রোজকার মতো বাতি নিভিয়ে এই নরম বিছানায় শুয়ে পড়লে তার মনে হয়, যেন জীবনটা সত্যি বুঝি এমনই। বাড়তি কোনো খেদ নেই, সুখ নেই, দুঃখ নেই, ঘৃণা নেই, হিংসা নেই—কেছুই নেই। এই জীবনাটা শুধুই একটা জীবন। শুয়ে থাকা বিছানার পাশের জানালায় বড় চাঁদ উঠেছে। তার হলুদ আলোতে ভরে যেতে শুরু করেছে চারদিক। এই যে ঘরটা এখানের প্রতিটি কোণ, আসবাব, সাদা দেয়াল, ঠাণ্ডা মেঝে যেন অনন্তকাল ধরে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে ওকে। বইয়ের তাকে সারি দেওয়া বই, ঘরের দেয়ালের এককোণে গেঁড়ে রাখা পেরেকের মাথা, দড়িতে ঝুলছে ঘামের গন্ধওয়ালা শার্ট, কিংবা দেয়ালে বসে মোকামাকড় খাওয়া ওঁৎ পেতে থাকা টিকটিকিটা। আসলে এমনই হয়তো জীবন। যেন আর কিছুই নয়, প্রত্যহ ঘটতে থাকা স্মৃতিসঞ্চিত প্রত্নতাত্ত্বিক পাহাড়। মাথার প্রতিটি কোষে কোষে, দেহের প্রতিটি শিরায় শিরায় প্রতিদিন সে এই ভয়াবহ উপলব্ধির বাহক। অথচ এই জীবন কি সত্যিই চেয়েছিল ও! প্রতিদিন ক্রীতদাসের মতো সকালে চোখে অপুষ্ট ঘুম নিয়ে জনস্রোত ভেঙে চলা। বিষময় ঘাম আর শুধু বেঁচে থাকার তাড়না নিয়ে একের পর এক ডিঙ্গিয়ে চলা দিন প্রতিদিন। যে কাজ তার অপ্রিয় অথবা কোনোদিন যে কাজটি করতে চায়নি, তবু বছরের পর বছর ক্লান্তিহীন সেই একই কাজ করে চলেছে সে। দুপুরে সময়মাফিক ক্ষুধা নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে পারা, বিকেলে পরিচিত বন্ধুর আড্ডায় অশ্লীল হুল্লোড়, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে লুঙ্গি আর উদাম গায়ের আরামে ভাসতে ভাসতে কখন যেন রাত। তারপর আরেকটা একই রকম দিনের জন্য শক্তিসঞ্চয়। অবশেষে ঘুম আর ঘুম। কতদিন ভরদুপুরে হাঁটা নেই, বৃষ্টিতে ভেজা নেই, বিকেলে নেই বৈকালিকপ্রিয়তা। সন্ধ্যায় প্রেমময় কথা নেই, নির্জনতা নেই, আবেগ নেই, আবেশ নেই। শুধু মাথার ভেতরে থাকে প্রত্নতত্ত্বের মতো ধোঁয়াশা কিছু স্মৃতি। তার কোনো বন্ধু নেই। আবার সবাই তার বন্ধু। কেউ তাকে বা সেও কাউকে যেন বুঝতে পারে না এতটুকু। কারও হয়তো সেই দায় নেই। কিংবা সেও দায়বদ্ধতাহীন। কতদিন এই জীবনে যে কতবার অকারণে চোখ ভিজে উঠেছে তার ঠিক নেই। সে জানে তবু এটাই ওর জীবন। একক এবং অনন্ত। আজও এই আবছায়াতে রোজকার মতো প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল ও। কিন্তু কে যেন ডাক পাঠালো কিসের। মনের ভেতর একটা কেমন যেন তাড়া অনুভব করলো ও। অনেক দিন পর সে নিয়ম ভেঙে শোয়া ছেড়ে উঠে জানালার ধারে গেলো। গোল পূর্ণ বয়স্ক চাঁদটা আকাশে নিঃসীম। অকাতরে জোছনায় ভাসছে সব।
পাতলা একটা শার্ট গায়ে সে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। এই রাতে নির্জন পৃথিবীতে মনে হলো যেন কেউ নেই। সে তার রক্তের ভেতর অন্যরকম একটা সুখ অনুভব করলো। মনে হলো হঠাৎ করে যেন স্বাধীন হয়ে গেছে পুরো দুনিয়া। সে হাঁটতে শুরু করে। জোছনার বন্যায় নির্জন রাস্তা তখন সয়লাভ। একটু একটু দুলতে থাকা গাছের পাতাগুলো থেকে চুঁইয়ে পড়ছে যেন হলুদ গলিত সোনা। হাঁটতে হাঁটতে গলি থেকে গলি অবশেষে জোছনার ঢেউ ভেঙে সামনে রাজপথ। সাপের মতো এঁকেবেঁকে শুয়ে রয়েছে যেন অনন্তকাল ধরে। প্রতিদিন এই রাজপথ হয়েই সে কাজে যায় আর ফিরে আসে। আজ এই রাতে চীর চেনা এই রাজপথকে অচেনা মনে হয়। সে হাঁটতে থাকে রাস্তা ধরে।
কেমন নির্জন আর রহস্যময় মনে হতে থাকে তার সবকিছু। জোছনার নরম আলোয় তার ছায়া বুকে নিয়ে যেন রাজপথ এগিয়ে চলেছে অজানা কোনো গন্তব্যে। আজ এই জোছনার রাতে তাই তারা এগিয়ে চলেছে যুগল। সে হেঁটে হেঁটে ভাবতে থাকে চির পরিচিত সকালের সব কোলাহলের কথা। এই রাস্তাতেই রুক্ষ বাসের চাকায় একবার পিষে গিয়েছিল এক বৃদ্ধ। কালো কংক্রিটে লাল রক্তের কথা মনে করে শিউরে উঠে গা। আশ্চর্য বৃদ্ধটার দিকে কেউ এগিয়েও যায়নি। মনে পড়ে ভাবলেশহীন মানুষগুলোর মুখ। দুটো দল প্রতিদিন কোথায় যেন নিয়ম করে ছুটতে থাকে পরস্পরের মুখোমুখি। আশ্চর্য ম্লানমুখো ভিক্ষুকটাও আর নেই। সেও কি এই শহরের কোন কোণে ঘুমিয়ে আছে! সবাই কি ঘুমাতে পারে এই রাতে! না কি একা শুধু জেগে আছে সে, রাজপথ আর চাঁদটা। হেঁটে চলে সামনে। হঠাৎ তার মনে হয়, কোথায় যেন সমস্বরে একটা শব্দ এগিয়ে আসছে। সে ভালো মতো ঠাহর করার চেষ্টা করে। আরেকটু দ্রুত পা চালায়। আরে! রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে সাদা একদল ধবধবে রাজহাঁস। ওদের সাদা গায়ে চাঁদের আলো যেন ঠিকরে পড়ছে ঝরনার মতো। এই নির্জন চন্দ্রালোকিত রাস্তায় তাহলে এগিয়ে চলেছে একদল রাজহাঁস। দৃশ্যটা কেমন অপার্থিব মনে হয়। মনে হয় কোথায় যেন এর একটা কাব্যিকতা আছে। সে মুগ্ধ চোখে রাজহাঁসগুলোকে দেখতে থাকে। সাদা ধবধবে হাঁসগুলো শব্দ করতে করতে এগিয়ে চলেছে হেলেদুলে। মনে হচ্ছে ওরা যেন কথা বলছে একে অন্যের সঙ্গে। কোথা থেকে এলো ওগুলো, কোথায় বা যাবে শেষে! মনে হয় আজ সেও যদি হাঁটতে থাকে সাদা হাঁসের মিছিলে তবে কোথায় নিয়ে যাবে ওরা ওকে! সাদা হাঁসের মিছিল এগিয়ে চলে কালো রাস্তা ধরে। সাথে চলতে থাকে সেও। হাঁসগুলো হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যায় দোকানপাট, সার দেওয়া সব উঁচু অট্টালিকা। ওদের সঙ্গে এভাবে সেও ঠিক কতদূর চলে এসেছে জানে না। তবে ক্লান্ত হয়নি এতটুকু। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর তাকে ডাক দেয়।
এই যে শুনছেন, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।
একটা লোক রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে আছে। নির্জন এই একা রাস্তায় লোকটাও হয়তো তারই মতো কেউ একজন। যে বেরিয়েছে আজ নিয়ম ভাঙার খেলায়।
এত হাঁস কোথা থেকে এলো? এত রাতে আপনিই বা কেন হাঁটছেন ওদের সাথে?
সে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়, তোবড়ানো গাল আর ভাঁজ পড়া মুখ। বয়সে অনেক সূর্যই লোকটা দেখে ফেলেছে বোঝা যায়।
আমি হাঁটলে আপনার কোনো সমস্যা আছে?
লোকটা মনে হয় ওর কাছ থেকে এত ককর্শ উত্তর আশা করেনি। না, সমস্যা নেই। কৌতূহল হলো আর কী! আমার নাম আশরাফ। আপনি কি হাঁসগুলোর মালিক?
না আমি কেবল ওগুলোর পেছন পেছন হাঁটছি। আমার দেখার শখ ওগুলোর গন্তব্য।
একা এই রাস্তায় থাকতে আর ভালো লাগছে না। আমি কি আসতে পারি আপনার পেছনে? আমিও না হয় দেখি হাঁসগুলো কোথায় যায়।
রাজপথ সবার জন্য, ইচ্ছে হলে হাঁটুন। আমার আপত্তি নেই।
বয়স্ক লোকটা উঠে দাঁড়ায়। ওরা যখন কথা বলছিল হাঁসগুলো তখন বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু ফকফকে এই চাঁদের আলোয় সাদা চাদর এখনো অদৃশ্য হয়ে যায়নি দৃষ্টিসীমা থেকে। ওরা দুজন পা চালায়।
আপনার, মানে তোমার নাম কী? আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। বয়সে আমার খানিকটা ছোটই হবে।
ঠিক আছে সমস্যা নেই। কিন্তু নাম জানাটা কি খুব জরুরি? প্রতিদিন এই রাজপথে কতশত মুখের সাথেই না আমরা হাঁটি। সবার কি নাম জানেন?
হ্যাঁ, তাই তো কত মানুষেরই তো নাম জানি না।
হাঁসগুলো সাদা ঔজ্বল্য ছড়াতে ছড়াতে এগুতে থাকে। পেছনে ওরা দুজন নিঃশব্দে পিছু পিছু চলে। আকাশে ভেসে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড মেঘ। নির্জন রাস্তায় কতগুলো স্বর্গীয় হাঁস আর দুজন দুই বয়সের মানুষকে দেখে হয়তো অবাক হচ্ছে ওরা। হঠাৎ মেঘের একখণ্ড আড়াল করে চাঁদ।
আহা, চাঁদটা কেমন ঢেকে গেলো। কী সুন্দর জোছনা হচ্ছিল!
একটু অপেক্ষা করুন আবার বেরিয়ে আসবে। ওকে আসতেই হবে। আপনি ওখানে একা বসে ছিলেন কেনো?
আশরাফ কোনো কথা বলে না। শুধু একবার তার মুখের দিকে তাকায়। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় করে নিশ্বাস ছাড়ে। চাঁদটা সত্যিই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে মেঘের ভেতর থেকে। সাদা হাঁসগুলো দুপায়ে হেলেদুলে চলতে চলতে প্যাক প্যাক শব্দে যেন আহ্বান জানাচ্ছে চাঁদকে বেড়িয়ে আসতে।
মাঝে মাঝে অচেনা মানুষও চেনা হয়ে যায়। আমি তোমার তেমনই একজন অচেনা মানুষ ভেবে নাও।
আজ আমি পথে নেমেছি নতুন জীবন দেখার আকর্ষণে। ওই যে হাঁসগুলো দেখছেন, ওগুলো কোথা থেকে এলো কিংবা কোথায় যাবে আমি জানি না। তারপরও চন্দ্রাহত হয়ে ওদের পেছনে চলেছি। হয়তো অজানাই ওদের আসল গন্তব্য। তবু এই জীবনের বাইরে কেমন সেই অজানার ডাক তা আমি শুনতে চাই। পথিমধ্যে আপনাকে পেয়ে গেলাম। আপনি আমাকে আপনার কথা বলতে পারেন। আমাকে এই মিছিলের একজন ভেবে নিন।
ওরা দুজন বেশ খানিক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। চাঁদটা অবশেষে বেরিয়ে আসে মেঘের আড়াল থেকে। দুলতে দুলতে এগিয়ে চলা হাঁসগুলোর মাঝেও যেন আনন্দ খেলে যায়।
আমার নাম আশরাফ। আমি একজন আদর্শ ব্যর্থ মানুষ। সারা জীবন অন্যেরা যেমন টাকা পয়সা জমিয়ে রাখে, আমি শুধু আমার জীবনে জমিয়েছি ব্যর্থতার আদিগন্ত ইতিহাস। আমি আর সবার মতো প্রাণখোলা হতে পারিনি। সংসারে কেবলই বোঝার মতো আমি চেপে আছি সবার মাথায়। হতে পারিনি আদর্শ সন্তান, ভাই, স্বামী কিংবা পিতা। আমার স্ত্রী-সন্তান অনেক আগেই ছেড়ে গেছে আমায়। বন্ধুরাও ছেড়েছে সেই কতকাল আগে। কর্মেধর্মে সংসারে আমার জমা হয়েছে কেবল একের পর এক ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতার বিপুল পাহাড়ই আমার একমাত্র সাফল্য। আমি মাঝে মাঝে রাতে এই রাস্তায় এসে বসি। খালি রাজপথ আমার ভালো লাগে। নিজেকে নিজে সঙ্গ দেই।
ওরা আবার নিঃশব্দে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে এই রাজপথ ধরে কতদূর ওরা এগিয়ে যায় খেয়াল নেই। হাঁসগুলোর বিশ্রামহীন এগিয়ে চলা ওদের সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। হলুদ জোছনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
মানুষের জীবন মানুষকে নিয়ে কেমন করে খেলে মানুষ তা জানে না। আচ্ছা, জীবনের সত্যিকার সংজ্ঞা কী, বলতে পারেন? আর সুখ দুঃখ? নিত্য অভাব আর গঞ্জনায়ও কেউ কেউ সুখের গালিচায় ঘুমায়। আবার সব কিছু থেকেও কেউ কেউ বেছে নেয় দুঃখের আসক্তি। বেঁচে থেকেও কেউ কেউ ফেরার হয়ে যায় আরও বেঁচে থাকার মোহে। এ যেন অদ্ভুত এক বিপন্ন বিস্ময় মানুষের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে। মানুষকে ক্লান্ত করে।
আমার মনে স্বপ্ন আর মানবিক জীবনে কোথায় যেন একটা বৈপরিত্ব আছে। যদিও মানুষই স্বপ্ন দেখে। মাঝে মাঝে আমার আরও কী মনে হয় জানো, আসলে স্বপ্নবাজরা পুরোপুরি মানুষ হয় না। আবার মানুষের সবসময় স্বপ্নবাজ হতেও নেই। কোনো মানুষ যখন স্বপ্নবাজ হয়ে ওঠে তখন সে নিজের চারপাশে তৈরি করে অন্যএক স্বপ্নের দুনিয়া। একসময় স্বপ্নের ভেতরের সেই ভুবন থেকেও নির্বাসিত হয় স্বপ্ন। বিত্ত, বৈভব, প্রাচুর্য, সুখে থেকেও,সে খুঁজে বেড়ায় তার ফেলে আসা প্রত্নবৎ পাললিকতা। সেখানে আছে ভালোবাসা আর কাদামাটির গন্ধ। কেউ কেউ সেই গন্ধেই হয়ে যাই তুমি আমি কিংবা ওই হাঁসগুলো।
কিছু দূরে হাঁসগুলো হঠাৎ ওদের হাঁটা থামিয়েছে। জোছনার প্রবল আলোতে এতক্ষণ যে সাদা চাদর দুলছিল, সেটা যেন এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওরা যেন কি খুটে খাচ্ছে।
ওই দেখো, হাঁসগুলো কী যেন খুটে খাচ্ছে।
ওরা মনে হয় জোছনার কনা খুটছে। এই হাঁসগুলো কি প্রতিদিনই হাঁটে রাজপথে, আর মাঝে মাঝে এমন খুটে খায় জোছনার কণা!
হঠাৎ ওদের পেছন থেকে একটা ঠকঠক আওয়াজ শোনা যায়। ওই পাড়ের গলির ভেতর থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে ওদের দিকেই আসছে। চাঁদের আলোয় মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে সাদা মনে হয়। ও কাছে এলে ওরা বুঝতে পারে মেয়েটার মুখে কড়া সাজগোজ। তার ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিক আর চোখের তীব্র চাহনির মধ্যে কি যেন একটা লুকিয়ে।
আপনারা কিছু খুঁজছেন?
না, তুমি কে?
আসলে আপনারা চাইলে যা খুশি আমাকে একটা নাম দিতে পারেন। আমি আপনাদের মতোই একজনকেই খুঁজছি।
কেন আমারা তো তোমাকে খুঁজছি না।
আমাকে না খুঁজলেও আমি আপনাদের জন্যই। আজ আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। এই চাঁদে এই রাস্তায় মানুষতো আমার মতোই কাউকে খোঁজে। আপনারা বুঝি ওই হাঁসগুলোর মালিক?
না, আমরা ওদের পেছনে কেবল হাঁটছি। ওদের গন্তব্য দেখতে যাবো আমরা।
বাহ, ভালো তো। প্রায়ই ওদের এই রাস্তায় দেখি। যখন এই পথ নির্জন হয়ে যায়, তখন আমি মুখে রঙ মেখে ওই গলিতে দাঁড়াই। রাত নির্জন সুনসান হলে মাঝে মাঝেই ওদের দেখি। ওখানে ওরা কি করছে?
জোছনার খুদ খাচ্ছে। কে জানে, চাঁদের আলোর কণার খুদ হয়তো ওদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়!
মেয়েটি ওদের আরও ঘনিষ্ট হয়ে আসে। ওর গা থেকে কেমন যেন পুরনো একটা নিঃশব্দ আতরের গন্ধ। ওদের মাথা কেমন ঝিমঝিম করে। গন্ধটা যেন প্রাচীন কোনো ইতিহাসের বই। ধুলোর নিচে চাপাপড়া প্রাগৈতিহাসিক।
এই চাঁদের আলোতে আপনাদের শরীর দরকার নেই? আমার শরীরটা আমি এই জোছনাতেই বিকাবো, কিনবেন?
দেখো, পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা থাকে। শরীর কেবল ভালোবাসার জন্য। যারা এটি বিকিয়ে দেয় এবং যারা কিনে নেয়, উভয়ই নিজেদের ঠকায়।
মেয়েটি ওদের কথা শুনে কেমন রিনরিন শব্দ করে হাঁসতে থাকে। ওর হাঁসির শব্দে খানিকটা দূরে জোছনার খুদ খেতে থাকা হাঁসগুলো থমকে যায় খানিকক্ষণ। ওগুলো সব যেন একযোগে পেছনে ফিরে তাকায়।
শুনুন ভদ্রলোকেরা, তত্ত্ব, যুক্তিতে মানুষের পেট ভরে না। পেট ভরতে চাই নগদ অর্থ। আর শরীর, ভালোবাসা? সে তো তথাকথিত আপেক্ষিক মোড়ক। আমি এখন জেনে গেছি, এই শরীরটা কেবল ভোগের জন্যই। ভোগের মধ্য দিয়েই আপনাদের মতো কামাতুর মানুষেরা ভালোবাসা ফেরি করে ফেরেন। প্রতি রাতেই ওই অন্ধ গলির মুখে নতুন নতুন ভালোবাসা নিয়ে আপনাদের মতো সাদা চেহারা কালো মানুষেরা হাজির হয়। ওদের চোখে নষ্ট ভালোবাসা দেখেছি। নষ্ট ভালোবাসা প্রতিদিন এই অন্ধকারে কিনে নিয়ে যায় নষ্ট শরীরকে। তারপর কোনো এক অন্ধকারে পুরুষ বেশ্যারা লোভাতুর ভালোবাসা মেলে দেয় মেয়ে বেশ্যাদের।
মেয়েটার কথার প্রতি উত্তরে কী বলা উচিত কিংবা আদৌ বলার কিছু আছে কি না, তা ওরা বুঝতে পারে না। একটা মৃদু বাতাস বয় চারদিক। খানিক দূরের সাদা হাঁসের চাদরে ঢেউ ওঠে। ওরা দেখে মেয়েটা কাঁদছে।
সংসারে আমি হারিয়েছি সব, রয়ে গেছে কেবল এই শরীর। আমার শ্রমেরও তো কেউ দাম দেবে না। তাই শুধু শরীর বিকাই। এই যেমন আজ রাতে কেউ নেয়নি আমায়। কেমন অদ্ভুত আর নিশুতি এই রাত তাই না? জোছনাটা দেখুন, কেমন বিভ্রম আর অশান্তিময় ধোঁয়াশা। আজ শরীর বিকোয়নি, কাল কিভাবে চলবে তাই জানি না!
শোনো সবার জীবন এক নয়। আমি বুঝতে পারছি।
মেয়েটা উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠে। নির্জন এই পথে সেই হাসি যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে বারবার। হাঁসগুলো খানিকক্ষণের জন্য শব্দ বন্ধ করে ওদের দিকে তাকায়।
জীবন? সত্যি জীবন নামে যে একটা কিছু আমারো আছে ভুলেই গিয়েছিলাম। ওই যে দেখছেন সাদা ধবধবে হাঁসগুলো। নির্জন রাত্রিতে মাঝে মাঝে ওরা কোথা থেকে এসে যেন হেঁটে যায় এই পথ ধরে। ওদেরও এটা জীবন। কিংবা এই যে আপনারা হাঁটছেন আর হাঁটছেন। হয়তো কোনো গোপন সত্যতা খুঁজে ফিরছেন পথে। ওটাও একটা জীবন। আর আমি-প্রতিদিন মুখে রঙ মেখে, মিষ্টি মেকি আহ্বানের ডালা সাঁজিয়ে ভুল ভালোবাসা ফেরি করে বেড়াই। এটাও একটা জীবন।
জীবনের বাস্তব যে রূপ তুমি বললে তার বাইরেও একটা অন্য কিছু কি কখনো ভাবায় না তোমাকে?
না, আমাকে শুধু ভাবায় আগামী দিনগুলোর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। আর কিছুই যে বুঝি না।
হাঁসগুলো আবার চলতে শুরু করে। চাঁদের পাশে আবার ভিড় করে মেঘেরা। শুভ্র সাদা চাদরটা রাজপথে আবার এগিয়ে চলে। ওরাও হাঁসগুলোর পেছনে চলে মন্ত্রগ্রস্তের মতো। মেয়েটা হয়তো নিজের অজান্তেই আছে ওদের সঙ্গে। তবু ওরা এখন তিন জন।
রাত আর বেশি মনে হয় বাকি নেই। হাঁসগুলো কি ওদের গন্তব্য খুঁজে পাবে না?
কে জানে হয়তো পাবে। কারণ ওদের আবার ফিরে আসতে হবে রূপালি জোছনায়। তারপর আমরা ফিরে যাব?
হ্যাঁ, আমাদেরও যে ফিরতে হবে। যে জীবন যাপিত হয়েছে বহুবার, এই রাজহাঁসগুলোর শেষ গন্তব্য এক ভুলিয়ে যে দিতে পারবে না।
আসলে সত্যিই কি জীবন গন্তব্য খুঁজে পায় কোনোদিন? এই হাঁসগুলোও কি পাবে! যদি পেতই তাহলে বারবার ওদেরও হয়তো নির্জন এই রাতে ফিরে ফিরে আসতে হতো না।
আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে আমার ব্যার্থ জীবনে। খুঁজতে হবে সারা জীবন ধরে তার শেষ গন্তব্য।
কাল রাতে আমিও আবার মুখে রঙ মেখে দাঁড়াবো ওই ফেলে আসা অন্ধকার গলির মোড়ে। আবার বিকানো পণ্য হয়ে লোভের লোলুপতায় কর্ষিত হতে হতে ভাবতে হবে—এই কি তাহলে জীবন!
আর আমি, আবার সেই ঘর, আসবাব, দেয়াল, মেঝে। আবার সেই আমি। আবার এই রাজপথ ধরে ভাঙতে হবে জনস্রোত।
ধীরে ধীরে জোছনা ফিকে হতে শুরু করেছে। গোল চাঁদটার চারপাশে এখন ঘিরে ধরেছে কালো মেঘ। রাতও বেশি বাকি নেই আর। সাদা স্বপ্নময় হাঁসগুলো এখনো হাঁটছে ধীরে ধীরে। পেছনে ওরা তিনজন। অবশেষে ওগুলো রাজপথের একদম শেষে এসে উপস্থিত হয়। কালো হয়ে আসা মেঘের মাঝেও তখন ভোরের আলো ফুটেছে অস্পস্টতা নিয়ে। পথের শেষে একটা বড় জলাভূমি। হাঁসের সেই মিছিল নেমে যায় জলে। ওরা তিনজন তখনো দাঁড়িয়ে দেখছে হাঁসগুলোকে।
এই তাহলে পথের শেষ? এই তাহলে একটা রাতের গন্তব্য!
ওরা ঝোছনার খুদ খেয়ে খুঁজে নিয়েছে ওদের গন্তব্য। হয়তো আবার ফিরবে কাল রাতে একই গন্তব্যের খোঁজে। কিন্তু কী লাভ? কেন বারবার খুঁজে ফেরা গন্তব্যের ঠিকানা!
মানুষও কি তবে তার গন্তব্য জানে! তারপরও আবার খুঁজতে থাকে হন্য হয়ে। শেষ গন্তব্য কি মৃত্যু? অনিশ্চিত অন্ধকার, কালো মদিরতার জগৎ। আসলে মনে হয়, যে জীবন আমরা ফেলে এসেছি পথের শুরুতে সেটাই আমাদের প্রকৃত গন্তব্য। ওই জীবনে থেকেই যাপন করতে হবে দিন।
তোমরা দেখো, আকাশে কেমন মেঘ জমেছে। বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি। রাত্রির শেষ লগ্নে বৃষ্টি কি মৃত্যুর মতো? নিশ্চুপ ফিকে কালো সমূদ্রে ঝরে যাওয়া একমনে। গত রাতের দুঃখ, হতাসা, ক্লান্তি কি পারবে এই বুষ্টি ধুয়ে দিয়ে নতুন একটা দিনের শুরু করতে?
বৃষ্টি কি পারবে আমার মুখে লেগে থাকা রঙ, ঠোঁটে মিথ্যে লালের প্রলেপ, শরীরে লেগে থাকা নকল স্পর্শ ধুয়ে একটু শান্তির ঘুম এনে দিতে মৃত্যুর মতো?
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে সত্যিই বৃষ্টি নামে। ওরা সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভেজে। তখন কেনো যে ওদের সবার চোখে জল ওরাও জানে না। কেবল মনে হয় ঝুম বৃষ্টিতে মেঘের দরজার ফাঁক দিয়ে কে যেন বিড়বিড় করছে দুঃখময় স্বর।
ক্ষুদ্র আশাতে রয়েছি বাঁচিয়া সদাই ভাবনা
যা কিছু পাই হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।