—হ্যাঁ, হ্যাঁ ওখ্যানে, ওই জাগাখ্যানেই খুব চুলক্যাছে। চুলকানির জ্বালায় হামি তো মর্যাই যাবো, ওই মাগী আরও জোরে কোইরা চুলকিয়্যা দে।
—দিছি তো, দেখতে প্যাছেন না? আপনাকে চুলকিয়া দিতা য্যায়া তো হামার দু’হাতের নখ গ্যালাও উঠ্যা য্যাবে মোনে হোছে। স্বামীর ওপর রেগে ওঠে সলিসা বেগম। খোলসছাড়া দেশি পেঁয়াজের ঝাঁজের মতোই তিরিক্ষি মেজাজ তার। চেহারাও দেশি পেঁয়াজের মতোই মসৃণ।
—কমে না কেনে বাল? মনে হোছে আগুনে ঘি ঢালছিস।
—হামি কোহিবো ক্যানকোর্যা? চুলক্যাতে চুলক্যাতে কী অবস্থা দ্যাখাছেন? জাগাটা লাল হোয়্যা রক্ত ব্যাহির হ্যোয়া গেছে।
—চুতমারানি আরও ভালো কইরা চুলকা। শীতসন্ধ্যার শেয়ালের মতো খেঁক-খেঁক করে ওঠেন চেয়রাম্যান।
সলিসার গায়ের জোরের কাছে অসার হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে চেয়ারম্যান। স্বামীর শরীর চুলকাতে গিয়ে নিজের এই কাহিলদশা সলিসা মেনে নিতে পারে না৷ সর্বশক্তি প্রয়োগের পরেও চেয়ারম্যানের চুলকানি কমে না দেখে ভীষণ বিরক্ত সে।
—হামি আর পারবো না কোহিনু, মানুষ দ্যাখেন এব্যার।
কড়াইগরম তেলে পেঁয়াজ কুচি ছেড়ে দিলে যে অবস্থা হয়, সলিসার মেজাজের অবস্থাও তেমন। ধসেপড়া মরদেরা যখন কামে পারে না, তখন মেজাজের চড়ানি দিয়ে বউকে সামলাতে চায়। আলতু চেয়ারম্যানও গরম রক্তের সলিসাকে মেজাজের তলোয়ার দিয়ে ঠাণ্ডা করতে চায়, কিন্তু পারে না।
—বহু, দে একটু, মোর্যা যাছি তো হামি। চিচিঙ্গার শরীরের মতো নরম হয়ে আসে আলতুর মেজাজ। সলিসা সুযোগ বুঝে কোপ মারে, চুলকিয়া দিছি, হ্যাকে কিন্তু তিন ভরির গলার গহানাটা কিন্যা দিতেই হোব্যে।
—আচ্ছা দিবো, তুই চুলকা। আলতু চেয়ারম্যান বশমানা জিন হয়ে বউয়ের কথায় সাঁয় দেয়।
জেলার সবচেয়ে বড় এই ইউনিয়নের মানুদষ তো বটেই; গাছ-গাছালি, পশু-পাখি, ধুলোবালি, আকাশ-বাতাস—সবাই আলতু চেয়ারম্যানের কথায় ওঠ-বোস করে। টুঁ-শব্দ তো দূরের কথা, কেউ তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পর্যন্ত করে না। প্রতিদ্বন্দ্বীর মাজা সে এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে, আসলাম তো আসলাম আর কেউই তার সামনে এসে দাঁড়াতে পারে না। পরপর তিন বারের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী চেয়ারম্যান আলতু সামান্য চুলকানির যন্ত্রণায় এমন কাহিল হবে, তা কি সে নিজেও জানতো? কতভাবেই না চেষ্টা করলো, একবার ডান হাত দিয়ে, একবার বাম হাত দিয়ে। নাহ কোনোভাবেই জায়গাটায় পৌঁছুতে পারে না। এক অদ্ভুত শারীরিক গঠন নিয়ে জন্মেছে আলতু। শরীরের তুলনায় হাত দুটা অনেক ছোট, পা দুটাও। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই বৈষম্য আরও বেড়েছে। তাকে দেখতে ঠিক পেটফোলা পটকা মাছের মতো লাগে। আড়ালে পটকা-চেয়ারম্যানও বলে কেউ কেউ।
বাইরে-বাইরে খুব শক্ত থাকার চেষ্টা করে চেয়ারম্যান কিন্তু সামান্য চুলকানির কারণে তার এই দশা হবে—তা সে নিজেও ভাবতে পারেনি।
এমনই চুলকানি! কিছুতেই কমছেই না। বড় বউ, মেজ বউ চেষ্টা করে গেছে। ভেবেছিল ছোট বউ চুলকে দিলে কমবে। কিন্তু না কিছুতেই কমেনি। মনে-মনে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে, ছোট বহুও তো ম্যালা চেষ্টা কল্ল! ওই শালীর গতরে যা জোর! ওর গতরের ঠ্যালায় তো র্যাতে হাঁকে বিলাই হোয়্যা থাকতে হয়, সে-ও ফেল মাল্লো? বিড়বিড় করে বলতে বলতে কতিবর মেম্বোরকে ফোন দেয় চেয়ারম্যান।
—মেম্বোর কুণ্ঠে আছ?
—হামি আছি তো। বাড়ির দিকেই আছি উস্তাদ। কেনে? কী হোয়্যাছে খালি কহান, লাগলে আপনার ল্যাগ্যা জান দিয়া দিবো। না হ্যোলে কাহুরির জান লিয়া লিবো। খালি কহ্যা দ্যাখেন।
কতিবর সদ্য তেলেভাজা বেগুনির মতো কড়কড়ে কথাগুলোকে এগিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের দিকে।
—হামার বাড়িতে আসো তো একটু।
—কেনে উস্তাদ কী হোয়্যাছে?
—অ্যাসো তো একবার।
—আচ্ছা আসসসি।
হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে কতিবর। বলে, কী হোয়্যাছে চিয়্যারম্যান?
—আর কোহিস না ব্যাড়া, এমনই চুলক্যাছে, গহ্যা জ্বালিয়্যা দিছে বাঁড়া।
—কাহুকি দিয়্যা চুল্কিয়া লেন না জি! আপনি চিয়্যারম্যান, আপনার কথায় পাঁচ গাঁ উঠে বসে, এ সামান্য সমস্যা লিয়া আপনি এমন কোচ্ছেন কেনে? হাসি চেপে রেখে বলে কতিবর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, না পাল্লে চুলকানির ল্যাগ্যা প্লাস্টিকের হাত গ্যালা কিন্যা পাওয়া যায় না, ওগ্লা দিয়া চুলকালেও তো হয়।
—ধুর সালা, তিন বহুকে দিয়্যা চুলকিয়া লিনু। কুনু কামই হলো না। বাড়ির সব্যাইকে দিয়্যা চুলকিয়া লিনু। উহু, কাম হোছেই না। চুতমারানির চুলকানি কমছেই না।
—কই কুন্ঠে? দেখি, হামি চুলকিয়া দি দেখি।
—দ্যাও তো দেখি, যুদি কোমে একটু। যতভাবে পারে মেম্বার চেষ্টার কমতি রাখলো না।
—না রে ভাই কমে না। কী করবো কহ্যা তো!
—এক কাম করি? ঝড়ু ডাক্তারকে ড্যাক্যা লিয়া আসি। উ’শালা কিন্তু ভালো ডাক্তার, ওষুধ দিলেই কোম্যা য্যাবে। না হোল্যে মহলম লাগিয়া দিবো, আপনি চিন্তা করিয়ান না।
—যাকে পারবি লিয়া আয়। চুলকানির ল্যাগ্যা মোর্যা যাবো বে হামি?
সবাইকে দিয়ে চুলকিয়ে নিয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শুধু কী বাড়ির লোক! জায়গির, মসজিদের ঈমাম, প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, বেসরকারি কলেজের শিক্ষক, কেউই বাদ যাননি। সবাই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি৷
ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের ডাক্তার ফেল। এমনই চুলকানি, কিছুতেই কমে না। চুলকানির চোটে চেয়ারম্যানের নাকানি-চুবানি দশা। ইতোমধ্যে ইউনিয়নের পাড়ায় পাড়ায় রটে গেছে চেয়ারম্যানের এই কাহিল দশার কথা। আড়ালে-আবডালে মানুষ হাসাহাসিও করছে।
অনেকেই আসছে, দেখে যাচ্ছে, কেউ কেউ ফলমূল নিয়ে আসছে, উহু-আহা করছে, পানি পড়া থেকে আরম্ভ করে গঙ্গার জল কোনোকিছুই বাদ নেই, সবাই যারযার মতো পরামর্শ দিচ্ছে, একটু চুলকে দিয়েও যাচ্ছে কেউ কেউ, অতিমাত্রার অনুসারী সাজতে কেউ কেউ চুলকানির ফলে ঘা হয়ে যাওয়া জায়গাটায় চুমু দিয়ে যাচ্ছে, চেয়ারম্যানের সুনজরে আসতে টাকাপয়সাও দিয়ে যাচ্ছে কেউ-কেউ। এমনই চুলকানি, কিছুতেই কমে না, দিন দিন বেড়েই চলেছে। কমে না কিছুতেই।
সদরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে, কিছুতেই কিছু হয়নি। ঢাকা থেকে প্রতি শুক্রবার চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসে। তার কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোনো চিকিৎসায় কাজ হয়নি। কত ওষুধ, কত মলম—আরাম পাওয়া তো দূরের কথা, দিনকে দিন বাড়তেই আছে। ঝাড়ফুঁকও করিয়েছে, কবিরাজ, তাবিজ হারবাল, হোমিওপ্যাথি—সবকিছুই করা শেষ।
এলাকার বুজুর্গ- হুজুরদের পরামর্শে কোরআন খতম, মিলাদের আয়োজন, ফকির মিসকিন খাওয়ানোও হয়েছে। কিন্তু এই চুলকানি এমনই, কিছুতেই কমে না। চেয়ারম্যানের পক্ষের গণ্যমান্য সবাই মিলে বসে একটা উপায় বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উন্নতির কোনো উপায় দেখছে না কেউ। শত্রুরা আগে হাসাহাসি করতো, এখন তো সুযোগ খুঁজছে। দিনের পর দিন চেয়রাম্যানের অত্যাচারে যারা কাহিল হয়ে আছে, তারা এবার প্রকাশ্যেই বিরুদ্ধাচারণ করার পাঁয়তারা করছে।
ঢাকা যায় চেয়ারম্যান, দেশের সবচেয়ে বড় ডাক্তারকেও দেখানো হয়। কয়েকজন ডাক্তারকে দিয়ে বোর্ড বসানো হয়। সেই অনুযায়ী চলে চিকিৎসা। কিন্তু কোনো ওষুধেই কাজ হয় না। মাঝে ইন্ডিয়াও যায় চেয়ারম্যান। সেখানকার চিকিৎসাও ফেল। বাইরে-বাইরে খুব শক্ত থাকার চেষ্টা করে চেয়ারম্যান কিন্তু সামান্য চুলকানির কারণে তার এই দশা হবে—তা সে নিজেও ভাবতে পারেনি।
চুলকানি কমে কিন্তু ফিনকি দিয়ে সব বদরক্ত চেয়ারম্যানের শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে আর নিস্তেজ হতে থাকে চেয়ারম্যানের গলার স্বর।
চেয়ারম্যানের অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ইদানীং কেউ তার সামনেও আসতে চায় না। নিজের তিন বউ, যাদের সারাজীবন সুখে রাখার জন্য হেন কাজ নাই, যা চেয়ারম্যান করেনি, তারাও দূরে দূরে থাকে। মেম্বার, এলাকার গণ্যমান্য লোকজন আসে—সামনে সামনে অনেক কথা বলে। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে সবাই চেয়ারম্যানের ওপর বিরক্ত। চেয়ারম্যান সবই বুঝতে পারে, মনে-মনে ভাবে—চুলকানিটা সারুক। তারপর সব শুয়োরের বাচ্চার ব্যবস্থা নিজহাতেই করবে।
—হুজুর, কিছু মোনে না কল্লে একটা কথা কহিতুং, হ্যার কী মোনে হয় জানেন, আপনি নিজ হাত দিয়া যুদি চুলক্যাতে পাত্তেন তাহিলে মনে হয় চুলকানি কমতো। না হলে এত ওষুধ, এত ডাক্তার সভাই ফেল মারে? পিঠের এমনই বেকায়দা জায়গায় চুলকাচ্ছে, কোনোভাবেই ডান বা বাম হাত চুলকানির জায়গাটায় পৌঁছাতে পারে না।
—ঐ গরু জব্যাই করা ছোরাখান লিয়্যা আয় তো!
চেয়ারম্যানবাড়ির ফুটফরমায়েস খাটা সুকুদ্দি বারবার ধার দিয়ে রাখা ছোরাটা নিয়ে আসে। ছোরা নিয়ে এক কোপে নিজের বাম হাতের কনুই বিছিন্ন করে ফ্যালে চেয়ারম্যান! সুকুদ্দিকে নিজের বিচ্ছিন্ন কুনইটা তুলে দিয়ে পিঠের যে জায়গাটায় নিজের কোনো হাত কোনোভাবেই পৌঁছায় না—সেই জায়গাটা চুলকাতে বলে।
—সুকুদ্দি, হ্যা বে চুলকানি কিছুটা কোম্যাছে মোনে হোছে। কিন্তু পুরাপুরি সারে না যে বে।
—হুজুর হ্যার মোনে হয় ডাহিন হাত দিয়া চুলক্যালে আপনার চুলকানি পুরাপুরি স্যার্যা য্যাবে।
চেয়ারম্যান রক্তাক্ত ছুরিটা তুলে দেয় সুকুদ্দির হাতে, দিয়ে বলে মার। আবে মার কোপ। হামি কোহোছি কোপ মার।
—হামি কোপ মারবো আপনার হাতে? কী কহিছেন?
কবজি বিচ্ছিন্ন চেয়রাম্যানের বামহাত থেকে গল-গল করে রক্ত পড়ছে, ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। আশপাশে সবাই কী করবে বুঝতে পারে না, কেউ-কেউ অবস্থা বেগতিক হতে পারে ভেবে চুপচাপ কেটে পড়ে। বিচ্ছিন্ন কবজি দিয়ে চেয়ারম্যানের পিঠের জায়গাটা চুলকে দিচ্ছে সুকুদ্দি।
—মার, চুতমারানি, হামি কোহোছি তুই কোপ মার। আশেপাশে চেয়ারম্যানের আত্মীয়স্বজন, কাছের লোকজন সবাই সুকিদ্দিকে চেয়রাম্যানের আদেশ পালনের জন্য বলে।
সুকিদ্দি সজোরে কোপ মারে চেয়ারম্যানের ডান কবজি বরাবর। হাত থেকে বিচ্ছিন্ন দুই কবজি দিয়ে চেয়ারম্যানের পিঠ চুলকে দিতে দিতে মায়ের কথা মনে পড়ে যায় সুকুদ্দির। পিতৃপরিচয় গোপন রাখতে চেয়ারম্যান দুই হাত দিয়েই তার মাকে গলা টিপে হত্যা করেছিল।
চুলকানি কমে কিন্তু ফিনকি দিয়ে সব বদরক্ত চেয়ারম্যানের শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে আর নিস্তেজ হতে থাকে চেয়ারম্যানের গলার স্বর।