যে দ্রৌপদীর কথা বলছি, মহাভারতের সেই দ্রৌপদী সে নয়, পাঁচ ভাই তার বরও নয়। তার বনবাসে যাওয়া না হলেও স্বামীর সংসারে যেতে হলো। এই যাওয়াটা অনেকটা বনবাসের মতোই। ভয়, দ্বিধা, আর দোলাচলের ভেতর তাকে যেতে হলো হনুমানের মতো এক লোকের সংসারে। যে কিনা রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের প্রথম শ্রেণির কর্মচারী। ‘দিনে আনি দিনে খাই’ পরিবারে এটুকুই অনেক বড় খবর। বরের দ্বিতীয় না তৃতীয় বিবাহ তাও ধর্তব্য নয়। ঘটনাচক্রে দ্রৌপদীর এটা প্রথম বিয়ে হলেও বর কৃষ্ণেন্দুর এটা নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম পক্ষের স্ত্রীকে অন্যত্র গৃহ-সংস্থান করে দিয়েই কৃষ্ণেন্দু পাকা চুল ও গোঁফে কলপ করায়। তারপর একদিন বর সেজে এসে বিয়েটাও করে ফেলে। আগের পক্ষের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কাছে সময়মতোই পৌঁছে গিয়েছিল সে খবর। ওরা যতটা না আহত হয়েছে এই বিয়েতে, তারচে’ বেশি আহত হয়েছে মফস্বলের সেইসব ছেলেছোকরারা। যারা দ্রৌপদীর আসা-যাওয়ার রাস্তায় বিভিন্ন উছিলা করে দাঁড়িয়ে থাকতো। দ্রৌপদীর নিতম্ব দুলিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতো। দ্রৌপদীর এই বিয়েতে তারা গভীর ভাবনায় পড়ে। নিজেদের মধ্যে খিস্তি-খেউড় করে। ঝগড়া লাগে। কেউ কেউ মরে যাওয়ার চিন্তাও করে। যে গাছে ঝুলে পড়ার কথা ভাবে, গোপনে সে গাছে হাত বুলিয়ে আসে। গাছের নিচে কান্নাকাটিও করে। আর চোখের জল টপটপ করে পড়ে, কাছের গাছের পাতায় পাতায় শিশির বিন্দুর মতো! শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেউ আর জীবন বিসর্জন দেয় না। ভীম, নকুল, সহদেব ও যুধিষ্ঠীরের মতো ওরাও পাষাণে বুক বাঁধে। আর অর্জুনের জায়গাটা ছেড়ে দেয় কৃষ্ণেন্দুর জন্য। এই হারানোর বেদনাকে নিয়তিই ধরে নেয় তারা। হায় হায় দ্রৌপদী বলে ওরা দ্রৌপদীদের বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে যায়। কেউ লিখে বিষাদের কবিতা। আর কেউ গায় বিষাদের গান। কিন্তু তাদের ভেতরে যে গোপন রক্তপাত, তা কিসে বন্ধ হবে? কেউ সেই ভেতরের রক্তপাতকে বাইরে আনার জন্য নতুন ব্লেডে নিজের হাত চিরে ফেলে। রক্ত সবুজ ঘাসে পড়ে ঘাসের রঙ হয়ে লাল ওঠে!
যার নাম দ্রৌপদী, তাকেও যেন যুগযুগ ধরে চলে আসা পাশার দানের বাস্তবতা ছুঁয়ে থাকে। রাজতন্ত্রের বাস্তবতা ছুঁয়ে থাকে। মিথ আছে এই দ্রৌপদীকে একবার একজন জোর করে চুমু খেতে চেয়েছিল, তার পরদিন থেকেই তার মুখে কুলুপ। সে আর কথা বলতে পারে না। আরেকবার কোনো দুর্বৃত্ত দ্রৌপদীকে মওকামতো পেয়ে খড়ের গম্বুজের আড়ালে শাড়ি খুলতে তৎপর হয়েছিল, তার পরদিন থেকে সবাই দেখল তার দু-হাতই অবশ। আরেকবার কেউ গোপনে দ্রৌপদীর স্নান দেখতে গিয়ে হারালো চোখ। তারপর থেকে কেউ দ্রৌপদীকে আর ঘাঁটানোর সাহস পেতো না। দ্রৌপদী তার তানপুরার মতো নিতম্ব দুলিয়ে দুলিয়ে পথের বাঁকে মিলিয়ে যায়। আর ছেলেছোকরারা তাকিয়ে থাকে আর তাকিয়ে থাকে। কেউ একজন এসে তাদের এই মূর্ছনা ভাঙায়। তারপর তারা আবার নিজেদের মধ্যে ফিরে আসে। কেউ নাকে গোলাপের কাঁটার চিরে দেওয়া টের পায়। কেউ পায়ের আঙুলে বিষ পিঁপড়ের কামড় টের পায়। এভাবে তারা আরও অনেক কিছু টের পায়। টের পায় তাদের কারও নাম বাবুল, কারও নাম মহসীন, কারও নাম হাসমত আর কারও নাম নিখিল। এরা চার পাণ্ডব।
তারা কপালের ঘাম মোছে। নদীতে ওইদিন ছিল উথালপাথাল জোছনা। যেন চাঁদের ঠাণ্ডা আগুন জ্বলছে। আর সেই আগুন ছলকে ছলকে পড়ছে। জোছনার আলোয় তাদের চোখে সন্দেহ না ভয় ঠিক কী বোঝা যায় না। ওদের কাছে হঠাৎ মনে হয় এটা জাল নয়, এটা দ্রৌপদীর শাড়ি। এই জালে কোনোদিন মাছ উঠলেও এক-দুটির বেশি উঠে না। সেই এক-দুটি মাছ যেন হাভাতে জেলেদের কিছুটা দুঃখ প্রশমনে।
দ্রৌপদী বিয়ের শাড়িতে যেদিন কার্তিক জলদাসের নৌকায় করে লংগন নদী পেরিয়ে যায়, সেদিন লংগনের ঢেউ আর থামে না। পেছনে শুধু দীর্ঘশ্বাস। পেছনে শুধু পাতা ঝরে ঝরে পড়ে। পেছনে বাবুল, মহসীন, হাসমত অথবা নিখিল কারও আর বাড়ি যাওয়ার কথা মনে থাকে না। ওরা নদীতেই আস্ত একটি রাত কাটিয়ে দেয়। এরপর তারা ঘুমের মধ্যে সবাই দ্রৌপদীকে একযোগে স্বপ্নে দেখে। দেখে দ্রৌপদীর খিলখিল হাসিমাখা মুখ। দ্রৌপদীর পদ্মফুলের মতো চোখ, কুঞ্চিত ঘন কালো কেশ, তাম্রবর্ণ নখ। সুন্দর হিল্লোলিত স্তন।
বিয়ের পর দ্রৌপদী আত্মহত্যা করেছিল। সিলিংফ্যান থেকে নামানো সেই লাশ তারপর চলে গেলো পোস্টমর্টেমের জন্য সোজা মর্গে। সেই ছেলে-ছোকরারা চোখে পর্যন্ত দেখেনি দ্রৌপদীর লাশ। জানতে পারেনি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। ওরা শুধু জেনেছে দ্রৌপদী মারা গেছে। যে দ্রৌপদী একসঙ্গে তাদের চার পাণ্ডবের একতরফা প্রেমিকা ছিল। তারা একসঙ্গে এই মুঠোফোনের যুগেও দ্রৌপদীকে রঙিন খামে চিঠি পাঠিয়েছিল। দ্রৌপদীর হাতে প্রায়ই পৌঁছত চার-চারটে চিঠি। চিঠির ভাঁজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতো গোলাপের পাপড়ি। কিংবা চিঠির ভেতর থেকে আসত কোনো পারফিউমের সৌরভ। ওইসব চিঠির ভাষাও থাকতো প্রায় এক। কিন্তু ওইসব চিঠিতে থাকতো না কোনো ঠিকানা। ফলে চিঠি লেখকদের উত্তরের কোনো অপেক্ষা করতে হতো না। ওইসব চিঠিতে সদ্য কৈশোর পেরুনো কিংবা সদ্য গোঁফের রেখা ভাসা কিছু মুখই যেন আঁকা। দ্রৌপদী সেই চিঠি পড়ে হাসতো। তারপর সেই চিঠিগুচ্ছ ভাসিয়ে দিতো লংগনের জলে!
চিঠিগুলো নৌকা হয়ে ভেসে যেতো। কিন্তু ওপারে যাওয়ার আগেই ডুবে যেতো অবলীলায়।
দ্রৌপদীর মৃত্যুর খবর যেদিন পেলো চার পাণ্ডব—ওরা আবার মরে যাওয়ার কথা চিন্তা করে। আবার গাছে গিয়ে হাত বোলায়। ঝরঝর করে কাঁদে। শিশিরের মতো আবার পাতায় পাতায় টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। হাসমত, মহসীন, নিখিল, বাবুল ওইদিন রাতের বেলাতেই একটা জেলে নৌকা দখল করে। ওরা গাঁজা সিগারেটে ভরে এক-একটা স্টিক বানায়। সেই স্টিকের মুখে আগুন জ্বালায়। গাঁজার গন্ধ বহুদূর পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাস। একটার পর একটা স্টিক টানতে টানতে ওদের খেয়াল হয়—ওদের নৌকার চারপাশে একটা জাল। ওরা জালের চৌহদ্দীতে বন্দি হয়ে গেছে। একবার মনে হয় নৌকা ওদের নিয়ে ঘাটে ভিড়ছে, আবার মনে হয় মাঝ নদীর দিকে দিক-দিশাহীন হয়ে ছুটছে। ওরা জালের গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। এই জাল মনে হলো ওদের সঙ্গে রহস্য করছে। ওরা এই রহস্য সহ্য করতে পারে না। এই মায়া বা রহস্য ওদের চেতনাকে মনে হয় বহু বছর যাবত অবশ করে রেখেছে। এই রহস্য থেকে ওরা মুক্তি চায়। ভাঙতে চায় এই বেষ্টনী। ওদের চারদিকে পেতে রাখা জাল টেনে তুলতে তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। কিন্তু সেই জালের বহর এত প্রশস্ত মনে হয় তাদের কাছে, রীতিমতো সবার ঘাম ছুটে যায়। তারা কপালের ঘাম মোছে। নদীতে ওইদিন ছিল উথালপাথাল জোছনা। যেন চাঁদের ঠাণ্ডা আগুন জ্বলছে। আর সেই আগুন ছলকে ছলকে পড়ছে। জোছনার আলোয় তাদের চোখে সন্দেহ না ভয় ঠিক কী বোঝা যায় না। ওদের কাছে হঠাৎ মনে হয় এটা জাল নয়, এটা দ্রৌপদীর শাড়ি। এই জালে কোনোদিন মাছ উঠলেও এক-দুটির বেশি উঠে না। সেই এক-দুটি মাছ যেন হাভাতে জেলেদের কিছুটা দুঃখ প্রশমনে। এই জালের ছিদ্র দিয়ে জ্যোছনা ঢুকে পড়ছে। এই জোছনা জালের সঙ্গে মেশে জালের আয়তন ক্রমশ প্রশস্ত করছে। ওদের কাছে মনে হয় ওই জালের শেষ প্রান্তে দ্রৌপদীর লাশ। ওরা বুঝতে পারে না এই চিন্তাই কেন তাদের মাথায় এলো। ওরা সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ওদের নিজেদের মুখ নিজেদের কাছে ভয়ার্ত লাগে। ওরা জাল আবার জলে ডুবিয়ে দেয়। জাল ডুবতে ডুবতে বুদ্বুদ আওয়াজ তোলে। সেই বু্দ্বুদ মনে হয় দ্রৌপদীর মিলিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর।