পদ্মাপাড় থেকে খানিকটা দূরে এদিকটায় মনে হয় কখনো সন্ধ্যে নামে না। দিনের আলোর মতোই এ সময়টাতেও এখানে এত হইচই। কালো-কালো ন্যাংটা বাচ্চাদের হুটোপুটি, দোকানে উচ্চস্বরে হিন্দি গান, টেলিভিশনের শব্দ, চা সিগারেটের ধোঁয়া, খিস্তি-খেউর যেন প্রাণপণে ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে সন্ধ্যেটাকে। টিনের চালা দেওয়া ঘুপচি ঘরগুলোয় হলুদ বাল্বগুলো কেমন একটা গুমট অন্ধকার ছড়ায় যেন অন্যপাশে। সন্ধ্যে আসবে না, শেষ হবে না রাত। এ যেন চিরযৌবনা, চির টইটুম্বুর মৌচাক। তবে এই পরিবেশে যে মাকসুদ একেবারেই নতুন ওর চোখের হতবিহ্বল চাহনি, আড়ষ্ঠভাব আর দাঁড়ানোর ইতস্তত ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে। কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করতে করতেই ওর মোবাইলে আবার রিং বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে সে দেখে, রেবা আবার কল করেছে। খানিকটা বিরক্ত আর খানিকটা রাগ নিয়েই সে ফোনটা ধরে। ওই পাশ থেকে রেবার কান্না শোনা যায়-কখন আসবা তুমি? বিরক্তিতে মাকসুদের জিহ্বাটা তেতো মনে হয়। সে ঝাঁজের সঙ্গেই বলে-তোমাকে না বলেছি কটা দিন ফোন দেবে না, আমি ব্যস্ত। আমিতো খারাপ, তাহলে কেন এত ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করো। ওই পাশ থেকে রেবার ফোঁপানি শোনা যায়, সে বলে, আমি আত্মহত্যা করব, আল্লার কসম। এই বাবুর মাথায় হাত রেখে বলতেছি। ছিঃ ছিঃ ছিঃ কেউ জানলে মুখ দেখাতে পারব না। তোমার পায়ে পড়ি, আল্লাহর দোহাই ফিরে আসো। মাকসুদ ফের শান্ত কণ্ঠে বলে, না। রেবা আবার ফোনে কাঁদতে থাকে আর বলে-তোমার বাপ মারে বলো আমারে বিষ আইনা দিতে। আমিও খাব আর বাবুকেও খাওয়াব। আর, তোমার ছবি আঁকতে হইলে বাসায় আসো। আমি ন্যাংটো হয়ে শুয়ে থাকমু, তাই বলে বেশ্যাপাড়ায়! মাকসুদের কপাল কুঁচকে ওঠে। সে বলে- কী, তুমি ন্যাংটো হবে, ছিঃ। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলবে না। আর তোমাকে দেখে আঁকবো ন্যুড। খেয়ে দেয়ে কি ধুমসি হয়েছ দেখেছ? আমি কাল সন্ধ্যায় আসব রাখি। রেবা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মাকসুদ সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল। পরক্ষণে তার মনে হলো, রেবাকে এত কঠিন কথা বলা তার ঠিক হয়নি। কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই, ওকে কড়া ভাষায় না বল্লে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে।
বাতাস কেমন যেন ভারী, কিসের যেন একটা গন্ধ চারদিক। ছোট ছোট দোকানগুলো যেন রহস্যময়তায় আচ্ছন্ন। হঠাৎ হঠাৎ কেউ কেউ গামছায় মুখ ঢেকে চলে যাচ্ছে। কেউ বা বের হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু সে মাকসুদ কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে? দোকানদাররা কেমন কুটিল হাসি ফুটিয়ে ঠোঁটে দেখছে ওকে। যেন সবাই জানে ও এখানে একেবারে নতুন। কালো শরীরের এক টিঙটিঙে লোক এগিয়ে এলো ওর দিকে। পান খাওয়া লাল দাঁতে ফিক করে হেসে ফেল্লো সামনে এসে। লোকটা বললো-ভালো মাল আছে, কম রেট। লোকটা মাকসুদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। আমি আসলে ইউনূস আলীকে খুঁজছি। লোকটার হাসিটা যেন মিলিয়ে গেলো। কার ঘরে যাইবেন-মিনাক্ষী, রেশমা নাকি পপি? পুরান কাস্টমার নাকি আপনে ইউনূস মিঞার? মাকসুদ তার কাঁধের ব্যাগটা ফের টেনে ঠিক করে নেয়। লোকটা বলতেই থাকে-বড় পার্টি না কি, কয়জন লাগব? আহা, আপনি ইউনূস মিঞাকে চেনেন? আমার তাকে দরকার। লোকটা চুপ মেরে যায়, গোমরা মুখ করে একবার চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে। হেই কোণায় পাইবেন ইউনূস মিঞারে। তা, পানিটানি যদি কিছু লাগে কন, ভাগেজোগে দেই। বিদেশিটাও আছে, দেশিটাও পারুম, ট্যাকাও কম রাখুম। মাকসুদ উত্তর না দিয়ে পা চালায়।
পথের দুপাশে সার দেওয়া টিনের ঘর। কোনো কোনো ঘরের দরজায় দুই-একজন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার আচ্ছন্নতায় যেন খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ। দুই-একটা নারী মুখ জানলা দিয়ে মুখ বার করে মাকসুদকে দেখছে, হাসছে। কেউ একজন একটা শিষ দিলো। কেমন অসহায়, উগ্র, অন্ধকার সব পরিবেশ। রাস্তার বালিতে, কোণেতে, অন্ধকারে যেন কিসের আকর্ষণ। মাকসুদ যেন এক লোভনীয় খাবার। যেন এক্ষুনিই হুড়মুড় করে চারদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে সোনালি কেশরওয়ালা সিংহের দল। সে ওই গলিটার শেষ মাথায় এসে পৌঁছায়। ততক্ষণে পিছু হটা অন্ধকারের আবছা কালো রেশ যেন পাহারা দিচ্ছে চারদিক। কোথা থেকে যেন জল পড়ার শব্দ আসছে, টেলিভিশনে চলছে মারামারি। একপাশে কিছু লোক হ্যাজাক জ্বালিয়ে ক্যারাম খেলছে। মাকসুদ সেদিকে এগিয়ে গেল-ইউনূস মিঞা কে? খেলতে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে থেকে লুঙ্গি পরা এক ভুঁড়িওয়ালা লোক এগিয়ে এলো। ও, আপনেরই তাইলে আসার কথা, আমি আরও ভাবি, আসে না ক্যান এখনো। লোকটা তার লুঙ্গির গিটটাকে আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে নিলো। আহেন, লগে আহেন। লগে বেলুন-মুলুন আনছেন? হাঁটতে থাকা মাকসুদ ঠিক কী বলবে বুঝে পায় না। দেখুন, সরোয়ার নিশ্চই আপনাকে ফোনে বলেছে, আমি আসলে এসেছি ছবি আঁকতে। মানে ন্যুড, একটা নগ্ন নারী শারীরের ছবি। লোকটা হাঁটতে হাঁটতেই ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসে। ওইরকম কথা সবাই কয়, তারপরে ঠিকই ছায়া উল্টায়া দেখে। আমারে রেট মতন টাকা দিবেন। তারপর আপনে ছবি আঁকেন নাইলে যা মন চায় তা করেন। তয় মাল যেইটারে দিতাছি সেইটা কিন্তু কচি, খাসা। লোকটা মাকসুদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা সরু গলির ভেতরে ঢোকে। দুপাশে লাগোয়া সব ঘর। প্রতিটি ঘর থেকেই মৃদু স্বরে বিভিন্ন গানের শব্দ আসছে। পায়ের নিচে প্যাচ্যোচে কাদা, তারওপর রাখা ইটে পা দিয়েই তবে সামনে এগুতে হয়। অবশেষে ফুলওয়ালা পর্দা দেওয়া একটা ঘরের সামনে ওরা থামলো। ইউনূস বলে, এই ঘরই পান্নার, যান ট্যাকা দিয়া যানগা। মাকসুদ মানিব্যাগ বার করে লোকটাকে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিলো। ইউনূস তারপরও হাত পেতেই রইলো-ওমা বকশিশ দিবেন না? মাকসুদ আরও একশ টাকা দিলো ওর হাতে। ইউনূস টাকাগুলো লুঙ্গির খোটে গুঁজে আস্তে করে দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, কে? দরজা খোলে ফর্সা আর তীক্ষ্ণ নাকের একটা মেয়ে। ইউনূস হাসে, এইডাই হেই ছবির কাস্টমার।
ভেতরের গুম পরিবেশ যেন ক্রমেই অস্থির করে তুলছে মাকসুদকে। ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। গোছানো বিছানার পাশে টেবিল, শোকেস, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি। দেয়ালে ঝুলছে গত বছরের একটা ক্যালেন্ডার আর এক সিনেমার নায়কের ছবি। যেন ছিমছাম কোনো গেরস্থ ঘর। মেয়েটা হয়তো দুপুর বেলা ঘুমিয়েছে খুব। এখনো চোখে ঘুম লেগে আছে। ছিমছাম চিরাচরিত বাঙালি চেহারায় কোথায় যেন একটু কৌতুক। অথবা মাকসুদের ভুলও হতে পারে। বড় বড় ফুলওয়ালা একটা ম্যাক্সি পরে পা দুলিয়ে বসেছে বিছানায়। হঠাৎ মাকসুদের ফোন বেজে ওঠে। আবার রেবা ফোন করেছে। সে ফোনটা কেটে দেয়। অযথা কান্নাকাটি ভালো লাগে না। কিন্তু আবার রিং আসে, এবার মাকসুদ কেটে দিয়ে ফোনটাই বন্ধ করে রাখে। মেয়েটা হেসে ওঠে, প্রশ্ন করে- কে বউ? মাকসুদ একটু ঘাবড়ে যায়।
ইউনূস সাহেব নিশ্চই আপনাকে আমার কথা বলেছে, আমি ছবি আঁকি। মানে আপনার একটা পোট্রেট আঁকতে চাই। মানে ন্যুড, নগ্ন একটা নারী শরীর। অবশ্য আমরা আর্ট কলেজে নগ্ন নারী মডেলদের পোট্রেট এঁকেছি। মিকেঞ্জেলো, টিটিয়ান, ম্যানেট কিংবা ভ্যানগগরাও অবশ্য বিখ্যাত সব ছবি এঁকেছেন। আমি তেমন তেলরঙে নয়, বরং আমার বন্ধু…মেয়েটা হঠাৎ জলতরঙ্গের মতো খিলখিল করে হেসে ওঠে। যেন মাকসুদ খুব মজার কোনো কথা বলছে। কাপড় কি এখনই খুলমু, নাকি আর কোনো কাজটাজ আছে? আসেন, বসেন আমার কাছে। মেয়েটা মাকসুদের হাত ধরে তার কাছে টেনে বসায়। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে কাঁধে হাত রাখে। মাকসুদের কেমন যেন লাগে, মনে হয় সে দাঁড়িয়ে আছে একটা খাদের কিনারে। পড়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। তারপর ইচ্ছে করেই মেয়েটার কাছ থেকে একটু দূরে সরে আসে। মানে আমি একটু পানি খাব। সে ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে পানি খায়। মেয়েটা হাসে আর বলে-পানি কিন্তু আমাগো এইখানেও আছে। ঘিন্না কইরেন না, ভালো পানি, ফুটানো।
না মানে আমরা কি কাজ শুরু করতে পারি? মাকসুদ উত্তরের অপেক্ষা না করে ছবি আঁকার বড় খাতা, পেন্সিল, রাবার, এন্টি কাটারসহ সব জিনিস বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এন্টিকাটার দিয়ে মাকসুদ চোখা করে পেন্সিল কাটতে থাকে একমনে। হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠলো, ছবি আঁকবেন, বাসায় বইসা বউয়ের ছবি আঁকলেই পারেন। খানকি পাড়ায় ক্যান? পাড়ায় আসবেন আনন্দ ফুর্তি করতে।
না মানে-আমার বন্ধু সরোয়ার আর আমি নতুন ধরনের কিছু ন্যুড ছবি আঁকতে চাই। ‘অ্যা মারমেইড’ বা পল চাভেসের সেপ্টেম্বর মর্নিংয়ের মতো কিছু নয়। আরও অন্যরকম কিছু। জানি না পারব কি না। তারপরও চেষ্টা করতে চাই। সরোয়ার একদিন বলেছিল, অন্ধকারের ছবি একটি একটা ছায়া লহরির মধ্যে দিয়ে আঁকা যায় কি না? তখন থেকেই বিষয়টা আমার মাথায় ঘুরছিল। একদিন একটা কবিতা পড়ছিলাম, কি যেন—‘ইসাবেলার শরীর আঁকতে হয় সাঁঝ প্রভাতে।’ তারপর যখন ন্যুড নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম তখন মনে হলো আমার সত্যিকারের কোনো নষ্ট অন্ধকার দরকার। সেই অন্ধকারের কালোটা কেমন তা জানা দরকার। ওই রঙটা আমি ধরতে চাই।
ঠিক আছে, টাকা দিছেন ছবি আঁকবেন। কাপড় খুইলা বসমুনে সামনে। আগে এক ঢোক পানি খায়া নেন। মেয়েটা উঠে গিয়ে আলমারি থেকে মদের বোতল বের করে। তারপর দুটো গ্লাসে মদ ঢেলে একটা মাকসুদের দিকে এগিয়ে দেয়। মাকসুদ আঁতকে ওঠে: আমি, মানে মদ খাই না…
আরে খান শরীরে জোশ আসবো। ভালো মতো ছবি আঁকতে পারবেন। মাকসুদ না বলতে পারে না। সে গ্লাসটা হাতে নেয়। সেখানে সাদা তরল যেন নিষিদ্ধ কোনো আনন্দের দিকে পথ টানতে থাকে। মাকসুদ জানে, যারা সে পথের পথিক, এই আনন্দের অলৌকিক ভার কেবল তারাই টের পান। মেয়েটা এক ঢোকে গ্লাস খালি করে। তারপর এগিয়ে এসে বসে ওর গা ঘেঁষে। মাকসুদ তরলে একটু চুমুক দেয়। কে যেন বলেছিল-‘মন এবং শরীর দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক আদি ও চীরন্তন। কামধামে মদিরাই মধুপার্বন।’ ছিঃ ছিঃ, এসব কী ভাবছি আমি? আমার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। স্ত্রীকে আমি ভালোবাসি। সবার ওপরে আমি একজন চিত্রকর। পাপপুণ্য নয় বরং রঙের তপস্যার জন্যই আঁকার সময় নারীদেহ ছোঁয়া তার জন্য সঙ্গত হবে না। কিন্তু রেবা কেন আমার ওপর একটু বিশ্বাস রাখতে পারল না। এতদিন একসঙ্গে থেকে একসঙ্গে শুয়ে আমার ওপর কি একটুও বিশ্বাস জন্মায়নি! আমি একজন আর্টিস্ট। তুমি দেখে নিও রেবা আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙব না।
মাকসুদের মনে রেবার হাসিখুশি গোলগাল মুখটা ভেসে ওঠে। এরই মধ্যে অন্যমনে সে গ্লাসে আরও চুমুক দেয়। কখন যে মেয়েটা ওর কাঁধে মাথা রেখেছে মাকসুদ এতক্ষণ টের পায়নি। ওর চুল থেকে কেমন যেন একটা ঝিমঝিমে গন্ধ। সম্ভবত তেল দিয়েছে চুলে। মাকসুদের মনে হয়, মেয়েটার মুখ যেন একটা সাদা খাতা। সে পেন্সিল দিয়ে প্রথমে মেয়েটার একটা পোট্রেট ফাউন্ডেসন করবে। তারপর একটু একটু রঙ…হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে মাকসুদ চমকে ওঠে। ওর কথা জড়িয়ে এসেছে। দেখুন, আপনি কোথায় থাকেন বা কী করেন তা দিয়ে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি খালি…
খালি প্রয়োজন একটা শরীর? মেয়েটা খিল খিল করে হাসতে থাকে। তারপর উঠে গিয়ে গ্লাসে আরেকটু মদ ঢেলে নেয়। নিজে খায় আর মাকসুদকেও ঢেলে দেয়। ওর চোখে কেমন যেন দৃষ্টি। তারপর কখন যে টপ করে মেঝেতে খসে পড়ে মেয়েটার ম্যাক্সি মাকসুদ টেরও পায় না। সাদা ফর্সা একহারা গড়ন। পেটে খানিকটা মেদের আভাস তবু ফর্সা দুই স্তন যেন কাউকে সাবধান বাণী দিচ্ছে। মাকসুদের কানের পাশের চুলগুলো তিরতির করে কাঁপে। সে নিজেকে মনে মনে প্রবোধ দিতে থাকে, এখানে তুমি যৌনতা কিনতে আসোনি। এসেছো ছবি আঁকতে। যা হয়ে উঠতে পারে মহৎ কোনো শিল্প।
মেয়েটা তখনো মিটি মিটি হাসছে। সে বলে, আঁকেন ছবি আঁকেন। মাকসুদের চোখের ঘোর যায় না। তার মনে হয় ন্যুড ছবিটা যেন বাতাসে কাগজ হয়ে ভাসছে। সে তার পেন্সিল দিয়ে মেয়েটার ঠোঁটে, চোখে, ঘাড়ে, স্তনে, জঙ্ঘায় আঁচড় কাটে। যেন ওর শরীরটা একটা জীবন্ত খাতা। কখন মেয়েটা ওকে টেনে নিয়ে যায় বিছানায় মাকসুদ টেরও পায় না। এবার কি তবে রঙ লাগাবার পালা? বাল্বের হলুদ আলোয় মেয়েটার শরীরের প্রতিটি বাঁক ঘিরে যেন পরম ছায়ার বাসা। আচ্ছা, প্রতিদিন যারা ওর শরীর কিনে নেয়, তারা কি দেখা পায় এই পরম অন্ধকারের।
এবার মাকসুদ মেয়েটাকে ছেড়ে উঠে পড়ে। টেবিলের ওপর রাখা খাতাটা নিয়ে পেন্সিল দিয়ে সত্যিকারের আঁচড় বসায়। তারপর কখন যে সময় যেতে থাকে ওর খেয়াল নেই। কেবল মনে হয়, ও যেন মেয়েটার শরীরের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি উত্তেজনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এ যেন ছবির ঈশ্বর। আদিমময়তা আর যৌনতার রঙে রসে পুরোপুরি কোনো জীবন্ত যাত্রা।
মেয়েটা কখন উঠে এসে মাকসুদের পাশে দাঁড়ায় সে টের পায়নি। হঠাৎ দেখে ওর ফর্সা হাতটা গেঁড়ে রয়েছে কাঁধে।
বাহ, আপনেতো সত্যিই ভালো ছবি আঁকেন। বুকের মাঝখানের তিলটাও কেমন সুন্দর কইরা দিছেন। আমারে এই ছবিটা দেবেন?
আপনাকে দেব মানে? এখনো তো আঁকাই শেষ হয়নি। আর তাছাড়া এটা হবে আমার মাস্টারপিস। এর দাম কতো উঠবে আপনি ধারণাও করতে পারবেন না।
করলাম না ধারণা, তয় শরীর বেচলে যেমন টাকা পাওয়া যায়, তেমনি ছবি বেচলেও টাকা আছে, এইটা বুঝছি। অবশ্য আমি ছবি দিয়া করমুই বা কী! সেই একই রকম শরীর দিয়াতো এমন হাজার হাজার ছবি বানানো যায়। আপনেরে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? এই যে আমাগো ঘর, চেয়ার, টেবিল, বিছনা, বাতাস, সব নষ্ট অন্ধকার না?
মাকসুদ ঠিক কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। তবে এটুকু বোঝে মেয়েটা কিসের যেন একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে নগ্ন অবস্থাতেই গ্লাসে আরেকটু মদ নিয়ে গিলে ফেলে। তারপর মাকসুদের গ্লাসেও ঢেলে দেয় আর খিলখিল করে হেসে ওঠে, নেন খান। শুনেন, অন্ধকার কখনো নষ্ট হয় না, সেইটা হয় আরও গভীর। নষ্ট হয় কেবল শরীর। চাইরদিকে দেখা দেয় পচা ঘা, লোভ, পুঁজ। গালে, মুখে, ঠোঁটে, হাতে, বুকে, পায়ে হাজারটা ছোঁয়া। মেয়েটি আবার উন্মাদের মতো হাসে আর মাকসুদ তার গ্লাসে চুমুক দেয়। মদের আসন্ন কুয়াশা ঘেরা ঝিমুনিতে ওর চোখ কেমন ঢুলুঢুলু হয়ে উঠেছে। ওর মনে হয়, নগ্ন কোনো সত্য হয়তো ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলেছে ওকে। কেমন অপার্থিব, অলৌকিক মনে হয় সব। মাথাটা ঝিম ঝিম করে, অবশ লাগে। ওরই আঁকা পোট্রেটে কেমন কেমন নেশাময়ভাবে পা ভাঁজ করে শুয়ে রয়েছে মেয়েটা। ও নিপুণভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এঁকেছে তার প্রতিটি অঙ্গ। কী পরম কামনাময়, নেশাময় এই মাদকতা।
রাতের সময় কখন চলে যাচ্ছে কিছুই মনে নেই মাকসুদের। চোখের সামনে কেবল নগ্ন এক নারী দেহের ছায়াময় অর্ধ পোট্রেট। শেষ করতে হবে এটিকে পুরোটুকু। আর হাত দূরত্বে সেই নেশাময় নারী দেহ। মেয়েটা মাকসুদের কাছে আসে। ওর শরীরে একটা অচেনা গন্ধ পায় মাকসুদ। ওর ভাবনাগুলো গুলিয়ে যেতে থাকে পলকেই। হঠাৎ সে নগ্ন শরীর শরীরটিকে জড়িয়ে ধরে আদিমতায়। কোথায় যে কার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। এবার শুধু একটি নয়, কুৎসিত আদিম রিপুর তীব্র মাদক নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুটি দেহ।
মাকসুদের অর্ধেক শেষ হওয়া পোট্রেটটা এখনো পড়ে আছে চোখের সামনে। গুটিকয় পেন্সিল, ইরেজার, কাটার পরে আছে পাশে। মদের খালি গ্লাসটাতে দুটো মাছি ভনভন করছে। আর পড়ে আছে কারও তীব্র অনুশোচনা, কারও বা নিস্পৃহতা। যদিও ঘরের বাইরে আকাশে তারার মেলা। পদ্মা থেকে ছুটে আসা বাতাস যেন ফেরারি আসামির মতো মুখ লুকায় এই পাড়ায়।
কেন, কেন এমন হলো, আমি তো আঁকতে এসেছিলাম। সৃষ্টি করতে এসেছিলাম, সওদা নয়। আর রেবা, আমি তোমার সঙ্গে কোনো প্রতারণা করতে চাইনি। তবু কখনো কখনো কাম তাড়নায় দেবতাদেরও তো ধ্যান ভাঙে। আমাকে তুমি ক্ষমা করো রেবা। আর ওই মেয়েটা, না না ও মেয়ে না, কেবলই একটা শরীর।
কী হইলো এক দৃষ্টিতে তাকায়া রইছেন ক্যান? আমি কতক্ষণ এরকম ল্যাংটা হয়া শুয়া থাকুম। ছবিটা শেষ করেন।
মাকসুদ যেন সংবিতত ফিরে পায়। চোখের সামনে এতক্ষণ যে দৃশ্যাবলী খেলে গেলো সেটা কি সত্য, নাকি মদের ঘোর! ওইতো মেয়েটা, সত্যি সত্যি নগ্ন ফর্সা শরীর নিয়ে পা দুটো ঈষৎ ভাঁজ করে শুয়ে আছে। ওর পায়ের ফাঁকে, জঙ্ঘায় হালকা কালো ছায়া। সে আবার পোট্রেটটাতে পেন্সিল চালায়। গাঢ় কালো জঙ্ঘায় আঙুল ঘষে ঘষে রঙ হালকা করে। তবু কামের একটা অদ্ভূত শিহরণ বয়ে চলে মাকসুদের শরীরের এমাথা থেকে ওমাথা। হঠাৎ পেন্সিল থামিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করে ও-একটা কবিতা শুনবেন?
পুরুষ বেশ্যারা ঘিরে আছে নিশিদিন
নারী বেশ্যাদের ভনভনে মৌচাক
আগুনে জ্বলছে ঘর-দোর মন বাড়ি
কয়লা পুড়ে ময়লা হয়েছে খাক
হাতে তুলে নাও বিষ্ঠা রঙা গ্রাস
ঠোঁটে ঠোঁটে মদিরার মেকি বন
শরীরগুলো বিষম রিপুর ধাঁধা
যৌনতর মৌন আকর্ষণ।
শুনুন, এই ছবিটা আমি আপনাকেই দিয়ে দেব। আমি এটা কিছুতেই শেষ করতে পারছি না। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, ক্যান অন্ধকার পছন্দ হয় নাই? মাকসুদ উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পর সে বলে, আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আমি একজন চিত্রকর?
মেয়েটি খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে একমনে। কে চিত্রকর, আপনি? হুঁ, আমি জানি না।
তাহলে আমি কী?
এবার প্রথম মাকসুদ মেয়েটার চোখে তীব্র কৌতুক, ঘৃণা আর করুণা টের পায়। এই রঙ কিভাবে আনা সম্ভব ছবিতে! কোন জগতে লুকানো এই গভীর গাঢ় রঙ! মেয়েটা বিছানা ছেড়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর মুখোমুখি।
আপনি একটা পুরুষ বেশ্যা।