ইচ্ছে ছিল ওর নাম নীহারিকা রাখবো। ছোট করে নীরু বলে ডাকবো। যতবার নীরু…নীরু…বলে ডাকবো, ততবার রিশাদ চমকে উঠে আমার দিকে তাকাবে। এমনিতে তো দিনে এক-আধবারও তাকানোর সুযোগ পায় না।
রিশাদকে আমি দোষ দেই না। আমি দ্বিতীয়বার ফিরে তাকানোর মতো কেউ না। অথচ কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের দিকে দ্বিতীয়বার কেন বারবার ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয়। দুদণ্ড বসে তাদের সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে হয়। রিশাদের প্রথম স্ত্রী নীহারিকা মানে নীরু হয়তো এমনই ছিল। রিশাদ হয়তো বারবার নীরুর দিকে ফিরে তাকাতো, বাড়ি ফিরে শুয়ে বসে ওর সঙ্গে কুটুর কুটুর মুটুর মুটুর গল্প করতো। ছুটির দিনে খুনসুটি করতো আর কারণে অকারণে আবদার করতে করতে আহ্লাদি ঢঙে হাসতো।
এখন যে রিশাদ হাসে না, তা না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে হাসি হাসি চেহারা করে আমার নাম ধরে ডাকে। মাস শেষে পরিমিত হেসে জানতে চায় সংসারে কী কী লাগবে। আমার কিছু লাগবে কি না—মৃদু হেসে হঠাৎ হঠাৎ জানতে চায় রিশাদ। যেন আমি এই বাড়িতে আসা অতিথি, অতিথি আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না হয়, সেদিকে গৃহকর্তার সতর্ক দৃষ্টি।
রিশাদের মুখে নিজের নাম উচ্চারিত হলে শুনেও আমি না শোনার ভান করি। রিশাদ তখন আবার ডাকে, রিতা…শুনছ, এককাপ লেবু চা দেওয়া যাবে? গলাটা খুশখুশ করছে। অসময়ে বৃষ্টি এলো! আমি বিড়ালপায়ে হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরে যাই, চায়ের লিকার বাড়িয়ে দিয়ে লেবু কাটতে বসি। রিশাদ পাশের ঘর থেকে আবার ডাকে, রিতা শুনছ?
দিনে অন্তত ছয় সাতবার ফোন করে ওর খবর নেয়। দর্পে দুলদুল সারাদিন দুলকি চালে হাঁটে, বসে, শোয়।
আমার নাম রিতা। নিজের নামটা পছন্দ না আমার। নামটা রিটা হতে পারতো। লিয়াও হতে পারতো। কোনো পরিবারে একাধিক ছেলে মেয়ে হলে ছন্দ মিলিয়ে নাম রাখার একটা প্রবণতা ছিল একটা সময়ে, আমাদের পরিবারেও তাই ঘটেছে। বাবা মা তিন কন্যার নাম রেখেছে-মিতা, রিতা, গীতা। আরেকজন হলে নির্ঘাৎ তার নাম রাখা হতো ববিতা।
যাই হোক, নিজের একটা মনোরম নামের অভাব দূর করার জন্য এই বাড়ির সর্বশেষ সদস্যটির নাম রেখেছি ‘দুলদুল।’ রিশাদও ওকে দুলদুল নামে ডাকে। দুলদুলের তুলতুল তুলতুল শরীর। নরম নরম পা। হাঁটলে দুলদুলের পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না। এদিকে অন্ধকার ঘনীভূত হতে থাকলে এই বাসার চার দেয়ালের ভেতর শহরের তাবত শব্দ প্রকট হয়ে বাজতে থাকে। গাড়ির চাকার ঘর্ষণ, হর্নের সতর্ক ধ্বনির সঙ্গে একেকটা মানুষের পায়ে পায়ে ছুটে চলার শব্দও কানে লাগে।
শব্দ শুনতে শুনতে আড়মোড়া ভাঙি। কী করি, কোথায় কী রাখি ভেবে ভেবে এ ঘর ও ঘর হাঁটি। হঠাৎ দরজার ওপাশে রিশাদের পায়ের শব্দ এসে থামে।
‘দুলদুল… দুলদুল…’
দুলদুলের বদলে দুলতে দুলতে সময় নিয়ে হেঁটে গিয়ে আমি দরজা খুলি। আমার দিকে তাকায় না রিশাদ, কিছু বলেও না। রিশাদের দিকে ধাবমান দুলদুল আমার পা মাড়িয়ে যায়। দুজনের পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে থাকা দুলদুলকে দুহাতে দলাইমলাই করতে করতে রিশাদ বলে, সারাদিন কী করছিস রে দুলদুল? দুলদুলকে নিরুত্তর দেখে আমি বেহায়ার মতো মাথা ঝাঁকাই। সারাদিনে দশবার কেন ফোন করেছ? কেন দেরিতে দরজা খুলেছ? দুলদুলের লারা অ্যাডল্টের প্যাকেট ফাঁকা! কী খাওয়ালে সারাদিন?—প্রশ্ন করে করে উন্মাদের মতো কেউ চেঁচিয়ে ওঠে না। কেউ উদগ্রীব, উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতেও চায় না, সারাদিন তুমি কী করেছ রিতা?
এত নীরবতা, এত প্রশ্নহীনতা, এত আতিথেয়তা ভালো লাগে না আমার! এর চেয়ে বেশি ভালো হতো, মুখস্থ সব প্রশ্ন করে করে ধিক্কারে ধিক্কারে কেউ যদি আমাকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলতো। বানানো সন্দেহে আমার দিকে আঙুল তুলতো একশ বার। কথায় কথায় বলতো, এত নির্জীব কেন তুমি? এত অগোছালো, এত উদাসীন কেন?
আমাকে কেউ কিছু বলছে না। রিশাদ আর দুলদুল, পরস্পরের সঙ্গে শব্দহীন সহস্র কথা বলে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এই বাড়িতে ওরা ছাড়া কেউ নেই। রোজই এমন হয়। রিশাদকে বাইরের কাপড় পাল্টানোর সুযোগ পর্যন্ত দেয় না দুলদুল। আদরে আহ্লাদে রিশাদের হাত, পা চাটে।
আজও তা-ই হচ্ছে।
আমি নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে দেখি দুলদুলের মুখটা হঠাৎ নীহারিকার মতো হয়ে যায়। নীহারিকা আর রিশাদ দুজনে বিছানায় গড়ায়…গড়িয়ে গড়িয়ে তৃপ্তির চূড়োর ওঠে। নেমে ক্লান্ত হয়ে পাশাপাশি মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। আমি ঘুমাই না। দুচোখের পাতা খুলে রেখে ওদের রতিক্লান্ত মুখ দেখি।
সেদিনের উন্মত্ত আমোদ আহ্লাদের পরেই দুলদুল গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ওর গর্ভস্থ ভ্রুণের জনক রিশাদই-এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কোনো ভ্রম হয় না আমার। রিশাদ এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। দুলদুলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রেখে বাড়ি ছাড়ে। দিনে অন্তত ছয় সাতবার ফোন করে ওর খবর নেয়। দর্পে দুলদুল সারাদিন দুলকি চালে হাঁটে, বসে, শোয়।
নুয়ে থাকা ঘাড়-মাথা জাঁকিয়ে শেষবারের মতো দুলদুল কাউকে ডাকতে চাইছে। কী জানি মরে যাওয়ার আগে হয়তো বা শেষবারের মতো শুনতেও চাইছে, ‘দুলদুল, দুলদুল’ ডাক।
আমারও নিজের গর্ভ ভরাতে ইচ্ছে করে। খাবার মুখে তুলে ইয়াক বলে ছুটে গিয়ে বেসিন ভাসিয়ে বমি করতে ইচ্ছে করে। এক হাতের তালুতে আচার তুলে আরেক হাতের আঙুলে মেখে মেখে জিভে চকাস চকাস শব্দ করে খেতে ইচ্ছে করে। ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়নমেন্ট আছে বলে বড়োসড়ো একটা ব্যাগ ভর্তি টুকিটাকি খাবার, পানির বোতল নিয়ে বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছে করে।
একদিন আমাকে হতচকিত করে রিশাদ সেই সুযোগটি দিয়ে দেয়। দরজা থেকে ফিরে এসে পিছন থেকে আমাকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে, দুলদুলের দিকে একটু খেয়াল রেখো প্লিজ। রিশাদের নিশ্বাসের ওমে কাঁপতে কাঁপতে আমি কাঙ্ক্ষিত সঙ্গমসুখ পেয়ে যাই। দুপুরের মধ্যেই আমার শূন্যগর্ভ পূর্ণ হয়ে যায়। মোটা করে কাটা পেঁয়াজ, লেবু পাতা দিয়ে করা বেলে মাছের ঝাল ঝাল চচ্চড়ি দিয়ে একথালা ভাত খেয়ে নিয়ে আমিও দুলদুলের মতো শরীর ফুলিয়ে ডিভানের ওপরে শুয়ে থাকি। আমার দুই স্তনাগ্র ক্রমশ কালো হতে হতে থাকে, আমার গর্ভের চূড়া ক্রমে উঁচু থেকে আরও উঁচু হয়। পেটের নরম চামড়ায় টানটান ভাব হতে হতে চিড় ধরে। গর্ভের উজানে জল বাড়ে। একটা মানবশিশু গর্ভজলের মধ্যে খাবি খেতে খেতে হাত পা ছোড়ে। বাইরে থেকে ওর শরীরের অবয়ব দেখা শেষ হলে আমি দুলদুলের চকচকে চোখের ঈর্ষা দেখি। দুলদুল একটা সময়ে আর সহ্য করতে পারে না, লাফিয়ে আমার পেটের ওপরে পড়ে। টাল সামলাতে না পেরে আমি কাত হয়ে যাই আর আমার পেটের ভেতরে গুঁজে রাখা বালিশটা বেফাঁস কথার মতো বেরিয়ে আসে।
আচমকা মনের ভেতরে পুষে রাখা গভীর গোপন ভাবনাটা চোখের সামনে এসে আমাকে বিবশ করে দেয়। এত স্পষ্ট হয়ে ওঠে দৃশ্যটা যে চোখের সামনেই ঘটে যায় সব।
চুলার ওপরে বলকান গরম পানির হাঁড়িটা কাত করে ঘুমন্ত দুলদুলের ওপর ফেলার সময় ও যেন দৌড়ে পালাতে না পারে সেজন্য আলতো করে ওর পা ঝুড়ির সঙ্গে বেঁধে রেখেছি। দুলদুল অসুস্থ হয়ে পড়েছে, নিজেই লাফিয়ে পড়েছে গরম পানির হাঁড়িতে, শ্বাস নিতে পারছে না, অসহনীয় জ্বলুনিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ও শকে চলে যাবে—খবরটা জানাবো বলে রিশাদকে কয়েকবার ফোন করেছি। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরেনি। আমি ফোন রেখে দুলদুলের কাছে যাই। গিয়ে দেখি ওর জ্বলজ্বলে দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। নুয়ে থাকা ঘাড়-মাথা জাঁকিয়ে শেষবারের মতো দুলদুল কাউকে ডাকতে চাইছে। কী জানি মরে যাওয়ার আগে হয়তো বা শেষবারের মতো শুনতেও চাইছে, ‘দুলদুল, দুলদুল’ ডাক।