এক.
‘মাগুর মাছের আড়াইলের’ মতো রাস্তায় গর্তের শেষ নেই। মুড়ি ভর্তার মতো মানুষগুলোকে ভর্তা বানাচ্ছে বাসটি। কখনো মৃদু কখনো তীব্র ঝাঁকুনি। ইঞ্জিনের শব্দ না ঝাঁকুনির শব্দ তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ‘হর্ন ছাড়া গাড়িটির সবকিছুই বাজে’—বাসটিতে না উঠলে এই কথার সত্যতা বোঝা যেতো না। চৈত্রের খা খা রোদ্দুর, ভ্যাপসা গরম, জরাজীর্ণ মানুষের ঠাসাঠাসি, বাসটির রঙবাজি সবকিছু মিলিয়ে অতিষ্ঠ। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস আসে বটে তবে ভিড় বিঁধিয়ে আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ঘাম আর গরমে স্যান্ডউইচ হয়ে গেছি।
অনেক বছর পর গ্রামে যাচ্ছি। দশ বছর কিংবা আরও কিছু বেশি হতে পারে। এই দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত কিভাবে হয়ে গেলো, তাই মাঝে মাঝে ভাবছি। জীবনের পরতে পরতে তলিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো মনের অজান্তেই মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে মজাবিলের কাদা থেকে ভেসে ওঠা বুদ্বুদের মতো। আর এগুলো লাল-নীল-বেগুনি নানা রঙের প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে মনের আকাশে। হারিয়ে যাওয়া অতীত। সেই সব অতীত কোনোটা উজ্জ্বল, কোনোটা রাহুগ্রস্ত চাঁদের মতো ক্ষয়ে যাওয়া, কোনোটা বাঁশির শেষ সুরের রেশের মতো বুকের ভেতরে পূরবীর সুর তোলে। আজ পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া মানুষের শৈশবের দুরন্তপনার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ছে যাদের সঙ্গে আমার জীবন মিশেছিল একাত্ম হয়ে এককালে। কখনো হাস্যরসপূর্ণ অতীতের কথা মনে হতেই হাসি পায়। একাই মৃদু হাসছি। আমার সিটের পাশের লোকটি আমাকে মাঝে মাঝে দেখছে আর অন্য কোনো সিট খালি হচ্ছে কি না, লক্ষ করছে। তার ধারণা আমি পাগল। তাই পাগলের কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো। পাগল মানুষের কোনো ক্ষতি না করলেও পাগলকে মানুষে ভয় পায়। ঘটনাটি আমার বোধের মধ্যে এলে আমিও তার সঙ্গে একটু মজা করার জন্য ভাব নিলাম। যা করছিলাম অসাবধানতায় তা এখন সচেতনভাবেই করছি আর লোকটিকে আড়চোখে দেখছি।
কিছুদূর গিয়ে বাসটি একটা স্টপে থামলে আমার পাশের লোকটি সামনের একটা খালি সিট দখল করলো। সে লোকটি সেখানে গিয়েই তার পাশের লোকটির কানে কানে ফিসফিস করে বললো, ‘লোকটি পাগল, একা একা ঝিম ধরে থাকে আর মাঝে মাঝে হাসে।’ আমি লক্ষ করলাম, সেই লোকটিও আমার দিকে সকৌতুকে তাকালো কয়েকবার। একসময় মনে হলো তার সঙ্গেও একটু রসিকতা করা যাক। অপেক্ষায় রইলাম আমার দিকে কখন তাকায়। কিছুক্ষণ পর যখন সে লোকটি আমার দিকে তাকালো তখন আমি চোখ বড় বড় করে এদিক-সেদিক ঘুরালাম। মনে হলো লোকটি ভয় পেলো। এরপর দীর্ঘক্ষণ তাকে আর আমার দিকে তাকাতে দেখিনি।
এক প্রকার মায়ার্দ্রতায় আমি হঠাৎ সিক্ত হয়ে উঠলাম। মনে হলো জলের ধারা নেমে এসেছে আমার দুই চোখের গভীর কোটরে। মনে হলো পঁয়ত্রিশ বছর আগের এমন এক দুপুরের কথা।
বাসে যাত্রী আছে, মফিজও আছে। তিলধারণের ঠাঁই নেই। মনে মনে বললাম, ‘তিল ঠাঁই নাহিরে’। রবীন্দ্রনাথ কী একশ বছর আগে এই ধরনের বাসের কল্পনা করতে পেরেছিলেন না কি, আকাশের মেঘ দেখেই বলেছিলেন—কে জানে? মানুষের ঘামের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ, তারপর হেল্পার কন্ডাক্টরের চেঁচামেচি। মফিজদের ভাড়া কম দেওয়ার খ্যাচরখ্যাচর ইত্যাদি নানা যন্ত্রণার কসরত সীমা লঙ্ঘন করে চলছে।
গাড়ির গতিবেগ সঠিক হলে নিমতলী বাসস্ট্যান্ডে যেতে দুই ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু চার ঘণ্টা পরে বাসটি ঝনঝন শব্দ করে থামল নিমতলী বাসস্ট্যান্ডে। জায়গাটা আমার এক কালে খুব পরিচিত থাকলেও এখন বড় অচেনা হয়ে গেছে। সবকিছুর এত দ্রুত বদলানোতে স্মৃতি ধরে রাখা যায় না।
বাস থেকে নেমে যৌবনপ্রাপ্ত একটা মেহেগনিগাছের নিচে দাঁড়ালাম। গাছটি বেশ তরতাজা। পাতারা দুই রকম সবুজ দেখাচ্ছে ভারী বাতাসের সৌজন্যে।
হাতের ব্যাগটি কাঁধের ওপর রেখে মেহগনিগাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। এখানে দাঁড়িয়ে দিগন্ত লাগোয়া প্রসারিত মাঠের যে উত্তাল প্লাবনের সবুজ রূপ দেখা যেতো, এখন আর তা দেখা যাচ্ছে না। ধানি জমি গ্রাস করে গড়ে উঠেছে মানুষের আবাসিক ঘরবাড়ি। চরের বালিতে সেই পুরনো বেপরোয়া ব্রহ্মপুত্র চাপা পড়েছে একটা খালের মতো দাগ রেখে। জরাজীর্ণ নদীর এই নিদারুণ শ্রীহীন রূপ দেখে মনে মনে বললাম, ‘হায়রে ব্রহ্মপুত্র তর মা-বাপের অভিশাপ লেগেছে কিনা? তর বুকে কেন জলহীন চর?’ পরক্ষণেই মনে হলো নদীর মতো আমিও আজ এখানে অচেনা।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বেভোলার মতো দূরে, অনেক দূরে। নাগরিক খাঁচায় আটকে থাকা পাখি মুক্ত আঙিনায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই ভালো লাগছে। চৈত্রের রৌদ্রসেদ্ধ বাতাসেও শান্তি। এভাবে বিমর্ষ ও বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন হারিয়ে যাওয়া আমাকে খুঁজছিলাম এই বিপন্ন আঙিনায়, তখন একটি মেয়ের কান্নার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি এক যুবতী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং তার পাশে কয়েকজন নারী নিঃশব্দে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। যুবতীর চারপাশের মানুষের চোখে-মুখে অসহনীয় বিমূঢ়তা। তাদের পাশে ধূতি পরা একজন পুরুষ একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখে-মুখেও উৎকণ্ঠা। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে ওরা সনাতন ধর্মাবলম্বী। এক রিকশাওয়ালা কাছের লোকটিকে জিগ্যেস করল, ‘মেয়েকে ওপাড়ে পাটায়া দিতাছেন দাদা?’ লোকটি ওপর-নিচ মাথা নেড়ে রিকশাওয়ালার প্রশ্নের সদগতি করলো। মুখে কোনো কথা বললো না। রিকশাওয়ালার কথা ও পাশের লোকটির মাথা নাড়ানো দেখে আমার বুকের ভেতরে ভাঙনের শব্দ হলো। মানুষের কান্না দেখলে আমার সাধারণত হাসি পায়। কিন্তু আজ হলো বিপরীত। অন্তরাত্মায় একটা ঝাঁকুনি লাগলো বড় ধরনের। বুকটা ভারী লাগতে শুরু করলো। এক প্রকার মায়ার্দ্রতায় আমি হঠাৎ সিক্ত হয়ে উঠলাম। মনে হলো জলের ধারা নেমে এসেছে আমার দুই চোখের গভীর কোটরে। মনে হলো পঁয়ত্রিশ বছর আগের এমন এক দুপুরের কথা।
দুই.
সেই আর কদিনের কথা! তখন আমার বয়স কত হবে, নয়-দশ বছর। এক ভরা বাদলের দিনে পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে অনিতাদিদের বাড়ি থেকে জাম্বুরা চুরি করতে গিয়েছিলাম বল খেলার জন্য। এই কাজটি আমি প্রায়ই করতাম। বৃষ্টি নামলেই জাম্বুরা চুরি…দিনভর বৃষ্টিতে ভিজে খেলা। খেলতে খেলতে একসময় কাদার সচল মূর্তি। এই আনন্দ ছিল ঢেউয়ের বুকে খেয়াপাতার নৌকা। সেদিন অনিতাদি গাছের পাশেই বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করছিল। তাকে আমি দেখিনি। একটা জাম্বুরা ছিঁড়ে হাতে নিতেই অনিতাদি খপ করে আমার হাতে ধরে ফেললো। মনে হলো প্লায়ার দিয়ে হাত চেপে ধরলো। আমি অনিতাদির দিকে তাকাতেই দিদি হেসে দিলো। এবার হাত ছেড়ে কানে ধরলো। বললো, ‘তুইই তাহলে প্রতিদিন জাম্বুরা নিয়ে যাস, না?’ চুরি করা পাপ, তারচেয়ে বড় পাপ মিথ্যা বলা। তাই আমি মিথ্যা না বলে বললাম, ‘হা। আমি বৃষ্টি নামলেই জাম্বুরা চুরি করি।’ আমার কথায় অনিতাদি রাগ না করে হেসে দিলো। কেন হাসলো বুঝতে পারলাম না। এবার কানটা আরও জোরে টেনে ধরে বললো, ‘আয়, বাবার কাছে নিয়ে যাই তোকে। তুই বড় চোর হয়ে গেছিস।’ আমি বললাম, ‘ওনার কাছে নেবে কেন? তুমি যা পারো শাস্তি দাও।’
অনিতাদি হেসে দিলো। বললো, ‘বল, আর চুরি করবি না, তাহলে ছেড়ে দেব।’
বললাম, ‘আর চুরি করবো না।’
অনিতাদি আমার কান ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অপমানটা কম নয়। প্রায়শ্চিত্ত করার আর কী পথ! তবে ঘটনাটি যদি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে আরও মরা। যদি আব্বা আম্মা জানতে পারে, তাহলে ক-বেলা উপোস রাখে, তাও ভাবছি। তাই এই ঘটনা কাউকে যেন না বলে সে জন্য তাকে অনুরোধ করার একটু সুযোগ খুঁজতে গিয়েই তার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মানসিক অবস্থা বুঝেই হয়তো অনিতাদি বললো, ‘চাল ভাজা খাবি?’
ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি অনিতাদি জানালার পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের মতোই গম্ভীর, বাকহীন। আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম।
অনিতাদির বাবার সঙ্গে আমার বাবার খুব সখ্য ছিল। তাদের বাড়ির সঙ্গেও আমাদের বাড়ির একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে বলেই হয়তো দিদি আমাকে সহজ করার জন্য কথাটি বললো। বৃষ্টির দিন চাল ভাজার কথা শুনে জিভে জল এসে গেলো। আমি তার দিকে নিরুত্তাপ চোখ তুলে তাকাতেই অনিতাদি বললো, ‘বাড়ি থেকে কাপড় বদলিয়ে ছাতা নিয়ে শুকনো কাপড় পরে আয়। আমি চাল আর কাঁঠালবিচি ভাজতে যাই।’
বৃষ্টির মধ্যেই কাপড় বদলিয়ে ছাতা নিয়ে অনিতাদির বাড়িতে এলাম। কিছুক্ষণ পরেই অনিতাদি চাল, কাঁঠাল বিচি আর মিষ্টিকুমড়োর বিচি ভেজে ডালায় নিয়ে তার রুমে ঢুকলো। দুজনে পাশাপাশি বসে খেলাম আর গল্প শুরু করলাম। অনিতাদির সঙ্গে আমার এই ঘটনার পর থেকেই সখ্য বেড়ে গেলো। এর পর থেকে প্রতিদিনই আমি অনিতাদির বাড়িতে যেতাম। দুজনে মিলে আচার খেতাম, গাছের আড়ালে বসে গল্প করতাম, মাঝে মাঝে ফড়িং ধরতাম। কখনো কখনো দুজনে মিলে প্রজাপতি ধরতাম তাদের বাড়ির আঙিনায়। যখন আমরা প্রজাপতি ধরতাম, তখন অনিতাদি বলতো, ‘প্রজাপতিটা আমার গায়ে ছোঁয়ায়ে দে।’ আমি জানতে চাইতাম ‘কেন?’
—এম্নি। হিহিহি।
—না বললে ছোঁয়ায়ে দিব না।
—থাক ছোঁয়াতে হবে না। এভাবে ছোঁয়ালে কিছু হয় না।
—কী হয় না?
—থাক। জানিস, গুট্টু, আমার গায়ে যখন প্রজাপতি এসে নিজে নিজে বসবে তখনই আমার বিয়ে হবে।
—কে বলেছে?
—প্রজাপতি হলো বিয়ের দেওতা, তাই। বুঝলি গুট্টু।
কী বুঝলাম আর কী বুঝলাম না তা ভেবে না পেয়ে বললাম, তাহলে প্রজাপতি তোমার গায়ে কখন বসবে?
—যখন বিয়ের সময় হবে।
—আচ্ছা। মনে হলো আমি অনেক কিছুই বুঝে গেছি।
—আচ্ছারে গুট্টু, আমার যদি দূরে কোথাও বিয়ে হয় তাহলে তোর খারাপ লাগবে না?
—না, খারাপ লাগবে কেন?
—আমাকে না দেখলে তোর খারাপ লাগবে না? তুই এত স্বার্থপর?
—না দেখলে তো খারাপ লাগবেই।
তার কথা আমি কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পেরেছিলাম। দূরে বিয়ে হলে তো তার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হওয়ার কথা নয়। তাহলে খারাপ না লেগে উপায় কী? সেদিন অনিতাদির কথায় সত্যি আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবং মনে মনে বলেছিলাম, ‘অনিতাদির যেন কোনো দিন বিয়ে না হয়।’ তাকে প্রতিদিন দেখতে পারব না তা ভাবতেই আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। একপ্রকার অজানা কষ্টের বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল মগজে, মননে ও চেতনায়। আমি সেদিন অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনিতাদিও বুঝতে পেরেছিল আমার মনের অবস্থা। তখন দিদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘ধুর বোকা, আমার কি দূরে বিয়ে হবে? কাছেই হবে কোথাও। তোর সাথে আমি প্রতিদিনই খেলতে পারব।’
অনিতাদির কথায় আমার গুমড়া মুখে হাসি ফুটেছিল। বুকের কষ্টটাও কমে গিয়েছিল অনেকখানি।
তিন.
স্কুল ছুটির দিন। এক দুপুরে আমি অনিতাদির বাড়িতে গেলাম। অনিতাদি তাদের হেঁসেলের পাশের নারকেলগাছটার নিচে চুপচাপ মুখ কালো করে বসে আছে। তাকে চিন্তাক্লিষ্ট মনে হলো। আমাকে দেখে অন্য দিন যেভাবে উছলে উঠত আজকে তাকে এমন মনে হচ্ছে না। অনিতাদিকে এত গম্ভীর আমি কোনো দিন দেখিনি। খুব ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে বসলাম। অনিতাদি হাঁটুতে থুতনি রেখে মাটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটি বার আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। কিছুক্ষণ বসে থাকলাম তার পাশ ঘেঁষে। একপ্রকার অস্বস্তিতে আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। অনিতাদি এমন গম্ভীর হয়ে বসে আছে কেন, বারবার একটি প্রশ্ন মনটাকে কোচবিদ্ধ করছে।
একবার তার থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বললাম, ‘তুমি এভাবে বসে আছ কেন?’
অনিতাদি তার মুখ ওপরে তুললো। ভাবলেশহীনভাবে আমাকে বললো, ‘তুই আমাকে বিয়ে করবি?’
কথাটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অনিতাদি আমাকে এমন কথা বললো কেন? বিস্ময়াহত হয়ে জানতে চাইলাম, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব? এমন কথা বলছ কেন অনিতাদি?’
অনিতাদি বললো, ‘তুই যদি আমাকে বিয়ে করিস তাহলে আমি এই গ্রামে থাকতে পারব। না হলে আমাকে ভারতে পাঠিয়ে দেবে।’
অনিতাদির কথা বুঝতে আমার অনেকক্ষণ সময় লাগল। আমি বুঝি দেরিতে। সোডিয়াম বাতির মতো। তারপর তার ভারমুখে এক চিলতে হাসি দেখার জন্য আমি এই সেই তেঁদরামি করলাম। একটা ফড়িংয়ের পুচ্ছে একটা সরু ঘাস বেঁধে তার সামনে ছেড়ে দিলাম। ফড়িংটি উড়তে পারছে না শত চেষ্টা করেও। মুখ ভেংচালাম। না, সেদিন অনিতাদি হাসেনি। একটুও হাসেনি। আমার কাছে বড় অস্বস্তিকর লাগছিল। এই অস্বস্তিকর পরিবেশে আর থাকতে পারলাম না। চলে এলাম বাড়িতে। বাড়িতে এসেও আমি একটুও শান্তি পেলাম না। কেন এত কষ্ট, তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। সারাটা দিন আমার খুব খারাপ গিয়েছিল। এমন একটা জীবন্ত মেয়েকে এমন মনমরা আমি আর কোনো দিন দেখিনি। ভাবতে ভাবতে আমিও বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার কানে শুধু বাজছিল, ‘তুই আমাকে বিয়ে করবি?’ আমি তো তখন বিয়ে কী তা ভালো করে বুঝতামও না।
তিন দিন পরে আমি আবার অনিতাদির বাড়িতে গেলাম। বাড়ির আঙিনায় খুঁজে না পেয়ে ঘরের দিকে তাকালাম। বারান্দায় মাসীমা (অনিতাদির মা) কুলোয় চাল ঝাড়ছিলেন। ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি অনিতাদি জানালার পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের মতোই গম্ভীর, বাকহীন। আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম। তাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও আচমকা থেমে গেলাম। এক অভাবনীয় জড়তা আমাকেও কঠিন করে তুললো।
অনিতাদি আমার দিকে ফিরে তাকালো অনেকক্ষণ পর। তারপর আমার নরম চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে বললো, ‘তুই তো আমাকে বিয়ে করলি না… আমি কাল ভারতে চলে যাব।’
—এইসব কী বলছ অনিতাদি?
—হ্যাঁ। ঠিকই বলছি। এ দেশে আমার বর নেই তো তাই। তুইও রাজি হলি না আর আমার এ দেশে থাকাও হলো না। অনিতাদি কাষ্ঠহাসি হাসল বড় কষ্টে। এই হাসি জোর করে বুকের ভেতর থেকে যেন ফরসেপ দিয়ে টেনে বের করা কাঁটার মতো।
তার কথা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠলো। আমি তার দিকে তাকালাম। আমার মাথায় অনিতাদি তার থুতনি রাখলো। কিছুক্ষণ পরে অনুভব করলাম আমার মাথায় চোখের উষ্ণ পানি টপটপ করে পড়ছে। আমি মাথা সোজা করে অনিতাদির দিকে তাকালাম। সত্যি তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। তার এই কান্না আমাকে ব্যাকুল করে তুলল। আমিও নির্বাক হয়ে মূর্তির মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনের অজান্তে আমারও চোখ ভিজে গেলো।
পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই ক্রন্দনরত মেয়েটিও চোখ মুছতে মুছতে বাসে উঠছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় ভেজা কতগুলো চোখ।
একসময় অনিতাদি বললো, ‘এখানের মাটির ঘ্রাণ খুবই তীব্র রে রাকিব। আমি যখন ভাবি আমি ভারতে চলে যাচ্ছি এই দেশ ছেড়ে, সেখানে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া হচ্ছে, তখন এই মাটির ঘ্রাণ আমাকে খুব আড়ষ্ট করে তোলে। তখন তাকিয়ে থাকি গাছের দিকে, ব্যাকুল করা সবুজের দিকে, পাখিদের দিকে। এসব ব্যাকুল সবুজ, পাখিদের দেখার, মাটির ঘ্রাণ নেওয়ার ভাগ্য আমার জীবনে আর কোনো দিন হয়তো হবে না। আমি হয়তো ‘ভোরের কাক হয়ে আর ফিরে আসব না ধান সিঁড়িটির তীরে। আমাদের এই দেশে।’ অনিতাদি তার ওড়না দিয়ে চোখ ঢাকলেন। আমার চোখ থেকেও গলগল করে পানি ঝরল। খুব আশ্চর্য লাগল দিদি আজকে আমাকে গুট্টু ডাকল না। তার মুখে গুট্টু ডাক শুনতে মন খুব ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার আর হলো না।
পরদিন ঠিকই অনিতাদি বাড়ি ছাড়ল। আমিও এসেছিলাম তার সঙ্গে এই নিমতলী ঘাটে। এই ঘাট থেকেই অনিতাদি বিদায় নিয়েছিল চোখের পানি ফেলতে ফেলতে। ব্রহ্মপুত্রের বুক বেয়ে সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল নিজ দেশ, নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য দেশে, অন্য গ্রামে বা গঞ্জে। আজ সেই ব্রহ্মপুত্রের বুকের ওপর চর। নৌকা চলে না। নিমতলী ঘাট হয়েছে নিমতলী বাসস্ট্যান্ড। হারিয়ে যাওয়া অনিতাদির সঙ্গে আমার আর কোনো দিন দেখা হলো না। একটি মুহূর্তের জন্যও না।
অনিতাদি আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। তার আর এই দেশের মাটির ঘ্রাণ নেওয়া হয়নি। দেখা হয়নি হলুদ পাখিদের গাছের ডালে। তার চলে যাওয়ার পর আমি একা একা তাদের বাড়ির আঙিনায় ঘুরে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে নারকেলগাছের তলায় এলে আমার বুক ভারী হয়ে উঠত। চোখে পানি আসত। তবুও সেখানে থাকতে আমার ভালো লাগত। তার ছায়াদের খুঁজে বেড়াতে ভালো লাগত। নিঃসঙ্গতার অনুভ‚তিও কখনো আশ্চর্য রকম ভালো লাগে। কষ্টের মধ্যেও আনন্দ আছে যদি কষ্ট অনুভব করা যায়। আমি সেই কষ্টগুলো অনুভব করতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
চার.
পেছন ফিরে ক্রন্দনরতা মেয়েটির দিকে তাকালাম। এ যে অনিতাদির মতোই দেখতে। তার প্রতিচ্ছায়া কি এই মেয়ের মধ্যে প্রতিভাত? এই মেয়েটিও তাহলে অনিতাদির ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে? হায়রে মানব জীবন! এ দেশে কেন এদের বর নেই? এ দেশে কি প্রজাপতি নেই? বরের জন্য যদি দেশই ছাড়তে হয় তাহলে তাদের এ দেশে থেকে লাভ কী? কিংবা কেনই বা এক দেশ দুই দেশ হলো? এমন এলোপাতাড়ি প্রশ্নবাণে আমি বিদ্ধ হচ্ছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার ভেতরে তীব্র ক্ষরণ অনুভব করলাম। বধির কান্না কোনোভাবেই সংবরণ করতে পারছিলাম না। অবচেতনভাবেই পকেট থেকে রুমাল নিলাম হাতে।
মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়িটিও যেন একটি শ্মশানে পরিণত হলো। এমন শূন্যগর্ভাভূমি আকর্ষণ না করে আমাকে আজ বিকর্ষণই করে চলেছে। একসময় বাড়ি আসা ছেড়ে দিলাম। আজকে অনেক বছর পর নিজের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার যে আনন্দ হিল্লোলে ভাসছিলাম সেই আনন্দ নিমতলী বাসস্ট্যান্ডে আসার পর মরে গেল ব্রহ্মপুত্রের মতো। অনিতাদির এবং মা-বাবাহীন আমার হাহাকার করা গ্রাম বিষণ্ন শূন্যতার মধ্যে যেতে আর ইচ্ছে হলো না। ইচ্ছে হলো না বুকের ভেতরের ঘুমন্ত কষ্টগুলোকে আর জাগিয়ে তুলতে। ক্লান্তি, জড়তা, অসাড়তা, হতাশা—সবকিছু মিলে আমাকে মুষড়ে দিলো মুহূর্তের মধ্যে। গ্রামের দিকে যেতে পা দুটি পাথর হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। পেছনে তাকালাম। ঢাকা যাওয়ার একটি বাস এসে থামলো। ভিড় সেঁধিয়ে আমি বাসে উঠলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই ক্রন্দনরত মেয়েটিও চোখ মুছতে মুছতে বাসে উঠছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় ভেজা কতগুলো চোখ।