বাংলাদেশের সব নদ-নদীগুলো দেখতে একরকম; একই স্রোত, শাপলার ঝোপ, টানের দিনে ভেসে ওঠা চড়া, ঘাটগুলোও দেখতে একদম একরকম। সে খোয়াই হোক কিংবা কালনি কিংবা ভেড়ামোহনা। পাড় ঘেঁষে বাজার, টিনশেডের ছাপড়া আর সারি সারি হরেক মুদির মালামাল। সময়ের স্রোত বেয়ে নেমে গেছে পানির স্তর, তবু বাজার ঘেঁষে যে ঘাট বছরভর দাঁড়িয়ে থাকে তাতে ইঞ্জিনের নৌকা বেয়ে মাঝে মাঝে চড়ে আটকা পড়ে পড়ে চিপসের প্যাকেটের সাথে আসে কনডমের প্যাকেটও, পৌঁছায় নতুন রিলঞ্চ করা মিনিপ্যাক শ্যাম্পু তেল। ইউনিয়ন পরিষদের পিচ করা রাস্তা থেকে নেমে থাম্বাগুলো ধানের ক্ষেতে নির্দিষ্ট বিরতিতে জিরিয়ে জিরিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন নিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে জনপ্রতিনিধির প্রতিশ্রুতি পূরণে। আর তার হাত ধরে ঢোকে আকাশ সংস্কৃতি। সন্ধ্যার পর ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষগুলোর একঘেয়ে নিরানন্দ দিনগুলো সন্ধ্যায় বেশ রঙ-চঙে হয়ে ওঠে জামাইরাজার শাশুড়ি-জামাইয়ের ঝগড়া আর প্রতিবাদী পুত্রবধূ দুর্গার দাপট দেখতে দেখতে। মাঝে মাঝে তাদের হাতগুলো ভেতরের উত্তেজনা প্রকাশ করে ফেলে পুনঃপুন তালির মাধ্যমে।যদিও ঘরের নারীদের কোনো ব্যাপারে নাক গলানো একদম পছন্দ নয়।
সেদিন সক্কাল সক্কাল মাটির উনুনে ডেংগা পোড়াতে পোড়াতে ধোঁয়ায় নাক চোখ মুখ দমবন্ধ হয়ে আসতে আসতে ললনা রানির কানে ধাক্কা দেয় হালকা কোলাহল। ক্রমে সে কোলাহল বাড়তে থাকলে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বুড়ির বিলাপ-আমার কেউ নাই গু বেইট্টাইন, আমার কুনতা নাই। অতলা বেইল অইল কেউ এট্টুতা খাওন দিল অ না। ললিতা রানি মুখ ঝামটায় অভ্যাস মতো- আরে খাড়ৈন না, এক্টুট্টা দিরং করৈন। বুড়ি ক্ষানিক চুপ করে, ললিতা রানি শুনতে পায় গুঞ্জন ক্রমে হৈ চৈ-এ রূপান্তরিত হচ্ছে। চুলার ভিতরে আরো ডেংগা ঠেসে ঠেসে ঢুকাতে ঢুকাতে অপরিচিত কোলাহল তার কৌতূহল উসকে দেয় ক্ষিদা পেটে ভাতের মাড়ের গন্ধের মতো। একবার উঁকি দিয়ে দেখার ইচ্ছেটার গলা টিপে ধরে সে। বুড়িরে এই খুদ সিদ্ধ না দিয়ে গেলে বুড়ির বিলাপ বাড়ির অদৃশ্য পাঁচিল ডিঙিয়ে মাঠে পুলার বাপের কান অব্দি গিয়েও থামবে না। দূরে, আরও দূরে পঞ্চায়েতের কান পর্যন্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকবে। বুড়ির বয়স হলে হবে কী, গলায় যেন এখনো বিশ বছরের জোয়ানকি।
ললিতা রানির নানান যন্ত্রণা। অতিবৃষ্টির কারণে বৈশাখের ফসল ওঠেনি। পুরা দরে চাল কিনে খেতে হয়। নিজেদের জন্য তিনবেলা মোটা চালের ভাত হলেও বুড়ির জন্য একবেলা। সকাল আর রাতে সস্তা দরের খুদ সেদ্ধ। বুড়ির পোলার মতে দাঁত নাই মায়ের, এই সেদ্ধ খুদই তার খেতে সুবিধা। কিন্তু প্রতিবেলাই বুড়ি প্যানপ্যান করে, খুদ খেতে চায় না। সক্কাল সক্কাল ডেংগার ধোঁয়ায় নাক মুখ জ্বলিয়ে খুদ রান্না করতে হয় বুড়ির জন্য, নিজেরা আগের দিনের বাসি ভাতই খেয়ে নেয় যদিও। এবছর ধান না হওয়ায় খেরও নেই, এমনকি গরুটাকে পর্যন্ত ডেংগা (ধান গাছের গুড়ি বা শেকড়) খাওয়াতে হয়, তায় আবার চুলার জ্বালানি!
বাপের জন্মে চাল কিনে খেতে দেখেনি সে, না বাপের ঘরে না শ্বশুরের ঘরে। অথচ এ বছর অতিবৃষ্টিতে বৈশাখের ধান তো গেছেই এই অঘ্রাণেও যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে, এই মৌসুমের ফসলও ঘরে ওঠার সম্ভাবনা কম। জনমে সে আকাল দেখেনি, শাশুড়ির মুখে শুনেছে, যে বছর বঙ্গবন্ধু মরলো তার আগের বছর ঘরে ঘরে আকাল লেগেছিলো। বুড়ির জন্য সেদ্ধ খুদ নিয়ে গেলে, বুড়ি প্যানপ্যান করলে ললিতা সেই গল্পই শোনায়। কিয়ার লাইগ্যা, হোনান নাই তখন চাইয়াচিন্তা চোদ্রি বাড়ির ফ্যান খাইছেন। অখনো ত ভাত পাইতাছইন, ফ্যান না। প্যানপ্যান কইরেন না।
বলে বটে, বুড়িও সেই কথা শোনামাত্র কিছু একটা স্মরণে এনে চুপ করে যায়, কিন্তু বুড়ির বার্ধক্যের ক্লান্ত ভাঁজে ভাঁজে কী যে এক স্মৃতি ঝিলিক মেরে হাওরের ঘাঘট মাছের মতো আবার গহীন জলে লুকিয়ে যায়। ললিতা রানির তা চোখে পড়ে না। সে শাশুড়িকে চুপ করিয়ে নিজের বিজয় উদযাপন করে বিড়বিড়িয়ে- কেমনে থুতা মুখ ভোঁতা কইরা দিলাম, বেডি আমি জানি এই একডা কথা কইলেই তুই ঠাণ্ডা।
তাদের বাস্তবতা মোটেই সালিশে বিবেচিত হয় না। দুই ম্যানেজারের এক ম্যানেজার পলাতক এই দিবালোকের মতো সত্যটা সবাই বেমালুম ভুলে যাবার সুচতুর অভিনয় করে।
নদীতে ভেসে ওঠা লাশটির ফুলে ফেঁপে আসল চেহারা প্রায় বিকৃত। নদীর ভাঙনে তলিয়ে যাওয়া নিশ্চিহ্ন গ্রামের মতো এর নাক চোখ মুখ সব সমান। মাছের খুবলে খুবলে খাওয়া মাংসে পচন ধরেছে, রক্তের রঙ কালো আর মাংসের রঙ কালচে ফ্যাকাশে সাদা। পেট ফুলে ঢোল, গায়ের শার্টের দুর্বল বোতাম সেই ফোলা আটকাতে না পেরে ছিঁড়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়েছে। শার্ট প্যান্ট আঁটো শরীরের সাথে সেটে গেছে, আর তার ফাঁকে বের হয়ে থাকা হাতের তালু, পায়ের তালুতে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না লাশটির গায়ের রঙ সাদা না কালো। বীভৎস বিকৃত লাশটি কার এ নিয়ে মৃদু কোলাহল ক্রমে হৈ চৈ-এ রূপ নিতে থাকে। সকাল সকাল হাটগামী লোকদের গবেষণা দিনের তাড়া স্থগিত করে রাখে কিছুক্ষণের জন্য। কেউ পকেট হাতড়ায় মোবাইলের খোঁজে, থানায় না হোক নেহাৎ চেয়ারম্যানের কানে তো খবরখানা পৌঁছানো উচিত। নদীতে ভেসে আসা বেওয়ারিশ লাশ, না জানি পিছনের কেইসটা কী? আত্মহত্যা না হত্যা। তারা আবার সভয়ে মোবাইলখানা পকেটে রেখে দেয়। অতিসক্রীয় আর সচেতন চেতনা সাবধান করে। থাকুক, কে আবার আগে ফোন করে বিপদ ডেকে আনে! কার লাশ, কিসের মরা, কেমনে এখানে এই নদীতে এসে ভিড়েছে কেউ যেমন জানে না, না জানাই ভালো। জানতে চাওয়ার সঙ্গে যদি বিপদও ঘাড়ে আসে! উত্তুরে বাতাসের সাথে একটা উৎকট গন্ধ নাকে ঝাপটা দিলে পানঅলা, মাছঅলা আর সবজিঅলা তাদের ঝাঁপিগুলো মাথায় তুলে হাটমুখী হাঁটা দেয়। কারো ঘরে শাশুড়ি-বউএ ঝগড়া লাগলে সে খবর হাটে বসে পাওয়া যায় আর এতো জলজ্যান্ত একটা লাশ। কার লাশ, কিসের লাশ, হিন্দুর লাশ নাকি মুসলমানের, হত্যা নাকি আত্মহত্যা হাটে বসে নিশ্চিন্তেই খবর পৌঁছে যাবে কানে। প্রাথমিক দেখার কৌতূহল নিবৃত্তির পর শুধু শুধু এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
দুই.
দুলাল আর দুলালের বউ মাজনের পায়ে কানতে কানতে ঝাঁপিয়ে পড়লে হরমুজ মাজন থানা পুলিশের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। শনিবার বাজারের সাপ্তাহিক বন্ধ। ঐদিনই নিজ দোকানে সালিশের আয়োজন করে হরমুজ মাজন, সালিশের আনুষাঙ্গিক পান সুপারি জর্দা আর জিলাপিও তৈরি রাখে সময়মতো।
হরমুজ মাজনের এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবার দরকার নেই। এই যেমন পক্ষ-বিপক্ষ, সাক্ষী-প্রমাণ, হাদিয়া ইত্যাদি সালিশের আবশ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ ভাবনাগুলো অবস্থানগত কারণেই তার ভাবতে হয় না। এই বাজারে একমাত্র হজ্ব করা হাজী সে। সবার সমীহ আর সম্ভ্রমের মানুষ। সবাই নানা সালিশ বিচার ফতোয়ার প্রয়োজনে তার কাছে আসে। আজ তার প্রয়োজনে দোষ-নির্দোষ বিবেচনায় সবাই যে চোখ বন্ধ করে তার পক্ষেই কথা বলবে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েই সালিশ ডেকেছে সে।
সন্ধ্যায় সব পরিকল্পনা মতোই ঘটে। সালিশে উপস্থিত মুরুব্বীরা হরমুজ মাজনের দাওয়াত পেয়ে বর্তে গেছে। ‘বালানি মাজন সাব’ বলে পান খাওয়া দাঁত বের করে সালাম আদাব দিয়ে স্ব স্ব আসন গ্রহণ করতে করতে তাদের বিগলিত হাসি বন্ধ করতে বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে যায়। সালিশের অপরপক্ষ দুলাল আর তার ক্রন্দনরত বউয়ের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দুলাল কিংবা তার বউ সেটা আশাও করে না। একটুকরা ভিটার মাটি বাঁচানো আর থানা পুলিশ থেকে বাঁচা এই দুই প্রত্যাশার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেই সালিশে হাজির হয়েছে তারা। যে লাখ পাঁচেক টাকার মামলা কোটি টাকার মালিক হরমুজ মাজন ইচ্ছে করলেই মাফ করে দিতে পারে। পরে না হয় স্বামী স্ত্রীতে ভিক্ষে করে খাবে। তবু এবারটা তো মাফ হোক। কিন্তু উপস্থিত কারোরই করুণার একখানা শব্দ কিংবা বাণী তাদের দিকে ধাবিত হয় না। তাদের বাস্তবতা মোটেই সালিশে বিবেচিত হয় না। দুই ম্যানেজারের এক ম্যানেজার পলাতক এই দিবালোকের মতো সত্যটা সবাই বেমালুম ভুলে যাবার সুচতুর অভিনয় করে। আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সামান্যতম সুযোগ মেলে না দুলাল আর তার বউয়ের। বাজারদর বিবেচনায় ভিটেবাড়িখানা হরমুজের নামে লিখে দেয়ার শর্তে সালিশের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটে এশার নামাজের আগে আগেই।
দিন কয় ধরে কালিগাছতলার মোমবাতি আগরবাতির মানত ভেস্তে যাওয়ার দুঃখ আর মাথা গোজার ঠাইঁটুকু হারানোর বেদনায় নীল দুজন, দুলাল আর দুলালের বউ রাস্তায় নামে। দুলালের তখন হিসাবে আসে না সত্যিকারের বিষ খেলে কতোটা নীল হয় মরদের শরীর। মদ-জুয়ার বদভ্যাস টুকটাক আছে বটে দুলালের। এর জন্য সুদে কিস্তিতে ঋণও অঢেল। মাসের বেতন পেয়ে তার যোগান দিতে গিয়ে পেটের ভাতের যোগান হয় না। তাই বলে হরমুজ মাজনের মতো প্রতাপশালী ব্যবসায়ীর ক্যাশবাক্সে হাত দেয়ার মতো পুরু কলিজা তার নয়। এ সত্য যেমন হরমুজ মাজন জানে, তেমনি জানে সালিশের মুরুব্বীয়ান রা, আর জানতো দুলালের সহকর্মী অপর ম্যানেজার খায়রুল। তাই সুযোগটা নেয়া তার সহজ হয়েছে। শিয়ালের কাছে মুরগি বাগি দিলে আত্মসাৎ করা সহজ। দুলালের মদ-জুয়ার আসক্তির বিষয়টা মাজনের সামনে পুনঃপুন উত্থাপন করেছে চতুরতায় যেনো বা সাবধান করছে মালিককে, অন্যদিকে আখের গুছিয়েছে।
কৃষ্ণপুর, মাকালকান্দি গ্রামগুলোতে নির্বিচারে মানুষ মেরে রেখে গেছে পাঞ্জাবীরা। শ্যাম আর তার দাসপার্টি তাদের সাথে পেরে উঠবে তো শেষ পর্যন্ত?
ঘরে ফিরে একমাত্র বংশধর সজল দাসের গলা জড়িয়ে ধরে মরা কান্না ধরে দুলালের বউ। দুলালের পেটে তীব্র খিদে ক্ষুন্নিবৃত্তির আবশ্যিক ডাক, কিন্তু ইচ্ছে আর রুচি বিপরীতমুখী। দুর্বিষহ এই মৃত্যুপুরী, সত্যি কাল থেকে পথের ভিখারি সে। এর চেয়ে মৃত্যু ভালো। কী হবে স্ত্রীর, কী হবে একমাত্র বংশধরের… দূর শালা থাকুক সব। আগে তো নিজে মরে বাঁচুক।
তিন.
রাধারানী জমে যাওয়া নারকেল তেলের শিশিটা রোদের আঁচে গলতে দেয়। মাথাভর্তি উকুন পাঞ্জাবীদের মতো বিরামহীন আক্রমণ করে চলে দিনভর। শান্তিতে দুদণ্ড বসবার জো নেই। গলা তেল নিয়ে পড়ন্ত শীতের বেলা রোদে চিরুনি নিয়ে বসতেই মা গলা খ্যাঁকরি দিয়ে ওঠে- তাইর শইরল রং লাগছে, তেল হাবান দিয়া হাজত বইছে। মাইজ্ঞো মাই, মাগীর ডর ভয় নাই, হাইঞ্জাকালও নদীর কান্দাত মাগী হাজাত বইছে। মাগীর ভাতার আইব…।
মায়ের ইশারা কোনদিকে রাধারানী বোঝে। আশেপাশের গ্রামগুলোতে দাউদাউ আগুন, নিত্য রাতে আর্ত চিৎকারের সাথে আরো একটা নাম কানে আসে তার। শ্যাম, তার প্রাণের শ্যাম। হাওরের জলে পাঞ্জাবীদের ত্রাস জগৎজ্যোতি দাস। তার দাসপার্টি নিয়ে ভাটি এলাকা মোটামুটি শত্রুমুক্ত রাখার আপ্রাণ লড়াই করছে সে। রাতে সোনাকাকা হারানকাকাদের গল্প শুনে রাধারানী, পাঞ্জাবীরা তার মাথার দাম হাঁকিয়েছে লাখ টাকা। নিবু নিবু কুপির শিখায় মোটা কাঁথার নিচে শুয়ে ঘুম আসে না রাধারানীর। এ মানুষটা তার, একান্তই তার। ভাবনাটার আপাদমস্তক শিহরণ তাকে সারারাত ঘুমাতে দেয় না।
শেখসাব যেদিন ভাষণ দিল ঢাকায়, পরদিন ঢাকা থেকে ফেরার পথে দেখা দিয়ে গিয়েছিলো সে। ক্ষেতের আল ধরে ফিরতে ফিরতে বলে গিয়েছিল, দেশ স্বাধীন করে তার কাছেই ফিরে আসবে। রাধাই যে শ্যামের ঠিকানা।
রাধারানী বৌদির কাছে শুনতো বটে ভাইয়ের গল্প, সুনামগঞ্জ কলেজে ভাই তার মিছিল মিটিং করে। বড় ছাত্রনেতা। কিন্তু আজ যে কান পাতলেই শোনে জামালগঞ্জে পাঞ্জাবীর নাও ডুবিয়ে দিয়েছে, শাহজীবাজারে কারেন্টের স্টেশন উড়িয়ে দিয়েছে, বানিয়াচং থানায় ৪০ জন পাঞ্জাবীরে ব্রাশ ফায়ার করেছে, এ যে তার শ্যাম বিশ্বাসই হতে চায় না। ঠিক দুপুরে হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়িতে ঢুকে গোগ্রাসে ভাত খেয়ে হাওরের জলে হাত ধুয়ে যে সুযোগ খুঁজতো রাধারানীর আঁচলে মুছবে বলে। সেই শ্যাম? নিজের শ্রবণেন্দ্রীয়কে অবিশ্বাস হয় কখনো, কখনো বা শঙ্কা গ্রাস করে বৈশাখে ঈশাণ কোণে জমা মেঘের মতো, মানুষটা ফিরবে তো, সত্যি ফিরবে তো বেঁচে? তার ভরসাতেই না আশপাশের পাঁচ গ্রামের মানুষগুলো গ্রামেই রয়ে গেছে। কিন্তু যে অবস্থা! পানি কমে যতোই চর জাগছে ততোই রাজাকাররা পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে পাঞ্জাবিদের। কৃষ্ণপুর, মাকালকান্দি গ্রামগুলোতে নির্বিচারে মানুষ মেরে রেখে গেছে পাঞ্জাবীরা। শ্যাম আর তার দাসপার্টি তাদের সাথে পেরে উঠবে তো শেষ পর্যন্ত?
আজ এই চারদিকে যে অলৌকিক ত্রাণকর্তার মতো কেবল জগৎজ্যোতি আর দাসপার্টির রূপকথা এ যে কেবল তার শ্যাম, তারই শ্যাম…। রাধার শ্যাম। ফিরবে তো সে? তার জন্য যে অপেক্ষার দিন ফুরায় না আর।
চার.
খাওয়া শেষ করে বুড়ি বায়না ধরে ভেসে আসা লাশখানা দেখবে। মহা মুশকিল তো! ঠিকমতো হাঁটতে পারে না, কে নিয়ে যায় বুড়িকে নদীর ঘাট অব্দি? নিজেরও মনে মনে যে অদম্য কৌতূহল উঁকি দেয় না তা নয়। শাশুড়ির উসিলায় একবার দেখে আসলে হয়, না জানি কোন মায়ের পুলা কিংবা কোন স্ত্রীর স্বামী এমন বেঘোরে পড়ে আছে নদী ভেড়ামোহনার পাড় ঘেঁষে। আহারে কতোই জানি খুঁজতেছে তারা তাকে!
ততোক্ষণে থানা পুলিশ চেয়ারম্যান মেম্বার সব জমে গেছে। উৎসুক মানুষের ভিড়ও পাতলা হয়ে গেছে, রোদ উঠলে যেমন পাতলা হয় কুয়াশার আস্তরণ। ললিতা রানি ভাবে এই ফাঁকে একবার দেখে এলে মন্দ হয় না। জামাই কিছু বললে শাশুড়ির দোহাই দিলেই চলবে। শাশুড়ির প্যানপ্যানানিও বাড়তে থাকে- অ বউ চল না বেডি একবার আমারে লগে লইয়া, একনজর দেইখ্যা লই। এই ভেড়ামোহনায় একটা লাশ আইবার কথা বেডি, বিশ্বাস কর, আমি এরে চিনি। লও বেডি একবার। ললিতা রানি চমকে ওঠে, কিতা কইন আপনে? মাথামুথা গেছেনি এক্কেবারে। পুলিশে হুনলে আপ্নের গুষ্ঠিশুদ্ধা বাইন্ধা নিব।
মর্গে পোস্টমর্টেমের পর স্থানীয় পত্রিকায় ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন তার স্ত্রী।
আইচ্ছা আমি কইতাম না আমি চিনি, তব একবার লইয়া ল, অ বেডি। ললিতা রানি নিজের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরে বলে চলেন, আর মনে মনে বলে, বেডির যেমন শখ তেমন হুঁশ। চিনে কইয়া আবার কয় পুলিশের ধারে কমু না।
বীভৎস বিকৃত মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত থমকে থাকে বুড়ি। খুবলে খাওয়া চোখ, ঝুলে পড়া, খুলে পড়া ঠোঁট ঠেলে বের হয়ে আসা দাঁতের পাটি, কিচ্ছুতে চেনার উপায় নেই লোকটি কে। লাঠি ভর দিয়ে বসে পড়ে পাশে। উৎকট পচা গন্ধ তার নাকে যেন লাগেই না এভাবে পরম মমতায় হাত বাড়াতে চায় সে লাশটির মাথার দিকে।
ঠিক তখন একটি ভ্যান এসে দাঁড়ায় লাশের পা ঘেঁষে, পুলিশ বাঁশি বাজায়, সরেন সরেন। হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে টুকটাক জটলা সরাতে সরাতে বুড়ির কাছে এসে সামলে নেয়, উডেন উডেন- বলে ইশারায় ভ্যান গাড়িটিকে এগুতে বলে। লাশ সদরের মর্গে যাবে।
ললিতা শাশুড়ির হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির পথ ধরে, শাশুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দুই পা আগায় আর পিছনে তাকায়- অ বউমা এক্কেরে টিক হেই চুল, এক্কেরে…। দুই কুড়ি বছরে ভুইল্লা যামুগা? অ বউমা…।
পাঁচ
১৬ নভেম্বর ১৯৭১, মৃতদেহ ঘিরে বিকৃত উল্লাসের পর বীরযোদ্ধা শহিদ জগৎজ্যোতির ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ ভেড়ামোহনায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাজাকার আলবদর বাহিনী। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আবার নদী ভেড়ামোহনায় ভেসে ওঠে যে অজ্ঞাতনামা বিকৃত মৃতদেহ, তা জগৎজ্যোতির উত্তরাধিকারী ভ্রাতুষ্পুত্র দুলালচন্দ্র দাসের। মর্গে পোস্টমর্টেমের পর স্থানীয় পত্রিকায় ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন তার স্ত্রী।
নদীর নাম ভেড়ামোহনা
রুমা মোদক
প্রকাশক: পেন্সিল প্রকাশনী
বইমেলা, স্টল নং-৩১৪