টিভির মধ্যে এক আলেক কথা বলছে, পাড়ার লোকেদের সঙ্গে বসে আর এক আলেক তা দেখছে—এই দৃশ্য কল্পনা করে কতবার যে গায়ে কাঁটা দিয়েছে আলেকের, হিসাব নেই। সারাটা ছোটবেলা তার কেটেছে এই স্বপ্ন দেখে। বন্যা খরা ঝড় লেগেই থাকে এলাকায়। ক্যামেরাও প্রায় জ্বলতে থাকে প্রতিদিনের সূর্য হয়ে। কিন্তু যদু মধুর মুখ দেখাতেই ব্যস্ত তারা, আলেকের দিকে ফিরেও তাকায় না। নজরে পড়ার জন্য কতকিছু করল—গাছে ওঠা থেকে পানিতে নামা, লাভ হলো না কিছুতেই। এটাই তার সবচে’ বড় দুঃখ ছিল একসময়। কারও দুঃখকে ডুগডুগি বানিয়ে বাজানোর লোক তো আর কম নেই গ্রামে, ফোড়ন কাটে তারা, ‘এই না তার চিহারা, নাম রেখেচে পিয়ারা’। বদখত চেহারাই নাকি এই দুর্ভাগ্যের কারণ। ফলে যে যা করতে বলতো, সুন্দর হওয়ার লোভে তা-ই করতো সে। আর তখন আরও বেশি হাস্যকর লাগতো তাকে।
মাঝে মাঝে সেসব পাগলামির কথা ভেবে নিজেও হাসে এখন।
কিন্তু গেল সপ্তাজুড়ে ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার। মনে হচ্ছে একবার যদি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারতো, একবার যদি এগিয়ে আসতো কথা বলার মাইকটা ওর দিকে, তাহলেই বোধহয় সমাধান করে ফেলতো সব।
মাছ মারার যাবতীয় আয়োজন নিয়ে সে বসে ছিল ভেলায়। তবে মাছের দেখা নেই। চার যা এনেছিল মাখিয়ে, শেষ হয়ে গেছে। খারোই তবু খালি এখনো। অথচ মাছ বেচে চাল কেনার কথা তার। কেনার কথা দুধ। এখন কী হবে?
ফল খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই মানুষ শিকড়ে যায়। আলেকও গেলো।
বদরের সঙ্গে ঝগড়া করাটা ভুলই হয়েছে। না হলে রিলিফ পাওয়া যেত। খাওয়ার চিন্তা করা লাগতো না। জালটা আবার ফেলার প্রস্তুতি নিতে নিতে ভাবে আলেক। ঝগড়াও হলো, পরদিন পানিও নামলো। এই কাঁচা ঝগড়ার স্মৃতি ভুলে ওরা কি পাশে দাঁড়াবে এই দুর্দিনে? মা বলতো, ‘ঝগড়া-বিবাদ মানুষের সাথে করতি হলি করবা। খবরদার বড়লোকদের সাথে না।’ বন্যা আসছে জানলে আলেক টুপ করে গিলে ফেলতো অপমানটুকু। কথা বাড়াতো না। অবশ্য ত্রাণের ভরসা আলেক করেনি কখনো।
গরিব ঘরের ছেলে। তবে হিসাব করে চলে। আব্বার মতো তাই হাত পাততে হয় না। খুব বেহিসেবী ছিল আব্বা। যখন টাকা থাকতো, পারলে তখন তেল দিয়ে গোসল করে, আর না থাকলে পানিও জোটে না! বহুবার তাকে অপদস্ত হতে দেখেছে আলেক এ কারণে। আর শিক্ষা নিয়েছে, প্রয়োজনে কম খাবে মোটা পরবে, কিন্তু একবার বাড়তি খেয়ে দুই বার ভুখা থাকবে না। থাকে না। ছোট সংসার। গোছালো জীবন। অকারণ খরচ করে না। রান্নার আগে মুষ্টি করে যেমন চাল জমিয়ে রাখতো মা, অমন করেই খাই-খোরাকি জমিয়ে রাখে। বছরের এই সময়টা উৎরেই যায় তাতে।
তবে কিনা যাচ্ছেতাই গেল বছরটা এবার। একটা পা শুকোয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে ঝিনঝিনে ব্যথা। পাতা থেকে শুরু হয়েছিল, ছড়িয়ে গেছে এখন। হাঁটুপর্যন্ত প্রায়ই অবশ, সাড় থাকে না কোনো। এমন দিনগুলোতে ঘরে পড়ে কাতরায় সে। বের হতেও পারে না, জোনে যাওয়া তো দূরের কথা। এদিক সেদিক করে বউটা চালিয়ে নিয়েছে কোনোমতে। বউর কাছে অল্প কিছু ছিল, বন্যার আগ দিয়ে অসুখ হলো বাবুটার, ওষুধ কিনতেই শেষ। চাল ডাল নারকোল যা ছিল, বন্যার প্রথম সপ্তাহেই সাবাড়। হাত, হাঁড়ি, পকেট সব এখন খালি। রিলিফও পায়নি। গত প্রায় সপ্তাখানেক মাছের ড্যাকনা আর পাখনায় বেঁধেই চলছে ওরা। কিন্তু কাল থেকেই কিসের যেন গেঁরো লেগেছে কপালে। খুলছেই না। ছিপের ফাৎনাটা পর্যন্ত ডোবেনি একবারও। অথচ মাছ আর মাছ চারদিকে। পাশেই জাল ফেলছিল কাশেম পাগলা। ঝুড়ি ভরে নিয়ে গেছে সেই কখন! নগেন এসেছিল সকালে, খারো ভরে নিয়ে গেছে। ওদের জায়গায় গিয়ে জাল ফেলেও আলেকের খারোয় চৈতের খরা। দেখেই সদু মেম্বারের চেহারা ভাসছে চোখে, আর রাগ হচ্ছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে।
মাল খেলতো। সদুর বড়ভাই কদু ছিল বিখ্যাত মাল। তার সামনে কেউ দাঁড়াতেই সাহস পেতো না, আলেক ছাড়া। যদিও বারবার আলেকেরই পিঠ পড়তো মাটিতে! কতবার কতভাবে চেষ্টা করেছে, পারেনি। পারেনি ও পাড়া থেকে বুক উঁচিয়ে ঘরে ফিরতে। পারেনি বাবুল ঢ্যাঁকের কথাটাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে। ‘পাটকাঠির গুছা বেন্দে কি আর গাবগুড়ি বানানো যায়? না গুড়ির কাজ কাঠি দিয়ে চলে? তিনবেলা ভাত পায় না, আলেক আইচে কদররে হারাতি। বাপ-ছেলে মিলে আসলিও তো পারবে না!’ সাহস ছিল, কিন্তু সবাই জানে, ঢ্যাঙা পটকা শরীরটার জন্যই পেরে উঠত না আলেক। এই বয়সেও কি তা-ই হবে? হেরে যাবে খিদের কাছেই! ভাবতে ভাবতে জাল গুটায় সে। এমনভাবে গুটায় যেন পানিও টের না পায়। ঠিক যেমন টানতো আব্বা—ডানহাতে গুটানো থাকতো আগেই টানা জাল। বাম হাতটা আলতো করে এগিয়ে যেত প্রশস্ত জালকে গুটিয়ে এনে তালুর বাধ্যগত করতে করতে। হাতখানেক দূরে গিয়েই সেটুকু জমা দিত ডানহাতের জিম্মায়। আবার ফিরে যেত আগের মতো, আস্তে, ধীরে। শব্দ হতো না, কাঁপত না। তবু টের পেয়ে যেত মাছেরা। মাছেরা চালাক বড়। লাফালাফি শুরু করে দিত। ছোট্ট আলেক খারোই হাতে দাঁড়িয়ে থাকত অধীর। জালের কম্পন দেখেই আব্বা বলে দিতো এইবার শোল মাছ। এইবার সিলভার। এইবার ট্যাংরা। পুঁটি।
মালেক মিয়ার মতো সিদ্ধহস্ত না হলেও, মাছ আলেক খারাপ ধরে না। কিন্তু এই যে, এই বারও ক খানা শামুক দুটো ট্যাপা আর ক’টা পুঁটি ছাড়া উঠল না কিছু। কপালে কি তাহলে দুর্যোগই লেখা?
সপ্তাহ তিন হয়ে গেলো, পানি নামার নাম নেই। অবশ্য কুড়োয়েই গিয়েছিল। গত সপ্তাহ আবার বাঁধ খুলেছে ইন্ডিয়া। এবার আগেরবারের চেয়েও বেশি। ইশকুল ঘরে পর্যন্ত ঢুকে গেছে। মানুষ না মরলে তো জাগে না মানুষ। সরকারের কানে ঢুকতে বন্যারও তাই সপ্তাহ লেগে গেলো। এর মধ্যে ঘর ধসল। পথে বসল লোক। আরো বাণ আসলো। দলে দলে জান ভাসল। তারপর, সবে এই কদিন হলো, গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে সবাই। সকালে রিলিফ। বিকেলে রিলিফ। চাল ডাল তেল নুনের ছড়াছড়ি। আজকে এ দেয় তো কালকে ও।
মেম্বারের বাড়ির নিচতলায় পানি, সবাই এসে দোতালায় বসে। সেখান থেকেই বাটোয়ারা। যে যেভাবে পারে হাতিয়ে নেয়। অথচ আলেকের হাঁড়ি চলে না। মাঝে দুই দল লোক নিজেরাই বিতরণ করে গেছে। কিন্তু পায়ের যন্ত্রণায় উঠতেই পারেনি ও। রুইলারও উপায় নেই যাওয়ার। ডাক্তার আপার বারণ। বেশি ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে। আর তখন নিউমোনিয়া না কি যেন বলে তাই হবে বাবুর।
কিন্তু বাঁচতে তো হবে। কী করবে, নিরুপায় আলেক! ছোট হওয়াই দস্তুর এখন। চোখকান বুজে কাল মাফ চেয়েছে বদুর কাছে। তারপর দেখা করেছে সদু মেম্বার। এ কথা সে কথায় চলছিল ভালোই। কার্ডের কথা শুনতেই রেগে সে ফায়ার! যাকে ভোট দেয় না, তার কাছ থেকে কার্ড চাইতে আসে কোন লজ্জায়? মেম্বারকে কি পাগলে পেয়েছে? ‘খুব তো আজিজ মেম্বারের বিড়ি টানো। তার ভোট করে বেড়াও। বাজারে বাজারে মিছিল মারাও। ঝগড়া করতি করতি দা দেখাও আমার ভাইরে। তা আজ আমার কাচে আইচাও ক্যান? যাও না ক্যান আজিজ চুরার কাচে!’ আজিজ মেম্বারের কাছেও গেছে এরপর। কিন্তু লাউ যা, কদুও তো তা-ই। ‘যারে ভোট দিয়ে মেম্বারি পাস করাইচো, সে-ই তোমাকে দেয় না। আমার কাছে খ্যামতা নেই, লোকবল নেই, রিলিফ পাবো কনে? যখন ছিল তখন তো দিইছি। মনে করে দেখো। গেলবার বন্যের সুমায় আমি মেম্বার ছিলাম, কোনো সাজ না খেয়ে থাকা লাগিল তুমাদের? সরকার দিতি দেরি তো আমার দিতি দেরি না। নিজির গুলার চাল পর্যন্ত বিলোয়ে দিইচি! বলো, দিইনি? কিন্তু কোন ভুতি কিলোইচে তুমরা জানো, এবার আমারে ভোট দিলে না। দিলে গিয়ে সদু চোরারে। যাও, তার কাচে যাও। রিলিফ বলো জীবন বলো তার কাচেত্তে নেও।’
জিজ্ঞেস করে আলেক কি টাকা খেয়ে করেছে কাজটা?
সরকারকে বেকায়দায় ফেলাই কি উদ্দেশ্য
একেও না, ওকেও না ভোটটা তাহলে দিয়েছিল কাকে? বুঝে পায় না আলেক। আচ্ছা, ভোট যদি নাও দেয়, গ্রামবাসীর ভালোমন্দ কি মেম্বার চেয়ারম্যান দেখবে না? রাজা যখন রাজা, সব প্রজাই কি তার প্রজা না? প্রশ্নের ভারে নুইয়ে পড়া মাথা নিয়ে কোনোমতে ভেলা ভাসিয়েছিল। আসার পথে কাটুর সঙ্গে দেখা। কাটু বলে, যাক পথেই দেখা হয়ে গেল, কষ্ট করে আর যাওয়া লাগবে না। তোর বাড়িই যাচ্ছিলাম আলেক।
ভোটের আগে আলেককে ভাই ডাকতো, তুমি করে বলতো। এখন বদলে গেছে কাটু। ছোট কেউ নাম ধরে ডাকলে সহ্য হয় না আলেকের। তবে কাটুর ব্যাপার আলাদা। মেম্বারের খাসচাকর সে। দেখে বরং আশাই জাগে। হয়তো অনুতপ্ত হয়েই তাকে ডেকে পাঠিয়েছে মেম্বার।
তুমার কাডের ব্যবস্তা আমি করিচি।
ঠিক এটাই ভেবেছিল আলেক। কৃতিত্বটা কাটু নেবে। তা নিক। খিদের সময় খাওয়াই ইবাদত, আর সব গৌন—কী বলো কাটুভাই! মজা করচো নাকি?
না, মজা কাটু করে না। তবে তার পরের কথায় কালি লেপটানো, আন্ধার হয়ে আসে আলেকের মুখ। ‘সন্দ্যেয় একবার রুইলারে পাটাতি বলেছে মেম্বার সাব। পার্টসপত্তরে জং, ঘরদোরে ময়লা, সবকিছু জ্যাম হয়ে আচে। পইস্কার করতি হবে। পাটায়ে দিস। রিলিফির ব্যবস্তা আমি করবানে।’ বলেই ডুঙা ছেড়ে দেয় কাটু। সদুকে আলেক ভালোই চেনে। রিলিফ নিতে হলে এখন রুইলারেই পাঠাতে হবে, নইলে নাই। ভেলাটা তখন চলতে ভুলে যায়। টলতে থাকে শুধু। টলতেই থাকে।
আলেকের বোকামির জন্যই এই অবস্থা।
মাটি-বাঁধানো উঁচু উঠোন। সারাগ্রাম ভেসে গেলেও তার ঘর ডোবে না। ফলে রিলিফ নেওয়া লাগে না। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ঝামেলাও নেয় না সে। লোকে বলে, দেমাগে পা পড়ে না মাটিতে। তবে এবার আর ‘দেমাগ’ দেখানোর সুযোগ ছিল না, ঘরে খাবার নেই দাবার নেই, আশ্রয়কেন্দ্রেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কদিন পরেই পানি শুকিয়ে যেতে শুরু করলে আর যায়নি। পরে যে আবার ডবল তিন ডবল পানি আসবে, উঠোন ছাড়ায়েও উঠে যাবে পটেই, বোঝেনি। ভুলটা তারই। তবে রাগটা হয় সদুর ওপর। মাঝে মাঝে সেটা রুইলার দিকেও যায়।
ওই রাগে ঘামতে ঘামতেই ঘরে ফিরেছিল আলেক।
বাচ্চাটা তখন বারান্দার কিনারে। যা চঞ্চল হয়েছে, মাঠে শোয়ালে ঘাটে পাওয়া যায়। কবে যে গড়ায়ে পড়বে উঠোনে, কে জানে। কতবার বলেছে দুপাশে বালিশ দিয়ে রাখতে, কে শোনে কার কথা। এটা নিয়েই বকছিল। আর রাগ ঝাড়ছিল ইনিয়ে বিনিয়ে। কথায় কথা জোগাচ্ছিল রুইলাও। ‘এত যে বাপ বাপ মারাও, বাপ হয়ে কী বালডা ছিঁড়িচাও বলো! দুটো খাওয়ার জোগাড় করতি পারো না, বউডার না হয় উপায় নেই না খাইয়ে রাকলিও যাবে না, বাচ্চাডা এই কষ্ট সহ্য করবে কী করে? সারা গ্রাম রিলিফি ভেসে যাচ্ছে, তুমি পাও না। আমি যাই, দেখি কিডা আমারে না দিয়ে খাতি পারে!’ কাটুর মাখানো আলকাতরায় এমনিই তো তেতে ছিল বুক, রুইলার আগুনে তা জ্বলে উঠল দাও দাও।
‘বুকি দুদ থাকে না ক্যান মাগি তোর? ও দুটো কি ঢলঢল করে দেকানোর জন্যি? বল মাগি, ও দুটো কি পুরুষির লোভ ধরানির জন্যিই শুদু?’ বলেই তেড়ে যায় মারতে। রুইলাও হাতের হাড়ি চেলে মারে। আলেকের পায়ের কাছে এসে পড়ে সেটা। রাগ ঝাড়ে সে হাড়িটার ওপরই। তারপর বের হয়ে যায় জাল বরশি নিয়ে। পেছন থেকে শোনা যায় রুইলাকে। ‘পায়ে নাকি উলাউটো হয়েচে, নাড়াতি পারে না। তা ভাতের হাড়িতে লাথি মারে কিরাম করে? ওই পা পড়ে যাবে না কি আর লোকেরটা যাবে?’ শুনতে শুনতে আর জ্বলতে জ্বলতে চলে এসেছিল বিল পানে। চারপাশে পানির মধ্যে থেকেও সে তুষ নেভেনি এখনো।
তবে মাথা এখন অনেকটাই ঠাণ্ডা। রাগও কমে এসেছে। শিকড়ে রস না জুটলে যে ফল ধরে না গাছে, তা তো বোঝেই। খারাপই লাগছে। খেয়ে না খেয়ে বউটা যে এই পোড়া সংসারে পড়ে আছে এখনো, এই তো তার ভাগ্য। কিন্তু খারোর দিকে চোখ পড়তেই রাগ হয় আবার। রুইলার বুকির মতোই যেন খারোইটা। দেকতিই সুন্দর শুধু, কাজের কাজ কিছু না। বাচ্চাডা সারা রাতই ট্যাউ ট্যাউ করে। আজও করবে। খিদে সহ্য হয়, বাচ্চার কান্না হয় না। আচ্ছা, পাটাব নাকি রুইলারে একবার? ভাবতেই চিরে যায় বুকটা। না! না খেয়ে মরলেও পাঠাবে না। অন্য উপায় করতে হবে। ‘অন্য উপায়’ বলতে টিভির কথাই মনে আসে তার।
ইশ! যে যখন সুযোগ পায়, নিজের কথাই বলে শুধু। সে পেলে সবার কথা বলতো। এলাকার দুর্দশার কথা বলতো। কাছের দূরের সবাই তো মানুষ, কষ্ট তো সবারই হয়। এই যে রহমতরা দাদার কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়েছিল, এখন খুইয়েছে সব, কষ্টে আছে, ওদের কথাও বলতো। তবে সবার আগে ফাঁস করত সদরের গুমর। ‘এরাম কতা কতাম না, মেম্বারগিরি সব পাছা দিয়ে বেরোয়ে যেত সদুর!’ এরপর করতো আজিজ্যার গুষ্টি উদ্ধার। ‘শালারা! নামেই যা আলাদা, ভেতরে ভেতরে সব রসুনের পাছা। ইহ! ভোট দেওনি তাই রিলিফ পাবা না, রিলিফ কি তোদের বাপের রে সালা!’ ভাবতে ভাবতেই চোখ গেলো হরিপদ’র দিকে। মাছ ধরা শেষ। জাল গুছিয়ে নিলো। ফর্সা পানিতে ডুব দিলো একটা। তারপর ফিরতি পথ ধরলো। এখন বড় রাস্তায় যাবে। শহরের লোকেরা এসে সস্তায় কেড়ে নিয়ে যাবে টাটকা তাজা মাছগুলো। হরিপদই শুধু না, জনু নজু নরেন সদেব সবার পেট এই মাছ মেরেই চলছে। মিরগেল রুই বা শোল মাগুর সরপুঁটি, কী নেই বলো। বান ভাসলে সিলভার কার্পের তো বলতে গেলে ঢলই নামে। আশপাশের যত ঘের ভেড়ি ভেসে যায় সব। মাছ তাই সবখানে। নরেনদের উটোনেও নাকি মাছের গাদা। এই মাছ আর রিলিফই ভরসা বন্যার সময়। এর আগে আলেকও তো মাছ বেচেই খেয়েছে।
কিন্তু কী যে হলো কাল থেকে!
দুঃখ করছিল সন্ধ্যায়। শুনে দাঁত কেলাচ্ছিল নরেন। ‘গার জোরে কি আর মাছ ধরে দেয় গো দাদা, মাছ ধরতি কপাল লাগে। তুমি শুনলাম বিলের মধ্যে পুড়ে পুড়েও মাছ পাওনি। আর আমি এদিকি উঠোন থেকেই কেজি তিনেকের আইড় মারলাম একটা!’ তেড়ে উঠেছিল আলেক, ‘কপালের জোর তুই কিরাম করে বুঝবি রে বাগদী। দিন ফিরুক, দেখাবানে তোরে কপাল কারে বলে’। এখন মনে হচ্ছে, কপালটা বোধহয় আসলেই ছোট ওর।
সারাটা দিন গড়ায়ে গেল দুডো মুড়ি চিবোয়ে। এক ঘটি পানি এনেছিল সঙ্গে, শেষ হয়েছে বেলা সোজা হওয়ার সময়। এখন এই সন্ধ্যা হবো হবো। শুকনো গলা। শুকনো খারোই। তলায় কটা পুঁটি খোলসে। ওই নিয়ে কী দে কী করবে আলেক? নিজেরা না খেয়ে থাকা থায়, বাচ্চাটার কী উপায় হবে? রুইলাকে দিয়েই কি উদ্ধার পেতে হবে শেষ পর্যন্ত? ভাবতেই চিৎকার করে ওঠে আলেক। ‘শালার কপালের গুষ্টি কী দিয়ে যে মারিচি,..’ শেষ করতে পারে না কথাটা। পড়ে যায় সমুদ্রপ্রায় জলে।
পড়তেই শান্তি! আহা! কামারের হাঁপরে পোড়ানো দেহটা পানিতে পড়ে জীবন পেলো যেন। ভয়ও লাগে খুব। বন্যার সময় সাগর নদী বিল সব সমান। কত জায়গা থেকে কত রকম বিপদ যে ভেসে আসে! মাঝবিলে একা পড়ে ভাবতে থাকে সে। আর কাঁটা দেয় গায়।
না, আর অপেক্ষা না। বাজারে যেতে হবে, ধারধোর কিছু পাওয়া যায় কি না দেখতে হবে। তা এই দুর্যোগের দিনে কেই বা বসে আছে টাকা নিয়ে! তা হয়তো নেই, তবে চেষ্টা করতে দোষ কী?
কপালের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে পথ ধরে বাড়ির।
ভেলাটায় তিনটে কলাগাছের জোড়। একটা জোড় খোলে খোলে ভাব। বাঁশের আঙটাদুটো ঠিকমতো গুঁজে দিলেই হয়, কিন্তু ইচ্ছে করছে না। রাগে অথবা খিদেয় কাঁপছে শরীর। বিল পেরিয়ে ধানখেত। তারপর পথ। পথের পরে আলুপটলশাকের খেত। তারপর বাগান। তারপর উঠোন। এখন সবই পানির নিচে। ঝোপ বা ঘাসজঙ্গলগুলো কালচে দেখায় ওপর থেকে। ওই আড়ালে লুকোয়ে থাকে মাছ। শেষ চেষ্টা হিসেবে ওদের অপেক্ষাতেই ওৎ পাতছে আলেক। দুলতে থাকা ভেলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকছে। সজাগ সটান। হাতে ধরা ছয় শিকের কোচ। পানি নড়ে উঠলেই শপাৎ শব্দে বসে যাচ্ছে কোচটা। ফলাগুলোয় তীক্ষ্ণ ধার। বিঁধলে মাছের বাপের সাধ্যি নেই বেঁচে ফেরার। সমস্যা হলো নিরিখে। ছোটবেলায় নই খেলতো খাবরা দিয়ে। যত দূরেই নই ফেলুক না কেউ, ঠিকই নিশানা করতো সে। পাড়ার ছেলেদের যত মার্বেল, সিগারেটের তাস কোচড় ভরে নিয়ে উঠত ঘরে। তবে নইয়ের আর কোচ মারার নিরিখ তো এক না। তিন-চারবারে একবার হয়তো ঠিক ঠিক লাগে। তাতেই একটা শোল আর একটা রুইপোনা উঠে আসে খারোইয়ে। একবার ওঠে সাপ, একবার ব্যাঙ। দেখে আরো তিরিক্ষি হয়ে যায় মেজাজটা। এসব খাওয়া শুরু করবে নাকি শেষ পর্যন্ত বাগদীদের মতো! গজ গজ করতে করতে বাড়ি ঢোকে সে। ঢুকতেই হাওয়া লাগে রাগের আগুনে। রুইলা নেই। গেল কোথায় খানকিটা? ঘরে আলো পর্যন্ত দেয়নি। বাচ্চাটা কোথায়? ভাবে, কোনো বিপদ হলো না তো? নাকি মেম্বারের কাছে গেল? শুয়োরটার প্রস্তাব ওকে জানানো ভুল হয়েছে। যা হওয়ার হয়েছে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে, মেম্বারের ঘর এবার জ্বালিয়েই ছাড়বে। না, তার চেয়ে ভালো শুয়োরটাকে জবাই করতে পারলে। আর রুইলাকে দেবে তালাক। জ্বলন্ত মাথাটা নিয়ে যেই না ঘুরিয়েছে ভেলার মুখ, তখনই খলবল শব্দ হয় উঠোনে। মাছ!
মুরগি বাগে পেলে শিয়ালের যেমন হয়, তেমন করেই ঠাণ্ডা হয়ে যায় মাথাটা আলেকের। ভেলায় শুয়ে থাকা কোচটা টেনে নেয় সন্তর্পণে। আবার ঘাই মেরে ওঠে হাত তিনেক দূরের পানিটুকু। অমনি ছুড়ে দেয় ব্রহ্মাস্ত্র! তীক্ষ্ন একটা শব্দ হয় শপাং করে। আলেক বোঝে, আরেকটা দিন বাঁচার উপায় এবার হলো। কয়েক কেজি তো হবেই মাছটার ওজন। নরেনের কালচে দাঁতের হাসিটা ভেসে ওঠে চোখে। ‘দাঁড়া সালার বাগদী, আজ দেখবি আমি মাছ ধরতে পারি কি না।’ সন্ধ্যাটা কেমন আলো আলো হয়ে ওঠে হঠাৎ। ঠিকমতো গেঁথেছে কি না নিশ্চিত হতে পারে না। মাছটা আসলেই বড়। নড়ছে। সাবধানে চেপে ধরে কোচটা। হাতদুয়েক নিচের মাটিতে বাধা পায় সেটা। আরও একটু চাপ দেয়। তখনই চোখ পড়ে পথের দিকে। এগিয়ে আসছে বউ। মুখে দুষ্টু হাসি। ভেলার সামনের দিকে সাদা একটা বস্তা। সদু মেম্বারের কাছ থেকে আসলো নাকি? রাগে কাঁপতে থাকে সে। কোচটা ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে করে রুইলার পেটে। তবে তার আগে মন দেয় মাছটার দিকে, ছুটে যেন না যায়। সাবধানে তুলে আনে ভেলায়। ‘মাছটার’ পেটভরা কোচের ফলা। ফলার গায়ে রক্তের লাল। দেখেই পাথর হয়ে যায় আলেক। চিৎকার দিয়ে ওঠে রুইলা। তার ‘আল্লা রে’ শুনে চমকে ওঠে ঘরের পেছনের বাঁশগাছে জমতে থাকা নীরবতা। কোমরউঁচু পানিতে নেমেও প্রথমে যেন ঠাঁই পায় না রুইলা। পা পড়ে উঠোনের ছাতলাজমা মাটিতে, পিছলে যায়। তল পায় না। ভেসে ডুবে কোনোমতে ছুটে আসে আলেকের ভেলার কাছে।
ঝাপসা চোখে রুইলার দিকে তাকায় আলেক। কেমন পাগলের মতো তড়পাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে, দমটা কেউ কেড়ে নিয়েছে, মরে যাচ্ছে রুইলা। সে হাতড়ায় চারধার। সে কাতরায়। আলেক কিছুই করে না। গা হাত পা জমে গেছে আলেকের। দুর্ভাগ্য যে, পাথর হয়েও সে ডোবে না। বুকের ভেতর একটা আখের রস জ্বালানোর চুলা ধরিয়েছে যেন কেউ। চুলোয় আগুন, কড়াইয়ে গরম গুড়। টগবগ করছে দুধারি যন্ত্রণা। আর সর্বনাশা জ্বালা। তার হাতটা যদি ছিঁড়ে নিত কেউ, বা এই সেদিন গণ্ডগোল হলো বদরের সঙ্গে, হেসো নিয়ে তেড়ে এসেছিল মারবে, যদি কোপ দিতো, যদি কেটে পড়ে যেতো মাথাটা বা একটা পা বা একটা চোখ উপড়ে নিতো কেউ এত কষ্ট কি হতো? কিছুই আর ভাবতে পারে না আলেক। শুধু মনে হয় বাচ্চাটা তার আঙুল ছাড়ে না ধরলে। বাচ্চাটা তাকে দেখতে পেলেই হাসে। বাচ্চাটার দাঁত উঠি উঠি। বাচ্চাটার চোখ ভীষণ পরিষ্কার, তাতে আলেকের ছবিটা নায়কের মতো লাগে। বাচ্চাটার কান্না শুনে বুক চিরে যায়। ভাবতে ভাবতে ডুবতে ডুবতে তার হুঁশ হয় রুইলা পড়ে আছে ভেলার ওপর, নড়ছে না। বাচ্চা আর বউ নড়ছে না যখন, তখন আলেকের নড়তেই হয়। এগিয়ে যেতেই হয়। কিন্তু সবাই সবসময় এগুতে পারে না। পড়ে যায় কেউ কেউ। আলেকও পড়ে। তার চোখের জলে বন্যা বাড়তে থাকে।
দুদিনপর স্বপ্ন পূরণ হয় আলেকের। ভীষণ সাজুগুজু করা এক মেয়ে আসে তার সাক্ষাৎকার নিতে। জিজ্ঞেস করে আলেক কি টাকা খেয়ে করেছে কাজটা? সরকারকে বেকায়দায় ফেলাই কি উদ্দেশ্য?
আরেকজন আসে। উল্টো প্রশ্ন করে সে। বন্যাপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা থেকে মিডিয়ার মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্যই কি এই হত্যা?
গাছে হলুদ জামা পরে একজন আসে। সে ফাঁদে অন্য গল্প। একজন এসে তাকে বামে দাঁড় করায়। আর একজন এসে ডানে।
এভাবে আসতেই থাকে তারা। তুলতেই থাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। উত্তরও দেয় তারাই। শেষ হয় না কথা তাদের।
আলেকেরই কেবল মনে হয়, তার বলার কিছু নেই।