দক্ষিণের বাতাস উত্তর দিক থেকে আর উত্তরের বাতাস দক্ষিণের দিক থেকে—চারিদিকে আজ উল্টো বাতাস বইছে। সাধারণত শহরবাসী এমন ঘটনা আগে কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি। এরই মাঝে হঠাৎ বাসার পুরনো ল্যান্ডফোনটি বাজতে থাকে।
—ক্রিং ক্রিং। ক্রিং ক্রিং ক্রিং…
—হ্যালো।
—খেয়াল করেছিস কিছু?
—কী?
—আশ্চর্য…
—কী হয়েছে, বলবি তো।
—কিছু দেখতে পাচ্ছিস না?
—কী? কই?
—দ্যাখ। দ্যাখ, আশপাশে তাকিয়ে দ্যাখ।
—লাইনে থাক।
—আচ্ছা।
—তাই তো!
—আমার বেডরুমের জানালার গ্রিলে তিনটা টুনটুনি। কী সুন্দর!
—আমার বেলকনি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমার বেডরুমের ব্যালকনিতে দুইটা, হ্যাঁ, টিয়া পাখি। টিয়া বলেই মনে হচ্ছে।
—টুনটুনি তিনটা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
—তাই?
—কতদিন টুনটুনি পাখি দেখি না।
—আর টিয়া!
—টিয়ার ডাক শুনতে কী দারুণ।
—ডাকবে, ডাকবে। আমার একটা টিয়া ছিল। ছোটবেলায়।
—নিশ্চয় ডাকবে। যখন এসে বসেছে তখন ডাকবে নিশ্চয়।
—কী মুশকিল, কেমন মুখ ফিরিয়ে নিলো!
—তোর ওপর রাগ হয়েছে বুঝি।
—চাল বা মুড়ি কিছু দে।
—দিয়েছিলাম, খায় না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করে।
—ধরতে গেলেও উড়ে যায় না।
—যা-ই বল, দেখতে কিন্তু দারুণ লাগছে।
—হ্যাঁ।
—দ্যাখ, হাজিফুর কী স্ট্যাটাস দিয়েছে দেখেছিস?
—ওই শালা আবার কী স্ট্যাটাস দেবে?
—দেখইনা।
—ওর বারান্দায় চারটি ময়ূর!
—কী হলো আজ?
—বনজঙ্গল ছেড়ে পাখিরা লোকালয়ে চলে আসছে মনে হচ্ছে?
—নাকি চিড়িয়াখানার খাঁচাগুলো খুলে দিয়েছে কেউ।
—চিড়িয়াখানায় আর কয়টা পাখি?
—ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং।
যে শহরে পাখি বলতে কাক ছাড়া অন্য কিছু নেই, সেখানে এত পাখি! কিভাবে সম্ভব? সাইফুল ফোন রেখে জানালা দিয়ে উঁকি দিলো বাইরের দিকে। অবিশ্বাস্য। তার এই আটচল্লিশ বছরের জীবনে সে এমন দৃশ্য কখনোই দেখেনি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাইফুল আবার কল দিলো জাহিদকে।
—দোস্তো, দেখছস? ফেসবুকে গিয়ে দেখ কী তেলেসমাতি ব্যাপার।
—কেন ফেসবুকের আবার কী হলো?
—গিয়েই দ্যাখ না!
—আরে আমি বারান্দায়। এই এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
—যা দেখছিস তা শুধু তুই না। অনেকেই দেখছে। হাবিবকে কল দিয়ে দ্যাখ। ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে রীতিমতো পাখির হাট বসে গেছে।
—কিন্তু এত পাখি এলো কোত্থেকে?
—যেখান থেকেই আসুক, ব্যাপারটা দারুণ। একটা-দুইটা না। শত শত পাখি। রঙ-বেরঙের পাখি। নাম না জানা পাখি।
—ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। শতশত কী বলিস? হাজার হাজার পাখি। আমার তো মনে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ পাখি। এই এইমাত্র একটা পাখির দল উড়ে এসে বসলো পাশের ফ্লাটের সামনের জারুল গাছটিতে। অসম্ভব ব্যাপার।
—আরে প্রত্যেকের টাইমলাইনে শুধু পাখি আর পাখি। নানান জাতের, নানার রঙের পাখি।
—অবাক। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে? তোর কী মনে হয়? আমি জীবনেও এত পাখি এক সাথে দেখিনি।
—অনেকেই পাখি দেখতে বেরুচ্ছে, কেউ কেউ শাহবাগের দিকে যাচ্ছে।
—ইতোমধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর রমনা পার্ক নাকি পাখিতে সয়লাব হয়ে গেছে?
—কিসের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান? সব জায়গাতেই পাখি, দেখার মতো ব্যাপার। অসংখ্য পাখি চারিদিকে কিচিরমিচির করছে। কলকাকলিতে ভরে উঠছে শহর।
—আচ্ছা, এক জাতের পাখি কী অন্য জাতের পাখির ভাষা বুঝতে পারে?
—হিব্রু ভাষা না জানলে তোর সামনে কেউ কথা বললে বুঝতে পারবি?
—বের হবি?
—হ্যাঁ। কিন্তু অফিস?
—আরে ব্যাটা আজ অফিস বাদ দে।
—এমন সুযোগ আর জীবনে না আসতেও পারে!
—বেরিয়ে আয়।
—দাঁড়া। দাঁড়া। আমার বারান্দার সামনে একঝাঁক তিতির, ছবি তুলে রাখি। কী অসম্ভব সুন্দর!
—আমিও তুলেছি। আমার জানালার কার্নিশে এসে বসেছে পনেরো বিশটা পায়রা। বাক বাকুম বাক করছে।
—কাঁটাবন থেকে একটা খাঁচা কিনে আনব আসার সময়। কয়েকটা পাখি ধরে খাঁচায় রাখবো। পুষবো।
—কী মুশকিল! ছবি তুলেছি কিন্তু ছবি তো আসছে না!
—যাশ্শালা। ছবি আসবে না কেন? তোর মোবাইল ক্যামেরায় সমস্যা।
—দাঁড়া। আমি তুলে পাঠাচ্ছি।
—কই? পাঠা।
—জানালার গ্রিলে বসে থাকা টিয়া দুইটার ছবি তুললাম, কিন্তু ছবি তো আসছে না।অবাক কাণ্ড।
—তোর মোবাইল ক্যামেরায়ও সমস্যা। হা হা হা। খুব তো ভাব নিলি।
—উঠেছে। এবার উঠেছে। কিন্তু আমার ব্যালকনিতে বসে থাকা তিতির তিনটার ছবি না। পাশের ফ্লাটের পাঁচটা তোতা পাখির ছবি তুললাম। শালা পাখিগুলোও কী স্মার্ট। ছবি তুলতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
—পাখি! আবার স্মার্ট। আমার বাসার উলটো দিকের বাসার সামনের নিম গাছে শয়ে শয়ে পাখি বসে আছে। ওদের ছবি তুলে দেখ।
—তোর তোলা ময়নাগুলোর ছবি দেখলাম। কী দারুণ। এফবিতে পোস্ট দে।
—দিচ্ছি। আগে তুই ছবি পাঠা।
—হ্যাঁ। ছবি উঠেছে। সেই রকম। কিন্তু আমার জানালার কার্নিশের টিয়া দুইটার ছবি কেন উঠছে না?
—আচ্ছা তুই বেরিয়ে আয়। প্রচুর মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে যাচ্ছে। ওখানেও নাকি একই অবস্থা।
—কী হলো এই শহরের।
—তুই বের হ।
—ইতোমধ্যে খাঁচার দাম বাড়া আরম্ভ হয়েছে। বাঙালি ব্যবসা বোঝে না, ধান্দা বোঝে।
—কিন্তু পাখি ধরে খাঁচায় পুরার সাথে সাথে পাখিগুলো নাকি মানুষের ভাষায় কথা বলা আরম্ভ করছে।
—ভালোই তো। পাখির সাথে কথা বলতে ভালোই তো লাগবে।
—আরে শালা যা বলছে, সে কথা শুনে সাথে সাথে পাখিগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছে সবাই।
—ক্যানো সবার গোপন খবর ফাঁস করে দিচ্ছে না কি?
—আর বলতে!
—আচ্ছা কোথায় যাওয়া যায় বল তো?
—শাহবাগের দিকে যাবি? না কি চন্দ্রিমার দিকে?
—আমি বের হচ্ছি। তুই বেরিয়ে আয়।
—আজ রিকশায় যাবো দোস্তো। পাখি দেখতে দেখতে যাবো দুইজনে।
—এতক্ষণে ঢাকার প্রায় সব মানুষ নেমে পড়েছে রাস্তায়। রিকশা চলবে বলে মনে হয় না।
—আচ্ছা বের হ আগে।
মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় মাটির মসজিদের কাছেই থাকে সাইফুল। ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ামাত্র সামনের ফ্লাটের কিবরিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা। তার চোখেমুখেও বিস্ময়।
—ভাই, কোথায় যান?
—আরে ভাই অবাক কাণ্ড ঘটছে পুরো শহরে।
—হ্যাঁ। সারা শহরে শুধু পাখি আর পাখি। নাম না জানা রঙ-বেরঙের পাখির ডাকে মুখরিত শহর।
পাখি দেখতে বেরুলাম। কে জানি এমন সুযোগ আর কোনোদিন আসে কি না।
—ভাবী-মেয়ে কই?
—আপনার ভাবী মেয়েকে নিতে স্কুলে গেছে। ওদের স্কুল থেকে নিয়ে পাখি দেখতে যাবো। আজ সারা শহর ঘুরবো।
—ও আচ্ছা।
—আপনি অফিসে যাচ্ছেন?
—আরে না। আজ এমন দিনে আবার কিসের অফিস? আমিও পাখি দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। শাহবাগের দিকে যাবো।
—চলুন। চলুন। এই সুযোগ হয়তো জীবনে আর আসবে না।
—কিন্তু কী হলো বলেন তো?
—এ শহরে কাক ছাড়া অন্য কোনো পাখির দেখা পাওয়াই দুষ্কর। এত পাখি এলো কোত্থেকে?
—সেটাই তো?
—ওই যে দ্যাখেন? দ্যাখেন?
—কত্ত পাখি।
—কোনো কোনো টিভি লাইভ দেখানোও আরম্ভ করেছে।
—তাই?
—আচ্ছা ভাই আসি।
—আপনারা কোনদিকে যাবেন।
—আমি চন্দ্রিমার দিকে যাবো। আপনি তো শাহবাগের দিকে তাই না?
—হ্যাঁ। ভাই আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করলাম, আমাদের রান্নাঘরে তিনটা চন্দনা পাখি এসে বসেছে। ছবি তুললাম। কিন্তু অবাক, ছবিগুলো আসছে না। এমন সময়ে আমার মোবাইলের ক্যামেরাটা নষ্ট হলো।
—আপনার সাথেও এমন হয়েছে?
—কেন? আপনারও একই অবস্থা? কিন্তু দূরের গাছে বা বারান্দার গ্রিলে বসে থাকা পাখিদের ছবি তুললে সেগুলো আবার আসছে। কী আশ্চর্য না!
—মানে? আমি তো ভেবেছি আমার ক্যামেরা নষ্ট।
কথা বলতে বলতে দুইজন নিচে নেমে এলো, এসেই সাইফুল দোতলার, মানে তার বাসার বারান্দায় বসে থাকা তিনটা তিতির পাখির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল।
—ওই যে দেখছেন, আমার বাসার বারান্দার গ্রিলে,ওই যে তিনটা টুনটুনি বসে আছে। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই ছবি ওঠে না।
—আপনি তোলেন তো দেখি, ওঠে কি না?
কিবরিয়া তার হাতের স্যামসাং এইট প্লাস মোবাইলটা বের করে ছবি তোলার চেষ্টা করে।
—হ্যাঁ, এই তো কী সুন্দর ছবি উঠেছে! প্রিন্ট করে ঘরে টাঙিয়ে রাখার মতো ছবি।
—ভাই প্লিজ। শেয়ার ইট দিয়ে ছবিটা আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দেন না।
—আচ্ছা দিচ্ছি। তার আগে চলুন আমার রান্নাঘর লাগোয়া গাছটায় বসে থাকা বসে থাকা পাখিগুলোকে দেখাই আপনাকে। আপনার ক্যামেরা দিয়ে ওদের ছবি তুলে দেবেন? আমি কত চেষ্টা করলাম!
—ভালো বলছেন। এই এই তো, উঠেছে। কী সব অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড!
—কই দেখি? আহ দারুণ। ভাই প্লিজ পাঠিয়ে দিন। ছবিটা পাঠিয়ে দিন ভাই।
দুই জনেই মোবাইলে শেয়ারইট চালু করলো। ছবি সেন্ড হলো। একজন আরেকজনের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে ছবি দেখার চেষ্টা করল।
—ভাই, বুঝলাম না ব্যাপারটা। ছবি উঠল কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কেন?
—তাই তো?
আরও পড়ুন: যন্ত্র ও মানবিকতা ॥ সোলায়মান সুমন
ততক্ষণে সারা শহরে শুধু পাখি আর পাখি। রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে, মার্কেটে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিস আদালত, বাসে ট্রেনে—সব জায়গায় শুধু পাখি আর পাখি। নানান জাতের পাখি, চেনা পাখি তো আছেই, নাম না জানা অসংখ্য পাখিও আছে। কেউ জানে না এতো পাখি এলো কোথা থেকে। অনেকে কোন কোন পাখিকে এর আগে কখনই দেখেনি।
শুধু লাইভ দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি টিভি চ্যানেলগুলো, কোনো কোনো চ্যানেলে ইতোমধ্যে টকশো’র আয়োজনও করে ফেলেছে। বেশ কয়েকজনকে পাখি বিশেষজ্ঞ বানিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।
সাইফুল একটা রিকশা ডাকে, কিন্তু রিকশাওয়ালা যেতে রাজি হয় না। আরেকজনকে ডাকলে সেও রাজি হয় না যেতে, এভাবে আরও কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে ডেকেও রাজি করাতে পারে না সাইফুল তখন বুঝে যায়, আজ কেউ কোনো কাজ করবে না। আজ সবাই পাখি দেখবে।
উপায়ন্তর সাইফুল হাঁটতে আরম্ভ করে। উদ্দেশ্য শাহবাগ হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানেই নাকি পাখির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ রেলগেটের কাছে এসে দাঁড়ালে জাহিদের সঙ্গে দেখা হয় সাইফুলের। দুই বন্ধু পাখি দেখতে দেখতে শাহবাগের দিকে এগুনো আরম্ভ করলো।
সত্যিকার অর্থেই আজ পুরো ঢাকা শহরের মানুষ নেমে এসেছে রাস্তায়। ইদে ঢাকা শহর ফাঁকা থাকে, পূজাপার্বণেও সবাই নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যায়। পহেলা বৈশাখে মানুষ রাস্তায় নামে, কিন্তু এত মানুষ কখনোওই একসঙ্গে নামে না। চারিদিকে মানুষ আর পাখি, পাখি আর মানুষ। মানুষের উৎসাহ আর পাখিদের কলকাকলি—এই দুই মিলে এক অভিনব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে শহরে।
হাঁটতে হাঁটতে দুই বন্ধু কখন এসে পৌঁছেছে শাহবাগে, খেয়ালই করেনি। এখানে তো মহাসমুদ্র, মানুষ-পাখি। চারিদিক থেকে খবর আসছে। উত্তরা, গুলশান, বনানী, মহাখালী, ক্যান্টনমেন্ট, মিরপুর, শ্যামলী, জুরাইন, সায়দাবাদ, ওয়ারী- শহরের সবখানেই একই অবস্থা। শুধু পাখি আর পাখি। শুধু মানুষ আর মানুষ।
উৎসবের এমন উপলক্ষ তৈরি হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পাখিমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলছেন, এই যে হঠাৎ এত এত পাখি, এই যে সবাই উৎসবে মেতে উঠেছেন তা আমাদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এত পাখির আনাগোনা শুভ সংবাদ হয়ে কাছে এসেছে আমাদের জন্য। আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। আপনারা আনন্দ করুন, উৎসব করুন। খেয়াল রাখুন কোনো চক্রান্তকারী যেন আপনাদের আনন্দঘন উৎসবে কোনো ব্যাঘাত না ঘটাতে পারে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাবরের মতোই প্রস্তুত আছে।
শাহবাগে দাঁড়িয়ে সাইফুল আর জাহিদ, শুধু ওরা কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ—এমন উৎসবে যোগ দিতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনের ক্রমাগত খারাপ সংবাদে মানুষ খুব বিরক্ত, অতিষ্ঠ। বিশেষ করে ধর্ষণের খবর- শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে বাদ যায়নি, এমনকি পিতা দ্বারা সন্তানের ধর্ষণের খবরও শোনা গেছে। এই অস্থির সময়ে এমন পাখি উৎসব মানুষের মনে শান্তির পরশ হয়েই এসেছে, অনির্ধারিত এ উৎসব মানুষের মন থেকে বিগত দিনের যন্ত্রণা-ক্ষোভ মুছে দিতে না পারলেও সেগুলোকে কিছুটা প্রশমিত করবে তা এই আনন্দঘন পরিবেশ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।
—কোন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে না, দোস্ত। অবাক ব্যাপার না?
—আরে, আছে, আছে। যাবে কই! এদিকে অতিরিক্ত ভিড় দেখেই হয়তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
—বালের কথা বলো, ভিড় তাই কোনো মাল নেই!
—দোস্ত আমি কিন্তু একটা কাজ করছি।
—কী?
—তিনটা পাখি ধরে…
—আমিও…
—তুইও! আজ বাসায় ফিরে পাখির মাংস খাবো।
—দারুণ জমবে দোস্ত।
—ভাই আপনারাও এ কাজ করেছেন, আমিও।—ফিসফিস করে বলে মুচকি হাসলো সাইফুল-জাহিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক।
—আমার তো মনে হয় সবাই।
পাখি-ভিড়ের ভেতর থেকে একটা বাক্য ভেসে এলো, নারীদের দেখতে পাচ্ছেন না, তবে কি তারা পাখি হয়ে গেছে। হয়তো পাখি-জীবন বেছে নিয়ে পুরুষের জিঘাংসা থেকে নিজেদের বাঁচাতে চাইছে তাঁরা।
—নারীরা পাখি হয়ে গেছে?
—যত্তসব গাঁজাখুরি কথা।
—কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এটাও তো সত্যি।
—ভাবী আর তোর দুই মেয়ে কই?
—ওরা বেড়াতে গেছে।
—আর সুধা ভাবী, রাইতা, কাহিনী? ওরা? ওরা কোথায়?
—ওরা তো মার্কেটে গেছে, বললো।
—শোনা যাচ্ছে, চারুকলার গেইটে বসে থাকা একটা দোয়লে নাকি গড়গড় করে কথা বলছে।
—ধুর বাল!
—এই, এই দ্যাখ—বলেই তার হাতের মোবাইলটা এগিয়ে দিলো জাহিদের দিকে।
—চল, দেখি তো গিয়ে।
দোয়েলের কথাগুলো প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু নিজেদের কৃতকর্মই কথাগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে সব পুরুষের কাছে। সাইফুল ও জাহিদ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। চারপাশে চোখ বোলায়, কোনো পাখিকেই পরিচিত মনে হয় না তাদের কাছে, নিজের স্ত্রী-কন্যাদের মতো তো নয়ই।
শুধু জাহিদ, সাইফুল নয়, এমন একটা সংবাদ শুনে মুহূর্তের মধ্যে হাসিতামাশা, পরবর্তী সময়ে সাময়িক উত্তেজনা এবং অবশেষে হতবিহবল হয়ে পড়ে আশপাশের অনেকেই, আস্তে আস্তে চুপসে যায় উৎসবের আমেজে থাকা মানুষগুলো। বিশ্বাসটা জেঁকে বসার আগেই চূড়ান্ত অস্থিরতা লক্ষ করা যায় সবার মধ্যে। হঠাৎ সবাই দৌড়াতে আরম্ভ করে নিজ নিজ বাড়ির দিকে!