ক.
টুস্ টাস্ টুস্ টুস্ শব্দটা এই মাত্র বন্ধ হলো। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক কতগুলো কাগজ ইউসূফের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইউসুফ ভাই এই কাজগুলো একটু তাড়াতাড়ি সারতে হবে। ম্যাডাম চলে গেলে সমস্যায় পড়বো যে।’
লোকটার দিকে একনজর তাকিয়ে স্মিত একটা হাসি ছুড়লো ইউসূফ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিছুটা লম্বাটে ও ফর্সা শরীরের লোকটার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিনয় মিশিয়ে কাগজগুলো হাতে নিলো এবং বললো,‘ভাইজান শরীরটা ভালো ঠেকছে না। ভাবছি চলে যাবো। এসেই যেহেতু পড়ছেন আপনার কাজটা শেষ করেই যাই।’
অনেকটা করুণার দৃষ্টিতেই ইউসূফের দিকে এক নজর তাকালেন ভদ্রলোক। সঙ্গত কারণেই মৃদু একটা হাসি ছেড়ে বললেন,‘আচ্ছা ঠিক আছে ভাই, শরীর খারাপ লাগলে দরকার নাই। আমি বরং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কম্পিউটারের দোকানে দিয়ে দেই। যেগুলো কম জরুরি সেগুলো রেখে যাই।’ কথার ফাঁকে কাগজের বান্ডেল খুলে কিছু কাগজপত্র সরিয়ে নিলেন তিনি। অবশিষ্ট কাগজগুলো তুলে দিলেন ইউসূফের হাতে। ‘এগুলো দু’দিন পরে দিলেও সমস্যা নাই। তত জরুরি না। যখন শরীর ভালো লাগবে, করে রাখবেন।’ তারপর দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলেন।
কোর্ট বারান্দার এই ফাঁকা জায়গায় নীরবে টাইপ-মেশিনের কি-বোর্ডের বাটনে হাত চালানো ইউসূফের নিত্য-রুটিন। নিজের শরীরের মতো জরাজীর্ণ এই স্থানটি তার অনেক দিনের পরিচিত। কবে এবং কিভাবে এই কাজে আসছে তা এখন আর স্পষ্ট মনে নেই। যেটুক মনে পড়ে,, ‘অজ্ঞাত কারণে তার চাকরিটা চলে যাওয়ার পর যখন হতাশায় ভুগছিলো তখন প্রয়াত স্ত্রী রাহেলা নিজের শখের গহনা বিক্রি করে স্বামীর বেকারত্ব ঘোচাতে টাইপ মেশিনটা কিনে দিয়েছিলো। তখন তো দেশজুড়ে ওপটিমা রাইটারের কী সমাদর!
প্রযুক্তির পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় মানুষ কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ নানা রকম যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। সেই সাথে টাইপমেশিনের প্রয়োজনীয়তাও রীতিমতো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একসময় কোর্ট আঙিনায় যে কতো কতো টাইপিস্ট ছিলো! পেটের দায়ে সবাই এখন বিকল্প কাজে জড়িয়ে পড়েছে। ইউসূফের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এককালে তো টাইপ মেশিনের টুস্ টাস্ টুস্ টুস্টুস টুস টুস্ কলোরোলে মুখরিত ছিলো পুরো কোর্টপ্রাঙ্গণ। আজকাল তা কল্পনায় আনা দুষ্কর! বর্তমানে কোর্টবারান্দায় একমাত্র ইউসূফই হচ্ছে ওপটিমা টাইপিস্ট। অবশ্য কাজ জোগাতেও তত কাটখড় পোহাতে হয় না তাকে। ইউসূফ এখানকার পুরোনো টাইপিস্ট। আধুনিক যান্ত্রিকযুগেও সর্ম্পকের খাতিরে লোকজন অনেকটা করুণার বশেই তাকে কাজ দেয়। শুধু যে করুণা তা বললেও ভুল হবে। ইউসূফই পুরনো ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। বিজ্ঞ হাকিমগণের অনেক দুবোর্ধ্য রায়ের নকল টাইপে সে বেশ পটু, এ ক্ষেত্রে অনেকটা বিশ্বস্তও বটে। আটচল্লি¬শোর্ধ্ব এই টাইপিস্টের চশমার ফাঁকে এমন সব দুর্ববোধ্য শব্দ ধরা পড়ে, যা অন্যদের বেলায় ভীষণ অসাধ্য।
শীর্ণদেহি টাইপ মেশিনটাই তার একমাত্র সঙ্গী, সম্বলও। ইদানিং মেশিনের উঁচু-নিচু র্বোডে হাত রাখতে মন টলে না তার। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে মেশিনের কি-বোর্ডের এলোমেলো বাটনগুলোতে লুকিয়ে আছে পর্তবপ্রমাণ বিষণ্নতা। বস্তুত, সকালে বড় ভাবির বলা অনাকাঙি্ক্ষত কথাগুলোই তার ভেতরে হতশার চাক বেঁধে রেখেছে। নাড়া দিচ্ছে মুহুর্মুহু। বিশ্বাসই হচ্ছে না কিভাবে এই কথাগুলো মুখে আনলেন ভাবি! ভাবি এত বদলে গেলেন! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এই ভাবিই একদিন অনাথ ইউসূফের মাথার ওপর মাতৃছায়ারূপে দাঁড়িয়েছিলেন।
গোমড়ামুখী হয়ে গেলো আলোকৌজ্জ্বল রাত্রি। সরল ও বিশস্ত প্রকৃতি বিশ্বাস ঘাতকতা করলো একটি পবিত্র সম্পর্কের সাথে। সব হিসেব এক লহমায় ওলোট-পালোট হয়ে গেলো!’
সেই ভাবি আজ কিভাবে বললেন, ‘রাহেলা, রাহেলা করে তো জীবনটাই শেষ করেছিস্। কী পেয়েছিস বিনিময়ে! আমি বুঝি না একজন মরা মানুষকে নিয়ে এতো দরদ কীসের। যার জন্যে এতো দরদ সে কী আর কোনোদিন ফিরবে? বাঁচতে হলে তো কতো কিছুই সহ্য করতে হয়। কতো বার বললাম, রাহেলা নাই তাতে কী হয়েছে। আরেটা বিয়ে কর, নিজের দিকে একটু নজর দে। কার কথা কে শোনে। আরে স্ত্রী-সন্তান না থাকলে বুড়ো বয়সে দেখভাল করবে কে? আমাদেরও তো বয়স হয়েছে। কতোদিনই বা টিকবো। সংসারের দিকে খেয়াল করতে করতে কয় দিকে নজর রাখতে পারি। বুড়ো হলে তখন কে তোরে দেখবে। তোর নাম নিয়ে কাঁদার জন্যে তো একজন মানুষও থাকবে না দুনিয়ায়। কত মানুষের বউই তো মরে, তাই বলে কি এমন বৈরাগী সাজতে হয়। একটা ভালো জামা কাপড়ও কি পড়তে মন চায় না? ভালো কোন কাজকর্ম করারও কি সাধ হয় না?’
ভাবির কথার শেল যেন ইউসূফের বুকে এসে বিঁধলো। সব কিছু ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। একবার মনে হলো ভাবিতো ঠিকই বলছেন, বৃদ্ধ বয়সে আমাকে কে দেখবে। আমারতো কোনো উত্তরসূরি নাই। ভাই-ভাবির কৃপায়ই তো বেঁচে আছি। সত্যিই তো আমি মরলে কাঁদার মানুষও নাই। তারাই-বা কতো দিন আমার বোঝা টানবে। তাদের এখন বয়স হয়েছে, সংসার, সন্তান-সন্তুতি, নাতি-পুতি এসেছে। সবকিছু সামলানোর পর আমাকে নিয়ে বাড়তি ঝামেলাই বা কতেদিন করবে।
ইউসূফ জানে, কথাগুলো মন থেকে বলেননি ভাবি। ইউসূফের দুদর্শার কথা চিন্তা করেই এতকিছু বলেছেন তিনি। ছোটকাল থেকে ভাবিইতো তাকে সন্তানের মতো আঁচলের তলে রেখেছে। কোনোদিন বাঁকা চোখে তাকাননি। পৃথিবীতে কে কার জন্যে এত করে।
খ.
কেন যেন আজ মনে হচ্ছে রাহেলার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে না করাটা তার উচিত হয়নি। রাহেলা তো তাকে কোনো শর্ত-টর্তও দেয়নি যে বিয়ে-শাদী করতে পারবে না। বেখেয়ালেই চিন্তায় ডুবে গেলো ইউসূফ,‘আচ্ছা রাহেলা না মরে যদি আমি মরতাম তাহলে রাহেলা কি দ্বিতীয় বিয়ে করতো! নাকি সেও আমার মতো একা থেকে যেতো আমৃত্যু।’ কথাটা ভাবতে ভাবতে কখন যে তার হাত দুটি টাইপমেশিনের কি-বোর্ডে গিয়ে ঠেকলো সেদিকে খেয়ালই পড়েনি। আচমকা স্বগোতৌক্তির ছাড়লো, ‘না। না। আমি কোনো ভুল করিনি।’
ইউসূফের চোখের সামনে ভেসে ওঠলো আঠাশ বছরের পুরনো সেই স্মৃতিময় দিনগুলো আর রাহেলার সাথে চুটিয়ে প্রেম করার দুর্লভ মুহূর্তগুলির ছবি। লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি আদান-প্রদান, আড়ালে আবডালে উকিঝুঁকি মারার সোনাঝরা দিনগুলো। বালখিল্যতায় ঠাসা স্মৃতিঘন দিনগুলো কি চাইলেই ভোলা যায়?,ইত্যাকার ভাবনার মধ্যেই শুশুকের মতো হঠাৎ স্মৃতির জলে ঘাই তুলে ওঠলো আঠাশবছরের পুরোনো দৃশ্যপট,,‘এক হেমন্তের জ্যোৎস্নায় বাবা-মার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে না করে ইউসূফের হাত ধরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে রাহেলা। বনজঙ্গলের বিষধর সাপখোপ, জীবজন্তুর ভয়ডর উপেক্ষা করেই পরস্পর হাত ধরে পালিয়ে ছিলো সেদিন। শত চড়া-ই-উৎরাই পেরিয়ে, কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে যখন নাড়াই বিলের কাছে এসে তারা থামলো তখন আকাশ চুইয়ে ইলশেগুঁড়ির মতো বেরিয়ে আসা থোকা থোকা জ্যোৎস্নার তরলে ছেয়ে গেছিল সমগ্র পৃথিবী, পায়ের নিচে নিঃশব্দে লুকিয়ে ছিলো শিশিরসিক্ত উজ্জ্বল বিচালি। চলারপথে কতবার যে ফসলশূন্য জমির আলের ওপর আর ঢেলামাটির স্তূপের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়েছে! তারপরও একমুহূর্তের জন্যে কেউ কারও হাত ছাড়েনি। অগ্রহায়ণের মৃদুশীতল আর জ্যোৎস্নাসফেদ রাত্রিতে কোনো প্রকার যানবাহনের সাহায্য ছাড়াই পায়ে হেঁটে ভোর হওয়ার আগে আগে তারা গন্তব্যে পৌঁছেছে। সে দিন ভবিষ্যতের ভার ইউসূফের হাতে তুলে দিয়ে সবার অগোচরে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিল রাহেলা। সে অপরাধে জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও বাপের বাড়িতে ঠাই হয়নি তার। সেবার বড় ভাইয়ের ঘোর আপত্তি থাকার পরও ভাবির বদান্যতায় এ বাড়িতেই তাদের বাসর হয়।’
নানান কল্পনার চাতুরিতে মন শান্ত করতে গিয়েও কুলিয়ে ওঠতে পারছে না ইউসূফ। বার বার হু হু করে বেড়ে ওঠছে ২৮ বছরের স্মৃতিময় আগুন। পৃথিবীতে এতো মানুষ বাঁচতে পারে, অথচ রাহেলার মতো একজন সুন্দর মনের মানুষের কেন যে স্থান হলো না!, তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। ইদানিং ধর্মকর্মের বালাইও ইউসূফকে স্পর্শ করে না। সবসময় একটাই ভাবনা, সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক চেয়েছি, বিনিময় পেয়েছি কী।
যেই রাতে রাহেলা প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছিলো সেই ভয়াল রাত্রিতে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে কতোবার যে হাত তুলে কেঁদেছিলো। রাহেলার সুস্থ্যতা কামনা করে মানত পযর্ন্ত করেছিলো। সৃষ্টিকর্তা কানেও মাখেননি।
অগত্যা ইউসূফের চোখ ভাসিয়ে দিলো বিভীষিকাময় এক রাতের প্রতিচিত্র, একবার গভীর রাতে রাহেলা হঠাৎ ঘুমে থেকে চিৎকার দিয়ে ওঠে ইউসূফের কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে শুরু করলো। রোরুদ্যমান অবস্থায় ইউসূফকে উদ্দেশে বলে উঠলো, ‘ইউসূফ আমাকে মাফ করে দিও। আমার বোধ হয় সময় শেষ। আমি জানি, আমার বাবা মা আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তাদের মনে আঘাত দেয়ার বিচার আমার হবেই। দয়া করে আমার হয়ে তুমি একটু ক্ষমা চেয়ে নিও। পৃথিবীতে তো তুমিই ছিলে আমার একমাত্র আশ্রয়, ভরসা।’ তার চিৎকারধ্বনিতে বাড়ির সবাই জেগে ওঠে।
অবস্থা বেগতিক দেখে রাতেই রাহেলাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালীন যানবাহন আর যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা তাদের সুখের বাসরে ঢুকিয়ে দিলো বিভেদের সাপ। ধনুবাঁকা ডাকাতিয়ার দুর্দান্ত ব্রীজটিও তখন ছিলো না। নৌকোই ছিলো নদী পার হওয়ার একমাত্র বাহন, উপায়।
বাইরে বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাত্রি। অনেক খোঁজাখুজির পরে একজন মাঝির পাত্তা মিললো। সে রাতে খরস্রোতা ডাকাতিয়াই ছিলো তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ। প্রতিকূল স্রোতের ক্ষুদ্ধ জালে আবদ্ধ হয়ে নৌকা চলছিলো মন্থর গতিতে। রাহেলার চিৎকার সহ্য করতে না পেরে মাঝির সঙ্গে ইউসূফও বৈঠার আঘাত বসাতে আরম্ভ করলো ডাকাতিয়ার বুকে।
সময়টি ছিলো কোজাগরী জ্যোৎস্নার। জ্যোৎস্নার রূপালি আলোয় প্লাবিত ছিলো পৃথিবী। ব্যূহবেঁধে আসা বাতাসের পর্দা ছিড়ে উইপোকার মতো নদীর পানিতের লাফিয়ে পড়ছিলো মাতাল জ্যোৎস্নার ফুলকি।
রাতের নিস্তব্ধতায় বৈঠাজলের শব্দ আর রাহেলার চিৎকারধ্বনি ছাড়া ডাকাতিয়ার বুকে আর কোনো পিনপতনের শব্দ ছিলো না। বিদীর্ণ রাত্রিতে ডাকাতিয়ার বুকে কয়েকটি মানবপ্রাণীর আকুতি দেখে দুলে ওঠেছিলো বিরহকাতর জারুলের ডিঙি।
ধীরে ধীরে বৈঠার আওয়াজ বাড়তে লাগলো সেই সাথে কমতে থাকলো রাহেলার আয়ুরেখা। বেপরোয়া জ্যোৎস্নার শুভ্রতা আর বৈঠার বাড়ির শব্দকে পাশ কাটিয়ে মাঝনদীতেই উড়ে গেলো রাহেলার প্রাণবলাকা। শীতল হয়ে গেলো চিরচঞ্চল একটি দেহ। ধবধবে জ্যোৎস্নার আকাশ যেন কিছুক্ষণের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। গোমড়ামুখী হয়ে গেলো আলোকৌজ্জ্বল রাত্রি। সরল ও বিশস্ত প্রকৃতি বিশ্বাস ঘাতকতা করলো একটি পবিত্র সম্পর্কের সাথে। সব হিসেব এক লহমায় ওলোট-পালোট হয়ে গেলো!’
আঠাশবছরের ফেলে আসা স্মৃতির ধকল সহ্য করা আজ বড় দায় হয়ে পড়েছে ইউসুফের। হয়তো সে কারণেই সে ভাবলো, রাহেলার স্মৃতিবিজড়িত এই টাইপ মেশিনখানি সবসময় চোখের সামনে থাকলে পুরনো স্মৃতিগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে।
না। আর নয়। আজ থেকে অন্য কাজ খুঁজে নেবে সে। অন্য ভাবে বাঁচার পথ খুঁজে বের করতে হবেই। স্মৃতির পক্ষাঘাত থেকে মুক্তি পেতে আজই টাইপের কাজ থেকে অবসর নেবে ইউসূফ!
গ.
সারাদিন স্মৃতির নদীতে সাঁত্রিয়ে মেশিনপত্র গুটিয়ে যখন বাড়িতে পা ফেললো তখন সন্ধের আকাশ রক্তাক্ত, কিছুটা বিষণ্ন। মলিন মুখখানির দিকে একনজর তাকিয়ে সকালে তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে ভেবে বড় ভাবি আর কথা বাড়ানোর সাহস পাননি। ভাবির ধারণা, ইউসূফ এখনো রেগে আছে।
মুনীরের আবিষ্কৃত ওপটিমা মেশিনটা টেবিলের ওপর রেখে নরম বিছানায় পিঠ রাখলো ইউসূফ। অলক্ষ্যেই একবার চোখ পড়লো মেশিনের দিকে। ক্ষুদ্রজীবনের অসংখ্য খণ্ডস্মৃতি তার বুকে এসে চেপে বসলো। নিজের কাছে তার কত জিজ্ঞাসা! কিছু মানুষের জন্যে জীবনটা কতো ক্ষুদ্র আর কিছু মানুষের জন্যে জীবনটা কতো বড়!
এবারও ডাকগুলো ইউসূফের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। ইউসূফ রাগ করেনি। মাতৃরূপী এই ভাবির সাথে রাগ করে সে এতক্ষণ থাকতে পারতো না। তাকে ওঠতেই হতো।
আজ হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়লো তার। মায়ের চেহারাটা ঠিক মনে নেই, ঝাপসা ঝাপসা লাগে। মনে আছে, মা তাকে কতো আদর করতেন! শাসনও কম করেনি। শাসনের মাঝেও ছিলো ভালোবাসার ছাপ। শুধু কি তাই! বাবা তাকে আসকারা দিতে দিতে তুলেছিলেন মাথায়। চলাফেরার নিয়মনীতির তারতম্য না দেখে মা যখন বকাঝকা করতেন বাবা তখন তার পক্ষ নিয়ে বলতেন,‘দেখবা, আমার এই ছেলে একসময় অনেক বড় হবে। সে এমন কিছু করবে যা কেউ কল্পনাও করবে না। দেখো না সব ক্লাসেই সবার ওপরে সে, এমনকি প্রতিযোগিতার বেলায়ও। মনে নেই, যে বছর আমাদের ইউসূফ জন্মেছে সেবার আমাদের উত্তুরের বিলে কত্তোগুলি ধান হয়েছে? সেই খুশিতে পুরোগ্রাম দাওয়াত করে খাইয়েছি। সেবারই তো চৌধুরীদের দখলের বন্ধকী আবাদী জমিগুলো ছাড়াতে পারলাম।’
বাবার কথা সত্যি হয়নি। হতে পারতো। ইউসূফ ছাত্র ও প্রতিযোগী হিসেবে কখোনোই খারাপ ছিলো না। যৌবনে কতো উদ্দাম আর প্রাণচঞ্চলই না ছিলো সে! ভাবতে অবাক লাগে, সেই দিনগুলো আজ কোথায়! তার সমসময়িক বন্ধুরা, তার চেয়ে নিম্নমানের মেধাবীরাও এখনো দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক মাঠে প্রতিষ্ঠিত। ক্ষণিকের জন্যে ফেলে আসা অনেক অন্তরঙ্গ বন্ধুর স্মৃতির উল্কি তার মাথায় জেঁকে বসলো। জীবনে তার কতো পুরস্কার জুটেছিলো! অথচ রাহেলার মতো শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জুটেও হাত ছাড়া হয়ে গেলো। তারপর তো সবই স্মৃতি।
অতীতের অনেক কথা এখন অগ্নিপিণ্ড হয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। একসময় পরম বিক্রমে এলাকা চষে বেড়ানো সে ইউসূফের আজ কি বেহাল দশাই না হলো! বার বার বিছানার এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুম আসছে না। বাইরে দল বেঁধে নামছে অন্ধকার। সেদিকে তার কোনো কৌতূহল নেই। শত চেষ্টা করেও টাইপরাইটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না ইউসূফ। বেখেয়ালে মেশিনটির দিকেই চলে যায় তার চোখজোড়া।
একবার ভাবলো, না। কাল থেকে মেশনিটা আবার চালাবো। রাহেলাই তো জীবনের সবকিছু। শুধু শুধু অভিমান করে রাহেলার মনে কষ্ট বাড়ানোর দরকার কি? তাছাড়া এই মেশিনটির বদৌলতেই তো এতোদিন বেঁচে আছি।
আসলে কী যে করা উচিত মনোস্থির করতে পারলো না ইউসূফ।
বেঘোরেই মনে হলো, দোষত্রুটি না থাকলেও আমি তো রাহেলাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু তার পরিবারের কেউ আদৌ কি ক্ষমা করেছে? নাকি বিত্তবৈভবের অহমিকা এখনো কাটেনি তাদের? মেশিনটার দিকে পুনরায় চোখ পড়ায় নিজেকে কিঞ্চৎ ধিক্কার দিলো, ‘ছি! রাহেলার হাতে কেনা টাইপ মেশিনের ওপর অভিমান করেছি আমি!
গ্রীষ্মের অগ্নিঢালা সন্ধ্যা। ঘুরন্ত ফ্যানের বাতাসে উড়ছে কাপড়-চোপর, পুরনো পত্রিকার কাগজ। এর মধ্যেই শরীরটা কেমন হিম হয়ে আসছে ইউসূফের। ফ্যানের বাতাসের এতো শীতলতা জীবনে কখনো অনুভব করেনি সে।
ভারাক্রান্ত মনে মেশিনটির দিকে আরেকবার চোখ রাখলো ইউসূফ। অবিশ্বাস্য ঘটনা! এ সময় সে দেখতে পেলো মেশিনের ভেতর থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে রাহেলা। এসেই পদ্মের পাপড়ির মতো কোমল দু’টি হাত রাখলো ইউসূফের বুকের ওপর। রাহেলার হাতের অকৃত্রিম স্পর্শ তাকে অদ্ভুত আনন্দ দিতে লাগলো। আস্তে আস্তে হাতের ওজনটা ভারি হতে থাকলো। রাহেলার হাতের ওজনটা আজ কত ভারী! এই ভারী হাতের ওজন সইতে না পেরেই শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ইউসূফ।
ঘ.
উদ্ভট একটা শব্দে মাঝরাতে ঘুম কেটে গেলো ভাবির। নজর গেলো ইউসূফের ঘরে। রুমের বাতিটা তখনও জ্বলছে। সারাদিন কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকায় ইউসূফকে যে খাবার দেয়া হয়নি একথা হঠাৎই মনে পড়লো তার। ইউসূফ নিজেও তো কোনো খাবার চায়নি। আহ বেচারা!
তাড়াহুড়ো করে ইউসূফের ঘরে ঢুকলো ভাবি। তখন বিছানায় শান্তু হয়ে ঘুমিয়ে আছে ইউসূফ। ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে মনে হলো, সেই কতোকাল আগে এই বাড়ির বউ সেজে এসে প্রথম যে ছোট্টখোকা ইউসূফটিকে দেখেছে সে অবিকল যেন সেই ইউসূফটিই গুটিসুটি হয়ে পড়ে আছে বিছানার এক কোণে। নিজে নিজেই প্যাঁচাল পিঠলো ভাবি, ‘আরে ভাই আমার সারাদিন কিছু মুখে তুলেনি। সকালে না হয় রাগের মাথায় একটু বেশিই বকেছি। তাতে কি এতো রাগ করতে হয়।, ‘এই ইউসূফ, ওঠ ভাই, ভাত খাবি। ওঠ।’
ইউসূফের কোনো সাড়া শব্দ নেই। এভাবে আরো কয়েক বার ডাকা হলো। তাতেও কাজ হলো না। হাত ধরে টেনে ওঠানোর চেষ্টা করলেন,‘ওঠ ভাই। সকালে এমন বকাবকি করা ঠিক হয় নাই। ওঠ খেয়ে নে।’
এবারও ডাকগুলো ইউসূফের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। ইউসূফ রাগ করেনি। মাতৃরূপী এই ভাবির সাথে রাগ করে সে এতক্ষণ থাকতে পারতো না। তাকে ওঠতেই হতো।
ইউসূফের পাথর-ঠাণ্ডা শরীরে হাত রেখে প্রকম্পিত ভাবি! এসময় তার জল ছল ছল চোখজোড়া পড়লো টেবিলের ওপর পরম অযত্নে পরে থাকা নির্বাক টাইপ মেশিনটির দিকে। ওই নির্বাক টাইপ-মেশিনটিই আজ থেকে এ বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলবে, স্মৃতি হয়ে থাকবে!