শহর জুড়ে অবিরাম শান্তি। শরতের আকাশে সাদা মেঘের ফানুস। আজ শরৎপূর্ণিমা। ভোর থেকে শহুরে জনতার চোখে-মুখে রাতের অপেক্ষা। নবযৌবনের দুয়ার টপকানোদের মধ্যে অচিন উত্তেজনা। পৃথিবীর একমাত্র শহর–যেখানে শরতের দুটি ও হেমন্তের একটি পূর্ণিমার আগের দিন ও পরের দিন ছুটি থাকে। হাজার হাজার জোছনাপিয়াসী এই সময়ে শহরকে মুখরিত করে রাখে অতিথি পাখির মতো। শহরের উত্তর প্রান্তে নদী। নদীর উত্তর প্রান্তে কাশবন। পূর্ণিমার রাতে নেমে আসে ঝিমধরা এক অদ্ভূত দৃশ্যকল্প। সাদা চাঁদ, সাদা নক্ষত্র আর সাদা কাশবনে নামে সাদার ঢল। সব নারী-পুরুষের গায়ে সাদা পোষাক। রাত নটার পর সারা শহরে নেমে আসে মানুষের ঢল। স্রোতের মতো ছোটে মানুষ। নদীর উত্তর-চরে। বিদ্যুৎকে দেওয়া হয় ছুটি। এই পূর্ণিমা উৎসব–কে, কখন, কিভাবে চালু করেছে এই নিয়ে আছে নানা মিথ আর কথকতা।
যুক্তি নির্ভর ও জ্ঞান নির্ভর মানুষের মতে, বহু-বহু বছর আগে এই শহর দখল করতে এসেছিল হানাদাররা। ভৌগলিক অবস্থার সুবিধায় এই শহরটা ছিল সবসময়ই দখলদারদের আগ্রহের কেন্দ্রে। আবার ভৌগলিক সুবিধার কারণেই এই শহরের শাসকরা বিনা যুদ্ধেই নিজেদরে রক্ষা করতে পারত। এবার হলো কি! এই হানাদাররা শহরের প্রবেশ দেয়াল ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা শুরু করে। অথচ যুদ্ধের জন্য কেউই মাঠে আসতে চাইল না। তখন শহরের প্রধান নারীদের ডাকলেন। নারীরা শহরপ্রধানের হাতে ধরে শপথ করল তারাই শহর রক্ষা করবে। এক হাজার নারী যুদ্ধের জন্য মাঠে নেমে গেলে পুরুষদের ভেতরের পৌরুষ জেগে ওঠে। নারীরা দৌড়াতে থাকে শহরের সীমানা দেয়ালের দিকে। তাদের স্বমীরা প্রচণ্ড গতিতে দৌড়াতে শুরু করে। দেয়ালের কিছুক্ষণ আগেই তারা তাদের স্ত্রীদের টপকে যায়। সেদিন ছিল শরতের দ্বিতীয় পূর্ণিমা।
কোনো রকমের পরিকল্পনা ছাড়াই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। অবাক করা ব্যাপার হলো এই এক হাজার নারীর কারোই স্বামী জীবিত ফেরত আসেনি। ফেরত আসেনি আরও দুই শো পঞ্চাশজন নারী। তবুও নারী-পুরুষের সম্মিলিত আত্মত্যাগে হানাদাররা পালিয়ে যায়। তখন শহরপ্রধান এই সব নিহত নারী-পুরুষকে নদীর উত্তর চরে সমাহিত করেন। পরের বছরই এই সমাধিস্থলে অদ্ভূত সুন্দর একটা কাশবন জেগে ওঠে। স্বামীহারা বিধবারা সাদা শাড়ি পরে পূর্ণিমার জোস্নায় তাদের স্বমীদের জন্য প্রার্থনা করতে যেত। সেই থেকে এই পূর্ণিমা উৎসবের সূচনা।
আবার অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী জনতার মতে, বহু-বহু বছর পূর্বে দুধসাদা এক শরৎ পূর্ণিমায় এক সন্নাসী তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে এই শহরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন। সেই থেকে এই শহরের পূর্ণিমা উৎসবের সূচনা। এরা এই সন্ন্যাসীর নামে পূর্ণিমার রাতে নানা রকমের ভক্তিমূলক গান গায়। তাদের প্রমাণ হলো শহর জুড়ে জেগে থাকা প্রাচীন স্থাপত্যগুলো।
আটপৌরে মানুষের এখন আর এসব ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা মিথের প্রতি আগ্রহ নেই। তাদের প্রয়োজন বিনোদন। রিফ্রেসনেস। তারা কিছু সময়ের জন্য অফিস, বাণিজ্য আর আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যস্ততা ফেলে ছুটে আসে পূর্ণিমা উৎসবে। সময় কোথায় অতীতের কাসুন্দি ঘাটার!
০২.
হঠাৎ করেই জায়েদ আর সাবাহ দম্পত্তির জন্য অফিসের বস দুটো ভিসা নিয়ে আসেন। ভিসা দুটো দেখে জাযেদের মনে পড়ে কয়েকমাস আগে বসের কাছে পাসপোর্ট জমা দিয়েছিল। এরপর কোনো একটা অফিসে গিয়ে কিছু ফরমালিটিও সেরেছিল। তখন জানতো সময় মতো কোথাও তাদের একটা অফিসিয়াল ট্যূর হবে। কিন্তু ভিসা দেওয়ার পর বস যখন বলল এবার আমরা পূর্ণিমা উৎসবের শহরে যাচ্ছি। তখনই সাবাহ বলে, জায়েদ আমি যেতে পারব না।
–কেন? কেন?
–জায়েদ তুমি হয়তো জানো না। সেই শহরে পূর্ণিমা উৎসব শুরু হয় রাত নটার পরে। শুরুর পাঁচমিনিট আগে শহরের বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া সব জায়গার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এবার বলো, একজন নারীর জন্য এমন একটা আজগুবি সিস্টেম কতটা নিরাপদ?
–এত খবর তুমি জানলে কেমনে?
–আমি কয়েকদিন ধরেই কানাঘুষা শুনছিলাম পূর্ণিমা উৎসবের শহরের। তাই একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম।
–ঠিক আছে। তুমি লাঞ্চ করে আসো। আমি আরেকটু খোঁজ খবর নেই।
সাবাহ লাঞ্চে যাওয়ার পর জায়েদ অনলাইনে পূর্ণিমার শহরের এ টু জেড খোঁজ নেয়। জায়েদ দেখে গত তিন শো বছরের ইতিহাসে এই শহরের পূর্ণিমা উৎসবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার ইতিহাস নেই। জায়েদের এমন খোঁজা-খুঁজি দেখে ফেলেন বস। তিনি বলেন, আরে জায়েদ, এই শহরে আমি যাই আজ প্রায় দশ বছর। রাতের কাশবনে মনে হয় হাশর শুরু হয়েছে। কেউ কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। সবাই ছুটছে তো ছুটছেই। কোন লক্ষ্য নেই। কোনো ঠিকানা নেই। সবাই শুধু হাঁটে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরে হাজার হাজার নৌকা বাঁধা থাকে। মানুষ যে দিক দিয়ে ইচ্ছে পার হয়ে গন্তব্যে চলে যায়। এই বলেই জায়েদের বস ইখতিয়ার সাহেব হাসতে থাকেন।
ইতোমধ্যে সবাহ লাঞ্চ সেরে চলে আসে। আসার পর বসের আলাপ আর জায়েদের সার্চ রেজাল্ট জেনে অনেকটাই আস্বস্ত হওয়ার ভান করে। তেমন আগ্রহ দেখায় না। বলে, অন্য কোথাও হলে ভালো হতো। সাবাহর কথা শুনে জায়েদ বলে–দেখো, বিয়ের আজ দশটা বছর। তুমি কোথাও বেড়াতে যাওনি। তোমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার মতো আমার সামর্থ্যও ছিল। এখনও নেই। বস যেহেতু নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, তাহলে তুমি কেন এমন করছ। সাবাহ জায়েদের কথায় কয়েক ফোটা অশ্রুপাত করে নীরব হয়ে যায়।
আসলে সাবাহকে হঠাৎ করেই জায়েদ বিয়ে করে। এক সন্ধ্যায় জায়েদ জেল গেইটের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় দেখতে পায় সাবাহকে। জেল গেটে বসে আছে। পুলিশ বলছে, আপনার তো খালাশ হইছে। বাড়িতে যান। সাবাহ বলছে, আমার তো বাড়ি-ঘর কিচ্ছু নাই। আমি আমার দেশ ছেড়ে চলে আসার সময় সবই ত্যাগ করে এসেছি। এখন আর সেখানে ফেরা সম্ভব না। আমি আজ রাতটা জেল গেটে কাটিয়ে কাল কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করব। জায়েদ তখন পূর্ণ মনযোগ দিয়ে সাবাহকে দেখে। মনে মনে ভাবে, আমারও তো কেউ নেই। আচ্ছা, আমি যদি এই মেয়েটাকে নিয়ে সংসার শুরু করি তাহলে কেমন হবে! এইটা ভেবেই জায়েদ হেসে ওঠে। জায়েদের হাসি দেখে ফেলে সাবাহ। বলে, আপনার আগ্রহ থাকলে আমি রাজি। জায়েদ আঁতকে ওঠে। বলে, ওয়াট!
–আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমি মানুষের চেহারার দিকে চেয়ে তার মনের খবর বলতে পারি। তবে সবাইকে সেটা বলে বেড়াই না। আপনি যদি আমার পরিবার আর অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করেন তাহলে আমি আপনার জীবনে সঙ্গী হতে রাজি। আমার অতীত সম্পর্কে শুধু এইটুকু জানাব যে, আমি মানুষের হৃদয় রিড করতে পারি বলেই–নিজের পরিবার ও স্বদেশ ছেড়ে চলে এসেছি। বৈশ্বিক নাগরিক হওয়ার আবেদন করে আপনাদের এই কারাগারে বন্দি ছিলাম। এক বছর পর্যবেক্ষণ করে নগর পিতা আমাকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও আমার কোনো তথ্যই তিনি জানতে পারেননি। তবু বলেছেন, এই শহরের কোনো যুবক যদি তোমাকে নিয়ে ঘর করেতে চায় তাহলে আমার আপত্তি নাই।
এর পর জায়েদ পুলিশের কাছে আইনি বিষয়ে কিছু খবর নিয়ে সরকারের কাছ থেকে বিয়ের অনুমতি নিয়ে, সবাহকে বিয়ে করে। সেই থেকে সাবাহ-জায়েদ এক সঙ্গে আছে। হয়ে গেছে দশ বছর। এই সময়ে তারা কোথাও বেড়াতে যায়নি। বলা ভালো যেতে পারেনি।
০৩.
গত বিশ বছর ধরে পৃথিবীর তিন শোটি দেশে পূর্ণিমা হয় না। চাঁদ ওঠে না। নক্ষত্ররাও নাই হয়ে গেছে। অদ্ভূত এক নক্ষত্রখোর নেমেছে পৃথিবীতে। পূর্ণিমা উৎসবের শহর ছাড়া গত বছর পর্যন্ত একটা দেশে পূর্ণিমা হতো। এই বছর কদিন আগে সেই দেশের চাঁদ ও নক্ষত্র গিলে ফেলেছে সেই নক্ষত্রখোর! ঘটানার বিবরণে জানা যায়–এর আগে প্রতিটা জনপদে পূর্ণিমার রাতে একটা বিকট আওয়াজ হয়ে কিছুক্ষণ উল্কাবৃষ্টি হতো। এরপর চিরদিনের জন্য এই শহরের পূর্ণিমা হারিয়ে যেত। প্রথম প্রথম এই বিষয়টাকে কেউই তেমন পাত্তা দিত না। প্রতি বছরই যখন এমনটা কোথাও না কোথাও ঘটতে থাকলো তখন সবাই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগল। কিন্তু কেউই সত্য প্রকাশ করতে পারল না।
ধার্মিক ভাবত ঈশ্বরের ক্ষোভের কারণে এমনটা হয়েছে। বিজ্ঞানি ভাবত, পৃথিবীর বয়স শেষ হয়ে আসছে তাই–চাঁদ ও নক্ষত্র মরে যাচ্ছে। গোয়েন্দারা ঠিক তথ্য প্রকাশ করতে পারত না। তারা কিছুটা জানলেও তাদের মুখে ছিল অদৃশ্য সেলাই। শাসকরা প্রতিটা ঘটনার পর প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করত। আরেকদল প্রতিশোধের নামে অদৃশ্য শত্রু তৈরি করে আমজনতাকে রক্তাক্ত করত। কেউ-কেউ ধর্মরাষ্ট্রের জন্য ধর্মযুদ্ধের ডাক দিত। কিন্তু! নক্ষত্রখোরের সন্ধান কেউই দিতে পারতো না। নক্ষত্রখোরকে কেউই ধরত না। ধরতে চেষ্টা করত না অথবা ধরার সাহস ও যোগ্যতা রাখত না। পুরো পৃথিবীতে এমন একটা ঘোলাটে অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারল না। কবি কবিকে বিশ্বাস করল না। সাংবাদিক সাংবাদিককে সম্মান করল না। শাসক শাসককে পাত্তা দিল না। একদল আরেক দলকে মানুষ মনে করল না। প্রতিটা আদর্শের ভেতর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা হতে লাগল। প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে দেহকে গুরুত্ব দিতে লাগল–দেহবাদ মুখ্য সত্য হয়ে উঠল জীবনের জন্য। শিক্ষক-শিক্ষকের চেয়ারে থাকল না; নেমে গেল ধর্ষকের কাতারে। শাসক শাসকের কাতারে না থেকে হয়ে গেল আত্মরতিমগ্ন। সত্যের সংজ্ঞা, নীতির ধারণা, আচরণিক সৌন্দর্যের স্বরূপ বদলে গেল। মানুষ একটা প্রাণীর মতোই নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে লাগল।
দিনে দিনে চন্দ্র আর নক্ষত্র হারাতে-হারাতে পৃথিবী একটা নিরস পাতিলের মতো হয়ে গেল। সাহিত্যে কাঁচমুখ। গানে হুঙ্কার। আর্টকালচারে নিরস স্থুলতা। চলচ্চিত্রে মগজখোর আজদাহা।
মানুষের খোলসে যেন কোনো যন্ত্রের পদচারণা চলছে পৃথিবীতে। জায়েদ ভাবছে পূর্ণিমা উৎসবে গিয়ে মানুষের সাক্ষাৎ পাবে। যেখানে এখনও রাতের কাশবনে চাঁদের জোছনায় মানুষের কোনো বিকৃত চরিত্রের প্রকাশ ঘটে না–সেখানে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে। জায়েদ একটা করপোরেট অফিসে চাকরি করলেও ভেতরে ভেতেরে এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আর ফুরাতে পারেনি বলেই, বিয়ের দশ বছরে স্ত্রী সাবাহকে নিয়ে কোথাও ঘোরতে যাওয়ার টাকাটা ম্যানেজ করেতে পারেনি। অফিসের অনেকেই বলে এই সময়ে এত হাবা থাকলে চলে! সাবাহ সান্ত্বনা দেয়। জায়েদ, কিছু হাবা না থাকলে পৃথিবীটা অচল হয়ে যাবে। হাবা শব্দটা অভিধান থেকে হারিয়ে যাবে। তোমার মতো হাবা থাকায় পৃথিবীতে দুটো জিনিস টিকে থাকবে–এইটাই বা কম কিসে? যখন কেবল হারানোর ইতিহাস—জায়েদ হাসে। স্ত্রীর দিকে চায় এবং কাজে মনযোগ দেয়। কেউ আবার বলে, সাবাহ ভাবি! জায়েদকে আপনার জন্য ফিট মনে হয় না। সাবাহ তীব্র প্রতিবাদ করে। ভয় পায় বক্তা।
০৪.
সেপ্টেম্বরের এক ভোরে জায়েদের বাসার সামনে একটা সাদা প্রাইভেটকার দাঁড়ায়। ইখতিয়ার সাহেব পূর্ণিমা উৎসবের জন্য চেষ্টা সবকিছুতেই সাদার কম্বিনেশন করতে। যদিও গাড়িটা বিমানবন্দরে গিয়ে আর যাওয়ার পারমিশন পাবে না। জুতা পর্যন্ত সাদা কিনেছেন তিনি। বেলা ওটার আগেই জায়েদ আর সাবাহ গাড়িতে ওঠে বসে। সাবাহ বলে–আমার মন বলছে, ইখতিয়ার সাহেবের ভিন্ন কোনো মতলব আছে। জায়েদ, যদি সম্ভব হয় আমাকে রেখে যাও। আমার মন কিছুতেই পূর্ণিমা উৎসবের জন্য সায় দিচ্ছে না। কেন যেন শুধু মনে হচ্ছে একটা অসম্ভব কিছু ঘটে যাবে।
–বলো কী? জায়েদের কণ্ঠে স্পষ্ট কনফিউশন।
–আমি আবারও বলছি আমাকে রেখে গেলে তোমদের পূর্ণিমা উৎসবটা আনন্দদায়ক হবে হয়তো। দেখো, আমি ঠিকানাহীন একজনকে তুমি যে মর্যাদা দিয়েছে, সেটাই এনাফ। এর বেশি আমি কিছু চাই না।
জায়েদ সাবাহকে বোঝাচ্ছে আর সাবাহ জায়েদকে নিবৃত করতে চাইছে। সাবাহ জায়েদকে বোঝলেও জায়েদ সাবাহকে বুঝতে পারছে না। এমন তর্কের মধ্যেই গাড়ি এসে থামে ঠিক ইখতিয়ার সাহেবের সামনে। ইখতিয়ার সাহেব সাবাহর মুখ দেখে খুশি হতে পারলেন না। বললেন, সাবাহ্ তোমার মধ্যে কেমন যেন একটা নির্মোহ ফ্লেভার। এমনটা আশা করছি না। বন্দিত্বময় পৃথিবীতে একটু মুক্তির আয়োজনে সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে আর তুমি কেমন মিইয়ে যাচ্ছ! এটা ঠিক না। সবার আনন্দের জন্য আর্টিফিসিয়ালি হলেও উৎফুল্ল থাকো।
–জ্বী স্যার তাই হবে। কিন্তু…
–কোনো কিন্তু নয়। এই কয়দিন আমি কিন্তু শুনতে চাই না।
এরপর সাবাহ কী যেন বলতে একবার বসের কাছে যায় আরেকবার জায়েদের কাছে যায়। বলতে পারে না। গলায় এসে কথা আটকে যায়। হঠাৎ ইখতিয়ার সাহেব লক্ষ করেন ব্যাপারটা। বলেন, সাবাহ, এনিথিং রং? আমি লক্ষ করছি তোমার গলায় কী যেন বারবার আটকে যাচ্ছে। কী যেন বলতে চেয়েও বলতে পারছ না। বলে ফেলো। এবারও সাবাহ বলতে পারল না। গলায় কথা আটকে গেল। তার মুখের ভেতর যে কথা বাধ মানছে না। তাকে হজম করে নিল। মিশে গেল কলিগদের আনন্দ স্রোতে।
০৫.
চার ঘণ্টার জার্নি শেষে বিমান শহরে নামল। এয়ারপোর্টের কাছেই একটা হোটেলে সব কিছু রেখে, রাত সাড়ে আটটায় জায়েদ-সাবাহ সমান্তরাল হাটতে লাগল। অন্যরাও তাই করল। কাশবনের পাশে এসে জায়েদ প্রায়চৈতন্য রহিত হয়ে গেল। বেখাপ্পা আচরণের জন্য কিছু জরিমানা গুনল। এতে জায়েদের কোনো আফসোস নেই। সাবাহর মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার একটা প্রবণতা দেখা গেল। জায়েদ ছাড়া সেই প্রবণতা কেউই টের পেল না। কিন্তু, এই টের পাওয়াটা জায়েদের জন্য বিপদ নিয়ে এলো। সাবাহ বলে উঠল, জায়েদ আমার ভেতরের সক্ষমতাটা তোমার মধ্যে ডাইভার্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি আমার মনের সব কথা জেনে যাবে। সুতরাং আমি চললাম…
–আমার সাবাহ! কী বলছ এসব? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। কথা জড়িয়ে আসে জায়েদের।
–কিছুই বুঝবে না। বোঝার সময় এখনও হয়নি। এখন রাত এগারোটা। আর বিশমিনিট সময় আছে। তোমার হাতে দুটো সুযোগ। কেবল তোমার জন্য। আর কারও জন্যই এটা সম্ভব হবে না। হয়তো আমার সঙ্গে যাবে। চিরদিনের জন্য এই শহরে থাকার অঙ্গীকার করে। নয়তো এই বিশমিনিট সময়ের মধ্যে নদী পার হবে। কোনটা নেবে?
–তার মানে এখানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে? যা তোমার ক্ষমতায় বুঝতে পারছ। আর সেইটা আরও আগেই বুঝতে পারছিলে। তাই আসতে চাইছিলে না!
–এখন এসব বলার সময় নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাও। আঠারো মিনিট সময় আছে। তার আগে জেনে নাও। আমি এই শহরের মেয়রের একমাত্র কন্যা। আমার পিতা হলেন বর্তমান পৃথিবীর সকল অসুন্দরের স্রষ্টা। পিতার চিন্তার সঙ্গে একমত না হওয়ায় আমি শহর ছেড়েছিলাম। আজ যখন আবার এই শহরে এসে গেছি আমার আর ফেরার পথ নেই। তুমি একটু চেয়ে দেখো। এই কাশবনে কোনো অস্ত্র থাকত না অতীতে। আজ কত কত পাহারাদার!
–সাবাহ ভালো থেকো! আমি আমার শহরে ফিরে যাব। যদি পারো তবে আবার ফিরে এসো। আমি নৌকায় চড়লাম। জায়েদ কাঁদছে…।
জায়েদ নৌকায় উঠে বসে। সাবাহ পাগলের মতো পশ্চিমে দৌড়াতে থাকে। সাবাহার শরীর হতে একটা একটা কাপড় খোলে আর নৌকায় এসে জায়েদের কোলে পড়তে থাকে। সাবাহর শরীর থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। পশ্চিম দিক থেকে আরও তিনজন মানুষ পূর্বে দৌড়ে আসতে থাকে। তাদের শরীরেও আলোর বান ডাকে। পুরো কাশবন সাদা আলোয় ভরে ওঠে। জায়েদ ফিরে আসতে চায়। মাঝি বলে, ফিরলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। নৌকা মাঝ নদীতে। সাবাহ বা-বা বলে চিৎকার করে ওঠে। জায়েদ ভয়ে চোখ বন্ধ করে। মাঝি বলে, চোখ বন্ধ করলে আওয়াজ আরও তীব্র ও তীক্ষ্মহবে। চির দিনের জন্য বধির হয়ে যাবেন। চোখ খুলে রাখুন। দেখুন কী ঘটতে যাচ্ছে।
কাশবনের মাঝখানে সাবাহ ও তার বাবার সঙ্গে আসা দুজন। মোট চারজন। কাশবনের ঠিক মধ্যে দাঁড়ায়। দুই হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে ওপরে ওঠায়। তীব্র চিৎকার করে ওঠে চারটি আলোকমূর্তির। ওরা বাড়তে থাকে। হা বড় হতে থাকে। বর্ষায় উঁচু জমিনের পানি নিচে নামার সময় যেমনভাবে নামে–ঠিক তেমনভাবেই আকাশের নক্ষত্রদল চাঁদসহ তাদের মুখের দিকে নেমে আসতে থাকে। সাবাহর বাবা শহরের মেয়রের মুখে টুপ করে চাঁদটা হারিয়ে যায়। ঘন অন্ধকার নেমে আসে।
পূর্ণিমা উৎসবের প্রতিটি মানুষ এবং কাশফুল পাথর হয়ে যায়। পরদিন এই শহর থেকে পৃথিবী জুড়ে বড় বড় স্বেতপাথরের চালান যেতে থাকে…