এরপর কী হয়েছে?
চাচিকে তাড়া দেই আমি।
বাড়িঘরে কম যাই বলে বঞ্চিত হতে থাকি বিবিধ মুখরোচক গল্প আর নির্মল আলোহাওয়া থেকে। পোড়াকপাল নিয়ে জন্মেছি হয়তো, নইলে যখন একটু হৈচৈ করে জানান দেব নিজের অস্তিত্ব তখনই কেন শহর নামক খাচায় পুরে দেবে? এখন বুঝি—জন্মের সময় নিয়ে আসা শিক্ষা নামক মৌলিক অধিকারটির বক্ষ উন্নত করতে মা-বাবা পাঠিয়ে দেয় শহরের কলেজে। মা চোখের জল মোচেন, বাবা বিদেশ থেকে পাঠান রিয়াল। পড়াশোনার অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার মাঝপথে খানিক অবসরে গ্রামে যাই—প্রাণ ভরাতে, চেনামুখ, জানা পরিবেশ আর শৈশবকে খুঁজতে। আহা, কি আনন্দ, অনেক দিনের বদ্ধ ঘরে আলোহাওয়া প্রবেশের হর্ষে শোকর গুজার করি দেহমন। ভেতরকার আভাটুকুর কবর দিয়ে আগ্রহ দেখাই চাচির মুখে। চাচির আবার সুনাম আছে পাড়াজুড়ে। যেমন শরীর, তেমন খায়ও। ছোটকালে, ভিন্নগ্রামের মোটা মহিলাটি যখন আমাদেরই বাড়িতে চিকনা শরীরের চাচার বিবি হয়ে আসেন, চোখ তো চড়কগাছ! বাইরে গেলে বড় কেউ কেউ বলতো—যা গাভি এক্কান আনলে, দুধের আর অভাব পড়বে না। আমি ওসব না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি কথকের মুখের দিকে, কপালের বিশেষ রেখা আর শরীরের ভাষার দিকে। বিকেলে, মাঠফেরত কোনো কোনো বন্ধু বিস্ময় নিয়ে বলতো—রশিদ চাচা বেঁচে আছে? এত বড় গোশতের দলা পড়লে কি আর চিকনা কেউ বেঁচে থাকে! সেই চাচি কী এক অমোঘ কারণে আমাকে স্নেহ করেন একটু বেশিই। শহর থেকে গেলে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনী শোনাবে, এটা-ওটা খাওয়াবে, পড়ালেখার খবর নেয়ার সাথে সাথে বলতে ভুলেন না সামনের দিনগুলোই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সো ব্যর্থ হওয়া চলবে না। চাচি বলতে থাকেন—সেদিন সবই ঠিক ছিল। সকালে কী এক কারণে নূরুর মেজাজ চরমে গেলে বেদড়ক পেটায় বউরে। বউ স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করে বলে কিনা—বেডার শক্তি নাই!
চাচি চোখের কোণে তখন ঈষৎ লজ্জ্বা। শক্তি নাই বলে হয়তো কুৎসিত কিছুই বোঝালেন দেবরের অবিবাহিত ছেলেকে! সে অপরাধে তিনি খানিক নীরবই থাকেন। আমিও গুরুতর কেস সামলে নেওয়া পুলিশ কর্তার ঢঙে বলি—সত্যিই বলেছে? সুখু ভাবি এ রকম বললো?
নূরুল আলম আমার জেঠার একমাত্র ছেলে। ছয় মেয়ের পর নূরুভাই জেঠিমার কোলে এসে ধন্য করে আমাদের বংশ। এতদিনের গ্লানি, দাম্পত্য অসন্তুষ্টি কিংবা সমাজেরই লতিয়ে থাকা চোখগুলো মেয়ের মা অপবাদ দিতে দিতে ক্লান্ত হওয়ার আগে নূরু ভায়ের আগমন আমাদের পৈতৃক গৃহে আনে স্বর্গস্বস্তি। জেঠা আমার বাজারের বড় দোকানদার। হাঁটবাজারের বেচাকেনার লোভ ঝেড়ে পুত্রলাভের সুসংবাদে তিনি প্রায় দৌড়ে গাড়ির দূরত্বকে হারিয়ে দিয়ে আসেন ঘরে। রসুইঘরে ঢুকে যাবতীয় লজ্জার বুকে লাথি দেখিয়ে স্ত্রীকে তিনি চুমু খান ধাত্রীর সামনেই! এরপর মসজিদের মুয়াজ্জিনকে ডেকে আহ্লাদি স্বরেই বলে—বড় করে আজান দেন। সবাই শুনুক আমাদের ছেলে হইছে। জেঠার শরীরে তখন হয়তো স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করার মতো, অতীতের গ্লানি ভুলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট যুক্তি। সেই নূরু ভায়ের অপমান তো আমারই অপমান! সুখু ভাবি, তুমি তো অভাবের কথা এ দেবরকেও বলতে পারতা! সামনে না হোক, ফোনকলের গোপনে।
উত্তরাধিকারে পাওয়া মাঝারি দোকানটিকে মেধা আর শ্রমে নূরুভাই করে তোলে বাজারের সেরা দোকানে। মুদি দোকানের যা লাগে, গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন যা দরকার পড়ে, প্রায় সবটাই নূরুভাই দোকানে তোলে। বেচাবিক্রির ভিড় লেগে থাকে হামেশা। হাটবার হলে তো বেদিশা ব্যাপার। সকালে, সূর্য এক বাঁশ উঠলে নূরু ভাই যায় দোকানে, আসে রাতের বয়স যুবক হলে। চার সরকার দিয়ে দোকান চালানো যায়, ক্যাশ তো আর দেওয়া যায় না। বুড়োরা কি এমনে বলে—নারী আর টাকার লোভ যে কারোই নাকে লাগে! জেঠা না শুধু বাপ-চাচারাও উঠেপড়ে লাগে বংশের প্রথম ছেলেকে বিয়ে-থা দিতে। আমারই জেঠিমা প্রস্তাব দেয়—তার ভায়ের মেয়ে সুখুই নূরুর উপযুক্ত পাত্রী। নূরুভাই না বলেনি মায়ের মুখের ওপর, মামাতো বোনকে আগে থেকে জানে বলেই হয়তো। কতবার সুখু আপার সঙ্গে খেলেছি, সাঁতার কেটেছি। অবশ্য বয়সের ফারাক বিস্তর হওয়ার কারণে কিছুটা ভয়ও পেতাম তাকে। সুখু আপা, সুখু ভাবি হয়েই আমাদের ঘরে আসে। বছর শেষ না হতেই আমাদের আরেক দফা খুশির বার্তা দিয়ে যায় সুখু ভাবি। তিনি মা হলেন। ছয় বছরের মাথায় ভাবি চার সন্তানের গর্বিত জননী। আমার যারা বন্ধুস্থানীয়, খুব কাছের—আড্ডায় বেশরম বলে বেড়ায়—ওখানে নাকি আমাদের হাত আছে! কেমনে বুঝাই সুখু ভাবি আর নূরু ভাই খাপের খাপ! বছর বিয়ানোর সুপ্রসন্ন ভাগ্যে ভরপুর তাদের কপাল। বেউপায় হয়ে বলি—ভাই, আমাদের চাচা-জেঠারা প্রত্যেকেই আলাদা ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত এখন। পাতিল যেমন আলাদা, ভাবনাপাতিও ভিন্ন। যাই হোক, নূরু ভাই ব্যবসাদারিতে চতুর, সংসারেও যে হিম্মতয়লা তার প্রমাণ তো ফি বছর পয়দা হওয়া ভাইপো-ভাতিজিতেই দেখতে পায় পার্থিব মানুষগুলো। অন্যদের মতো আমারও কেমন যেন ঈর্ষা হয় সুখু ভাবি-নূরু ভাইকে। শালার, মানিকজোড় আর কাকে বলে!
চাচি বলে, বউটা আসলেই বেদ্দব। মেয়ের বিয়ে দেবে দুদিন পর; প্রতিদিনই কি করা লাগে! এত লাগলে নাট-বল্টু কিছু রাখতে পারো না সাথে! চাচির উত্তেজিত গলার কথাবার্তা শুনে আমি তো পুরাই বেকুব! কী বলে এসব? সুখু ভাবি আমাকে কোনদিন দেবরের চোখে দেখেনি, ছোটভাই হিসেবে স্নেহ করেছে; কই কখনো তো তার কাছে এরূপ কোনো কিছু দেখিনি! কোনোদিন ফোনকলে একটু দুষ্টামি বা ভিডিওকলে দেবরের চেহারা মোবারক দেখবে সে হালত যদি থাকতো, তবে না হয় বুঝতাম—তেনার মনে কিছু চায়। কালের দুষ্টগ্রহের চক্করে কোনো দুর্লক্ষণ সুখু ভাবি না দেখিয়েই এত খেল, কোথায় জমা ছিল, অ্যা?
সুখু ভাবি সত্যি এ রকম বলছে?
কান সাক্ষী।
নূরু ভাই কিছু করেনি?
কী করবে আর? বেড়ামানুষ এরকম কথা শুনলে কি আর ঠাণ্ডা থাকতে পারে? আচ্ছামতো পিটিয়ে বউরে বেহুশ রেখে দোকানে চলে গেছে।
তোমরা বাধা দেবে না? হাজার হোক বউমা তো।
ঝাটার বউ! যে বউ ছেলেরে বেইজ্জতি করে তারে আবার দেখবে তো, ও বউয়ের স্থান হবে জাহান্নামে; স্বামীর সাথে হেডাম দেখায়—বলি, খোদার বিচারও আছে দুনিয়ায়।
বিপদ নিশ্চয় ভারী হয়ে গেছে। এবার আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাবে না। খোঁচা দেবে গোষ্ঠী ধরে। শালা, এতগুলো ভাই—একটা বউ রাখতে পারলি না! আড্ডায় বসলে কি আর ওদের মুখে লাগাম থাকে? তারচেয়ে ভালো দুদিন ঘরবাস করে শহরেই চলে যাব। সামনে আবার এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষা! ইজ্জত যাওয়ার চেয়ে পরীক্ষার বাহনা উত্তম, অন্তত চেনাজানা বন্ধু আর প্রতিবেশিদের বাকা চোখের আক্রমণ থেকে বাঁচতে।
কেমন যেন উতাল-পাতাল লাগে আমার। মানুষ তবে এমনও হতে পারে! বহুবিভায় ধরে রাখে ভেতরকার যন্ত্রণা? কিংবা সুখের অসুখে ভোগার পরেও হাসিমুখে রান্নাবান্না এমনকি সন্তান ধারণের কাজটুকুও করে যায় কত নিপুণভাবে? প্রাকৃতিক নিয়মেই! যার সঙ্গে দাম্পত্য জীবন অনেক দিনের; সুখ-শক্তি যার চেনাজানা; শরীরের গোপন ভাঁজ যার কাছে উন্মুক্ত—কাবিনের অধিকারে। হোক না অসুবিধা-অসুখ—এমনভাবে প্রকাশ্যে কেউ বলে দেয়—এসব কথা! ছিঃ ছিঃ মেয়েমানুষ তবে এমনতর খাদক? কত চাহিদা তার গোপন দরোজায়, কত ভোগ চায় কালে-অকালে!
চাচি বলে যায়—সে তো পাঁচমাস আগের কথা। নতুন খবর হলো—তোমাদের সুখু ভাবির পেট আবারও উঁচু হয়েছে তিনমাসের। কবরের লাহান পেট নিয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে সংসারধর্ম।
কী বলেন?
হুম, আমিও মেয়েমানুষ তো বাবা। পরের মেয়ে সম্পর্কে খারাপ বলার আগে আমিও তো ভাবি, পেটে আমার মেয়ে ধরছে—এছাড়া তুমি তো ছেলে, শরমিন্দা হলেও না বলে উপায় নেই। তুমি বড় হয়েছ, তাই বলছি।
তো, সেবার বাড়িতে আসছি তখন বলেননি কেন?
চেয়েছি গোপন করতে, বাধ্য হয়ে জানালাম আজ।
সুখু ভাবি হয়তো এ কারণেই আমার সামনে আসে না এবার। চা-পানি খেতে ডাকে না। পোলাপাইনদের নিয়ে পড়ার ঘরে বসার তাগিদ আসে না মায়াবি অথচ শাসনের ঢঙে—শুধু বাপ পড়লে তো আর হবে না, পোলাপাইনদেরও পড়াতে হবে—না হয় কি মাস্টার সাহেবের মান থাকবে? ও মাস্টার, অনেক দিন শহরে পরের বাল-বাচ্চা পড়াইছেন, এবার নিজেরগুলোরে নিয়ে বসো—সুখু ভাবি আমাকে মাস্টার বলেই ডাকে। মনের ইতিউতিতে সন্ধ্যায় যাই শৈশবের কাছারিঘরে। আহা, দাদার অন্যান্য সম্পত্তি ভাগ হওয়ার মতো কাছারিঘরও ভাগের খপ্পরে পড়ে এখন নূরু ভাইদের দখলে। কত হাসি-কান্না এই ঘরে। মেহমান এলে প্রথমে বসতেন ও ঘরেই, রাত যাপন করতে হলেও ও ঘরের খাটে আশ্রয় হতো তাদের। লজিং স্যার থাকতেন কাছারি ঘরে। পেট আর পিঠের নিশ্চয়তায় তিনি আমাদের পড়াতেন সন্ধ্যা আর সকালবেলায়। পড়া না পারলে তো বটেই, দুষ্টামির সামান্য লক্ষণ পেলেও রেহাই পেতাম না স্যারের বেত থেকে। না পেটাতেন শুধু সিমু আপুকে। সিমু আপু মানে নূরু ভায়ের ছয় নম্বর বোন মোছাম্মৎ নাছিমা আক্তার সিমু। আপুকে পাশে বসাতেন স্যার। পড়া না পারলে বুঝিয়ে দিতেন শান্তভাবে। আপুর বাড়তি দায়িত্ব ছিল স্যারের মশারি টাঙিয়ে দেওয়া, সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। আশ্চর্য, সিমু আপুর বিয়ের পর স্যার আর ছিলেন না আমাদের এখানে। দূরে কোনো স্কুলে নাকি তার চাকরি হয়েছিল। বাজার থেকে আসা নূরু ভায়ের বড়ছেলে, ক্লাস এইটে পড়ুয়া সাকিব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—মেজাব্বু, দোকানে আব্বু আজ খুব রাগছে, গফুর আঙ্কেলকে (নূরু ভায়ের দোকানের পুরনো সরকার) খুব বকছে। তাকে বিদায় করে দিয়েছে আজ।