এক.
ঘোলা চোখ নিয়ে গ্রামের উত্তর দিকে দৌঁড়াচ্ছে ভোলা। হা হয়ে আছে তার বিঘতখানেক লম্বা জিহ্বা, লালা পড়ছে চুইয়ে। সঙ্গে নিশ্বাসে হাপরের শব্দ। ভোলা যেদিকে দৌড়াচ্ছে, সেদিক থেকে লোকজন সরে সরে যাচ্ছে। ফাতর আলী গভীর শঙ্কায় দেখছেন কুকুটার দৌড়াদৌড়ি। পাগলা হয়ে গেছে একদম। যাকে পাচ্ছে তাকেই কামড়াচ্ছে। গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুকুরটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। এরইমধ্যে তার কামড়ে কজন ভর্তি হয়েছে সদর হাসপাতালে। ফাতর আলী কুকুরটার জন্য একটা আফসোসের শব্দ করেন। আহারে পাগলা কুত্তা, তোর কপালেও মানুষের মতোই সুখ হইলো না, যাহ্! এই গ্রামে ভোলার আগমনের ইতিহাস পুরনো। বিশ্বকাপের সিজন চলছিল। শরফুদ্দিনের টংয়ের দোকানে সবাই তখন সকাল-বিকাল হা করে গিলছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। বুঝুক আর না বুঝুক, গোল প্যানাল্টি হলুদকার্ড-লালকার্ড নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের তর্কাতর্কির শেষ নেই। এতসব হই হট্টোগোলের মাঝে পিঠের ছালওঠা একটা কুত্তা ঝুপ করে দোকানটার গদির নিচে এসে পিঠটান দেয়। একেবারেই মরণদশা। শরফুদ্দিনের দল কুকুর তাড়াতে এগিয়ে যায় কিন্তু ঠিক তখনই ‘গোওওওল’ শব্দের উত্তেজনায় কুকুরসংক্রান্ত করণীয় কর্মযজ্ঞের হিসাব উল্টে যায়। কুকুরটা কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিস্তেজ পড়ে রয় পাটাতনের নিচে। কেউ আর খোঁজ রাখে না এই মৃতপ্রায় কুকুরটার দিকে। শরফুদ্দিনের ভাগ্নে সনেট যেদিন কুকুরটার খোঁজ পায়, সেদিনই হয়তো তার শেষদিন ছিল এমন বিদঘুটে কুকুর এর আগে সনেট কোনোদিন দেখেনি । মৃতপ্রায় এ কুকুরটার জন্য সনেটের কোথায় যেন কেমন অনুভূতি হয়। আহা একটা জলজ্যান্ত জীবন একটু পর শেষ হয়ে যাবে! সনেট ঝুঁকে দেখে কুকুরের শরীর। একটা ঠ্যাং খোঁড়া, কোমরের কাছটায় মনে হয় কেউ জোরে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করেছে, ল্যাজটা নেতিয়ে আছে। সনেটের মায়া হয়, ছোটবেলায় পোলিওর কারণে সেও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতো। সে দোকান থেকে একটা বাসি পাউরুটি ছিঁড়ে এগিয়ে ধরে কুকুটার মুখের কাছে। কুকুরটা ফিরে দেখে না। এরপর দেয় মিষ্টি টোস্ট। নাহ তার কোনো বিকার নেই। অবশেষে না পেরে চায়ের কাপ সমেত এগিয়ে যায় পাউরুটির টুকরো অংশ ঠাণ্ডা চায়ে ভিজিয়ে কুকুরটার মুখে ধরে রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত কুকুরটা মুখ না তোলে। মানুষের এইটুকু মমতায় কুকুরটা হয়তো বিস্মিতই হয়। কুঁই কুঁই করে কাঁদে কিছুক্ষণ, কী মনে করে জিভে চেটে খায় একটু, এরপর আবার কুই কুই করে ঘুমিয়ে যায়। পরের কয়দিনে সনেট ও কুকুরের মধ্যকার এই প্রণয় পর্ব বাঁচিয়ে দেয় একটা জীবন! মানুষের না হোক তা কুকুরের জীবন, জীবন তো! সনেট পাঁচটাকা দামের মনেকা বিতরণের মধ্য দিয়ে কুকুরটার নাম রেখেছে ভোলা। আকিকা দেওয়া বৈধ নাম। সবার সম্মতির ভিত্তিতে সেই ভোলার আজ মৃত্যুদণ্ডাদেশ গ্রামবাসী কতৃক গৃহীত হয়েছে এবং সেখানে তার প্রভু সনেটও ছিল।
দুই.
কুসুম ঘুম ঘুম চোখে গুনগুন করে গান গায় আর সুতায় তোলে ফোঁড়। কোলের পাশে টেটনা মেয়ে বিন্তি, ঘুম নেই চোখে। আড়ে আড়ে ঘর দেখে, বিছানা দেখে, মা দেখে।
—মা, তোমার মুখের গীতটা একটু জোরে গাও না।
—চুপ থাক, পারবো না, ঘুমা এখন।
—গাও মা একটু।
—দেখস না, কাম করতাছি,তবু জ্বালাস! মেয়েকে ধমক দিলেও কুসুম ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করে। বেখেয়ালি ভাব ধরে গলার স্বর আরেকটু চড়ায়, মনে তার নতুন সুখ।
উলি উলি উলবাদুরের ছাঁও
উলির মায় বাইত্তে নাই ঘুম দিয়া যাও
হাটে নাইরে বাজিলা মাছ
ঘরে নাইরে নুন
আমার বিন্তির ঘুম করে কুম কুম…
—হইছেনি এইবার?
—না হয়, নাই। কও তো বাজিলা মাছ দেখতে কেমন? ওইটা কি ইলিশ মাছের লাহান না কি তেলাপিয়া!
—চুপ থাক, কথা কইবি না, বাইরে এখন নিশুতি রাইত, এইসময় কথা কইলে ঘরে দৈত্যদানো ভর করে, ঘাড় মটকায়া দেয়, হাড়গোড় চাবায়া খায়।
কী বলবে কুসুম? বিরক্ত হবে, মেয়েটা এমন করছে কেন?
চোখে লাগার মতো বাপ-বাপান্তি!
বিন্তি পোকায় খাওয়া দাঁত বের করে হাসে, মা তুমি যে কী কও, দৈত্যদানো আইলেই হইবো? আমার দাঁত আছে না! আমি কি কামড়াইতে জানি না? শুধু না হয় মইধ্যের দাঁতটা একটু নড়ে!
—নড়ুক, বেশি কথা কইস না ছেড়ি, রাইতের বেলা কাঁথা সেলাই অনেক কষ্টের কাম, দিনে সময় পাই না আবার রাইতে বেলায়ও ত্যক্ত!
—কী করুম? নতুন বাড়িতে আমার ঘুম আসে না। কিরণমালা দেও। রাক্ষুসি কটকটিরে দেখি।
কুসুম মেয়ের ওপর বিরক্ত হয়, গতসপ্তাহে কেন যে ফাতর আলী এই ছোট সাইজের সেকেন্ডহ্যান্ড এই টিভিটা কিনলো! হয়তো মেয়ের কথা ভেবেই কেনা! কুসুম হাসে হাহ্ মেয়ে! যার মেয়ে তার ধুম নাই, পরের বাপের ঘুম নাই।
—মা চুলে ফিতা পড়ছো ক্যা? তোমার কি মন খুব ভালা আইজ?
কুসুম থতমত খায়, কী বলবে! আসলেই তো ভালো। কী যন্ত্রণা মেয়ে বুঝদার! গত ছয়মাস আগেও এই মেয়ের মুখে রা ছিল না। আর এখন খালি কটর-কটর! ফাতর আলী লোকটা আসলেই বোকা। না হয় এই ধাড়ি মেয়েসমেত কেউ কাউকে ঘরে তোলে! জীবন হয়তো এমনি, যে পাড় ভাঙে, সে পাড়ের মাটি অন্য কোথাও জমে থাকে পলি হয়। কুসুম তার পেটে আদরের হাত ছোঁওয়ায়, হাত বিশ্বাসের, আস্থার! আসছে যে শিশু, তার মুখটা কেমন হবে? ফাতর আলী দেখতে ভালো না মাথায় চুল নেই, হাবাগোবা চালচলন, তাতে কি মানুষটা তো সাক্ষাৎ ফিরিস্তা।
—ওমা, বাবা আসে না ক্যান?
—বাবারে দিয়া তোর কী? এত আলগা পিরিত ভালা না বিন্তি।
—বাবারে আমার লাগবো।
—ক্যান লাগবো?
—ওমা, তুমিই তো কইলা আমি উল বাদুরের ছাঁও! তুমি কি মনে করছ বাদুরের ছাও কি আমি জানি না? শোনো মা, কাইলই বাবায় কইছে বাদুর আন্ধা পক্ষী, এগোরো রাইতে ঘুম অয় না, তাইনে হেগোর বেবাক কাম রাইতে, তাই তো আমি রাইতে কটর কটর করি। কও আমার বাপে কি মিছা কয়?
কী বলবে কুসুম? বিরক্ত হবে, মেয়েটা এমন করছে কেন? চোখে লাগার মতো বাপ-বাপান্তি! দুদিন আগেও যে মানুষটা তাদের অনাত্মীয় ছিল, আজ তাকেই বাবা বাবা করে জান দিয়ে দিচ্ছে! আজব বেহায়া মেয়ে। কুসুম তার গলার ভেতরে জমে থাকা বাষ্প গিলে ফেলে পানি হওয়ার আগেই। যতই সে বিন্তিকে বেহায়া বলুক, সে তো ঠিকই জানে, বিন্তির আত্মিক সংকট কোথায়, জন্ম দেওয়া বাপ-দাদার স্মৃতি ভুলে, এই অপরিচিত মাটিতে নতুন শেকড় পোতার লড়াইয়ে বিন্তিকে আজ হোক, কাল হোক পাল্টাতে তো হবেই। একটু আগেভাগে হলে দোষ কী!
বিন্তি তার সৎ বাবার জন্য বিছানা গোছায়। বালিশ পাতে, মশারি গোছায়। বিন্তির ছোট হাত, ছোট ছোট পা, ছোট ছোট চোখ অথচ সে চোখে অদ্ভুত ধার। কুসুম ভয় পায়, জীবনযুদ্ধের জন্য বিন্তি প্রস্তুত আর কুসুম?
তিন.
গগাই-গগাই-গগি-গগি—এই কয়টা শব্দ দুলালের খুব প্রিয়, শরীরটাকে বাঁকাচোরা করে মসজিদে আমপারা পড়ার মতো সুর করে ঝুলে ঝুলে দুলাল একমনে বলে যায়—গগাই-গগাই-গগি-গগি। পেটে ক্ষুধা হলে গলার জোর বাড়ে। খেতে যে চায়, সে কথাও মুখ ফুটে বলার জো নেই ছেলেটার। দুলালকে খাওয়ানোর জন্য নিত্যনতুন অনেক কায়দা কানুন আবিষ্কার করে বিন্তি। ঘরের মুরগিকে দেয় একমুঠ দুলালকে দেয় আধামুঠ, ছড়ছড় করে বালতিতে একমগ পানি ফেলে কলকল শব্দ হয় আর সেখান থেকে এক চামচ মুখে দেয় দুলালের। দুলাল যতটা খায়, তারচেয়ে বেশি লালার সঙ্গে গড়িয়ে ফেলে দেয়। বিন্তি ওর মায়ের ফেলে যাওয়া বড় বড় কাপড়গুলো টুকরো করে নিয়েছে, সকালে একটা গলায় বাঁধে দুপুরে আরেকটা। বিন্তিদের এদিকে কেউ তেমন একটা আসে না। ছোট বড় সবাই দুলালকে ভয় পায়। কেউ বলে জিনে ধরা ছেলে। কেউ বলে সাক্ষাৎ দেও। মুখে কিছু বলতে পারে না বোবা ছেলে বিছানা ভেজায় মলে লেপ্টে দেয় পাটির ওপরে বিছানো কাঁথা! সকাল হলে ভায়ের নোংরা করা কাঁথা বালিশ নিয়ে ওপাড়ার খালপাড়ের সাঁকোর নিচের ছোটে বিন্তি। ঘোলা পানিতে ধুয়ে রাখে সব। ভালো পুকুরে গেলে মানুষ গালমন্দ করে। বিন্তি জানে, বিন্তি ছাড়া দুলালের উপায় নাই। সে-ই এখন মা, সে-ই বাবা। বাবা ওর দিকে ফিরেও তাকায় না, কেন কে জানে। কোটর থেকে আধা ইঞ্চি ছিটকে থাকা এই অদ্ভুত চোখের জান্তব মানুষটার পৃথিবীতে বিন্তি শুধু একা। পৃথিবীতে যেসব মায়ের নাম উৎকৃষ্ট জন্মদাত্রী হিসেবে পাঠ্যবইয়ে বা সিনেমা নাটকে লেখা থাকে, তাদের মা সে শ্রেণীর নয়। কী অদ্ভুত অবহেলায় কুসুম নামের তাদের জননী তার দুই পক্ষের সন্তানকেই ফেলে চলে গেলো পেটের দায়ে! সে এতদিনে জেনে গেছে শরীরের দামে ঠিক একটা ভালো জীবন পাওয়া যেতে পারে। এই অপুষ্ট পা আর লম্বা মাথাঅলা সন্তান জন্মের দায় তার না। ফাতর আলী কুদর্শন, এ পাপ তার!
দুলাল তার হাতের আঙুলগুলো চুষতে চুষতে ঘা বানিয়ে রাখে। বিন্তির মায়া লাগে—আহারে, ভাইটা তার মায়ের বুক টেনে ছিঁড়ে খাবলে খাওয়ার সুখ পায়নি। খাক না আঙুলগুলোই, চুষে চুষে খাক, খাবলে খাক। দুলালের চোখ দেখলে বোঝা যায়, মানুষের আনাগোনা ওর ভালো লাগে না। শুধু বিন্তি পাশে থাকলেই দুলাল একটু শান্ত। বিন্তি ভাইকে চামচে করে সেদ্ধ ভাতের জাউ খাওয়ায়, গল্প শোনায়, কবিতা শোনায়!
—বুঝলি ভাই, তুই আর আমি হইলাম এতিম বাপের পোলা-মায়া, মা আছে, মা নাই, বাপ আছে, বাপ নাই! আমারা হইলাম সনেট ভাইগো পাটাতনের নিচে পইড়া থাকা ভোলার লাহান, ছালও নাই বাকলও নাই। আয় ভাই তোরে কবিতা শুনাই, আমার তো আর স্কুলে যাওয়া হইবো না, তাও মাস্টর আফা শিখাইছিল।
ইতল বিতল
গাছের পাতা
গাছের তলায় ব্যাঙের মাথা।
বৃষ্টি পড়ে ভাঙে ছাতা
ডোবায় ডোবে ব্যাঙের মাথা।
ও ভাই তুই ব্যাঙ খাইবি? যা কাইল একটা ব্যাঙ ধইরা তুই আর আমি জবাই দেবো, ভাইজা খাব কুড়মুড়! নে ভাই এইবার একটু ভাত খা। দুলাল খায়, মুখে হয়তো একটু হাসির আভাসও ফোটে। শুধু ফেটে যাওয়া ঘাঁয়ে রক্তাক্ত ঠোঁটে সে হাসি স্পষ্ট হয় না।
বাচ্চাগুলোর টসটসে নড়াচড়া দেখে সনেট মনে মনে ভাবে,
একটা বাচ্চা বিন্তিকে দিয়ে দেওয়ার কথা৷
বিন্তি পুরোপুরি সংসারী মেয়ে, বয়সের হিসাবে নয়, দুলালের হিসেবে। দুলালের অধিকার শুধু তার একার—এ-ও এক অন্যরকম সুখ। মাঝে দু’বার মা এসেছিল। কেমন কেমন তার চোখমুখ, হাতে কয়টা টাকা, টিনের এককৌটা বিস্কুট আর দুধের বড় একটা প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিল। দুলালের জন্য একটা লাল রঙের জামাও আর বিন্তির জন্য এনেছিল ফ্রক। বিন্তি হাসিমুখেই সব রেখেছে। শুধু পরদিন খালের পারে গিয়ে দুলালের কাঁথার নোংরা আবর্জনার সঙ্গে ভাসিয়ে দিয়েছে টিনের বিস্কুট প্যাকেটের দুধ। বিন্তির ফ্রকের টুকরো লালশার্টের হাতা দুলালের লালা মোছার সময়ে খুব কাজে দেয়। ভাইকে নিয়ে বিন্তি সুখেই আছে। ঘরের কাজ শেষ হলে একটা চাকা লাগানো ছোটগাড়িতে করে ঘুরে দুলালকে ঘোরায় বিন্তি, সনেট ভাই দিয়েছে। ঘুরে ঘুরে রোজই ওরা দোকানটায় যায়। ভোলাকে দেখে। ফাও পেলে দুই-একটা বিস্কুট খায়!
ফিরতি পথে শালিখ পাখি দেখলে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, বল তো ভাই এইটা কী?
—গগাগি-গগী।
—ধুর বোকা, এইটা শালিখ।
— ওই দেখ, ওইটা হইলো হাঁস, পাতিহাস।
—গগাগি, গগী।
—উহু উহু তুই পারিস না। কলাগাছ দেখলেও তুই কইবি গগাগি-গগী।
দুলাল হাসে, টুপ করে মাটিতে পড়ে জিভ চুঁইয়ে পড়া লালা।
হয়েছে হয়েছে চল বাবার কাছে যাই। বাবা আমাদের না চিনুক, আমাগো তো চিনতে হইবো। তাই না ভাই? আমরা তো জানি, তোর আসল বাপ আর আমার সৎ বাপ ফিরিস্তা।
বিন্তি তিনচাকার কাঠের গাড়ি ঠেলে ঠেলে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বাবাকে বের করে। বারোয়ারি কাজের মানুষ ফাতর আলী কখনো কাঠমিস্ত্রী, কখনো রাজমিস্ত্রির জুগালি, কখনো ভাড়ায় চালায় রিকশা। কখনো ক্ষেতে দেয় নিড়ানি। যাক, দিন তো তাদের কাটেই। গ্রামে নতুন মসজিদ উঠছে, বিন্তি তার ভাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে কেমন সুন্দর করে তাদের বাবা একটার পর একটা ইট গেঁথে তৈরি করছে ঘর। আল্লার ঘর। বিন্তির মন ভরে যায় দুলালও খুশি, ওর চিৎকারে উল্লাস—গাগাই, গগী!
চার.
ভোলার চারটা নাদুস নুদুস বাচ্চা হয়েছে, ওর ভাঙা ঠ্যাং কবে যে সচল হলো আর কবে যে কার সঙ্গে পেট বাঁধিয়ে এলো, এ নিয়ে শরফুদ্দিনের দোকানে হাসিঠাট্টার বেশ মহড়া হয়৷ কেউ কেউ এও বলে, কিরে সনেট তোর কুত্তার নাম ভোলা শুইনা ব্যাটাকুত্তা ভাবছিলাম, গায়ে মাংস লাগতেই দেখি শরীর কেমন। এখন তো দেখি হালিতে হালিতে বাচ্চাও বিয়ায়। আরেকজন ফোড়ন কাটে—সব আল্লাহর ইচ্ছা, তেলেসমাতি কাণ্ড! সনেট হাসে, কথা বলে না, কী বলবে মুরুব্বি সব! ভোলার বাচ্চা হওয়ার জন্য সনেট দোকানের পাশেই খুপরি করে দিয়েছিল, রাত হলে দোকান পাহারায় তখন থেকে আর মানুষ লাগতো না। ভোলা একাই যথেষ্ট। বাচ্চাগুলো খুব সুন্দর হয়েছে, সনেট নাম রেখেছে ধলা, কালা, নলা, পলা। বাচ্চাগুলো চুকচুক করে জিভ চেটে দুধ খায় একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ে। দেখলে সবারই খুব আমোদ হয়, ভোলার বাচ্চাদের উপলক্ষে শরফুদ্দিনের দোকানে কয়দিন ভিড়বাট্টা একটু বেশিই হয়। বাচ্চাগুলোর টসটসে নড়াচড়া দেখে সনেট মনে মনে ভাবে, একটা বাচ্চা বিন্তিকে দিয়ে দেওয়ার কথা৷ ওর পাগল ভাইটা মাঝেসাঝে খেলবে। দোকানের আশ পাশে প্রায়ই ঘুরঘুর করে দুজন, ভোলার সঙ্গে কী যেন কথাও হয়, একসঙ্গে হাসে-কাঁদে৷ আহারে দুখী মেয়ে! একটা কুকুর পেলে বেশ দুজনের আমোদে কাটবে দিন৷ যা ভাবা তাই কাজ। সনেট সাদাকালোয় ছোপছোপ দেখে একটা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে ছোটে বিন্তিদের বাড়ি। বিন্তি তখন চুলায় ভাত ফুটাচ্ছিল। বাবাকে খাবার দিতে হবে। সনেট গিয়ে দুলালের পাশে বসে। ছেলেটা ঠোঁটের লালায় ভিজিয়ে রেখেছে মোটা কাথার বিছানা, কেমন বোটকা গন্ধ! বিন্তির জন্য মায়া হয়। ছোট মেয়ে কত আর পারে? সনেট কুকুরের সঙ্গে সঙ্গে হাতে করে একটা নরম বিস্কিটের প্যাকেটও এনেছিল, কোনা ভেঙে দুলালের মুখে ধরে। দুলাল জিভ দিয়ে চাটে। সনেটের মনে পড়ে, ভোলার সেই প্রথম আগমনের স্মৃতি।
—বিন্তি এই পিচ্চি ধলারে তোর কাছে দিয়া গেলাম, তুই আর দুলাল খেলিস।
—সনেট ভাই, হেরে খাওয়ামু কী? আর সন্তানশোকে তোমার ভোলা যদি রাত-বিরাতে এই বাসায় হানা দেয়, তাইলে কী হইবো?
—আরে না পাগল, হেরা কি মানুষ নাকি? পোলাপানের দরদ বুঝবো? কথাটা বলেই সনেট বুঝতে পারে, কথাটা কত বেফাঁস কথা। বিন্তির মায়ের ইতিহাস তো সবারই জানা। সনেট প্রসঙ্গ পাল্টায়।
শোন বিন্তি, ধলা তোর দুলাল না, তারে তো যত্নআত্মি কইরা রাজা-বাদশা বানাইতে হইবো না। বাসি ঝটা যা থাকবো, তাতেই চলবো৷ আর এইগুলা তো বোবাপশু নিজেরাই চইড়া খায়। সময় সময় ভোলার কাছে যাবে-আসবে, এই যা।
সনেটের এসব দার্শনিক কথায় বিন্তি বা দুলাল না পটলেও বাচ্চাটা যে রাজি হয়েছে, তা বেশ বোঝা যায়, ছোট শরীরটা দুলিয়ে সে এক চক্কর দেয় উঠোনে, বাহরে বাহ! বিন্তি হাসে, সনেট হাসে। দুলালও মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে—গগাই, গগাই, গগি, গগি!
পাঁচ.
ফাতর আলীর মুখ ভার। কাজে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বিন্তি পানি দেয় ভাত দেয়, ফাতর আলী খায় না, মেয়ের দিকে আড়ে আড়ে দেখে। বিন্তির মুখ ছাই হয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চায়। পূর্বজনমে এই মেয়েটা শুধু যে দুলালেরই মা ছিল, তা হয়তো না। এ ব্যাপারে ফাতর আলী নিশ্চিত। এই বিন্তিরা থাকে বলেই রাত হলে এখনো তাদের মতো কুকুরে তাড়াখাওয়া মানুষদের কেউ কেউ ঘরে ফেরে, অপেক্ষা করে একটু স্নেহের। হোক সে বিন্তির মতো বয়ঃসন্ধিকাল ছুঁই ছুঁই অপরিপক্ব কেউ, তবু। ফাতর আলী জানে, সে নিজে প্রাগৈতিহাসিক কালের কোনো মজা পুকুরে ডুবে থাকা একখণ্ড জমাট পাথর! কত শ্যাওলা জমে আছে গায়, বিন্তির মতো কেউ কখনো সাহস করেনি, সে আবর্জনার স্তূপ ঘষা দিয়ে তোলার! তার এই মেয়েটা যদি পরের হয়, তবে দুলালই একমাত্র ঔরসজাত, এ ভাবনাও অযৌক্তিক!
বিন্তি বোঝে তার এই সৎবাবা বৃক্ষস্বভাবের, শ্বাস নিলেও টের পাওয়া যায় না, তবু কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করা চাই তার।
—ও বাবা, দুলালের জ্বর, দুদিন ধরে খায় না কিছু। ভায়ের দোষ নেই। দোষ আমার৷ সরফুদ্দিন চাচার দোকানে গেছিলাম বিস্কুট কিনতে। ভোলা এই ক দিনে যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই কামড়েছে। আঁচড়ও পড়েছে অনেকের গায়, দুলাল ছাড়া সবাই এখন সদরে। তুমি ওরে সদরে নেও বাবা।
ফাতরআলী বিন্তির দিকে তাকায় না, কথাটা শুনেছে কি না, মুখের অভিব্যক্তিতেও বোঝা যায় না কিছু। নিঃশব্দে ছেলের কাছে যায়। বসে একটু। মুন্সীদের ক্ষেতে আজ নিড়ানি, ফাতর আলীর ভাল্লাগে না। দুলালের পাশে ঠায় বসে থাকে দুপুরঅব্দি। বসে থেকে থেকে একসময় অস্থির হয়ে শোয়া থেকে টেনে তোলে দুলালের শরীর, জন্মের পর এই প্রথম তার সন্তান কোলে নেওয়া।
—বাবা, দুলাল শুধু পানির দিকে চায়া থাকে, ঘরের দুইটা কলস ভাঙছে। গ্রামের সবাই কয় ইনজিকশান দিলে ভালা হইবো। ডাক্তারের কাছে নেও বাবা নেও।
ফাতর আলী বিন্তির কথার সাড়া দেয় না, চুপচাপ ছেলেকে গোছায়, ভালো দেখে একটা জামা পরায়, ওর মায়ের দেওয়া লাল জামাটা খুঁজেছিল, পায়নি। ফাতর আলী দুদিন ধরেই শুনছে ছেলেটার গোঙানি, একহাত পরিমাণ বের হয়ে আসা জিভ দেখে জেনেছে দুলাল বাঁচবে না। তবু বিকার নেই তার। সে কী পাষাণ, না দুলালের মতোই পাগল! বিন্তির একা হয়েছে পাগলা দশা! নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, এই এক বোবা কালা ভাই ছাড়া কে আছে তার! কেউ বোঝে না, কেউ না। সনেটের দেওয়া কুকুরটা অবোধ হোক, তবু কিছুক্ষণ পরপর এসে বিন্তির জামার কোণা ধরে কামড়ায়। ধলা তো ধলা, একটা কুকুরের বাচ্চা, মানুষের বাচ্চাগুলা সব এমন খালি নিজে আদর চায়, অন্যেরটা বোঝে না। বিন্তির বুকটা ফাঁকা হয়ে আসে,অস্থির লাগে। এখন সে কার জন্য শোক করবে? মায়ের কথা না হয় বাদই থাকুক, বুক আছড়ে কার জন্য কাঁদবে সে। বাপ-ভাই, না কি গতকাল বিকেলে মরে যাওয়া ভোলার জন্য। সনেট তো কাঁদেনি, ভোলার লাশটা মাটি খুঁড়ে যত্ন করে কবর দিয়েছে গ্রামের ওই মাথায় পুকুরের পাশে। ভোলাকে বেঁধে সবাই আচ্ছামতো পিটিয়েছে সনেটের সামনে। একটা পাগলা কুত্তার ছিটকে যাওয়া তরল মগজ, গরম তাজা রক্তে গ্রামবাসীর সেকি উন্মদনা। মহৎ কাজের অংশীদার কেনা হতে চায়! সবার চোখেই পুণ্য পুণ্য ভাব! বিন্তি ধলার পিঠে একটু হাত বোলায়, আদর করে, আহা এতিম কুত্তা, তোরও আজ মা নাই বাপ কে, সেটাও তো জানস না।
ফাতর আলী দুলালকে কাঁধে নিয়ে বের হয়। দুলাল নেতিয়ে পড়ে, তবু নেয়। ঘোরে পুরো গ্রাম, শেষকালে নিজেই ক্লান্ত হয়ে ছেলেটাকে বসায় মুন্সীর ক্ষেতের আলের ওপর । মাটি খুঁড়ে আগাছা তুলে রেখেছে কেউ, সেখান থেকে একগোছা তুলে এনে দুলালের হাতে দেয়। বলে—ঘুমাইও না বাপ। দেখো তুমি আর আমি হইছি এই আগাছার লাহান। যত আগে আমাগোরে কেউ তুইলা ফেলবো দুনিয়া থেইকা, ততই তোমার-আমার শান্তি। তুমি তো মইরাই যাইবা, যাও বাপ যাও, মানুষ যতই বলুক, আমি তোমারে ডাক্তারের কাছে নিমু না। এই লাল ঝোলের জীবন, এই ঘা-পাঁচড়ার জীবন আর কত! তারচেয়ে ভালো তুমি মরেই যাও। বিন্তি বু’র কথা ভাইবো না বাপ, ও তো পরের বাপের জন্ম দেওয়া মাইয়া, কবে দেখবা তোমায় মায়ে আইসা টান মাইরা লইয়া যাইবো। কইবো—চল বিন্তি, মায়ের সাথে চল, এই ব্যাটা তোর সৎ বাপ। তখন? তার চেয়ে এই ভালো বাপ, এই ভালো।
ফাতর আলী ছেলের গা ঝাঁকায়, ও সোনা কান্দো ক্যান? তোমার চোখ দেখছো কেমন রক্তজবার মতো লাল হইছে। আসো, কাছে আসো, তোমার গায়ের তাপ কমাই। ফাতর আলী গভীর আবেগে ঔরসজাত সন্তানকে আলিঙ্গন করে। বুকের কাছে মাথা রাখে তার, ঢিপ ঢিপ শব্দ শোনে। কান চেপে রাখে বুকে দীর্ঘক্ষণ। ফাতর আলী জানে, সে অপয়া, কোনো ভালোবাসা তার জন্য নয়। তার বাপ ভাই, বউ সন্তান কেউ তার জন্য না। এই যে ছোট ছোট হাত পা শরীরজুড়ে রেশ উঠে থাকা এই মৃত্যুমুখী সন্তান, সেও তার কেউ না। সব দুদিনের মায়া। তবু ফাতর আলীর ইচ্ছে হয় এই অবেলায় সন্তানকে একটু ভালোবাসতে। দু-চারটা স্নেহের কথা বলতে। ছেলেটার গালের লালা ঝরছে অঝোরে। ঝরুক, আজ সে পরম যত্নে তার পুত্রের লালা মুছবে, ঝোল মুছবে!
ফাতর আলীর কথা দুলালের কানে যায় না। সে জমির পাশে
রাখা মাটির সানকির পানির দিকে তাকিয়ে থাকে।
মরার আগে মানুষ নাকি খুব বুঝদার হয়ে ওঠে। ফাতর আলী জানে, তার ছেলেও এখন বুঝদার। আচ্ছা দুলাল কি ভয় পাচ্ছে? ফাতর আলী ছেলেকে সান্ত্বনা দেয়। বলে, বাপজান, বাপ আমার, তুই কান্দিস না । তুই যদি মরে যাস, দেখবি তুই খুব ভালো থাকবি। আল্লার কিরা, তুই ভালো থাকবি। তুই জানস, আমার বাপের নামও ছিল দুলাল গাজী। মইরা গেছে, এখন যে কত ভালো আছে, মাঝে মাঝে স্বপ্নে তারে দেখি। বেহেস্তের সুবাস গায়, যতদিন বাঁইচা ছিল, খালি কষ্ট আর কষ্ট। এখন দেখ, কত সুখ আর সুখ! আয় বাপ, তোরে আমার বাপের গল্প শুনাই,শুনবি? শোন।
ফাতর আলী নুইয়ে পড়া ছেলের মাথা কোলে নিয়ে আয়েশ করে বসে। বলে, আমার বাপ ছিল আমার মতোই হাবাগোবা। সবাইরেই ডরাইতো হ্যায়, বাপ-চাচারাও সব ছিল যমের যম। আমার দাদা তার অন্য ছেলেপিলের ভয়ে আমার বাপেরে খুব একটা যত্নআত্তি করতো না। দাদার এত টাকা, এত কড়ি, অথচ আমার বাপ থাকতো এক কোণায় কুত্তাবিলায়ের মতো। বাবার কাছে শুনছি, বাড়ির সবাই তারে নাকি কইতো বান্দির পুত। আমার বাপ জন্মের পর তার মায়েরে চউক্ষেই দেখে নাই। বান্দি বুঝবো কেমনে, ক? বাপ, তুই কি জানস, বান্দি জিনিসটা কী? বান্দিরা দেখতে কেমন হয় বাপ!
যাউক বান্দির কথা বাদ, বাপের কথা কই, শোন৷ তারপর একবার হইলো কী, আমার বাপের কপাল ফিরা গেলো। তখন সবে আমার জন্ম হইছে। মায়ের কাছে শুনছি বাপরে অল্প কতক জমিসমেত দাদা একটা জায়গির দেয়। আহা চাচা জেঠাগো চোখ টাটায়। তয় সেইটা ছিল দাদার বাড়ি থেইকা ম্যালা দূরের গাঁ। পাশে নদী আর ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল,পুকুর। বাপে মায়া কইরা আমারে বড় করে, মায়েরে নিয়া জঙ্গল কাটে। আমার মায়ের গায়ে গতরে সেকি জোররে বাজান, ঠিক যেন তোর বিন্তিবু। সেই পরথম শুরু হয় আমাগো ভালো থাকার দিন। আমি বড় হই আর একটু একটু কাম শিখি। মায়ের সাথে বাপের সাথে ঘরের ছাউনি দেই, উঠান বান্ধি। জমিতে যাই আমন লাগাই, বোরো লাগাই ছোট ধানগাছের জালা তুলি, পুকুরে বাপ ব্যাটা মিলে মাছের চার দেই। পুকুর থেকে রাক্ষুসি মাছ খেদাই। আহা কী সুখের দিন আমাগোর। আমার বয়স তখন কত দশ কী বারো!
ফাতর আলীর কথা দুলালের কানে যায় না। সে জমির পাশে রাখা মাটির সানকির পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই থাকে, চোখে তার অসীম তৃষ্ণা।
বাপ, তুমি পানি খাইবা? খাও না ক্যান বাপ? ডরাও। ডরাইও না। খাড়াও পানি আইনা দেই। ফাতর আলি ভাঙা সানকির তলায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি এনে ধরে দুলালের মুখের কাছে। মনের সুখে বলে, খাও বাপ। মনে রাখবা, এই পানিই জীবন, এই পানিই মরণ। আমার বাপ দুলালগাজীও মরছে এই পানির সাগরে। পানি কিন্তু যেই সেই বিষয় না বাপ! বিষ বিষ!
অসুস্থ দুলালের কি এত বোঝার অবস্থা আছে। সে হাঁপায়, কুকুরের মতো হাত-পা ছুড়ে ধরতে যায় পানি, কাছে যায়, আতঙ্কে ছুড়ে মারে সব। খেতে পারে না, গোঙ্গায় শুধু।
ফাতর আলী ছেলেকে থামায় না, করুক যা খুশি। গায়ের তাপ বাড়ছে বাড়ুক, তার কত কথা বলা বাকি এখনো। বউ তো তার পোলা জন্মদিয়েই ভেগেছে। গায়ে-গতরে একটু বড় হলেই মেয়েও নিয়ে যাবে জানে, এরপর কে শুনবে তার কথা। ফাতর আলী অবুঝ হয়। শুনবে শুনবে তার আপন রক্ত শুনবে, তার দুলাল শুনবে।
শোন বাপ, আমার বাপে যেদিন মইরা যায়, সেদিন আমরা দুই বাপ-ব্যাটা কোন্দা বিয়া বাইর হইছিলাম হোগলা পাতা কাটতে। মিয়ার চরের পাশের জঙ্গলে যামু ঠিক করছিলাম। যাওয়া আর হয় নাইরে বাপ, হয় নাই। মধ্যিপথে কারা যে নৌকা থামাইলো, কারা যে আমাগো বাপ-ব্যাটার মুখ চটের বস্তায় বান্ধন দিলো, কিছুই বুঝি নাই। আমার বাপ তো মইরাই গেলো। ক চাই, তোর বাপ বাঁচলো কেমনে, ক? থাক কওয়া লাগবো না। এই দেখ বাঁইচা তো আছি। আমার তখন পেটভরা পানি আর পানি। আইচ্ছা বাপ, তুমি কও তো দেখি একটা মানুষের পেটে কত পানি আঁটে। এক বালতি, দুই বালতি, একপুকুর, দুইপুকুর; না কি পুরা একটা নদী? কইতে পারবা?
ও বাপ, তুমি পানি ফালায়া দিছ ক্যান? খাড়াও আবার আইনা দেই। না থাক, তারচেয়ে এক কাজ করি, চলো তোমারে পুকুর ভরা পানির কাছে নিয়া যাই। তুমি পানি খাও, আরও পানি খাও, আমার বাপের মতো পানি খাও, আমার মতো পানি খাও। পানিতে ডুইবা যাওয়া সব মরা মানুষের লাহান পানি খাও, খাইবা?
দুলাল আর পানি চায় না। খিঁচুনিতে বাঁকা হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে দুলাল তাকায় বাবার দিকে, সীমাহীন তৃষ্ণায় একবার বলে, গগাই, গগাই, গগী। এই একটা কথায় ফাতর আলীর কী যেন হয়। মাটি ফেলে, পানির পাত্র ফেলে জমির মুন্সীর ক্ষেতের আল ফেলে পুত্রসমেত দৌড়ায় সে দিগ্বিদিক! তখনো মুখে তার গল্পের ফুলঝুরি! দুলালকে শুনতে হবে সব! আজ এক্ষুনি। দুলালের গায়ের উত্তাপ, ফেটে যাওয়া শরীরের চামড়া, হা করা মুখের আধ-হাত জিহ্বা আপাতত তার সেসব অতীতচারী গল্পের কোনো প্রতিবন্ধক হতে দেবে না। পুকুরভরা পানি, নদীর স্রোতের উথাল-পাথাল ঢেউ, সমুদ্রের নুনজলমাখা ফেনা—এই তো আছে কাছে কোথাও। ফাতর আলী ছুটছে। এদিকে তরল আঠালো লালা ফেলতে ফেলতে পাগলাকুত্তার কামড় খাওয়া দুলাল জলের আতঙ্ক ভুলে পরম স্নেহে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে পিতার পিঠে। হয়তো দুলাল বেঁচে আছে অথবা নেই অথবা বেভুলে শুনছে ঘোরগ্রস্ত পিতার পৌরাণিক গল্পের ইতিহাস! আপাতত দুলাল নিশ্চুপ।