কী অদ্ভুত এক অন্ধকারে ঢেকে থাকে মানুষের জীবন। ঈশ্বর শুধুই মানুষের তৈরি একটি শব্দ। যার নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। অস্তিত্ব নেই। মাথার পেছনে দুহাতের আঙুলের বন্ধনে মাথার ভার রেখে, চোখ বন্ধ করে ভাবে মিঠু মাহমুদ।
শ্যামা চৌধুরী যেকোনো মূল্যেই অফিসে নিজের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। নিজের রূপের প্রতিও তার আস্থা কম নয়। সে জানে তার শরীরী সৌন্দর্য দিয়ে সহজেই অনেক কিছু নিজের আয়ত্বে নিতে পারে। এছাড়া কথা বলার সময় বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে একটা স্মার্টনেস দেখানোর ভাব আছে সবসময়। বানিয়ে গল্প সাজানোতে তার তুলনা নেই। অফিসের ভেতর সবসময় একটা অশান্তির লু হাওয়া বইয়ে দিতে তার মতো পারদর্শী পাওয়া কঠিন। সে খুব সাধারণ মাপের একজন অফিসার। কিন্তু তার ভাব তিনিই প্রধান। আগে অফিস চলেছে এভাবেই। আগের প্রজেক্ট ডিরেক্টর থাকতে তার বেশ দাপট ছিল। কিন্তু হুট করে তিনি চাকরি ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাওয়ায়, নতুন প্রজেক্টর ডিরেক্টর হয়ে আসেন মিঠু মাহমুদ। প্রজেক্ট ডিরেক্টর অফিসে সাধারণত পিডি স্যার নামেই পরিচিত। নতুন পিডি স্যারের সাথে শ্যামা চৌধুরী এখন আর নতুন নয়। দেখতে দেখতে বছর পার হয়ে গেছে।
শ্যামা চৌধুরী শুরু থেকেই যেভাবে আগের পিডি স্যারের মতো এই পিডি স্যারকে নিজের আঁচলে বাঁধতে চেয়েছিল, তা হয়ে ওঠেনি। তার রূপের ঝলক আর আহ্লাদিমার্কা কথা কোন কিছুই মুগ্ধ করেনি পিডি স্যারকে। অফিসে আগের মতো সেই দাপট এখন আর নেই শ্যামা চৌধুরীর। সে কারণে পিডি স্যারকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে তার সব ধরনের চেষ্টা সবসময়ই সক্রিয়। নিজের ব্যর্থতায় পিডি স্যারের প্রতি তার ক্ষোভ-রাগ কম নয়। অভিমানও অনেক। ভেতরে ভেতরে পিডি স্যারের নামে দুর্নাম বদনাম রটাতেও তার বাধে না। এতে করে যদি পিডি স্যার তার কোন সাহায্য বা সহযোগিতা চায়। কিন্তু এসব দুর্নাম বদনামও তার গায়ে লাগে না। কোনো কিছুতেই শ্যামা চৌধুরীকে সে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় না। সবার সঙ্গে পিডি স্যার একই রকম আচরণ করেন। যা একদম পছন্দ করে না শ্যামা চৌধুরী। অফিসে পিডি স্যারের কাছে সে সবার থেকে আলাদা হবে, বিশেষভাবে তাকে গুরুত্ব দেবে, এর জন্য সে কতকিছুই না করে। কিন্তু সে কোন কিছুতেই মিঠু মাহমুদের মন গলাতে পারে না।
শ্যামা চৌধুরী অস্থিরচিত্তে নিজের শোবার ঘর থেকে বারান্দায় যায়। গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে শ্যামা। রাতের নগরী হলেও আলোতে রাত যেন ঢেকে থাকে। মাথার ভেতর একই চিন্তা, পিডি স্যারকে কেন সে নিজের মতো করে নিতে পারছে না! পিডি স্যার তার মাথায় এমনভাবে ঢুকেছে, স্বামীর সঙ্গেও দিন-দিন তার সম্পর্ক শীতল হয়ে গেছে। স্বামীর চেহারার জায়গায় পিডি স্যার চেহারা ভাবে। এরকম ভাবনাতেও তার অনেক ভালো লাগে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই পিডি স্যারকে বলতে পারে না সে। এক অদ্ভুত যন্ত্রণা তাকে সারাক্ষণ সূঁচের মতো বিদ্ধ করতে থাকে।
সকালে অফিসে গিয়ে সেজেগুজে ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পিডি স্যারের রুমে ঢোকে। কিন্তু পিডি স্যার তার দিকে না তাকিয়েই একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ ধরিয়ে দিলেন। শ্যামার রাগ হয়। রাগ চেপে খুশি হওয়ার ভাব করে। সে চায়, পিডি স্যার আদর করে বসতে বলবেন, চা খেতে বলবেন। গল্প করবেন। ভালোলাগার একটা সুবাস ছড়াবে। কিন্তু এসবের কোনো বালাই নেই। অত সুন্দর চেহারার একজন পুরুষ মানুষের ব্যবহার যে এত অ-আন্তরিক ও নিরস হতে পারে, তা তার কল্পনাতেও ছিল না। সুন্দরী মেয়ে মানুষ দেখলে তো বস তো বস কত সাধক-সন্যাসী ধ্যান ভেঙে ফেলে, ক্ষমতাধর কতো রাজ-রাজারা সিংহাসন ছুড়ে ফেলে, আর উনি যে কী একখান জিনিস! শ্যামার ধারণা ছিল, তার সাজগোজ একসময় স্যারের চোখে নিশ্চয় ধরবে। কিন্তু সময় যতই গড়ায় স্যার একইরকম। ফলে প্রতিদিনই স্যারের রুম থেকে একগাদা কাজের ফিরিস্তি নিয়ে নিজের রুমে ঢুকেই টেবিলের ওপর কাগজগুলো আছড়ে মেরে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয়।
নাকি বীর্যহীন পুরুষের একটা অবয়বমাত্র! সেধেপড়ে একটা মেয়ে তার কাছে ফুলের মতো খসে পড়তে চাইছে, আর তিনি কী যে ভাবেন! নিজেকে মহাপুরুষ মনে করেন! মহাপুরুষের রক্তেও তো আগুনের ঝাপটা থাকে।
স্বামীকে ফোন করেই ফুটন্ত কড়াইয়ের তেলের মতো বাক্য ছুড়তে থাকে। তাতেও মনের জ্বালা মেটে না। পারলে মোবাইলই ভেঙে ফেলে। ইউটিউবে সানি লিওনের ছবি দেখতে থাকে। মনিটর এমনভাবে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রাখে, কেউ রুমে ঢুকলেও তার চোখ ছবির দিকে পড়বে না। কানে হেডফোন লাগিয়ে নেয়। হঠাৎ স্যারের ডাক পড়লেই মেজাজ খারাপ করে হেডফোন কান থেকে খুলে ঠাস করে টেবিলের ওপর রেখে। জানে, স্যারের ডাকে তো আদর-সোহাগের কোনো বালাই নেই, শুকনো নদীর মতো মুখ করে একগাদা কাজ ধরিয়ে দিয়েই বলবেন, রুমে যান, কাজগুলো দ্রুত শেষ করবেন। মনে মনে স্যারকে কতকগুলো গালি দিয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসে শ্যামা। পিয়নকে ডেকে চা দিতে বলে। পিয়ন চা দিতেই শ্যামা বললো, আচ্ছা আমাদের পিডি স্যারের চরিত্র অনেক খারাপ তাই না!
কী জানি ম্যাডাম।
তুমি তো কিছুই জানো না। তুমি তো তার একনম্বর চামচা। যে কোন কথা শুনেই তো স্যারকে বলে দাও। রাত্রি ম্যাডামের তো ঘরই ভেঙে গেল পিডি স্যারের জন্য। আর এখন নদী ম্যাডামের সাথে যে লীলাখেলা করছে, দেখো কী হয়!
ম্যাডাম আপনি তো সব উল্টাপাল্টা বলতেছেন। রাত্রি ম্যাডামের তো বিয়েই হয়নি। এনগেজমেন্ট হয়েছে। আমাকে তো বলেছে। নদী ম্যাডামের সাথে যে সম্পর্ক স্যারের, আপনার সাথেও তো একই।
আসলে তুমি একটা অন্ধ, বুঝছো। যাও। খালি তর্ক করতে পারো।
পিয়ন রুম থেকে বের হতে হতে আপন মনে বলে, আগের পিডি স্যারের সময় যা দেখাইছেন ম্যাডাম, এখন আর তা হচ্ছে না। এখন তো অফিসে কেউ আপনাকে এক পয়সাও দাম দেয় না। এ জন্য আপনার মাথামুণ্ডু গেছে গা। কিসের ভেতর যে কী কথা কন!
মিঠু মাহমুদ অর্থাৎ পিডি স্যার ইন্টারকমে শ্যামার কাছে জানতে চায়, গতকাল যে ফাইলটা রেডি করার কথা ছিল, সেটা হয়েছে কীনা!
শ্যামা জানায়, স্যার করছি, প্রায় শেষের দিকে।
রেডি করে আমাকে দেখাবেন। বলেই লাইন কেটে দেন মিঠু মাহমুদ।
শ্যামা চৌধুরী ভাবে, আচ্ছা, উনি তো আমাকে ডেকে নিয়ে সুন্দর করে কথাটা বলতে পারতেন। কী এক বুনোর সাথে কাজ করছি রে বাবা! মনের ভেতরে রাগ জ্বলে ওঠে তার, মনে মনে বলে, অর্ডার করলেই হলো! আসল কাজ বোঝার ক্ষমতা নেই, খালি আলতুফালতু কাজ দেওয়ার বেলায় আছে। লোকটার গায়ে বোধহয় টিকটিকির রক্ত।
রুমে বসেই পিয়নকে ডেকে আচ্ছামতো একটা ঝাড়ি দেয় শ্যামা চৌধুরী। বললো, কী করো তুমি? তুমি তো কোনো কাজই করো না। কোথায় থাকো? ডাকলে তো পাওয়াই যায় না। ভালোই চলছে অফিস, যেমন তোমার পিডি স্যার, তেমনি তুমিও। আর সবাই তো চলছে তেলের ওপর। পিডি স্যার তো তেলের ওপর ভাসছে।
পিডি স্যারের কথা বলতেই পিয়ন জানতে চায় স্যার আবার কী করলো ম্যাডাম? এটা আবার জিজ্ঞেস করো, দেখো না দুচোখ শকুনের মতো করে থাকে! আমি তো তোমার অন্য ম্যাডামদের মতো না, বুঝছো। আমার একটা সম্মান আছে। আমার পরিবারের সম্মান আছে। আমি একটা আদর্শ নিয়ে থাকি। আমার টাকা-পয়সা তো কম নেই। আমার হ্যাজবেন্ড একটা বড় চাকরি করে। অনেক টাকা বেতন পায়। বুঝছো! আমি নিয়মিত নামাজ পড়ি। অন্য ম্যাডামদের মতো আমি সস্তা না। এই পিডি স্যার একটা চরিত্রহীন লোক। তার সামনে যেতেই ইচ্ছে করে না। এরকম একটা চরিত্রহীন লোকের সাথে কী কাজ করা যায়! আমার কথা কিছু বুঝতে পারছো? পারলে এখুনি যেয়েই তো বলে দিবা!
পিয়ন কোনো উত্তর না দিয়ে মনে মনে ভাবে, স্যার তো ম্যাডামের দিকে ফিরেও তাকায় না। স্যার কাজের কথা বললেই তো ম্যাডাম জ্বলি ওঠে। স্যারের রুমে যাবার আগে তো মুখে স্নো-পাউডার কত কী মাখে। পিয়ন দুষ্টুমি বুদ্ধি করে মুখ কাচুমাচু করে ভয় ভয় ভাব করে বলে, ম্যাডাম, স্যার কি আপনারে খারাপ কিছু কইছে? আপনি সব সময় স্যারের পেছনে লেগে থাকেন!
পিয়নের কথাটা শ্যামার পছন্দ হয়। পিয়নের কথায় নিজেকে একটু ঠাণ্ডা করে নিয়ে বললো, আরে তোমাকে তো সব কথা বলা যায় না। পিডি স্যার যে আমাকে কতোদিন কতো কথা বলেছে, তুমি তা চিন্তাও করতে পারবা না। আগের কথা বাদ দাও। গতকালের কথা শোনো, তবে এসব কথা আবার বাইরে বলো না। তুমি তো আবার তার এক নম্বর চামচা। তারপর আবার তোমার পেটের চামড়া পাতলা। আমাকে পিডি স্যার গোপনে এক সপ্তাহের জন্য মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে চায়। শুধু উনি আর আমি। ভাবো, লোকটার চরিত্র! মানুষ কতো খারাপ হয়। তার তো আবার অন্য ম্যাডামদের এরকম নিয়ে যাবার অভ্যেস আছে। সবাইকে সে একইরকম ভাবে।
পিয়ন ভাবে, স্যার একথা তাকে কোনদিনই বলেনি। নিজের দাম বাড়ানোর জন্য এসব আমাকে শোনাচ্ছে। পিয়ন বুদ্ধি করে বললো, ম্যাডাম স্যার যেহেতু আপনাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, আপনি যান। গেলেই তো ভালো। আপনার দাম বেড়ে যাবে।
শ্যামা পিয়নের কথা শুনে কোন উত্তর না দিয়ে মনে মনে বলে, স্যার যদি সত্যি সত্যিই আমাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে চাইতো, তাহলে কী আর তোমার মতো ভেড়াকে জানাতাম। হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, শোনো, এসব আবার অফিসে কারো সাথে শেয়ার করো না। রাত্রি আর নদী ম্যাডাম কিন্তু খুব খারাপ। এদের কোনো চরিত্র নেই। পিডি স্যারের সঙ্গে ওদের অন্যরকম সম্পর্ক আছে। আমি সব জানি। এসব ভুলেও কারোর সাথে শেয়ার করো না। তোমাকে আমি অনেক বিশ্বাস করি। যাও। ভালো করে এক কাপ চা দাও।
ইন্টারকমে শ্যামা চৌধুরীর ডাক পড়ে মিঠু মাহমুদের রুমে। শ্যামা দ্রুত ঠোঁটে লিপিস্টিক নেয়, নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়, চুলগুলোতে একটু ফ্যাশন করে। মুখে হাসি মেখে, মিঠু মাহমুদের রুমে ঢোকে। তিনি তখন কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। কম্পিউটারে কাজ করতে করতেই বললেন, ফাইলের কী অবস্থা?
স্যার প্রায় শেষের দিকে, শিগগিরই হয়ে যাবে। বলেই ভাবে, লোকটা কী মানুষ! এত সুন্দর করে সেজেগুঁজে আসলাম। চোখ তুলেও তাকালো না। ঘরে গিয়ে মনে হয় লোকটা বউর দিকেও তাকায় না। ভাবনা শেষ না হতেই মিঠু মাহমুদ বললেন, কাজের প্রতি আপনার কোন আগ্রহ বা দায়িত্ব দুটোর কোনটাই দেখি না।সব সময় আপনার একই কথা, শেষের দিকে স্যার, হয়ে যাবে। এই শেষ আপনার কবে হবে বলুন তো। যান। ফাইলটা তাড়াতাড়ি রেডি করে নিয়ে আসেন।
শ্যামা রুম থেকে রাগে গদগদ করতে নিজের রুমে এসে ঠাস করে চেয়ারে বসে বলে, লোকটা একদম বাজে। অভদ্র! বসতে পর্যন্ত বলে না। আরে আমি তো দেখতে অত অসুন্দর না। বহু রূপসীর থেকে আমি অনেক বেশি রূপসী আছি। আমার দিকে এখনো কতোজন হা করে থাকে। কতোজন এখনো আমার ঘর ভেঙে আমাকে ঘরে নেয়ার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমারও তো স্বামী আছে। সেও তো পুরুষ মানুষ। আমার রূপের কাছে সে তো ভেড়া হয়ে থাকে। আর উনি কী এক স্যার হয়েছেন! পিডি স্যার! পৃথিবীতে আর কেউ যেন পিডি স্যার হননি! মনে হয় উনিই শুধু হয়েছেন! ক্লিনটন যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেও তো লিউনিস্কিকে আদর করতো। আর আমার পিডি স্যার যেন ক্লিনটনের থেকেও বড়! আমাকে তার মনেই ধরে না। আমি কী লিউনিস্কির চেয়ে কম! কোন রূপসী তার মনে ধরেন! তিনি কী মনে করেন, আমাকে মনে ধরবে না, আর আমি তার হুকুমমতো কাজ করবো! বললেই কাজ করে দেব! আমার রূপের রশিতে তাকে বেঁধে ভেড়া না বানানো পর্যন্ত আমিও ছাড়ছি না। অফিসের কাজেরও বারোটা বাজিয়ে, তার বসগিরি ছোটাবো, তারপর যদি ছাড়ি।
বাসায় খুবই মনখারাপ শ্যামা চৌধুরীর। সোফায় বসে আনমনে টিভি দেখতে দেখতে স্বামীকে বললো, আমার শরীর ভালো লাগছে না। তুমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসো।
রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। তার স্বামী তাকে খাবারের কথা বলতেই, বললো, আমার খিদে নেই। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়। শ্যামা চৌধুরীর স্বামী কোন কথা না বাড়িয়ে একা খেয়ে বিছানায় গিয়ে শোয়। ঘরের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বিড়বিড় করে বলে, আস্ত একটা ভেড়া। পিডি স্যার কতো সুন্দর! সারাদিন অতো সুন্দর স্যারকে দেখে, রাতে এই ভেড়ার কাছে কে শুতে চায়! কেমন যেন ঘিনঘিন লাগে শ্যামার। রাত ক্রমেই গাঢ় হতে থাকে, কী ভেবে সব লাইট বন্ধ করে অন্ধকার ড্রয়িং রুমে বসে মনে মনে বলে, পিডি স্যার, আমি আপনাকে সহজে ছাড়বো না। আমার রূপের আঁচলে আপনাকে আমি বাঁধবোই। অঘোষিত পিডি ম্যাডাম হবো আমি। আমি যা বলবো অফিসে তাই হবে। পিডি স্যার থাকবে শুধুই নামকাওয়াস্তে স্যার। সেধেপড়ে ফুলের গন্ধ দিতে চাই, আপনার নাকে এখন ঢুকছে না, সেধেপড়ে পাপড়ি খুলে পূজা দিয়ে নিঃস্ব হতে চাচ্ছি, আপনি না বোঝার ভান করে আছেন। এমন বোঝানো বোঝাবো আপনাকে, তখন বুঝবেন ফুলের গন্ধের ঝাঁঝটা কেমন।
শ্যামা চৌধুরী অফিসে বসে অনেকক্ষণ ফাইলগুলো নাড়তে নাড়ে। একটা একটা পাতা উল্টাতে থাকে। নিপোর্ট তৈরি করার কথা ভাবে। আবার অমনি রেখে দেয়। কম্পিউটারে সালমান শাহ-শাবনূরের সিনেমা দেখতে থাকে। মোবাইল নিয়ে স্বামীকে ফোন করে ঝাড়ি দিতে থাকে। বাসায় তাড়াতাড়ি গিয়ে রান্না করার হুকুম দেয়। আবার হুট করে ভাবে, আচ্ছা, অনেকক্ষণ হয়ে গেল স্যার আমাকে ডাকছেন না কেন? পিয়নকে ডেকে বললো, স্যার রুমে নেই?
পিয়নের ছোট্ট উত্তর, আছেন তো।
শ্যামা চৌধুরী আর কিছু না বলে মনে মনে ভাবে, যতই আপনি আমাকে গুরুত্ব না দেন, এক সময় আপনাকে আমার এই রূপ দিয়েই জখম করবো। তাতেও যদি আপনার হুস না হয়, তাহলে এই রূপের ফণাতেই আপনাকে ছোবল দেব।বিষের জ্বালা বুঝবেন তখন। যদি আপনি পুরুষমানুষ হন, আপনার গায়ে যদি মনুষ্য রক্ত থাকে, আপনার গায়ে আমি আগুন ধরাবোই। শ্যামা ঁেঠাটে গাঢ় করে লিপিস্টিক লাগিয়ে, চুলগুলো ঢেউ করে ছেড়ে দিয়ে, ওড়নার দুই আঁচল চিকন করে বুকের উপর দিয়ে, আয়নার নিজেকে একবার দেখে নেয়, নিজেতে নিজেই মুগ্ধ হয়। আর অস্পষ্ট স্বরে বলে, এতো রূপ, তবুও আপনার চোখে ধরে না পিডি স্যার! শ্যামা রুমে ঢুকতেই স্যার তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বসতে বললো। শ্যামা ভাবে, তাহলে আজ একটু হলেও মনে ধরেছে।
মিঠু মাহমুদ বললো, শ্যামা, রিপোর্টটা সাবমিট না করলে আমরা তো বিলটা সাবমিট করতে পারছি না। একটা রিপোর্ট তৈরি করতে একদিন দুদিন লাগতে পারে, দশদিন পনেরদিন তো লাগতে পারে না। আমি আপনাকে নিয়ে খুবই হতাশ।
শ্যামা চৌধুরী কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। হুট করে মনগড়া উত্তর দেয়, আসলে কিছুদিন ধরে আমার বাসায় ঝামেলা চলছে। মানসিকভাবে আমি ঠিক নেই। আমার হাজবেন্ড তার অফিসের এক মেয়ের সাথে পরকিয়া করছে। দাম্পত্য জীবন বলতে যা বোঝায়, আমার আসলে এখন আর তা নেই। সমাজ দেখানো একটা সংসার করছি আর কী! বিবাহিত হয়েও অবিবাহিতর মতোই জীবন কাটাচ্ছি। একছাদের নিচে ঘুমালেও আমাদের মাঝে হাজার মাইল দূরত্ব। সরি স্যার, ব্যক্তিগত কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না।
পিডি স্যার এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করলো না। কোন আগ্রহও দেখালো না। পিডি স্যারের সামনে নিজের চোখ মুছলো শ্যামা চৌধুরী। চোখের কোণে পানি ছিল কিনা সে নিজেও জানে না। স্যারকে দেখানোই ছিল আসল।
ঠিক আছে আপনি রুমে যান। রিপোর্টটা তৈরি করে ফেলুন।
শ্যামা অনেক খুশি। রুমে গিয়ে মন ভরে এক কাপ চা খান। ফাইলগুলো নাড়েন। কিন্তু রিপোর্টে তার মন বসে না। কম্পিউটারে গান শুনে, নাটক দেখে সময় পার করে। শ্যামা অফিস থেকে বের হয়ে একটু পরেই স্যারকে ফোন দেয়, স্যার আপনি কি অফিস থেকে বের হয়েছেন?
হ্যাঁ, আমি তো পথে।
স্যার, আপনি কোথায়?
গুলশান এক নম্বরে।
স্যার, আমি তো দুই নম্বরে। আমি তো এখানে কোন ট্রান্সপোর্ট পাচ্ছি না। আমাকে আপনার গাড়িতে একটু লিভ দিবেন?
পিডি স্যার একটা কিছু ভেবে বললো, সরি শ্যামা। আমার এখানে একটা জরুরি মিটিং আছে।
ওকে স্যার। আপনি বললে আমি অপেক্ষা করতে পারি। স্যার একটা কথা বলবো?
বলুন।
আমার মনটা আজ অনেক খারাপ। আপনি যদি আমাকে একটু সময় দিতেন। কিছুটা সময় যদি আপনার সাথে কাটাতে পারতাম। হাতিরঝিল তো পাশেই। সারাদিন তো আপনার সঙ্গেই থাকি। এটুকু যদি আপনি আমাকে না বোঝেন, পাশে না থাকেন, কার কাছে যাবো, কার কাছে নিজের কষ্টের কথা বলবো। আপনি অনেক বড় বস হলেও মানুষ তো। একজন ভালো মানুষ আপনি। অফিসের বাইরে আমরা তো ভালো বন্ধুও হতে পারি।
দেখুন শ্যামা, আমি এধরনের আচরণ পছন্দ করি না। অফিসের বাইরে সহকর্মীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক আমি অপছন্দ করি। আপনি ভুল বলছেন এবং ভুল করছেন। রাখছি।
শ্যামা চৌধুরীর মনে হলো নিজেই নিজের গালে কষে একটা চড় মারে। বিন্দুমাত্র ভদ্রতা জানে না লোকটা। একটা সুন্দরী মেয়ের এমন আবেদন যে পুরুষমানুষ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে উপেক্ষা করে, সেকি আসলেই পুরুষ! না কি বীর্যহীন পুরুষের একটা অবয়বমাত্র! সেধেপড়ে একটা মেয়ে তার কাছে ফুলের মতো খসে পড়তে চাইছে, আর তিনি কী যে ভাবেন! নিজেকে মহাপুরুষ মনে করেন! মহাপুরুষের রক্তেও তো আগুনের ঝাপটা থাকে। এ কেমন মহাপুরুষ! মন নেই, আবেগ-কামনা কিছুই নেই। একটা মরাগাঙ যেন মহাপুরুষের ভান ধরে পড়ে আছে।
মিন্টু কয়েকদিন বলেছেও মাসুক তালুকদারকে। কিন্তু তিনি তার কথা কানেই নেন নি। শ্যামা চৌধুরী এমনভাবে মিন্টুকে ধরেছে, সেও প্রায় নিরূপায়। মিন্টু কয়েকবার বলেছে, আপনি কি ব্যাপারে দেখা করবেন, বলেন, আমি স্যারকে বলি।
শ্যামা চৌধুরীর ভাবনা একটাই অফিসের সব কিছু তার কথা মতো চলবে। অফিসের সবাই জানবে শ্যামা ম্যাডাম এখানে যা বলে, তাই হয়। পিডি স্যার শ্যামা ম্যাডামের বাইরে কিছু করতে পারে না। সবাই আমার কাছে ঘুরঘুর করবে, আমাকে তোষামোদ করবে। আড়ালে আবডালে আমাকে নিয়ে ফিসফিস করবে, বলবে, শ্যামা ম্যাডাম তো এখন পিডি ম্যাডাম। সেটা শুনেও আমি শান্তি পাবো। এর জন্য আমাকে যত জলেই নামতে হোক আমি নামবো। আমার সোজা চিন্তা পিডি স্যার এবং পিডি স্যারের ক্ষমতা দুটোই আমার চাই। তা নাহলে এই মহাপুরুষটাকে এক ধাক্কায় আমি এমন এক জায়গায় ফেলে দেব, সেখান থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, কারো সামনে মুখই দেখাতে পারবে না। সমাজের নষ্ট মানুষ হিসেবে তার পরিচয় হবে। তখন বুঝবে শ্যামা চৌধুরীর মূল্য কতটা।
ইদানীং পিডি স্যার না ডাকলেও কোন না কোন অজুহাতে সকালেই সাজগোজ করে তার রুমে যায় শ্যামা চৌধুরী। কিন্তু পিডি স্যার সেই আগের মতোই। কোন পরিবর্তন নেই। শ্যামা চৌধুরী ভেবে পায় না কীভাবে কোন রঙে তার মন ভুলানো যায়! লোকটাকে কীভাবে দখলে নেয়া যায়! আচ্ছা লোকটার বউ কী ডানাকাটা হুরপরী! একদিন দেখা দরকার। তার বউ কেমন হুরপরী! শ্যামা, আবার ভাবে, আমারই বা অতকিছু ভাবার কী দরকার! অফিসের কাজ ঠিকঠাক মতো করে নিজের মতো নিজে থাকলেই তো পারি! পিডি স্যারকে নিয়ে আমিইবা অফিসে এর-ওর কাছে উল্টাপাল্টা বলি কেন! স্যার তো আমার কোন ক্ষতি করেনি। আমি নিজেই তো স্যারের জন্য জ্বলি-পুড়ি। রাতে স্বামীর বুকে শুয়ে পিডি স্যারকে ভাবি। আমার আপাদমস্তক পিডি স্যার, আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে পিডি স্যার। আমি চাই না আর কেউ স্যারের বেশি কাছের হয়ে উঠুক। স্যারের কাছের লোক হয়ে অন্য কেউ বেশি ক্ষমতা খাটাবে, আমি তা কখনোই সহ্য করতে পারবো না। ক্ষমতা আমিই খাটাবো-অন্য কেউ নয়। কিন্তু অদ্ভুত এই লোকটাকে তো বুঝেই উঠতে পারি না। এক দুই করে তো বছরই পার হয়ে গেল; তবুও লোকটা সম্পর্কে তো এখনো অন্ধকারেই আছি। কিসে লোকটা খুশি, কিসে লোকটা অখুশি; তাই তো অনুমান করতে পারলাম না। অফিসের কাজ ছাড়া আর কিছুই তো বোঝে না। অফিসে চাকরি করলেও তো একটু ভালোলাগা, একটু আবেগের প্রকাশ, ব্যক্তিগত দুচারটি কথাবার্তা হয়, দিনে দিনে একটা সম্পর্কও হয়, ঘরের কথা; মনের কথা সবই হয়। ঘনিষ্ঠতাও হয়। কিন্তু কী অদ্ভুত, লোকটা যেন রোবট। অফিসের কাজের বাইরে আর কিছুই যেন নেই তার মস্তিষ্কে। ছুটি নিতেও ইচ্ছে করে না। স্বামী-ঘর-সংসার সব ফেলে পিডি স্যারের কাছে কাছে থাকতেই ভালো লাগে। অমন সুন্দর পিডি স্যারকে দেখে ঘরে কে দামড়ার সাথে ঘুমায়! তারপরও ইচ্ছে করেই অসুস্থতার কথা বলে দুদিনের ছুটি নিলো শ্যামা। আসলে এ তো এশধরণের অভিমান। বিন্তু কে বুঝবে তার এই অভিমান! ছুটির দ্বিতীয় দিনে বেলা এগারটার দিকে স্যারকে ফোন দেয় শ্যামা।
স্যার, আমার একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে।
বলুন কি রিকোয়েস্ট?
আগে বলুন রাখবেন কীনা?
আমি ব্যস্ত আছি যা বলার দ্রুত বলুন।
স্যার আপনি এভাবে কথা বলেন কেন? আমাকে আপনি একচোক্ষেও দেখতে পারেন না।
দেখুন শ্যামা, আমি অনেক ব্যস্ত। আর আপনি তো অসুস্থ।
না, আমি অসুস্থ না। অসুস্থতা বলে ছুটি নিয়েছি।
কী বলছেন এসব! অফিসে এতো কাজ আর আপনি মিথ্যে বলে ছুটি নিয়েছেন! এটা ঠিক করেন নি।
শুনুন, ঠিক-বেঠিক জানি না। আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে, বলেছি। আপনাকে রাখতে হবে। আজ দুপুরে আমার বাসায় আসবেন।
মানে?
মানে কিছুই না। আমি নিজে আপনার জন্য রান্না করছি। আপনাকে তো আমি কোনদিন বাসায় আসার জন্য রিকোয়েস্ট করিনি। এই প্রথম। আশা করি আপনি আমার কথা রাখবেন।
সরি। আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না।
আমি জানতাম আপনি এই কথাই বলবেন। তারপরও আমি চাই আপনি আজ আমার রিকোয়েস্ট ফেলবেন না। আমার হাজবেন্ড বাসাতে নেই। ও সকালে চিটাগং গিয়েছে। বাসাতে আমি একা। আপনি আসুন প্লিজ। আপনার জন্য অনেক সারপ্রাইজ আছে।
আপনার বাসায় আসতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু আমি সত্যিই দুঃখিত, আপনার রিকোয়েস্ট রাখতে পারছি না।
আপনি কখনো গোলাপের ফুটে ওঠা কাছ থেকে দেখেছেন? দেখেন নি। আসুন, আমি নিজে আপনাকে আজ দেখাবো। আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেনই না।
দেখুন, আমি আপনাকে একজন সহকর্মী হিসেবে সম্মান করি। কিন্তু আপনার কথা, আপনার আচরণ, আমার কাছে শোভন মনে হচ্ছে না।। আমি সত্যি দুঃখিত।
স্যার, আমি যা চাই তা পেয়েই ছাড়ি। আর যদি না পাই তা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলি। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকেই আমি আপনার জন্য পাগল হয়ে গেছি। সেদিন থেকেই আমার ঘর ভালো লাগে না, আমার স্বামী ভালো লাগে না। অফিসে যতসময় থাকি, মনে হয় এইতো আমার শান্তি, কারণ এখানে আপনি আছেন। কিন্তু এখানে দোজখও আছে, অন্য কোন মেয়ে আপনার রুমে ঢুকলে আমার সারাশরীর কেউ যেন এসিড ঢেলে দেয়। তখন আমার মনের ভেতর বেপরোয়া ঝড় বয়ে যায়।
শুনুন, অনেক সীমা লঙ্ঘন করেছেন। রাখছি।
শ্যামা চৌধুরী আবার ফোন দেয়। একবার দুবার অনেকবার। মিঠু মাহমুদ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে বললেন, আপনি ভুল করছেন। আপনাকে আমি একজন সহকর্মী ছাড়া আর কিছুই ভাবি না। অফিসের জরুরি কাজ ছাড়া আমাকে ফোন দেবেন না।
শ্যামা চৌধুরী ফোনটা বিছানার এক পাশে ফেলে রাখে। ভাবে, এভাবে নিজেকে সমর্পণ করে ব্যর্থ হয়ে, আগামীকাল অফিসে কীভাবে যাবো! কিভাবে পিডি স্যারের সামনে যাবো! নিজের কাছে নিজের এতবড় অপমান! এতবড় পরাজয়! আমিও ছাড়বো না। কারণ স্যারের ওপরও স্যার আছেন।
অফিসের সিইও মাসুক তালুকদার। বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। তার বাবা আবুল হোসাইন তালুকদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। টাকার জোরে সেসব এখন ঢেকে গেছে। মাসুক তালুকদার নিজেও জানেন না তার অফিসে কতো শত জন চাকরি করেন। তার সাথে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। শ্যামা চৌধুরীও সাধারণ কর্মকর্তার ভেতরেই পড়ে। কিন্তু সে নিজেকে অনেক বড় কর্মকর্তা ভাবে। এর মূলে তার রূপের শক্তি। মাসুক চৌধুরীর ব্যক্তিগত সহকারী মিন্টুর কাছে কয়দিন ধরেই ঘুরছে, তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। মিন্টু কয়েকদিন বলেছেও মাসুক তালুকদারকে। কিন্তু তিনি তার কথা কানেই নেন নি। শ্যামা চৌধুরী এমনভাবে মিন্টুকে ধরেছে, সেও প্রায় নিরূপায়। মিন্টু কয়েকবার বলেছে, আপনি কি ব্যাপারে দেখা করবেন, বলেন, আমি স্যারকে বলি।
শ্যামা চৌধুরী বারবারই একই উত্তর দিয়েছে, ব্যক্তিগত।
বিশেষ কারণে আপনাকে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে আর রাখতে পারছি না। আপনি আগামীকাল সকালেই পদত্যাগ করবেন।
ব্যক্তিগত বললে তো স্যার দেখাই করবেন না। এক ধমক দিয়ে দেবেন। মিন্টু সাফ জানিয়ে দেয়। অফিসের কোন একটা কাজের কথা বলতে হবে, তাও আপনার পিডি স্যারের মাধ্যমে অ্যাপয়মেন্ট নিতে হবে। আপনার স্যার চেষ্টা করলে সম্ভব হতে পারে।
শ্যামা চৌধুরী ভাবে পিডি স্যারকে দিয়ে তো অ্যাপয়মেন্ট করাই যাবে না। উনার বিরুদ্ধেই তো আমি অভিযোগ করবো। পিডি স্যারকে বলা মানেই তো সর্বনাশ। শ্যামা চৌধুরী পরিকল্পিতভাবে মিন্টুর সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে তোলে। হোটেলে খেতে যায়। হাতিলের ঝিলে ঘুরতে যায়। মিন্টুর চোখে রামধনু মেঘ এঁকে দেয়। রাতের আলোতে শ্যামা চৌধুরী হাতির ঝিলের আলোর ঢেউয়ের মতো শরীর বাঁকিয়ে মিন্টুর গা ছুয়ে দেয়। মনমাতানো এক মুগ্ধতা মিন্টুকে পেয়ে বসে।
মিন্টু অনেক চেষ্টায় মাসুক তালুকদারকে তার মন-মেজাজ বুঝে বললো, স্যার, শ্যামা চৌধুরী নামের মেয়েটি তো অনেকদিন ধরে ঘুরছে, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। মেয়েটি দেখতে কিন্তু অনেক সুন্দর। চেহারা-সুরতে অফিসের সেরা মেয়ে। আপনার পছন্দ হবে, স্যার।
আগামীকাল চারটায় আসতে বলো।
মিন্টু শ্যামা চৌধুরীকে বললো, অনেক কষ্টে আপনার জন্য এটুকু করতে পেরেছি।
শ্যামা চৌধুরী মনে মনে ভাবে পিডি স্যার আপনাকে এবার খেলাটা দেখাবো। দেবতাকে এবার শয়তানের তকমা লাগিয়ে দেব।
নিজেকে অনেক সুন্দর করে সাজায় শ্যামা। যেন এতো যত্ন করে আর কোনদিন সে নিজে সাজেনি। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়। আবার ভাবে, না, পিডি স্যারের জন্যও তো মাঝেমধ্যে কম যত্ন করে সাজিনি, উনি তো চোখ তুলে আমার দিকে তাকানই না। আর সিইও স্যার তো এতোবড় স্যার পিডি স্যারের মতো একশ টা স্যার যোগ করলেও তো তার বিন্দুমাত্র হবে না। আমি সেই স্যারের সাথে দেখা করার সুযোগটা যখন পেয়েছি, এমন নাটক করবো, জনাব মিঠু মাহমুদ; প্রিয় পিডি স্যার, হাড়ে হাড়ে তা টের পাবেন।
শ্যামা চৌধুরীর ঢোকার সময়ই মাসুক তালুকদার সূক্ষ্ম পলকে তাকে দেখে নেয়। মনে মনে বলে, মিন্টু ভুল বলেনি। ফাইল দেখতে দেখতেই তিনি বললেন, তুমি পরশু দিন দুটোর সময় ওয়েস্টিনে আসবে। ওখানেই শুনবো। যেতে পারো।
রুম থেকে বেরুতে বেরুতে শ্যামা চৌধুরী ভাবলো, সিইও স্যার তো আমার দিকে তাকালেনই না। পরশু ওয়েস্টিনে যেতে বললেন। ভাবে, ওয়েস্টিনের কথা মিন্টুকে বলা কী ঠিক হবে! ঠোঁটের কোণে এক চিলতে চোরাহাসি ফুটে ওঠে শ্যামা চৌধুরীর। পিডি স্যারের সাথে আমার খেলাটা এবার জমবে।
মাসুক তালুকদারের রুম থেকে বের হয়ে মিন্টুর রুমে ঢোকে শ্যামা চৌধুরী। সে কিছু বলার আগেই মিন্টু বললো, কি ! খুশি তো?
হুম! অনেক খুশি।
কোথায় নিমন্ত্রণ পেলেন, ওয়েস্টিন না সোনারগাঁও? স্যার যদি আপনাকে আরো আগে দেখতেন, নিমন্ত্রণটা আরো আগেই হতো। পরশুর পর থেকে তো ম্যাডাম আপনাকেই আমার মান্য কওে চলতে হবে।
কেন?
কেন, বুঝতে পারছেন না? পরশুর পর থেকে আপনি তো অঘোষিত নতুন সিইও ম্যাডাম হয়ে যাবেন। আপনার চোখ আর আঙ্গুলের ইশারায় তখন এখানে দিনকে রাত আর রাতকে দিন হয়ে যাবে।
শ্যামা চৌধুরী হাসি দিয়ে মনে মনে বললো, আমি সেটি চাই। পিডি স্যারের সব অহংকার আমি এই অফিসের সারা মেঝেতে লুটিয়ে দেব।
মাসুক তালুকদার একটা দুর্দান্ত লাল টকটকে গোলাপফুল শ্যামা চৌধুরীকে দিয়ে বললো, আমার পায়ের কাছে বসো।
শ্যামা চৌধুরী পায়ের কাছে বসতেই তিনি বললেন, ম্লান হাসি আমার পছন্দ নয়। গোলাপের মতো সুঘাণ হাসির আভা ছড়াও। গোলাপের পাপড়িগুলো একটা একটা করে খুলে আমার পায়ে দাও।
শ্যামা চৌধুরী ফুলের পাপড়িগুলো খুলে খুলে মাসুক তালুকদারের পায়ে সাজিয়ে দিতে থাকে। মনে মনে ভাবে, আমিও আপনার জন্য পুরোটা তৈরি হয়েই এসেছি সিইও স্যার। গোলাপের থেকেও বেশি শোভা দিয়ে সৌন্দর্য দিয়ে ঘ্রাণ দিয়ে আপনাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেব। শুধু এর বিনিময়ে আমি চাই মিঠু মাহমুদকে চরম দুর্নাম দিয়ে তাড়াতে, আর আমাকে সবাই অঘোষিতভাবে জানবে অফিসের পিডি ম্যাডাম নয়, সিইও ম্যাডাম। এটা আমি যে কোন মূল্যেই চাই।
মাসুক তালুকদার বললেন, দেখো গোলাপটি এখন নিঃস্ব। যা ছিল সব বিলিয়ে দিয়েছে আমার পায়ে। আর তুমি বিলাবে আমার বুকে, বলেই শ্যামা চৌধুরীকে দুবাহুর টেনে নেয় মাসুক তালুকদার।
মাসুক তালুকদার নিজেই রাতে ফোন করেন মিঠু মাহমুদকে। বললেন, পিডি সাহেব, আপনার প্রতি আমার অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল এবং আছে। কিন্তু বিশেষ কারণে আপনাকে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে আর রাখতে পারছি না। আপনি আগামীকাল সকালেই পদত্যাগ করবেন। নতুন পিডি অ্যাপয়মেন্ট দিয়েছি। বলেই মাসুক তালুকদার মোবাইল রেখে দেন।
কোনো কথাই বলতে পারলো না মিঠু মাহমুদ। মোবাইলটা অমনিই হাতে ধরে থাকে। হাতটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসে। সারা শরীরে যেন অদ্ভুত এক নীলবিষ ছড়িয়ে পড়ে।