নায়ের পাতলুন গুটাতে গুটাতে থুথুর মতো দলা করে একটা খিস্তি জলের দিকে ছুড়ে দিল দেবু। পুবের বাতাসের গতি কমে এসেছে। দিক পাল্টে ঈশান কোনের দিকে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এ সময় গাঙ্গের হাওয়া উত্তরে নতুন জেগে ওঠা বাজনার চরের ওপর দিয়ে সাই-সাই করে ছুটে আসার কথা। অষ্টাদশীর কোমরের ভাঁজের মতো মিহিন বাঁক খেয়ে চরের সাদা বালিময় প্রান্তরে ঢুকে পড়েছে নদীটা। এখানে পুবালি হাওয়া নদীর নরোম বুকে দুলতে থাকা নৌকার পালে যৌবনের উদ্দাম জোয়ার তোলে রাতের প্রথম প্রহরে। কিন্তু আজ যেন তার যৌবনে কেউ বাদ সেধেছে। হঠাৎ হাওয়া ঘুরে যাওয়াটা ভালো কিছু হতে পারে না!
দেবু পালের দড়ি গুটাতে গুটাতে ঈশান কোণের দিকে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়— নাহ! মেঘের একটুখানি সরু রেখাও ছাপ ফেলেনি। ঝড়ের কোনো আভাস নেই দৃশ্যপটে, তাহলে হঠাৎ হাওয়া ঘুরে গেল কেন? দেবুর বুকটা অজানা আশঙ্কায় একটা গভীর নিঃশ্বাস উগরে দিল। পাল গোটানো হলে পাটাতনে বিছিয়ে রাখা বৈঠাখানা অন্ধকারে হাতড়ে খুঁজে বের করলো। তারপর নায়ের গলুইয়ে বসে বৈঠাটা জুতমতো ধরে জল ভাঙতে লাগল। বৈঠা দিয়ে যতবার শ্যাওলাগন্ধা জলে ঘাঁই মারছে, ততবার নদী অষ্টাদশী কুমারীর মতো সুখের আবেশে যেন শিৎকার করছে— ছল-ছলাৎ-ছল!
আন্ধারে কে বায়?— মজু কাকার খনখনে কণ্ঠ শোনা গেল। বুড়া এই ভাঙা শরীর নিয়ে এখনো একা একা ডিঙ্গি বেয়ে গঞ্জে যায়! দেবু অবাক হয়। সে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, আমি কাহা, আমি দেবনাথ। কেঁচকি বাতাসের ঝাপটায় কথাগুলো কেটে কেটে যায়। মজু মিয়া কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজের ফাঁক গলে যে খানিক শব্দ কেটে কেটে শুনতে পায়, তার প্রত্যুত্তরে আবার জিজ্ঞেস করে— আমগো দেবুনি? নাও আন্ধার কইরা রাখছিস ক্যাঁ?
দেবু যখন একা একা নাও বায়, সূর্য হেলে পড়লেও সে লণ্ঠন জ্বালায় না। ভাদ্র-আশ্বিনে এদিকে ডাকাতের উৎপাত বেড়ে যায়। লণ্ঠনের টিমটিমে আলো নদীর বুকে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে, বহুদূর থেকে সেই জাজ্বল্যমান আহ্বান ডাকাতদের দৃষ্টিতে একবার বিঁধলে আর নিস্তার নেই। গেল সপ্তায় কাশেম ভাই গঞ্জ থেকে ফেরার পথে একদল ডাকাতের কবলে পড়েছিল। কাশেম ভাই গায়ে গতরে তাগড়া মরদ, গঞ্জ থেকে তার দোকানের জন্য সওদা বোঝাই নাও নিয়ে ফিরছিল, সঙ্গে দুটো কর্মচারী, হয়তো ডাকাতদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছে এক চোট, পরেরদিন বাজনার চরে তাদের তিনজনের লাশ পাওয়া যায়। লাশের এমন বীভৎস অবস্থা করেছে, দেখে কাশেমের বউ কান্না ভুলে চোখ ঢেকে ফেলেছিল ভয়ে-ঘৃণায়।
দেবু প্রতিদিন তার বাপের সঙ্গে গঞ্জে যায়। আজ সকালে বাপের শরীর ভালো ছিল না, কাশির দমকে দমকে শরীর কাঁপতেছিল, তাই দেবু একলাই নাও বেয়ে গঞ্জে গেছে। এ জন্য সাঁঝের পরে অন্ধকারে ঠাহর করে করে নাও বাইছে। কথায় কথায় দূরত্ব কমে আসে, দেবুর নায়ের ছুঁচালো গলুই মজু মিয়ার ডিঙ্গি নৌকার পেটে গোত্তা মারে। মজু কাকা খেঁকিয়ে উঠলো— নাও সামলা রে হরির পো। আরেকটু অইলেই ত দিসিলি আমার ছোট্ট ডিঙ্গি গালায়্যা। হরিনাথ কই?
আব্বার সকাল থেইক্কা কাশির দমক, আইজ বাইর অয় নাই। গঞ্জে আমি একলা গেসি।
নাও আন্ধার ক্যা, লণ্ঠন নাই তোর? ডর করে না?
ডর করে কাহা। একলা নাও বাইতে ডর করে। হের লাইগ্যা আন্ধার কইরা রাখছি। যেন তারা ঠাহর না পায়।
হায়রে দুনিয়া! কেউ ডরে লণ্ঠন জ্বালায়, কেউ ডরে লণ্ঠন নিভায়। আলো আহে, আলো যায়; মাগার ডর যায় না!
কাহা, এই শরীলে বাইর না অইলে পারতেন।
এই শরীলের লাইগ্যা ত বাইর হওয়া, সাধে কি আর এই বয়সে কেউ ডিঙ্গি বায়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা ভাটিয়ালি গান ধরেন মজু মিয়া—
পোড়ার শরীর বাইয়্যা চলে
গহীন যৈবন নদী
মন মোহনার উদ্দিশ দেহা
একবার পাইতাম যদি রে আমি
একবার পাইতাম যদি…
গানের তালে নৌকা দুটি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সমান্তরালে জল কেটে সামনে এগুতে থাকে। খানিক বাদে বাদে আড়াআড়ি ধাক্কা খায়। ধাক্কায় দুলে দুলে ওঠে। ভেজা কাঠের ঘর্ষণে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আর বৈঠার জল ভাঙার ছলছল শব্দের অদ্ভুত ফিউশন যেন এই রাত্রির রহস্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি দুটো নাও, একটি লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় আবছা আলোকিত; অন্যটি ছায়া-অন্ধকার। বাজনার চর থেকে তাকালে মনে হবে— আলো-অন্ধকার, দুটো মিলে শ্যাওলাগন্ধা জলে পাশাপাশি সাঁতার কাটছে!
অ মাঝিইইইই, কোন ঘাটের ডিঙ্গি?—দূরাগত আহ্বানে গানের তাল কেটে গেলো। মজু মিয়া চিৎকার করে জবাব দিলো— কোঞ্চাপাড়া।
দেবুর কিছু একটা সন্দেহ হয়, ফিসফিস করে বলে— কাহা, চুপ! এরপর দুজনে সন্তর্পণে লক্ষ করল দশহাত দূরে জলে কিছু একটা নড়ার শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ শব্দটা থেমে গেলো। দেবু নায়ের গলুই ঘেঁষে এনে মজু মিয়ার বাহুতে একটা টিপ্পনী কেটে আঙুল তুলে ডিঙ্গিটার উত্তর কোণে দেখালো। আঙুল বরাবর লক্ষ করে মজু মিয়া লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরতেই দেখতে পেল, সেখানে জল থেকে অবিরাম বুদবুদ উঠছে! জ্বীন ভূত নয় তো? মজু মিয়া একটু সামনে ঝুঁকতেই জলের ভেতর থেকে আচমকা কপালে একটা ধাতব আঘাতে ভনভন করে উঠে মাথা। ঘটনার আকস্মিকতায় মজু মিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। হাত রক্তে ভিজে যায়।
ভগবান আজ তার পক্ষে আছে!
প্রথম আঘাতের টাল না সামলাতেই দ্বিতীয়বারের মতো ধাতব বস্তুটা ঘাড় লক্ষ করে সজোরে ছুটে এলো। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো অস্ত্রটা। ঘাড়ের ওপরের দিকে স্পর্শ করার ঠিক আগ-মুহূর্তে মজু মিয়াকে কেউ হ্যাঁচকা টানে বাম দিকে শুইয়ে দিয়েছে। আঘাতটা পিছলে গেল। মজু মিয়ার মাথা তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। কপাল ভেসে গিয়ে একটা চিকন রক্তের স্রোত নেমে এসেছে নাকের ডোর ঘেঁষে। তিনি মুখ তুলে দেখলেন—জলের দিকে হাতের বৈঠাটা উল্টো করে ধরে হাতলের চোখা কানা দিয়ে বর্শার মতো ঘাঁই মারছে দেবু। একটা আর্তচিৎকার শোনা গেলো। তারপর দেবু তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে পাশের অন্ধকার নৌকাতে ছেড়ে দিল। গড়িয়ে গড়িয়ে নায়ের মাঝখানে এসে গুঁটিসুটি মেরে শুয়ে আছে মজু মিয়া। দেবু ত্রস্ত হাতে বৈঠা বাইছে। জল কেটে কেটে যতটা দ্রুত ও নিঃশব্দে সম্ভব, নাও বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
নাহ! এভাবে পলায়ন সম্ভব নয়। আর্তচিৎকার শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই বাইচের নৌকার মতো ‘হৈ হৈয়া হৈ’ শব্দের তালে তালে সারি বৈঠা বেয়ে ডাকাত দলের নৌকা মজু মিয়ার লণ্ঠনঅলা ডিঙ্গির দিকে ছুটে আসতে শুরু করেছে। একটু পরেই তারা ঠাওর পাবে দেবুর আন্ধার-নাওয়ের কথা। দেবু অসহায়ের মতো অবিরাম বৈঠা বাইতে বাইতে চেয়ে দেখে ডাকাতদের বজরার টিমটিমে আলোগুলো আস্তে আস্তে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে ক্রমাগত আওয়াজ বাড়ছে ‘হৈ হৈয়া হৈ…’
দেবু বৈঠাটা গলুইয়ের ওপর রেখে নাক উঁচু করে বুকভর্তি কয়েকটা গভীর শ্বাস নিল। তাতে পাঁজরের হাঁড় বেলুনের মতো স্ফিত হলো, কিন্তু ভেতরের ধুকপুকানিটা কমলো না। সে বাজনার চরের দিকে তাকালো। নবমীর ঝাপসা জোৎস্নায় চরের বালি যেন ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা বিছানার মতো জমিন পেতে আছে।
কাহা, সাঁতরাইতে পারবেন?—দেবু ঝাঁকি দেয় মজু মিয়াকে। মজু মিয়া পিটপিট করে তাকায়। অন্ধকার দেখে শুধু।
দেবু উত্তরের অপেক্ষা না করে লুঙ্গিটা কাছা মারে। দাঁড় টানার দড়ি দিয়ে বৈঠাটা পিঠে বেঁধে নেয়। তারপর মজু মিয়াকে আবার পাঁজাকোলা করে তুলে সন্তর্পণে জলে ছেড়ে দেয়। যথাসম্ভব নিঃশব্দে সেও টুপ করে জলে নেমে পড়ে। এক হাতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে অন্য হাতে মজু মিয়াকে টেনে নিয়ে চলে। মজু মিয়া যেন তন্দ্রার জগতে চলে গেছে! সে কেবল টের পাচ্ছে ক্রমাগত জলের ঝাপটা, মাঝে মাঝে কচুরির ঝোঁপে মুখ ডুবে গেলে শ্যাওলা-পচা ঘ্রাণ নাক চেপে ধরছে। নাকে-চোখে ঘোলা জল ঢুকে ভেতরে জ্বালা করছে। কপালে চিনচিন করছে একটা তীব্র সরু ব্যথা। দেবুর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে শব্দগুলো—কাহা, হাত পা ছাইড়া দেন…জল কাটেন…ওই যে বাজনার চর দেহা যায়…আর এটটু…। যৌবনে একবার নৌকা বাইচ বেয়েছিল মজু মিয়া, হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল, সেই বাইচের সারি গানের লহর—‘হৈ হৈয়া হৈ’শুনতে পাচ্ছে সে…
কানে পানি ঢুকে কেমন বোঁ বোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথাটা দুই/তিনবার ঝাঁকি দিতেই কিছু গরম পানি ডান কান থেকে গড়িয়ে পড়লো। দেবু তাকে শুইয়ে দিয়েছে কোথাও। চোখ খুলতে পারছে না মজু মিয়া। প্রচণ্ড তন্দ্রায় মাতালের মতো আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কোত্থেকে যেন করুণ দোতারার সুর ভেসে আসছে। তবে কি তারা বাজনার চরে পৌঁছে গেছে? এই চরটাতে মধ্যরাতে নাকি বাজনার শব্দ শোনা যায়। তাই লোকে বাজনার চর বলে ডাকে। দোতারার শব্দে ঘুমটা আরও যেন ঘনিয়ে আসছে। মজু মিয়া ঘুমিয়ে পড়ল।
চোখ মেলে মজু মিয়া আসমান দেখতে পেল। একদম ফকফকা, যেন আমেনা মাত্র ঝাঁট দিছে, মেঘের ছিটেফোঁটাটিও নেই। আমেনা কাজে কর্মে বড়ই লক্ষ্মী। কিন্তু কপালটা পোড়া। বিয়ের বছরেই স্বামী ওলা উঠে মারা গেল। অপয়া বলে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা খেদিয়ে দিল। তারপর থেকে মা মরা মেয়েটা বাপের ঘরে। মজু মিয়া মরে গেলে যে অভাগীর কী হবে, ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফুড়ুৎ করে নাক গলে বেরিয়ে এলো।
কাহা, এ বেলা বাঁইচা গেছি মনে অয়!—দেবুর কণ্ঠ থেকে আতঙ্কের কাঁপুনি এখনো যায়নি। ঘাড় উঁচু করে মজু মিয়া একটা বালির ঢিপি দেখতে পেলো। জলের কিনার থেকে দূরত্ব নেহাৎ কম নয়। এতটা পথ তাকে কী করে যে বয়ে নিয়ে এসেছে দেবু, ভেবে কুল পায় না মজু মিয়া।
দেবু বর্ণনা করে, কিভাবে হামাগুড়ি দিতে দিতে তাকে টেনে হিঁচড়ে বয়ে নিয়ে এসেছে ঢিপির আড়ালে। তারপর আবার জলের কিনার পর্যন্ত গিয়েছে একা একা। বৈঠার হাতল খুলে দাঁড়টানা দড়ি দিয়ে দুই পাশে দুইটা পাথর বেঁধে হাতলটা বালির মধ্যে চ্যাঁচিয়ে এনেছে, যেন হামাগুড়ির চিহ্ন মুছে যায়। মজু মিয়া বিস্ময়াভিভূত হয়ে শুনতে থাকে। এই ছোকরার মাথায় এত বুদ্ধি, আগে ঠাহর হয়নি! এমনিতে চুপচাপ থাকে। কথা কম কওয়া ছেলেগুলো বুঝি এমনই হয়!
তুই ডাকাইত দলে আছিলি কোন বেলা? এত কিছু কই শিখলি?
দেবু হাসে। এমন আজগুবি প্রশংসা শুনে বুকের ধুকপুকানি উবে গেছে। সে একটু ঝুঁকে মজু মিয়ার কপালের ক্ষত বোঝার চেষ্টা করে, অন্ধকারে ঠাহর হয় না। গলা খাকারি দিয়ে জিভ থেকে একদলা থুতু আঙুলের ডগায় নিয়ে ক্ষততে আলতো করে লেপে দেয়। অন্য সময় হলে মজু মিয়া ঘেন্নায় শিউরে উঠতো। অচ্ছুতরা ছুঁলেই কেমন যেন নাপাক নাপাক লাগে নিজেকে। কিন্তু এখন, এই নবমীর আধো-জোৎস্নাময় আলোতে—বাজনার চরের এই ঢিপির আড়ালে-বালিতে হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া মজু মিয়া যে দেবুর আঙুলের উষ্ণতায় মমতা খুঁজে পেল, বুকের ভেতরে একটা কাঁপুনি দিয়ে একবিন্দু লোনা জল অন্য সব অনুভূতি ঠেলে উঠে এলো চোখের কোটরে।
দেবু গেলো নৌকাখানা খুঁজতে। আন্ধারে কিছু দেখা যায় না। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে জলের ওপর কচুরিপানার ঝাঁকগুলোর অবয়ব আবছা আবছা বোঝা যায়। দেবু সরু চোখে আঁতিপাতি করে খুঁজছে। হঠাৎ মনে হলো, ডান কোণে খানিকটা দূরে কচুরিপানার ঝোঁপে একথোক অন্ধকার জমে আছে। দেবুর মুখে হাসি ফুটলো। ভগবান আজ তার পক্ষে আছে!
সাঁতরে কাছে গিয়ে দেখতে পেলো তার অনুমানই ঠিক। নৌকাটা কচুরি আর হেলেঞ্চার ঝোঁপে আটকে থির হয়ে আছে। দূর থেকে তাকে জমাট অন্ধকার মনে হয়। নৌকায় কিছু সওদাপাতি ছিল। সেগুলো ঠিকঠাক আছে। ডাকাতরা লণ্ঠনহীন নাওটার হদিস পায়নি। হয়তো ভেবেছে, অস্ত্রের আঘাতে ঢলে পড়ে মজু মিয়া জলে ডুবে মরে গেছে। তাই সেই ডিঙ্গিতে যা যা পেয়েছে, লুটে নিয়েছে। দেবুকে খোঁজার চেষ্টা করেনি। এই বিজন মোহনায় যে পালাতে চায়, তারে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জল ঠেলে ঠেলে নাওখানা চরের কিনারে নিয়ে আসতে দুই হাতের তালু ছিঁড়ে ফেটে গেল। সেদিকে তাকানোর সময় কই? মজু মিয়ারে ধরে নৌকায় তুললো। ভাঙা বৈঠাটার হাতল দড়ি দিয়ে বেঁধে কোনো রকম কাজ চলে মতোন সারালো।
ধীরে ধীরে বৈঠা বাইতে থাকলো দেবু। উত্তর-পশ্চিম কোণ ঘেঁষে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তাই হালকা জল কেটে কেটে নাও বাইতেই দুরন্ত গতি পাওয়া যাচ্ছে। মজু মিয়া পাছা-গলুইয়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মৃদু বাতাসে হালকা শীত শীত লাগছে। শীত কাটাতে মজু মিয়া ভাটির গান ধরল:
বইয়্যা চলে ময়ুরপংখি
উজান ভাটি বাইয়্যা
সেই নদীতে গোসল করে
অচীন দেশের মাইয়্যা…
অ মাইয়্যা তোর গতর কালো
তার’চে কালো আঁখি
কালো কেশে ইচ্ছা করে
পরান বাইন্দা রাখি রে আমার
পরান বাইন্দা রাখি…
গানে মগ্ন হয়ে বাইতে থাকে দেবু। বাইতে বাইতে যেন অচীন দেশের সেই কালো মেয়েটিকে দেখতে পায় কল্পনায়। কোন ঘাটে যে সেই কন্যা অপেক্ষায় আছে তার? কবে দেখা হবে?
নৌকা কোঞ্চাপাড়ার ঘাটে ভেড়াতেই সফু ছুটে এলো। মজু মিয়ার ভাতিজা সফু। চাচার কপালে ক্ষত দেখে হায় হায় করে উঠল— চাচা, কী অইছে আমনের? কপালে রক্ত ক্যা? দেবু, তুই এ কাম করছোস?
না রে সফু। দেবু না থাকলে আইজ জীবন লইয়্যা ফিরবার পারতাম না। বাজনার চরে ডাকু পাইছিলো আমরারে। এই দেবুই ত আমারে বাঁচাইছে।
আমরা এদিকে চিন্তায় চিন্তায় আধ্মরা। আমেনারে মাত্র পাডাইলাম। সারারাত মাইয়াডা ঘাটে বইয়া কান্দছে।
দেবু আর সফু দু’জন ধরাধরি করে মজু মিয়ারে নাও থেকে নামালো। হটাৎ দেবুর দিকে ফিরে সফু বললো:
দেবু, তুই এই ঘাটে নামিস না। কালীঘাটে গিয়া নোঙর দে।
ক্যা, এই ঘাটে তো রোজ নোঙর দেই। আইজ দিমু না ক্যা?
গ্যাঞ্জাম অইছে কাল রাইতে। হিন্দু-মুসলিম লাঠালাঠি অইছে। তুই চাচারে বাঁচাইছোস। তোর ভালার লাইগ্যা কইলাম। কেউ এই ঘাটে দেহনের আগে যা গিয়া। ত্বরা কর।
কী নিয়া গ্যাঞ্জাম?
এত কাহিনী কওনের সময় নাই, বাড়িত গিয়া হুনিছ। এহন যা।
দেবুর বিশ্বাস হতে চায় না! সফু তাকে জোর করে নাওয়ে তুলে দেয়। সে কোঞ্চাপাড়ার ঘাট ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত মজু মিয়া সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দেবুর মতো মজু মিয়াও আকস্মিক দাঙ্গার সংবাদে স্তম্ভিত! সফুর কাঁধে ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে; কিন্তু মনে হচ্ছে সব ভর, সব অবলম্বন, সব নির্ভরতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
দেবুর নৌকাটা দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে চলে যেতে থাকে।