এক.
হাউ টু প্রিপেয়ার ফর দ্যাট জব? নিজের সঙ্গে গল্প করা? না মোটেও সহজ কাজ নয়। কাজটা এখনপর্যন্ত করে দেখা হয়নি। অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সে। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের বোঝাপড়া চলছে। এই উদ্দেশ্যেই সে স্থিরচিত্তে দাঁড়ায় বিশালাকৃতির আয়নার সামনে। শরীরের ভেতরও থাকে আরেকটা শরীর, সেই শরীর অনুভূতির, অনুভবের, সে দেখে নিতে চায় তার ভেতরের আকাঙ্ক্ষা, অপ্রাপ্তি, দ্বেষ, কলুষতা। কিন্তু সে যা দেখতে চায়, তা দেখতে পাচ্ছে না, বরং তার দৃষ্টিজুড়ে শীতের একরোখা কুয়াশা ছাড়া অন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রক্তমাংসের শরীরটা মাঝেমাঝে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে আয়নায়, তবে কি শরীরের ভেতরের শরীর দেখার জন্য অন্য কোনো দৃষ্টিশক্তি থাকা প্রয়োজন? সেই দৃষ্টিশক্তি কি সে হারিয়ে ফেলেছে? শরীরের ভেতরের শরীরে প্রবেশের অনুমতি সে পায় না, বাধ্য হয়েই সে দেখতে থাকে, তার উনিশ বছর বয়সের যৌবন। চিকন চালের মতো ঠোঁটজুড়ে এক ধরনের মদির আকাঙ্ক্ষা। অবহেলায় বয়ে চলা চিবুক যেন মিহি বালির ধারালো শাঁস। অচঞ্চল গ্রীবা নেমে গেছে আগন্তুক পাহাড় অভিমুখে, পাহাড়ের গাজুড়ে রঙ-বেরঙের ফুল। বাহু দুটো খুঁজে নিচ্ছে প্রান্তিক সীমানা। না, কোথাও অতিরিক্ত কোনো ফ্যাট নেই। আগুনরঙা মসৃণ পেট যেন পুরনো পেঁয়াজের খোসা। নাভিমূলে মুখ গুঁজে খেলা করছে সৌন্দর্যলীলা। নিজেকে দেখে খুবই হতবাক হলো সে। নিজেই আন্দাজ করছে সে নিজ শরীরের উত্তাপ। নাহ, এভাবে হয় না। একটা সিগারেট ধরানো প্রয়োজন। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়, টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। লাইটারটা জ্বালাতে গিয়েও কী ভেবে জ্বালায় না। ঠিক কী বিষয়ে গল্প করবে? রি-উইন্ড করে দেখবে তার অতীত? কিন্তু রি-উইন্ড করবে কোন অংশ থেকে? তার জন্মের আগে থেকে করতে পারে। চাইলে করতে পারে তার শিশুবেলা থেকেও। টিনএজের আরম্ভ থেকেও করা যায়। আর যৌবনকাল থেকে তো করাই যায়। প্রত্যেকটা অংশই আলাদা আলাদা, অ্যা কমপ্লিট স্টোরি। বাট সি উ’ডোন্ট এক্সপ্রেস অল দ্য থিংস। যেটুকু না বললেই না, সেটুকুই বলবে। মা মারা গেছিলেন তার জন্মের সময়। ড্যাড আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। বিয়ে না করে তার লাভ হয়েছে। তিনি তার ইচ্ছেমতো যা খুশি, তা করেন। হি ইজ আ ব্লাডি বুলশিট, খুব খারাপ একজন মানুষ। নিজের বাবা সম্পর্কে বাজে বলা হচ্ছে? বাট দ্যাট ক্রুয়েল ম্যান ডিসার্ভ ইট। দ্যাট ম্যান জাস্ট কিলড হিজ ওয়াইফ। নাওয়াল তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। অনলি ড্যাড নোজ এবাউট হিজ ওয়েলথ, দ্য সোর্স অব হিজ ই্ললিগ্যাল প্রোপার্টিজ। সে নিজেও জানেনা তারা কী পরিমাণ রিচ। একচুয়ালি সি ডি’ডোন্ট ওয়ান্ট টু নো। নাওয়ালের ঘরটা শাদা ওয়ালম্যাট দিয়ে মোড়ানো। ঘরটা বলতে ঘরের দেওয়াল-ফ্লোর সব। বাসিন্দা সাকুল্যে তিন জন—সে, একটা কিং সাইজের বেড সঙ্গে ড্রেসিং আয়না। অনিয়মিত বাসিন্দা হিসেবে খুব দুর্নাম তার। ধুর কিছুই ভালো লাগছে না নাওয়ালের। ব্লাকবেরি ডিটিইকে৫০ মডেলের মোবাইলটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। কে আবার কল দিলো? অসময়ের ফোনে মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো নাওয়ালের। অল দ্য ব্লাডি ফাকার আর সেইম।
হ্যালো, ইয়েহ, ওহ ডুড! এই সময়ে?—লকলকে শাদা রঙের গাউনটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলে নাওয়াল।
ইয়েহ বেবি, কাম অন, হারি আপ।
ক্যান ইউ সে হোয়াট হ্যাপেন্ড, ডিয়ার।
এখুনি বেরিয়ে আয়, আই অ্যাম ওয়েটিং।
হ্যাভ উ এনি আইডিয়া? বাজে ছেলে।
নো প্রব বেব্বি, কাম অন, প্লিজ। বিপরীত দিক থেকে সাইমনের উত্তেজিত কণ্ঠ।
কী এমন হলো এই মধ্যরাতে! নিশ্চয় কোনো ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ পেয়েছে। একটা ইয়োলো কালারের টি-শার্ট পরলো নাওয়াল। সঙ্গে ব্ল্যাক কালারের ব্রুক শিল্ড’স জিনস। মানিব্যাগ—মানিব্যাগে সবসময়ই টাকা থাকে তার। টাকা না থাকলে কার্ড তো আছেই। নাওয়ালের বাবা এসব ব্যাপারে খুবই লিবারেল। বাবা লিবারেল হবেন নাই বা কেন?
কি রে কই তুই? আয় জলদি। সাইমনের যেন তর সইছে না আজ। হোয়াট হ্যাপেন্ড উইথ দিজ ক্রেজি গাই। কে জানে কী হয়েছে আজ ওর!
ফুপিমা, আই অ্যাম গোয়িং উইথ সাইমন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো কথাগুলো। ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতালায় নাওয়ালের শোবার ঘর। ঠিক পাশের ঘরেই থাকেন তার ফুপিমা। কখন ফিরবি, বলে যা, বিব্বি—কঁকিয়ে উঠলেন ফুপিমা তার ঘর থেকেই।
আই ডোন্ট নো, প্লিজ ডোন্ট ওয়েট—ওদিকে অনবরত ফোনে কথা বলছে সাইমন। সাইমনের কথায় অবশ্য এখন মনোযোগ নেই। সে এখন কথা বলছে ফুপিমার সঙ্গেই।
তোমার বাবা কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে। চলে এসো বিব্বি, এত রাতে বাইরে? বাসাতে সবাই তাকে বিব্বি বলেই ডাকে। বন্ধুরাও সবাই এই নামেই ডাকে তাকে।
হু কেয়ারস ফুপিমা। তুমি তো জানোই—বলতে বলতে ঝড়ের বেগে দৌড়ে নেমে যায় নাওয়াল।
হোয়াট অ্যা প্লিজ্যান্ট সারপ্রাইজ ইট ইজ? সাইমন ছাড়াও আরও তো অনেকেই এসেছে। নাওয়ালকে দেখেই সবাই একসঙ্গে চিৎকার করল। হোন্ডা সি আর ভি-র দরজা খোলা। ভেতরে গাদাগাদি করে বসে আছে রহিয়া, সিনথিয়া, ইমরোজ, আনিফ, কুন্তল, রাজ। সামনের সিটে বসে আছে গাড্ডু নিখিল। ও একটা আস্ত শয়তান, ভীষণ ফাজিল।
হাই বিব্বি, ইউ আর লুকিং ইরোটিক—সামনে থেকে পেছনে তাকিয়ে বললো নিখিল।
ইউ বিচ, তোর ধান্দা তো এদিকেই—বললো সিনথিয়া, তার মুখে কপট হাসি। ইনফ্যাক্ট ইউ আল গার্লজ লুকিং সেক্সি। নিখিল মানেই এমন, অলওয়েজ ধান্দাবাজ, দুষ্টু।
হোয়ার উই আর গোয়িং, প্লিজ মেক মি ক্লিয়ার। সাইমনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো নাওয়াল।
গোয়িং টু টেস্ট আ নিউ এক্সপিরিয়েন্স—ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সাইমন, হাসছে।
মিনস হোয়াট, কী হতে যাচ্ছে বলতো? সিনথিয়া বলে উঠলো পেছনের সিট থেকে—মানে তুইও জানিস না, কিরে রিয়া?
১২৯ নাম্বার রোড থেকে বেরিয়েছে গাড়িটা। এক নম্বরে টার্ন নিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে। রাস্তা চুপচাপ, খাবার দোকানগুলোর সামনে ভিড়। কোথায় যে যাচ্ছে এরা, কে জানে? মিনিট সাতেকের ভেতর গাড়ি থামালো সাইমন।
এই নাম, নাম, হারি আপ, প্লিজ। গাড়িটা পার্ক করানোর সময় পর্যন্ত নাই।
হোয়াট ইজ গোয়িং টু বি হ্যাপেন?
হবে হবে, আগে নাম তো, আ বিগ সারপ্রাইজ!
গাড়ি থেকে সবাই হুড়মুড় করে নামলো। তাড়াহুড়া করে ঢুকে পড়লো বনানী এগারো নাম্বার রোডের হোটেল বারিন্দে।
দুই.
লাইফ ইজ এক্সট্রিমলি বোরিং। যখন যেখানে যেতে ইচ্ছা করছে যাচ্ছে, যখন যা করতে ইচ্ছা তাই করেছে। এইতো গতমাসেই স্টেটস থেকে ফিরে এসেছে নাওয়াল। ড্যাড এসবে কখনো বাধা দেননি। ইনফ্যাক্ট এই ভদ্রলোকের সেই সাহস নেই। মা বেঁচে থাকলে কি এমন হতো? মাঝে–মাঝে আত্মহত্যার কথা ভাবে কিন্তু ফুপুম্মাকে ফেলে কোথায় যাবে নাওয়াল?
বিব্বি, কী ভাবছিস মা, ঘুমাবি না?
এত রাতে ফুফুমা জেগে আছে কেন? নাওয়াল ভেতরে গিলে নেয় এলোমেলো ভাবনাগুলোকে।
তুমি এত রাতেও ঘুমাওনি, ফুপুম্মা!—বিস্ময়ের ঢেউয়ে নিজেকে ঠেলে দেয় নাওয়াল।
নারে ইদানীং ঘুম পায় না কিছুতেই।
তুমি তো আমার কথা নকল করছো।
তোর কথায় তো আমার কথা রে।
ও মাই বেবি, কী পেলে জীবনে?
জীবন! তুই জানিস জীবন মানে কী? শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে কথাগুলো বলেন হালিমা।
বেবি, এই আমার জীবনের কথাই ভাব। মা মারা গেলো আমার জন্মের সময়েই। ড্যাড থেকেও নেই। আমিও কি কম?
বিব্বি, মা আমার। সোনা মা, জীবন অনেক সুন্দর। নাওয়ালের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে কথাগুলো বলে হালিমা।
আচ্ছা তুমি বিয়ে না করে এ বাড়িতে থেকে গেলে ক্যানো? হোয়াই?
মারে, তোর মা মারা যাওয়ার সময় তোর বয়স মাত্র তিন মাস। তোর নানা-নানিও বেঁচে ছিলেন না। কার কাছে ফেলে যেতাম তোকে? আমার সোনা বিব্বিটা, ঘুমা। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমা সোনা।
নাওয়াল ঘুমানোর ভান করে, কারণ সে ভালো করেই জানে, সে না ঘুমানো পর্যন্ত এই মহিলা সারারাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই থাকবেন। খামোখা তাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে ঘুমানোর ভান করলে কিছু সময় পর এমনিতে ফুপুম্মা তার নিজের ঘরে চলে যাবেন। ফুপুম্মার কথা ভেবে অবাক হয়ে যায় নাওয়াল। শুধু নাওয়ালের কথা ভেবেই ফুপুম্মা এই সংসারে থেকে গেছেন, নিজের কথা এতটুকুও ভাবেননি, কিছু কিছু মানুষ ক্যানো এমন হয়, অন্যের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেয়। বাবা-মায়ের বিয়ের প্রায় এগারো বছর পর নাওয়ালের জন্ম। ফুপির কাছে শোনা, নাওয়ালের বাবা চাকরি করতেন, সরকারি চাকরি। আর্কিটেক্ট। হঠাৎ তার মাথায় ব্যবসার ভূত চাপে। গভর্নমেন্ট জব ছেড়ে ঊনিশ ঊননব্বই সালের দিকে তিনি ব্যবসা আরম্ভ করেন। ডেভেলপারের ব্যবসা। বুয়েট থেকে পাস করা মেধাবী জালাল উদ্দীন পাটোয়ারী খুব অল্প দিনেই ব্যবসায় ভালো করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন, অর্থের নেশা পেয়ে বসে তাকে। বৈধ-অবৈধ উপায়ে তিনি বছর বিশেকের মধ্যেই দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। বর্তমানে প্রায় কুড়িটি ছোট বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক। টিভি চ্যানেল, পত্রিকার মালিকানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস ব্যবসা, শেয়ার বাজার, ম্যান পাওয়ার রিক্রুটিং এজেন্সি বহুবিধ ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়েছেন তিনি। সন্তান জন্ম দেওয়া খুব সহজ কাজ, যদিও জালাল আর মাধবী সন্তান পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে প্রায় এগার বছর। কত আদরে সন্তান, কত আরাধনার সন্তান। নাওয়ালের জন্মের মাত্র তিন মাসের মাথায় মারা যান মা। মায়ের সম্ভবত পোস্টপারটাম কার্ডিওমায়োপ্যাথী নামের অসুখ হয়েছিল। নাওয়ালের জন্মের পরপর মায়ের নাকি একটু নড়াচড়া করলে বা একটু পরিশ্রমেই খুব শ্বাসকষ্ট হতো। মায়ের কষ্টকে গুরুত্ব দেননি বাবা, টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে অন্ধ হয়ে গেছিলেন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে মারা যান মা, হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। বড় হতে হতে এ কথাগুলো সে শুনেছে ফুপুম্মার কাছে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরও ব্যবসামুখী হয়ে পড়েন, জড়িয়ে পড়েন অবৈধ সম্পদ আহরণের দিকে, নারীসঙ্গ আর নেশায় ডুবে যান তিনি। টাকা দেওয়া ছাড়া নাওয়ালের প্রতি কোনো দায়িত্বও পালন করেননি বাবা! সন্তান জন্ম দিলেই তো কেউ বাবা হয়ে যায় না, বাবা হওয়া খুব কঠিন কাজ। বাবা যেমন বাবা হয়ে উঠতে পারেননি, তেমনি নাওয়াল নিজেও সুসন্তান হয়ে উঠতে পারেনি। ইচ্ছামতো টাকা উড়িয়েছে, নেশা, পার্টি, সম্পর্কে জড়িয়েছে, ভেঙেছে, কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে, সে চেষ্টা সফলতার মুখ দ্যাখেনি, যদিও ব্যাপারটা একবার হাসপাতাল অব্ধি গড়িয়েছিল।
তিন.
হোটেল বারিন্দের পার্টিটা অসাম। পুরো পার্টি স্পন্সর করেছে সিনথিয়া। সিসার সঙ্গে আফিমের নেশাটা জমেছে খুব। বাকার্ডি, কোরিয়ান রাম আরও কী কী যেন আছে মেন্যুতে। সবাই যার যার পছন্দমতো ড্রিঙ্ক করছে। রহিয়া, সিনথিয়া, ইমরোজ, আনিফসহ বন্ধুদের প্রায় সবাই সারারাত হোটেলেই, ডি-জে পার্টিটাও সেইরকম, কুল! নাওয়ালও মেতে উঠেছে। বন্ধুরা যে যার সঙ্গে ইচ্ছামতো ড্যান্স করছে, এসব পার্টিতে কোনো বাইন্ডিংস থাকে না, এমনকি কেউ কারও সঙ্গে বিছানা পর্যন্ত যেতে চাইলেও কেউ কাউকে নিষেধ করতে পারবে না, যার যা ইচ্ছা তাই করা যায়, এটাই শর্ত। নাওয়ালও এনজয় করছে খুব, ফুপিম্মা ফোন করছে বার বার, কিন্তু সবাইকে ছেড়ে বাসায় যেতেও ইচ্ছা করছে না নাওয়ালের। পার্টিতে সিনথিয়ার সঙ্গে একটি ছেলে এসেছে, সম্ভবত সিনথয়ার কাজিন। এমন কোনো পার্টি নেই, যেখানে নাওয়ালকে নিয়ে এক্সট্রা ইন্টারেস্ট শো করে না ছেলেগুলো। আর এখনও পরিচয় করিয়ে দেয়নি সিনথয়ার, মাদারফাকার মনে হয় নিজের কব্জায় রাখতে চায়। মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না, মাঝে আনিফ ড্যান্স করার জন্য টানাটানি করছিল। নাওয়াল একটু দূরে বসেছিল, একা প্রচুর ড্রিঙ্কস করছে সে, সিনথিয়ার কাজিন একে ওকে জড়িয়ে ড্যান্স করছে, আর রহিয়া! আ হোর, ছেলেটির সঙ্গে লেপ্টে আছে পুরোটা সময়। নাওয়াল ছেলেটিকে দেখেই বুঝেছে—এ ছেলে কোনো এক নির্দিষ্ট মেয়ের সঙ্গে আটকে থাকার ছেলে নয়। তাই বলে একবারও নাওয়ালের দিকে তাকাবে না! অ্যাবস্যার্ড, হতেই পারে না। একবার ইচ্ছা হচ্ছিল রহিয়ার মতো ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু খুব ইগোইস্টিক নাওয়াল। সে আরও মদ খাবে। কিছুতেই নিজে থেকে গিয়ে পরিচিত হবে না, না কিছুতেই না। ‘অল ব্লাডি আর মাদার ফাকার।’ মদের নেশায় জড়িয়ে যাওয়া শব্দগুলো হারিয়ে গ্যালো ডিজে মিউজিকের ভিড়ে।
ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ সেক্স উইথ মি? বাট নট টু ডে, এনাদার ডে। প্লিজ গো হোম নাও। রহিয়ার লিপসের সঙ্গে সেঁটে থাকা ছেলেটি, হ্যাঁ, সিনথিয়ার কাজিনই তো। কথাগুলো বলেই সে আবার জমে গ্যালো রহিয়ার ঠোঁটে।
মানে কী? নিজেকে কী ভেবেছে সে! ব্লাডি, বুলশিট, তোকে দেখে নেবে আমি। আর ও কিভাবে জানলো যে আমি বমি করেছি? আমি তো একা একা ফ্রেস রুমে গিয়ে বমি করলাম? তাহলে?—কথাগুলো শব্দ হয়ে উচ্চারিত হওয়ার আগেই আরেক পেগ চালিয়ে দিলো নাওয়াল। মেজাজ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে ওর শার্টের কলার ধরে ইচ্ছামতো থাপড়াতে, কিন্তু পারছে না, ওর পা দুটো সায় দিচ্ছে না।
নাওয়ালের যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে দুপুর আড়াইটা। পাশে বসা ফুপুম্মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ঠিকমতো চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না সে। চারপাশ কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া, আবছা, তার জীবনের মতোই, ফুপুম্মার জীবনের মতোই, কেমন যেন ঘোলাটে।
ফুপুম্মা আমি কয়টায় বাসায় ফিরেছিলাম?—ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সে।
রাত তিনটার দিকে, তোর মোবাইল থেকে একটা ফোন এলো, তোর বন্ধু সম্ভবত, কী যেন নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, মিনহাজ, হ্যাঁ মিনহাজই, বললো আন্টি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিন, নাওয়াল আজ একটু বেশিই ড্রিঙ্কস করেছে, কয়েকবার বমিও করেছে।
মিনহাজ? এ নামে তো আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই, হু দ্য হেল ওয়াজ দিস?
সামনে এসে দাঁড়ায় মিনহাজ, বলতে থাকে, শাড়িটা মায়ের, মাকে তো আমি দেখিনি, আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা আকাশ হয়ে গেছেন, আকাশ থেকেই আমার সঙ্গে কথা বলে মা, বাকি ছবিগুলো দেখছ না! ওগুলো মায়ের। আমিই এঁকেছি। আকাশ থেকে মা-ই বলেছেন, তোর জন্য একটা ‘উপহার’ আছে। কথাগুলো বলতে বলতে মিনহাজ ঘুরে দাঁড়ায়, আর দুই চোখের ভেতর শান্ত কোনো এক সমুদ্রের সমস্ত জলকে টলটলায়মান করে, মোচড়াহীন ঢেউ তুলে নাওয়ালের চোখে তাকায়
কী বলিস? পরে আবার ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, আন্টি, নাওয়াল ঠিকমতো বাসায় ফিরেছে? ওকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম তো!
আমি হ্যাঁ বলতেই কেটে দিলো—ফুপুম্মার মুখে বিস্ময়।
মানে? শালা কী ওই মালটা? মানে সিনথিয়ার কাজিন? না, হতেই পারে না। মনে মনে কথাগুলো আওড়ালো নাওয়াল। নাম্বারটা তো আছে, ফ্রেস হয়ে নিয়েই কল দিতে হবে, তার আগে সিনথিয়ার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।
বিব্বি, মা আমার নেশাটেশা ছেড়ে দে মা। জীবন অনেক সুন্দর। একে হেলায় হারাস না। কিছুতেই হারাস না মা। তোর মা সব দেখছে। সে কষ্ট পাবে।
বেবি, আমার ডারলিং, আমি আরও নেশা করবো, আমার কেউ নেই, কেউ আমাকে ভালোবাসে না, মা ক্যানো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কী দোষ ছিল, আমি কি জন্মেই পাপ করেছি? আর বাবা! আমি হারিয়ে যাবো— কথাগুলো বলতে বলতে হালিমার কোলে মাথা গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল নাওয়াল।
ফুপুম্মা আজ নাওয়ালের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। তার টানাটানিতেই বিছানা থেকে উঠে শাওয়ার নিতে যায় নাওয়াল। শাওয়ার নেবার পর থেকে শরীরটা খুব ঝরঝরে লাগছে, খিদেটাও চনমন করে উঠেছে। সবসময়ই ফুপুম্মাই তাকে তুলে খাইয়ে দেয়। এই মহিলাকে দেখেই নাওয়াল বুঝতে পারে মায়েরা মনে হয় এমনই হয়। কত যত্ন আরা ভালাবাসায় নাওয়ালকে আগলে রেখেছে ফুপুম্মা, কোনো স্বার্থ ছাড়া। জীবনে কোনোকিছু পাওয়ার আসা করে না এরা, শুধু অন্যকে দেওয়ার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে এই মানুষদের। মাঝে মাঝে ফুপুম্মার মতো ভালো মানুষ হয়ে যেতে খুব ইচ্ছা হয় নাওয়ালের।
চার.
হেই বিচ, সিনথিয়া? ওয়াজ দ্যাট ইয়োর স্টুপিড কাজিন? আ ব্লাডি বুলশিট, ও তো একটা হারামি, কাল পার্টিতে কী বলেছিল জানিস? প্রায় চিৎকার করেই কথাগুলো বললো নাওয়াল।
হ্যাঁ, জানি তো, তোর সঙ্গে সেক্স করার প্রপোজাল দিয়েছে। ওপার থেকে সিনথিয়ার ঠাণ্ডা মাথার জবাব।
আই উইল কিল দ্যাট ব্লাডি, জারজ একটা। সে আমাকে এ কথা বলার সাহস পায় কোথা থেকে? চিৎকার এবার রাগে টার্ন নেয়। রাগে কাঁপতে থাকে নাওয়াল। ওহ, ইজ ইট? তুই আবার কবে থেকে তুলশি পাতা ধোঁয়া পানি হয়ে গেলি? মনে হচ্ছে তুমি কারও সঙ্গে বিছানায় যাও না? ওপাশ থেকে ভেসে আসে সিনথিয়ার ঠাট্টা মিশ্রিত কণ্ঠ।
চুপসে যায় নাওয়াল, সত্যি তো সে নিজেও তো কতজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে। ফিজিক্যাল রিলেশন তাদের ফ্রেন্ডসার্কেলের কাছে এন্টারটেনমেন্টের আর পাঁচটা উপাদানের মতোই, যে কেউ যখন খুশি যেভাবে খুশি নিজেকে ইউজ করছে, ইউজড হচ্ছে।
দ্যাট মিনস তুইও তোর কাজিনকে সাপোর্ট করছিস, বাই দ্য ওয়ে হারামিটার নাম কী? মিনহাজ?
হি ইজ আ জেনুইন ম্যান, লেগে যা, ইউ উইল বি আম্যাইজড!
মানে তুমিও? কাজিনের সঙ্গে? দাঁড়া হারামিটাকে আমি দেখে নেবো, বলতো নেক্সটে কে পার্টি থ্রো করেছে? প্রতিশোধের তীব্র আগুনে জ্বলছে নাওয়াল, মন মনে ভাবছে একে ছাড়া যাবে না, এমন প্যাঁচে ফেলবে যে হাঁসফাঁশ করতে করতে মরবে।
ওর নিজের একটা ফ্ল্যাট আছে গুলশান একাত্তর নাম্বার রোডে, একা থাকে, চাচ্চুর সঙ্গে বনিবনা হয় না বলে চাচ্চু ওকে এই ফ্ল্যাট দিয়ে দিয়েছে, ওটা ওর পারসোনাল ওয়ার্ল্ড, কাউকে নেয় না ওখানে, কাউকেই না।
তো আমি কী করব? ওকে আমি দেখে নেবো।
নেক্সট পার্টি থ্রো করছে আনিফ, মিনহাজ থাকছে ওখানে।
মনে মনে প্ল্যান আঁকে নাওয়াল। কিভাবে ঘায়েল করা যায় মিনহাজকে, নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবছে সে, নাওয়ালও কম যায় না, মিনহাজকে সবার সামনে অপমান না করলেই নয়, এ তার প্রতিজ্ঞা। আরেকটা প্রশ্ন মনের ভেতর ঘোরপাক খাচ্ছে নাওয়ালের, কী ভেবে ছেলেটি গাড়িতে উঠিয়ে বাসায় পাঠিয়েছিল তাকে? কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়ত কোনোদিনই মিলবে না, মেলে না।
আজকে আনিফের পার্টিটাও জমবে খুব, আজ নাকি সেই মিনহাজ না ফিনহাজ ছেলেটাও আসবে, আজকেই কোপ মারতে হবে। নাওয়াল খুব করে সাজলো আজ, পোশাকের ব্যাপারেও খুব উদার আজ সে, তার রুপ দিয়ে আজ মিনহাজকে ঘায়েল করবে, যেভাবেই হোক। প্ল্যান মোতাবেক সে পৌঁছে যায় পার্টি ভেন্যুতে। আজ ওয়েস্টিনে জন্মদিনের পার্টি থ্রো করেছে আনিফ। ততক্ষণে অনেকেই এসে পৌঁছেছে, নাওয়াল পৌঁছানো মাত্রই বন্ধুদের মাঝে একটা হুল্লোড় পড়ে গেলো।
হাই ড্যুড, ইউ আর লুকিং সো ইরোটিক। আজ থাকবি? স্যুট বুক করা আছে। জমবে কিন্তু। সেইরকম! ইমরোজ অনেকটা দৌড়ে এসে হাগ করল নাওয়ালকে, কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল কথাগুলো।
একটু হাসল নাওয়াল, এই হাসির অর্থ হ্যাঁ হতেও পারে, না হতেও পারে। নাওয়াল মুহূর্তের মধ্যে চোখ বুলিয়ে নেয় পুরো হল রুমটার চারিদিকে। তার চোখ খুঁজছে অন্য কিছু, অন্য কাউকে। আজ তাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।
এই যে সোনামণি, খুব তো সেজেগুজে এসেছো, ওই দ্যাখো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলে সিনথিয়া।
দ্যাখ কী হাল করি আজ, আই উইল ব্লাস্ট দ্যাট ব্লাডি। রাগটাকে চেপে মুখের হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করে নাওয়াল।
যা ভেবে এসেছিল, তার কিছুই হলো না আজ। কোনো সুযোগই পেলো না সে। মিনহাজ আজ চুপচাপ বসে থাকলো, নাওয়াল খেয়াল করলো পুরোটা সময়, না, একবারও ড্রিংক্স করেনি, কাউকে জড়িয়েও ধরেনিই, কিস করেনি। নেতিয়ে পড়েছে মনে হয়, হয়ত বুঝতে পেরেছে নাওয়াল তাকে নাজেহাল করবে আজ। নাওয়ালও কোনো জোশ পেলো না, পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছাই নেই নাওয়ালের, এতে মজা নষ্ট হয়ে যায়, আরেকদিন ধরতে হবে একে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে আর ধরা হয় না মিনহাজকে, মানে ধরতে পারে না নাওয়াল, পরের সবগুলো পার্টিতে এসেছে মিনহাজ, সবগুলো পার্টিতেই সে চুপচাপ, মদ খায় না, কারও সঙ্গে ড্যান্স করে না। নাওয়ালের কি প্রতিশোধ নেওয়া হবে না?
পাঁচ.
হ্যালো, নাওয়াল আমি মিনহাজ বলছি, হাউ আর ইউ? তুমি আমার ফ্ল্যাটে আসবে? এড্রেস এস এম এস করে দিচ্ছি, ইচ্ছা হলে এসো, আই অ্যাম হেয়ার অল ডে লং। নি্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলে লাইনটা কেটে দেয় মিনহাজ। ধন্ধে পড়ে যায় নাওয়াল। খুব অবাক হয়। প্রায় মাস তিনেকের পরিচয় এই ছেলের সঙ্গে। পরিচয়ের আগেই এ ছেলে সরাসরি নাওয়ালকে তার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, আজ আবার সরাসরি ফোন করে নিজ ফ্ল্যাটে ডাকছে? সিনথিয়া তো বলেছিল, মিনহাজ তার ফ্ল্যাটে কাউকে কোনোদিন ডাকে না। যদি মিনহাজ তার প্রথম দিনের সেই প্রস্তাব করে বসে আবার? এই জন্যই কি সে নাওয়ালকে ডেকেছে নিজের ফ্ল্যাটে। সিনথিয়াকে একটা কল দিয়ে দেখবে? না এটা করা যাবে না, সিনথিয়া মুহূর্তেই রাষ্ট্র করে দেবে এই খবর। নাওয়াল ডাকাবুকো মেয়ে, সে ভয় পায় না, সে কি যাবে মিনহাজের ফ্ল্যাটে?
প্রায় আধাঘণ্টা ধরে বাথটাবে ডুবে আছে নাওয়াল, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, যাবে কি যাবে না, শাওয়ার নেওয়া শেষ করে দাঁড়ালো আয়নার সামনে, একটা শাদা টি শার্ট সঙ্গে একটা ব্ল্যাক জিনস পরে নিলো। বাবরি কাটের সদ্য স্নান সেরে নেওয়া চুলগুলো এখনো ভেজা। ছোট ছোট চুল চুইয়ে এক ফোঁটা দুই ফোঁটা করে পানি ঝরছে, মাথাটা এদিক ওদিক ঝাঁকালো বার কয়েক। ভাবনাটা পিছু ছাড়ছে না, সে কি যাবে? না কি যাবে না—এলোমেলো ভাবনারা একসময় স্থির হয়, নাওয়াল সিধান্ত নেয়, সে যাবে মিনহাজের ফ্ল্যাটে। নাওয়াল ড্রাইভারকে সঙ্গে নেয় না আজ।
কলিং বেল চাপ দেওয়ার আগেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যায়, মিনহাজের মুখে হালকা হাসির ছটা ঘোরপাক খাচ্ছে। দরজায় কে আসছে, না আসছে সব ভেতর থেকে ক্যামেরার সাহায্যে দেখছে সে!
জানতাম তুমি আসবে, এসো, এসো। এদিকটায়, এখানে বসো। আমি আসছি একটু। মেজাজ খারাপ করার মতো কথা না—আ-মি জা-ন-তা-ম তু-মি আ-স-বে! আজ নিজেকে শান্ত রাখবে এই সিদ্ধান্তে অনড় নাওয়াল। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পড়ে, প্রায় মিনিট তিনেক একা বসে আছে সে, এটা কোন ধরনের ইতরামি।
তুমি শাড়ি পরতে পারো—ভেতর থেকে একটা প্যাকেট আনে মিনহাজ। প্যাকেট থেকে বের করে একটা জলপাই কালারের শাড়ি।
নাওয়াল ভড়কে যায়, শাড়ি পরতে বলে ক্যানো, কী উদ্দেশ্য এই ছেলের? একটু ভয় ভয় করছে নাওয়ালের। না সাহস হারালে চলবে না।
শাড়ি পরবো ক্যানো? কেন শাড়ি পরব?
পরবে, আমি বলছি, তাই পরবে।
মানে?
মানে কিছুই না, তুমি এই শাড়িটা পরবে।
আমি পারি না, কিছুটা কুঁকড়ে গিয়ে শব্দ কয়টা উচ্চারণ করলো নাওয়াল, এই ছেলে এমনভাবে সব কথা বলে যেন সে যা বলে সেটাই নিয়ম, সেটা না মানলে কারও রক্ষা নাই। কী করবে নাওয়াল, চিৎকার করবে? না চিৎকার করলে কেউ শুনতে পাবে না, খুব তো সাহস করে এসেছিল, এখন? ফোন দেবে কাউকে, সিনথিয়াকে, না কিছুতেই না, তাহলে ফুপুম্মাকে, ফুপুম্মাই বা কী করবে। ফোন দেবেই বা কিভাবে, মিনহাজের ফ্ল্যাটে ঢোকার কিছু সময় পরেই মিনহাজ নাওয়ালের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে রেখে দ্যায়, রিং টোন নাকি তার অসহ্য লাগে। অসংখ্য দুর্ভাবনা নাওয়ালের মনে।
ওকে, দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। আমি পরিয়ে দেবো। জাস্ট দাঁড়াও, সোজা হয়ে দাঁড়াও, একটুও নড়বে না।
জলপাই রঙা শাড়িটার ভাঁজ খোলে মিনহাজ, শুধু কি শাড়ি? শায়া, ব্লাউজও তো আছে।
তুমি কি ফোর্স করছ আমাকে? নিজের ভেতর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে কথাগুলো বলে নাওয়াল, কিন্তু সে খেয়াল করছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের সাহস শূন্যের দিকে দৌড়াচ্ছে।
হ্যাঁ, জাস্ট ক্লোজ ইয়োর আইজ, আই সে ক্লোজ!
এখন নাওয়াল একজন হাল ছেড়ে দেওয়া মাঝি। চোখ বন্ধ করে সে, কিছু করার উপায় নাই, হয়ত আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য, এই ছেলে এত রূঢ়!
ওকে নাউ ইউ ক্যান ওপেন ইয়োর আইজ—হঠাৎ কণ্ঠ পাল্টে ফেলে মিনহাজ, যেন প্লেগ্রুপ বা নার্সারি ক্লাসের কোনো বাচ্চার ক্লাস নিচ্ছে সে, একেবারে সফট টোন কোথা থেকে এসে হাজির হলো! নিজেকে চিনতে পারে না নাওয়াল, এক অন্য ধরনের ভালো লাগা কাজ করে শাড়ি পরা নিজেকে দেখে, কিন্তু এক গাদা ভয়, শঙ্কা তাকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, চুপ করে থাকে সে। এদিকে আসো, এই ঘরে—বলে নাওয়ালের হাত ধরে তাকে কোনার দিকের একটা ঘরের দিকে নিয়ে যেতে চায় মিনহাজ।
আবার চোখ বন্ধ করো—কোনো কথাই বলার সুযোগ দিচ্ছে না নাওয়ালকে, যেন এটা তার টেরিটোরি, এখানে সেই রাজা। আর নাওয়ালও, যেন তার সব কথারা শুকিয়ে গেছে আজ।
রুমের ভেতরে নিয়ে কী করবে মিনহাজ?
না, রুমে ক্যানো যাবো, আই ওয়ান্ট টু গো টু হোম, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফর্ম মি?
ভয় পেয়েছ? খুব না আমাকে শায়েস্তা করবে বলেছিলে? এই বলেই নাওয়ালের হাত ধরে টানতে থাকে তাকে, নিয়ে আসে একটা রুমের সামনে, রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মিনহাজ—এসো।
নাওয়াল বুঝে গেছে তার কিছুই করার নেই আর, মিনহাজ যা বলবে তাই করে যেতে হবে এখন। ঘরে ঢোকে সে। ঘরে ঢুকেই হতবাক হয়ে যায় সে। এই জীবনে এতটা বিস্ময়াভিভূত সে কোনোদিনই হয়নি।
ঘরের দেয়াল জুড়ে অনেকগুলো পেইন্টিংস, কোনোটায় ব্যবহার করা হয়েছে পেনসিল, কোনটায় ওয়াটার কালার, কোনোটা আবার ওয়েল কালারে, কিছু কিছু প্যাস্টেল কালার, কোনোটাতে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাক্রিলিক কালার, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছবিই নাওয়ালের।
সামনে এসে দাঁড়ায় মিনহাজ, বলতে থাকে, শাড়িটা মায়ের, মাকে তো আমি দেখিনি, আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা আকাশ হয়ে গেছেন, আকাশ থেকেই আমার সঙ্গে কথা বলে মা, বাকি ছবিগুলো দেখছ না! ওগুলো মায়ের। আমিই এঁকেছি। আকাশ থেকে মা-ই বলেছেন, তোর জন্য একটা ‘উপহার’ আছে। কথাগুলো বলতে বলতে মিনহাজ ঘুরে দাঁড়ায়, আর দুই চোখের ভেতর শান্ত কোনো এক সমুদ্রের সমস্ত জলকে টলটলায়মান করে, মোচড়াহীন ঢেউ তুলে নাওয়ালের চোখে তাকায়, বলে— নাওয়াল শব্দের অর্থ তুমি জানো?