তাকে বিষণ্ন শোনায়। গোধূলি-সন্ধ্যার আলো-অন্ধকার ভেদ করে তার দৃষ্টি আরও একবার দিগন্তরেখার নিচ দিয়ে ছুটে যায় সেদিকে, যেদিকে মানুষেরা বহুকাল থেকে বসবাস করে আসছিল নিসর্গের সঙ্গে মিশে। চিম্বুক আরও দূরে। উজানিপাড়া, প্রুরাজার বাড়ি, রতিকান্ত ভান্তের হাতে গড়া বৌদ্ধমন্দির কি শঙ্খ নদীর কোল ঘেঁষে ছোট-ছোট কুটিরগুলো নিভে থাকা আলোর টুকরোর মতো দেখাচ্ছিল। হয়তো শেষবারের মতো নাকে এসে লাগে ঙাপ্পি’র আঠালো ঘ্রাণ। ডন বসকো স্কুলের ছাদে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে অস্কার গোমেজের টিভি-অ্যান্টেনা। অগ্নিদগ্ধ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে পড়ছিল কয়েকজন জুমিয়া সামনের দিনের শস্যের ভাবনা মাথায় নিয়ে। শেষবারের মতো উঠে পড়ার আগে কর্নেল হোসেন জালাল দেখতে পেলেন বছর পনেরো আগেকার এক উজ্জ্বল সকালবেলা উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত বেলায়। তার নামের আগে অবসরপ্রাপ্ত বা বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত কথাটা যুক্ত করতে পারলে তার সবটা পরিচয় খোলাসা হয় কিন্তু অবসরে তার আপত্তি হেতু আমরা শুধু তাকে তার হোসেন জালাল নামের মধ্যেই স্থিত রাখতে পারি।
ঝলমলে রোদের সকালবেলাটাই তার মনে উঁকি দেয় যদিও তারা এসেছিলেন পূর্বদিন সন্ধ্যায়। প্রথম রাতের স্মৃতি বলতে শুধু উচ্চতা আর উচ্চতা। মনে হচ্ছিল হঠাৎই তারা ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু এক জগতে এসে ঢুকে পড়েছেন, যেখান থেকে সমতলে পৌঁছনোর সব পথ বন্ধ। তাদের দলে ছিল চল্লিশ জন। কাগজে-কলমে তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্টের রোগী থাকার কথা নয় তবু দলের চারজনকে জরুরি অক্সিজেন দেওয়া হয় প্রথম রাতেই। শৈলাবাসের জানলা দিয়ে তাকাতেই ওপরে গোটা আকাশ এবং নিচে গাছপালা-ঘরবাড়ি। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ছায়া-ছায়াময়তা তাকে আচ্ছন্ন করে। আকাশের নক্ষত্রকণা এবং অরণ্যের দুয়েকটি ক্ষুদ্রাকার আলোকের উৎস চারদিককার অন্ধকারকে আরও পূর্ণ করে তুললে হোসেন জালাল জীবনে প্রথমবারের মতো ভয় অনুভব করতে শুরু করেন। স্তব্ধতার কারণে নয়। এমন নিশ্ছিদ্র অরণ্যবিধূরতার কোনো কূলকিনারা করা যায় না। এক অবর্ণনীয় বিবিক্তির বোধে আক্রান্ত হ’ন তিনি। সেই আচ্ছন্নতার বোধ পরদিন সকালের রোদে অনেকখানি মিলিয়ে যায় কিন্তু সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে ফিরে আসে। প্রাথমিক অভিজ্ঞতাটুকু আনন্দেরই ছিল। সন্ধ্যায় পাহাড়ে ঢুকবার সময়ে এখানকার জীবনের প্রায় সবটাই ছিল দৃশ্যহীনতার মধ্যে। চোখধাঁধানো সবুজে তিনি দেখতে পান পাহাড় ফুঁড়ে সহসা বেরিয়ে পড়েছে লোকালয়। থাকার জায়গাটা একেবারে পাহাড়ের শীর্ষে হওয়ায় সেই লোকালয়কে বুঝবার জন্যে মাঝখানে যেটুকু দূরত্বের নিরাপত্তা থাকে তা পেরিয়ে সবটা দৃশ্যের যথাযথ অনুবাদ হয়তো ঘটে না। দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায় ব্যস্ত জীবনের ধারা স্থির দৃশ্যের মতো যেন আল্গা-আল্গা হয়ে আসে। কারও কাঠ-বাঁশের ঘরের আঙিনায় শিকেয় হাড়ি ঝোলে। ঊর্ধ্ব ও নিম্নাঙ্গে থামি জড়িয়ে একা বা বাচ্চা পিঠে রমণীরা কর্মরত। শূকরগুলো কখনো খেলছে, কখনো ছুটছে মায়েদের পেছন-পেছন। কোনো-কোনো উঠোনে তীব্র রোদেও শূকরেরা ঘুমিয়ে থাকে। চীবর-পরিহিত শ্রমণেরা ইতস্তত এবং ব্যস্ত মন্দিরের এলাকায়। কোনো মন্দিরের বারান্দায় অভিজ্ঞ শীলভদ্রের ত্রিপিটক-ব্যাখ্যানে মগ্ন নবীশ ভিক্ষুরা। দূরে পাহাড়ি ঝর্ণাধারায় স্বচ্ছ জলে স্নান করে আদিবাসী মেয়েরা। শঙ্খের ধারা স্তিমিত। তবু অল্পক্ষণ পর-পর একটি-দু’টি নৌকো বা ডিঙ্গি পেরিয়ে যায় হঠাৎই পাহাড়ি স্থবিরতায় গতির সংযোজনায়। নৌকোর যাত্রীদের অধিকাংশ পাহাড়ি। তাদের সম্বল বাঁশবেতের সামগ্রী। সম্ভবত বিক্রির উদ্দেশ্যে অভিযাত্রা। কারও হাতে জুমের পাকা পেঁপে, কলা কিংবা অন্য কোনো ফল বা অন্য কোনো জিনিস। সত্যি বলতে কি এই বিচিত্র জীবনের বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে থাকা হোসেন জালালের মনে এক আশ্চর্য বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল সেই সকালে।
একটু পরেই তাদের ডাক পড়ে কুইনিন-পর্বে। চারদিকে পাহাড় আর সবুজ গাছপালার বৃত্তে এক টুকরো সমতলে তাদের চল্লিশ জনের দলটি একত্রিত হলে বাঁশিতে একটি তীব্র নির্দেশ ঘোষিত হয়। ছন্দোবদ্ধ হতে সময় লাগে না কারও। এ এক ধরনের প্যারেডই কিন্তু এর লক্ষ্য একটু ভিন্ন। কিছুক্ষণ ওয়ার্ম-আপের পর একজন পদস্থ কর্মকর্তা নবাগতদের সবাইকে কর্মজীবনে সুস্বাস্থ্য ও নীরোগ শরীরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ছোটখাটো একটি বক্তৃতা দেন। কঠিন শৃঙ্খলা ক্যাস্ত্রো কিংবা দেং শিয়াও পিং-এর দীর্ঘ জীবনে কী করে মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল সেই দৃষ্টান্তও তিনি উত্থাপন করেন। সবশেষে কর্মকর্তাটি পার্বত্যজীবনে ম্যালেরিয়ার প্রাণঘাতী তৎপরতা বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এবং তার কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একজন ব্যাটম্যান একটি চারকোণা পিচবোর্ডের বাক্স হাতে কোত্থেকে যেন এসে হাজির হয়। হয়তো ঘিয়েরঙা তাঁবুর বুক চিরেই সে বেরোয়। প্রতি লাইনে আটজন করে চলিশ জনের জন্যে মোট পাঁচটি লাইন।
সে কুইনিনধারী পেরিয়ে যায় মধ্যম ধরনের ধীর পদক্ষেপে। প্রত্যেককে তখন হাতে তুলে নিতে হয় একটি করে কুইনিন এবং সেই সঙ্গে একটি করে কাগজের ডিসপোজেবল গ্লাস। তাদের এক হাতে শাদা কুইনিন, আর হাতে জলের গেলাস। আরেকবার বাঁশির শব্দে তাদের আরামের অবস্থান ছেড়ে ক্ষিপ্রতায় দাঁড়াতে হয় সতর্ক অবস্থানে যে-অবস্থানকে সচরাচর যুদ্ধযাত্রার মুহূর্তের অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাদের বাম হাতে ধরা শূন্য গ্লাসগুলি ভরে ওঠে দ্বিতীয় ব্যাটম্যানের তৎপরতায়। শেষ বাঁশির ধ্বনির অর্থ ডান হাতে ধরা কুইনিন দ্রুত মুখের গহ্বরের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে বাম হাতের গেলাসের পানিতে ট্যাবলেটটাকে সরাসরি পাকস্থলীতে পাঠানোর প্রক্রিয়া। হোসেন জালাল অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে পালন করেন কুইনিন-পর্বের নিয়মাবলী। তিনি যে মৃত্যুকে বা ম্যালেরিয়াকে বা ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যুকে ভয় পান তা নয়, তার মনে হয়েছে তাকে সেই নির্দেশ মেনে চলতে হবে, যা ওপরের নির্দেশ এবং একদিন তিনিও ওপর থেকে নির্দেশের ক্ষমতাধারী হবেন। তখন নিম্নের লোকেরাও, তার আশা তার মতই পালন করবে নির্দেশ যা ওপর থেকে আসা। কিন্তু হোসেন জালাল একই সঙ্গে এটাও লক্ষ করলেন যে, সকলেই ওপরের নির্দেশ মানেনি এবং তাদের ক্ষেত্রে বেয়াদব বা বিদ্রোহী শব্দগুলোর মধ্যে কোনটির ব্যবহার যথাযথ, তা ভাবতে-ভাবতেই তিনি দেখেন এবং দেখে নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হয় না। তাদের দলের বেশ কয়েকজনই তাদের ডান হাতে ধরা কুইনিনটিকে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে পার্শ্ববর্তী ঝোঁপ বা গাছের দিকে বা কোনো কিছুর দিকে না, শূন্যতার দিকে। দৃশ্যটি তার কাছে নিতান্ত কৌতুককর বলেই ঠেকে। পরে বন্ধুস্থানীয় আমির তাকে গোপন পরিকল্পনার কথাটি ফাঁস করে দেয়। আসলে তিক্ততার ভয়ে ভীত হয়েই তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজটির উদ্যোগ নিয়েছিল। কী করে যেন পর-পর তিনটি কুইনিন-সেশনই তারা পেরিয়ে যায় দক্ষতায় কিন্তু সেই কৌতুককর উপাধ্যায়গুলো শেষ পর্যন্ত এমন এক করুণ অধ্যায়ের পরিপ্রেক্ষিত হয়ে উঠবে, সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি হোসেন জালাল।
মাসদেড়েক পরে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের শৈলাবাসগুলো মুহূর্মুহু কেঁপে ওঠে হেলিকপ্টারের অপ্রস্তুত ধ্বনিতে। কোনো যুদ্ধাবস্থার আসন্নতায় বা রণপ্রস্তুতির জন্যে নয়, মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে ছুটে আসছিল উড়ন্ত দূত। সংকট বোঝা গিয়েছিল শেষ রাতেই। জরুরি বার্তা পাঠানো হয় চিকিৎসা-সাহায্য চেয়ে। রাতভর জেগে ক্যাম্পের চিকিৎসক প্রাণপণ চেষ্টা চালান তার যাবতীয় অর্জনের ওপর নির্ভর করে কিন্তু তাকে হাল ছেড়ে দিতে হয় এক পর্যায়ে। চল্লিশ জনের তাদের দলটির দশজনকে জরুরিভাবে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএইচ-এর দিকে। পরে গুঞ্জনের হাওয়া বহু দূর থেকে ভেসে আসে পাহাড়ের কন্দরেও। দশজনের মধ্যে অন্তত চারটে ছিল মৃতদেহ। তাদের মৃত্যু ঘটেছিল হেলিকপ্টার এসে নামার আগেই। তাদের সকলেই আক্রান্ত হয়েছিল সেরিব্র্যাল ম্যালেরিয়ায়। এভাবেই মারা যায় দশ জন, মরতে-মরতে টিকে থাকে সাত/আট জন। হোসেন জালালের তখন মনে পড়ে, সেদিন এরাই ফাঁকি দিয়েছিল কুইনিনকে কিন্তু মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
মৃত্যুর প্রথম ধাক্কা অতিক্রান্ত হোসেন জালালের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, অন্তত ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু তার হবে না। তবু একটা অনিশ্চয়তা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কে জানতো এমন ক্ষমতাধর আলেক্সান্ডার এত নদ-নদী পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে এসে শেষে মারা পড়বেন দ্বৈরথে নয়, যুদ্ধে নয় সর্দি-কাশি-জ্বরে! ক্যাম্পে মানে পাহাড়ে তাদের চারদিককে ঝুঁকিমুক্ত করার যথেষ্ট উদ্যোগ এরই মধ্যে চোখে পড়ে। বড়-বড়, বিস্তৃতিপ্রধান, গভীর-ঘন অরণ্যময় বিটপিদের করা হয়েছে নির্মূল। বৃক্ষ নিজে ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও একে শত্রুরা ঝুঁকিতে পরিণত করতে পারে, তাই এমন বাড়তি সচেতন উদ্যোগ। তারা যে নির্মূল হয়ে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে তা অবশ্য বলা যাবে না। সেসব বিশাল সব ট্রাকে করে উপনীত হয় রাজধানীতে এবং হাল আমলের দেশি-বিদেশি সৃজনশীল-চমকপ্রদ ডিজাইনের আওতায় গিয়ে তাদের জীবন আরও বিচিত্র ও রূপান্তরময় হয়ে ওঠে। কিন্তু এত সবের পরেও হোসেন জালালের ভয় কাটে না। অরণ্যের ঘনত্ব কমলেও জীবনের দিকে প্রতি মুহূর্তে ধাবমান ঝুঁকির শঙ্কা কমে না। রোজ-রোজ অস্ত্রের চালান আসে, নতুন-নতুন ভারি-হাল্কা অস্ত্র চারদিকে স্তূপীকৃত হতে থাকে। সেসবের অনেকগুলোই হোসেন জালাল নিয়ন্ত্রণে অক্ষম তবু তার ভাবনা হয় জীবনরক্ষার প্রয়োজনে হয়তো অক্ষম তিনিই যথাসময়ে সাড়া দিয়ে উঠবেন যান্ত্রিক ভাষায়। মরতে-মরতে এক রাতে এরকমই এক অভিজ্ঞতা হয় তার যখন তিনি দেখতে পান মৃত্যু তার কাছ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে।
‘কম্যান্ডো অ্যাটাক’ বিষয়ে একটা ওয়ার্কশপ হচ্ছিল একটু ভেতরের দিকে একটা জায়গায়। নির্জনতা আর নিসর্গ জায়গাটাকে করে তুলেছিল মনোরম। সেখান থেকে অদূরে গিরিখাতে একটু নিম্নে বয়ে যায় ‘ঝিরি’। সেই নির্জনতায় ঝিরির প্রায়-নিঃশব্দ বয়ে-চলার গতিও বুঝি কানে এসে লাগে। সারাদিনের ওয়ার্কশপ ব্যস্ততার পর অস্থায়ী ক্যাম্পে হোসেন জালাল এবং অন্যরা শুতে যায় বেশ তাড়াতাড়িই। মাঝরাতে তাদের ঘুম ভেঙে গেলে তার মনে হতে থাকে এমন এক দুঃস্বপ্নের বাস্তবে তারা জেগে উঠেছেন শুধুমাত্র একটা নিরর্থক লড়াই চালিয়ে শেষে তাদের হারটাকে নিশ্চিত করার জন্যে। তার নিজস্ব অস্ত্র তারই কব্জায়, সকলেই আত্মরক্ষার কায়দায় সশস্ত্র তবু সেই রাতের নিসর্গ-বিদীর্ণ-করা চিৎকার যেন সহসা মৃত্যুপুরীর দরজা খুলে দেওয়া অননুকরণীয় একটি অধ্যায় যা কেবল একবারের জন্যেই উন্মোচিত হয় দৃষ্টির সামনে। ওয়ার্লেসের হ্যালো-রজার-ওভার-এর মুহূর্মুহু আর্তনাদে উৎকর্ণ পাতারাও। চারপাশ ঝলসে যেতে থাকে আগুনে। আঁচ গায়ে লাগে। তাবু’র ক্যানভাস, দড়িদড়া, কাগজের বান্ডিল, কাঠের আসবাব ইত্যাকার সমস্ত কিছু আগুনের ডানায় চড়ে কোন্ দিক হতে যে কোন্ দিকে ছুটে যায় কে জানে! হোসেন জালালও দৌড় দেন দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, সকলের সঙ্গে। কিন্তু তারা তাদের আশ্রয় সম্পর্কে নিশ্চিত নন। তাদের আগুনে ছুড়ে দিয়ে শত্রুরা যদি নিরাপদ অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে তাদের সবাইকে অব্যর্থ লক্ষ্যে পরিণত করে তাহলে চকিতে হোসেন জালালের মনে হয় দিবাভাগের ‘কম্যান্ডো অ্যাটাকে’র সমস্ত কুশলতার পাঠ তারাই নিল যারা এইসব স্বীকৃত ওয়ার্কশপের কোনোটাতেই কোনোদিন অংশ নেয়নি। তবু তারা আগুন থেকে বাঁচতে দিগভ্রান্তের মতন অন্ধকারের দিকেই ছোটে। আগুন নেভে। নিভে গেলে চারদিকে আর কোনো সাড়া মেলে না। শেষে দেখা গেল কোনো আক্রমণ নয়, পাল্টা আক্রমণ নয় সমস্ত দুর্যোগের মূল হোতা একটি প্রবারণার ফানুস। উল্কার মতো এসে পড়েছিল তাবুর গায়ে।
এবারেও মৃত্যুর আশঙ্কাকে এড়িয়ে আয়ুষ্মান হয়ে রইলেন হোসেন জালাল। আড়ালের সেই জীবন আড়ালে থেকেই নানা দিক থেকে তাকে উদ্ঘাটনের স্বাদ দেয়। তার একেকবার মনে হয় মানুষ তো পাহাড়েই থেকেছে শত-শত হাজার-হাজার বছর আগে। তবু সমতল থেকে আসা মন পাহাড়ের নিবিষ্টতায় আস্থাশীল হয় না, তার মন এমনই নিদ্রিত নাগরিকতা দিয়ে ঠাসা। পাহাড়ের নির্মল অক্সিজেন প্রাণ ভরে তিনি নেন, তার ফুসফুস পূর্ণ হয়ে ওঠে পূর্ণ প্রাণে তবু তার মনে হয় ঢাকা—যে-শহরে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে যার মধ্যে সকলেই রয়ে যায় কিন্তু তার থাকা হয় না। মাঝে-মাঝে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে বটে, শুধু চাকুরিকেই জীবনের মুখ্য বিষয় ভেবে নেশায় মগ্ন হওয়ার অবকাশ হলো না, পেশার সর্বগ্রাসিতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি। অথচ একটু কী এই জীবনের এই বৈচিত্র্যের গভীরে যাওয়া যেত না চাইলে! কেবল পলায়নপরতাতেই কেটে গেল সময়। কখনো-কখনো টিলার ওপর থেকে কর্তব্যের দূরবিন লাগিয়ে সুদূর জীবনের দিকে দৃষ্টির আস্তৃতিকে মুহূর্তের জন্যে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি ভাবতেন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ কী করে এই গহিন বৃত্তে অতিক্রান্ত হয়ে যায় জীবন। এ-জীবনও তো যায় চক্রাকারেই। এখানেও তো আছে আবর্তন। মনে হয় যেন মেঘের পরে মেঘের মত বৈচিত্র্যহীন বা একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তিই তো এই জীবন। কিন্তু এর ভেতরেও আছে স্তরতা। এখানেও জীবন খুলে-মেলে একটি পরত অন্য পরতের সঙ্গে না মিশে সমান্তরাল হয়েও অনেক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে পাশাপাশি বয়ে গেছে। শহুরে দৃষ্টি দিয়ে কিংবা পেশার বৈষয়িক বিচক্ষণতা দিয়ে সেই গভীরতাকে কখনো আবিষ্কার করা হয়নি। হয়তো তার আবিষ্কারের ইচ্ছে ছিল না।
কলেজ-জীবনে পড়েছিলেন গিলগামেশ—সুমেরিয় সভ্যতার এক জীবন-জাগানো কাহিনি। একই জাতি টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের ওপরে-নিচে থেকে মানে সমান্তরালে থেকেও একে-অন্যের দিকে ছুড়ে দেয় হননের তীর, অস্তিত্বের প্রয়োজনে। সেনাপতি এনকিডুকে হারিয়ে লড়াইয়ের উদ্যম হারানো গিলগামেশ ফের উদ্দীপ্ত হ’ন তারই স্বজাতির মানুষদের অনুপ্রেরণায়। আর যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন বলে তিনি শপথ নেন তারাও তার প্রতিবেশী। মানব-জাতি বার-বার প্রতিবেশীকে অপমান করেছে, তার নিয়ম ভঙ্গ করেছে, নতুন নিয়ম একে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। ফলে, হোসেন জালালের মনে হয়, মানুষ কখনো মানুষকে সমষ্টিগতভাবে ভালোবাসতে পারেনি। মানুষ কখনো তার নিজের ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করে দেয়নি বৃহত্তর সংঘবদ্ধতার জন্যে। কেবল প্রাপ্তির উন্মাদনা নিয়েই সে জীবন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্যকে আক্রমণ করার জন্য। নইলে এই পাহাড়ের ভেতরেই একবার এক রক্তারক্তির কাণ্ড ঘটে গেল। মুরংদের সঙ্গে মুরংদেরই। যে দু’টি দল পরস্পর পরস্পরকে মারার জন্যে উদ্যত তারা হুবহু একই জাতি। দেখতেও কোনো পার্থক্য নেই তাদের মধ্যে। পরে দেখা গেল নিজেদের জাতিগত ঐক্যকে তারা একেবারে একে অন্যের বিপরীত করে রেখেছে একটি অভ্যেস বা আচার দিয়ে। সেটা কী—একদল চিয়াপন্থী মানে গোপন্থী এবং অন্যদল চিয়াবিরোধী মানে গোবিরোধী। যারা গোপন্থী তারা গরুকে পূজোর যোগ্য মনে করে এবং তারা গোহত্যা করে না। যারা চিয়াপন্থী নয়, তাদের মধ্যে গরুর জন্যে কোনো সম্মান নেই, ফলে তারা গোহত্যা করে। হোসেন জালাল ভাবেন, মানুষের জন্যে নয় গরুর জন্যে একটা জাতির একই রকম জনগোষ্ঠির মধ্যে চিরকালের বিভেদ তৈরি হয়ে থাকল। কোনোদিন তারা এক হয়ে মিলিত হতে পারবে না। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবে একটি গরু। দাঁড়িয়ে থাকবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখবার জন্যে।
হোসেন জালাল বিরতি দেন। পাহাড়ে অতিবাহিত তার জীবনটা এমন ক্ষুদ্র-পরিসর নয় যে, এক বৈঠকেই তার সবটা বৃত্তান্ত বর্ণনযোগ্য। আবার সেই জীবনটা এমন বিস্তৃতও নয় যে তার বর্ণনার জন্যে অসংখ্য দিনরাত্রির প্রয়োজন। কখনো কোনো উপলক্ষে সেই জীবনের অভিজ্ঞতার তিনি অংশভাক্ কাউকে করেননি। হয়তো সে রকম সময় হাতেও আসে না তার। ঢাকা শহরে সবাই ব্যস্ত। সপরিবারে তারও থাকা হয় পাহাড়ে। কিন্তু সেটা যেন অনেকটাই পিকনিক-পিকনিক ঘরানার থাকা। যখনই তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঢাকা পাড়ি জমিয়েছে সেই অধিবাস স্থায়ী হয়েছে মাসের পর মাস। কখনোই তার স্ত্রীর মনে হয়নি দূর থেকে নয়, পেশার আনুষ্ঠানিকতার আসন থেকে নয় নিতান্ত উৎসবের টানেই একটি/দু’টি দিন না হয় শিথীল স্পন্দন হয়ে গড়িয়ে যাক তাদের দিক থেকে জলের আনন্দের দিকে। না হয় পাহাড়ের মাধুর্য গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিই একটি/দু’টি প্রহর। সেই অবকাশ হয় না তাদের। কাজেই খুব জোরের সঙ্গে বলা হয় না, বা বলতে তিনি পারেন না যে পাহাড়কে তিনি ভালোবাসতে পেরেছিলেন। সেটা একটা অগ্নিপরীক্ষার মতো তার সামনে এসে তাকেই পরীক্ষার্থীতে পরিণত করবে, তা কখনো ভাবতে পারেননি হোসেন জালাল। বিরতি দিয়ে পুনরায় তিনি সেই জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে চান যে-জীবনে তিনি কোনোদিন ঢুকতে চাননি, যে-জীবন থেকে সর্বদা বেরিয়ে আসার প্রণোদনাতেই ভুগেছিলেন তিনি অহর্নিশ।
যখন তাকে অবসর দেওয়া হয় তখন, বলা যায় তখনই পাহাড়ের প্রতি তার একটা আবেগ একটু-একটু করে কোথাও দুধের সরের মত জমে উঠছিল। সেটা তিনি টেরও পেতে শুরু করেছিলেন। প্রথম ঘটনায় সমতল আর পাহাড় মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। অবস্থা শেষে এমন চরমে পৌঁছায় যে সেনাবাহিনীকে নামতে হয়েছিল সমাধানের প্রচেষ্টায়। হোসেন জালালকে তখন অনেকটা সময় পাহাড়ের ভেতরেই একবার সমতল একবার পাহাড়ি এরকম ছোটাছুটিতে হয়রান হয়ে যেতে হয়। মিশন স্কুলের এক বাঙালি শিক্ষকের একটা কবিতা ছাপা হয় একটা জাতীয় দৈনিকে। সে-কবিতায় এক বাঙালি যুবকের প্রেমের অকুণ্ঠ প্রকাশকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু বিপত্তির সূচনা সেই চমৎকার প্রেমের কবিতাটি নিয়েই। সচরাচর রাজনৈতিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ইত্যাদি নানা কারণে সমস্যার উদ্ভব ঘটে আসছিল পাহাড়ে। সেখানে রাজনীতি বা সমস্যার সঙ্গে আপাত বিচ্ছিন্ন সাহিত্য এবং কবিতার মতো এমন একটি অপ্রত্যক্ষ মাধ্যমকে কেন্দ্র করে এহেন গোলযোগের আশঙ্কা কারও পক্ষেই করা সম্ভব ছিল না। কবিতাটি যেদিন ঢাকার কাগজে ছাপা হয় সেদিনই পাহাড়ে কাগজটি এসে পৌঁছায়। কিন্তু সেই বিকেলে কোথাও কোনো অনিয়ম লক্ষ করা যায় না। পরদিন দুপুরের দিকে একটা হৈচৈয়ের সংবাদ ছাউনিতে এসে পৌঁছায়। উজানিপাড়ায় কয়েকটি বম যুবক সেই বাঙালি শিক্ষক এবং কবিকে ঘেরাও করেছে। মূলত শিক্ষক সেই ব্যক্তি তার কবিসত্তাকে পুরোপুরি নেপথ্যে রেখে শিক্ষকসত্তার বর্ম দিয়েই নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালান কিন্তু বম যুবকেরা নাছোড়। শিক্ষক প্রথমটায় ভেবেছিলেন যুবকদের মধ্যে তার বর্তমান কিংবা প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ না কেউ থাকবে। বাস্তবে দেখা গেল তেমনটি দুর্লভ। যুবকেরা তাকে ঘেরাও দিয়ে বম রমণীকে বিষয়বস্তু করে কবিতা লেখার কারণ জানতে চায়। শিক্ষক-কবির সবচাইতে দুর্বল অবস্থানের হেতু হয়ে পড়েন তিনি নিজেই। কবিতাটিতে কেবল একটি পাহাড়ি মেয়ের কথা থাকলেই হতো কিন্তু বাঙালি কবি তার কবিতায় একটি পাহাড়ি নারীর নামোচ্চারণ করেন এবং বাস্তবে সে একজন বম রমণী হয়। তিনি অবশ্য বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, তিনি বম বা মারমা বা চাকমা নয় একটি চিরন্তন নারীকেই আঁকার চেষ্টা করেন। তাতে জিজ্ঞাসুরা তৃপ্ত হয় না। তারা এর মধ্যে অন্য গন্ধ খুঁজে পায়। তাদের মনে হয় যে কবিতাটিতে এক বাঙালি যুবক এবং এক পাহাড়ি নারীর অন্যায্য মেলবন্ধন দেখানো হয়েছে যা বাস্তবের সম্পূর্ণ বিরোধী। তাদের ধারণা, কবির অন্তিম বাক্যটাই বম রমণীর দিকে একটি তীব্র তীরের মতো ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে যা আক্রমণাত্মক এবং যাকে প্রেমের প্রতিফলন বলে গণ্য করা অনুচিত। লাইনগুলো হচ্ছে- ‘তোমার অন্তরের ঝর্ণায় আমি ঝাঁপ দেবো হে … … (সেই বম রমণীর নাম) তুমি উত্তুঙ্গ মেঘের মতো উড়ে যাও, পাহাড় ছাড়িয়ে অ-পাহাড়ের দিকে!’ কী বোঝালো এতে! ঘেরাওকারীদের কথা হচ্ছে, সোজাসাপ্টা ভাষায় একজন বাঙালি যুবক একটি পাহাড়ি মেয়েকে সুকৌশলে পাহাড় থেকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধান্দা করছে। তা না হলে এমন সরাসরি নামোচ্চারণ কেন, যখন সেই নাম থেকে স্পষ্টত তার নৃ-গোষ্ঠির পরিচয়টি শুধু নয় তার ব্যক্তিগত পরিচয়টিও গোপন না থেকে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। সবাই জানতে পারল, পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি শিক্ষক তার বাসা থেকে খানিকটা দূরে বাস করা বম রমণীকে প্রেমে আহ্বান করছে। বাঙালি শিক্ষক যতই বোঝাতে চায়, বম রমণীরা কী প্রেমশূন্য হৃদয়ধারী, যদি তা না হয় তাহলে কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও তার জন্যে হৃদয়ে একটুখানি আবেগ জমিয়ে রাখতে পারে না!
রাস্তায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঝগড়া করা যায় কিন্তু সাহিত্যের বিশেষ করে কাব্যের আলোচনা করা যে কতটা দুঃসাধ্য, সেটা সেদিনকার মুখোমুখি অবস্থানে থাকা বাঙালি শিক্ষক আর বম যুবকদের দেখে আন্দাজ করা গিয়েছিল।
এদিকে বম যুবকদের মধ্যে বাঙালি শিক্ষক-কবির কোনো বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র না থাকলেও বিবাদ-বিসংবাদের হেতুর সন্ধান নিতে চাওয়া মারমা বাসিন্দা যে তখন সেখানকার মণ্ডলীর হেডম্যানও বটে, দেখতে পেল তার প্রাক্তন শিক্ষকই বম-কবলিত অবস্থায় খানিকটা উপদ্রুত হয়ে পড়েছেন। তখন বলতে গেলে তারই দৌত্যে এবং অকুস্থলে পৌঁছানো হোসেন জালাল ও তদীয় সহযোগীদের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ার শপথ নিয়ে স্থান ছেড়ে চলে যায়।
পরের ঘটনা আরও ভয়ংকর যেখানে হোসেন জালাল প্রাণসংশয়ের মতো পরিস্থিতিতে পড়েন। অপরাহ্নের পর-পর ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন তিনি। পাহাড়ের সব জায়গাই এমন। সবখানেই ঝিরি আছে, সবখানেই সরু রাস্তা আছে, সবখানেই বাঁক আছে। হাঁটতে-হাঁটতে কোন্ বাঁক থেকে বাঁক নিয়ে কোন্ বাঁকে যে তিনি এসে পড়েন তা তার মনেই থাকে না। হয়তো একই সঙ্গে তিনি তার মনের মধ্যে তার নিজেরই জীবনের পথে ঘুরতে-ঘুরতে পথ হারিয়ে বসেন কোন এক বাঁকে গিয়ে। একটু হয়তো আনমনাও হয়ে পড়েন। বিকেলটা এত মনোরম, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আর নৈসর্গিক যে, মনে হয় কোনো এক অজানা স্বর্গ থেকে এই বিকেলটা হোসেন জালালের কথা মনে রেখেই রচনা করা হয়েছে। এটা মনে হতেই তিনি প্রায় প্রকৃতির কাছে পারবশ্য মেনে কোথাও উদাসীনতার উত্তুঙ্গ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছিলেন, যা তাদের চাকরির শর্তকেও লঙ্ঘন করে চলে যায়। কেননা, তার চাকরির শর্তই হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে তটস্থ রাখা, নিজেকে। একটা শব্দ হতেই দ্রুত এক লাফে নিচু হয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে তিনি বসে পড়েন। তার মনে হয়, ওপর থেকে তাকে লক্ষ করে কেউ স্নাইপার আক্রমণ চালিয়েছে। সেটা দুর্ঘটনাও হতে পারে কিন্তু শতভাগ সাবধানতা অবলম্বন করে আস্তে আস্তে আরও গভীর অরণ্যের মধ্যে ঢুকে পড়েন তিনি। জায়গাটা সম্পর্কে পুরোপুরি না হলেও কাজ চালানোর মত একটা আন্দাজ তার তৈরি হয়েছে গত ক’বছরে। একটু আড়ালে পৌঁছে চারদিকে একটা জরিপ চালান তিনি। যদি স্নাইপার আক্রমণ হয় তাহলে তাকে লক্ষ করেই হয়েছে। তিনি অন-ডিউটি নন বলে ইউনিফর্ম পরিহিত থাকেন না। কিন্তু আক্রমণকারী হলে অবশ্যই সে তাকে নজরে নিয়েই গুলি ছুড়েছে। অথবা হতে পারে দুর্ঘটনাবশে অন্য কোন লক্ষ্যের নিকটে যেতে ব্যর্থ হয়ে তা তার দিকেই তেড়ে এসেছে যা তার দৃষ্টিতে আক্রমণেরই সামিল। কিন্তু পাহাড়ের শীর্ষভাগগুলো তাদেরই দখলে। সেখানে তাকে আক্রমণ করবার জন্যে আক্রমণকারীকে অবশ্যই আগে নিজের অবস্থানকে মজবুত করা চাই। তা না হলে পাল্টা আক্রমণে তারও মারা পড়বার সম্ভাবনা থেকে যায়। হোসেন জালাল এরই মধ্যে অরণ্যে একটা পার্বত্য কুটিরের কাছে এসে পড়েন। একটি মাচাং। সেদিকটাতে কয়েকটি পরিবার থাকে যারা ঠিক একটি পরিসর পাড়া নয়, কয়েক ঘর বাসিন্দা। তাদের একজনের বাস অপর জনের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে যাকে ছাড়া-ছাড়া বলা যাবে। তাদের এমন অবস্থিতির সঠিক হেতু হোসেন জালালের জানা না থাকলেও ব্যাপারটা পাহাড়ে মাঝে-মাঝেই দৃষ্টিগোচর হয়। হয়তো এরও কোন গূঢ় কারণ নিহিত থাকা সম্ভব।
হোসেন জালাল দ্রুত পরবর্তী আক্রমণ থেকে বাঁচবার আগেই একটি মাচাংয়ে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই এক মাঝবয়েসী পুরুষের সামনাসামনি পড়ে যান তিনি। ইশারায় নিজের আশ্রয়প্রার্থিতা প্রকাশ করেন তিনি এবং লোকটি তাকে বসতে বলেন ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ভাষায়—তার নিজস্ব উচ্চারণে বাংলায়। লোকটা সেখানে একাই থাকে—খিয়াং নৃগোষ্ঠির মানুষ। নামটা এমন স্থায়ীভাবে হোসেন জালালের মস্তিষ্কে ঠাঁই করে নেয় যে কোনোদিন সেটিকে ভোলা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। চিংথোয়াই খিয়াং, সম্প্রতি বিপত্নিক হয়েছে। কথা ছিল সাংলান-এর পর বউকে নিয়ে সে ঢাকা বা চট্টগ্রাম যাবে ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু তার আগেই কিডনি-রোগি বউ তার মরে যায় এবং নিঃসন্তান চিংথোয়াই-এর একমাত্র অবলম্বন বসে-বসে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর স্মৃতিচারণা। সেই সন্ধ্যার কথা হোসেন জালালের মধ্যে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে যায়। চিংথোয়াই-ই জীবন রক্ষা করে তার এবং তার তৎপরতার ফলেই সেদিনকার স্নাইপার-উত্তর ঝুঁকি এড়িয়ে হোসেন জালালের পক্ষে পুনরায় ক্যাম্পে ফেরা সম্ভব হয়। চিংথোয়াই তাকে আশ্বাস দেয় সব শুনে। বসতে বলে একটা কাঠের পিঁড়িতে এবং চাল আর কলা দিয়ে বানানো পিঠে খেতে দেয় তাকে। বেড়া-কাঠের দেয়ালে একটা রঙিন বুদ্ধমূর্তির ছবি শোভা পাচ্ছিল আর চিং তার স্ত্রীবিয়োগোত্তর দিনেও একটা সান্দ্র স্বরের গুনগুন ভাঁজছিল হোসেন জালালকে মাটির কলসি থেকে পানি ঢেলে দিতে-দিতে—‘নি পয়েইটি নাম লেহা তোং তিলা/ নাং নেচেতাল ও মুতচু ও-ও/ নি নামলা নিহুই অপয়েই ইনিপেক/ নাং মঙা নোবোনালায়্যাম…।’ অর্থটা খুব জানতে ইচ্ছে করে তার এবং বাংলা আর আঞ্চলিক মিশিয়ে চিংথোয়াই যা বলে তা চিরকালের জন্যে মনে গেঁথে যায় হোসেন জালালের, ‘এই সুন্দর গ্রাম ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ ও মেয়ে, এই গ্রাম তোমায় অনেক সুন্দর দিয়েছে, এর মত সুখ তুমি কোথায় পাবে!’ হয়তো গতায়ু স্ত্রীর শোক-ই চিং-এর গানে মুখ্য কিন্তু হোসেন জালালের মনে হয় আজ বিকেলে যদি তার অতর্কিতে মৃত্যু হতো তবে কেউ না বললেও চিংথোয়াইয়ের এই গান তার জীবনের জন্যেও যথার্থ বলে মনে হতো।
সত্যিই তো এই পাহাড়ের জীবন থেকে হোসেন জালাল অনেক কিছুই পেয়েছেন। তার এমনও মনে হয় পাহাড়ের জীবন তাকে অভিজ্ঞতার বৃত্তকে পূর্ণ করে তুলবার সন্তুষ্টি এনে দেয়। পাহাড়ে না এলে তিনি কখনো অনুভব করতে পারতেন না যে শুধুই বড়-বড় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গাড়িঘোড়া আর রকমারি কলস্বনের নামই জীবন নয়। সম্পূর্ণ বিযুক্তির বোধ নিয়ে একদম কোন এক সুদূর উপকণ্ঠে প্রায় নৈর্ব্যক্তিক হয়ে পড়ে থেকে অবলোকন করতে-করতে বেঁচে থেকে ক্রমশ জীবনশেষের দিকে গড়িয়ে যাওয়াও তো অনেক সুন্দর একটা প্রবহমানতা হতে পারে! খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর হোসেন জালাল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তাতে টেলিগ্রামের ধরনে তিনটি শব্দ লেখেন এবং যেহেতু ইতোমধ্যে চিং তাকে সম্পূর্ণ অভয় দিয়েছে তার নির্ভরতার সপে সেহেতু উদ্ধারের চেষ্টা তাকে চালিয়ে যেতেই হয়। সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময়ে চিং হোসেন জালালের সেই সাংকেতিক শব্দযুক্ত কাগজটা নিয়ে পৌঁছে দিল তাদের সেনাক্যাম্পে। পাঁচজনের একটা উদ্ধারকারী দল এসে হোসেন জালালকে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। সম্পূর্ণ জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে অভিভূত হোসেন জালাল এবং অন্য সৈনিকেরা চিংথোয়াইকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, কখনো কোন প্রয়োজনে সে যেন এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে হোসেন জালাল এবং তারা সকলেই তার সহায়তায় সর্বদা প্রস্তুত রাখবে নিজেদের। চিংথোয়াই মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। আর উর্ধমুখী হাত তুলে স্মরণ করে গৌতম বুদ্ধকে।
সেদিনকার সেই মৃত্যুচিহ্নিত বিকেলটি হোসেন জালালের মনে একটা নতুন ধরনের বোধের জন্ম দেয়। যদি সে স্নাইপার আক্রমণে মারা পড়তো, তাহলে এর পরে ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে আরও যে-একটা জীবনের পট উন্মোচিত হয়ে যায় তা তো কোনদিনই ঘটতো না। তাহলে কী ঘটবার জন্যে এমন সব ঘটনা প্রতি মুহূর্তেই তৈরি হয়ে থাকছে না কোথাও না কোথাও! নিশ্চয়ই থাকছে এবং মানুষের সঙ্গে সেসবের দেখা হচ্ছে না কারণ মানুষেরা সেসবের অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই দুম্ করে মরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের কথাটাই ভেবে দেখে হোসেন জালাল। এই যে একটা মারণাস্ত্র নিয়ে সারাদিন পাহাড়ের শীর্ষে বসে-দাঁড়িয়ে বা এপাশে-ওপাশে টহল দিয়ে কী সে অর্জন করছে বাস্তবে! এরকম মারনাস্ত্রের সামনে কী জীবনের মহৎ ও মহত্তর ঘটনাগুলি দেখা দেবে! এ রকম সংকুচিত ও সরু পথে কী নির্বিঘ্নে গড়িয়ে যাবে সাবলীল জীবন। আসলেই কার দিকে বন্দুক তাক করে রয়েছে সে! যদি তখন চিং থোয়াইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় না ঘটে এবং সে, থোয়াই চিং নিজেরই অজ্ঞাতে একটু দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হোসেন জালালের মনে বিন্দুসুলভ সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়, তখন সে তো অস্ত্রের লাগাম খুলে দিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দেবে মৃত্যুবাণ এবং সে সেই লোকটাকেই আদতে হত্যা করে বসে যে মরে না গিয়ে বেঁচে থাকলে তাকেই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে হয়ে উঠতো এমনই এক ত্রাণকর্তা যার আদতে কোন স্বীকৃত ত্রাণকর্তার পরিচিতিই থাকবার কথা নয়।
হোসেন জালালের জীবনে বাস্তবে তেমন মুহূর্ত একদিন সত্যি আসে এবং সে তার মুখোমুখি হয়ে অভিজ্ঞতার এমনই এক অভূতপূর্ব জগতের বাসিন্দা হয়ে যায় যার জন্যে কোনকালেই তার কোন প্রস্তুতি থাকে না। সেই অভিজ্ঞতা তার জীবনের সমস্ত উৎসারণকে এক নিমেষে কোথায় নিয়ে চলে যায়। তার মনে হয় মানুষ নিজেকে মানুষ নামের একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠে আটকে রেখে প্রতি মুহূর্তে নিজেকেই অপমানিত করে যাচ্ছে। অথচ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে তার অপার মহিমার সম্ভাবনাকে লুটিয়ে ফেলছে ধূলোয়। হোসেন জালাল চেয়েছিল, মহান হতে নয়, নিজের সংকীর্ণতাকে ছাড়িয়ে একটু সময়ের জন্যে অন্তত জানান দিতে যে চেষ্টা করলে চিংথোয়াইয়ের মতো সে-ও হতে পারে ত্রাণকর্তা—কিছু অর্জনের জন্যে নয় বরং কোথাও একটুখানি সাড়া দেবার জন্যে, সাড়া দিয়ে নিজের সত্তাকে কারও কাছে নয় কেবল নিজের কাছেই অর্থপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। অথচ যা হোসেন জালাল ভাবে, ঘটে তার বিপরীত। পরিস্থিতির এমন নিষ্ঠুর কৌতুকের ফলে হোসেন জালালের জীবনটা সমস্ত অর্জনের কিনারা থেকে এক ঝটকায় যেন শূন্যতার প্রান্তরে এসে দলামোচড়া হয়ে পড়ে থাকলো। কোনোভাবেই সে বুঝে উঠতে পারল না এমন পরিণতি বেছে-বেছে কেন তার দিকেই ধাবিত হলো!
আগের দিন পাহাড়ি-বাঙালিদের একটা সংঘর্ষের ঘটনার ফলে জায়গাটা দিনভর থমথমে হয়ে থাকল। এক বাঙালি শ্রমিকের ধর্ষণের শিকার হয় এক তঞ্চঙ্গ্যা নারী। এর প্রতিবাদে কেবল তঞ্চঙ্গ্যা নয় একাট্টা হয়ে গেল সমস্ত ছোট নৃগোষ্ঠি। তারা বাজারের একটা অংশে জমায়েত হয়ে হামলা চালাল বাঙালিদের দোকানপাটে। আগুন জ্বালিয়ে দিল এবং তাদের হাতে আক্রান্ত হলো জনাকুড়ি বাঙালিও। অগ্নি অগ্নির সঞ্চারক। উৎসের ঘটনা লোকে ভুলে যায়। সর্বত্র রটে যায়, পাহাড়িরা বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছে। এরই জের ধরে আরও অগ্নি এবং আরও মৃত্যু। শেষে সমস্ত উত্থান যখন পরিনির্বাণে এসে শমিত হলো ততক্ষণে দশজন আদিবাসী এবং ডজনখানেক বাঙালির জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে।
হোসেন জালালেরা যখন উর্দি পরে হাল্কা ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সবাইকে ঘেরাও ও ধাওয়া করছে তখন আর্ত-চিৎকার ছাড়া আশেপাশে আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ঘটে যাওয়া মৃত্যুর সামনে সব বাঙালি এবং সব পাহাড়ি অসহায় ও উপদ্রুতের মত তখন দাঁড়িয়ে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র সংবাদ হয়ে ঘটনাটি বিদ্যুতের গতিতে ছড়ায়। হোসেন জালালদের ওপর কঠোর নির্দেশ বর্তায়, সামান্যতম শৈথিল্যের কারণে চরম ফলের জন্যে তৈরি থাকতে হবে। কাজেই তাদের অস্ত্রগুলোর ভঙ্গি হয় পূর্বের চেয়ে শ্যেন ও ভেদী। তাদের অবস্থান হয় আগের চেয়ে অনড় এবং তারা আভিধানিক অর্থেই অতন্দ্র শব্দটির বৃত্তে অবস্থান নেয়।
নিয়মিত ডিউটির শেষে হোসেন জালাল তার ঘরে এসে বিশ্রামের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন গোধূলির আলো অরণ্যের সর্বোচ্চ বিটপীটিকেও ছাড়িয়ে চলে গেছে কোথায় কোন্ অজানায়। হোসেন জালালের মনে হতে থাকে, ঢাকার লালমাটিয়ায় তার স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলে মাহের আলোঝলমল রাজধানিতে বসে নিশ্চয়ই তার ভবিতব্য’র চিন্তায় অস্থির হয়ে বলছে, এটা একটা চাকরি হলো, সারা জীবন জঙ্গলের মধ্যে পড়ে থাকো! কিন্তু হোসেন জালাল বিড়বিড় করে, চাকরির জন্যে গুহায় বললে গুহায় গিয়েও থাকতে হবে! বস্তুত পাহাড়ের সেই সন্ধ্যা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের পরিণামের পর আরও নিস্তব্ধ ও ভারী বোধ হয়। কোথাও কোন শিশু চিৎকার করে কেঁদে উঠলেও তা কানের কাছে বেজে উঠে হোসেন জালালকে সেই ধ্বনি-উৎসের সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা দেয়। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কোথাও তেড়ে ছোটে একটি শূকর। হয়তো এমন উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় নিজেদের দিকেই মনোযোগের উপায় নেই গৃহবাসীদের, কী করে তারা যত্ন নেবে শূকরের! হোক না সে গৃহপালিত, হোক না সে অবোধ! বিশ্রামের অবকাশে দূরের আকাশের দিকে দৃষ্টি দেন হোসেন জালাল। কোথাও কোনো আলোড়ন নেই। আকাশ থেকে যে আলো নেমে আসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে তার উদ্ভাসে পাহাড়ের এলোমেলো কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক শীর্ষগুলো দূর থেকে দেখায় আদিম যুগের নীরব অস্ত্রের মতন। প্রস্তর যুগের অস্ত্রগুলো এমন চূড়া নিয়েই বুঝি আজও জেগে রয়েছে অন্তত বইয়ের পৃষ্ঠদেশে। কিছুদিন আগেই ছেলে মাহেরের পাঠ্য বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে হোসেন জালাল এজিল গুহার, নিয়ানডার্থাল উপত্যকার, গ্রিমাল্ডি-মানবের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোর ছবি দেখে-দেখে ভাবছিলেন এসব পাহাড়ের মধ্যেও কী এমন প্রত্ন-সম্ভার, মানবের এসব উপকরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না! ভাবনাটা জোরালো হয় পার্বত্য জীবনে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে এবং আরও গাঢ় রূপ নেয় তার চারদিকে ছোপ-ছোপ অন্ধকার নামতে শুরু করলে।
সেই সন্ধ্যাটাও তেমন একটা অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল মনে এবং সারাদিনের উত্তেজনার অন্তে গোটা এলাকা এমন একটা অখন্ড স্তব্ধমণ্ডলীতে পরিণত হয় যে, হোসেন জালালের মনে হতে থাকে, এই প্রাচীন পর্বত থেকে কোনোদিনই তার নিষ্ক্রান্তি নেই। কোনোদিনও তিনি মাত্র কয়েক শত কিলোমিটার দূরের লালমাটিয়াতে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন না। স্ত্রী-পুত্রকে বেশ খানিকটা কাল আগেই ঢাকা পাঠিয়ে দেন তিনি যখন বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন, তার বদলির আদেশ আসতে পারে। নতুন পোস্টিং হতে পারে খোলাহাটি নয় সাভার। খোলাহাটিও ভালো, সাভারও ভালো। খোলাহাটি হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আদরযত্ন মিলবে আর ঢাকা হলে তো নিজের সীমানাতেই থাকা। ঠিক তখন কথা নাই বার্তা নাই আচমকা একটা অস্বস্তিকর শোরগোলের শব্দ কোত্থেকে এসে আছড়ে পড়তে থাকে পাহাড়ের বেশ খানিকটা নিকটে থাকা হোসেন জালালের ঘরের গায়ে। নিরাপত্তা এখানে দৃঢ় তবু চকিতে একটা ভীতি মেরুদণ্ড বেয়ে সাঁই করে ধেয়ে গেলে তার মনে হয় প্রথমটায় একটা শূকর দৌড়ে গেলে যেমন শোনায় তেমন এবং শেষবার মানুষেরই পদশব্দ। কী ভেবে দরজাটা আস্তে খুলে তিনি আবছা অন্ধকারে বাইরে পা রাখতেই একটি যুবক দ্রুত ধাবমান বুনো প্রাণীর মতো তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং কিছু বুঝে বা না বুঝে হোসেন জালাল তার ঘরের দরজা আটকে দিয়ে ভেতরমুখো দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন যুবকটি সটান ঢুকে পড়েছে তারই শিশু-কাঠের তৈরি খাটের নিচে। হোসেন জালাল বুঝতে পারেন লোকটি আশ্রয়ের সন্ধানী। আক্রমণের উদ্দেশ্যে আসা কেউ এমন ভীতসন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে রাত্রির অন্ধকার সত্ত্বেও গভীরতর আঁধারের মধ্যে ঠাঁই নিত না। কর্তব্য সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার দরজায় করাঘাত পড়ার শব্দ শোনা যায় এবং তিনি বাধ্য হ’ন দরজা খুলে দিতে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যদিও তিনি ভাবছিলেন, আশ্রয় নেওয়া লোকটা হয়তো পাহাড়ি কোনো বিরুদ্ধ দল নয় বাঙালি বা সৈনিকদের ধাওয়া খেয়েই ছুট লাগিয়েছে। হোসেন জালালদের ক্যাম্পের দিকটা মোটামুটি পাহাড়ি-ঝুঁকির আওতামুক্ত। দরজা মেলতেই অবাক হয়ে যান হোসেন জালাল। তারই তিন সহকর্মী একতাবদ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তিন দ্বিগুণে ছয়টি বাতির শক্তি ছুড়ে দিয়েছে তার দিকে। ওরা ধারণা করে একটা পাহাড়ি যুবক এদিক দিয়ে দৌড় লাগিয়েছে। হোসেন জালাল তাদের কথা শোনে। যুবকটির গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক। তাকে চ্যালেঞ্জ করা হলে সে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেছে ভোজবাজির মতো। কিন্তু, তিনজনের দলের মধ্যে রিজওয়ান নামের সৈনিকটি বলে, তাদের মনে হচ্ছিল ঠিক এইখানটায় মানে হোসেন জালালের ঘরটার কাছে এসেই যুবকটি মিশে গেছে কোন এক অব্যাখ্যেয় নিস্তব্ধতার মধ্যে। তারা যে হোসেন জালালকে প্রশ্নটা উত্তরের আশায় করে তা হয়তো নয়, তাদের প্রশ্নটা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি-প্রত্যাশিত। প্রশ্নটা করবার সময়ে তাদের অবয়বে উদ্ভাসিত অভিব্যক্তিই বলে দেয় যে, হোসেন জালালের কাছে তারা সমাধান আশা না করলেও হোসেন জালাল যে সেই আকস্মিক ধাবমানতার ব্যাপারটা টের পেয়ে থাকতে পারেন সেটা তারা বিশ্বাস করে নিজেদের নিরাপত্তাকে শঙ্কামুক্ত করতে চায়।
হোসেন জালালকে মনে-মনে উত্তর সাজাতে হয় এবং সেজন্যে অধিক সময় হাতে থাকে না তার। যেহেতু তিনি সময় নেন বুঝতে হয় তিনি সত্য বলছেন না কিন্তু আগুয়ান প্রশ্নকারীদের তা জানার কথা নয়। যে-যুবক অল্প আগে তীরের মতো তার খাটের তলে ঢুকে বলতে গেলে পলাতক কিন্তু অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে তার সমস্ত ভবিতব্য তার হাতে ঝুলছে এবং তখনই হোসেন জালালের মনে পড়ে চিংথোয়াই খিয়াংয়ের কথা। একদিন চিংথোয়াই তাকে মরে যাবার ঝুঁকি থেকে বাঁচিয়ে জীবনের দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কোনো কিছুর জন্য না, কোনো কিছুর বিনিময়েও না। চিং থোয়াই তাকে যে-প্রাণটা সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল তার সঙ্গে একটু আগে খাটের নিচে ঢুকে পড়া যুবকটার প্রাণকে পারস্পরিক প্রতিস্থাপন করলে কী দাঁড়ায়! এর মধ্যে কোনটির কী ধর্ম তা কী বোঝা সম্ভব! প্রাণের কী হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আছে! এই দুনিয়াতে শুধু প্রাণ দেখে কে বলে দিতে পারবে তার ধর্মীয় পরিচয় কী! কেমন যেন একটা রোখ চাপে হোসেন জালালের। হঠাৎ নিজেকে প্রবল শক্তিমান বলে বোধ করতে থাকেন তিনি এবং তার মনে হয় এই পাহাড়-জঙ্গল-ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে অসহায় ভাবে বসে থাকা চিংথোয়াই যদি এমন অসাধারণ কাজ করতে পারে তাহলে এমন বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ও দামি-দামি অস্ত্রে সজ্জিত সে হোসেন জালাল কী একটু নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারে না। হঠাৎ তার মনে হতে থাকে, একটু আগে উপদ্রুতভাবে আশ্রয় নেওয়া আদিবাসী যুবকটি তার নিকটে বিধাতার আমানত-বিশেষ। তার নিজের প্রাণকে সেদিন সেই বিপন্ন অপরাহ্নে তার নিজের কাছে যেমন মূল্যবান বলে মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই যুবকটির কাছেও তার প্রাণের দাম ততখানিই। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির হয়ে যায় তার। নির্বিকার ভঙ্গিতে তিনি অস্বীকার করেন নিজের প্রত্যক্ষতাকে এবং তিনি নির্দোষ ভঙ্গিতে তার দৃষ্টিকে পাঠিয়ে দেন দূরের দিকে। সৈন্যেরা চলে যায়। একটু পরে আদিবাসী যুবকটি বেরিয়ে এলে হোসেন জালাল তার দিকে তাকিয়ে নিজের দৃষ্টিকেই আবিষ্কার করেন যে-দৃষ্টি দিয়ে তিনি দেখছিলেন চিংথোয়াইকে, যদিও হোসেন জালাল এমন সরাসরি মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েননি সেদিন। কিন্তু তিনি মারা যেতেও পারতেন।
যুবকের চোখ থেকে আশ্চর্য এক দীপ্তি ছিটকে বেরোয়। হোসেন জালাল জানেন যে, তিনি একটি দায়িত্ববিরোধী কাজ করেছেন এবং যুবকটিরও সে কথা জানা হয়। সে বুঝতে পারে যে, সে একটা বড় ঝুঁকি থেকে বেঁচে গেল। নীরব কৃতজ্ঞতায় তার সারা মুখ উদ্ভাসিত হয়ে যায়। সহসা হোসেন জালালের দু’টো হাত নিজের হাতে নিয়ে সে প্রায় করজোড়ে হোসেন জালালকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দিতে থাকলে তার চোখে অশ্রু দেখা দেয় এবং সে আর একটিও মুহূর্ত ব্যয় না করে রাতের অন্ধকারেই দরজা আলগোছে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে কোনো এক সজোর তাগিদে। আর তখনই পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে যে-ঘটনার তীব্র প্রদাহে ঝলসে যায় হোসেন জালালের জীবন। হোসেন জালালের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে ধরা পড়ে যায় এবং প্রবল জিজ্ঞাসাবাদের তোড়ে তাকে সত্য স্বীকার করতেই হয়। সেই স্বীকরণের পরিণাম উল্টো যে হোসেন জালালকে কাঠগড়ার আসামিতে পরিণত করবে, সে কথা সেই আদিবাসী যুবকের জানা থাকা না থাকা তার জন্যে সমান কথা। তাকে অচিরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার দায় কাঁধে নিয়েই ছেড়ে আসতে হয় তার পার্বত্য কর্মস্থল। আর ক’টা দিন পরেই তার বদলির সম্ভাবনা ছিল। যখন বদলির আদেশ না হওয়া সত্ত্বেও তার পাহাড়কে ভালো লাগছিল একটু-একটু করে তখন আত্ম-সমর্থনেরও কোনো প্রকার উপায়বিহীন হোসেন জালালকে মেনে নিতে হয়, পৃথিবীতে সব ভালো কাজ প্রশংসনীয় নয়।
এভাবেই হোসেন জালাল অবসরপ্রাপ্ত হলেন যখন অবসরের চেয়ে কাজেই তার আনন্দ হচ্ছিল অধিক। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, নিজের যে-ছেলেকে তিনি পাহাড়ের জীবন থেকে আগলে রেখেছেন মনে-মনে এই ভেবে, সমতলের যোগ্যতা দিয়ে পাহাড়ের জীবনে কৃতিত্ব অর্জন করা অসম্ভব, সেই ছেলেই বজ্রাঘাতের অধিক বিস্ময় হেনে একদিন ঘোষণা দেয়, সে চিরকালের জন্যে পাহাড়ের বাসিন্দা হয়ে যাবে। এ কেমন লীলা! প্রশ্ন জাগে হোসেন জালালের। আমিও বেরিয়ে পড়লাম বা আমাকে বের করে দেওয়া হলো আর তুমিও প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছ! তবে কী নিজের অসমাপ্ত আরাধ্যকে পূর্ণতা দেওয়ার এমন খেলা অদৃষ্ট খেলতে আরম্ভ করল! ছেলে মাহের জালালের জীবনের দুর্ভাবনা তাকে এক অসীম কষ্টের মুখোমুখি
করে দেয়। নিজের কর্মজীবনের অজস্র কষ্টকর স্মৃতি আর পাহাড়ের স্বকীয় অশিষ্টতার অনেক গল্প হোসেন জালাল জড়ো করেন এবং সেসব কাহিনি একের পর এক সাজিয়ে ছেলেকে সেই জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে তিনি চেষ্টা করে যান আপ্রাণ। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। তার আত্মজকে ঘায়েল করবার জন্যেই হয়তো গোকূলে বেড়ে ওঠার মতো এক পাহাড়ি মেয়ে তারই চোখের সামনে দিয়ে মাহেরকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে আর তিনি হোসেন জালাল অসহায়ের মতো তা দেখেই যান কিন্তু তার সাধ্যে কিছুই কুলোয় না।
নৃতত্ত্বের ছাত্র মাহের যখন উচ্চশিক্ষার এক পর্যায়ে ফিল্ডওয়ার্কের জন্যে পাহাড়ে রওনা দেয় তখন সবচাইতে খুশি হয়েছিলেন পিতা হিসেবে হোসেন জালালই। তখনো তিনি জানতেন না পাহাড়ি মেয়ে বম সিয়া লনচেও একদিন মাহেরকে সমতল থেকে নিয়ে চলে যাবে পার্বত্য অঞ্চলে। অথচ পাহাড়ের এতটা অনুরক্ত মাহের কোনোকালেই ছিল না। বরং হোসেন জালাল যখন পাহাড়ের গল্প করতেন তখন একটা নিরাসক্তির ভাবই ফুটে উঠত ওর চেহারায়। সেই ছেলেই একদিন সিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিলে হোসেন জালাল প্রমাদ গুনতে শুরু করেন। সিয়া খ্রিস্টান মেয়ে বলে নয়, বম নৃগোষ্ঠির সবাই খ্রিস্টান-ই, কী করে সম্পূর্ণ অন্য এক সংস্কৃতি অন্য এক জীবনের মধ্যে ঢুকে তার ছেলে না পথ হারিয়ে ফেলে! এ তো সমতলের চেনা রাস্তায় পথ-হারানো নয়, অরণ্যে পথ হারানো যেখানে পথেরই নিশানা মেলা দুষ্কর! যতই হোসেন জালাল ছেলেকে পাহাড়ের গল্প সাজিয়ে সংশয়ী আর বিভ্রান্ত করে তুলতে চান, ততই সে আরও অধিক হারে ঝুঁকে পড়ে সিয়া লনচেও’র দিকে। এক পর্যায়ে হোসেন জালাল অনুভব করেন মাহের হয়তো সিয়াকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করবে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি তার স্ত্রী নিলুফারকে বলেন, আসল কথা হলো কী জানো, কমিটমেন্ট, এটা ছাড়া বিয়েই কী, সংসারই কী! নিলুফারের উত্তেজনার শেষ নেই। তার ধারণা, ছেলে নৃতত্ত্ব পড়তে গিয়ে সার্কাসের ভাঁড়ে পরিণত হয়েছে এবং সে পরিকল্পনা করছে আরেকটি ভাঁড়কে তার জীবনের সঙ্গে জড়াতে। তারপর দুই ভাঁড় মিলে আরেকটি ভাঁড়কে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে এবং তখন যা দাঁড়াবে তাকে এক কথায় বলা যাবে, দ্য থ্রি স্টুজেস। ছেলে এবং মায়ের মুখ-দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ হয়ে গেলে হোসেন জালালের অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার দশা। তার জানা ছিল না নিলুফার পাহাড়ি মানুষদের এতটা অপছন্দ করে, এতটা অদ্ভুত মনে করে, তখন নিজের বিরোধিতাকে মুছে দিয়ে হোসেন জালাল এক অর্থে ছেলের সমর্থনেই স্ত্রীর সামনে প্রচারণা চালাতে থাকেন। হোসেন জালালের ধারণা হয়, দুইয়ের সম্মিলিত বৈরিতায় শেষে ছেলে তাদের দু’জনকেই যদি ছেড়ে চলে যায় তখন সর্বশেষ অবলম্বনটুকুও তারা হারিয়ে ফেলবেন।
এইসব চিনা মেয়েদের মতো মেয়েরা আমার ছেলের বউ হবে আমি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না! স্ত্রীর উদগীরণে উপদ্রুত হোসেন জালাল তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, চিনাদেরও কী সমাজ-সংসার নেই! দেখো পৃথিবীর আদি জনগোষ্ঠির একটি প্রধান যে-মঙ্গোলীয় ধারা তার ষোলোটি শাখা। কাজেই বিশ্বে চিনা জনগোষ্ঠি তো কম নয়। ছেলের পুস্তক-সূত্রে পাওয়া জ্ঞানের বহিপ্রকাশ ঘটিয়ে স্ত্রীকে বোঝানোর অধ্যবসায় বজায় রাখতে হয় তাকে। হোসেন জালাল অবশ্য সমস্যা বলতে যেটুকু আবিষ্কার করেন, তা হলো ওদের চোখ অন্যদের তুলনায় আকারে খানিকটা ছোট। কিন্তু এই ছোট চোখ দিয়েই তো তারা বানিয়েছে বিশাল প্রাচীর। এই ছোট চোখের লোকেরাই তো এশিয়াকে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে পরিণত করেছে। বাঙালিদেরও কি ছোট চোখ হয় না! হ্যাঁ, হয়—নিলুফারের উত্তর—এবং ছোট চোখের লোকেদেরকে বলা হয় এরা খুব ধূর্ত প্রকৃতির। সেটা ছোট চোখের লোকেদের ভালো বলে নিশ্চয়ই বলা হয় না! হোসেন জালালের কোনো যুক্তিই কাজে লাগে না এবং একদিন নিলুফার নিজেই সমস্ত যুক্তি ও তর্কের সীমানা পেরিয়ে যান। কোনোভাবেই যখন আর ছেলেকে ফেরানো সম্ভব হয় না, তখন হোসেন জালালের স্ত্রী ছেলেকে আত্মহত্যার ভয় দেখালে মাহের স্পষ্ট ঘোষণা দেয়, দেখো তোমাদের জীবন তোমাদের, আমার জীবন আমার! ছেলের জবাবে নিলুফার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন এবং কোথায় তিনি পান, কোত্থেকে তিনি জোগাড় করেন কে জানে, তীব্র প্রাণঘাতী বিষে নিজের জীবনকে নিয়ে চলে যান সবকিছু থেকে দূরে।
অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার আঘাতকে প্রথম ধরলে নিলুফারের মৃত্যু তার জন্যে ছিল দ্বিতীয় আঘাত আর অবসরপ্রাপ্তিকে সহনীয় ঘটনা বলে মেনে নিতে পারলে স্ত্রীর মৃত্যুই ছিল তার জন্যে যথার্থ প্রথম আঘাত। ছেলের আদিবাসী-বিবাহের বিষয়টাকে সেদিক থেকে কোন আঘাতই মনে হয় না হোসেন জালালের। বরং সেটা তুলনামূলকভাবে প্রীতিপদ। ছেলে যদি চিরকুমার থেকে যাওয়ার ব্রত গ্রহণ করত, সেটাও তো হতে পারত তাদের দু’জনের জন্যে এক ধরনের মানসিক আঘাত। তাই অভিভাবক হিসেবে তিনি সবকিছুকে মেনে নিয়ে এক আপাত নিস্তরঙ্গ তপোময় ধ্যানী জীবনের স্বপ্ন মনে আঁকতে শুরু করেন। ভাবেন ছেলে বিয়ে করে একটা নতুন জীবন আরম্ভ করবে এবং তিনি হোসেন জালাল এই জীবনে দেখা না হয়ে ওঠা স্থানগুলো ধীরে-ধীরে দেখতে শুরু করবেন। কত কিছুই তো দেখা বাকি রয়ে গেল জীবনে। একদিক থেকে আগাম বা জোর-অবসরকে হোসেন জালালের আশীর্বাদ বলেই মনে হতে থাকে। এটা সবরকমের পিছুটান ছিন্ন করে জীবনকে আরও একটু ভাল করে উপভোগের সুযোগও বটে। তখনো তার জানা হয় না, তাকে আরও একটি কঠিন আঘাতের জন্যে তৈরি হয়ে উঠতে হবে। চাকরির জন্য পাহাড়ে পাড়ি জমানো তাদের দলের অন্তত চারজনের কথা মনে পড়ে তার, যাঁরা ছিলেন তার অনেক কালের সুখ-দুঃখের সাথী। বুনো ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে একে-একে তাদের সবাই যখন মরে গেল হোসেন জালালের মনে হতে লাগল মানুষ আসলে আঘাত পাওয়ার জন্যেই বেঁচে থাকে। তার মনে হয়, মানুষ আনন্দের অভিজ্ঞতা পায় আসলে আঘাত পাবে বলে। নিজের জীবনের বিন্যাসটাকে সামনে রেখেই তিনি দেখতে পান আঘাতে-আঘাতে তার জীবনের ওপর কালসিটে দাগ প্রবল হয়ে উঠেছে। ছেলে যখন সিয়া লনচেওকে বিয়ের সিদ্ধান্ত জানাল এবং বিয়ে করল, তখনো তার মনে হয়েছে যে, এর চেয়ে বড় এর চেয়ে প্রবল আর কী ঘটা সম্ভব! মাহের জালাল এবং সিয়া লনচেও-এর মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেলে স্বামী তার নিজের ধর্ম এবং স্ত্রী তার নিজের ধর্ম নিয়ে যার-যার নিজস্ব নিয়মের সীমানায় স্থিত থাকল। রাষ্ট্রের সিভিল ম্যারেজ আইন অনুযায়ী আলাদা ধর্ম আলাদা সংস্কৃতি নিয়েও তারা একটি পরিবারের নির্মাতা হয়ে উঠল। ব্যাপারটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখলেন হোসেন জালাল। তিনি ভাবেন, আর্যরা সেই মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে এসে অনার্য মেয়েদের বিয়ে করে গো-পালন আর কৃষি-সমাজের মধ্যে মিলন ঘটাল। কে কবে ভেবেছিল আর্য-অনার্যে মিলন ঘটবে!
যে-অভিজ্ঞতার জন্যে নিজেকে কোনোভাবেই প্রস্তুত রাখেননি হোসেন জালাল, তা এমন করাল হয়ে তাকে ছোবল মারবে এবং তাকে নিঃসঙ্গ-নির্জন নয় অনেকটা আশাহীনও করে দেবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভেবে দেখেননি তিনি। এখন সেই আঘাতে তার চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তার সব সম্ভাবনা একটি সংকীর্ণ খাঁচায় এসে বন্দি হয়ে পড়ে। তার মনে কোনো সান্ত্বনা জোগায় না, তিনি হয়ে পড়েন ভাষাহীন। বিয়েটা একটা প্রাথমিক আঘাত ছিল সেটা ঠিক কিন্তু যখন মাহেরের মনে সিয়াকে নিয়ে কল্পনার ওড়াউড়ি চলছিল তখনই হোসেন জালালের মনে হয়, ছেলে তার বহুদূর যাবে। ফলে তিনি পাহাড় সম্পর্কে তার জানা-শোনা এবং না-জানা সব গল্প একের পর এক সাজিয়ে ছেলের মনে একটা বীতস্পৃহা জাগানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টাই চালান। কুইনিন-প্যারেড পর্ব, জীবনের নানান ঝুঁকি এবং মৃত্যুঝুঁকি—তার কোনো গল্পই কাজে লাগে না। মাহের হেসে বলে, আমি তো আর বন্দুক কাঁধে পাহারা দিতে যাব না! শেষে বিয়েটা হলো। এখন বম বউ খ্রিস্টান থাকলে থাকুক, ছেলেও তার এমন ধার্মিক না যে নিজেরটা নিয়েও খুব ভাবনায় আছে, থাকুক তারা যার যেমন খুশিম, হোসেন জালাল জটিলতামুক্ত একটি আগামী দিনের ছবি নিজের মনে এঁকে ফেলেন। সেখানে ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতির-ধর্মের লোকেরা পরম ঐক্যে একটি আনন্দপূর্ণ জীবন রচনা করে। তারা অবলীলায় পরস্পর পরস্পরের ভিন্নতা নিজেদের গায়ে একটুও না মেখে একজন আরেকজনের ছাদের নিচেও একই রকম অনুভব মনে জাগিয়ে তোলে। বাজারের মূল সড়ক ধরে হেঁটে যেতে-যেতে লম্বা-লম্বা ঈল মাছের মতো কোনো মাছের শুঁটকির বোঁটকা গন্ধে কিংবা আঠালো ঙাপ্পির গন্ধে হোসেন জালালের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম, সেই হোসেন জালাল দেখেন তারই আত্মজ মাহের জালাল কোনো এক বম গৃহস্থ বাড়ির মাটির মেঝেতে বিছানো পাটিতে বসে বাঁশ-কড়–লি-চিংড়ির ঝোল কি বুনো ওল দিয়ে রান্না করা হাঙর মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছে তৃপ্তি সহকারে। দৃশ্য-দৃশ্যান্তরের এমন মৌহূর্তিক পালাবদল হোসেন জালালের মনে এক মায়া-বাস্তবের দোলাচল জাগায়। সত্যিই তো, হোসেন জালালের মনে হয়, সব মানুষই আদিবাসী। সকল আদিবাসীত্বেই অন্ত্য আছে এবং সকল অন্ত্যেই আছে আদিবাসীত্ব। মানুষ তার বাসিত্ব সেই অনাদি কাল থেকেই বয়ে চলেছে। হোসেন জালাল দার্শনিক হয়ে ওঠেন। তিনি দেখতে পান, আদিম কৃষিজীবী মানুষ রান্না করা অন্ন খেয়ে বেঁচে যাওয়া অন্ন হাঁড়িতে রেখে পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে সেই অন্ন খেয়ে ঘুম-ঘুম চোখে ফের ঘুমিয়ে পড়েছে। আদিম মানুষের ভাতের সংস্কৃতি থেকে আজকের মানুষেরও মুক্তি মেলেনি।
ছেলের বিবাহের ঘটনাটিকে হোসেন জালাল একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ও সংযুক্তির দৃষ্টান্ত হিসেবেই নেন। বিচ্ছিন্নতা, সে তার পিতৃপুরুষের রক্তের ধারায় ভিন্ন সংস্কৃতির রক্তের আমদানি ঘটিয়েছে এবং সংযুক্তি, একটা ভিন্ন ধারায় বয়ে যাওয়া রক্তকে নিজের ধারায় সংমিশ্রিত করেছে আর এই মিশ্রণের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হয়ে উঠবে আরও বিচিত্র এবং বিভিন্ন। কিন্তু ছেলে যে তার এমন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নিজের জীবনটাকেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার শিকারে পরিণত করবে সেটা স্বপ্নে বা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি হোসেন জালাল। হ্যাঁ, তিনি জানতেন যে, বম সমাজে মাতৃতন্ত্রের প্রাবল্য বিদ্যমান। বিয়ের পর বম মেয়েরা নিজেদের ঘরেই থাকে এবং তাদের স্বামীরা এসে যোগ দেয় তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কার লোকেদের কথাও তার জানা ছিল যেখানে বিয়ের পর ছেলেরা মেয়েদের গৃহের বাসিন্দা হয়ে যায়। স্থানীয় অভিব্যক্তিকে এটাকে ঘরজামাই বলা হলেও হোসেন জালালের ধারণা ছিল মাহের এবং সিয়া বিয়ে করে সংসার করবে স্বাভাবিক নিয়মে। তারা নিশ্চয়ই ঢাকা শহরেই তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে এবং সেটা তারা অব্যাহতও রাখবে। পিতাকে অবাক করে দেওয়া পুত্রের ঘোষণা সত্যি হলে মাহেরের সমতলের দিনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, এখন তার পার্বত্য জীবনের শুরু। নিজের সিদ্ধান্তটা পিতাকে জানিয়ে দিয়ে মাহের পর্বত-যাত্রার প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুনে হোসেন জালাল মূঢ়তায় আক্রান্ত হন। প্রথমটায় ভেবেছিলেন ছেলে তার পর্বতনিবাসী শ্বশুরালয়ে বেড়াতে যাবে কিছুদিনের জন্যে। কিন্তু না মাহের সিয়ার সঙ্গে ঘর বাঁধবে পাহাড়েই। ছেলের এমন উদ্যোগের কোন কার্যকারণ বা কূলকিনারা খুঁজে পান না হোসেন জালাল। শেষে সরাসরি প্রশ্ন করেন তিনি, কারণ জানতে চান। মাহেরের কণ্ঠ নিষ্কম্প। সমতলের জীবন থেকে, সমতলের দমবন্ধ চৌহদ্দি থেকে একটু নিভৃতিতে গিয়ে সে জীবনটাকে অনুভব করতে চায়। যেহেতু বিবাহ তার জীবনে সেরকম একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে সে তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে। তাছাড়া পাহাড়ে কি মানুষেরা সমাজ-সংসার গড়েনি। যুগ-যুগ ধরে পাহাড়ের নীরব আড়ালে মানুষেরাই তো নীড় গড়ে তুলেছে। ছেলের কথা হোসেন জালাল শোনেন কিন্তু সবটা তার হৃদয়ঙ্গম হয় না। তিনি ভাবেন নৃতত্ত্বের লেখাপড়ার ফলেই হয়তো মাথা বিগড়ে গেছে তার। কিন্তু পৃথিবীতে আরও লোকে কী নৃতত্ত্ব পড়েনি, পড়ছে না! মনে পড়ে একদিন তিনি মাহেরকে পাহাড়ের বুনো ম্যালেরিয়ায় প্রাণঘাতী মৃত্যুর কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন মানুষে-মানুষে অবিশ্বাসের ভয়ংকর পরিণাম ঘৃণা কী অবলীলায় না গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের খাত বেয়ে যেখানে যুগ-যুগ ধরে বয়ে গেছে অবিশ্রান্ত ঝর্ণার ধারা। আর সেই চিংথোয়াই খিয়াংয়ের স্মৃতি যার সেদিনকার দৈব উপস্থিতি না ঘটলে হোসেন জালাল নির্ঘাৎ একটি সাধারণ মৃত্যুর শিকার হয়ে কবেই হারিয়ে যেতেন!
ছেলে মাহের জালাল এবং ছেলের বউ সিয়া লনচেওকে বান্দরবানের বাসে উঠিয়ে দেন হোসেন জালাল। একদিন বহুকাল আগে এ রকম একটি যাত্রায় তারা হৈ-হৈ করতে থাকা প্রাণ নিয়ে ছুটেছিলেন পাহাড়ের দিকে। ভেবেছিলেন চাকরিটা পিকনিকের মতন। সমতলের একঘেঁয়ে জীবন থেকে খানিকটা ব্যতিক্রমের অবকাশেই তাদের পাহাড়-যাত্রা। সেদিনকার সেই যাত্রীদের কেউ মারা পড়েছে ডেঙ্গু বা বুনো ম্যালেরিয়ায়। ক’জন মারা পড়েছে অপ্রত্যাশিত আক্রান্ত হওয়ার পরিণামে। পাঁচজন মারা পড়েছিল বাবুর্চির বেসন বা ময়দা ভেবে গ্যামাক্সিন পাউডারে বানানো ইফতারের বেগুনি খেয়ে। সেই থেকে হোসেন জালালও আর বেগুনি খান না। মাহের আর সিয়া বাসে উঠে পড়লে ঘোরলাগা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন হোসেন জালাল। মনে-মনে ভাবেন, যাচ্ছো তো যাও, দু’দিন পর যখন দেখবে কষ্টের ঘাম টপ-টপ পড়তে শুরু করেছে তখন তুমি ঠিকই আবার ছুটে আসবে বাপ-বাপ বলে! ফর্সা সিয়া দেখতে বেশ সুন্দরীই বলা যায়, তবে যেমনটা হোসেন জালালের স্ত্রী বলেছিলেন, চিনাদের মতো ছোট-ছোট চোখ। তা হোক, ভাবনাবিলাসে মন্দ লাগে না হোসেন জালালের। যদি মাহের জালাল আর সিয়া লনচেও’র ঘর আলো করে একটি সন্তানের জন্ম হয়, দেখতে কেমন হবে সে! সে কি মাহেরের মতো লম্বা এবং সিয়ার মতো দুধে-আলতা মেশানো হবে। না কি সিয়ার মতো মধ্যম উচ্চতার আর মাহেরের মতো শ্যামলা হবে! চোখগুলো সে পাবে কার! যদি সে মাহেরের চোখই পায় তাহলে তার চোখগুলো হবে বড়-বড় আর যদি মাহেরের চোখ না পেয়ে পায় সিয়ার চোখ তাহলে তাদের সন্তানের চোখগুলো দেখতে হবে চিনাদের চোখের মতো। তা হোক, হোসেন জালাল দেখেছেন পাহাড়ের ঢালে বা মাচাংয়ে বা বাড়ির দাওয়ায় বয়স্করা গান গাইছে আর মৃদু দোল দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে তাদের শিশুদের। এমনকি প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কঠিন জুমের কাজে ব্যস্ত মায়েদের পিঠে ঠিকই নিরাপত্তার ব্যবস্থা তৈরি থাকে বাচ্চাদের জন্যে। হোসেন জালালের কানের কাছে বাজে সেই গান, তার প্রাণরাকারী চিং থোয়াইয়ের সেই গান—‘নি পয়েইটি নাম লেহা তোং তিলা/ নাং নেচেতাল ও মুতচু ও-ও/ নি নামলা নিহুই অপয়েই ইনিপেক/ নাং মঙা নোবোনালায়্যাম…’। গানটা হোসেন জালাল ভোলেন না কিন্তু গানটা তার সহজ নয় কঠিনই মনে হয়। হয়তো তার কাছে ‘ও নদী রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…’। গানটা যেমন সহজ মনে হয় চিং থোয়াই খিয়াংয়ের কাছেও তেমনই সহজ ‘নি পয়েইটি নাম লেহা তোং তিলা…’। কতকাল আগেকার খিয়াং মানব চিং-এর কথা হোসেন জালালের মনে পড়ে। বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও তার জানা নেই কিন্তু একদিন সে তার প্রাণরক্ষার কারণ হয়েছিল। তাই চিং-এর সেই গানটি সহজে ভোলেন না হোসেন জালাল। হয়তো তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের ঘরে বাচ্চা হলে সে হোসেন জালালের মতো অবলীলায় বাংলায় এবং চিং থোয়াইয়ের মতো অবলীলায় পাহাড়ি ভাষায় গাইতে পারবে এ রকম কোনো গান। কিন্তু যদি তারা নিঃসন্তান থেকে যায়, সেই ভাবনাটাও সহসা উঁকি দেয় হোসেন জালালের মনে। সেই ভাবনাটা নিয়ে তিনি অবশ্য বেশিদূর যেতে পারেন না। বান্দরবানের গাড়ি স্টার্ট দেয়।