এক.
হঠাৎই শুরু। বলা নেই, কওয়া নেই, কোত্থেকে উঠে এলো উড়োনচণ্ডী বাতাস। অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। একরাশ ধুলাবালি উড়ে এসে চোখে ঢুকে গেলো। চোখ বুঁজে, প্রায় অন্ধের মতো হাতড়ে উঠোনে মেলে দেওয়া কাপড়গুলো নিয়ে দৌড়ে এসে রুমের দরজা বন্ধ করলো দোলন। শীত ফুরোলো—স্মরণ করিয়ে দিতেই প্রকৃতির এ আয়োজন। আস্তে করে জানালার একটা পাল্লা খুলতেই আবার একদমক হাওয়া এসে ঢুকে গেলো চোখে। তাড়াতাড়ি পাল্লাটা লাগিয়ে দিয়ে দুই হাতে চোখ কচলায় দোলন। বালু ঢুকেছে আবার একরাশ। ইশ! ঝড়ের প্রকৃতি দেখাটা মাঠে মারা গেলো। অবশ্যই প্রকৃতি বলতে তেমন কিছু নেই আশেপাশে। যে দিকে চোখ যায় খোঁড়াখুড়ির দৃশ্য, নতুন বিল্ডিং ওঠার তোড়জোড়। মানুষ বাড়ছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিল্ডিং।
মাথার ওপর দুমদাম শব্দে ঢিল ছুড়ছে কি কেউ? টিনের চালে কে ছুড়ছে অমন বিরামহীন? ভাবতে ভাবতেই দোলন টের পেলো, শোঁ শোঁ শব্দটা আর নেই। তার স্থানে তুমুল শব্দে টিনের চালে দ্রিমদ্রাম ঢিল পড়তে শুরু করেছে। শিলাবৃষ্টি! খুশিতে মনটা নেচে উঠলো তার। ভয়ও পেলো। এমন প্রচণ্ড শব্দে শিলা পড়তে কখনো দেখেনি সে, শোনেওনি। আর এটা মোটেই ঝড়ের সময় নয়। তাহলে? প্রবল কৌতূহলে আবার জানালার একটা পাল্লা সামান্য খুললো দোলন। খুলেই বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেলো তার। সামনের খোলা জায়গাটুকু সাদা। কয়েক পুরুত উঁচু শিলা জমে গেছে। অন্ধকার কেটে গেছে অনেকটাই, বৃষ্টি নেই, বাতাস নেই, শুধু শিলা পড়ে চলেছে ধুমধাম। টিন বুঝি ফুটো হয়ে যাবে, মনে হলো তার। ভয়ে ভয়ে ওপরে তাকিয়ে একবার দেখলো—না, তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না আপাতত। বাতাস থেমে যাওয়ায় পাল্লাটা এবার ভালো করে খুলে দিলো। বিশাল সাইজের একেকটা শিলা পড়ছে আকাশ থেকে। কারও গায়ে মাথায় পড়লে মারাত্মক আহত হওয়ার আশঙ্কা। অবাক হয়ে দেখলো দোলন। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, আকাশ থেকে সমানে পড়ছে বিশাল সাইজের এক একটা শ্বেত-শুভ্র শিলা। পড়েই ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনোটার ওজন আবার কমসে কম একশ দু’শ গ্রাম হবে। নিচে কেউ যেন সাদা বরফ বিছিয়ে দিয়েছে কয়েক পরত! হঠাৎ পাশের বাড়িটায় চোখ পড়ে গেলো দোলনের। ও বাড়িতে প্রাচীর ওঠেনি এখনো। এ বাড়ির পেছন দিক থেকে স্পষ্ট ও বাড়ির সামনেটা দেখা যায়। দৃশ্যটা মনের মধ্যে গেঁথে নিলো দোলন। আহা! জীবন সত্যিই মায়াময়।
ইন্দির ঠাকরুণ সাদা থানটা অনেকখানি তুলে মাথায় একটা টিনের গামলা নিয়ে ছুটে ছুটে উঠোনে যাচ্ছে, একটা ক’রে শিলাখণ্ড কুড়িয়ে আবার ছুটে যাচ্ছে বারান্দায়। তার ফোকলা মুখ হাসিতে উজ্জ্বল। তাকে দেখে কে বলবে, বুড়িটা বাতের ব্যথায় সারাদিন বারান্দায় পা মেলে বসে আকাশ দেখে, রাস্তা অতিক্রমনরত মানুষ গোনে! ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে নামছে তার সাত বছরের নাতিটাও। তারও মুখে হাসির খই ফুটছে, মাথায় ইয়া বড় সাইজের একটা গামলা নিয়ে সেও শিলা কুড়োচ্ছে সমানে। মাঝে মাঝে, বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তখন নাতি-ঠাকুমা ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে উঠছে বারান্দায়। তারপর, আবার তাদের আনন্দ উছলে পড়ছে, আবার খুশির বাঁধ ভাঙছে, শিশুর নির্মল সারল্য নিয়ে আবার নেমে পড়ছে শিলা কুড়োতে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো দোলন। বুড়িটা আহ্লাদে আটখানা হয়ে হাসছে, শিলা কুড়িয়ে ফোকলা মুখে চুষছে, নাতির দিকে তাকিয়ে হাসছে ফিকফিক। নাতিও সমানে ছুটছে এদিক-সেদিক। ফোকলামুখো বুড়িটাকে সে ইন্দির ঠাকরুণ নাম দিয়ে ফেললো মনে মনে, নাতিটাকে অপু। বুড়িটা সারাদিন ঘরের গ্রিলঘেরা বারান্দার কোণায় বসে ছেলে-বউয়ের মুখঝামটা খায়, শাপশাপান্ত করে যখন তখন। শুধু নাতিটার সঙ্গে তার গভীর প্রেম। সকাল-সন্ধ্যায় নাতির সঙ্গে বসে বসে সাতরাজ্যির গল্প করে। ফিকফিক হাসে। দোলনের খুব ইচ্ছে বুড়ির কাছে গিয়ে একদিন গল্প শুনবে জমিয়ে। কেন যেন বুড়িটাকে দেখলেই ইন্দির ঠাকরুণকে মনে পড়ে।
আনমনে বুড়ি আর তার নাতির খুনসুটি দেখে দোলন। আকাশ অনেকটা ফাঁকা। মেঘ সরে গেছে। রোদ উঠেছে কড়া। বুড়ি তার নাতিটাকে নিয়ে বারান্দায় বসে একটা কাঁসার গেলাসে জমানো শিলাগুলোর মধ্যে সূতো ফেলে কী এক খেলায় মেতেছে। কিশোরীর মুখের মতো উজ্জ্বল, আনন্দময় মুখ। নাতিটি গভীর আগ্রহে দেখছে দাদির কর্মকাণ্ড। আনন্দে ফেটে পড়ছে সেও। বুড়িকে দেখে মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার চে’ আনন্দময় কিছু নেই আর। জীবনের সঙ্গে তার তুমুল প্রেম, কঠিন পিরিতি।
দুই.
অফিস থেকে ফিরে টিভি পর্দায় চোখ রেখে সবে চায়ে চুমুক দিয়েছে মানস, অবসাদে গা এলিয়ে সোফায় আধশোয়া হয়েছে সবে, তখনই হঠাৎ কানখাড়া হয়ে গেলো তার। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে উঠলো ভীষণ। শুরু হয়ে গেছে। শালা! একটু কি শান্তি মিলবে না জীবনে! মিলবে নাকি সামান্য স্বস্তি! সারাদিন অফিসে গাধার খাটুনি, বসের ঝাড়ি, সহকর্মীদের কূটকচালি, টিটকারি, রাস্তার ভোগান্তি, বাজারের ঝুটঝামেলা, জীবনের পরতে পরতে লেগে থাকা হাজাররকম অপমান, অশান্তি আর অস্বস্তিকে সহ্য করে, পাশ কাটিয়ে, বাসায় ফিরে একটু যখন শান্তি খোঁজে সে, তখনই শুরু হয় রাবণের যুদ্ধ! মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করে। শালা! সবিতা না হয় পরের মেয়ে, স্বার্থপর, বোঝে না কিসে মানসের স্বস্তি, কিসেই বা শান্তি! কিন্তু রোহিণী! সেও কি বোঝে না ছেলের শান্তি কিসে!
সব শালা স্বার্থপর! এমনকি নিজের মা-ও! বিড়বিড় করে মানস। চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে কাপটা সরিয়ে রাখে পাশের টি টেবিলে। মানব!—কড়া গলায় ডাকে।
আসি বাবা!—খেলা ফেলে দৌড়ে আসে মানব। বাবাটা ভারী বদমেজাজি তার। গলার স্বরেই সে বুঝে নিয়েছে, বাবার মেজাজ খারাপ।
ডাকছ বাবা?—মানসের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে মানব। মানস তাকায়। ছেলেটার মুখে বাবার আদল। তাকালেই কেমন মায়া উছলে ওঠে বুকে। ওর বড় বড় চোখে পৃথিবীর তাবৎ বিস্ময় আর সারল্য যেন উপুড় করে দিয়েছে কেউ। মুখ ফিরিয়ে নেয় মানস। টিভি পর্দায় চোখ রেখে বলে, কী হয়েছে রে? তোর মা-ঠাকুমা ঝগড়া করছে কেন?
কী আবার হবে! ও তো রোজ হয়! ঠাকুমার নিরামিষে ভুল করে আমিষের চামচ ডুবিয়ে দিয়েছে মা।
তোর পড়া শেষ হয়েছে?
হুঁউউ! সেই কখন! এখন খেলছি তো!
কী খেলছিস?
কত্ত খেলা! এতক্ষণ গাড়ি গাড়ি খেলেছি। বাবা, আসো না আমরা এবার বাজার বাজার খেলি? খেলবে বাবা?
মানস চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আবার ছেলের দিকে। লোভে, উত্তেজনায় চকচক করছে তার চোখ। কে কোথায় ঝগড়া করছে সে নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই তার। প্রতিদিন এমন ঝগড়া দেখে, মিটতেও দেখে, এসব জীবনেরই অপরিহার্য অংশ বলেই জানে সে। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানস। তারপর বলে, আয় খেলি।
রান্নাঘরে তখনও রোহিণী-সবিতার গলা চলছে সমানে। কেউ কাউকে ছাড় দেবে না তিলমাত্র। বিনাযুদ্ধে নাহি দেবে সূচাগ্রমেদিনী।
মেঝেতে পণ্য সাজিয়ে আপণ খুলে বসে মানব। মনোপলি বিজনেস। সে একাই বিক্রেতা এখানে। দাম হাঁকে চড়া। তবে ব্যবসায় ধ্বস নামে তার। জমে না তেমন। কারণ ক্রেতা বলতেও ওই একজনই। মানস। তার বাবা। সে যদি বলে পাঁচটাকা, মানস তবে একটাকা বলে সেই যে টিভিতে চোখ রাখে, আর কোনো কথা পর্যন্ত কয় না। ফলে তাকে অগত্যা একটাকায়ই রফা করতে হয়। শেষে বিরক্ত হয়ে মানব বলেই বসে, ধুর বাবা! তুমি তো খেলতেই পারো না একদম! আমি পাঁচটাকা বললে তুমি বলবে দুই টাকা, তখন আমি বলব, না, চার টাকা! শেষে আমি তিনটাকায় রাজি হয়ে যাব, বুঝলে? এরকম খেললে তো এক্ষুনি এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে খেলা!
মানবের শেখানো তরিকায় খেলা কিছুটা গতি হয়তো পেতো, তার আগেই ঝড়ের বেগে রুমে প্রবেশ করে সবিতা। চোখ-মুখে ঘোর আষাঢ়। বিরক্ত মানস অগ্রাহ্য করতে চাইলো তাকে। মন দিতে চাইলো মানবের সাজানো পসরায়। কিন্তু সবিতা তা হতে দেবে না। সে কান্না জুড়ল হাপুস নয়নে। রোহিণী মোটেই সহ্য করতে পারে না তাকে, একদম দেখতে পারে না দুই চোখে। অকারণে তার পেছনে লাগে। সব কাজে খুঁত ধরে, সারাক্ষণ খোঁচা দিয়ে কথা বলে।
ধৈর্য রাখা মুশকিল হলো মানসের। বিরক্ত, ক্রুদ্ধ হয়ে সে বললো, তুমিই বা বেছে বেছে মা’র অপছন্দের কাজগুলো করতে যাও কেন? মা যেগুলো পছন্দ করে না সেগুলো না করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!
ওহ্! আমাকে তাহলে উনার পছন্দ মেনে চলতে হবে?
হবে বৈকি! উনি আমার মা!
আমি? আমি কেউ নই? আমার কোনো স্বাধীনতা নেই?
অফিস শেষে এসেছি। রাতদুপুরে এসব অশান্তি ভাল লাগে না সবিতা। প্রতিদিন এই এক অশান্তি! এই এক বিচার! পেয়েছটা কী তোমরা, শুনি? একটু শান্তিতে থাকি, চাও না?
আবার কাঁদতে বসে সবিতা। পাশের রুমে কাঁদতে কাঁদতে শাপ-শাপান্ত করে চলে রোহিণী। মা আর বউয়ের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানস হাত বাড়ায় মানবের দিকে। সংসারে প্রেম বলতে নেই কিছু। ভালোবাসা কোথায়! মানবের মুখে শুধু দোল খায় পৃথিবী এখন। বেঁচে থাকার যা কিছু সুখ, ইচ্ছা, সব ওই মুখে। ওখানেই প্রেম, ওখানেই শান্তি।
তিন.
আজ ক্লাস নেই। সকাল থেকে বিছানা ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না মোটে। অভীক সেই সাত-সকালে চলে গেছে অফিসে। সারাদিন কী করবে, ভাবছিল দোলন। তখনই ফোন দিলো তিথি। তার কণ্ঠে সীমাহীন ব্যস্ততা। আলসেমি ভুলে নড়েচড়ে বসে দোলন। মন দেয় তিথির ফোনে।
দোলন, তোর কি কোনো কাজ আছে আজ? কোথাও যাবি?
না রে! বাসায়ই আছি সারাদিন। কেন বল তো?
দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে! কুইক! আমি আসছি!
কেন বল তো? কোথায় যাবি?
ঝটপট রেডি হ! এখন সময় নেই! এসে বলছি!
ফোন রেখে তৈরি হতে থাকে দোলন। তিথিটা পাগলা গোছের আছে একটু। মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে মনে হয়। তবে তালে সে পুরোপুরি ঠিক। দোলনকে চরানোর ক্ষমতা রাখে। কোথায় যাবে সে দোলনকে নিয়ে কে জানে! আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই তৈরি হয়ে নেয় দোলন। অপেক্ষা করে তিথির। একটু বাদেই তিথি এসে হাজির। তাকে দেখে দারুণ চমকে যায় দোলন। তিথি বরাবরই সাজগোজ প্রিয়। লিপস্টিক, কাজল, হালকা মেকাপ ছাড়া সে ওয়াশরুমেও যায় না বলতে গেলে। কিন্তু আজকের সাজটা মাত্রাছাড়া। দোলন মনে মনে প্রমাদ গোনে। সে নিজে সাজগোজ পছন্দ করে না একদম। সাজতে সে পারেও না আদতে। তিথির এই সাজে সঙ্গী হওয়াটা খুব অস্বস্তিকর তার কাছে।
কী রে? তুই তো পুরা মেকাপবাক্স মুখে লাগায়া ফেলছিস দেখি! ঘটনা কী?
দোলন!—চোখ পাকায় তিথি। একদম ফাজলামি করবি না। জরুরি একটা কাজে ক্যাম্পাসে যাব। চল আমার সাথে। —যেন দোলন নিতান্তই তার আজ্ঞাবহ কেউ, সে যেতে বললে দোলনের না গিয়ে গত্যন্তর নেই আর, তেমনি সুরে ঘোষণা করে তিথি।
দোলন মজা পেয়ে যায়। সে নিরীহ মুখে বলে, ক্যাম্পাসে যায়া করবি কী? আজ তো তোর জানুর ক্লাস নাই। নাকি চোখের দেখাটা দেখবি একবার? মন কানতেছে দেখার জন্য?—ডিপার্টমেন্টে সদ্য যোগ দেওয়া শিহাব স্যারকে নিয়ে খোঁচা দেয় দোলন। তার দিকে চোখ পড়েছে তিথির, জানে সে।
মারব একটা! ফাজিল! একজনের সাথে দেখা করতে যাব। চল!
কার সাথে?
ও্ যে! তোকে ফোনে সেদিন কথা বলিয়ে দিলাম না? তার সাথে। চল চল, তাড়াতাড়ি চল!
ঐ যে তুহিন না কি যেন নাম, সেই ছেলেটা? যার বাপের অনেক টাকা? অনেকগুলা গাড়িটাড়ি আছে, ব্যবসা করে?
হ্যাঁ, চল!
তুই যাইতেছিস ডেটিংয়ে, আমি তাহলে করবটা কী যায়া? তোরা প্রেম করবি, আর আমি চায়া চায়া দেখব?
বেশি কথা বলিস না তো! চল!
রিকশায় বসে দোলন আবার খোঁচায় তিথিকে। এটা যেন কত নাম্বার হলো তোর?
কী কত নাম্বার?
কেন, প্রেম?
ধুর! কী বাজে বকিস! প্রেম কেন হতে যাবে! প্রেম করলাম কখন?
তাই তো!—বলে চুপ করে যায় দোলন। খুব বলতে ইচ্ছে করে, প্রেম যদি নয়, তবে দুই দিন পর পর একেকজন নতুন বন্ধু জুটিয়ে কী করে তিথি, ডেটিংই বা কেন করে! এই ক’দিন আগে তিথির যখন ডেটিংয়ের সময় হলো, সে এসে দোলনকে বললো, দোস্ত, তুই তো ম্যারিড, আমাকে একপাতা পিল কিনে দে!
দোলন অবাক হয়ে বললো, সে কী রে! তুই পিল দিয়ে করবি কী? এছাড়া আমি কোনোদিন ওসব কিনিনি!
দে না দোস্ত! রঞ্জন এর সাথে দেখা করতে যাব, কিন্তু ওইদিন আমার পিরিয়ডের ডেট পরে গেছে! প্লিজ!
অতপর দোলনকে কিনতে হয়। এমনি কত আবদারই মেটাতে হয় তাকে তিথির! কিন্তু তিথি বলে, তার কপালে প্রেম নেই। একটা প্রেমও সে করতে পারলো না জীবনে।
চোখমুখ করুণ করে দোলন বলে, সেই তো! তুই আসলে করিসটা কী, বল তো? একটা প্রেম করতে পারলি না জীবনে! অথচ আমাকে দেখ! বিশ হতে না হতেই প্রেম, বিয়ে, সব কমপ্লিট! তোকে দিয়ে আসলে কিচ্ছু হবে না, বুঝলি!
তিথি সায় দেয়। দোলনের চে’ তার মুখ আরও করুণ দেখায় তখন। দোলন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসি লুকায়।
ক্যাম্পাসে গিয়ে ঘটনা খোলাসা করে তিথি। তুহিন ক্যাম্পাসে আসবে। আজই প্রথম সাক্ষাৎ। তুহিন ও তিথি দুজনই নির্দিষ্ট কালারের ড্রেস পরে আসবে, তেমনই কথা হয়ে আছে। তিথি অন্য কালার পরেছে। কেন, প্রশ্ন করলে বলেছে, এমন তো হতে পারে, তুহিনকে দেখে পছন্দ হলো না আমার! তখন ও যেন আমাকে চিনতে না পারে, তাই আমি ওর বলা কালার পরিনি।
পছন্দ না হয় মানে? তাহলে এতদিন যে ভালোবাসার কথা বললি তাকে! পছন্দ না হলে আবার ভালোবাসার কথা বললি কিভাবে?
বোকার মতো কথা বলিস না তো! ভালোবাসার কথা বললেই তাকে ভালোবাসতে হবে?—ধমকে ওঠে তিথি।
কী জানি বাপু! তোর ব্যাপার-স্যাপার তো বুঝি না। কিন্তু ও যদি তোর বলা কালার না পরে আসে? তখন? কী করে চিনবি?
ও পরবে—তিথির কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।
তিথি ফোন দেয় তুহিনের নাম্বারে। কাছাকাছি চলে এসেছে, জানায় সে। এরপর নির্দিষ্ট স্থান থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসে দোলন আর তিথি। দূর থেকে তুহিনকে আসতে দেখা যায়। হালকা আকাশি রঙের শার্ট, ফেডেড জিন্স, পায়ে দামি সু। শ্যাম্পু করা বাবরি চুল কপালের দুপাশে লেপ্টে আছে। বাতাসে উড়ছে ফুরফুর। সানগ্লাস কপালে তোলা।
তোর আশির দশকের নায়ক তো এসে গেছে রে!—কণ্ঠে কৌতুক নিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে দোলন। চোখ তুহিনের ওপর।
ফাজলামি ছাড়। বল তো দোলন, সত্যি করে বল, আমার কি এই ছেলেটার সামনে যাওয়া উচিত?—কণ্ঠে দ্বিধা আর হতাশা নিয়ে বলে তিথি। ততক্ষণে সে ঘুরে বসেছে তুহিনের দিক থেকে। চোখ অন্যদিকে ফেরানো। যেন সে আর দোলন গভীর কোনো আলোচনায় মগ্ন। কারও অপেক্ষায় নেই তারা। দোলন আপাদমস্তক দেখে নিয়েছে তুহিনকে। সে-ও ঘুরে বসেছে ঢের আগেই। সে বিরক্ত কণ্ঠে বলে, এ যদি তোর বর হয়, তাইলে তোর বাপ তো হার্ট অ্যাটাক করবে রে! এরে তো বয়সে তোর বাপের চায়াও বড় মনে লাগতেছে।
এরপর ফোনটা অফ করে দিয়ে, তুহিনের সামনে দিয়েই ড্যাঙড্যাঙ করে দোলন আর তিথি ফিরে চললো বাসায়। বন্ধ ফোন কানের কাছে ধরে তিথি মাঝে মাঝে কারও সঙ্গে কথা বলার ভানও করলো তুহিনের দৃষ্টিসীমায় থাকার সময়। বেচারা তুহিন তখন মরিয়া হয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে চলেছে তার অদেখা প্রেমিকাকে, ফোন দিচ্ছে সমানে। যান্ত্রিক কণ্ঠটা বেরসিকের মতো বলে চলেছে, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে, অনুগ্রহ করে…
চার.
সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। শুক্রবার। অফিস বন্ধ। অভীক পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। দোলন সেই সাত সকালে উঠেছে। নাস্তা রেডি করে বসে আছে তো আছেই। অভীকের ওঠার নাম গন্ধও নেই। অথচ কথা ছিল আজ নাস্তা শেষে বের হবে তারা। ঘুরবে সারাদিন, বাইরে খাবে। একেবারে রাতের খাওয়া সেরে তারপর ফিরবে। অভীক গভীর ঘুমে। দোলন বেশ ক বার চেষ্টা করেছে তোলার। ওঠেনি অভীক। পাশ ফিরে শুয়েছে বরং। শেষবার বিরক্ত হয়ে লাল চোখ মেলে দোলনকে যাচ্ছেতাই ব’লে বকেছে। অভিমানে চোয়ালে ব্যথা জমে যায় দোলনের। অনেক কষ্টে কান্না আটকে সে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে, খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। শীত শেষের হাওয়ায় তেমন ঠাণ্ডা নেই এখন। বেশ একটু বসন্ত মিশে গেছে তাতে। বেশ লাগে হাওয়াটা। কেমন ফুরফুরে, উদাস উদাস। মাথার ওপরে কয়েকটা টুনটুনি, দোয়েল কিচিরমিচির ওড়ে। আমগাছটা মুকুলে ছেয়ে গেছে। সজনে গাছের সাদা ফুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সবুজ সরু সজনে ডাঁটা। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে উদাস বসে থাকে দোলন। আকাশটা কেমন গুমোট মুখে তাকিয়ে আছে। তার মনের মতোই। হালকা একটু কুয়াশা কুয়াশাও আছে। ঘোলা লাগছে চারপাশ। ছুটির দিন বলে কেউ ওঠেনি এখনো। দোলনের ভোরে ওঠার অভ্যাস। আজ বের হওয়ার কথা ব’লে আরও আগে উঠে পড়েছে সে। অথচ অভীক তাকে এভাবে…সাবধানে চোখ মোছে দোলন।
পরিবারের অমতে অভীককে বিয়ে করেছে সে। পালিয়ে। একই ডিপার্টমেন্টে পড়তো তারা। অভীক যখন মাস্টার্সে, দোলন সবে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে তখন। অভীকই প্রস্তাবটা দিল। দোলন কিছুদিন একটু নিমরাজি ভাব দেখিয়ে শেষে রাজি হয়ে গেলো। অভীককে ভালো লেগে গেছিল তারও। কিন্তু বাদ সাধল দুই পরিবার। অভীকের পরিবার অভীককে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় আগে, বিয়ে দিতে চায় পরিবারেরই পছন্দমাফিক। দোলনের পরিবার আরও এককাঠি বাড়া। দোলনের পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে বিয়ের প্রশ্নই নেই, প্রেম তো নিষিদ্ধ একেবারেই। দোলন বললো, তাহলে বরং অভীক নিজেকে একটু গুছিয়ে নিক, পড়াশোনা শেষে একটা চাকরি জুটিয়ে নিক আগে, ততদিনে তারও পড়াশোনাটা এগোবে কিছুটা।
কিন্তু অভীক নাছোড়বান্দা। সে তখন তখনই বিয়ে করবে। শেষে পালিয়ে বিয়েটা করেই ফেললো তারা। প্রথম প্রথম গোপন ছিল বিয়েটা। অভীক আর দোলন বাড়ি থেকে যে টাকা পেতো মাস খরচবাবদ, সে টাকা আর অভীকের টিউশানির টাকা দিয়ে একটা সাবলেট রুমে বেশ চলে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু কিভাবে কে জানে, জানাজানি হয়ে গেলো দুই পরিবারেই। ফলে অভীকের পরিবার অভীকের খরচ পাঠানো বন্ধ করল। সঙ্গে তার বাড়িতে ঢোকার ওপরেও জারি করলো একশ চুয়াল্লিশ ধারা। একইভাবে দোলনের পরিবারও সাফ জানিয়ে দিলো, দোলনের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না তারা, দোলন তাদের কাছে মৃত। অভীক কোনোভাবে মাস্টার্স শেষ করে বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে ঢুকলো অনন্যোপায় হয়ে। দোলনের তখন মাত্র সেকেন্ড ইয়ার। তারা এই টিনশেড বাড়িটায় একটা রুম ভাড়া নিয়ে সাবলেটে থাকছে। কিচেন আর ওয়াশরুম শেয়ার করতে হয় তাদের। তা, সেসব নিয়ে দোলনের মনে আক্ষেপ নেই কিছুই। কিন্তু অভীক! সে কেমন বদলে যাচ্ছে ইদানীং। কেমন নিরাবেগ, নিস্পৃহ হয়ে যাচ্ছে দোলনের প্রতি। যেন দোলন পুরনো হয়ে যাচ্ছে, অনাকর্ষক হয়ে যাচ্ছে অভীকের কাছে। অভীক যেন দোলনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। কিন্তু কেন হচ্ছে এমন? কান্না উছলে ওঠে দোলনের চোখে। সে তো দিনে দিনে আরও বেশি নির্ভরশীল, আরও বেশি অনুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠছে অভীকের প্রতি। তাহলে অভীক কেন সরে যাচ্ছে দূরে? দোলনের মনে হয়, সে যতই অভীককে বাঁধতে চায়, অভীক যেন ততই বন্য হয়ে উঠতে চায়, ততই বেশি কাটাতে চায় মায়া। তবে কি সেও নির্লিপ্তি দেখাবে অভীকের প্রতি? সেও কি তবে অভীককে বোঝানোর চেষ্টা করবে যে, অভীককে ছাড়াও দিব্যি চলতে পারে সে? চোখ ফেটে কান্না পায় তার। ফেটে চৌচির হয় বেদনার ডালিম। পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে সে। আত্মীয়-স্বজন সবাই ত্যাগ করেছে তাকে। কাউকে সে অভীকের সম্পর্কে কোনো অভিযোগ জানাতে পারবে না। তাছাড়া অভিযোগ করে, কারও মধ্যস্থতায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতি সে নয়। যে সম্পর্ক গড়তে কোনো মধ্যস্থতার প্রয়োজন পড়েনি, সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যদি প্রয়োজন পড়ে তার, তবে সে সম্পর্ক ভাঙাই মঙ্গল।
দোলনের হঠাৎ অনেকদিন পর নিজের পোষা বেড়ালটাকে মনে পড়ে। মনে পড়তেই কান্না আছড়ে পড়ে দুই চোখে। বেড়ালটা কী যে প্রিয় ছিল তার! তার সঙ্গে খেতো, তার সঙ্গেই ঘুমোতো। সারাদিন পায়ে পায়ে ঘুরতো। একবার, সবে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছে। কী মনে হলো তার। হুট করে মনে হলো, ধুর! কী হবে বেঁচে থেকে! কোনো মানে নেই জীবনের।
ব্যস। অমনি সে সারাঘর খুঁজে বের করে আনলো চাষের ক্ষেতে দেওয়া কীটনাশক বিষ, আর গিলে ফেললো একমুঠ। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। দুই দিন যমে-মানুষে টানাটানি শেষে হাসপাতাল থেকে যখন বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হলো তাকে, তখন বেড়ালটা কোথায় ছিল কে জানে, দৌড়ে এসে লাফিয়ে পড়লো তার গায়ের ওপর। শায়িত দোলনের মুখের কাছে মুখ এনে তার মুখে, গলায় এমনভাবে মুখ ঘষতে লাগল বেড়ালটা, এমনভাবে গরগর করে আদর জানাতে থাকলো, মিউমিউ করে ডাকতে থাকলো এমনভাবে যে, মরতে চেয়েছিল ভেবে নিজেরই ভারি লজ্জা হলো। বেড়ালটাকে দুই হাত দিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সে কাঁদতে শুরু করলো হুহু করে।
সেই বেড়ালটা নেই আর। ভার্সিটিতে ভর্তির পর মাঝে মাঝে যখন বাড়ি যেতো দোলন, কী যে খুশি হতো বেড়ালটা! কিন্তু বিয়ের পর, বাড়িতে বিয়ের খবর জানা-জানি হওয়ার পর, আর যাওয়া হয়নি তার। ও পথ বন্ধ। বেড়ালটা দোলনের শোকেই কি না, কে জানে, খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি পড়তো তার। তারপর একদিন মারা গেছে। ভোরের বসন্তলাগা হাওয়ায় নির্জন বারান্দায় বসে, বহুদিন বাদে বেড়ালটাকে আবার মনে পড়ে দোলনের। মনে পড়তেই কান্না জমে হুহু। চোখ মুছে ঘরে ঢোকে দোলন। অভীক তখনো ঘুমুচ্ছে। গভীর ঘুম। নাক ডাকার শব্দ কানে বিষ আছড়ে পড়ে দোলনের। ঘরের কোনে রাখা পড়ার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে। পর্দা সরিয়ে দেয় জানালার। ওপাশে ইন্দির ঠাকরুণ নাতিটাকে নিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে ফোকলা দাঁতে মুড়ি-নাড়ু চিবুচ্ছে তখন। মানস অদূরে চেয়ারে হেলান দিয়ে পেপার পড়ছে গভীর মনোযোগে। সবিতা মেঝেতে কলাপাতা বিছিয়ে নারকেল কোরাচ্ছে। সেদিকে চোখ পড়ে দোলনের বাড়ির জন্য মন কেমন করে ভীষণ। অভীকেরও কি হয় অমন? প্রশ্নটা উঁকি দিয়ে যায় মনের কোনে। ভাল্লাগে না। কিচ্ছু ভাল্লাগে না। বাইরে থেকে টেবিলে চোখ সরিয়ে নেয় দোলন। টেনে নেয় জীবনানন্দ। যদি কিছু শান্তি মেলে, যদি মেলে কিছু প্রেম।