সেই কবে বিধাতা খেয়ালের বসে লিঙ্গ ভাগ করলেন আমাদের। একটি দানের জন্য। অন্যটি কেবল সেই দান ধারণ করবে তার শরীরে। ক্রমে সেই ধারণকৃত দান জন্ম সাঁতারের যুদ্ধ শেষে পরিপুষ্ট হয়ে আবার সৃষ্টি হবে নতুন লিঙ্গে। কত সুদীর্ঘকাল এই একই প্রক্রিয়া। একঘেয়ে, বিস্ময়হীন আর কান্তিকর। এই নীলাকাশের পৃথিবী, উঁচু ঘন বনস্পতি সৌন্দর্যের আবির বিলায় সে কতকাল! কার জন্য, সবই আমাদের? তাই জন্মই তথাস্তু, জন্মই পুণ্য, জন্মই চীর সত্যের আলোড়ন। তবে মৃত্যু কি মিথ্যা, সে কি কেবলই ক্ষয়? কেবলই জন্মে গড়ে ওঠা প্রাণ-প্রাচুর্যের কাল ক্ষয়ে ক্ষয়ে লিঙ্গ কি পূর্ণতার অনিবার্য অপচয়! এ সত্যটুকুও প্রাণী এড়ায় কিভাবে? ভুলোমন বসে থাকে আকর্ষণে। জাগতিক আকর্ষণ, প্রেম আর ক্ষুধা। এ ক্ষুধা সর্বগ্রাসী। এক লিঙ্গ বলে যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর যা কিছু শক্তি সব আমার চাই। না পেলে ধ্বংস করব চারবংশ। গায়ের জোরেই জিতে নিতে চাই সব দুর্বলতা। অন্য লিঙ্গ কি কেবলই ধারণ করে! জানি না, জানতে চাইও না। পদার্থ ভাঙতে ভাঙতে শেষ সীমায় অবশিষ্ট থাকে যে অণু। নিরীহ দর্শন, সুন্দর অথচ কি কল্পনাতীত শক্তি নিহিত ওই শেষ বিন্দুতে। যে লিঙ্গ ধারণ করে সে যেন ভূমি। শক্ত প্রলেপের ভেতর কি বিপুল উর্বর রস! কর্ষণ চায় সে। যদি হয় আনন্দ কর্ষণ, সৃষ্টি লাঙলের আশীর্বাদে সে বসুন্ধরাকে ভরিয়ে দেবে ফুলফল প্রজাপতিতে। সব কিছুতে যেন গোপন অধিকার। সমস্ত গুপ্তধনের সে যেন তালাবদ্ধ কুঠুরি। পাঠোদ্ধার হলে সে সংকেতের তালা খুলে সে বিলাবে রত্ন-ধন। নয়তো মাথা কুটে মরলেও যেন কোনো ভাবান্তর নেই। এভাবেই দিন এভাবেই কাল। উভয় লিঙ্গের কখনো মুখোমুখি, কখনো বা ঘনিষ্ট অবস্থান। কত বিতর্ক, কত দেনাপাওনা, কত মান-অভিমান, অভিযোগ। তবু মহাগামী বিধাতার আশীর্বাদে জন্মের পর মৃত্যুই সত্য। মাঝের সত্য লিঙ্গ। প্রাণীতে-প্রাণীতে তরুতে-গুল্মে সব জন্মেই এই দুই সত্যির খেলা। আমরা এক লিঙ্গে নর, অন্য লিঙ্গে নারী।
দানব পুরাণ
ওকে আমি বেঁধে রেখেছি একটা অন্ধকার হীম ঘরের মধ্যে। বাঁধা থাকতে থাকতে ওর হাতে শিকলের দাগ কেটে বসে গেছে চীরস্থায়ীভাবে। তবু প্রতিদিন একবার ওকে আমার ভোগ করা চাই। এটি আমার আনন্দ লিপ্সার একটি অংশ। জানি, অন্ধকারে ওর ওই নিষ্পাপ সুন্দর মুখটার অবস্থা দেখে যে কেউ চমকে উঠবেন। কেউ কেউ আমাকে গালিও দিতে পারেন। অসভ্য, পিশাচ, রাক্ষস কিংবা যা কিছু। তবে আমার সবচেয়ে নিজেকে ভাবতে ভালো লাগে দানব। আমি যখন প্রতি রাতে দানবীয় উল্লাসে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি, চীর আদি পৌরুষিক কামের নেশায় কামড়ে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেই ওর সুন্দর মাখন নরম শরীরটা, তখন আমার অপার্থিব আনন্দ হয়। আমার দাঁতের আঘাতে যখন ওর শরীর বেয়ে রক্ত ঝরে আমি মাঝে মাঝে তা চেটে দেখি। গরম রক্তের কি যে অদ্ভুত বুনো গন্ধ! যে না চেখে দেখেছে সে বুঝতেই পারবে না। তাই ওর প্রতিটি উত্তেজক অঙ্গে আমি আমার দাঁতের দাগ রেখে দিয়েছি। এটা চিহ্ন যে এই সম্পত্তি আমার, শুধুই আমার। প্রতি বুনো রাতে আমি তাকে বারবার বুঝিয়ে দেই আমাদের লোক দেখানো সভ্যতার বাইরে জগৎ কতটা ভয়ানক পৌরুষিক। ও ব্যথা, ঘৃণা, লজ্জা, বেদনা, রাগে আমার ওপর থু থু ছিটায়। আবার শরীরের উষ্ণতা ভোগে বাঘিনির মতো কামড় দেয় আমার বাহুতে। হয়তো ভাবে আমি এতে দুর্বল হব। কিন্তু না, ও জানে না পৌরুষ কেবল পৌরুষের কাছেই শক্তির বিবেচনায় মাথা নত করে। দুর্বল নারীর কাছে নয়। ওকে ভোগের সময় আমি বারবার আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে তুলি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ওর কাঁতরানোর ধ্বনি, কখনো বা শীৎকার আমার কানে মধু বর্ষণ করে। মনে হয় যেন বুনো সিংহের সামনে মৃত্যুর জন্য মন্ত্রমুগ্ধ ও যেন কোনো হরিণী। আমি সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ঘাড়ের নরম মাংসে ক্ষুধার কামড় বসাব। ও আমার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। জানি, সমাজের অন্য সভ্য পুরুষ এটাকে নির্মমতা, কাপুরুষচিত আর অসভ্যতাই বলবেন। কিন্তু আমি ওদের মতো ভানসর্বস্ব নই। কাম আমার আদিম অধিকার। তার জন্য আমার আরেকটি বিপরীত লিঙ্গ দরকার। যা চেয়ে পাওয়া যায় না তা শক্তি দিয়ে পুরুষের আদায় করে নিতে হয়। এটাই সত্যি এবং প্রকৃত সভ্যতা। সৃষ্টির আদি থেকে চোখ রাখুন, সব প্রাণীকুলেই পুরুষ নারীকে শক্তি দিয়েই বস করে। পুরুষ ময়ুরপুচ্ছ নাচায় নারীকে আকর্ষণে। তবু কি ভালোবাসার ময়ুরীটি ধরা দেয়? সে বশবর্তী হয় শক্তির কাছে। যে পুরুষ ময়ুরটি সবচেয়ে বলশালী, সে শক্তি দিয়েই জয় করে নেয় তাকে। আমি তাই অন্য সভ্য পুরুষদের মতো নই।
আমি শক্তির ক্ষমতায় নারীকে ছিন্নভিন্ন করতেই ভালোবাসি। বলুক একটি পুরুষ বুকে হাত দিয়ে কখনো কখনো মনের চোরকুঠুরিতে হলেও নারী দেহের প্রতি লোভ তাদের জন্মায় না! অবশ্যই জন্মায়, আলবৎ। নয়তো সে পুরুষ নয়। কিন্তু সে নারীটিকে কি পাওয়া যায়? আমাদের তথাকথিত সভ্য পুরুষেরা সেই কামনা অবদমিত রাখেন। যা তাদের কাছে সভ্য, আমার কাছে নয়। যা কামনা করি তা ছিনিয়ে নিতেই আমি ভালোবাসি। এর জন্য আমি যুদ্ধেও প্রস্তুত। শুধু বুদ্ধির বেলাতেই আমি মানুষ নয়তো অন্য সব ক্ষেত্রে আমি আসলে পশু। স্বীকার করুন আর নাই করুন অন্য সবাইও তাই। সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ তথা পুরুষের কাছে নারী ভোগের সামগ্রী ছাড়াও ছিল ব্যবসার জমজমাট উপকরণ। শক্তিশালী আর ধনী পুরুষদের হেরেমখানা তাই ভরে উঠেছিল জীবন্ত ভোগ্য খেলনায়। এই খেলনা হাসে-কাঁদে, আঘাত করে, আবার উল্টো কামের বশবর্তী হয়। শক্তিশালী ধনীরা ওই সব নারীর যৌনাঙ্গে লোহা গরম করে ছ্যাঁকা দিয়ে দিতেন। এটি একটি আজন্ম চিহ্ন, পুরুষের শক্তির সিলমোহর। পুরুষ দাশের চেয়ে নারী দাশের দামও ছিল তাই আকাশচুম্বী। এখন হয়তো দিন পাল্টেছে। এখন পুরুষেরা হয়তো নারীকে জোর করে ব্যবসা করায় না, বরং পরোক্ষ প্ররোচনা দেয় ব্যবসা খুলে বসতে। তাই আপনাদের আধুনিক সভ্যতার কালো গলিঘুপচিগুলোতে দিনের আলোতে ভোল পাল্টে থাকা নাটের আসল পুরুষগুলোর মৌমাছির মতো ভিড়। আমারও জন্ম হয়েছিল তেমনই এক বারোবাজারের অন্ধকারে। শিশুর চোখ দিয়ে আমি তখন থেকেই দেখেছি আর শিখেছি সভ্যতা নামের উলঙ্গ শয়তানটাকে। যৌবনে সেই শয়তানটার উপস্থিতি অবশেষে আমিও আমার শরীরে উপলগ্ধি করলাম। ততদিনে আমি চিনে গেছি দুর্বল নারীর ঠিকানা। ওকে আমি ওখান থেকেই নগদ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। মনে আছে ওকে যখন আমি প্রথমবার ধর্ষণ করি সেই সময়টার কথা। একটা একটা করে যখন আমি ওর কাপড় খুলে নিচ্ছিলাম তখন দুঃসহ লজ্জা, ক্ষোভ, অভিমানে যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল ও। সেই চিৎকার শুনে আমার মায়া হয়নি। বরং রক্তের মধ্যে যেন আনন্দের বান ডেকে গিয়েছিল। আমি অমানুষিক শক্তিতে অসুরের মতো খাবলে খামচে রক্তাক্ত করেছিলাম ওকে সেদিন। তারপর থেকে প্রতিদিন ওর ভয়, চিৎকার আমাকে আরও উত্তেজিত করে তুলতো। তবে দুর্বলরাও যে কখনো রুখে দাঁড়ায় না তা নয়। কিন্তু প্রমত্ত শক্তির সামনে সে আয়োজন খুবই ক্ষুদ্র। ওর প্রতিবাদ রুখে দেওয়ার ভাষা আমার জানা ছিল। একটা একটা করে নখ উপড়ে নিয়েছি ওর। সুন্দর নরম হাতগুলো থেকে যখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে, তখন ও টের পায় সবলের শক্তি। প্রতিবাদের ভাষা মরে আসে। কিছুদিন বিশ্রাম তারপর ওকে আমি আবার জাগিয়ে তুলি আরেক পাশবিকতার জন্য। না না, এমন অবশ্য বেশিদিন হবে না। কোনো পুরুষকে এক নারীতে স্থির থাকতে দেখেছেন? আমিও থাকি না। পাশবিকতার মতো নিটোল চিত্তবিনোদন আর হয় না। ভাবছেন এই প্রথম কি না? না দশ বছরের শিশুটিকে যখন এই কষ্ট দিয়েছিলাম তার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কিংবা হারিয়ে যাওয়া সেই দুর্দান্ত মেয়েটি। মুখে যার কথার ফুলকি উঠতো প্রতিবারে। আমিই ওকে প্রথম দেখিয়েছিলাম শক্তি কেবল কথায় থাকে না, তাতে গায়ের জোরও লাগে। ওকে ধর্ষণ করতে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। ওর একটা স্তন কেটে আমি একটি পুরুষ কুকুরকে দিয়ে একবার খাইয়েছিলাম। সে তৃপ্তির তুলনা হয় না। আমার বাড়ির পেছনের যে পুরাতন কুয়া, সেখানে একে একে জমছে ওদের হাঁড়। ওকেও আমি সেখানেই পাঠাব। নারী সত্ত্বা দুর্বলতার প্রতীক, পুরুষ সত্ত্বা উত্থানের। আমার দানব দাঁত এই চীর সত্য খুঁজে বেড়ায় দুর্বল নারীদের মাঝে। শধু একটি প্রশ্নে মাঝে মাঝে থেমে যাই। প্রশ্নটা যে কি তা কখনোই স্পষ্ট হয় না মনে। একে একে দুর্বল শিকারের রক্তে হাত ডুবিয়ে আমি ডুকরে কাঁদি। না, কোনো যন্ত্রনায় নয়, ক্ষোভেও নয়। আসলে জানি না। সব নারীই ধরা দেয়, শুধু একজন ছাড়া। আমি চিৎকার করি সামনে এসো, সামনে এসো সাহস থাকলে। কিন্তু সে যেন আড়ালে আবডালে কুটকুট করে কেটে চলে আমার সাহসের সুতো। পৌরুষিক উত্থানের যৌবন সময়। আমি স্বীকার করি না, আমি মানি না এসব। পৌরুষিকতা ছাপিয়ে যাবে না কোনো কিছু। যেতে পারে না। আমি জান্তব জিঘাংসায় আবার ঝাঁপিয়ে পড়ি দুর্বল নারীর ওপর। তবু যেন সেই আড়ালের নারী মুখ টিপে বিদ্রূপ করতে থাকে সর্বদা। দৃষ্টিতে তার কি বিপুল শক্তি! যেন গুলাল হাতে ডেভিডের সামনে আমি ছোট্ট গালিয়াথ। না, না, না আমি ওই ছোট্ট দৃষ্টিতে হেলে পড়ব না মাটিতে। পৌরুষ কখনো নারীত্বের কাছে হেলে পড়তে পারে না। সে জয়ী। জন্ম থেকে নারীত্ব ভিরুতা, দুর্বলতার বিরুদ্ধে জয়ী পুরুষ। এখন এই চকচকে ফলার খোলা ছুরি সামনে আমি দাঁড়িয়েছি ওই নারীর বিরুদ্ধে। এসো দেখি নারী, কত শক্তি ধরো তুমি তোমার পাঁজরে! ওই তো সেই মুখ। আহ্ কি যন্ত্রণাময় তোমার হাসি। খুন করব তোমায় এসো। নারীর মুখটা মনে হয় যেন চেনা। কি দুঃসহ শক্তি তোমার। বাতাসে ছুরির কেবল সা-সা শব্দ ওঠে। সেই ধারে শুধু আমার পৌরুষই খণ্ড-খণ্ড হয়। কিন্তু নারী মুখটার সূঁচাগ্রের স্পর্শও পাই না।
বিখণ্ডকাহন
জানালার এই ঝাপসা কাঁচটার ভেতর দিয়ে আমি মাঝে মাঝে উঁকি দেই। এখানে উঁকি দিতে আমার ভালো লাগে। মনে হয় যেন মানুষের কাছাকাছি ফিরে গেছি। ঘরটার ভেতর একটা ছোট্ট শিশু খেলা করে। ওর চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য খেলনা। কোনো কোনোটা নিয়ে ও আপন মনে চাটে, চোষে। শিশুটির কচি মুখের কচি লালা খেলনাগুলোয় লেপ্টে যায়। এসবই দেখতে আমার ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় দরজায় ধাক্কা দেই। শিশুটির সঙ্গে একটু খেলি। আর সব বড় বড় মানুষ যেমন মানুষ চিনে গেছে, এই শিশুটি হয়তো এখনো মানুষ চিনতে শুরু করেনি। তাই জানালার এই ঘষা কাঁচের বাইরে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও মাঝে মাঝে হাসে। নিঃষ্পাপ ওই সরল হাসিতে যেন মানুষ না চেনার আনন্দ। ও যেন আমাকে ডাকে, এসো এসো ভয় নেই। আমি এখনো মানুষ চিনি না। চলো খেলি দুজনে মিলে। আমি মাঝে মাঝেই এই জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে এসব অর্থহীন কথা ভাবি। কখনো শিশুটির মা চলে আসে। আমাকে দেখে ভয় পায়, গালি দেয়। হয়তো নিভৃত অন্দর মহলে শিশুটির কপালের কোণে কালো টিপ দিয়ে বলে, বালাইষাট। এসব ভাবতে গেলে আমার কেন যেন তীব্র অভিমান হয়। ক্ষোভে দুঃখে কখনো কখনো নিজেকে নিজে আচড়াই, কামরাই। কখনো আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হই। এ তো সেই একই রকম মানুষ! কই আমিও তো ওদেরই মতো। মাঝে মাঝে মনে পড়ে শৈশবের স্মৃতি। যদিও সেসব মনে পড়বারই কথা। কারণ শিশুমনে স্মৃতি যখন থেকে জমাট বাঁধতে শুরু করল, ততদিনে আমি বুঝতে শিখে গেছি মানুষকে, নিজেকেও। ও আমার বাবা, ওই যে আমার মা, ওই যে আমার ভাই, এ্ই হলো আমার বোন। তারপর বুঝতে শিখেছিলাম বিকৃতি। ভাই বোনের সঙ্গে পার্থক্য আমাকে ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছিল আমি প্রকৃতির বিকৃত সন্তান। জন্ম বিকৃত মানুষ। তখন থেকেই মনের অজান্তে আমি চিনতে শিখেছি লিঙ্গ। আমার মা একজন মেয়ে, আমার বাবা একজন ছেলে। আমার বোন হলো মেয়ে, আর আমার ভাই, যে মাঝে মাঝে আমার সামনে এসে চোখ বড় বড় করে নির্বাক তাকিয়ে থাকতো সে একজন ছেলে। কিন্তু আমি তোমার কি হই মা? আমি তোমার কে? নিশুতি রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে মা কাঁদতেন জড়িয়ে ধরে আমাকে। বলতেন, তুই আমার সন্তান, কেবলই সন্তান। বাবার মুখে দেখতাম ঘন অন্ধকার। যেন তীব্র কোনো আঘাতে ব্যথায় নীল হয়ে গেছেন। ভাই বোনদের মেো বাইরে খেলতে যেতাম না, এমনকি কোথাও বেড়াতেও না। একটা ঘরই হয়ে গিয়েছিল আমার পুরো পৃথিবী। এই সব স্মৃতি এখনো মনের কোণে উজ্বল। কিন্তু যেসব স্মৃতি মনে পড়ে না, কেমন ছিল সেসব! জানি না, জানতে চাইও না। তবু কেন জানতে চাই? আমার জন্ম, প্রথম নাড়ি কাটা, প্রথম চিৎকার, মায়ের চোখের জল, বাবার লজ্জা কেমন ছিল সেসব? শুনেছি বিধাতা মাটি দিয়ে নাকি গড়েছিলেন মানুষ। তারপর পুরুষের বাম বুকের হাঁড় থেকে নারী। মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করি। তাহলে আমি কিভাবে সৃষ্টি? একি স্রষ্টার মতিভ্রম, নাকি সৃষ্টির কলঙ্ক! মেলে না, মেলে না, প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আমার মনেও নারীত্বের তীব্র অভিমান জাগে, শরীরে বাসা বাঁধে পুরুষালী রাগ। ওই যে শিশুটি খেলছে, কি নিশ্চিন্ত, নির্ঝঞ্ঝাট। আমার বেড়ে ওঠাও তো এমন নিঃষ্কলঙ্ক হতে পারত। মনে পড়ে ছোট্ট বেলায় আমার ভাই যখন খেলনা গাড়ি, বন্দুক নিয়ে খেলতো কিংবা বোনের রঙচঙা পুতুল কিছুই ভালো লাগতো না আমার। একটা যুতসই খেলনা খুঁজে পাইনি কখনো। অথচ একটা খেলনার লোভ তাড়িয়ে বেড়াতো সবসময়। মনে আছে আমি বোনের সুসজ্জিত পুতুলগুলো নিয়ে চলে যেতাম খাটের নিচে। তারপর একে একে খুলতাম ওগুলোর কাপড়। পুতুলগুলোর উলঙ্গ শরীরে আমার দৃষ্টি পড়ে থাকতো দু পায়ের ফাঁকেই। আমি কি ওদের মতো কেউ? ওই নিঃষ্প্রাণের মাঝে কতদিন যে নিজের প্রাণ খুঁজে বেড়িয়েছি তার ঠিক নেই। এভাবে কতদিন কত অচেনা রহস্যময়তায় বন্দি থেকে থেকে কেটে গেছে শৈশব! কিন্তু সেই তো একদিন আলাদা হতেই হলো। ক্রমশ যে বড় হয়ে উঠছিলাম আমি। চারদিকে তখন কত ফিসফাস, কত কানাকানি। অবশেষে ছেড়ে এলাম সবকিছু। তারপর থেকে মানুষ থেকে দুরে। না মানুষদের কাছাকাছি। তবু এই জানলার ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে ওই শিশুটিকে দেখলে বুক হু-হু করে। ইচ্ছে করে পা দুটো ফাঁক করে দেখি ওর। জন্মটা আমার মতো ফেলনা নয় তো! আমি আর না মানুষেরা এখন একসঙ্গে থাকি। আমাদের মানুষ নামের যন্ত্রণাকর কান্না হাসি আনন্দ সব আমাদের সঙ্গেই জড়াজড়ি করে থাকে। কখনো রাতে অসহ্য লজ্জায় হতাশায় শরীরগুলো কুকড়ে আসে। আবার কখনো মনে হয় সত্য যেন গনগেনে আগুনের মতো। তার লাল শিখা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সুন্দর। যেন ছুঁয়ে দেখি একটু প্রাণ ভরে। কিন্তু ছুঁতে গেলে যে তা শুধু জ্বালাই বাড়ায়। তাই জন্মের ভয়ঙ্কর সত্যটুকুকে মেনে নিয়েই আমার জীবন। অন্যদের চেয়ে আলাদা, এবং ভিন্ন। তাইতো মাঝে মাঝে সব ভুলে যেতে চাই। আমি কে, কোথা থেকে, কেন এসেছি, চারপাশে ওরা কে বা কতটুকু সব। ক্রমান্বয়ে কৈশরের যন্ত্রণা পেরিয়ে যখন নিজের যৌবন টের পাই, ততদিনে মোটা পুরুষালী রোমশ হাত পায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেঢপ স্ফীত হয়ে পড়েছিল মেয়েলি বুক। রাতের পর রাত বিছানায় কি অসহ্য ক্ষণ। কি যন্ত্রণা কি যন্ত্রণা! একে কি বলে মানুষের কামনা? এ কামনা কি পুরুষের নাকি যৌবনা কোনো নারীর? এ যন্ত্রণার যেন কোনো আদি নেই অন্ত নেই। যেন এক অন্ধ গহ্বরে ছুটে চলা অন্ধের মতো দিক্বিদিক। একটা রোমশ মাকড়শা যেন হেঁটে বেড়ার শরীরের অলিগলি। প্রতিটি রোমকুপ কখনো বিচ্চুরিত, কখনো যেন বিস্ফোরিত হয়। তবু ঠাঁই নাই, কোথাও ঠাঁই নাই। কখনো মনে হয় আমার এখন একজন পুরুষ চাই। যে আমাকে টেনে নেবে তার শক্ত পেশীর বাঁধনে। রাতের এই অসহায় সময়ে তার পুরুষ গন্ধের বুকে মুখ ঘষব আমি। আবার কখনো মনে হয় ভালোবাসার একজন নারী চাই।
যে নারী তার সমস্ত দিয়ে আগলে রাখবে আমার অসহায় পৃথিবী। তার নরম ঠোঁটে খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে মনিরতন। আবার কখনো একা। যেন নিথর নিশ্চল আমি এক শূন্য মাংসপিণ্ড। এইসব দিন রাত আমাকে কেবলই মনে করিয়ে দেয় আমার পরিচয়। শুধু আমি নই, কত না মানুষের কান্না, গোপন হাহাকার ভারী করে তোলে এখানের বাতাস। আমি ওদের কাউকে কাউকে সান্ত্বনা দেই। তাওতো ভালো তোমার একটা শৈশব ছিল, তুমি আমার মতো জন্ম বিকৃত নও। তবু ওদের মনের বাঁধ মানে না। চোখের দুকূল ছাপিয়ে কেবলই বন্যা আর বন্যা। ওরা অসহ্য ব্যথায়, লজ্জায়, নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণায় গুমরে গুমরে কাঁদে। তবু যেন সকালে নিয়ম করে আবার সব কিছু ঠিক হতে হয়। তাই কখনো আমরা নিজের সঙ্গে নিজেই অভিনয় করি। আয়নায় নিজের অদ্ভুত চেহারাটায় রঙ-চঙ মেখে সাজি। ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিকে যখন নিজেকে দেখি, তখন মনে হয় আমি যেন কোনো পরিপূর্ণ নারী। পৃথিবীর এক কোণে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে কোনো পুরুষ। আমি যেন চাইলেই গর্ভে আরেকটি প্রাণ ধারণ করতে পারি। আমি তাই মাঝে মাঝেই ছুটে আসি এইখানে। এই ঘষা কাঁচ জানালার ধারে। কতদিন একচিলতে সকালের রোদে এই ঘরটা আলোকিত হয়। শিশুটি আপন মনে খেলে। কতদিন বা শিশুটিকে ঘিরে থাকে আবছা রহস্যময়তা। শিশুটি আমার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই হাসে। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে ওকে কোলে নেই। ওর ছোট্ট কচি চিবুকে চুমু খাই আর বলি-বল আমি তোর কে? বাবা নাকি মা, ভাই নাকি বোন? নাকি আমিই হলাম তুই, অথবা তোর মতোই হতে পারতো আমার গর্ভজাত সন্তান। কিন্তু আমার ওর কাছে ছুটে যাওয়া হয় না। লুকিয়ে থাকি জানালার আড়ালে। আমার শরীর জুড়ে পাপ, দৃষ্টিতে অশুচি, স্পর্শে নাকি কেবলই ঘৃণা। কখনো কখনো তীব্র দুঃখে শরীর যখন ভেঙ্গে আসে দূর থেকে আমি ওকে দেখে কাঁদি। বিধাতার কতটুকুই বা ক্ষতি হতো সেদিন সেখানে আমি না জন্মালে! আমাকে দূর থেকে দেখেও মায়ের চোখে জল আসে। ইচ্ছে করে ছুটে যাই আর বলি-মা বিধাতা পুরুষ মানুষ বানিয়েছে সকল সৃষ্টির সেরা করে। ফু দিয়ে তাতে নাকি দিয়েছেন জীবন। তারপর তাকে দুই খণ্ড করে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। এক খণ্ডে পুরুষ, অন্য খণ্ডে নারী। আর আমাকে না হয় পাঠিয়েছেন খণ্ড-বিখণ্ড করে। না হয় হলো জন্ম বিখণ্ডিত, কিন্তু দশ মাস তোমার যে গর্ভধারণ, প্রসব বেদনাতো খণ্ড বিখণ্ড ছিল না। তবে কাছে টেনে নাও, একটু আদর করো। যেমন তুমি আদর করো আমার অন্য ভাইবোনকে। কিন্তু বলা তো হয় না কোনো কিছু। মা দুর থেকে কেবল অশ্রু সজল চোখে তাকিয়েই থাকেন, আর বাবা দেখলে লজ্জায় অপরাধে চোখে নামিয়ে নেন। ভাইবোনেরা দুঃখিত, বিব্রত। আমিও ওদের দেখলে এখন দৌড়ে পালিয়ে আসি। মনে হয় পৃথিবীটা যেন শূন্য, ফাঁপা। সভ্যতা নামের শয়তানটা নিছক একটা টক মিষ্টি আচার। তাই এই যে চোখের জল কখনো ক্ষোভে অভিমানে মুছে ফেলি। নিজেকে নিজে বলি তোমার জন্ম তোমার কলঙ্ক নয়। এর সব দায় স্রষ্টার। ফুলফলের সুন্দর পৃথিবীতে তিনি যে বিষাক্ত পোকামাকড় দিয়েও পাঠিয়েছেন। এ বিখণ্ডিত জীবন মানুষের নয়। ঘষাকাঁচ জানালার ভেতর দিয়ে শিশুটিকে দেখা যায়। ও খেলছে কেবলই খেলছে শুধু মানুষ হয়ে। এই খেলায় ও শুধু আমার মতোই কেবল মানুষ। না পুরুষ না নারী।
অনুস্বর
তুমি কি মনে কর না যে, সব প্রশ্নেরই একসময় উত্তর দিতে হয়। উত্তর যত কঠিন যত রূঢ়ই হোক না কেন তার জন্য সামান্যতম প্রস্তুত না থাকলে ওটা তোমাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেবে। সে ক্ষতটা বড্ড ভয়ানক সোনা। ওটা অনেকটা ক্যানসারের মতো। সব কিছু আস্তে আস্তে গ্রাস করে। মনে করো একটা বিপুল স্রোত শান্ত একটা উপকূলের পাড় ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ভাবতে পারো সেই চিত্রটা? এটা না বুঝলে আসলে ঠিক বোঝানোও যাবে না। বোঝানো সম্ভবও নয়। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমিও বুঝি না। তবু এত সহজে হার মেনে নেওয়ার মেয়ে আমি নই। তীব্র স্রোতের ধ্বংসলীলার পর যে স্মৃতি চিহ্নটি তখনো দাঁড়িয়ে থাকে আমি তাই হতে চাই। এই যে তোমার ঠোঁটে চুমু খাচ্ছি, স্তনে হাত বুলাচ্ছি এটাও ওই স্রোতের মধ্যে লড়াই করার মতোই। এটা যে সে স্রোত নয়। সভ্যতা, মহাকাল আর প্রকৃতির প্রকাণ্ড জিঘাংসা। টিকতে পারব কি না জানি না, তবু সান্ত্বনা এই যে লড়াই তো হলো! তবু তো পাওয়া গেলো যোদ্ধার সম্মান। এসো, আমার আরও কাছে এসো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরো আমায়। জানো, আমার যদি একটা ঐশ্বরিক তলোয়ার থাকতো, বিশ্বাস করো আমি এই প্রবৃত্তিটাকেও কেটে বাদ দিতাম। কিন্তু কি করব বলো। আমার শরীরে তো কোনো দোষ নেই। শত হলেও তো মানুষ। এছাড়া পৃথিবীর সব প্রাণীই যে এই প্রবৃত্তিদুষ্ট। কোনো কোনো দিন মনে হয় শরীরের সমস্ত ধমনী যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে ওঠে। মনে হয় বিস্ফোরণ ঘটবে। ওহ, আরও সবল শক্তিতে জড়িয়ে ধরো আমায়। পিষ্ঠ করো, দংশন করো। রক্তচক্ষু দেখানো প্রকৃতিকে দেখিয়ে দাও শক্তিমত্তা শুধু পৌরুষের প্রতীক নয়। জানো, এই তীব্র কামনাটা যখন আমায় তার প্রথম দর্শন দিয়েছিল তখন আমি মাত্র কৈশোরে। হঠাৎ যেন কি একটা দমকা বায়ু ঘূর্ণি ঝড়ের বেড়ে শরীরের সমস্ত বাঁধ ভেঙে দিচ্ছিল। ক্রমেই যেন তখন মনে হতো একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার সুড়ঙ্গে ছোট্ট একটা আলোর কণা যেমন দুরন্ত বেগে ছড়িয়ে পড়ে মনে হতো এটা ঠিক তেমনই। আমার কেন-যেন খুব জানতে ইচ্ছে করে, আচ্ছা তোমার অনুভূতিও কি তখন একই রকম ছিল। প্রথম নিজের রক্ত দর্শনে কী ভেবেছিলে তুমি? সেসময় আমি নিজের মধ্যে নিজের পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছিলাম জানো? বুঝতে পারছিলাম ক্রমশ আমি কৈশোর পেছনে ফেলে আসছি। তার কিছুদিন পরই আমি প্রথম পুরুষ চিনতে পারি। কেউ যেন আমার কৈশোরের জাগতিক অজ্ঞানতাকে এক চড়ে যৌবনে এনে ফেলেছিল। আমি বুঝতে শিখতে শুরু করি আমি আসলে একজন মেয়ে। আমার বুক আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যৌনাঙ্গ জন্মের অনুষঙ্গ। আমার সেই প্রথম পুরুষটিকে আমি এখনো ভুলতে পারিনি জানো? ঠিক তোমার মতো করেই এভাবে একদিন জড়িয়ে ছিল আমায়। তবে তার বাঁধন ছিল তোমার চেয়ে শক্ত। চুমুতে ছিল সেদিন সমুদ্রের স্বাদ। বেষ্টনে ছিল আত্মাহুতির আনন্দ। আহ, আমার প্রথম গহন গোপন পুরুষ! না তার নাম কখনো প্রকাশ করিনি। থাক না গোপনই থাকুক। এখন আমি পুরুষ ঘৃণা করি। না অন্য কোনো কারণ নেই। ওরা কেবলই পুরুষ তাই। ওরাই আমাকে একটু একটু করে শিখিয়েছে কিভাবে বিদ্রোহ করতে হয়। না না, এটা নিছকই কোনো তন্ত্র কথা নয়। বরং এটিই মনে হয় সৃষ্টির সবচেয়ে বড় ত্রুটি। জানি অনেকেই আমার এই কথার সঙ্গে মতপার্থক্যে জড়াবে। তবু এটাই সত্যি কথা। পুরুষ কেবলই অত্যাচারী, নির্দয়, আর ছলচাতুরিতে ভরা। শুধু মানুষ কেন অন্য প্রাণীদের দিকে তাকাও না, মেয়েদের ওরা কেবলই ব্যাবহার করে ভবিষ্যৎ বংশের বীজ বপনের উর্বর ভূমি হিসেবে। শুধু গায়ের জোরেই ওরা দখল করে, ভালোবাসার জোরে নয়। জানি, বিকল্প কিছু উদাহরণ তুমি নিশ্চই দেখাতে পারবে। তবে সেটা ওদের ক্ষেত্রে যে খুব বেশি নগন্য এটাও নিশ্চই স্বীকার করো? আমার স্বামী ছিলেন একজন আদর্শ পুরুষ। দায়িত্ববান, কর্তব্যবান এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। তিনি যে আমাকে ভালোবাসতেন না এমন নয়। তবে সেটা ছিল খুব বেশি শারীরিক। আমার বিবাহিত এক বছরের জীবনে শরীরের ওই ভালোবাসা যে আমিও একেবারে কম উপভোগ করেছি তাও নয়। তবু কিসের যেন অভাব বোধ করতাম। জানো, আমার স্বামী যখন আমায় জড়িয়ে ধরতেন আমি আলাদা করে কোনো স্বাদ অনুভব করতাম না। আমি আনেক ভেবেছি এর কারণ। পরে বুঝেছি আসলে সব পুরুষের স্বাদই এক। আমি যেন রাতের পর রাত নিজের ভেতরেই নিজে পিষ্ট হচ্ছিলাম। পরের দিকে আমার স্বামীর সঙ্গে প্রতিবার মিলনের সময় মনে হতো আমি যেন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। কাঁচের মতো ভেঙে যেন টুকরো টুকরো হচ্ছি শত খণ্ডে। পরমুহূর্তেই এই সমাজের কেউ আবার ভয় দেখিয়ে জোড়া লাগিয়ে তুলছে ওই কাঁচ খণ্ডটা। এভাবেই আমি একদিন বিদ্রোহ করতে শিখলাম। সমাজের বিরুদ্ধে, পুরুষের বিরুদ্ধে। আচ্ছা তোমার জীবনে পুরুষ কত জন? আমার? শুধু এটা জেনে রেখো সেই দুটিই নয়। তারপর আরও একাধিক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি আমি। বৈচিত্র্যের আশায়, অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। কিন্তু সত্যি উপলব্ধি হলো এই যে, ওরা বৈচিত্র্যহীন, বিরক্তিকর, আর সুবিধাবাদী। হ্যাঁ, চাইলেই আমাকে তুমি ব্যাভিচারিনী আখ্যা দিতে পারো। তবে তাতে বিন্দুমাত্র কিছু আসে যায় না আমার। প্রতিটি পুরুষ একটু একটু করে খুঁচিয়ে জাগিয়েছে আমার নারীসত্তাকে। প্রতিটি পুরুষেই আমি একই রূপ দেখেছি। সুবিধাবাদী ও পলায়নপর। সব পুরুষই আমাকে আগুনের জলন্ত শিখায় ফেলে পালিয়েছে সবসময়। বিশ্বাস করো আমি দেখেছি ওদের মাঝে নতুন কিছু নেই। ওদের আবিষ্কার করা অপ্রয়োজনীয়। অবশ্য নারী, যে কিনা নিজেই এখনো আবিষ্কার হয়নি, সে কিভাবে আরেকটি লিঙ্গকে আবিষ্কার করবে! শুধুই বংশ রক্ষা, শুধুই কামনা, শুধুই মাতৃত্ব! আমার বারবার ইচ্ছে করেছে ওদের একটাকে খুবলে খামচে রক্তাক্ত করে জিজ্ঞেস করি, আমার মাঝে কি যৌনতা ছাড়া আর কিছুই নেই? এসো সোনা, আরো ঘনিষ্ট হও। চুমু খাও আমায়, চুমু খেতে আমার ভালো লাগে। জানো সমাজ যে পুরুষটিকে আমার স্বামী বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাকে অবশ্য এক বছরের বেশি আমি কাছে পাইনি। সে আমার মাঝে বংশের বীজ বপনের আগেই পৃথিবী ছেড়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় কি জানো, তার মৃত্যুর পর মৃতদেহের সামনে বসে আমি চোখের জল ফেলেছিলাম। এখনো আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি কেন কেঁদেছিলাম সেদিন! লোকটাকে তো আমি ভালোবাসতাম না। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তার মৃত্যুর পর আমি চুড়ান্ত একা হয়ে গিয়েছিলাম।
মাঝে মাঝে তখন মনে হতো আমি গর্ভধারণ করলেই বোধ হয় ভালো করতাম। অন্তত মাতৃত্ব কাকে বলে সেটাতো বুঝতে পারতাম! পরে অবশ্য সেটা ঠিকই পেয়েছিলাম যখন, তখন তার বৈধতার স্বীকৃতি সমাজ দেবে না। তাই সেই গর্ভফুল আর কোনোদিন আলোর মুখ দেখেনি। সেই থেকে পলায়নবাদী পুরুষত্বের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা। আমি যেন আমার ওই বৈধব্যের সময়তেই বারবার হোঁচট খেতে খেতে আবিষ্কার করি পুরুষদের। আমার এখন সত্যিই খুব করুণা হয় ওই সব মেয়ের জন্য, যারা সারাজীবন নিজেদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে রাখে পুরুষের খড়্গ তলে বলি হওয়ার জন্য। যেন যোনি তৈরিই হয়েছে পুংলিঙ্গের পরিপূরক হিসেবে। এটি অবিচার, পক্ষপাতিত্ব প্রকৃতির। তাই তো যখন তোমার নরম পেটে এখন চুমু খাই তখন নিজেকে সত্যিকারের বিদ্রোহী মনে হয়। মনে হয় কামনাতেও পুরুষত্বকে হার মানানো যায় অন্য সব কিছুর মতো। আর পক্ষপাতদুষ্ট প্রকৃতিকে দেখানো গেল- দুটি লিঙ্গ করেই যদি প্রাণী সৃষ্টি করলে তবে কনে একটি শুধু আজীবন ভিক্ষুকের মতো দান গ্রহণ করবে। জানো, ঘৃণায় আমার শরীর শিরশির করে ওঠে যখন দেখি এখনো পৃথিবীতে মেয়েরা পুরুষত্বের পূজা করে। সামান্য একটা কালো পাথরকে পুংলিঙ্গ বানিয়ে তাতে দেবতা জ্ঞানে দুধ-সিঁদুর ঢালে। তাদের কাছে ওই কালো পাথরের লিঙ্গই যেন সারাজীবনের আরাধ্য। ছিঃ, নারীত্বের কি চরম অসম্মান, নির্বুদ্ধিতা আর গোলামির কি হতাশাজনক নিদর্শন! তুমি কি কখনো পুরুষদের যোনি পূজা করতে দেখেছ? অথচ মেয়েরা ভূমির প্রতীক। তারা শস্যদাত্রী-দেবী। তবু কি পুরুষ কখনো আরাধনা করেছে তার যোনির? করেনি, কেবল নারীকে মাতৃরূপ আর প্রেরণাদায়ী হিসেবে ভূষিত করে ভুলিয়ে রেখেছে বোকা মেয়েগুলোকে। আমার বিদ্রোহ তাই প্রকৃতির প্রতি। এসো হাত বুলাও আমার শস্যের ভাঁড়ারে। চুমু খাও ঠোঁটে, স্তনে, গ্রীবায়, জঙ্ঘায়। দেখো, আকাশে কেমন চাঁদ উঠেছে। নির্জন এই রাতে চাঁদটা যেন মাদকতা ছড়ায় প্রতিবার। এই যে অসম্ভব কামনা, ঘোর তৃষ্ণা, বুঝতে পারো, ধরতে পারো একে? আমি বারবার চেষ্টা করি খুব মন দিয়ে পড়তে এই পাঠ। তবু কখনো এই দুর্বোধ্য পাঠ বুঝতে পারিনি। দীর্ঘ যুদ্ধে যেখানে হাজার হাজার যোদ্ধার লাশ পড়ে থাকে, তবু কি বাকিরা যুদ্ধ থামিয়ে দেয়? আমার যুদ্ধও চলছে। কিন্তু কতদিন আর তা করতে হবে জানি না। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে নিজের ছায়ারা এসে ঘিরে ধরে। নিজেকে মনে হয় রণক্লান্ত সৈনিক। ছায়ারা আমাকে দেখে হাসে, প্রশ্ন করে, কার বিরুদ্ধে কিসের এই যুদ্ধ? সত্যি কী প্রমাণ করতে চাও তুমি? আমি জানি না, জানি না বলে চিৎকার করি, তবু ওরা তৃপ্ত হয় না। ছায়ার দলটা আমাকে ঘিরে থাকা ওদের বৃত্তটা ছোট করে আনে। মনে হয় যেন আমি অথৈ জলে ডুবে যাচ্ছি। বাঁচাও বাঁচাও আমায়, জড়িয়ে ধরো শক্ত করে। আমি কারও বুকে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমাতে চাই। না আমার তৃষ্ণা মেটে না, এ বড় গহন তৃষ্ণা। বারবার আমি আমার মাঝেই মুখ লুকাই। পাই না, পাই না আমি যা চাই। যাও তুমি, সরে যাও। তোমাকেও আর চাই না। তোমার বুকে কামনা আছে ঠিকই কিন্তু উষ্ণতা নেই। সুগন্ধের পানপাত্র রাখা আছে ঠিকই, তবু কিসের যেন অভাব। আমার নাক যেন একটা রোমশ গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। কি যেন বারবার আমার ভেতর বিদ্যুতের মতো ঝলক দেয়। প্রকৃতি যেন আমার অতৃপ্ত কানের সামনে ফিসফিস করে বলে, হে পৃথিবীর আদি মাতা, শস্যের সম্ভাবনা নিহিত থাকে লাঙ্গলেই। বৃষ্টি হোক, পাতার কণায়, বীজের গভীরে পৌঁছে যাক তৃপ্তির জল। দেখো, দূরে সেই জল হাতে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষায় কেউ। খুঁজে নাও তারে, আবার আলিঙ্গন হোক।