—আমার দ্বন্দ্বটা মূলত কার সঙ্গে বলতে পারো? কেন এত দ্বিধাগ্রস্ত দেয়াল চারপাশে?
ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটাতে চুমুক দিচ্ছিলাম আলতো করে। কিন্তু ওর প্রশ্নটা যেন আমাকেও খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত করে তুললো।
—দ্বন্দ্বটা তোমার নিজের সঙ্গে। একান্ত নিজস্ব কিছু ধ্যানধারণা, একগুয়েমি আর যথেচ্ছা জীবন অপচয়ের ঘেরাটোপে তুমি বন্দি। কিন্তু এটাও তো একটা জীবন, অন্য সবার মতো। স্পন্দন আছে, উত্তাপ আছে। আচ্ছা, নিজের মতো করে নিজের পৃথিবীতে বাঁচা কি অন্যায়?
—না, সেটি নয় বরং খুবই ন্যায়। তবে সেই পৃথিবীটা যদি চারপাশের দেয়াল হয়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসে, তাহলে শীতল শ্বাসপ্রশ্বাস কোথায় পাবে তুমি?
—অথচ আমি কখনোই এমন হতে চাইনি জানো। আবার আমি ঠিক কেমন হতে চেয়েছিলাম তাও জানি না। চারপাশে যে প্রশ্নের সমুদ্র, সেই উত্তাল প্রশ্নের ঢেউয়ে একটা খড়কুটো খুঁজে পাওয়ার আশায় কত রাত যে আমি একা একা অসহায়ের মতো কেঁদেছি, ছটফট করেছি, তবু একটি তৃণলতাও মেলেনি। নেমেসিস আমাকে এমন জাদুরই সন্ধান দিলো, যেন আজীবনের জন্য আটকা পড়লাম নিজস্ব অদৃষ্টে।
আমি কফির কাপটায় চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমাদের দুজনের নৈঃশব্দ্যের মাঝে হঠাৎ ফস করে জ্বলে ওঠা ম্যাচের আগুনটাকে মনে হতে থাকে তৃতীয় একজন। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ওর চোখে জ্বলন্ত বারুদের আলো। আমার আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটের ধোঁয়া পরিবেশটাকে যেন আরও রহস্যময় করে তুলেছে। ওর কালসিটে চোখ, থ্যাবড়ানো গাল আর উস্কোখুস্কো চুল। তবু আমার কোথায় যেন ধাঁধা লাগে—এই কি তবে নার্সিসাস, না কি অন্য কেউ? নদী দেবতা আর জলদেবীর পুণ্যকাম-পুত্র আত্মঅহঙ্কারী নার্সিসাস!
—তুমিই কি নার্সিসাস?
—আমি আসলে নার্সিসাস হতে পারি। কখনো কখনো আমারও সে কথাই মনে হয়। কিন্তু জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে তো শুধু আদিগন্ত শূন্যতা। কোথায় সেই গনগনে সুন্দর, কোথায়?
আমার কী বলা উচিত বা কী বলা যায়, তা বুঝে উঠতে পারছি না। সিগারেটের ধোঁয়া ওর আর আমার মধ্যে একটু একটু করে যেন আরও অস্পস্টতা তৈরি করছে। আমি ওকে বুঝতে পারছি না। কখনো ওর মুখ দেখা যায়, কখনো যেন ধোঁয়া আড়াল করে সবকিছু। ঠিক যেমন মেঘে মাঝে মাঝে ঢেকে যায় সূর্য।
—তুমি যদি নার্সিসাস হয়েও থাকো, তবে কী এসে গেলো? নিজের ছায়া ধরার চেষ্টায় যে নিজেই আত্মঘাতী হয়, তার জন্য আর কারই বা কী করার থাকে!
—আমার আর সৌন্দর্য অবশিষ্ট নেই তাই না? সৌন্দর্য এত নশ্বর কেন? ধরতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেই, অথচ…
—আমার মনে হয়, এই জীবনে মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য স্পর্শ করতে নেই। প্রকৃত সৌন্দর্য বিরাজ করে তার নিজস্ব সৌকর্যে। তাকে কেবল অনুভব করতে হয়, ছুঁতে যেতে নেই।
—না, না। আমি সৌন্দর্য নির্মাণ করি। সৌন্দর্য আমার চারপাশজুড়ে। আর যা অনুভব করি, তা আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই। অবশ্যই, অবশ্যই…
হঠাৎ ও মুখ ঢেকে ডুগরে কেঁদে ওঠে। ওর উস্কোখুস্কো চুলগুলো টানতে থাকে জোরে জোরে। এখন আবার ওকে অন্যরকম লাগে। এরমাঝে সৌন্দর্যের যেন লেশমাত্র নেই। কেবল উদ্ভট পাগলামি। না কি সৌন্দর্যের ভাঁজে ভাঁজে কখনো কখনো অন্ধকারও লুকিয়ে থাকে!
—তুমি ইকোর প্রতিধ্বনি শুনতে পাও?
—দেখো, আমি কিছুই শুনতে চাইছি না, কেবল শান্ত হয়ে একটু বসতে চাইছি। কিন্তু তুমি ক্ষ্যাপাটে আচরণ করছ।
—আমি ক্ষ্যাপাটে আচরণ করছি? এই ক্ষ্যাপামির মধ্যে কি তুমি কিছুই দেখতে পাচ্ছো না? আমার জন্য তোমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না?
—শোনো, কষ্ট কিংবা ভালোবাসা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। এই মুহূর্তে কফির কাপে চুমুক দিয়ে সিগারেটে টান দিতেই আমার বেশি ভালো লাগছে।
—তুমি খুব নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছো, তা কি বুঝতে পারছ?
—হতে পারে, কেনো কখনো কি তুমি নিষ্ঠুর হওনি?
—আমি, কার প্রতি? ইকো…
—সে আমি জানি না। আর তোমার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা নিষ্ঠুরতা কি না, সেটিও বুঝতে পারছি না।
ও খানিকক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখে গোক্ষুর চাহনি। ও উঠে দাঁড়ায় আর আমারও হাত ধরে বলে, ওঠো। আমি হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করি, কিন্তু ও যেন বজ্রআঁটুনিতে ধরেছে আমাকে। আমি জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাবো?
—তোমাকে সৌন্দর্য দেখাবো। ছায়ার পেছনে ছায়া, আলোর পেছনে আলো আর ভালোবাসার পেছনে ভালোবাসার রঙ দেখাবো।
ও আমার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলো। যেন সৌন্দর্যের অবধারিত অনুভূতি আমাকে পেতেই হবে, নইলে জীবনই বৃথা। প্রথম ঘরটিতে থরে থরে সাঁজানো ক্যানভাস। যেন কোনো এক ক্ষ্যাপাটে শিল্পী তার মনের ইচ্ছেমতো রঙ ঢেলে দিয়েছে ওগুলোতে। ও একটা ক্যানভাস তুলে ধরে আমার সামনে। ছায়া ছায়া বনতলে ছোট ছোট পাতা ঝরে পড়েছে এলামেলো। আর তারই ফাঁকে একটা সাদা ফুটকিওয়ালা হলুদ প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়া রোদের দিকে।
সবমিলিয়ে ছবিটা দেখে আমার একটা কথাই মনে হলো—অসাধারণ। ছবির হলুদ প্রজাপতিটাকে মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত। আর গাছের ফাঁকের চুইয়ে আসা রোদটাকে মনে হচ্ছে বাস্তব। যেন হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়।
—দেখো, ছবিটা দেখো। বনপথের ছায়াটা দেখেছ? যেন এ পথে এক্ষুণি দৌড়ে আসবে কোনো বেভুল বাতাস। আর ভাসতে ভাসতে কোনো এক ডালে গিয়ে আশ্রয় নেবে প্রজাপতিটা। সত্যি করে বলো, তোমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না? পথ হারিয়ে হঠাৎ চলে যেতে ইচ্ছে করে না সে পথে?
—দেখো, চিত্র কিংবা বিচিত্র সব কিছুর মধ্যেই একটা গোপন টান আছে, সেটা স্বীকার করি। আরও সেটা প্রবল হয়ে ওঠে নির্মাণকারী যদি সেটিকে পূর্ণ শৈল্পিক রূপ দিতে পারেন। কিন্তু সত্যিই কী সুন্দর ছোঁয়া যায়? সব বাস্তবে কি মানুষের প্রবেশ ঘটে কখনো?
—কেন নয়? কেন ধরা যাবে না সুন্দর? আমি যখন চোখ বন্ধ করি, তখন মিশমিশে কালোর জগৎ চারদিক। তাহলে কার জন্য পৃথিবীর এই সুন্দর! কেন এই মানবজন্ম!
ওর কথার জবাব দেওয়াটা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। সুন্দর ধরার চেষ্টায় ও এখন শুধু তর্কই করবে। অথচ আমি টের পাচ্ছি, কোথায় যেন একটা গোপন ঘণ্টা বাজছে। কেন, কিসের জন্য! না, না সুন্দর স্পর্শ সত্যিই করতে নেই।
—আচ্ছা তুমি কখনো আগুন দেখেছ ভালো করে? ধিকিধিকি কিংবা লেলিহান। সেখানে কি সুন্দর দেখতে পাওয়া যায় না? ধরতে ইচ্ছে করে না জ্বলন্ত অঙ্গারকে?
—হ্যাঁ, আগুনেরও সৌন্দর্য আছে, স্বীকার করছি। কিন্তু সেটা স্পর্শ করতে গেলে তো কেবল যন্ত্রণা আর ছাই পড়ে থাকে।
—আমি যদি সত্যিই নার্সিসাস হতাম, তাহলে একদিন যে আত্মছায়া ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল অস্তিত্ব, তা আবার ছুঁয়ে দেখতাম। সুন্দর ধরা আমার নেশা।
ও একটা ম্যাচ বের করে ঘরের এক কোণা থেকে। তারপর ফস করে একটা কাঠি জ্বালায়। কতক্ষণ সেদিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে কী যেন বিড়বিড় করে।
—নার্সিসাস আগুন ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল নিশ্চয়ই। এর ভেতরের ক্ষরণ, উত্তাপ, জ্বলন্ত সম্ভাবনা সব হয়তো ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল ও। নার্সিসাস ও নার্সিসাস, তোমার নিজের মতোই সুন্দর এই আগুন।
ও আঙুল দিয়ে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠিটাকে চেপে ধরে। খানিক সময়ের জন্য বাতাসে কেমন যেন গন্ধ ছড়ায়। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হয় কিসের একটা গোপন আনন্দ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ওকে। ও যেন ঘরের চারকোণে কিছু বীজ বুনে দিতে চায়। ক্ষ্যাপামি, উদ্ভট আচরণ, অহঙ্কার আর অলৌকিক সৌন্দর্যের চারা। ক্যানভাসগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে ও বলতে থাকে—A foot he viewed a silver lake, and took himself to take a drink. then beauty moved his thirsting soul, as there he bent above the bring…
—জানো, তৃষ্ণার জল জল দেখতে গিয়ে পান করা ভুলে সেটি যদি কেউ ছুঁয়ে দেখতে চায়, তবে আজও তাতে নিজেরই ছবি ভাসে। তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ, সৌন্দর্য কেবল জীবনটাকে পোড়ায়, তাড়িয়ে বেড়ায় দিকবেদিক তার ভাণ্ডারের লোভ দেখিয়ে। আর যেই না ছোঁবে তুমি, অমনি সেই গনগনে সুন্দর, অমনি আমার মতো বন্দি হবে এক মরণকৌটায়। তারপর খুলে যাবে প্যান্ডোরার বক্স, যন্ত্রণা, মন্ত্রণা আর জ্বালামুখ ঘিরে ধরবে জীবন।
ক্যানভাসের ছবিতে একটি সাদা ফুল ঝুঁকে পড়ে সরোবরে দেখছে তার ছায়া। সরোবরের শান্ত জলে তার তরঙ্গ। তবে ফুলের চারপাশ ঘিরে এখন এক বিষণ্ন অদৃশ্য তরুণের মুখ যেন তাকিয়ে সরোবরের জলে।
ওর চেহারাটা দীরে ধীরে যেন জান্তব হয়ে উঠছে। ও দুই হাত মেলে শূন্যে ভাসার ভঙ্গি করে। হঠাৎ চমক লাগে, কী আশ্চর্য ওর এই ভয়ঙ্কর চেহারাটাও যে এতটা সুন্দর হয়ে উঠবে, ভাবতে পারিনি। যেন এক্ষুণি অলৌকিক বৃক্ষডাল থেকে তার রাজকীয় পাখা মেলে উড়াল দেবে এক স্বর্ণ ঈগল। ভয়ঙ্কর সুন্দর আর হিংস্রতা মিশে যেন ওর ছায়াটা রূপ পেয়েছে এক প্রাগৈতিহাসিক পাখিতে। ও যেন উড়ে বেড়াতে থাকে ঘরের এ কোণে ও কোণে, দেয়ালে, ক্যানভাসে।
—নার্সিসাস, তুমি কি সত্যিই নার্সিসাস? ইকোর দীর্ঘশ্বাস মাখা প্রতিধ্বনি!
—জানি না, আমি কিছুই জানি না। কেবল জানি এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে নেমেসিসের অভিষাপ অদৃষ্টে সত্যিই বন্দি হয়ে পড়ে কেউ কেউ। আজ আমি আমার রহস্যে মুগ্ধ। আজ আমি আমার জীবন নিঙ্ড়ানো সৌন্দর্যে অভিভূত।
—তাহলে ইকো, দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি, তোমার রূপমুগ্ধ প্রেমিকা?
—সে তো আছে সর্বত্র। আমার পাপ, পুণ্য, হতাশা, সৌকর্য, সৌন্দর্য যেখানে শেষ, সেখানেই তার প্রতিধ্বনিময় উপস্থিতি। আমার শেষ চিহ্নের যে সাদা ফুল, ইকোর দীর্ঘশ্বাস তারই সুবাস।
—কিন্তু এখন আর তোমাকে নার্সিসাসের মতো লাগছে না। তুমি আসলে অন্য কেউ। আমার ভেতরের কেউ, না কি ছায়া? কেমন কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর ঘিরে ধরেছে তোমাকে।
ওর চোখ জ্বলতে থাকে। আমার কথা শুনে কেবল অবজ্ঞার একটা চিকন রেখা ওর ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেলো। নাকি ও নার্সিসাস! আত্ম সৌন্দর্যে মোহাবিষ্ট চির অহঙ্কারী যুবক। সে একটা সাদা ক্যানভাস বের করে। ঘোলাটে সাদার সেই ক্যানভাসে যেন বিষণ্ন আকাশের প্রতিচ্ছবি।
—সুন্দর দেখবে, সুন্দর ধরতে চাও? আজ এই সাদা ক্যানভাসে আমি নিজের সৌন্দর্য ফোটাবো। কোন রঙে-লাল, নীল, হলুদ নাকি গাঢ় সবুজ। অথবা সাদা হলেও ক্ষতি কী? না কি কালো অন্ধকার মিশিয়ে!
—দেখো, সুন্দর আমি ধরতে চাই না। সেটা স্পর্শ করতে নেই। সৌন্দর্য কেবল শোভা পাক, খেলার বস্তু যেন না হয়। কিন্তু আমি যে নেশাময়। দেখবে এই নান্দনিক নাটুকে সৌন্দর্য কেমন করে বন্দি হয় অভিশাপের কাছে।
ও ঠিক যেন পাগল হয়ে গেছে। একের পর এক রঙ ঢালে, রঙ মেশায়। রঙে যেন ভবিষ্যতের বুদ্বুদ। সময় এগুতে থাকে। আমার নিষেধ অমান্য করে ক্যানভাসে চলতে থাকে তুলি। কোথাও গাঢ়, কোথাও আভাস, কোথাও যেন রঙ বিস্ফারিত সে ছবি। একটি সাদা ফুল ঝুঁকে পড়ে সরোবরে তার ছায়া দেখছে। সরোবরের শান্ত জলে তার তরঙ্গ। ফুলের চারপাশ ঘিরে এক বিষণ্ন অদৃশ্য বালক মুখ। যেন তাকিয়ে সরোবরের জলে। তাদের পেছনে তিরতির করে কাঁপছে একটি গাছের ডাল। যেন প্রতিধ্বনি করছে ইকোর দুঃখ হয়ে—না, না, না। আর চারদিকে তখন গোধূলি বেলা।
ছবিটি দেখে আমার চোখ সরে না। মুখের ভাষা যেন মুখেই মিলিয়ে যায়। এত সুন্দর কেন, উফ, এতো সুন্দর, এতো অসহ্য সুন্দর! ছবির বালকটির মুখ যেন আমারই আদলে গড়া। আসলে যেন আমিই সরোবরে ঝুঁকে দেখছি প্রতিবিম্ব। কোথায় সৌন্দর্য, কত অতলে, কতদূরে তুমি চির রহস্য?
ও আমার চারপাশে তখন ঘুরে চলেছে। ছবিটাকে এ কোণা ও কোণা থেকে দেখছে চিলচক্ষু দিয়ে। কখনো কখনো পাগলের মতো বাটিতে রঙ ঢালছে, মেশাচ্ছে। এটার সঙ্গে ওটা, ওটার সঙ্গে অন্যটা। তবু যেন তৃপ্তি নেই।
না, পারছি না। শেষ গোধূলি লগ্নের রঙ চাই আমার। যেমন জীবন পৌঁছায় স্বায়ন্বে।—কী, কেমন, কোথায় সেই রঙ! ও চিৎকার করতে থাকে পাগলের মতো। যন্ত্রণায় ছটফট করে, মাটিতে মোচড়াতে থাকে, কামড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে তোলে নিজেকে অপার্থিব সেই রঙ আবিষ্কারের নেশায়। এরপর একসময় হঠাৎই যেন থেমে যায়। ঘরের সাদা দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে জানি না। এরপর চকিতে নিস্তব্ধতা ভাঙে।
—এই সুন্দর, অহস্য সুন্দর, কে বসে আছি এর পাশে? তুমি, আমি না কি নার্সিসাস! দেবী লেরিওপে যখন ভবিষ্যতের কথক টাইরেসিয়াসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—এই সৌন্দর্য সন্তানের পরমায়ু কতখানি? অন্ধ টাইরেসিয়াস বলেছিলেন—যতদিন না সে শুধু নিজেকে ভালোবাসে। টাইরেসিয়াসের ভবিষ্যতের মতো আজ তুমি-আমি এক হয়ে গেছি। সৌন্দর্যে অপূর্ব অহঙ্কারী নার্সিসাস আজ শুধু নিজেকে নয়, সে আজ আবার ভালোবেসে ফেলেছে তার ছায়াকে। মুগ্ধতার এই আত্মদান এখন তাকে দিতেই হবে। তবু যদি ইকোর ভালোবাসা একবার ফেরাতে আমাকে। হে দেবী, মহামান্য মাতা, তুলে নাও ইকোর অভিশাপ। প্রতিধ্বনি ভুলে এবার না-হয় ভাষার ভালোবাসায় ও ফিরিয়ে নেক আমার সর্বনাশের মুখ থেকে।
রঙ মিশেলের মুর্তিমান মুগ্ধতা তখন গ্রাস করেছে ঘর। ক্যানভাসের ছবিতে একটি সাদা ফুল ঝুঁকে পড়ে সরোবরে দেখছে তার ছায়া। সরোবরের শান্ত জলে তার তরঙ্গ। তবে ফুলের চারপাশ ঘিরে এখন এক বিষণ্ন অদৃশ্য তরুণের মুখ যেন তাকিয়ে সরোবরের জলে। তাদের পেছনে তিরতির করে কাঁপছে একটি গাছের ডাল। যেন প্রতিধ্বনি করছে ইকোর দুঃখ হয়ে—না, না, না। শুধু তখন গোধূলির রঙ আগের চেয়ে অনেক গাঢ়, অনেক স্পর্শী আর সুন্দর। কেবল মেঝেতে রক্তের একটা লাল ধারা গিয়ে মিলেছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রঙ-গালিচায়।