাবার পড়াপানির জোরোতেই ওমার জম্ম! কত বাঁজা-বন্ধ্যার কোল ভরি দিয়া সংসার বাঁচে দিছে বাবাহুজুর, তা কি জানিস?’
‘তাইলি কদুপাগলাও তো পীরিরই বেটা, কী কন চাচা, অয়ও তো তাইলে পীর, না কি? যাও কনতা অর পাওত গিয়া পড়ো! তা তো পড়বু না, না? বাতাসত না ডাঙ্গে, মোর কতা শোন, ও পীর ভণ্ড!’ হো হো হাসির হল্লা বাধায় নুরু। মাথার ওপর গাছের মাথায় কিছু কাক বা কোকিল বা শালিক তাদের কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে, উড়ে যায় তারা। ক’টা আধাপাকা পাতা এসে পড়ে সামনে। সেদিকে তাকিয়ে সবাই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর উঠে যায় যে যার কাজে। তবে বাবাকে জড়িয়ে এমন তীব্র একটা নোংরা কথা বলার পর তাদের যে ছেড়ে দেওয়া হবে না, তা বোঝা গেলো রাতেই।
ফিরতেই নুরুর মা তাড়িয়ে দিলো নুরুকে। অত্যাচার অনাচার অনেক সহ্য করেছে সে, আর না। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি, তার মতো কুলাঙ্গারের ডেরা না। মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে নুরু। তার বিশ্বাসের ভুলটা ধরিয়ে দিতে লাগে। আশ্চর্য লাগে নুরুর, যে মা পৃথিবীর তামাম বিষয়ে ছেলের কথাকেই ঠিক মানে সেই ছেলেরই ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বলা কথায় জ্বলে ওঠে, বিস্ফোরণ ঘটায়! মা’রা এমন কেন? ভাবতে ভাবতে পা বাড়ায় সে, থাকবে না এই অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খের অন্ধকার লোকালয়ে। গিয়ে শোয় অমলের বাড়ি।
পরদিন সকালেই ওই মৃত্যুখুশির সংবাদ। সাজু আর নেই! নুরুর কথাটা হয়তো মিথ্যেও না, বাবাকে অসম্মান করার কারণে কোনো মুরিদ এটা করেও থাকতে পারে। তবে কিভাবে মরলো, কোথায় মরলো, খোঁজ নেয় না কেউ। যেন সাজু পথের কুকুর, মরে পড়ে থাকলেও কারও কিছ আসে-যায় না, গন্ধ ছুটে গেলেই শুধু থুতুর বাহার! সাজুকে এমনকি গোসল দিতেও রাজি হয় না কেউ। নুরুর সাগরেদরাই অপটু হাতে কোনোমতে সারে কাজটা। উঠোন ততক্ষণে উত্তাল। সাজু যেহেতু ধর্ম মানেনি, ধর্মমতে তার দাফন হবে কি না, হলে জানাজা কে পড়াবে এই নিয়ে তর্ক। কেউ বলে এই, তো কেউ বলে নেই। এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলের মানুষ নিতে পারে না। তারা বাবার কাছে যায়। সব শুনে বাবা একটু হাসেন প্রথমে। সেই হাসির ছটা চোখে মেখেই ছুটে আসেন নুরুর বাড়ি। হট্টগোল থামান। বলেন, ‘মরা মাইনসক নিয়া ব্যঙ্গ বদ্রূপ করার নাই। এছাড়া কারও পাপ পুণ্যের বিচার করার দায়িত্ব আল্লা মোক দ্যায় নাই, মোর যিটা কাজ মোকে তা করির নাগবে। একনা সব থাকি জরুরি কাজ হইলো মৃতের দাফন।’
বলেই তাকালেন নুরুর দিকে, মুখে অস্ফূট হাসি। নুরু যেন মিশে যায় মাটিতে! এমন প্রতাপশালী আত্মবিশ্বাসী মানুষকেও কেমন অসহায় লাগে, হুজুরের মহানুভবতার কাছে যে হার মেনেছে, বোঝা যায়।
জানাজা শেষ হয়। কবর প্রস্তুত। লাশ নামাতে আসে গোরখোদকেরা। তখনই হঠাৎ বিস্ময়চিহ্ন আঁকে নুরু।
‘সাজু মরেনি। অ্যালায় উটি আসিবে অয়!’
কী বলে ছেলেটা! ওর কি মাথা গেলো?
‘না’—বলে নুরু। ‘বাবা যেহেতু না দেখেই সবকিছু কিবার পায়, জানাজা পড়িবার দিয়া তাক পরীক্ষা করা হইল! গবার সামনত অর মুখোশ খুলি দিবার বাদে শুয়ি আছে সাজু। মরেনি।’
তখন ক্ষোভ। তখন আগুন। লক লক করে জ্বলে ওঠে জনতা। এতবড় আস্পর্ধা নুরুর! বাবার সঙ্গে মশকরা!
লোকেরা তেড়ে আসে নুরুর দিকে। আস্ত রাখবে না তাকে আর।
শিষ্যরা হৈ হৈ করে ওঠে তখন। ‘এই পীর ভুয়া। নকল। ধোঁকাবাজ।’
বেশ একটা মারকাটারি অবস্থা!
ডামাডোলে নড়ে ওঠেন বাবা। কেমন একটা ভূমিকম্পের মতো মনে হয় তার। মনে হয় এমন যদি হতো, তার ডানা আছে, তিনি উড়ে যেতেন। কিংবা অদৃশ্য হতেন ক্ষমতা থাকলে। ভেতর ভেতর কাঁপেন তিনি। ঘামতে থাকেন। তার চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারেন না। মুরিদরা একটা চেয়ার এনে দেয়। ঘিরে রাখে মুরিদবর্ম তৈরি করে। অন্য মুরিদরা আওয়াজ দিতে থাকে, সাজু যা করেছে তা অন্যায়। এর একটা বিহিত তারা করবেই। অনুমতির অপেক্ষা করে তারা। বাবা অবশ্য কিছুই বলেন না।
সাজুর দিক থেকেও সাড়া পাওয়া যায় না কোনো। বেঁচে থাকলে তো এতক্ষণ উঠে আসার কথা। কী হলো? আসছে না কেন? কেমন যেন ভীতিকর হয়ে ওঠে সব। এগোয় না কেউ। কাফনমোড়া লোকটা উঠে বসবে এই দৃশ্য দূর থেকে দেখারই সিদ্ধান্ত নেয় তারা। অগত্যা নুরুকেই যেতে হয়। ‘সাজু ওঠ’ ‘ওঠ সাজু’ বলতে বলতে এগিয়ে যায় সে। সাজু কিন্তু ওঠে না আর। নুরু গিয়ে কাপড় সরায় খাটিয়ার ওপর থেকে। তারপর কেঁদে ওঠে ডুকরে!
আবার তখন গলা খোলে মুরিদদের। এই হাওয়ায় বাবার গলায়ও ঢেউ খেলে। বাণী পাঠান। এগিয়ে আসে বাবার প্রধান খাদেম। হাসিহাসি মুখে তার জোর করে আনা কাঠিন্য। নকল কঠিন গলায় ঘোষণা দেয় সে যে, হুজুর সবাইকে শান্ত হতে বলেছেন। বলেছেন, মৃতের সামনে শোরগোল না করতে। হাওয়াহীন চৈত্রের দুপুরে একা পড়ে রোদে পুড়তে থাকা পুকুরের জলের মতো শান্ত হয়ে যায় সবাই। গনগনে চুলোর মতো লালস্বরে বলতে থাকে মুরিদ। ‘এমন করি বাবাক পরীক্ষা কইরবার আসা ঠিক হয় নাই। সাজু যে বাঁচি আছে, বাবা তা জানি ফেলাইছে। জ্যান্ত মানষির জানাজা হয় না বলিয়াই তাকে আগোতে মারা নাগিছে। কাওকো মারা কোনো কঠিন কাজ নোয়ায়, ফুঁক দিলিই হয়। কিন্তুক সাজুক মারবার যায়া খুব কষ্ট হইছে বাবার। কিন্তুব বড়র স্বার্থে কখনো কখনো কঠিন তো হবারে নাগে। যাই হোক, এইবার য্যান্ শিক্ষা হয় নুরুর। এই মতন দুঃসাহস য্যান আর না দেখায় অয়।’ ঘটনাটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাক।
নুরুরা আবার কোণঠাসা। নুরুর বুদ্ধিতেই মানুষটা মরলো। ভর্ৎসনা আসে। অভিশাপ আসে। নুরুর মা এসে ঘৃণা জানিয়ে যান। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে থাকে নুরু। ভেঙে পড়া শূন্য দুটো চোখ ফেলে রাখে মাটির দিকে।
মুরিদরা ভাসতে থাকে স্বভাবতই। অথবা উড়তে থাকে। তাদের বুকগুলো উঁচু হয়ে ওঠে টিলার মতো, পাহাড়ের মতো। সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়েই নুরু বেয়াদবি করে আবার। তার গলায় চিলের চীৎকার। ‘সাজুক বাবা খুন করিল। আমি ছোট, ভুল করিবারে পাও। কিন্তুক বাবা এইটা কী করিল্? যেহেতু বুঝিই ফেলাইছেন, অয় তো কবার পাইল ব্যাপার সবাইক। এটে মেম্বার চাচা আছিল, গণ্যমান্য ব্যক্তি আছিল, বিচার করিল হয় সব্বাই। কিন্তু মোক শায়েস্তা করতি সাজুক মারি ফেলাইল অয়!’
সাগরেদদের গলা শোনা যায়। ‘এই হত্যার বিচার চাও। বিচার চাও।’
ব্যাপারটা যে আরও গুলিয়ে গেলো, তা জনতা বুঝতে পারে না সহসা। বাবা যা বলেছেন, তা যদি সত্যি হয়, নুরুর কথাও তো সত্যি। সাজুকে তিনি মেরেছেন। তাহলে বাবা একজন খুনি! দায়টা তাকে নিতেই হবে। কিন্তু শুধু দুটো ফুঁ দিয়েই যেভাবে করেছেন কাজটা, তার কৃতিত্বটা কি কম? এমন অসাধ্য যিনি সাধন করেন, তার পায়ে পড়তেও ইচ্ছে হয়। লোকেরা তাই ঠিক করতে পারে না কি করবে! মুরিদরাও হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে। তাদের বুকের পাহাড় ছোট হতে থাকে। কারো বুকে খোঁড়া হতে থাকে খাল কারো গর্ত।
মুরিদঘেরা দুর্গে নিরাপদে ঘামেন বাবাও।
বাইরে তখন আবারও শোর ওঠে। চমকে ওঠে সবাই। বুকে থুতু ছিটাতে ছিটাতে, শিষ্য মুরিদ একসঙ্গে, লক্ষ করে নড়ে উঠেছে খাটিয়া। কাপড় সরিয়ে এগিয়ে আসে জ্যান্ত অথবা মৃত সাজু!
নুরুকে তখন মেম্বারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দুষ্টুমিষ্টি হাসিমাখা মুখ।
লোকেরা দাঁড়িয়ে থাকে ঘোরগ্রস্তের মতো। নড়ে না, সরে না। রা চড়ে না মুখে।
এরপর কিছুদিন লুকিয়ে থাকে মুরিদরা। যেন শীতনিদ্রা।
নুরুরা বইমেলা করে। যাত্রাপালা করে। মাঠে গোলের ঝড় তোলে মেয়েরা। স্কুলে তাদের উপস্থিতি বাড়ে। ঘরে বাইরে তাদের কণ্ঠ শোনা যায়।
কে যেন তখন পরামর্শ দেয়, ‘এভাবে চলবার দিবা যাবা নয়। যে বাড় বাড়িছে, নুরু বাঁচি থাকলি ধর্মকর্ম মানষি ভুলবে এ্যালা। নবীজির আদর্শ ভুইল ধর্মের অবমাননা করবু। অজাচারে অনাচারে ভরি যাবে দেশ।’ মুরিদরা তাই পরিকল্পনা আঁটে। লাশটা ফেলে রাখা হবে অশ্বত্থ গাছের তলায়। বাধ্য নুরু পড়ে থাকবে মাটিতে, ঈদগাহ’র দিকে মুখ করে। মাথার পেছন দিকটা কাটা হবে, গলা অক্ষত, সেটাকে বাঁকিয়ে আনা হবে, পা ভাঁজ করা, যেন বাংলা দ অক্ষর! লোকজন বলে বেড়াবে, নুরুর মাথার ওজন বেড়ে গিয়েছিল। বাড়তে বাড়তে ছিঁড়ে পড়েছে।
চাঁদগলা এক আঁধার রাতে ধারালো গরুজবাইকরা একটা ছুরি অপেক্ষায় থাকে নুরুর। কাজ শেষে বাড়ি আসবে সে। তার আজ শেষ জোছনা দেখা।
এমন দুধজোছনায় ভিজতে ভিজতে আমল করার অভ্যাস থাকলেও সব ফেলে সেদিন প্রাসাদে ছিলেন বাবা। বসে ছিলেন দাদার আমলে তুরস্ক থেকে আনা জায়নামাজে। চারপাশে মুরিদেরা বসে ছিল গোল হয়ে। বাবা খুব ফুরফুরে থাকার ভাণ করছিলেন, ভেতরে যদিও দুশ্চিন্তার জট। আমেরিকার এসিটা কাজ করছিল, তবে গরম কমেনি তার। ঘামতে ঘামতে ভাবছিলেন, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? ভাবতে ভাবতেই উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারি করতে লাগলেন দরবারময়, পায়ে তার দৌড়তে লাগল এটা সেটা ভাবনা। ভাবলেন, দরকারি কাজটা তো করতেই হবে, ঠিক বেঠিকের বাত নেহি। ঠিক ওই মুহূর্তেই প্রচণ্ড আঘাত পেলেন ঘাড়ের পেছনটায়, যেন মোটা বাঁশ বা কাঠ দিয়ে সজোরে বাড়ি দিয়েছে কেউ! আর্তনাদ করতে করতে পড়ে গেলেন তিনি।
কী হচ্ছে বুঝে উঠতে সময় লাগলো ভক্ত মুরিদদের। যতক্ষণে বুঝলো, বাবা ততক্ষণে তড়পাচ্ছেন। বাঁ-কাঁধের ওপর যেন ছুরি বসিয়ে দিয়েছে কেউ, রক্তের ফিনিক ছুটেছে! কে মারলো, কোথা থেকে মারলো, বুঝতে না পেরে তারা ভাবে, বাবা নিশ্চয় মাজেজা দেখাচ্ছেন কোনো। নিজের শরীর নিজে থেকেই কাটার কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয় করেছেন বাবা! না হলে এই এতজন দাঁড়িয়ে আছে তারা, কে মারছে দেখতে পারছে না তো কেউ! সবচে’ বড় কথা, যে ছুরি দিয়ে কাটলো তারও কোনো হসিদ নেই কেন! অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে টলতে থাকলো তারা। ঠিকরে যাওয়া চোখে তারপরই দেখলো, কোপ লাগলো পেটে, ভুড়ি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ কিভাবে সম্ভব! অদৃশ্য কেউ যেন বাতাসের ছুরি দিয়ে মেরেই যাচ্ছে কোপ, একের পর এক! এ দৃশ্য কি ভাবতেও পেরেছে কেউ? হতভম্ব কিছু মুরিদ তখন পালাতে থাকল এদিক সেদিক। অন্যরা নড়লো না, অথবা পারল না নড়তে। ড্রাইভার গেছে গাড়ি বের করতে, হাসপাতালে নিতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে ধরে তাকে উঠাতে চেষ্টা করতে লাগল কজন। বাবা ততক্ষণে অজ্ঞান, চেতনার আলোটুকু দপ করে নিভে যাওয়ার আগে তার মনে হলো, বড় ভুল হয়ে গেছে।
পরের সূর্যটা উঠল হাসপাতালের জানালায়।
চোখ খুলেই প্রধান খাদেমের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ভালো লাগল বাবার। ভালো লাগল সকালটাও। কী ভীষণ অন্ধকারেই না তলিয়ে গিয়েছিলেন তিনি! মৃত্যু কি তবে এমনই ভয়ঙ্কর! ভাবতেই তার মনে পড়লো ঘটনা। আচ্ছা, নুরু কি শেষ? ওর মাথা কি নিচু হয়েছে? ইদগাহমুখী হয়েছে? চারপাশে লোক, প্রশ্নটা জোরে করা যাবে না, তাছাড়া কষ্টও হচ্ছে কথা বলতে। এক ইশারায় নিচু হয়ে এল খাদেমের কান। নামতে নামতে কানটা যখন তার মুখের কাছে, তখনই মুখ খুললেন বাবা; তবে প্রশ্নটা করা হলো না। চোখ গেল পাশের বেডে। শুয়ে আছে নুরু। দেখেই চমকে গেল পিলেটা তার, নড়ে উঠলেন বাবা। নুরুর কাঁধে ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ বাঁধা পেটেও। পাশে বসা সাজু। চোখ পড়তেই তারা সালাম দিল বাবাকে। ব্যঙ্গ করে হাসলো।
কী যে বিশ্রী তিতকুটে হিংস্র সেই হাসি! বাবার গা জ্বলে গেলো।