বাড়িতে দুই-একটা ফুলের গাছ আছে মাত্র। কিন্তু ফুল নেই, তাতে কী হয়েছে? প্রতিবেশীর বাড়িতে অনেক ফুল। সেখান থেকে কয়েকটা গাঁদা ফুল নিয়ে খালি পায়ে স্কুল মাস্টার বাবার সঙ্গে স্কুলের শহীদমিনারে প্রথম যায় আবির। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কোনো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে যাওয়া তার। ভিষণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ভাষার জন্য জীবন দান! ইতিহাস না বুঝলেও আয়োজনটা ছোট্ট আবিরের হৃদয়ে নাড়া দেয়। এরপর থেকে স্কুলের কোনো অনুষ্ঠান বাদ দেয়নি আবির। কখনো সে দর্শক কখনো শ্রোতা, কোনোটাতে সে অংশগ্রহণকারী। এসবের কোনোটাতে আবার সে পুরুস্কার জয়ী। এভাবেই আবির বড় হতে থাকে আর তার হৃদয়ে, মননে বিকশিত হতে থাকে দেশ, প্রকৃতি ও মানুষের জন্য ভালোবাসা।
গ্রামের স্কুল, কলেজ পার হয়ে আবির ভর্তি হলো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। এখানে এসে পেলো উন্মুক্ত পৃথিবী। যত দিন যাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে তার জানা-শোনা, পড়া ও দায়িত্ববোধের সংকীর্ণতা। গ্রামের পরিবেশ থেকে শহুরে জীবন বেশ দারুণ লাগছে। কিন্তু লোকগুলোর ব্যস্ততা বেশি। কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না। কিসের যেন তাড়া; অথচ সবাই স্টুডেন্ট মাত্র।
হোস্টেলে দুই দল ছাত্রের মধ্যে মারামারি । যেমন তেমন মারামারি নয়; খুনোখুনি আরকি! আবির মুষড়ে গেলো। একটা শঙ্কা জেগে উঠলো মনের ভেতর। এইসব খুনোখুনি নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবস্থান দেখে সে বিষাদগ্রস্ত হয়ে হলো। অথচ ছোট্ট বেলায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কত রোমাঞ্চকর মহান বীরত্বের গল্প শুনেছে। সে পাঠ্য বইয়ে পড়া ইতিহাস আর তার চোখের সামনে ঘটা বর্তমান নিয়ে অসহায়বোধ করছে। সবার মতো স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা তার মধ্যে নেই। কিসের যেন একটা তাগাদা ভেতর থেকে শক্তি আর সাহস জোগাচ্ছে। তার মনে পড়ে প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, কলেজের কথা। সে সময় ভাবতো, বড় হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে আর রাজনীতি করবে। কিন্তু এখন তো সে কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ সবাই বলে রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি।
আবির পড়ালেখায় আর আগ্রহ খুঁজে পায় না। তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মন বসে না। নিজকে প্রতারক মনে হয়। ষোলই ডিসেম্বর শহীদমিনারে ফুল দেওয়ার জন্য বের হয়েও ফুল দিলো না অজানা আতঙ্কে। তুমুল অস্থিরতায় বিকেল বেলা নিজ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসর সাফিয়ার রহমানের সঙ্গে আবির মনের কথা শেয়ার করলো।
-স্যার, আমি রাজনীতি করবো।
-রাজনীতি করতে চাও ভালো কথা। তোমার আবেগকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এতকিছু থাকতে তুমি কেন রাজনীতি করবে?
-দেশের যে অবস্থা তা কি মানা যায়?
-দেশ তো ভালোই চলছে। কোথায় সমস্যা বলো তো?
-মানুষের কতটুকু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত, স্যার?
আবিরের প্রশ্ন শুনে প্রফেসর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি সত্যিই রাজনীতি করতে চাও?
-জি স্যার।
-তোমার জন্য শুভকামনা রইলো।
-আপনার হেল্প দরকার, স্যার।
-আমি তো রাজনীতি করবো না। তুমি করবে তাহলে আমি তোমাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি?
-রাজনীতির পড়াশোনা করতে চাই স্যার। রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করতে চাই। বইটই লাগবে।
-কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু এই পথ তো অনেক রিস্কের। জীবন ধ্বংস হতে পারে।
-কাউকে না কাউকে তো রিস্ক নিতে হবেই স্যার।
-বেশ ভালো কথা বলেছ। আচ্ছা তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
-বাবা, মা আর দুই বোন। আমি সবার বড়।
-বাপের টাকা-পয়সা কেমন? কত বিঘা জমি আছে?
-জমিজমা নাই স্যার। বাবা স্কুল মাস্টার। তার বেতনে চলি।
মোড়লরা আবিরের কথা মেনে নিলো। পুরো দেশটা শান্ত হয়ে এলো নিমেষে।
আবিরের কথায় প্রফেসর ভয় পেয়ে গেলেন, তোমার বাপ-মায়ের অনেক স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে। রাজনীতির কথা বাদ দাও। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করো।
– কেন স্যার?
-টাকা-পয়সা ছাড়া রাজনীতি হয় না। তোমার বাপের বেতনে সংসার টানাটানি করে চলে। আমি তা তো বুঝি। রাজনীতি করতে গেলে টাকা লাগবে। কই পাবে? চুরি-ডাকাতি, টেন্ডারবাজি করতে পারবে?
-না স্যার।
-তা না পারলে পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করো, পরিবারের উপকার হবে।
-আমি তো রাজনীতি করতে চাই স্যার।
-এদেশে নীতি-আদর্শের জায়গা নেই। সুভাষ বসু পারেন নাই, তুমি পারবে? স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকে তোমরা বাঙালিরা হত্যা করেছ। বঙ্গবন্ধু যেখানে টিকতে পারেননি, তুমি পারবে? বাঙালিরা পিতাকে হত্যা করতে পারে। জানো তো?
আবির অবোধ শিশুর মতো প্রফেসরের কথা শুনছে। প্রফেসর বলতে লাগলেন, লাভ কী হয়েছে? আমি তোমাকে বিপদের মুখে ফেলতে পারি না। রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে চাও, বেশ ভালো কথা, পড়ো। কিন্তু রাজনীতি করতে যেও না আপাতত।
আবির প্রফেসরের কথায় সম্মোহিত হয়েছিল। সুরসুর করে হোস্টেলে চলে এলো। রাতে ছটফট করতে থাকলো। ঘুম আসছে না। স্যারের কথাগুলোই বারংবার ভাসতে লাগলো।
দুই.
দেশের চিন্তা বাদ দিয়ে আবির ভদ্র ছেলের মতো অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় মন দিলো। এর ফলে রেজাল্ট ভালো হলো। অনার্স ও মাস্টার্সে ডিপার্টমেন্ট ফাস্ট। মেধা ও যোগ্যতায় নিজ ডিপার্টমেন্টে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কথা কিন্তু পেলো না। না পাওয়ার কারণ সে বুঝতে পেরেছে। এটা নিয়ে কোনো আফসোস নেই তার। তার মনের মধ্যে প্রফেসর সাফিয়ার রহমানের সেই কথাগুলো প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। সে বিদেশ যাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। একপর্যায়ে ক্যাপিটোর নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পেলো। সেখানে অতিদ্রুত ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারলো। সেখানেই চাকরি পেলো, কিছুদিন পর নাগরিকত্ব পেলো। তার গবেষণার সুনাম সারা ক্যাপিটোতে ছড়িয়ে পড়ায় ক্যাপিটোর রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ দূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে তাকে যেতে হচ্ছে। এই দায়িত্ব পাওয়ায় তাকে নিয়ে তার জন্মভূমিতে গর্বের শেষ নেই। তাকে নিয়ে কতটা গর্ব করে তা আবির নিজেও জানে না।
এদিকে আবিরের জন্মভূমিতে জনসেবা করা নিয়ে কাজিয়া ফাসাদ এতই বেড়ে গেলো যে, দেশের লোকজন তাদের মহান এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। দেশের মোড়লরা দিশেহারা হয়ে বিশ্বনেতাদের পা চাটার জন্য জিব বের করে মাতম করছে। বিশ্বনেতারা এক হয়ে এই কাজিয়া ফাসাদ অবসানের জন্য আবিরকে দায়িত্ব দিলো। আবির অবিভূত সেই দায়িত্ব প্রাপ্তিতে। সে এক মূহূর্ত দেরি না করে চলে এলো জন্মভূমিতে শান্তির দূত হয়ে।
দেশের হিংস্র মোড়লরা নীরব। আবিরের কোনো কথার বিরোধিতায় টু শব্দ করার মতো হিম্মত হলো না। আবির হিংস্র মোড়লদের ডেকে এনে বললো, আমি নতুন কিছু বলবো না। আপনারা এতদিন যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো পূরণ করুন। বিদেশের উদাহরণ দেবেন না। কারণ আমিই বিদেশের প্রতিনিধি। বিদেশের জ্ঞান দেবেন না। যে যা পারেন, কথা না বাড়িয়ে কাজ করুন। মোড়লরা আবিরের কথা মেনে নিলো। পুরো দেশটা শান্ত হয়ে এলো নিমেষে।
সবার অলক্ষ্যে আবির ছোট্টবেলার মতো খালি পায়ে শহীদমিনারে একটা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে। শহীদমিনারে সে আজ ফুল দেবেই। তার আজ কোনো ভয় নেই। তার আনন্দাশ্রু যেন বাধা মানে না।