রাত প্রৌঢ় হলে তার ঘুম ভেঙে যায়। প্রতিরাতেই এমনটা হচ্ছে। প্রথম ভেবেছিলেন বাথরুমের চাপ। কিন্তু পরে ভুলটা ভাঙলো। এমনটা নয় যে, ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘুম ভাঙে। রাত তখন ঢের পড়ে থাকে অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে।
কিন্তু তখন আর ঘুম আসে না। অকারণ বাথরুমে যান, জানালার শার্সিতে দাঁড়ান। এ-পাড়ার শেষবাড়িটার বারান্দায় একটা ম্লান আলো ঝুলছে সরু তার বেয়ে। তারটা দেখা যায় না, আলোটাকেই মনে হয় তিনি নিজে, নিঃসঙ্গ।
আজকাল তাঁর স্ত্রী-ও আর একপালঙ্কে ঘুমান না। তার নানারকম শারীরিক জটিলতা, নিজে থেকেই তিনি পাশের লাগোয়া ঘরটায় থাকতে শুরু করেছেন। এই ঘরটা ছোট মেয়ের ঘর। বিয়ের পর জামাইয়ের সঙ্গে আমেরিকা চলে গেছে । এখন ঘরটা খালি পড়ে আছে। স্ত্রী পাশের ঘরে চলে যাওয়ায় তিনি মনে মনে খুশিই হয়েছেন। তার নিজেরও আর এই যৌথজীবন ভালো লাগছিল না। আজকাল আর কারও সঙ্গই তার ভালো লাগে না। আগে এই বাড়িটা সবসময় আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধব আর ছেলেমেয়েরা মিলে জমজমাট থাকতো। তখন তার চাকরি ছিল, চাকরির কারণে ক্ষমতাও ছিল। ক্ষমতার কারণে কতজন যে তদবির নিয়ে হাজির থাকতো সকাল-সন্ধ্যায়। দান-খয়রাত, ডোনেশন, সাহায্য; এসবও কম করতে হয়নি। নিজেও নিজের এলাকায় স্কুল-কলেজের মতো অনেক সামজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মানুষ তাকে জানে একজন সজ্জন ও পরোপকারী মানুষ হিসেবে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন, এখন তারা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিছুদিন আগে চাকরি থেকে অবসর পেয়েছেন। একজন সফল মানুষ হিসেবে জীবনের দৌড় প্রতিযোগিতার শেষ করেছেন তিনি।
পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মব্যস্ত জীবন। সংসার,অফিস,স্বজন-পরিজন পরিবেষ্টিত জীবনে বুঝতেই পারলেন না পঁয়ত্রিশটা বছর কিভাবে যে কেটে গেছে। সবকিছুই যেন চোখের সামনে সেলুলয়েডের ফিতার মতো ছবি হয়ে ছুটছে। প্রথম চাকরি হলো তারপর কামরুন্নাহারের সঙ্গে বিয়ে, বিয়ের পর সংসার এবং সবশেষে সিনেমার পর্দা নামার মতো চাকরি থেকে অবসর। এই পঁয়ত্রিশ বছরের ননস্টপ জীবন, কোনোদিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ হয়নি। কিন্তু নিঃশব্দে গোপনে তিনি বয়ে নিয়ে এসেছেন আরও একটি নাম, একটি মুখ। সেটাই আজকাল বুকের মাঝখানে প্রতিনিয়ত তোলপাড় করে চলছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রতিজ্ঞাও সে রাখতে পারেনি, জীবন তার ইচ্ছায় নয়,নিয়তির নির্ধারিত পথেই এগিয়ে গেছে।
অবসরজীবন শুরু হওয়ার পর হঠাৎ করে মনে হলো কী যেন তার ছিল, কী যেন তার নেই। একটা গভীর শূন্যতা তাকে তলিয়ে নিচ্ছে, তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন এক করুণ শোকের ভেতর, তার চোখের সামনে রিমঝিমের মুখটা ভেসে ওঠে, এক অদৃশ্য করুণ ব্যথায় তার হৃদয়টা কাঁদছে। অবসরের আগে যখন নানা কাজ নিয়ে তাকে দৌড়ের মধ্যে থাকতে হতো, তখন কখনো কোনো অলস সময়ে তার কথা তার মনে পড়ত আবার নতুন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ায় তার কথা ভুলে গেছেন। এখন কাজ নেই, স্টেকহোল্ডাররাও আর আসে না, এখন অখণ্ড অবসর। এখন সারাটা সময়ই তার কথা মনে পড়ে। শেষরাতে জেগে উঠলে আর কিছুতেই ঘুম আসে না। জানালায় দাঁড়ালে মনে হয় ওই একা বাল্বজ্বলা বাড়িটাই যেন ওদের বাড়ি,এমনটাই ছিল দেখতে। বারান্দায় একটা বাল্ব জ্বলতো রাতভর আর বাড়িটা অন্ধকার ছায়ার ভেতর চুপচাপ বসে থাকতো। তখন তারা দুজনে মিলে একটা অদ্ভুত খেলার আয়োজন করেছিল। সারাদিন যদি কোনো কারণে তাদের দেখা না হতো, তাহলে ওই অদ্ভুত খেলাটার কারণে তাদের দেখা হয়ে যেতো। প্রতিদিন ঘুমোবার আগে নির্দিষ্ট সময়ে রিমঝিম এসে দাঁড়াতো আলোর সামনে।
আজহারের পড়ার ঘর থেকে রিমঝিমদের বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যেত। আজহারও ওই নির্দিষ্ট সময়ে এসে জানালায় দাঁড়াতো। আজহারের ঘরেও আলো জ্বলতো। কথা বলা যেতো না কিন্তু দুজন দুজনকে দেখতে পেতো। প্রতিদিনের ওইটুকু দেখা ছিল ভালোবাসার নবায়ণ করার মতো। তখনকার সেই আবেগই ছিল অন্যরকম। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল তাদের। একান্তে দুজনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দুবছর পর আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে তার বাবা-মাকে প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু তার আগেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে ঘটনাটি ঘটলো। রিমঝিমের কোনো এক আত্মীয় একজন ভালো পাত্রের সন্ধান নিয়ে এলেন। দু-চার দিন কথা চালাচালি হলো তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিল রিমঝিমকে। রিমঝিম তবু তার ইচ্ছের কথা বলেছিল তার বাবা-মাকে। বাবা বলেছেন, একজন বেকার ছেলের কাছে তাকে বিয়ে দেবেন না। এটা ছিল তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে পাত্রস্থ করার ঘটনা। খবর পেয়ে পাগলপ্রায় আজহার যখন ছুটে গেলো,তখন সব শেষ। নিয়তির অলঙ্ঘনীয় লেখনের কাছে তাকে হার মানতে হলো। চার বছরের তিল তিল করে জমানো ভালোবাসা যখন এক বিশাল পাহাড়ের সমান উঁচু হয়ে উঠেছে, তখনই হঠাৎ ভূমিধসে সব মাটিতে মিশে গেলো।
পড়াশোনা শেষ করার পরপরই চাকরি পেয়ে গেলো আজহার। যে কোনো কারও জন্যই সে চাকরি ছিল ঈর্ষণীয়। আজহার জন্য তখন সুন্দর সুন্দর মেয়েদের প্রস্তাব আসতে থাকে। আজহার তাদের মধ্যে থেকে বেছে একজন সুন্দরীতমাকে পছন্দ করে নিতে পারে। একবার তার ইচ্ছে হলো, ইচ্ছের চেয়েও বেশি জেদ চেপেছিল, যাকে সে বউ করে আনবে সে হবে রিমঝিমের চেয়েও সুন্দরী কেউ একজন। একসময় সে ভাবনাও আজহার পরিত্যাগ করে। কারণ সে জেনেছিল, রিমঝিম তার জন্য অনেক অনেক কেঁদেছিল, তার মা-বাবাকে তার সম্পর্কের কথা বলেছিল। বলেছিল, দুই বছর পর তো সে আর বেকার থাকবে না। কিন্তু কেউ তার প্রতি একটু অনুকম্পা দেখালো না। রিমঝিমের কোনো দোষ নেই। এ-জীবনে আজহার কোনোদিন তাকে ভুলতে পারবে না। তার জন্য সে সারাজীবন একাকী কাটিয়ে দেবে। যদি এমন কখনো ঘটে, কোনো কারণে রিমঝিমকে তার স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়, সেটা যদি জীবনের শেষ অপরাহ্নেও হয়, তখনো সে তার হাত ধরে বলবে, আমি এখনো তোমাকে চাই, তোমাকেই চাই। কখনো কোনোদিন তোমার অমর্যাদা করবো না। তোমাকে ভালোবাসবো, শুধু তোমাকেই ভালোবাসবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজহার মা-বাবা ও পরিবারের অন্যদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে। আরও দুই বছর কালক্ষেপণ করে রিমঝিমের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সুন্দর কামরুন্নাহারকে বিয়ে করতে রাজি হয়। কম সুন্দর বউ দেখলে তার রিমঝিমের কথা মনে পড়বে, এটা ছিল তার অন্তর্গত ভাবনা। আজহারের এই অদ্ভুত খেয়ালের কথা কখনো সে কাউকে বলেনি। একবার ভেবেছিল, বিয়ে করার প্রয়োজন ছিল, সেটা করেছে। ছেলেমেয়ের তার দরকার নেই, এই জীবনটাকে সে একাকীই বয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রতিজ্ঞাও সে রাখতে পারেনি, জীবন তার ইচ্ছায় নয়,নিয়তির নির্ধারিত পথেই এগিয়ে গেছে।
কিন্তু একে একে তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ভালোবাসার মানুষটির জন্য ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করেন।
ঘুম ভেঙে গেলে প্রতিরাতে আজহার নিঃসঙ্গ বাল্বটার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ একরাতে তার মনে হলো, রিমঝিম দাঁড়িয়ে আছে আলোর বৃত্তে। নিজের অজান্তেই হাতের ইশারা করেন তিনি। রিমঝিমও সতর্ক হাত নাড়ে। আজহার বিভ্রমে পড়ে যান। এপারের আজহার নবীন যুবক, ওপারে কিশোরী রিমঝিম। কিন্তু হঠাৎ আজহারের মনে হলো, রিমঝিমের মুখটা বিষণ্ন। রিমঝিম মানে খুশিভরা একটা সুন্দর মুখ, ওকে তো কোনোদিন এমন বিষণ্ন দেখেনি সে। আজহারের বিভ্রম কেটে যেতেও সময় লাগে না। এরপর থেকে প্রতিদিনই তিনি জানালায় এসে দাঁড়ান। প্রতিবারই তিনি বিভ্রমে জড়ান৷ যেন বিভ্রমে জড়াতেই তিনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ান। একটা নেশার মতো পেয়ে বসে তাকে। আলোর বৃত্তে রিমঝিম একটু দাঁড়িয়ে ভেতরে চলে গেলে বাকি রাতটুকু তার নির্ঘুম কাটে। কিছুতেই তিনি চোখের পাতা এক করতে পারেন না, রিমঝিম তার সমগ্র সত্তাকে অধিকার করে রাখে। কিন্তু কোথায় তার রিমঝিম? যে রিমঝিমকে তিনি পঁয়ত্রিশ বছর তার স্মৃতির সঙ্গী করে নিয়ে এসেছেন, কোথায় আছে সে? কেমন আছে সে, দেখতে কেমন হয়েছে? সে কী আগের মতোই সুন্দর আছে নাকি বয়স তাকেও জীর্ণ করে দিয়েছে? তাকে দেখতে বড় সাধ হয়। সে বেঁচে আছে তো! স্বামীর সংসারে সে সুখী ছিল তো? নাকি স্বামীর নানা গঞ্জনার শিকার হয়েছে? যদি তাকে তিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতেন নিশ্চয়ই তাকে তিনি আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন, হয়তো প্রাণের চেয়েও বেশি। কখনো তার সঙ্গে রাগ করে কথা বলতেন না, আদর করে কথা বলতেন। তার অসুখে-বিসুখে সারাক্ষণ তার পাশ বসে তার সেবা করতেন।
আচ্ছা রিমঝিমের ক’টা ছেলেমেয়ে? দেখতে কেমন হয়েছে তারা? মা’র মতো? মা-র মতো হলে নিশ্চয়ই তারা তার মতো হাসিখুশি ও সুন্দর হবে। বুকের ভেতর একটা কান্না গুমরে গুমরে উঠছে। একবার তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোথায় আছে সে? তারা যে পাড়ায় থাকতো, সেই জায়গাটা পঁচিশ বছর আগে সরকার অধিগ্রহণ করেছে, সেখানে সরকার বিসিক শিল্পনগরী করেছে। তখন বাবা জীবিত ছিলেন, তিনিই সেসব সামাল দিয়েছেন। সরকার সেখানকার মূল বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। পঁচিশ বছর আগের সেই ঘটনায় তাদের ও রিমঝিমদের পরিবারসহ বহু পরিবারকে দূরে কোথাও যার যার মতো বাড়িঘর করে চলে যেতে হয়েছে। এখন কে কোথায় আছে জানেন না আজহার। রিমঝিমকে তার চাই, অন্তত জীবনের এই পর্বে এসে একবার রিমঝিমকে দেখতে ইচ্ছে করছে। এখন ডিজিটাল যুগ। মানুষের যোগাযোগ মাধ্যম, কানেকটিভিটি বেড়েছে। ফোন নম্বর নেই তো কী হয়েছে, ফেসবুক তো আছে।
রিমঝিম কী ফেসবুক ব্যবহার করে না? আজহার রিমঝিমের নাম লিখে ফেসবুকে সার্চ দেন। তার মূল নাম, ডাকনাম নানাভাবে লিখে সার্চ দেন। এক নামে কত কত জনের মুখ ভেসে আসে,কিন্তু তাদের মুখের সঙ্গে বা অ্যাবাউটের সঙ্গে রিমঝিমের কোনো মিল খুঁজে পান না। রিমঝিমের একটা ভাই ছিল, তার নামও সার্চ দেন। সেই নামের সঙ্গে পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার মুখের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানেও একই নামের অনেকের মুখ ভেসে ওঠে। তাদের প্রোফাইল সার্চ করে তাদের বন্ধু তালিকায় রিমঝিমের নাম খোঁজেন আজহার। এই অন্তর্জাল ঘেটে রিমঝিমের নাম বের করা একটা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ। কিন্তু একে একে তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ভালোবাসার মানুষটির জন্য ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করেন।
আজহার এখন কাঁদছেন।