নিচু হলেন আসাদ সাহেব। বাম পায়ের জুতা খুললেন। হাত রাখলেন মোজার ওপর। চুলকালেন একটু। তারপর তাকালেন চারপাশে। না, দেখছে না কেউ। চকিতে তুলে নিলেন মানিব্যাগটা। আবার তাকালেন। সবাই বসে আছে আপনমনে। যে যার মতো। কেউ খেয়াল করেনি। নিশ্চিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
দাঁড়িয়েই থাকতে হলো আরও কিছুক্ষণ। তারপর সিট ফাঁকা হলো। তারপর বসলেন।
ততক্ষণে ঘাম ছুটে গেছে তার! বার বার পকেটে হাত দিয়েছেন। মনে হয়েছে কেউ বোধহয় দেখে ফেলেছে। মনে হয়েছে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারই দিকে! সবার চোখের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে। পকেটে তার পড়ে পাওয়া মানিব্যাগ। এই বুঝি কেউ এসে পকেট হাতড়াবে। ধরা পড়ে যাবেন তিনি। এই বয়সে এই কেলেঙ্কারি! মুখ দেখাবেন কী করে? মুখ তিনি এখনই দেখাতে পারছেন না! কারও চোখে চোখ রাখতেও লজ্জা করছে। ছোট মনে হচ্ছে নিজেকে।
সায়েন্স ল্যাব। চার-পাঁচটা পথ ছড়িয়ে দিয়ে বিছিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে মোড়টা। শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। রাতজাগা ক্লান্তিটা যায়নি এখনো। যায়নি ঘুমজড়ানো অলসতাটুকু। নিভুজ্বলা চোখে সে তাকিয়ে আছে ওপরের দিকে। সাদার ওপর ছোপ ছোপ নীল আকাশটাও তাকিয়ে আছে। দেখছে তাকে। পলক পড়ছে না কারও।
মোড়টাতেই দাঁড়িয়ে আছে আসাদ সাহেবদের বাসটা। কোনো আত্মভোলা কিশোর যেন। কোথায় যেন তাকে যেতে বলেছেন মা। ছেঁড়া প্যান্টের ভেতর হাফজামাটা গুঁজে নিয়ে রওনা করেছে সে। পথের ওপর পায়ের নকশা এঁকে ভালোই চলছিল। হেলে আর দুলে। হঠাৎ দেখে বাঁদরনাচ। কিংবা সালসা বিক্রির মজমা। অমনি দাঁড়িয়ে গেছে। তার এই দাঁড়িয়ে থাকাই কাজ। নড়ারও নাম নেই তার। চড়ারও নাম নেই। তার জন্য যেন অপেক্ষায় নেই কেউ। সেও যেন ধারে না কারও ধার।
সামনে গাড়ির লম্বা সারি। যেন এক রাস্তা ইট সাজিয়ে রেখেছে কেউ। একচুলও নড়ছে না গাড়িগুলো। আজ আবার দেরি হবে। হোক। চিন্তা করে কী হবে? একটু বরং ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। এসময় তিনি প্রতিদিনই ঘুমান। হেলান দিলেই ঘুম। কিন্তু ঘুমটা আজ আসছেই না। গলায় গন্ধম নিয়ে কি চোখ বোজা যায়? পারছেন না তিনিও। বুজলেই নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন। স্পষ্ট। দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অপরাধীর মতো। কাঠগড়ায়। হাতে জ্বলন্ত টাকা।
ঘুমোনো গেলো না তাই। যদিও তার দরকার ছিল খুব।
মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘুম হয়নি রাতে। ফিরতে দেরি হয়েছে কাল। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, যাননি। কিছু করারও ছিল না। তাই ভালো লাগছিল না কিছুই। মেয়ের ঘরে গেলেন একটু। বসলেন। পড়াশোনার খোঁজখবর নিলেন। একথা সে কথা বললেন। টিউটরের কথা জিজ্ঞেস করলেন। তার বাসায় কে কে আছে জানতে চাইলেন।
মা আর বড়ভাই। খুব গরিব মানুষ স্যাররা। টর টর করে বলে দিল স্মৃতি।
কথা বলতে বলতেই কাজ করে চলেছে মেয়েটা। জানালাগুলো বন্ধ করল। পর্দা টানল। মশার কয়েল জ্বালাল। পড়ার টেবিল গুছিয়ে নিলো। তারপর পড়তে বসল।
কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা! দেখতে দেখতে! মানুষ যেন গাছ, লাগিয়ে রাখলে বাড়ে। বাড়তেই থাকে। কেউ খেয়াল করলেও বাড়ে, না করলেও বাড়ে। বাড়ছে যে, চট করে বোঝাও যায় না। হঠাৎ একদিন ডাল ভাঙে বা উপড়ে যায়, তারপর ধরা পড়ে গাছটা বেড়ে উঠছিল। সময়টা ভালো না। ঝড় ঝাপটাও বেড়েছে। তিনি কি পারবেন তার গাছটাকে আগলে রাখতে?
চুপচাপ বসে ভাবলেন কিছুক্ষণ। উঠে পড়লেন তারপর। নিজের ঘরে গেলেন। পায়চারী করলেন একটু। এক টুকরো অফিস নিয়ে এসেছেন বাসায়। কিছু কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু কম্পিউটারটা অন করতে ইচ্ছে করল না। ডায়রিটা খুলে বসলেন তিনি। আগে প্রতিদিন লিখতেন। এখন আর হয়ে ওঠে না। আগের কিছু লেখা পড়লেন। ভালো লাগলো। বেশ লেখেন তো তিনি! পিঠ চাপড়ালেন নিজের। আর অনেকবারের মতো সিদ্ধান্ত নিলেন রোজ ডায়েরি লিখবেন। আবার।
আজকের ঘটনাটাও লিখে রাখা দরকার। না হলে ভুলে যাবেন হয়তো।
খুব সংক্ষিপ্ত হলো লেখাটা। আড়াই পৃষ্ঠার পর এগোলো না। তিনি চেষ্টাও করলেন না আর। লেখা হচ্ছে পড়ার মতো। নিজে থেকে যতটা হয় হয়, জোর করলে আর ভালো লাগে না।
কিছু লিখলেই তা একবার পড়ে দেখা অভ্যাস তার। পড়লেন। অবাক হলেন। লিখতে বসলে কত কিছু মনে আসে! কত খুঁটিনাটি কথা! ছিটেফোঁটা দিন। আর টুকরো টুকরো রাত।
সব মিলে প্রায় বছর দেড়েক সময় উঠে এসেছে লেখাটায়। শুরু হয়েছে দুবছর আগে থেকে।
মেয়েটাকে নিয়ে তখন মহা ঝামেলা। কোনো টিচারকেই সহ্য করতে পারে না সে। মাস গেলেই টিউটর বদলাতে হয়। টাকার মানে টাকাও যায়, আবার পড়াশোনাও হয় না। নিজে যে পড়াবেন আসাদ সাহেব, তারও উপায় নেই। কী করেন! পড়াতে চাই বিজ্ঞাপন ছাড়া তিনি পড়েন না কিছুই। সম্ভাব্য টিউটরদের নাম্বার ছাড়া দেখেন না কিছুই। কাউকে দেখলেই আগে ভাবেন, এ কি পড়াতে পারবে স্মৃতিকে? না, পারবে না বোধ হয়!
তখনই, এক সকালে, কথা হলো বেলালের সঙ্গে। সাধারণ একটা ছেলে। বোকাসোকা। লাজুক। ওর কাছে আটদিনও পড়ার কথা না স্মৃতির। কিন্তু সাতদিন না যেতেই ভুলটা ভাঙল। দেখলেন মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে পড়ছে।
দিনে দিনে সে মুগ্ধতা বেড়েছে বৈ কি!
ক’দিন পরই বেলালের সম্মানী বাড়ানোর জন্য চাপ দিল সে!
অবাক লাগে আসাদ সাহেবের। বিরক্তও হন। এতটুকুন মেয়ের কাছে টাকার কথা বলে! ছেলেটার কি বিবেকবুদ্ধি নেই! ভাবলেন, ছোট মানুষ, ভুল করে ফেলেছে। তাই কিছু বললেন না। না মেয়েকে, না বেলালকে।
কিন্তু আবার ঘটল ঘটনাটা।
এরপর আরেকদিন। এবার একটু অন্যভাবে।
বাবার পাকাচুল বেছে দিচ্ছিল স্মৃতি। একথা সেকথা হচ্ছিল। হঠাৎ স্যারের প্রসঙ্গ উঠাল সে।
স্যারের বেতন বাবা বাড়াচ্ছে না তো কী হয়েছে, সে ঠিকই বাড়িয়ে দিচ্ছে!
কান খাড়া করলেন আসাদ সাহেব। বলে কী মেয়েটা! কিভাবে?
ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। গর্ব করে বলল পিচ্চিটা। টিফিনের জন্য বাবা যে টাকা দেন, তার পুরোটা সে খায় না। কিছু জমিয়ে রাখে। খুব বেশি জমাতে পারে না। তবু। অল্প হলেও টাকা তো! মাস শেষে বাবার টাকার সাথে মিলিয়ে দেয়। স্যার ভাবেন, আসাদ সাহেব বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সহ্য হয়? একটা বিহিত করতেই হবে। ডাকলেন বেলালকে। শিক্ষা দেওয়া দরকার পাজির হাড়টাকে।
এটা বলবেন। সেটা বলবেন। মনে মনে অনেকবার গুছিয়ে নিলেন। কিন্তু কঠিন কিছু বলা হলো না।
স্মৃতির সঙ্গে টাকা-পয়সার ব্যাপারে আলাপ করতে বারণ করলেন। আর বললেন, কোনো কিছুর দরকার হলে তাঁকে বলতে। বেলাল শুধু শুনে গেলো। বলল না কিছুই।
এভাবেই কাটল কিছুক্ষণ। আরও কিছু বলবেন কি না, ভাবছেন। দেখলেন ছেলেটা কাঁদছে। এইটুকুতেই? অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন তিনি। কোনোমতে তাকে বিদায় দিলেন সে যাত্রা।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধল স্মৃতিকে নিয়ে। পরের দুদিন ঠিকমতো কথা বলল না। কোনো ব্যাপারে রাগ করলে ও এমন করে। কারণ জিজ্ঞেস করলেন আসাদ সাহেব।
গালটা আরও ফুলে উঠলো স্মৃতির। গোলাকার হলো চোখদুটো। আর অভিযোগের খই ফুটল মুখে।
কেন তিনি বকেছেন স্যারকে! কেন কাঁদালেন তাঁকে! কী ভালো মানুষ স্যারটা তার! এক কাপড়ে পড়াতে আসেন। জুতোটা সেলাই করানো। চুলগুলো উস্কোখুস্কো। দেখে সে-ই বাবাকে বলেছে টাকা বাড়িয়ে দিতে। স্যার কিছুই বলেননি। অথচ কিছুই বোঝেন না বাবা! না বুঝেই কথা বলেন! ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভাষা হারালেন আসাদ সাহেব। মেয়েটা তার ছোট নেই আর! কতকিছু খেয়াল করে সে। বড় মানুষের মতো!
কানটান ধরে মাফ পেলেন কোনোমতে। দুঃখ প্রকাশ করলেন মেয়ের কাছে। পরসন্ধ্যায় বেলালের কাছেও।
তার কদিন পরের ঘটনা।
সহকর্মী হালিম সাহেবের মেয়ের বিয়ে। দাওয়াতে গেছেন আসাদ সাহেব।
একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। নাম আরিফ। হালিম সাহেবের ছেলের টিউটর। কথায় কথায় জানা হলো ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ইংরেজিতে অনার্স। তার মানে বেলারের ক্লাসমেট। সরল মনেই বেলালের কথা তুললেন তিনি। ছেলেটা বলল চেনে ওকে। একই ফ্লোরে থাকে ওরা। পাশাপাশি রুম। তবে ইংলিশে না, বেলাল পড়ে অন্য একটা বিষয়ে। বিষয়টার নামও বলল ছেলেটা, খেয়াল করতে পারলেন না আসাদ সাহেব। মাথায় তখন চুলো জ্বলছে তার। যা-ই হোক, ইংরেজি তো না। তাকে ঠকিয়েছে পাজিটা। এ তিনি সহ্য করবেন না।
ফেরার পথে টগবগ করতে থাকলেন।
কিন্তু বাসায় ফিরেই নিভে গেলো সব।
ঘরে ঢুকতেই ছুটে এল স্মৃতি। জড়িয়ে ধরল তাকে। তার চিৎকার থামানো দায়!
কী এমন হয়েছে, যে এত আনন্দ?
রেজাল্ট হয়েছে। খুব ভালো করেছে সে। সেরা পাঁচে আছে! অথচ টেনেটুনে পাশ করাই তার রীতি।
মেয়ে উড়ছে আনন্দে। আসাদ সাহেবেরও ওড়া উচিত। কিন্তু পারছেন না তিনি। বার বারই তার বেলালের কথা মনে পড়ছে। এক মন বলছে মিথ্যা বললেও পড়িয়েছে ভালো। আরেক মন টানছে উল্টো সুরে। ভালো পড়ালেই কি সব চুকে যাবে? না। তার সঙ্গে প্রতারণার জবাব তিনি দেবেনই! আসুক সে কাল।
কিন্তু বেলাল এল না সে রাতে।
পরের দিনও না।
তারপরের দিনও না।
প্রতি সন্ধ্যায় অপেক্ষা করেন তিনি। অপেক্ষা করে স্মৃতিও। দরজা খুলে রাখে। সিঁড়ির দিকে চেয়ে থাকে। স্যারকে আনন্দের কথাটা না বললেই নয়!
কিন্তু বেলালের দেখা নেই।
না পেরে ফোন করলেন। বন্ধ।
ততদিনে রাগ কমে গিয়েছে। সে মাসের টাকাও নেয়নি ছেলেটা। মনে পড়ল। খুব বিব্রত বোধ হলো তার। অস্বস্তি বোধ হলো।
অবশেষে দেখা পাওয়া গেলো বেলালের। দুই সপ্তা পর।
সন্ধ্যার খবর দেখছিলেন। স্মৃতির ঘরে না ঢুকে বসার ঘরে এলো বেলাল।
সামনে এসে দাঁড়াল।
মাথা নিচু। বরাবরের মতো। হাত দুটো পেছনে।
আরিফ সব বলেছে তাকে। খুব লজ্জিত সে। তাই এতদিন আসেনি। আসতও না কোনো দিন। কিন্তু কাজটা ঠিক হয়নি। তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। ক্ষমা চাইতেই এসেছে আজ।
রাগ দেখাতে পারলেন না আসাদ সাহেব। শিকার নিজে থেকে ধরা দিলে শিকারীর মনও তো নরম হয়! সামনে বসালেন তাকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন কারণটা।
টিউটর চাইলেই মা-বাবারা ভালো ছাত্র খোঁজেন। ভালো ছাত্র মানে বুয়েটের ছাত্র। সাইন্সের ছাত্র। কমার্সের ছাত্র। সাধারণ বিষয়ে পড়ে বলে সে ভালো ছাত্র না। টিউশনি জোটে না। অথচ গণিতে আর ইংলিশে তার দখল ভালো। টিউশনি না হলে তার চলেও না। বাধ্য হয়েই তাই নাম ভাঙানো। তবে সাধ্যমতো পড়িয়েছে স্মৃতিকে। তবু, তিনি না চাইলে আর আসবে না সে।
আসাদ সাহেব কিছু বলতে পারলেন না। না তাকে চলে যেতে, না আসতে। শুধু বললেন স্মৃতির রেজাল্ট হয়েছে। ভালো হয়েছে।
এরপর থেকে ভালোই হচ্ছে স্মৃতির ফল।
বেলালও আপন হয়ে গেছে। বিপদে আপদে ছুটে আসে। যুক্তি পরামর্শ দেয়। একাজ সেকাজ করে দেয়। যেন পরিবারেরই একজন। সেরকমই ওঠাবসা। তেমনটাই ভাবেন আসাদ সাহেব। কিন্তু প্রকাশ করেন না। এদের এতকিছু বুঝতে দিতে নেই। দিলেই মাথায় ওঠে। হালিম সাহেব বলছিলেন। আরিফ নাকি তার মেজো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছিল। বুঝতে পেরে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
বেলালকে তাই চোখে চোখে রাখেন তিনি। পুরুষ মানুষ দিয়ে বিশ্বাস নেই। মেয়েটাও কেমন ধা ধা করে বড় হচ্ছে। কী হতে কী হয় বলা যায় না। এমনিতেই স্যারের প্রতি মুগ্ধতার শেষ নেই তার। প্রায়ই স্যারের বেতন বাড়ানোর কথা বলে। এখনো।
আসাদ সাহেবও মনে করেন বাড়াবেন। কিন্তু পারেন না। মাঝারি চাকরি। বেতনের অর্ধেক যায় গ্রামে। বাপ আর পঙ্গু বোনের সংসারে। বাকিটার কিছু যায় ব্যাংকে। মেয়ের জন্য একটা ডিপিএস করে রেখেছেন। মা মরা মেয়ে। বাবাও মারা গেলে যেন পানিতে না পড়ে তার ব্যবস্থা। পড়াশুনার খরচ আছে। স্কুলের বেতন। কোচিং। বেলালের সম্মানী। সব বাদে যা থাকে তা দিয়ে সংসার চালানো। বাড়তি খরচের জো নেই। এক টাকাও এদিক ওদিক করতে পারেন না তিনি। কেউ পায়ে পড়লেও না। কেউ পিস্তল ঠেকালেও না। সম্মানীটা বাড়াবেন কোত্থেকে? পাগলি মেয়ে এতসব বোঝে না। তার শুধু জেদ। আর যুক্তি। আর গাল ফুলানো।
আশ্বাস দেন আসাদ সাহেব। আগামী মাসে বাড়াবেন। কিন্তু সেই আগামী মাস আর আসে না ।
এর মধ্যেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে চাকরি করা। কোম্পানির অবস্থা ভালো না। ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নানা উপায়ে চেষ্টা চলছে। টেবিলে টেবিলে টিস্যু পেপার দেওয়া বন্ধ। দিনে একবারের বেশি চা খাওয়া নিষেধ। ইত্যাদি। বাড়তি লোক ছাঁটাই।
চাকরি গেলে চলবে কী করে? ঘুম হচ্ছিল না তার।
দুশ্চিন্তার অবসান হলো কাল। ছাটাইয়ের সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত। মন দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে বেশি করে খাটতে হবে। তা খাটবে। চাকরি হারানোর চেয়ে বেশি খাটা ভালো।
খবরটা জানিয়ে বের হয়ে গেলেন বস। তাদেরও যাওয়ার সুযোগ হলো। বের হলেন আসাদ সাহেব। বেরিয়েই মনে হলো অন্য দুনিয়ায় এসে পড়েছেন। গরম বাতাস। এসির মধ্যে থেকে থেকে স্বভাব বদলে গেছে। শরৎশেষের ঠাণ্ডা বাতাসও গরম লাগে!
ঘড়িতে সাড়ে ৫টা। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রাস্তাগুলো। আরেকটু পরই আসর পাতবে জ্যাম। কত জীবন যে অকারণ কেটে যায় রাস্তায়! এর কারণেই তার ঢাকায় থাকতে ইচ্ছে করে না। মেয়েটার পড়াশোনার কথা ভেবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে অবস্থা আরও খারাপ হলে কী করেন বলা মুশকিল।
বাসে উঠলেন তিনি। উঠেই সিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কাল মনে হয় ভাগ্যটা ভালো ছিল। সিট পাওয়া গেলো। আর সিট পেলেই তিনি চোখ বুজেন। মুখের উপর রুমালটাকে শুইয়ে দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেন। অনোন্যোপায় অবসরটুকু কাজে লাগান। অভ্যাসটা অনেক দিনের। উপভোগই করেন তিনি।
তন্দ্রা কাটল ছোট্ট একটা ঝাকুনিতে। ততক্ষণে বাস ভরে গেছে। ভ্যাপসা হয়ে উঠেছে বাসের ভেতরটা। ঘেমে নেয়ে উঠেছেন তিনি। জামাটা লেপ্টে গেছে। অস্বস্তি লাগছে। সোজা হয়ে বসলেন।
বসতেই দেখা গেলো বেলালকে। তার বাসেই উঠলো ছেলেটা। তারপর যা ঘটল, তা দেখার কোনো প্রস্তুতি তার ছিল না। তাই মনে হলো তিনি নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
যাত্রীদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো বেলাল। কাঁধে ব্যাগ। কয়েকটা বই বের করল সে। তারপর শুরু হলো বক্তৃতা। জমিজমা বিষয়ে অতি দরকারি একটা বই ওগুলো। পড়লে যা যা জানা যাবে বিস্তারিত বলল। আরেকটা কী বের করল এরপর। চরকার মতো ডিজাইন। মাঝারি আকারের। সাধারণ জ্ঞানের আকর নাকি ওই চরকাটা। কী কী জানা যাবে, কোনটার কী গুরুত্ব—বলে যাচ্ছে একটানে একদমে। অথচ এই ছেলেই কিনা চুপচাপ বসে থাকে তার বাসায়। সাত চড়েও রা করে না। অবাক লাগছে আসাদ সাহেবের।
গুণাগুণ বর্ণনা শেষ। এবার দামের পালা। প্রকাশনীর পক্ষ থেকে তার কাছে দাম কম। দোকান থেকে কিনলে ডাবল। ফলে নিতেই যদি হয়, এখান থেকেই নেওয়া ভালো। বলতে বলতে বই দিতে লাগল সবাইকে। পছন্দ হলে নেবেন না হলে না। নিলে লাভ, না নিলেও ক্ষতি নাই।
আসাদ সাহেবের সিট পেছনের দিকটাতে। বেলাল আসার আগেই রুমালের ঘোমটা পরলেন। কিছুক্ষণপর সামনে গেলো ছেলেটা। ছড়িয়ে দেওয়া বইগুলো ফেরত নিল। একটা বইও বিক্রি হয়নি। তবু মুখখানা হাসিমাখা। কাঁধে চিন্তাবোঝাই ব্যাগটা ঝুলিছে দাঁড়িয়ে থাকলো গেটের কাছে। তারপর নেমে গেলো।
তাকিয়ে থাকলেন আসাদ সাহেব। উৎসুক অবাক দৃষ্টি।
আরেকটা বাসে গিয়ে উঠলো বেলাল। আগের মতো করেই দাঁড়ালো। দেখা যাচ্ছে।
সিগন্যাল ছেড়েছে। দূরত্ব বাড়লো বাস দুটোর। একটা ছাড়িয়ে গেলো আরেকটাকে। তিনি কিন্তু পারলেন না ছাড়তে। পড়ে থাকলেন বেলালের কাছে। তার বইয়ের ব্যাগটাতে। হাসিমাখা দুখী চিবুকটাতে। নানা কথা মনে হচ্ছে। শংকর মোড় তার অপেক্ষায় ছিল। চিন্তায় চিন্তায় পার হয়ে গেলেন। খেয়াল হলো কিছুদূর পর। ইশ, এতটা পথ এবার হেঁটে যেতে হবে! কী আর করা। হাঁটতে লাগলেন।
ধানমন্ডি পনেরো। চেনা ঠিকানা।
কিন্তু এগোতে চাইছিল না পথটা। মাথা ভার হয়ে ছিল। নানা প্রশ্ন উড়ছিল মনে। উত্তরও ছিল সাথে। কেউ যেন সওয়াল-জবাব খেলছে তার সাথে। কৌতূহলী নিরীহ প্রশ্ন, আর কাটা কাটা ঝাড়া জবাব!
এভাবেই আসে ছেলেটা তার মেয়েকে পড়াতে। এত কষ্ট করে!
অ্যাঁ! এতে অবাক হওয়ার কী আছে। পড়াশোনার জন্য মানুষ কত কী করে! আর এ তো ফেরিগিরি।
এভাবে বিক্রি তো বেশি হয় না। অন্যদেরও দেখেছেন। তাহলে এত কষ্ট করে লাভ কী?
কী লাভ! বিনা লাভে গাছের পাতাও নড়ে না। প্রথমত ফেরিঅলাদের বাসভাড়া লাগে না। আর যতটুকুই বিক্রি হয়, তাতে লাভ একেবারে কম না।
বাস থেকে বাসে যেতে হয়। সময়সূচি ঠিক থাকে না। এজন্যই কি মাঝে মাঝে দেরি করে আসে সে?
হতে পারে। আবার দেরি হলে রাতের খাবারটা খেয়ে যেতে পারে বলে ইচ্ছে করেও দেরি করে!
না, এই উত্তরটা নিতে পারলেন না আসাদ সাহেব। পড়া শেষে বেশি রাত হলে কিংবা ভালো রান্না হলে বেলালকে খেয়ে যেতে বলেন তিনি। কিন্তু এমন তো ঘটে কালেভদ্রে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকেছিলেন তিনি। ঘরজুড়েও সাতপাঁচ।
খুব যে গুছিয়ে লিখতে পেরেছেন, তা মনে হয়নি। তবু ভালো লাগছিলো লিখতে পেরে। খারাপ লাগাটা যদিও ছেড়ে যায়নি তখনো। তবু। ঝাড়া মেরে উঠলেন। উঁকি দিলেন মেয়ের ঘরে। বেলাল এসেছে। পড়াচ্ছে।
পড়ার সময় তিনি মেয়ের ঘরে যান না। কখন কী প্রশ্ন করে বসে। এখনকার পড়াশোনা খুব একটা বোঝেনও না। বেশ কিছুদিন উল্টোপাল্টা উত্তর দিয়ে লজ্জা পেয়েছেন। এ সময়টুকুতে তাই সাবধান থাকেন।
তবে কাল গেলেন।
হাসাহাসি করছে ওরা। বেলালের দিকে তাকালেন। কী অদ্ভূত জীবন! কে বলবে এ ছেলেটাই আসার পথে ফেরি করে এসেছে! ওই তো ব্যাগটা পায়ের কাছে রাখা। প্রতিদিনই ওটা নিয়ে আসে সে। খেয়াল করেছেন আসাদ সাহেব। কিন্তু এর ইতিহাস যে এমন হতে পারে, ভাবনাতেও আসেনি কখনো।
কুশল বিনিময় হলো।
কেমন মায়া মায়া লাগছে। নিজেকেই তিনি বসে থেকে দেখলেন বেলালের চেয়ারে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে।
কিন্তু জড়িয়ে ধরা তো সহজ কথা না। তার জন্য জোর লাগে, অধিকার লাগে। সেসব সবার থাকে না সবসময়।
বের হয়ে গেলেন। পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বসলেন টিভির সামনে। মন বসছে না। অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে ছেলেটাকে সাহায্য করা দরকার। কিন্তু কিভাবে পারবেন! কী করা যায় ছেলেটার জন্য? আয়ের অন্য উৎস নেই। অফিসের উপরি আয় আছে। কিন্তু তাতে হাত দেন না তিনি। স্মৃতির মা মরার আগে দিতেন। পরে মনে হলো এই অসৎ টাকার ওষুধ খেয়েই মরেছে সে। এই মৃত্যু একটা ইঙ্গিত। ইঙ্গিতটা তিনি বুঝলেন। পরদিনই জানিয়ে দিলেন উপরির হিস্যা তিনি নেবেন না। তাকে বাদ দিয়েই তাই ভাগ হয় টাকাটা। আবার কি পা বাড়াবেন ওপথে? যা পাবেন, সব দিয়ে দেবেন বেলালকে। একটু আরাম করে পড়তে পারবে ছেলেটা। বিনিময়ে তিনিই না হয় একটু ভাগ নিলেন পাপের! নেবেন না কি?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালে উঠলেন খুব ভারী একটা মাথা নিয়ে। ঘুম হয়নি। এলোমেলো স্বপ্ন দেখেছেন। বেলালের কথা মনে হয়েছে। কী করা যায়। কী উপায়। ভেবেছেন খুব। কিন্তু ফল হয়নি। তাই ঠিক করেছেন হালিম সাহেবকে বলবেন। উপায় কিলবিল করে তার মাথায়। একটা না একটা কাজে লাগবেই।
চিন্তাটা সঙ্গে নিয়েই বাসে উঠলেন। সিটিং সার্ভিস। কিন্তু সিট খালি থাকে না। দাঁড়িয়েই বেশির ভাগ পথ। অভ্যাস হয়ে গেছে। বাসজুড়ে রাতজাগা হাওয়া। ঘুমভাঙা রোদ। ঢুলুঢুলু চোখ। ঘুমঘুম যাত্রী। ফুটপাতে দিন শুরুর আয়োজন। মোড়ে মোড়ে লোকজন উঠছে। তাকে জায়গা করে দাঁড়াতে বলল কন্ডাক্টর। সরে গেলেন আসাদ সাহেব। তখনই মুচকি হাসলো মানিব্যাগটা। তারটা নয় তো! না, সেটা পকেটেই আছে। তাহলে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কেউ খুঁজছে না। কেউ দেখছে না। কী যেন হয়ে গেলো তার! আবেগের দমকা হাওয়ায় উড়ে গেলো বুদ্ধি বিবেচনা। হঠাৎ। কুড়িয়ে নিলেন ব্যাগটা।
তারপর থেকেই পুড়ছেন। ভেতরে ভুলের আগুন।
পল্টন মোড়। লোকজন নামছে। নামাদলের একজন বিলাপ করে উঠলেন হঠাৎ। তার মানিব্যাগ চুরি গেছে। খুঁজতে বলছেন সবাইকে। আর চিৎকার করছেন। ছেলে বিদেশে পড়ে। টাকার দরকার। পাঠাবেন বলেবা যাচ্ছেন ব্যাংকে। এতগুলো টাকা। কী করবেন এখন তিনি?
মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আসাদ সাহেবের। ইচ্ছে করছে ব্যাগটা বের করে দিতে। কী কুক্ষণেই না ওটা হাতে নিয়েছিলেন তিনি! কী মনে করে নিয়েছিলেন? কেন নিয়েছিলেন? জানেন না। শুধু জানেন নিয়েছেন। এখন আর কিছু করার নেই। তাকে চোর বলবে সবাই। পকেটমার বলবে। লজ্জাটা তিনি সইতে পারবেন না।
বাসজুড়ে সোরগোল। কেউ বলছে পকেটমার নিয়েছে। তা হলে আর খুঁজে লাভ নেই। কেউ বলছে তিনিই হয়তো ভুলে রেখে এসেছেন বাড়িতে। তবু খুঁজে যাচ্ছেন লোকটা। প্রতিটি সিটের নিচে ঢুকছেন তিনি। হন্যে হয়ে দেখছেন।
অমানুষ অমানুষ লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হাত নাড়াতেও ভয় হচ্ছে তার। কেউ যদি বুঝে ফেলে! বসে থাকতেও ভয় হচ্ছে। কেউ যদি বুঝে ফেলে। কথা বলতেও ভয় হচ্ছে। চুপ থাকতেও ভয় হচ্ছে। কেউ নিশ্চয় বুঝে ফেলবে। দূর ছাই! আর পারা গেলো না। নেমে পড়লেন তিনি। অফিস এখনো দূরে। তবু। আজ হেঁটেই যাবেন। দেরি হবে। হোক। পা চালালেন। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে খুব। সহ্য করতে পারছেন না নিজেকে। কর্পূর হলে ভালো হতো, মিলিয়ে যেতেন হাওয়ায়। জল হলে মিশে যেতেন মাটিতে। ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছেন তিনি। আবার থামছেন। আবার এগুচ্ছেন। আবার থামছেন। পা দুটো ভারি হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর আর উঠানোই গেলো না। দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওটা ফেরত দিলে কেমন হয়? একটু হেঁট হবে মাথাটা। দু’চার ঘা পড়তেও পারে মুখে পিঠে। আরও খারাপ কিছুও হতে পারে। কিন্তু সারাজীবন জ্বলারচে’ সেও কি ভালো না? তাছাড়া ভুল তো মানুষই করে। শুধরে নেওয়ার সুযোগও থাকে। তাই ঘুরলেন। যা হয় হবে।
বাসটা তখনো জ্যামে। জমে যাওয়া পশুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চল। নিথর। হঠাৎ চলতে শুরু করল। যেন প্রাণ পেয়েছে। তবে গতি বেশি না। এক পা দু’পা করে এগুচ্ছে। পা চালালেন আসাদ সাহেব। ছোট্ট একটা লাফ দিলেন। উঠে পড়লেন দরজায়। প্রচণ্ড ভিড়। গিজগিজ করছে জুতো। তবে পা রাখার জায়গা হলো তার। হাতলটা ধরে রাখতে হলো একহাতে। অন্যহাত দিলেন পকেটে। ওখানেই রাখা তার গন্ধমের ফল। কিন্তু এ কী! মানিব্যাগটা নেই! নেই তো নেই!
সহসা হাত চলে গেলো পেছনের পকেটে। স্মৃতির ডিপিএসের টাকাটা নিয়ে যেখানে অপেক্ষা করছে নিজেরটা। না, সেটাও নেই! আশ্চর্য!