আপনারাই বলুন দেখি, অমন স্ট্যাটাসের লোকের সঙ্গে কি মেশা যায়? ঠা ঠা করে হাসে, ঘষ ঘষ করে চুলকায়, খেক খেক করে তেড়ে আসে, যখন তখন পকেট থেকে মুরগির পাখা বের করে কান চুলকায় আর উ উ উ করে জান্তব আওয়াজ তোলে—এমন লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে বউ-বাচ্চার কাছে কি মুখ দেখানো যায়? আপনারাই বলুন।
বাড়ির সামনে পা রেখেই প্রতিদিন লোকটা এমন হৈ হট্টগোল বাধিয়ে দেয় যে, ভর-দুপুর কিংবা সন্ধেতেও পুরো পাড়া নড়েচড়ে বসে। কটকটে টিয়া রঙা একতলা ভবনের আশেপাশের উঁচু-নিচু ভবনের বাসিন্দারা জানালার ধারে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসে আর পান হরি চন্দ্রের কাণ্ড দেখে। দুই-একটি ইঁচড়েপাকা ছেলে-ছোকরা বাবা-মাকে লুকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে বলে, ‘পান হরি পান করে এসেছে।’
ওই অভ্যাস যে পান হরি চন্দ্রের নেই পাড়ার সবাই তা জানে। তবু তার নামের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে হালকা রঙ্গরসিকতা করতে এরা পছন্দ করে। পান হরি চন্দ্র আবার হাসিতামাশা বোঝে না। সবার ব্যঙ্গবিদ্রূপ উপেক্ষা করে সে দশ টাকা ভাড়ার রাস্তা পেরিয়ে পনেরো টাকা দাবি করা রিকশাচালককে ধর্ম-অধর্মের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওদিকে রিকশাচালক নব্বই কেজি ওজনের বাহককে টেনে এনে বাড়তি টাকা দাবি করে ম্লান মুখে হাসার চেষ্টা করলে যাত্রী আরও ক্ষেপে ওঠে। কথায় কথা বাড়লে পান হরি চন্দ্র চালককে এই মারে তো সেই মারে।
হৈ চৈ করতে করতে তার পা টলমল করে। এই দোদুল্যমানতা যে পানীয়র কারণে নয়, ইন্দ্রিয়ের উসকানির কারণে, তা ঠিকঠাক বুঝতে পান হরি চন্দ্রের কাছাকাছি দাঁড়ানো ব্যক্তিরও সময় লাগে। আর কে-ই বা দাঁড়াবে অমন লোকের কাছাকাছি? আপনারাই বলুন দেখি অমন স্ট্যাটাসের লোকের সঙ্গে কি মেশা যায়?
রোজ রোজ রিকশা বা অটোচালকের সঙ্গে একই ক্যাচাল চালায় সে। এরপর বাড়িতে ঢুকে কাপড় পাল্টে নিয়ে নিজের মতো ঢাউস একটি বালতি হাতে নিয়ে কাজে নেমে যায়। ঝড়-বৃষ্টির দিন ছাড়া বছরের তিনশ দিনই তাকে এই কাজ করতেই হয়। পান হরি চন্দ্রের বাড়ির সামনে যখন তিন ফুটি রাস্তা ছিল, তখন থেকেই সে এই কাজ আরম্ভ করেছে। এখন যে সেই তিন ফুটি রাস্তা ত্রিশ ফুটি রাস্তা হয়েছে, রাস্তার দুপাশ ঘিরে নানা হাইরাইজ ভবন উঠে গেছে, তাতেও পান হরি চন্দ্র ক্ষান্ত হয়নি। বালতির সঙ্গে মানানসই একটা পেটফোলা মগ নিয়ে রোজই সে তার বাড়ির সামনের রাস্তায় পানি ছিটাতে থাকে।
এদিকে ধূলা মজে রাস্তার প্রায় দু তিনশ গজ জায়গা যে কাদায় সয়লাব হয়ে যায় সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপই থাকে না। তা থাকবে কেন? এমন ভুঁড়িওয়ালা লোকের দৃষ্টি তো তার ভুঁড়িতেই ঠেকে থাকে। আর কি কিছু দেখে সে? জগতের আর কারও ভালোমন্দ বোঝে?
এই যে এই রাস্তা নিয়ে কি কম কাণ্ড হলো? সিটি করপোরেশন থেকে যেবার রাস্তার জন্য জায়গা নিতে এলো, বাড়ি বাড়ি নোটিশ দিলো, জায়গা ছাড়তে বললো,আমরা সেদিন কী করা যায়, সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাড়ির মালিকদের সমন্বয়ে মিটিং ডাকলাম। পান হরি চন্দ্র মিটিংয়ে তো এলোই না নিজের জায়গা থেকে আধা শতক জায়গা ছেড়ে দিয়ে মোড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে মুরগির কালো একটা পাখা কানের ভেতরে চক্রাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠা ঠা করে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো, ‘শালার বড়লোক, শব যাওনের রাস্তাও থোয় নাই।’
দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে পান হরি চন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেখে আমার স্ত্রী মিতার মতো শান্ত মেয়েটি পর্যন্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ‘এই তো হলো পুরুষ জাত। বউর চিতাও নিভতে দেয় না এরা।’
ওর মতো মুশকো পেটপোটা লোকের শব নিতে না হয় ত্রিশ ফুটি রাস্তা দরকার। তাই বলে আমাদের মতো সম্ভ্রান্ত মেপে চলা মেপে খাওয়া রুচিশীল মানুষকে সে শালা বলে গালি দেবে? অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার মাইদুল সাহেব অবশ্য কম যান না। আড়ালে আবডালে পান হরি চন্দ্রকে তিনি মালাউন বলেন। বলেন, ‘এই সব মালাউনের বাচ্চাকে পাড়া ছাড়া করা উচিত।’একবার মসজিদ থেকে ফেরার পথে সবার সামনে এ কথা উচ্চস্বরে বলে ফেলে তিনি অবশ্য জিভ কামড়েছিলেন।
শুধু মাইদুল সাহেব নন, আমরা সবাই জানি পান হরি চন্দ্রের স্ট্যাটাস আমাদের স্ট্যাটাসের সঙ্গে খাপ না খেলেও তাকে পাড়া ছাড়া করা সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িকতার সূত্রে ফেঁসে যাবো বলে আমরা সবাই নিতান্ত চুপচাপ থেকে ওর উচ্ছৃঙ্খলতা, অসভ্যতা সহ্য করে যাচ্ছি।
আমি বরাবর সবকিছু সয়ে যাওয়ার মতোই মানুষ। আমি পাড়া-মহল্লা; এমনকি নিজের সংসারের কোনো উটকো কিছুতেই থাকি না। ঝামেলায় না পড়তে হয় সেই চিন্তায় সিগারেট আনতে গেলে মোড়ের দোকানে পর্যন্ত বেশিক্ষণ সময় কাটাই না। মুখ বুজে দিন পার করাটাই এ যুগে টিকে থাকার অন্যতম যোগ্যতা তা হাড়ে হাড়ে বুঝি বলে সহজে ঘর থেকে দুপা বাইরেও ফেলি না। এমন কি বাসায় খবরের কাগজ পর্যন্ত রাখি না। আর একবার ওই পান হরি চন্দ্রকে দেখুন। তার প্রতিবেশী হয়ে সম্মানের সঙ্গে পাড়ায় বাস করার উপায় পর্যন্ত নেই। রোজ উঠানে চেয়ার পেতে বসে ভুঁড়ির ওপরে রেখে পত্রিকা পড়বে, ফেসবুক দেখবে আর মুখে গালির তুবড়ি ছোটাবে।
গোপনসূত্রে খবর পেয়েছি, লোকটা সপ্তাহে সপ্তাহে নামে-বেনামে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দেয়, ‘সব রসাতলে গেল।’ এ তথ্যটি অবশ্য পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেপেলের সংগ্রহ করা। বয়সের দোষে এসব নিয়ে ওরা রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ায়। আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে অবশ্য স্ট্যাটাসহীন পান হরি চন্দ্রের নামে কিংবা বেনামের স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আর তা থাকবেই বা কেন? আপনারাই বলুন দেখি অমন স্ট্যাটাসের লোকের সঙ্গে কি মেশা যায়?
আমরা সবাই তাই তাকে প্রাণপণে এড়িয়েই চলি। তবু এ এমন এক লোক সকাল সকাল অফিস কিংবা স্কুলে যাবার পথে যার যন্ত্রণা থেকে কারও রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই। রোজ সকালে স্যান্ডো গেঞ্জিটা বুক অবধি তুলে উঠানে দাঁড়িয়ে আধ ঘণ্টা ধরে দাঁত ব্রাশ করবে লোকটা। দাঁত পরিষ্কার করা শেষ হলে চকচকে পরিষ্কার মাথায় হাত বোলাবে আর স্ত্রীকে হাঁক ডাক দিয়ে নাস্তা দিতে বলবে।
পান হরি চন্দ্রের দাম্পত্যজীবন দেখতে ওপরতলার লোকেদের কাউকেই বিশেষ কসরত করতে হয় না। লোকটার হেঁড়ে গলা আর বাড়ি সংলগ্ন উন্মুক্ত উঠোনের কল্যাণে দেখতে না চাইলেও সকলেরই অনেককিছু দেখা হয়ে যায়। ঠিক পান হরির টাকের মতো।
পঞ্চাশোর্ধ পান হরি চন্দ্রের মাথার টাক তার ভুঁড়ির মতোই একটা দেখার মতো জিনিস বটে। ঘাড়ের কাছের এক গাছি চুল বাদ দিলে লোকটার পুরো মস্তকই বিশাল এক গড়ের মাঠ। তেল চুবানো চাঁদিতে নির্দয় রোদ হামলে পড়লে সে একখানা দেখার জিনিস হয়।
দেখতে দেখতে এর মধ্যে এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কার্তিকের এক ভোরে বুকের ব্যথায় ছটফট করতে করতে পান হরি চন্দ্রের স্ত্রী মারা যায়। তার ঘরে মানুষ বলতে ওই এক স্ত্রীই ছিল। পান হরি চন্দ্রের স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদটি বিশদে জানানোর আগে তার স্ত্রীর স্বভাব চরিত্রের সামান্য বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। ভদ্রমহিলার নাম ছিল তারা। এই সর্বনাম পদ তারা নয়, আকাশের তারাও নয়। গোয়ারগোবিন্দ আর অশ্লীল আয়তনের মানুষ পান হরি চন্দ্রের স্ত্রী তারা ছিল তার বরের একেবারে বিপরীত চরিত্রের মানুষ।
ছিমছাম গড়নের সন্তানহীনা তারার সাত চড়ে রা ছিল না। তাই বলে পান হরি চন্দ্র যে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতো তেমন কথাও আমরা শুনিনি। সুলক্ষণা আর ধীরস্থির তারার কণ্ঠস্বরও কখনো শোনেনি এই পাড়ার লোক। আর তারার প্রস্থানও হয়েছে তার যাপিত জীবনের মতো নিভৃতে, নিঃশব্দে।
পান হরি চন্দ্রের স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে চার তলার দুই ইউনিটের কাজ শেষে হাঁপিয়ে ওঠা হুমায়ূন সাহেব পর্যন্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই বার যদি পান হরি একটু শান্ত হয়।’
কিসের কী! স্ত্রীবিয়োগের এগারোতম দিনে শ্রাদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরেই পান হরি চন্দ্র হুমায়ূন সাহেবের ছেলে তৌকিরের সঙ্গে হৈ হট্টোগোল বাঁধিয়ে দিলো। তৌকির নাকি রাস্তার ধারে দাঁড়ানো পান হরি চন্দ্রের পায়ের ওপরে মোটরসাইকেল তুলে দিয়েছে। এই নিয়ে অনেক বাদানুবাদের পর পান হরি চন্দ্র জায়গা থেকে তো নড়লোই না, রীতিমতো খিস্তি শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত তৌকিরকেই দমে গিয়ে পিছু হটতে হলো।
এমন লোকের প্রতিবেশী হয়ে সম্মানের সঙ্গে আমরা যে পাড়ায় বাস করবো সেই উপায় পর্যন্ত নেই। এই দেখুন না আমাদের পুরুষ জাতির নাক কাটিয়ে স্ত্রী মারা যাওয়ার দুই মাসের মাথায় টোপর পরে কী ঘটা করেই না লোকটা ঘরে নতুন বউ এনে তুললো। দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে পান হরি চন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেখে আমার স্ত্রী মিতার মতো শান্ত মেয়েটি পর্যন্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ‘এই তো হলো পুরুষ জাত। বউর চিতাও নিভতে দেয় না এরা।’
আমরা দাঁতে দাঁত চেপে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখি, আমাদের আভিজাত্যকে মাটিতে মিশিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসদাতা পান হরি চন্দ্র মুরগির একটা কালো পাখা কানের ভেতরে চক্রাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে পুলিশের গাড়িতে উঠে যাচ্ছে।
হ্যাঁ এই হলো আমাদের পাড়ার পান হরি চন্দ্র। তা আপনারাই বলুন এমন স্ট্যাটাসের লোকের সঙ্গে কি মেশা যায়?
আমরাও তাই মিশি না। মিশতে চাইও না। বিশেষ করে অমনধারা লোকের সঙ্গে আমি ভুল করেও কথা বলতে যাই না। পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে চোখ বুলিয়ে যেমন কায়দা করে সব সহ্য করে যাই তেমন কায়দা করে ঐ বর্বর লোকটাকেও সহ্য করি। তবে আমার প্রতিবেশি ছয় তলা ভবনের মালিক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা জিকিরিয়া সাহেবের সহ্যক্ষমতা সামান্য কম। আর পান হরি চন্দ্রকে শায়েস্তার করার ব্যাপারে তিনি বরাবরই উৎসাহী। তাই কখনোই তিনি লোকটাকে ছেড়ে কথা বলেন না।
সেদিন দাঁত ব্রাশ করায় নিমগ্ন পান হরি চন্দ্রকে দেখে জিকিরিয়া সাহেব জোরে জোরে টিপ্পনী কাটলেন, ‘যেন গোটা পাঁঠা খেয়েছে। আধ ঘন্টা ধরে কীসের অতো ময়লা পরিষ্কার করা বুঝি না। এতোক্ষণে তো সারা দেশের ময়লা সাফ হয়ে যায়। দেশ উপচে যাচ্ছে ময়লায়, লরি আর ঝাড়ু হাতে বেরিয়ে পড়ো না কেন ভাই!’
এক কথা দুকথা নিয়ে পথ চলতি তিন-চারজনের মধ্যে দেশ নিয়ে কথা উঠল। জিকিরিয়া সাহেব বেমক্কা বলে বসলেন, ‘আরে ভাই দেশের যেই অবস্থা!’
সরকারি চাকরির পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের অপেক্ষায় থাকা জিকিরিয়া সাহেবের ছেলে মিন্টু বাবার হাত টেনে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করতে করতে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘কতবার বলেছি বাবা, একটাও বেফাঁস কথা নয়।’
ওদিকে যাকে নিয়ে কথার সূত্রপাত সেই পান হরিই বা ছাড়বে কেন। জিকিরিয়া সাহেব বাড়ির পথ ধরতেই সে ব্রাশ মুখে হৈচে শুরু করে দিলো। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে আশেপাশের সকলে শেষ রক্ষা করলো।
যাই হোক আমরা সাতে-পাঁচে না থাকা মানুষ, আপনারাই বলুন দেখি অমন স্ট্যাটাসের লোকের সঙ্গে কি মেশা যায়?
আমরাও মিশি না। কেবল বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালার গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে দেখে যাই পান হরি চন্দ্রের কীর্তিকাহিনি।
এইসব দেখতে দেখতেই একদিন চোখে পড়ে লোকটার বাড়ির সামনে মস্ত এক নীল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কানাকানিতে জানা যায় ও পুলিশের গাড়ি। বেফাঁস স্ট্যাটাস দিয়ে ভাইরাল হয়েছে আমাদের পাড়ার পান হরি চন্দ্র।
আমরা দাঁতে দাঁত চেপে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখি, আমাদের আভিজাত্যকে মাটিতে মিশিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসদাতা পান হরি চন্দ্র মুরগির একটা কালো পাখা কানের ভেতরে চক্রাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে পুলিশের গাড়িতে উঠে যাচ্ছে।