এই ছেঁড়ি, তুই কান্দোস ক্যান? প্রশ্ন শুনে ভেজা চোখ তুলে তাকায় আলেয়া। শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক-চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, এমনেই।
প্রশ্নকর্তা মহিলাটি এ কথায় সন্তুষ্ট হয় না। সে তার মোটাসোটা থলথলে শরীরটা নিয়ে আলেয়ার পাশে বসে পড়ে। তারপর আঁচলের খুঁট থেকে পান বের করে তাতে চুন-দক্তা মাখাতে মাখাতে বলে সেই সকালে এদিক দিয়া যাওনের সম দেখলাম বইসা আছ, এখন দুফর গড়াইয়া যায়, এখনো বসা। এলাইগাই জিগাইলাম। কুনু বিফদে পড়সোনি? মাইনষেই তো মাইনষেরে সায্য করে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে পানটা মুখে পুরলো মহিলা।
এত কথা শুনে আলেয়া এবার চোখ তুলে তাকালো। মহিলাটি পানের ছোট্ট পুঁটলিটা গোছাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড মহিলার দিকে তাকিয়ে থেকে আলেয়া বললো, তুমি এই শহরে থাকো? কতদিন ধইরা?
চোখ মুছে তার সাথে চলতে শুরু করে। চলার পথে কথায় কথায় জানতে পারে মহিলাটির নাম শাফিয়া। বড়লোকদের বাসা বাড়িতে কাজের লোক সাপ্লাই দেয়।
আলেয়ার কথা শুনে মহিলা বেশ একটু হেসে নিয়ে বললো, দ্যাহো মাইয়া, আমি শহরে আইছি ল্যাংটা কালে। বাপ মরলে মা‘রে দাদার বাড়িত থন খেদাই দিছলো। হের ফর মায়ে গেরামের এক ব্যাটারে বিয়া করলে হেই বেডায় মা’রে শহরে নিয়া আসে। আমারে নিয়া মার লগে হেই বেডার পত্তিদিন সকালে জগরা লাগে। এক সকালে ঘুম থেইকা উইঠা দেখি মা নাই। হেই বেডাও নাই। নাই তো নাই-আর কুনুদিন দেখি নাই। এই শহরে একা একা বড় হইছি। এলাইগাই কাউরে একা দেখলে আওগাইয়া আসি। সায্য করতাম চাই।
মহিলার কথা আলেয়ার মনে দাগ কাটে। ও বলে, একটা কাম কাইজ-খুঁইজা দাও না। কাল থেইকা না খাইয়া আছি।
ও প্যাটে খিদা! এ লাইগা কানতাসোস।
এডা কইবি না। ল আমার লগে। কাছেই থাহি। তেলাপিয়া মাছ রানসি। আমার লগে ভাত খাইবি।
মহিলাটির কথাবার্তা ভালো লাগে আলেয়ার। চোখ মুছে তার সাথে চলতে শুরু করে। চলার পথে কথায় কথায় জানতে পারে মহিলাটির নাম শাফিয়া। বড়লোকদের বাসা বাড়িতে কাজের লোক সাপ্লাই দেয়।
দুই.
তেলাপিয়া মাছের ঝোল, আর কচুর লতি দিয়ে তৃপ্তি করে ভাত খায় আলেয়া। বড় রাস্তা থেকে যে গলিটা একটা ভাঙা দেয়ালের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে, দেয়ালের ফাটা অংশ দিয়ে সরু লিকলিকে কাণ্ড নিয়ে ফুট দেড়েক বেড়ে উঠেছে একটা শিশু অশ্বত্থ, সেই গলিটা ধরে গজ বিশেক এগোলেই পনেরো ষোলোটা ঘরের ছোট্ট একটা বস্তি। ইটের দেয়াল টিনের ছাদের একটা ঘর আলেয়ার। দরজার সামনে চালের টিন খানিকটা বাড়িয়ে নিয়ে বারান্দার মতো। ওখানে ইট বিছানো। ইট গুলো রোদে জলে শ্যাওলা পড়ে সবুজাভ রঙ ধারণ করেছে। ওই ইটের ওপরই দুই পাশের সেলাই ছেঁড়া একটা মাদুর বিছিয়ে আলেয়াকে খেতে দিয়েছে শাফিয়া। প্রায় দুই দিন পর পেটপুরে ভাত খেয়ে হঠাৎই ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করে আলেয়া। প্লেটের ওপর হাতটা ধুয়ে নিয়ে ওখানেই শুয়ে পড়ে বলে, বুবু আমি এট্টু ঘুমাই? এরই মধ্য মায়ের বয়সী শাফিয়াকে বুবু ডাকতে শুরু করেছে সে।
শাফিয়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল খাওয়া-দাওয়ার পর আলেয়ার জীবনবৃত্তান্ত শুনবে। আলেয়াকে শুয়ে পড়তে দেখে নিরাশ হয়ে উঠে পড়ে। বলে, আইচ্ছা তুমি তাইলে ঘুমাও। আমি এট্টু ঘুইরা আসি। তারপর ঘরের দরজায় শিকল তুলে তালা দিয়ে বের হয়ে যায়।
সুতরাং দিনের বেশিটা সময় আলেয়া বাসায় একাই থাকে। নিজের ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে সব কাজ করে। দুপুরে খেয়ে নিয়ে টিভি রুমে বসে টিভি দেখে।
শাফিয়াকে বেরিয়ে যেতে দেখতে দেখতে লম্বা একটা হাই তোলে আলেয়া। ঘুম ঘুম লাগছে মনে হলেও ঘুম আসে না। অতীত ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
মাত্র সাতদিন আগেও একটা ঘর ছিল আলেয়ার। একটা সংসার ছিল। যদিও সে সংসারে সতীন ছিল। কিন্তু সেটা ছিল লোকজনে ভরভরন্ত। মাতৃপিতৃহীন আলেয়া অনাদরে অবহেলায় বড় হয়েছে মামা বাড়িতে। সেখান থেকে বিয়ে হলো প্রায় আড়াইগুন বেশি বয়সী এক লোকের সঙ্গে। বিয়ে হয়েছিল বটে তবে স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদার চাইতে বাড়ির কাজের মহিলা হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল বেশি। বাড়ি ভর্তি লোকজন, কামলা, কাজের লোক, আত্মীয় স্বজন—সব চালাতো আলেয়া। বিনে মাইনের ঝি আর কি! পুরো সংসারের দেখভাল ছাড়াও সতীন এবং সতীনের সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্বও ছিল তার কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হলো না। চরিত্রহীনা অপবাদ দিয়ে স্বামী তালাক দিয়ে দিলো।
মামারা ফিরিয়ে নিতে আসেনি। আর অভিমানে আলেয়াও ফিরে যায়নি সেখানে। অনির্দিষ্ট জীবনের পথে পা বাড়িয়ে আজ এ শহরে দ্বিতীয় দিন তার। একজোড়া পরনের কাপড় ছাড়া একটা পয়সাও নেই সঙ্গে।
বেঁচে থাকার জন্য একটা কাজ খুঁজতে হবে—এটাই এখন আলেয়ার একমাত্র চিন্তা।
তিন.
রান্না শেষ করে গোসলখানায় ঢোকে আলেয়া। বালতিতে ভেজানো কাপড়গুলো কেচে ছাদে শুকোতে দিয়ে এসে তবে নিজে স্নান করবে। এরকমই নির্দেশ দিয়ে গেছে এ বাসার কর্ত্রী।
আলেয়া ঢাকায় এসেছে মাসখানেক হয়। শাফিয়া তাকে এই বাড়ির কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। বাসায় লোকজন কম। গৃহকর্তা, তার স্ত্রী, এক ছেলে আর গৃহকর্তার এক ভাই থাকে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সকালে অফিসে চলে যায়। কলেজে পড়া ছেলেটাও বের হয় আটটা নাগাদ।
গৃহকর্তার ভাইটি বাসায় নিয়মিত থাকে না। মাঝেমধ্যে আসে। তিন-চার দিন থাকে। তারপর আবার চলে যায়। সুতরাং দিনের বেশিটা সময় আলেয়া বাসায় একাই থাকে। নিজের ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে সব কাজ করে। দুপুরে খেয়ে নিয়ে টিভি রুমে বসে টিভি দেখে।
আলেয়া মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়। এমন ভালো একটা বাসায় কাজ পেয়েছে বলে। একই সঙ্গে শাফিয়ার প্রতিও অনুভব করে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ছাদের টানানো প্লাস্টিকের দড়িতে কাপড় মেলে ক্লিপ আটকে দিতে থাকে আর গুন গুন করে নতুন শোনা গান।
এখন ভাদ্রের শেষ। সূর্য তার সমস্ত শক্তি জড়ো করে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করতে ব্যস্ত। তার মাঝেও দুপুর পেরোলে, আকাশের বুকে কোমল নীল ছড়িয়ে পড়ে। সে নীল পাখায় নিয়ে আপন মনে উড়তে থাকে উদাসী চিল।
আলেয়া একটা তারে দুহাতের ভর দিয়ে তার ওপর থুঁতনি রেখে শেষ দুপুরের আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে।
অনেক দূর থেকে কন্সট্রাকশনের শব্দ ভেসে আসছে। ভেসে আসছে রাস্তার কোলাহলও। তবে সেসব তার কানে প্রবেশ করে না। কোনো এক গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন মন।
কার কথা ভাবো? কানের খুব কাছে থেকে কারো কণ্ঠ—চমকে ওঠে আলেয়া। তাকিয়ে দেখে এপার্টমেন্টের গার্ড জয়নাল পাশে দাঁড়িয়ে।
লোকটাকে দুই চোখে দেখতে পারে না আলেয়া। কেমন কুতকুতে চোখে জুলজুল করে তাকায়। তাকানো দেখলেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। যেন কাপড়ের ওপর দিয়েই দেখে ফেলছে আলেয়ার শরীর। বয়সী লোকটার কথাবার্তা ও ভালো না। নানান ভাবে ভঙ্গিতে খারাপ ইঙ্গিত করে। আলেয়া দোকানে কোনো কাজে যেতে আসতে গেলে অশ্লীল কথা বলে। সেসব কথা বলা তো দূরের কথা, শোনা ও পাপ।
কিন্তু সাফকাতের কণ্ঠ শুনেই জয়নাল দ্রুত সরে যেতেই সেই আঘাত আলেয়ার মাথায় লাগে। তীব্রভাবে গুঙিয়ে ওঠে আলেয়া। লাল রক্তে ভেসে যেতে থাকে গোধূলির ছাদ।
এখন এই আঠারো তলার ছাদে, নির্জন অপরাহ্ণে জয়নালকে ছাদে দেখে আলেয়া ভয় পেয়ে যায়। ও তাড়াতাড়ি খালি বালতিটা হাতে নিয়ে ছাদ থেকে নামার জন্য পা বাড়ায়।
কিন্তু জয়নাল পথ রোধ করে আলেয়ার হাত টেনে ধরে, আহা এই বয়সে স্বামী খেদাইসে, তাই বইলা কি তোমার শরীল মইরা গেসে? স্বাদ আহ্লাদ অপূর্ণ রাখতে নাই—বলতে বলতে জয়নাল আলেয়াকে জাপটে ধরে। আলেয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে।
চার.
কলেজ থেকে ফিরে বাসার দরজায় তালা দেখে বিরক্ত হয় সাফকাত। নতুন বুয়াটা খালি ছাদে বসে থাকে—ভ্রূ কুঁচকে ওঠে ওর। লিফট ধরে সতের তলা ওঠার জন্য। বড্ড খিদে লেগেছে আজ। বুয়াটা ছাদে যে কী মজা পায় কে জানে! মাকে বলে বকা দিয়ে বুয়ার ছাদে যাওয়া বারণ করাতে পারে সাফকাত কিন্তু বুয়ার কথাবার্তা শুনলে সাফকাতের ভীষণ হাসি পায়। কী যে বোকা বোকা কথা বুয়ার! এমন বোকা মহিলাটাকে বকা খাওয়াতে মন সায় দেওয়া না। আর সাফকাত যখন বাসায় ফিরে খেতে বসে বুয়া খাবার তুলে দিতে দিতে অনেক গল্প বলে। সেসব গল্প শুনতেও ভীষণ মজা লাগে সাফকাতের।
লিফট থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে উঠতে আলেয়াকে ডাক দেয় সাফকাত।
ছাদে ওঠার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পানির ট্যাংকের পাশে জয়নাল আলেয়াকে ধরাশায়ী করে নিজের পশুবৃত্তি তৃপ্ত করায় মত্ত আর নিজেকে ছাড়াতে প্রাণপণে চেষ্টা করছে মুখ বাধা আলেয়া—দৃশ্যটা দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে সাফকাতের। সে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। পত্রপত্রিকা ইন্টারনেট ইত্যাদির কারণে দৃশ্যটা বুঝতে কষ্ট হয় না মোটেও। রাগে কান গরম হয়ে ওঠে।
ছাদের ওপর পড়ে থাকা পরিত্যক্ত একটা লোহার রড চোখে পড়তেই সেটা হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে—জয়নাল ভাই, বুয়াকে ছাড়ো তুমি।—বলতে বলতে রডটা তুলে জয়নালের মাথা লক্ষ করে একটা আঘাত করে। কিন্তু সাফকাতের কণ্ঠ শুনেই জয়নাল দ্রুত সরে যেতেই সেই আঘাত আলেয়ার মাথায় লাগে। তীব্রভাবে গুঙিয়ে ওঠে আলেয়া। লাল রক্তে ভেসে যেতে থাকে গোধূলির ছাদ।