একটু বেশি বয়সেই কুলসুমা বিবির সঙ্গে আবু হানিফের বিয়ে হয়। ২৪ বছর বয়স গ্রামের মেয়ের জন্য একটু বেশিই বটে! হানিফের সঙ্গে ২/৩ বছরের বেশি পার্থক্য হবে না। এ নিয়ে তখন কিছুটা সমালোচনাও হয়েছিল। কিন্তু কুলসুমের রূপ আর গুণের কাছে সেসব আলোচনা ধোপে টেকেনি। বিয়ের পর আবু হানিফ একেবারে যাকে বলে বুদ্ধু, তেমন হয়ে যায়। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, সারাদিন শুধু বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আল্লা গো! মাইনষে এত সুন্দর হয়!—কুলসুমের হাতের আঙুল ধরে, পায়ের পাতা ধরে, লম্বা লম্বা চুলগুলো ধরে দেখে আর কিছুক্ষণ পরপর এই কথা বলে! লজ্জায় কুলসুম পাকা টমেটোর মতো হয়ে যায়—ছি! কেমুন শরমের কথা! মাইনষে কী কয়!
হানিফের রোখ চেপে যায়। মাথায় আগুন ধরে যায়—আরে! আমার বিয়া করা বউরে যা মন চায় তা কমু, মাইনষের কী!
নাহ, কুলসুম বিবি কিছুতেই বোঝাতে পারে না, বউ নিয়ে এ রকম মেতে থাকা, বউয়ের রূপেগুণে মুগ্ধ হয়ে পিছেপিছে ঘোরা আমাদের সমাজ, সংসারে কেউ ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। ইতোমধ্যেই বউ-পাগলা, বউয়ের ভেড়া এমন আরও কতসব নামে যে লোকে ডাকতে শুরু করেছে, তার ইয়ত্তা নেই! আগে তবু আড়ালে ডাকতো, এখন তো অনেকে মুখের ওপরই বলে।
শাশুড়ি আর ননদদের কাছে শুনেছে কুলসুম, হানিফ ছোটবেলা থেকেই ভীষণ একরোখা আর বাউণ্ডুলে। তিন মেয়ের পর দশ বছর আবু ফজল দম্পতির কোনো সন্তান হয়নি। অনেক তাবিজ-কবজ, ঝাড়ফুঁকের পর হানিফ গর্ভে আসে। তিন মেয়ের পর ছেলে হওয়ায় তার আদরও ছিল বেশি। এ কারণেই হয়তো এমন হয়ে থাকবে। বাবা আবু ফজলের মুদি দোকান ছিল। ১০/১২ বছর বয়স থেকেই ছেলেকে দোকানে নিয়ে যেতো। পাশে বসিয়ে এটা-ওটা শেখাতো।
—বুঝলি হানিফ, আমি মরলে তরেই এই দোকান চালান লাগবো। সংসারের হাল ধরন লাগবো।
হানিফ মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতো না। তার ভালো লাগতো, গোলাপি চকচকে কাগজে মোড়ানো গ্লুকোজ বিস্কিট আর কাঠি-লজেন্স খেতে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হানিফের বিষয়বুদ্ধি জ্ঞান বাড়ছিল না বলে আবু ফজলের চিন্তার শেষ ছিল না। এ নিয়ে হানিফের মা’কে গালমন্দও করতো—বিয়াইলা তো পরথম তিনটা মাইয়া, তারপর যা-ও পোলা দিলা, হেইডাও বোকা কিসিমের! হানিফের মা নিজেকে অপরাধী ভেবে মাথা নিচু করে সমস্ত গালাগাল হজম করতো। যখনই সুযোগ পেতো, হানিফের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝাতো—বাপধন আমার, তুমি আমাগো একটা মাত্র পোলা, সাতরাজার ধন, সোনামানিক, তুমি অখন বড় হইতাছ, সংসারের কিছু দায়দায়িত্ব নেওন লাগব। তোমার বাপ অসুইখ্যা মানুষ। হেরে একটু সাহায্য করন লাগবো। তোমার বাপে মইরা গেলে তুমি চলবা কেম্নে?
হানিফ কী আর এসব কথা ধৈর্য ধরে শোনার ছেলে! মহাবিরক্তি নিয়ে চলে যেতে যেতে বলে—কী যে অলুইক্ষণা কথা কও মা, বাপজান আমার মরতো না, আমি অহন গেলাম। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস পড়ে মায়ের। সারাদিন গাছে চড়া, মাছ ধরা, লাটিম ঘোরানো, মার্বেল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো এরকম সব কাজ করা আর টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। ছোটবেলায় তাও দোকানে বসিয়ে রাখা যেতো। যতই বড় হচ্ছে, ততই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
পঁচিশ বছরের যুবক হানিফ বেশ লম্বা-চওড়া হয়ে গায়েগতরে বেড়ে উঠলেও বৈষয়িক বুদ্ধিতে আগের মতোই উদাসীন থেকে যায়। এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কাশিতে ভুগতে ভুগতে একদিন আবু ফজল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। হানিফের মা দুই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। হানিফের খামখেয়ালিতে দোকান-ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে সময় লাগলো না। তিন মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেক ধারদেনা হয়েছিল আবু ফজলের। পাওনাদারদের খিস্তিখেউড়ে হানিফের মায়ের দিশেহারা অবস্থা।
প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনদের একটাই কথা। বিয়ে করিয়ে দাও হানিফকে। দেখবে সংসারে মন বসবে। একে তো নিজেরাই চলতে পারে না। তার ওপর পরের মেয়ে এনে বোঝা বাড়াতে হানিফের মায়ের মন সায় দিচ্ছিল না।
শেষমেশ বিয়ে করলো হানিফ। বিবি কুলসুমা পাশের গাঁয়ের মেয়ে। শক্তপোক্ত শরীরের বাঁধন, গায়ের রঙ চাপাফুলের মতো মিষ্টি। জলতরঙ্গের মতো টুংটাং হাসে। গোসলের পর ভেজা চুলের পানিতে নিতম্ব ভিজে যায়। চুল ঝাড়ার শব্দে বুকের ভেতর তুফান ওঠে হানিফের। আল্লাহ যেন রূপের ভাণ্ডার উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে কুলসুমাকে। অন্তত হানিফের এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই!
কুলসুমাকে ঘরে তুলতেই রাতারাতি বদলে যায় হানিফ। সবাই দেখে আর কপালে চোখ তুলে বলে—কী ছেলে, কী হয়ে গেলো!
বিবাগী হানিফ এখন পুরোপুরিই সংসারী। সময়মতো দোকানে যায়, বাজার-সওদা করে, নতুন মাল তোলে, মায়ের জন্য পান-সুপারি আনে, বউয়ের জন্য আনে কাঁচের চুড়ি, আলতা! দোকানের চেহারা ফিরতে সময় লাগে না। বেচাকেনা বাড়ে, ব্যবসা বড় হয়। পাওনাদারের দেনাও মিটতে থাকে একটু একটু করে। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো নয় কুলসুমা। অন্যরা যখন অবসরে আড্ডা দেয়, গাঁয়ের বৌ-ঝিদের গিবত আর নিন্দায় ব্যস্ত থাকে, কুলসুমা তখন বাড়তি রোজগারের জন্য সেলাই মেশিনে কাজ করে, কাঁথা বানায়, বিছানার চাদরে ফুল তোলে। তবে মুখে হাসিটা লেগে থাকে সবসময়। কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া হয়েছে বলেও শোনেনি কেউ। হানিফের সঙ্গেই কুলসুমার যত গল্প, যত আহ্লাদ।
তরতর করে সময় কোন দিকে চলে যায়, হুশ থাকে না। হানিফের মা মুখভরে হাসে আর বলে, বউ আমার পয়মন্ত, ভারি লক্ষ্মী। বউয়ের টানে ছেলে আমার দোকান আর ঘর ছাড়া কোথাও যায় না। পাড়াপ্রতিবেশীরাও পান চিবুতে চিবুতে হানিফের মা’র কথায় সায় দেয়।
কথা সত্যি। হানিফ একদম বউপাগলা। কুলসুমকে আদর সোহাগ দিয়ে সকালে দোকানে যায়। বেলা এগারোটার দিকে চা খাওয়ার উসিলায় বাসায় আসে, দুপুরে ভাত খেতে আসা ছাড়াও বিকেলেও একবার কুলসুমকে দেখতে আসা চাই হানিফের। একটানা কয়েকঘণ্টা বউয়ের মুখটা না দেখলে হানিফের বুকের ভেতরটা খাঁচার পাখির মতো ছটফট করে।
সবই ঠিক ছিল। ভাইয়ের উন্নতিতে ননদ তিনজনও নাইওর এলো। এসেই তারা কুলসুমের ওপর নজরদারি শুরু করলো। নিজেরা নিজেরা কানাকানি করার পর মাকেও জিজ্ঞেস করলো—কী গো মা, তোমার রূপবতী বৌমার তো শরীরে কোনো লক্ষণ দেখি না। পাঁচ বছর গিয়া ছয় বছরে পড়লো, কোল তো খা খা করে! তুমার পোলা দেইখা আইজও ওই বাঞ্জা মাইয়ার মইধ্যে মইজা রইছে। আমগো সোয়ামি হইলে কুনসুম তালাক দিয়া দিতো। কী দিয়া জাদুটোনা করছে আল্লাহ মালুম!
একদম ঠিক কথা। হক কথা—মেজো বোনের সঙ্গে বাকি দুজনও তাল মেলালো। মাও দমে গেলো। আসলে আবু ফজলের মৃত্যুর পর ব্যবসা, সংসার দাঁড় করাতে গিয়ে এই ব্যাপার নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। দুই-একবার যে তার মাথায় কথাটা আসেনি, তা নয়। কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। বোনদের সঙ্গে আরও কিছু ঈর্ষাকাতর নিন্দুক জুটলো। পুরো পাড়ায় মোটামুটি কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। হানিফের বউ বাঁজা। এই সুযোগে গ্রামের যেসব বৌ-ঝিরা হানিফ-কুলসুমের ভালোবাসাবাসি, মাখামাখি নিয়ে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতো, তাদের পোয়াবারো হলো। রসিয়ে রসিয়ে নানা রংচং মিশিয়ে কুলসুমের নিন্দা করতে লাগলো—জন্মের বেহায়া মাইয়া, দিনে দুপুরেও জামাইর লগে ঢলাঢলি করে! আস্তাগফিরুল্লাহ! আল্লার দুনিয়ায় কী লাজ হায়া সব উইঠা গ্যাছে!
আসলে হানিফ আর কুলসুমের বোঝাপড়াটা খুব ভালো ছিল। বিয়ের পর থেকেই চুটিয়ে প্রেম করে চলেছে। নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে তারা তৃপ্ত, সুখী। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া কিংবা মন কষাকষি হয়নি। সন্তান না হওয়া নিয়েও মাথাব্যথা নেই তাদের। কুলসুম সারাদিন বাড়িঘর ঝকঝকে-তকতকে করে, শাশুড়ি আর স্বামীর পছন্দের রান্না করে, বাড়ির পেছনের জমিতে শাকসব্জির চাষ করে, হাঁসমুরগি পালে, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করে। তার চেয়েও বেশি করে হানিফের আদরযত্ন। দোকানের উন্নতির জন্য পরামর্শ দেয়। নিজের জমা টাকার কিছু অংশ দিয়ে বাড়ির দুটো কামরা নতুন করে সাজিয়েছে।
এত রূপ আর গুণের কারণে কুলসুমকে হিংসা করার মানুষের অভাব ছিল না। অনেক পুরুষেরাই তাদের স্ত্রীদের কুলসুমের তুলনা দিয়ে হেয় করতো। আর মহিলারা ভাবতো, কুলসুমের কী এমন জাদু আছে, যা দিয়ে এত বছর পর্যন্ত স্বামীর কাছে শারীরিক আকর্ষণ বজায় রেখেছে! হানিফ এখনও কী রকম পাগলের মতো কামনা করে কুলসুমকে। অথচ তাদের স্বামীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এক, দেড় বছরের মাথায়!
এবার নিন্দুকদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। এতদিন যেগুলো গুণ হিসেবে দেখা হতো, সেগুলোই এখন দোষে পরিণত হলো। কোনো মেয়ে সুন্দরী আর আকর্ষণীয় হলে আশেপাশের মেয়েরা নিজ দায়িত্বেই তার শত্রু বনে যায়। আর তার স্বামী যদি সেই মেয়ের জন্য পাগল হয়, তবে তো কথাই নেই! হিংসার আগুন তীব্রতা ধারণ করে!
ননদেরা যার যার বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু হানিফের সংসারে জ্বলতে থাকে তুষের আগুন। কুলসুমা বুদ্ধিমতি। সব বোঝে। এক দুপুরে হানিফ যখন আদর করতে ব্যস্ত, কুলসুমা প্রসঙ্গটা তোলে—তুমি আরেকখান বিয়া করো। আমি বাঞ্জা মাইয়া। আমার মনে লয়, বাইচ্চাকাইচ্চা হইবো না।
ভীষণ রেগে যায় হানিফ—আর কুনোদিন যেন এই কথা না শুনি। তাইলে কিন্তুক বাড়িতই ফিরুম না। বাইচ্চা লাগব না। আমার শুধু তুমি হইলেই চলবো।
এত গোয়ার্তুমি করে আর রেগে আগুন হয়ে যায় হানিফ, কুলসুমা আর এ ব্যাপারে কথাই তুলতে পারে না। এমনকি চিকিৎসা করার কথাও না। হানিফের এক কথা—আমি যদি বাঞ্জা বউ লইলা সুখী হই, আর মাইনষের কাম কী আমার সংসারে নাক গলাইবার। আমি কার খাই না পরি!
তবে হানিফের মা আর বউয়ের চেষ্টা থেমে থাকে না। হানিফকে না জানিয়ে নানা জায়গা থেকে পানি-পড়া, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-তুমার চালিয়ে যেতে থাকে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় হানিফ আর কুলসুমার সংসারে নতুন অতিথি আর আসে না। হানিফের অনুপস্থিতিতে মা বিলাপ করে আর কাঁদে—একটামাত্র পোলা আমার, বংশ তো নির্বংশ হইয়া যাইবো! আমাগো বংশের বাত্তি জ্বালাইব কে?
কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় কুলসুমা। তার আকর্ষণ, তার প্রেম থেকে মুক্ত করতে হবে হানিফকে। অতি আদরের, অতি যত্নের স্বামীর মঙ্গলের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য তাকে এইটুকু বিসর্জন দিতে হবে। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো হয়ে যেতে হবে, যাদের প্রতি স্বামীদের আকর্ষণ খুব বেশি দিন থাকে না।
শূন্য দৃষ্টিতে স্বামীর ঘরে ফেরার পথের দিকে চেয়ে থাকে কুলসুমা।