কর্মস্থলে প্রথম যোগ দেওয়ার পর এই শহরের প্রতি আমার এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্মে। কেবল নেতিবাচক ধারণাই নয়,চাকরিতে ঢোকার কিছুদিন আগে জাপানি কথাকার হারুকি মুরাকামির ‘বেড়ালের শহর’ শিরোনামের যে অদ্ভুত গল্পটা পড়েছিলাম, আনকোরা এই শহরের চেহারা-সুরত, অঙ্গপতঙ্গ অনেকটা সেই গল্পের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় প্রথম দর্শনে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম—স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে ঢের।
আমার জন্মশহর থেকে কর্মশহরের দূরত্ব যতটা না বেশি, তারচে বহুগুণ বেশি মনের দূরত্ব। ফলে এখানের মানুষজন, পশুপাখি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে ওঠা দুষ্কর হয়ে পড়লো। সমস্ত শহরে আতশি কাচ লাগিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কোনো পরিচিত মুখ আর বিশ্বস্ত হাসি চোখে পড়বে কি না সন্দেহ হয়!স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—অচেনা-অজানা এরকম অগণন মানুষের স্রোতে ধূসর পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে রাখা এই নির্দয় স্থানটি কি কখনো জাপানি কিংবদন্তি হারুকির চোখে পড়েছে? এটাই আবার ‘বিড়ালের শহর’ নয়তো!
অনেক ভোগান্তি শেষে, অনাত্মীয় শহরে একটুখানি আত্মীয়ের সন্ধান পেলাম, অপরিচিতের ভিড়ে পেলাম পরিচিতের ঘ্রাণ; পরিচিত বস্তুটি হচ্ছে—দক্ষিণের জানালা! অফিসের দ্বিতীয় তলায়, পেছন-কোণের দক্ষিণপাশে যার অবস্থান।
এখানে আসার পর থেকেই মন খারাপ লাগলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কাপড়ের পর্দা ঠেলে পৃথিবী দেখি। দেখি মানুষ, পশুপাখি। বাতাস মাখি গায়ে।নিচে কোলাহলময় ঘনবসতি। শোনা যায় মানুষের খিস্তি, শিশুর চিৎকার, গরুর হাম্ব স্বর। এরই মধ্যে আলাদা একটা দৃশ্যে আমার চোখ আটকে যায়। পেছন দিক হলেও, দক্ষিণ দিকের নিরিবিলি কক্ষটি আমার ভালো লেগে যায়। ভালো লাগে দীর্ঘ জানালাটিও। বলা যায় অচেনা শহরে এই জানালাটি আমার একমাত্র বন্ধু, আপনজন। তারই সূত্র ধরে খুঁজে পেলাম অন্যজনের দেখা।যে কেবল গোপনেই পুষ্পিত হয়!
জানালা গলিয়ে বাইরে চোখ নিলে দেখা যায়, অফিসের সীমানা-পাঁচিল লাগোয়া সরু-পাকা রাস্তা। কত মানুষের যে আনাগোনা ওখানে! বস্তির ভেতর দিয়ে রাস্তাটি চলে যাওয়ায় গাড়িঘোড়ার ঝক্কিঝামেলাও কম।লোকজনই বেশি। রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষের মুখগুলো দেখতে দেখতে এতদিনে প্রায় মুখস্তই হয়ে গিয়েছে। দেখায় ক্লান্তি আসে না তবু। ভালো লাগে। কেন লাগে? ব্যাখ্যা জানি না। শুধু জানি, নিভৃতে; এই জানালায় দাঁড়িয়ে এক মায়বতীর মুখ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। দূর থেকে দেখেছি তার হাতের চঞ্চলতা, কাজলহীন দরদি চোখের আল্পনা, উচ্ছল হাসি আর বাহুল্যবর্জিত কোমল-সজীব মুখশ্রী। মেয়েটি কখনো আমাকে দেখছে কি? জানি না। পৃথিবীর কেউ জানে না তার নজর আদৌ আমার দিকে পড়েছে কি না।
তরুণীর নামধাম জানি না।সকালে নির্দিষ্ট একটা মুহূর্তে কেবল জানালায় দাঁড়ালে তাকে দেখা যায়, এটুকুর বাইরে কোনো তথ্য আমার জানা নেই। থাকবেই বা কিভাবে, আমার গোপন চোখ যে আড়ালে দাঁড়িয়ে চায়, এসব কি আর বলে বেড়ানো যায়?
ইতিউতি দিনের অন্যান্য সময় দুএকবার যে সে হাঁটাচলা করে না, এমন নয়। করে। কালেভদ্রে। তবে অনিবার্য রুটিন হলো, সকালে দীর্ঘসময় সে রাস্তায় ব্যস্ত থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে, যেকোনো ঋতুতে; প্রতিদিন একই সময়ে, একই কাজে নিয়োজিত থাকে সে। কাজটি হলো—এক যুবক-ছেলের সহযোগী হয়ে ভ্যানগাড়িতে শাক-সবজি, তরিতরকারিজাতীয় কাঁচামাল সাজিয়ে দেওয়া।
ধীরস্থিরভাবে মেয়েটি যখন ভ্যানে তরকারি সাজায়, তার নরোম হাতের স্পর্শে কাঁচামালগুলোর সঙ্গে গাড়িটিও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাশের ছেলেটি খুশি হয়। হাসে। সম্পর্কে ওরা ভাইবোন। ‘ভাইয়া আইজগা একটু তাড়াতাড়ি আহিছ, একখানো যামুনে’ মাল বিক্রির উদ্দেশ্যে ভ্যান হাকিয়ে যাওয়ারকালে, দূর থেকে একদিন এজাতীয় বাক্য ভেসে আসায় নিশ্চিত হলাম—ওরা ভাইবোন।
মালামাল সাজানোর আদতে আস্ত একটা সকালকেই যেন সে মুখরিত করে রাখে—এটা কোরো, ওটা কোরো না; হাজার-কিসিমের নির্দেশনা! ভাইটি বড় সহজ-সরল, বোনের কথাকে কর্তব্য মানে।
জানালায় দাঁড়িয়ে প্রায়শ দৃশ্যটা দেখি। মুগ্ধতা কুড়াই। হররোজ একই দৃশ্য দেখেও ভালোলাগায় ছেদ পড়েনি। এসব দেখতেই কি ইদানিং একটু আগেভাগে অফিসের দিকে ছুটি? কখনো দীর্ঘসময় লাগিয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসাতে বসাতে দৃশ্যটার সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি। দিনেদিনে মুহূর্তটা বড় প্রিয় হয়ে উঠছে।
দুই.
কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ একদিন বদলির আদেশ হাতে পেলাম। আদেশটা পূর্ব-তদ্বিরের গুণে হয়েছে কি না জানি না। ইদানিং এসবের চিন্তা মাথায় নেই। তবে পছন্দের একটি জেলাতেই পোস্টিং হলো। অপছন্দের জেলাতে হলেই বা কী। পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসতে হলো নতুন কর্মক্ষেত্রে। কয়েকদিনের প্রাতিষ্ঠানিক ঝামেলা, চার্জ বুঝিয়ে দেওয়া, নানাবিধ বিষয়-আশয়ের ধকল কম সামলাতে হয়নি। ফলে অনেক কিছুই খেয়ালে আসেনি। হুট করে চলে আসায়, স্বল্পসময়ের জন্যে ভ্যান সাজানো মেয়েটির কথাও বেমালুম ভুলে গেলাম।
নতুন শহরেও আমার জন্য যখন দক্ষিণ-জানালাঘেঁষা অফিসকক্ষটি সেট করা হলো, তখন ভেতরে ভেতরে কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিয়েছি। তারা আমার মনের কথা অনুবাদ করতে পেরেছে জেনে প্রথম কর্মদিবসেই মন ভালো হয়ে গেলো। পুরোদস্তুর কাজে মন দিলাম। পুরনো অভ্যাসের কারণেই হয়তো, অফিসে ঢুকলে এখানেও দক্ষিণের জানালা আমার মন টানে। দাঁড়াই গিয়ে। কিন্তু সেই সবজিকন্যা, সরলসোজা যুবককে আর দেখা যায় না। হঠাৎ মন খারাপ হয়, পরক্ষণেই স্মরণ হয়, আমি তো অন্য শহরে! এখানে ওরা কিভাবে আসবে।
অনেকদিন যাবৎ লক্ষ করছি, দক্ষিণের জানালার মায়া আমি ছাড়তে পারি না। জানি মেয়েটি এখানে নাই, নেই তার ভাইটিও; প্রত্যাশিত কোনো সবজি-ভ্যানও এখানে সাজানো হয় না; তবু চুম্বকের মতো জানালা আমাকে টানে। যাই। মৃদুশ্বাস ফেলি। আর দূর থেকে দেখি,নেশায় বুদ হয়ে থাকা যুবকদের মাতলামি,সন্দেহভাজন মানুষের আনাগোনা, গণিকাদের ইতস্তত চলাফেরা। বুঝতে পারি, এখানকার জানালা আর ওখানকার জানালার মধ্যে বিস্তর ফারাক! ভাইবোনের মধুময় সংসার, পবিত্র খুনসুটির দৃশ্য এখানে কল্পনা করাও বৃথা। আড্ডাবাজ কিছু ছেলেপেলের শিস শোনা ছাড়া আর কিছুই এখানে আশা করা যায় না। শুধু কি তাই, সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি, হৈহুল্লোড় আর রক্তপাত! পুরো এলাকাটাই অস্থির!পৃথিবীর কোনো জানালা দিয়ে এমন দৃশ্য দেখে আমি অভ্যস্ত নই। তবু কর্মের তাগিদে, পেটের দায়ে মেনে নিতে হলো সবকিছু। দিন যত গড়ায়, প্রিয় শহর থেকে মন তত উঠে যায়। সাদামাটা পোশাকের সবজিকন্যা আর নির্ভেজাল যুবকের স্মৃতি আমাকে ধাক্কা মারে। অর্থহীন ঠেকে পৃথিবী, অসহ্য লাগে সব। কাজে বসে না মন। সারাক্ষণ মনের পুকুরে চিতল-মাছের মতো পিঠ জাগিয়ে রাখে পুরোনো শহর। একপ্রকার অধৈর্য হয়ে,বুদ্ধি-কৌশল খাটিয়ে, চেষ্টা-তদ্বির চালিয়ে, ওপরে অর্থ-উপঢৌকন ঢেলে পুনরায় আগের শহরে পোস্টিং নিলাম।অনেকদিন সময় গেলেও প্রফুল্লচিত্তে ছুটে এলাম পুরনো অফিসে।
তিন.
এ-ক’দিন মেয়েটিকে নিয়ে কল্পনার জাল যে কত বুনেছি তার কি আর হিসেব আছে! তাই প্রথম কর্মদিবসেই খুব তাড়াহুড়ো করে অফিসে ছুটলাম। জানালায় দাঁড়ালাম এবং আশ্চর্য হলাম—মেয়েটি নেই! যুবক ভাইটি একা একা গাড়ি সামলাচ্ছে। মাল তুলছে। তার শরীর ও মন ভীষণ ক্লান্ত, মুখটা বিধ্বস্ত! কপাল ঘেমে একাকার। হাত দুটো যেন নড়ছে না। তার অনভ্যস্ত হাতের ছোঁয়ায় শাকসবজি আর তরিতরকারিসমেত ভ্যানগাড়িটিও আগের মতো উজ্জ্বলতা পায়নি। নির্জীব দেখাচ্ছে। ভাবলাম, মেয়েটি বোধ হয় বেড়াতে গেছে—আজকালের মধ্যেই ফিরবে।
না। পরের দিনও একই অবস্থা, সে নেই! যুবক-ভাইটি আজও নিজে-নিজে গাড়ি সাজাচ্ছে। ঘামছে। মুখে এক-গ্লাস পানি তুলে দেওয়ারও কেউ নেই। তার চোখেমুখে ভারী ও পাথুরে ছায়া। গামছায় সে কি ঘাম মোছে, না কি অশ্রু মোছে? দূর থেকে ঠিক ঠাহর করা যায় না। তবে এটাই নিশ্চিত যে, সহযোগী বোনটি তার আশেপাশে কোথাও নেই!
সপ্তাহ পার হয়ে গেলো, মেয়েটির দেখা নেই। খোলা জানালার স্বাদও ম্লান হয়ে এলো। সবকিছুই আগের মতো চলছে, মেয়েটি কোথায়? ঘুরেফিরে জানালার দিকে উঁকিঝুঁকি মারি। আবারও সপ্তাহ ফুরায়। মাস ছুঁই ছুঁই করে। দিনদুনিয়া ঠিকঠাক চলে, মেয়েটি ফেরে না।