এক.
ঘটনাটা আমি একজন ভদ্রমহিলার কাছে শুনেছি।
মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। তার সম্পর্কে আমার অত বিস্তারিত কিছু জানারও সুযোগ হয়নি। তিনি কী করেন, কোথায় থাকেন, সংসারে কে কে আছে, এসব কিছুও না। যিনি আমাকে ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তার সম্পর্কে বেশ ভালো ভালো কথা বললেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্না, বিনয়ী, উদার। শেষে অন্যরা না-শোনার মতো কিছুটা নিচুকণ্ঠে বলেন, মহিলা সম্ভবত আমাদের সবার কাছ থেকে কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছেন। আমার এ কথায় বিশেষ আগ্রহ হয়নি। অন্যের গোপনীয়তায় যেচে উঁকি মেরে কাজ কী!
তার সঙ্গে আমার দেখা হতো মাঝে মাঝে। বিভিন্ন পার্টিতে, বন্ধুদের নিমন্ত্রণে, সামাজিক মিলনকেন্দ্রগুলোয়। আমারা পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাতাম, কুশল বিনিময় করতে করতে করমর্দন করতাম, শেষে পুনরায় দেখা হওয়ার, কথা বলার প্রত্যয় জানিয়ে অন্যদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে যেতাম। দীর্ঘ আলাপ আমাদের ভেতর কী কারণে যেন কখনো হয়ে ওঠেনি।
আচ্ছা আপনি কি সেই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটি জানেন? এমন অতর্কিত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। প্রথম চুমুকের পর আমি কাপটি নামিয়ে রাখলাম
একদিন এক সন্ধ্যাবেলায় আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে অবসর কাটাচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলা হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন। সবার সঙ্গে হাসি মুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। আমাকে সামান্য সময়ের জন্য একপাশে ডেকে নিলেন। ভাবলাম নিশ্চয়ই জরুরি কিছু। গিয়ে দেখলাম, তার চেহারাটি বেশ চিন্তাচ্ছন্ন। আমার সঙ্গে গতানুগতিক সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতা ভেঙে, কোনো ভূমিকা ছাড়াই, আবদারসুলভ ঘনিষ্ঠ গলায় বললেন, আপনার সাথে আমার খুব জরুরি একটা আলাপ আছে। আপনার কি কিছুক্ষণের জন্য সময় হবে?
উম্ম্। খুব কি জরুরি?
হ্যাঁ, খুবই। আমি এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি।
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম এরমধ্যে কোথাও কাউকে সময় দিয়ে রেখেছি কি না।
ঠিক আছে, বলুন। আমার হাতে সময় আছে।
তিনি একটু ইতস্ততা দেখালেন। একটু কেশে নিয়ে, ঠিক আগের মতো গলায় বললেন, চলুন, কোথাও নিরিবিলি বসা যাক। এখানে অনেক হৈচৈ অনেক চেনাজানা।
আচ্ছা হ্যাঁ, চলুন।
আমার একটু একটু কৌতূহল হচ্ছিল। তার কী এমন জরুরি কথা থাকতে পারে আমার সঙ্গে? কোনো বিপদ? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে? আবেগজনিত কিছু নয়তো। তা হওয়ার কথা নয়। আমাকে ঘিরে নারীদের মধ্যে বাড়তি কোনো আবেগ তৈরি হওয়ার ঘটনা আমার জীবনে খুবই কম। নারীদের চোখে প্রেমিকসুলভ ক্যারিশমেটিক কোনো কিছুই আমার মধ্যে নেই।
আমরা একটি রেস্তরাঁয় ঢুকলাম। রেস্তরাঁটি তার বেশ পরিচিত বলে মনে হলো। একপাশের নির্জন একটা টেবিল দেখে বসলাম। মুখোমুখি। আশেপাশে খুব একটা কোলাহল নেই বলে আমাদের দু’জনের নীরবতটাকে একটু কেমন বেখাপ্পা লাগছে। বেয়ারা এসে হুকুম চাইলো। আমরা চা ও কফির কথা বললাম। তারপর আবারও সমান নীরবতা।
অপেক্ষা আমার ভালো লাগছিল না। তবু মনে হলো অপেক্ষা করাই ভালো। যতক্ষণ না তিনি নিজে থেকে কিছু বলেন। আমি বয়সের তুলনায় নিজের চেহারাটাকে বেশি রকমের গম্ভীর করে বসে থাকলাম। চোখে রাখলাম ভাবলেশহীন দৃষ্টি। তৎপর বেয়ারা অল্পক্ষণের মধ্যে আমার চা ও তার কফি নিয়ে এলো। যাক, আমি তবু একটা কাজ পেয়ে গেলাম। দুজনের সামনে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠলো কুণ্ডলী পাকানো টাটকা ধোঁয়ার ঘ্রাণময় মিহি একটা দেয়াল। একটা অন্য রকমের আড়াল।
আচ্ছা আপনি কি সেই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটি জানেন? এমন অতর্কিত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। প্রথম চুমুকের পর আমি কাপটি নামিয়ে রাখলাম।
কোন গল্পটি?
সেই যে রাখাল বালক রোজ মাঠে মাঠে পশু চরাতো। আচমকা একদিন সে বাঘ বাঘ বলে চেঁচাতে লাগলো। গ্রামবাসী ভাবল তাকে নিশ্চয়ই বাঘ আক্রমণ করেছে। দল বেঁধে সবাই রাখাল বালককে বাঁচাতে গেলো। গিয়ে দেখলো বাঘ-টাঘ কিচ্ছু নেই। বালক হোহহো করে মজার হাসি হাসছে। গ্রামবাসী বুঝতে পারলো রাখাল বালক তাদের বোকা বানিয়েছে।
হ্যাঁ জানি। আমি কেন, এটা এমন এক গল্প, যেটা প্রায় সবাই জানে।
এই গল্পের দ্বিতীয় অংশটি নিয়েই মূলত আপনার সাথে আমার আলাপ।
করুন।
ভদ্রমহিলা একটু দম নিলেন। আমিও মনযোগ স্থির করে তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বসলাম। তার চেহারায় আগের সেই চিন্তা কেটে গিয়ে একটা প্রশান্তি খেলা করছে।
একদিন সত্যি সত্যি রাখাল বালকের সামনে হাজির হলো একটা জঙ্গুলে বাঘ। বালক বিপদ আঁচ করতে পেরে চিৎকার শুরু করে। গ্রামবাসী ভাবলো আজও নিশ্চয়ই সে সবাইকে বোকা বানাতে চেষ্টা করছে। বালক প্রাণপণে বাঘ বাঘ, বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেই গেলো, কিন্ত কেউই সেদিন তার সাহায্যে এগিয়ে এলো না। শেষপর্যন্ত বাঘ এক থাবায় তার প্রাণ নিয়ে নিলো।
হ্যাঁ, সব তো ঠিকই আছে।
না ঠিক নেই। কিছুই ঠিক নেই। গল্পের এই অংশটি একদম সত্য নয়। বালকটিকে কোনো দিনই বাঘ আক্রমণ করেনি। বালকের মৃত্যু হয়নি। এটা মিথ্যা। সত্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
কী বলছেন আপনি!
সে দিব্যি বেঁচে আছে।
বেঁচে আছে!
হ্যাঁ। আমি সব রকম খোঁজ-খবর নিয়েই বলছি। আমরা বছরের পর বছর ধরে মিথ্যা জেনে এসেছি। আমার কী ধারণা জানেন? গল্পটিতে বলা হয়েছে গ্রামবাসী রাখাল বালকের কাছে প্রায়ই বোকা বনতো। আসলে গ্রামবাসী নয়, এই গল্পে মূলত বোকা বানানো হয়েছে আমাদের। আমরা যারা এই গল্পকে নির্দোষ মনে বিশ্বাস করে নিজেদের পৃথিবীর অনেক কিছুকে এর আদলে গড়ে নিয়েছি, তাদের।
আমি প্রায় লা-জওয়াব হয়ে বসে থাকলাম। মনে হলো কোনো কথা বলার শক্তিই আর আমার নেই। আমরা কেউই আর একবারের জন্যও কাপ তুললাম না। ভদ্রমহিলার কপালে কুচি কুচি ঘামের কণা ভেসে উঠলো। আমার ভেতরে আচমকা শুরু হয়ে গেলো নাম না-জানা এক অদ্ভুত অস্থিরতা। আমি একবার মহিলার দিকে, একবার দেয়ালে, একবার টেবিলের বৃত্তাকৃতির লাল লাল নকশাগুলোর দিকে তাকাচ্ছি।
সেই রাখাল বালকের নাম ঠিকানা সব আমি জোগাড় করে রেখেছি। আপনাকেই প্রথম এ ঘটনা জানালাম। ব্যাপারটা নিরঙ্কুশ গোপনীয়তার দাবি রাখে। আমি চাই, আপনি এই ঠিকানা অনুযায়ী পুরো ব্যাপারটাকে একবার যাচাই-বাচাই করে আসবেন। তারপর আমরা সার্থক কিছু একটা করার কথা ভাববো। নইলে যেকোনো সময় বড় রকমের একটা বিপদ ঘটে যেতে পারে। এটা বেশি দিন চাপা থাকবে বলেও আমার মনে হয় না।
বলতে বলতে তিনি তার হাত ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো বের করে বাড়িয়ে দিলেন। আমি সেটা হাতে নিলাম। ভাঁজ খুলে মেলে ধরলাম। ছোট অক্ষরে একজনের নাম ও ঠিকানা লেখা। জায়গাটা আমার জানামতে এখান থেকে অনেক অনেক দূরে। কাগজটি হাত থেকে নামিয়ে টেবিলের ওপর রাখলাম। মনে হলো কাগজটির সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতর থেকে মূল্যবান অনেক কিছুও যেন আমি নিজের অজান্তে টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।
আপনি কি ঘটনাটার গুরুত্ব আঁচ করতে পেরেছেন?
আমি এবারও কোনো কথা বললাম না। কেবল হালকা করে মাথা ঝাঁকালাম।
তাহলে আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসুন। নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া আমরা দ্বিতীয় কিছু এখন ভাবতেও পারব না।
প্রথম কথাটিতে তার গলায় খেলে গেলো একইসঙ্গে অনুনয়, অনুরোধ এবং আরও কিছু একটা, যা ঠিক তরজমা যোগ্য নয়।
যাব, আমি অবশ্যই যাব। এই সত্য উদঘাটন করা আর কারও জন্য না হোক, অন্তত আমার নিজের জন্য হলেও ভিষণ জরুরি। আমি যাব এবং শিগগিরিই।
আমার কথা শেষ হতেই তিনি এই প্রথম বারের মতো হাসলেন। তার চোখ দুটোও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। টেবিলের ওপর দুই হাত পেতে আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এলেন। প্রত্যয় মেশানো নিচুকণ্ঠে বললেন,
আমি সবসময় ভিড়ের ভিতর থেকে সঠিক মানুষটিকে বেছে নিতে জানি।
দুই.
টানা তিন দিন দুই রাতের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, সে ঠিকানা অনুযায়ী আমি যে জনপদে এসে পৌঁছলাম, সেটা না পাহাড়ি, না সমতল। বরং বলা চলে এ দুটোর মাঝামাঝি। আমি ভালো করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম।
আমাদের কথপোকথন অন্যরাও কান পেতে শুনছেন। আমি এই সুযোগে সবাইকে শোনানোর উদ্দেশে একটু খোলা গলায়, ঘটনাটা বলতে শুরু করলাম। ঠিক আমরা যেভাবে এতদিন ঘটনাটা জানতাম, সেভাবে। সবাই আমাকে খুব মনযোগ দিলেন
লোকবসতি খুবই ছাড়া ছাড়া। যে দিকেই চোখ দিলাম, চোখ ল্যান্স গেলো বাধাহীন দূর দিগন্তের দিকে। চরাচরে শস্যের সাজসাজ রব। বাতাস মাতালদের মতো এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে আরও ওদিকে, ঘুরে ঘুরে আবার এদিকে, ইচ্ছে মতো দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। চোখ-মোলায়েম সবুজ গাছের পাতারা সে বাতাসের সঙ্গে হেলে-দুলে গান গাচ্ছে, খসখসে গলায়। নিমিষেই আমার মন তরতাজা হয়ে গেল। শরীর থেকে লা-পাত্তা হয়ে গেল দীর্ঘ পথের ক্লান্তি। আকাশে তখন সদ্যসমাপ্ত সকালের চকচকে রোদ।
স্থানীয়দের কয়েকজনের সঙ্গে যেচে গিয়ে সাক্ষাৎ এবং আলাপ করলাম। তাদের প্রত্যেকের চোখেমুখে আমার প্রতি দেখলাম এক ধরনের অভ্যর্থনা এবং প্রশ্রয়। আমাকে তারা আপ্যায়ন এবং সাহায্য করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলেন। তাদের আপ্যায়নে আমি স্থানীয় কিছু মিষ্টান্ন খেলাম। খেলাম হিম শীতল ঠাণ্ডা পানি। এরপর সেই রাখাল বালকের গল্পটি তাদের শুনালাম। তারা অনেক বছর আগেকার কোনো স্মৃতি মনে করার মতো করে জানালেন, এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বাঘ কখনোই আসেনি, বালাককে মেরে ফেলেনি। সে বেশ বেঁচে আছে। অবশ্য এখন আর সে রাখাল বালকটি নেই। পেশা পরিবর্তন করে হয়ে গেছে খেয়াঘাটের মাঝি। তার বয়স এখন পড়তি যৌবনের দিকে।
আমার আর দেরি সহ্য হচ্ছিল না। কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানিয়ে, তাদের কাছ থেকে খেয়াঘাটের পথটি জেনে নিয়ে, আমি পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম। মনের ভেতর আমার কিছুটা উত্তেজনা কিছুটা রোমাঞ্চ আবার কিছুটা বিমর্ষতা সমানতালে কাজ করতে লাগলো।
মনে মনে পরিকল্পনা এঁটে নিলাম, যে করেই হোক সেদিনের সে রাখাল বালক, আজকের পড়ন্ত যুবা মাঝির কাছ থেকে সত্য উদঘাটনের পর, যেকোন কিছুর মূল্যেই হোক, তাকে সঙ্গে নিয়েই আমি ফিরে যাব। দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দেব, সত্যের ভেতর মিশে থাকা মিথ্যাকে কী করে আলাদা করতে হয়।
ঘাটে পা দিয়ে দেখলাম কোথাও কোনো জনমনিষ্যি নেই। কেবল একটা মাঝারি আকারের নৌকায় একজন মানুষ নিরিবিলি বসে আছেন। নদীটিকে দেখাচ্ছে ভিষণ প্রমত্তা, যৌবনবতী। এপার থেকে ওপারের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে রোদ আর জলের মাখামাখিতে এক নিরবিচ্ছিন্ন কুয়াশার ধূ-ধূ।
নৌকার কাছে গিয়ে ভদ্র-সম্ভাষণযোগে আমি তার নাম জানতে চাইলাম। তিনি সে নামটি বললেন, যেটা আমি শুনতে চেয়েছি। আমিও আমার নাম বললাম। কোথা থেকে এসেছি এবং কী কাজে এসেছি, সংক্ষেপে তাকে জানিয়ে দিলাম। তিনি উঠে এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আন্তরিক গলায় জানালেন, আপাতত আমার সঙ্গে কথা বলার মতো সময় তার হাতে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে তার যাত্রীরা চলে আসবে। তাকে এখন নৌকা প্রস্তুত করার কাজে হাত দিতে হবে। আমি তাকে হাতছাড়া করতে চাইলাম না। প্রস্তাব করলাম, তার যাত্রীদের সঙ্গে আমিও নৌকায় চড়ে ওই পারে যাব। যেতে যেতে আমরা আলাপটা সেরে নিতে পারব। তিনি গালভর্তি হাসি দিয়ে, আমাকে একটি আসন দেখিয়ে বসতে বললেন।
খুব একটা দেরি হলো না। যাত্রীরা যেন মাটি ফুড়ে উঠে এলেন। ছোট্ট দুই-এক কথায় মাঝির সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে করতে বসে পড়লেন। তার যাত্রীরা সাকুল্যে চারজন। তিনজন নারী একজন পুরুষ। পুরুষ মানুষটি একজন বর্ষীয়ান অন্ধ। বয়স তার চেহারাকে কুচিকুচি করে ভাঁজ করে রেখেছেন। তিনি, কুঁজো হয়ে, ফ্যাকাসে দৃষ্টি মেলে পা গুটিয়ে বসে আছেন। হাতে একটা সাদা ছড়ি। তিনজন নারীর মধ্যে যিনি একদম ডানপাশে, তিনি আগাগোড়া নিজেকে বোরখায় ঢেকে রেখেছেন। চোখজোড়া ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সোনালি রঙের বোরখা চারপাশে বেশ উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। মাঝখানে বসেছেন যিনি, তাকে বলা চলে উঠতি তরুণী। তার সাজসজ্জা দারুণ উগ্র। চোখে লীলাময়ী ইঙ্গিতের দৃষ্টি। সম্ভবত তিনি একজন দেহ-পশারিণী। তার বাম পাশে বসেছেন ভরা স্বাস্থ্যের একজন মধ্যবয়স্কা। নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং সম্ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণের একটা চেষ্টা আছে তার পোশাক ও চহনিতে। কোলের ওপর একটি পশমী হাতব্যাগ। সে ব্যাগের ওপর মেলে ধরেছেন একটা মোটা বই। নিবিষ্ট গাম্ভীর্যে বইয়ে মনযোগ দিয়ে রেখেছেন।
আমি ভাবছি কিভাবে তাদের সবার সামনে ব্যাপারটা বর্ণনা করব। তারা কি ঠিকঠাক আমাকে বুঝতে পারবেন? কোনো কিছু গোপন করবেন না তো! নৌকা ঘাট ছেড়ে নদীর দিকে হালকা দুলুনীতে, একটু একটু করে এগুচ্ছে। আমি মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
তুমি কে হে? নিশ্চয়ই কোনো ভিনদেশি আগন্তুক?
আমি তরুণীর দিকে স্পষ্ট চোখে তাকালাম। সহজ গলায় উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি একজন আগন্তুক।
আমাদের এখানে কী করতে এসেছ? কোনো জোচ্চুরির মতলব নেই তো?
না, না। আমি কোনো জোচ্চোর নই। আমি একজন ছোটখাটো মাপের সত্য-উপাসক। অন্তত আমার দুনিয়ায় লোকে আমাকে তাই জানে। আপনাদের এখানে এসেছি দীর্ঘদিনের একটি প্রচলিত সত্যকে কাছ থেকে জানার জন্য।
না হলেই ভালো। তা কী এমন ব্যাপার আছে, আমাদের এখানে জানার মতন?
আমাদের কথপোকথন অন্যরাও কান পেতে শুনছেন। আমি এই সুযোগে সবাইকে শোনানোর উদ্দেশে একটু খোলা গলায়, ঘটনাটা বলতে শুরু করলাম। ঠিক আমরা যেভাবে এতদিন ঘটনাটা জানতাম, সেভাবে। সবাই আমাকে খুব মনযোগ দিলেন। মাঝি, বৃদ্ধ, বোরখা, তরুণী ও সম্ভ্রান্ত।
বাড়তি কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে, তাড়াহুড়ো না করে, আমি ধীরস্থির দমে গল্পটা শেষ করলাম। কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপ করে থাকলেন। আমিও অপেক্ষা করলাম। প্রথম প্রতিবাদ এলো বৃদ্ধের কাছ থেকে। সেটা অনেকটা অবজ্ঞা মেশানো গলায়।
কিন্তু এ তো পুরোপুরি সত্য নয়। ওকে তো কোনো বাঘ মারেনি কখনো।
জি, আমি ঠিক সেটাই পরখ করতে এসেছি। সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে ও কী করে একটার সঙ্গে অন্যটা মিশে গেলো, সেটাও।
সম্ভ্রান্ত আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন।
আপনি কে এই সত্য-মিথ্যা যাচাই করার?
যথাযথ বিনয় রক্ষা করে আমি বললাম, সত্য-মিথ্যার যাচাই নিশ্চয়ই যে কেউই করার অধিকার রাখে। আমি হয়তো ঠিক যোগ্য নই, তবু আপনাদের সাহায্য পেলে আশা করি উতরে যেতে পারব।
আমার কথায় তিনি কিছুটা পশমিত হলেন। আমিও হালকা বোধ করলাম এবং তরুণীকে জানতে চেষ্টা করলাম।
এ সম্পর্কে আপনি কেমন কী জানেন?
আমিও এ রকমই জানি। অবশ্য তখনো আমার জন্ম হয়নি। ছোট বেলায় আমি শুনেছি বড়রা বলাবলি করতে, যদি একদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসতো, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই যেতাম না। তখন ওর বিপদ হতো। এটুকুই জানি। ও হ্যাঁ, আমার এক সময়কার একজন বাঁধা প্রেমিক, তোমার মতো করে আমাকে ঘটনাটা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এ থেকে শিক্ষা নিতে। আমি ঘটনাটা অত গুরুত্বের সাথে নেইনি। কোনো শিক্ষাও নেইনি।
বোরখা পরিহিতাকে জিজ্ঞাসা করতে যাব, এমন সময় মাঝি মুখ খুললেন। আপনার কি আমার কাছে কিছু জানার আছে?
হ্যাঁ। সবচে’ ভালো করে সবকিছু তো আপনিই বলতে পারবেন। এককাজ করুন, দয়া করে আপনি আপনার শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে, পুরো ঘটনাটা শুরু থেকে শেষপর্যন্ত একবার বলুন। তাতে আমি পুরোপুরি পরিষ্কার হতে পারব।
যেন এ অনুরোধটির জন্য তিনি এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন। কোনো বাড়তি আলাপে না গিয়ে সোজা চলে গেলেন শৈশবে। তার কথা বলার ধরনটি ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো, নিরবচ্ছিন্ন এবং গতিময়। তিনি কথাগুলো আমার কিংবা অন্য কোনো শ্রোতার উদ্দেশে বলছেন, শুনতে ঠিক সে রকম শোনাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, বলছেন কেবল, নিজেকে শোনাতেই। আমি তবু তন্ময় হয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। প্রত্যেকটা দম, শব্দ, বাক্য; বাক্যের আড়ালের বাক্যটিও।
তার কথা শেষ হলে আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করলাম। তিনি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন। তারপর, আমি আর কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। নৌকাজুড়ে নেমে এলো অর্থহীন এক মৌনতা। কারও মুখে কোনো কথা নেই। কেবল একটানা বৈঠায় ছলাৎ-ছলাৎ জল ভাঙার আওয়াজ। আর বাতাসের হুড়োহুড়ি।
একটা ঘটনার শেষে, মানুষ যে ধরনের কণ্ঠে সে ঘটনার সিদ্ধান্ত টানে, আমি সে রকম কণ্ঠে বললাম, আমার যতটুকু জানার দরকার ছিল, আমি জেনে নিয়েছি। আপাতত আমার কাজ শেষ। এখন আমার জন্য আপনাকে একটু কষ্ট সহ্য করতে হবে। ঠিক আমার জন্যও নয়, আমাদের জন্য। আমরা যারা এতকাল ধরে সত্যের ভেতর একটা মিথ্যাকে বয়ে বেড়িয়েছি। আমার সঙ্গে আপনি আমাদের দুনিয়ায় যাবেন। সবার সামনে, প্রকাশ্যে সত্যের বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন এবং আমাদের উদ্ধার করবেন। আমিই আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব।
সেটা যে আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
জি, কেন?
মাঝি উত্তর দেওয়ার আগে বৃদ্ধ হোহহো করে হেসে উঠলেন।
সত্য আর মিথ্যার সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক দেখছি একদমই অপরিপক্ব। যা সত্য, তা তোমাদের কাছে মিথ্যার সঙ্গে মিশে হাজির হয়। আর মিথ্যাকে তোমরা ঘষতে ঘষতে সত্যের মতো ধারালো বানিয় ফেলো। তোমরা তো ভাই বড়ই মজার লোক।
এমন সময় বোরখা পরিহিতা তার মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। আমার বিমূঢ় চোখ জোড়ায় চোখ রাখলেন। বললেন, আমি সবসময় ভিড়ের ভেতর থেকে সঠিক মানুষটিকে বেছে নিতে জানি
তাকে কোনো উত্তর না দিয়ে আমি আবার মাঝির দিকে মনযোগ দিলাম। সম্ভবত আমার চোখের জিজ্ঞাসা তিনি ধরতে পেরেছেন।
সম্ভব নয়, কারণ আপনি নিজেই এই নদীর ওপর থেকে আর কোনদিন ফিরে যেতে পারবেন না।
আমাকে কি ভয় দেখাচ্ছেন?
না।
না? তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? আপনি আমার সাথে আমাদের দুনিয়ায় যেতে আগ্রহী নন?
আপনি নিজেই আর ফিরতে পারছেন না।
মানে?
আপনি সত্য উপাসক, এসেছেন সত্য-মিথ্যার পরখ করতে। অথচ সত্যের নিয়মটিই আপনার দেখছি জানা নেই। এতদিন আপনারা যা জেনে এসেছেন, তা সত্যই ছিল। কিন্তু যেই আপনি সত্যকে খণ্ডখণ্ড করে পরখ করে দেখতে নেমেছেন এবং তা থেকে মিথ্যাটুকু আলাদা করে সত্যের সঠিক রূপ জেনে গেছেন, এখন আপনার আর আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
না, না। আমি ফিরতে চাই। যেকোনো কিছুর মূল্যে আমি আমার দুনিয়ায় ফিরে যেতে চাই।
দুঃখিত। বিধির বিধান নড়াবে এমন সাধ্য কার।
যাত্রীদের সবাইকে এক পলকের জন্য দেখে নিলাম। সবার চোখে-মুখে মাঝির বক্তব্যের নীরব প্রতিচ্ছায়া। এক নিঃসীম আতঙ্ক জোয়ারের ফেঁপে ওঠা জলের মতো আস্তে আস্তে আমার পা থেকে ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। মাথা হয়ে গেলো প্রায় চিন্তাশূন্য। কেবল এটুকু বুঝতে পারলাম, মাঝি সম্ভবত ঠিকই বলছেন।
কিন্তু অবিমৃশ্যকারী মন তা বুঝতে চাইছে না। কোনো না কোনো সুযোগ যদি হাতড়ে পাওয়া যায়। ভেতরে ভেতরে আমার মন ছটফট শুরু করলো। সব কিছুর পরও আশা দেখতে চাইলো।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কথা দিচ্ছি। আমি সব ভুলে যাব। এই সম্পর্কে কোথাও কিচ্ছু বলব না। বরং লোকে ঠিক যেভাবে জানে, সেভাবেই প্রচার করব। তবু আমাকে যেতে দিন। অন্তত একবারের জন্য হলেও আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ফিরে যেতে চাই।
অনর্থক ছেলে মানুষি করছেন।
আপনারা আমার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি এমনটা চাইনি। এ ভার নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি কেবল একজন কৌতূহলী।
কেউ আর আমার কথায় একবিন্দুও কর্ণপাত করছেন না।
আচ্ছা ভালো কথা, বলুন তো আপনারা কি জানতেন কেউ একজন আসবে, এ বিষয়ে খোঁজ নিতে? আর আমার আগে কি কেউ এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
দুটো প্রশ্নের উত্তরই কি হ্যাঁ?
এসব জেনে এখন আর কোনো কাজ নেই।
না না, অবশ্যই কাজ আছে। সত্যের নিয়ম যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে যিনি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, তিনি তো ওখানে দিব্যি আছেন? তিনিই আমাকে আপনার নাম-ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়েছেন।
মাঝি নিশ্চুপ। অন্যরাও কোনো রা করছেন না। আমার উচ্চকিত কণ্ঠের আওয়াজ নদীর ওপর মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় বোরখা পরিহিতা তার মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। আমার বিমূঢ় চোখ জোড়ায় চোখ রাখলেন। বললেন, আমি সবসময় ভিড়ের ভেতর থেকে সঠিক মানুষটিকে বেছে নিতে জানি।