টিচারের পেছন পেছন অনিতারা দশ জন ক্লাসে এসে বসে। গ্যালারি সিস্টেমের এই ক্লাসে প্রথম তিন সারি বেঞ্চ ওদের দশ জনের জন্য অনেকটা সংরক্ষিতই থাকে। ইংরেজি লিটারেচারের ক্লাস। সপ্তাহ খানেক হলো, অনিতা কলেজে ভর্তি হয়েছে। বিশাল কলেজ। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী। একাদশ শ্রেণীতে শুধু সায়েন্স গ্রুপেই প্রায় তিনশ জন স্টুডেন্ট। তবে গার্লস মোটে দশ জন, বাকি সব বয়। মাধ্যমিকে অনিতা কো-এডুকেশনে পড়েনি। শুধুই মেয়েদের প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা আলাদা ব্যাপার থাকে। ঠিক যেন পায়ে বেড়ি পরে নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গাটুকুর ভেতর স্বাধীনতা ভোগ করা আর কী! অনিতার ক্লাসমেট রুবিনা বেশ ঠোঁট কাটা স্বভাবের। ও প্রায়ই বলে ‘ তোরা তো একেকটা ডানাভাঙা পাখি। কোনোদিন আকাশে উড়তে পারবি না তোরা’। কলেজে এসে অনিতা বেশ বুঝতে পারছে এর অর্থ। আসলেই ওর মনের ডানা ভেঙে গেছে, কেমন যেন ভীতু স্বভাবের হয়ে গেছে মনটা। ক্লাসে ঢুকে বয়দের চোখে চোখ পড়লেই বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। গভীর স্রোতে হাবুডুবু খাওয়ার দশা হয়। রুবিনা বরাবরই একটু আলাদা ধরনের। কলেজে এসে সে কমার্স গ্রুপে ভর্তি হয়েছে। ড্যাং-ড্যাং করে ঘুরতে-ঘুরতে প্রায় সবার সাথেই খাতির জমিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সায়েন্স গ্রুপে ভর্তি হওয়া সব’কটা মেয়েই প্রায় একই রকম। টিচারের সাথে সাথে ওরা ক্লাসে যায় আবার টিচারের সাথেই বেরিয়ে আসে। আজও ইংরেজি লিটারেচার ক্লাসে সেভাবেই এসে বসে ওরা। টিচার প্রথমে অ্যাটেনডেন্স নিতে রোল কল শুরু করেন। অনিতার রোল ফিফটি থ্রি। টিচার কল করার সাথে সাথে অনিতা উঠে দাঁড়িয়ে ইয়েস স্যার বলতে যাবে, ঠিক তখনই একজন ছেলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে ‘ইয়েস স্যার’। এভাবে দু’জনের একসাথে ইয়েস স্যার বলা শুনে ক্লাসসুদ্ধ সব ছেলেমেয়ে হিহি হাসিতে ফেটে পড়ে। টিচারও হেসে ওঠেন, দুষ্টুমি করে বলেন ‘ফিফটি থ্রি রোল নম্বরের মালিক আসলে কে’? পেছন থেকে উত্তর আসে ‘ আসল মালিক ফিফটি থ্রি স্যার’! আবার এক চোট হাসি হয় ক্লাসে। অনিতা ঘামতে শুরু করে।
পরদিন হায়ারম্যাথ ক্লাসে আরেক ঘটনা ঘটে। অনিতা ক্লাসে ঢুকেই দেখতে পায় কালো ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চক পেন্সিল দিয়ে নানান সাইজের ফিফটি থ্রি নম্বরটি লিখে রাখা হয়েছে। অনিতা অবাক হয়। টিচারও অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘বোর্ডে একই নম্বর এতবার করে লিখে রাখার মানে কী’? তিনি একজন ছাত্রকে ডাস্টার দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে বলেন বোর্ডটি। পরের দিন হায়ারম্যাথ ক্লাসে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কালো ব্ল্যাকবোর্ডে নানা সাইজের ফিফটি থ্রি নম্বর আঁকা রয়েছে। আজ টিচার বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন- ‘কী ব্যাপার বলো তো! তোমরা শিশুদের মতো এভাবে বোর্ড নোংরা করেছ কেন’? পেছন থেকে উত্তর আসে, ‘শুধু ফিফটি থ্রির জন্য স্যার’। ক্লাসে শুরু হয় গুঞ্জন, ফিস ফিস, হিহি হাসি। এবার ম্যাথ টিচার ভীষণ ক্ষেপে যান। ‘স্টপ ইট অ্যান্ড গেট আউট’। যে সব ছাত্রের দাঁত বের করা চেহারা তাঁর নজরে আসে, এ রকম প্রায় বিশ/পঁচিশ জনকে তিনি ক্লাস থেকে বের করে দেন। অনিতা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করে পুরো ব্যাপারটিতে। ও ঠিক বুঝতেও পারে না ঘটনাটি তাকেই ঘিরে ঘটছে না কি অন্য কিছু! লিজার পিরিয়ডে কমনরুমে রুবিনার সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হতেই রুবিনা হৈহৈ করে ওঠে- ‘আচ্ছা অনিতা, সায়েন্স গ্রুপে তোদের মেয়েদের জন্যে নাকি আজ অনেক ছেলে ক্লাস করতে পারেনি’! অনিতা জবাব দেওয়ার আগেই এবার বাবলী কথা বলে, ‘রুবিনা তোর এত গায়ে পড়া স্বভাব কেন বল তো’! আর ছেলেদের পক্ষ নিয়ে তুই কথা বলার কে?’ ‘আমি কে সেটা পরে টের পাবি’। রুবিনা গট গট করে হেঁটে চলে যায়। এরপর থেকে থিয়োরি ক্লাসের চেহারা পাল্টে যায়। নিশ্চুপ নিঃশব্দে কাটে সে সময়। কিন্তু প্র্যাকটিকেল ক্লাসগুলোতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটতে শুরু করে। হয় কোনো বৈজ্ঞানিক অ্যাপারেটাস খুঁজে পাওয়া গেলো না, ফলে হাতে কলমে কাজটা আর শেখাই হলো না। নতুবা হয়তো কারও প্র্যাকটিক্যাল খাতাটি গায়েব হয়ে গেল। অথবা জীববিজ্ঞান ল্যাবে ডিসেকশন করার ঠিক আগ মুহূর্তে তেলাপোকা উড়ে এসে গায়ে পড়ে গেল- এ রকম নানা ঘটনা। এরমধ্যে একদিন সবচেয়ে বিব্রতকর ঘটনা যেটা ঘটলো, তা হচ্ছে অনিতার কলেজব্যাগ হাওয়া হয়ে যাওয়া। গুরুত্বপূর্ণ বই, নোট-খাতা তো বটেই ওর মধ্যে ছিল ব্যক্তিগত নোটবুক ও মোবাইল ফোন। ভয়ে ভাবনায় দিশেহারা হয়ে ওরা ক’জন মিলে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে গেলো কমপ্লেইন করতে । কিন্তু কার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করবে! অনিতারা তো বয়দের কারও নামই জানে না। সায়েন্স গ্রুপের মেয়েদের এই ক্যালাসনেস দেখে মনে হলো প্রিন্সিপ্যাল স্যারও বিরক্ত হলেন। সাধারণভাবে একটি অভিযোগ লিখে নিয়ে ওদের সেদিনের মতো বিদায় করে দিলেন তিনি। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ডিস্টার্ব করছে, মোবাইল ফোনসেট তাই সার্ভিসিং সেন্টারে দেওয়া হয়েছে বাড়িতে এ মিথ্যা তথ্য দিয়ে আপাতত, পার পেলেও সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না অনিতা। ব্যালকুনিতে পায়চারি করে আর বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটলো সে রাত। পরদিন কলেজে গিয়ে নোটিশ পেলো দুপুর দু’টায় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের চেম্বারে সায়েন্স গ্রুপের সব ছাত্র-ছাত্রীকে হাজির থাকতে বলা হয়েছে।
অনিতাদের সাধারণত, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে থিরোরি ক্লাস। দুপুর দুটো থেকে একেক দিন একেক সাবজেক্টের প্র্যাকটিকেল থাকে। গতকাল বায়োলজি ল্যাব থেকে ওর ব্যাগটি খোয়া গেছে। কিন্তু আজ সকাল এগারোটার মধ্যে খবর এলো কেমিস্ট্রি ল্যাবে একটি ব্যাগ পাওয়া গেছে, সেটি নিজের কি না, এটা শনাক্ত করতে অনিতাকে প্রিন্সিপ্যাল স্যার এখনি ডেকেছেন। অনিতা এমনিতে ভীতু স্বভাবের। কোথাও সে একা হাঁটে না। কিন্তু স্যারের চেম্বারে ওকে একাকি যেতে হলো এবং আশ্চর্যজনকভাবে ও ব্যাগ ফিরে পেলো। অনিতা কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলো না বা প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বুঝাতে সক্ষম হলো না, যে ক্লাস গতকাল হয়নি সে ক্লাসে ব্যাগ গেলো কিভাবে? প্রিন্সিপ্যাল স্যার অনিতাকে ভীষণ বকা দিলেন। ফলে ব্যাগ ফিরে পাওয়ার আনন্দের পরিবর্তে পুরো ব্যাপারটি বিষাদে পরিণত হলো। ক্লাস শেষে বাড়িতে ফিরে গিয়ে ওর মনে হলো আর কোনোদিন ওই কলেজেই পা রাখবে না অনিতা। বাবাকে বলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চলে যাবে। যে প্রতিষ্ঠানের সহপাঠীরা এতটা হৃদয়হীন, সেখানে আর একদিনও নয়। কিন্তু বাবা বিষয়টি কিভাবে নেবেন, এটা ভাবতে অনিতার খুব অস্থির লাগে। অস্থির মন নিয়ে ঘরের পাশে লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আকাশে চাঁদ নেই। রোড লাইটও নেই লোডশেডিং এর কারণে। ফলে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে। তবে বেশ কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনিতার চোখ অন্ধকারের ভাষা বুঝতে শুরু করে। রাস্তা, আশপাশের বাড়ি, গাছ সবই আবছা আঁধারেই দৃষ্টিগোচর হয়। হঠাৎ ও লক্ষ করে ওদের ব্যালকনির নিচ দিয়ে এক ব্যক্তি বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করছে যার হাঁটার ভঙ্গিটা অনিতার খুব চেনা। মানুষটি অল্প একটু জায়গার ভেতরেই পায়চারী করছে এবং তার হাতে একটি জলন্ত সিগারেট ধরা আছে। সিগারেটটি যখন সে টানছে ওটি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আবার সেটা নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে। অপরিচিত এ মানুষটির প্রতি অদ্ভুত এক টান অনুভব করে সে। কে জানে হয়তো অনিতার মতো এ মানুষটিও কোনো দুঃখবোধ থেকে এভাবে অন্ধকারে পায়চারী করছে। তবে বেশিক্ষণ মানুষটির প্রতি মনোযোগ দিতে পারে না অনিতা। ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলে মায়ের ডাকে ঘরে ঢুকে যেতে হয় ওকে। রাতের খাবার শেষে যখন বিছানায় যাবে অনিতা মোবাইল ফোনটি অভ্যাসবসে হাতে নেয়। একটি মেসেজ এসেছে আননোউন নম্বর থেকে। তাতে যা লিখা রয়েছে তার অর্থ দাঁড়ায়- ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাই জীবন।’ এ রকম আঁতেল টাইপের মেসেজ তাকে কে দিল, অনিতা বুঝতে পারে না। এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে, মোবাইলে মেসেজ পড়ে আরও বিগড়ে যায় মনটা। শরীরটা ভালো লাগছে না এই অজুহাতে দুদিন কলেজেই যায় না অনিতা। ব্যালকনিতে গিয়েও দাঁড়ায় না। দ্বিতীয় দিন ঠিক দুপুর বেলায় সেই একই নম্বর থেকে আবার মেসেজ আসে ‘যে পালিয়ে গেল সে হেরে গেল।’ অনিতার হঠাৎ মনে হয় ও একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনসহ ব্যাগ হারিয়ে যাওয়ার সাথে এই মেসেজ এর একটি সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। অনিতা তাড়াতাড়ি ওই নম্বরটিতে ফোন দেয়। কিন্তু নাহ, নম্বরটি প্রায় সাথে সাথেই বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এরপর থেকে ওই নম্বরটি সম্পর্কে অনিতার মধ্যে একটা জেদ তৈরি হয়। ওকে জানতেই হবে নম্বরটি কার? অনিতা আবার কলেজে যেতে শুরু করে। আগের চাইতে অনেক বেশি সতর্কতার সাথে চারদিক লক্ষ করে। কিন্তু কলেজের কম্পাউন্ডে পা রাখতেই অদ্ভূত এক অনুভূতি হয় তার। দুটো চোখ সারাক্ষণই যেন অনিতাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু কোন্ সে চোখ অনিতা সেটা আবিস্কার করতে পারে না। ফলে খুঁজবে কি? অচেনা সে চোখের ভাষা পড়তে গিয়ে ওর পা বরং আরও জড়িয়ে যায় সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে।
নম্বরটি কিন্তু থেমে থাকে না। থিয়োরি ক্লাস, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, দিনের আবহাওয়া এমনকি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সব কিছু নিয়েই মেসেজ আসতে থাকে ওখান থেকে। কিন্তু অনিতা রিং দিতে গেলেই সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ যেন এক খেলা! আর একটি ব্যাপার নিয়মিত হতে থাকে। বাড়িতে সন্ধ্যার পর যখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়, সেই ছায়া মানুষ একটি জলন্ত সিগারেট হাতে রাস্তায় পায়চারী করতে থাকে। ইলেক্ট্রিসিটি এলেই ছায়া মানুষ দ্রুত সরে যায়। এই ছায়া মানুষ আর মোবাইল ফোনের মেসেজ দুটো বিষয়ের মধ্যে কোনো মিল আছে কি না সেটাও আবিষ্কার করা সম্ভব হয় না অনিতার। কিন্তু একটি ব্যাপারে অনিতা পরিষ্কার ধারণা পায়, তা হলো- মোবাইল ফোনে মেসেজ দাতা মানুষটি অত্যন্ত সমাজ সচেতন ব্যক্তি। সমাজে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি অনাচারের বিরুদ্ধে মেসেজে ইঙ্গিত থাকে আর থাকে প্রতিকারের প্রত্যয়। দেশ ও সমাজ নিয়ে ও এর আগে কখনো এভাবে ভাবতে দেখেনি কাউকে। নিজেও ভাবেনি। অনিতা সত্যি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। ঘটনাটি এমন দাঁড়ায়, দুনিয়ায় কোথায় কী ঘটলো, এর জন্য অনিতাকে আর টিভি কিংবা পত্রিকার দ্বারস্থ হতে হয় না। আগেই মোবাইল ফোনে মেসেজ আকারে চলে আসে ঘটনার বিবরণ। সেই সাথে থাকে একটি মন্তব্য।
একবার ঢাকার এক সোয়েটার কারখানায় বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগলো। ওই কারখানার শ্রমিকদের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত সিঁড়িটি ছিল অত্যন্ত কনজাস্টেড প্রকৃতির। ঘটনার সময় কারখানার মূল ফটকে ছিল তালা। ফলে শ্রমিকরা তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে আহত তো হলোই বেরিয়ে যাওয়ার পথ না পেয়ে পুড়ে মারা গেল অনেকেই। ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে মেসেজে মন্তব্য এলো- ‘প্রতিটি আয়েশের প্রাসাদের ইটের গাঁথুনিতে থাকে শ্রমিকের ঘাম, রক্ত আর কান্না।’ চমৎকৃত হয় অনিতা। ও এর আগে কখনো এভাবে ভাবেনি। সত্যিই তো আরাম আয়েশের জন্য যারা প্রাসাদ তৈরি করে, তারা নিজ হাতে তো তা করে না। বরং প্রতিটা আরামপ্রদ বস্তুর পেছনেই অন্য মানুষের যে নেপথ্য অবদান থাকে তার কথা কোথাও লেখা থাকে না। অনিতার কোনো উপায় থাকে না মেসেজগুলোর প্রতিউত্তরে কিছু বলা বা লেখা। তাই এক ধরনের অতৃপ্তি নিয়ে ওর দিন কাটে।
এদিকে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে শুরু হয় পিকুলিয়ার টাইপের এক ঘোলাটে পরিবেশ। যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে নেই, এমন একটি রাজনৈতিক দল হরতাল অবরোধ ডেকে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়, অন্যপক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে সেটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। পাবলিক পরিবহন, সরকারি স্থাপনা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় চলতে থাকে চোরাগুপ্তা হামলা আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। পেট্রোলবোমা নামক অদ্ভুত ধরনের এক অস্ত্রের আঘাতে কত মানুষ যে আহত ও নিহত হতে থাকে প্রতিদিন তার ইয়ত্তা নেই । পুড়ে যাওয়া এ মানুষগুলোর আর্তনাদ আর চেহারার বিভৎস রূপ দেখে হাত পা ঠাণ্ড হয়ে আসতে চায়। অথচ টেলিভিশনের পর্দায় রাজনৈতিক দলগুলো শুধু পরস্পরকে দোষারোপ করেই যাচ্ছে। এ যেন জন-মানুষের জীবন নিয়ে এক ছিনিমিনি খেলা! ফলে সাধারণ মানুষের জীবন এতটাই অনিরাপদ হয়ে পড়ে যে, অনিতার বন্ধুরা কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অনিতা নিজেও বাইরে বেরোনোর সাহস পায় না। তবে সবকিছু মিলে সামাজিক অস্থিরতা যখন তুঙ্গে তখন আশ্চর্যজনকভাবে মোবাইলের মেসেজওয়ালা নীরব হয়ে যায়। এমনকি সন্ধ্যায় ছায়ামানুষের যে ঘোরাফেরা সেটাও বন্ধ হয়ে যায় প্রায় একইসাথে। অনিতা ঠিক মেলাতে পারে না। মানুষটিকে সে কখনো দেখেনি। মানুষটির সাথে ওর কখনো কথাও হয়নি। কিন্তু মোবাইল ফোনের মেসেজ পড়ে যেটুকু চিনেছে, তাতে দেশের এরকম পরিস্থিতিতে মানুষটির নীরব থাকা বেশ বেমানান। তাহলে কি মানুষটি কোনো বিপদে পড়েছে! বিপদের কথা মনে হতেই অচেনা, অদেখা মানুষটির জন্য ওর খুব দুশ্চিন্তা হতে শুরু করে। অস্থির লাগে মনের মধ্যে। কিন্তু কিছু করার থাকে না অনিতার। কারণ সারা দেশের মানুষই একরকম গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। যাদের নিতান্তই বেরোতে হয়, তারা জীবন বাজি রেখেই বের হয়। প্রচণ্ড শীতে দমবন্ধ করা এই পরিবেশের মধ্যে কাটে প্রায় মাস খানেক।
এরপর পরিস্থিতি আবার বদলে যেতে শুরু করে। মানুষের ভেতর একটা নীরব শক্তি দানা বাঁধতে দেখা যায়। সুবিধাবাদীদের বুড়ো আঙুল দেখানোর শক্তি। সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজেদের মতো জীবন গড়ে নেওয়ার শক্তি। শীতশেষে প্রকৃতির মধ্যেও জেগে ওঠে এক চনমনে ভাব । এক ফাল্গুনের দিন, অনিতার মনে হয় প্রকৃতির প্রতিটি গাছই যেন নতুন পাতা দিয়ে তাদের শরীর সাজিয়ে নিয়েছে। তাহলে ওরা ঘরে বন্দি হয়ে আছে কেন? উত্তর পেতে অনিতার একটুও সময় লাগে না। আবার মোবাইল ফোন জেগে ওঠে। মেসেজ আসে- ‘পরিস্থিতির কাছে যারা মাথা নত করে তারা কাপুরুষ।’ শুধু এটুকু বলেই শেষ হয় না মেসেজ। জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুনের মতো দৃপ্ত শপথ থাকে সে মেসেজে- ‘আসছে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনারে আমরা বদলা নেব সব অন্যায়ের। আশা করি কালো পাড় সাদা শাড়িতে তোমাকে সেদিন পাশে পাব। আমার হাতে জড়ানো থাকবে পলাশ ফুলের মালা। হয়তো আমাকে চিনে নিতে কষ্ট হবে না তোমার।’ যে মানুষটিকে খুঁজতে এত ভাবনার জাল বুনেছে সে দিনের পর দিন, সেই মানুষটি নিজের থেকেই আজ ধরা দিতে যাচ্ছে। দম বন্ধ করা নির্জীব পরিবেশ থেকে মুহূর্তেই দম বন্ধ করা এক আনন্দের অনুভূতি অনিতার সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। মেয়েদের প্রতিষ্ঠানে পড়া এক সময়ের ভীতু স্বভাবের অনিতা হঠাৎ করেই যেন খুব স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। সব জড়তা, সব লাজ, সব ভয়কে ঠেলে দিয়ে ওর মনে হয় অনেক দায়িত্ব সামনে অপেক্ষা করছে তার জন্য। এরমধ্যে অন্য বন্ধুরাও যোগাযোগ করে অনিতার সাথে। তারা জানায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
পরের কটা দিন অনেকটা ঘোরের মধ্যে কাটে অনিতার । প্রভাতফেরির কালো পাড় সাদা শাড়ি, কালো টিপ, সাদা-কালো কাঁচের চুড়ি সব যোগাঢ় করতে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কেটে যায়। প্রভাতফেরির আগের রাতে ঘুমই হয় না। যে মানুষটির সাথে আগামীকাল দেখা হবে তার নাম জানা নেই। মানুষটি দেখতে কেমন হবে? প্রথম কোন কথা দিয়ে শুরু করবে ওরা? নানান ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে অনিতার মাথায়। রাত পেরোলে সাদা শাড়ি, কালো টিপ আর কাঁচের চুড়িতে নিজেকে সাজিয়ে নেয় সে। তারপর খানিকটা অন্ধকার থাকতে থাকতেই কলেজের পথে রওনা হয়। সকালের মিষ্টি আলোয় যখন সে কলেজ গেটে পৌঁছায়, তখন অনেকেই এসে গেছে। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ছিল তাদের সম্মান জানাতে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রভাতফেরির আয়োজন হয়ে আসছে এ দেশে। এদিনটায় মানুষের মনের মধ্যে অন্যরকম একটি আবেগ কাজ করে থাকে। তবে আজকের সকালটা অনিতার চোখে আরও কিছু আলাদা বিশিষ্টতা নিয়ে ধরা দেয়।
কলেজ গেটে প্রায় সবার মুখ থমথমে। কিছু একটা ঘটেছে কোথাও, এই রকম আভাস। গেট থেকে শহীদ মিনারের দিকে হাঁটতে থাকে অনিতা। হঠাৎ কানে আসে কথাটা। কাল সন্ধ্যায় সূর্যকে পেট্রোলবোমা ছোঁড়া হয়েছে। ওর সমস্ত শরীর ঝলসে গেছে। শহীদ মিনারে আসছে সূর্যের লাশ। ভাষা শহীদদের সাথে-সাথে সূর্যকেও ফুল দিয়ে সম্মান জানানো হবে। কে সূর্য? কেন তাকে বোমা ছুঁড়ে মারা হলো? অনিতার বুকের ভেতর তীরের ফলার মতো প্রশ্নগুলো গিয়ে বেঁধে। কলেজ শহীদ মিনারের বকুলতলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ও দেখতে পায় লাশ কাঁধে করে এগিয়ে আসছে বিশাল জনতার ঢল। হঠাৎ অনিতা স্পর্শ পায় কারো। রুবিনা! রুবিনা চেপে ধরেছে অনিতার হাত। ওর চোখ টকটকে লাল। ‘সূর্যটা এভাবে চলে যাবে কখনো ভাবিনিরে। জানিস ফুল কিনে ও যখন ফিরছিল অন্ধকারে গলির মধ্যে কাপুরুষগুলো তখন ওর মোটর সাইকেল লক্ষ করে বোমা ছুঁড়ে মারে। আমি ভাবতেই পারি না মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে!’ কথাগুলো বলে রুবিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ‘তোকে দেবে বলে বিশেষ অর্ডার দিয়ে ও মালা গেঁথে ছিল, জানিস। ও তোকে কতটা ভালোবাসতো সেটা তো তুই জানতেই পারলি না অনিতা।’ রুবিনা আবার কাঁদতে থাকে। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অনিতা। ও রুবিনার মতো কাঁদতে পারে না। ঘটনার বিহ্বলতা ওর সমস্ত আবেগকে যেন পাথর চাপা দিয়ে দেয়। নিরুত্তাপ মুখে অনিতা রুবিনার হাত ছাড়িয়ে নেয়, তারপর জনতার ঢলের ভেতরে চলে যায়।