নিরীহ অন্ধকারে সাপের মতো ঘুমিয়ে থাকা গ্রামটাকে যেন এক ঝটকায় জাগিয়ে দিলো একটি চিৎকার। তীব্র কোনো স্বর যেন প্রবল আর্তনাদে ছুটে গেল গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। নির্জন মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটার মাথা থেকে অজানা ভয়ে সশব্দে উড়ে গেল কতগুলো পাখি। জমির শেখের গোয়াল ঘরের সামনে ঘুমিয়ে থাকা নেড়ি কুকুরটা সতর্ক হয়ে উঠল। প্রসব বেদনায় ছটফট করতে থাকা রহিমার মায়ের ব্যথা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু কিসের এই চিৎকার, এত আগ্রাসী আর এত ভয়ঙ্কর! যেন সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে এসে কোনো রাজপুত্র টুঁটি চেপে ধরেছে দাঁতাল রাক্ষসীর প্রাণ ভোমরার। ঘরে ঘেরে অস্পষ্ট গুঞ্জন শুরু হয়। মর্দান আলীর বউ বিছানার একপাশে নিজের খুলে রাখা শাড়ি আর ব্লাউজটা কোনো রকমে গায়ে জড়িয়ে বাড়িয়ে দেয় মিটিমিটি জ্বলতে থাকা হারিকেনের শিখাটা। অবশ্য সবার আগে রাস্তায় গলা শোনা যায় আজিবরের। জোয়ানমর্দ আজিবর রাত-বিরেতে প্রমত্ত নদীতে মাছ ধরে অভ্যস্ত। চিৎকারাটা যদি নিশিডাকও হয়, তাতেও সে ভয় করে না। এমন কত ভূত-পেত্নিকে দেখে নিয়েছে সে। ওর হাতে একটা বড় বাঁশের লাঠি। যেন ওটার কয়েক ঘা মেরেই ও থামিয়ে দিতে চায় ওই মরণ চিৎকার। দক্ষিণপাড়ার রইছ মৃধার বাড়ির উঠানে এসে হাঁক দেয় সে।
রইস মিয়া, আরে ও রইস মিয়া বাহিরে আসো। চিক্কুর শোনো নাই? রইস মিয়া আর তার বউ দরজা খুলে বাইরে আসে। দুজনেই কিছুক্ষণ আজিবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর রইস মিয়ার বউ নোলক ফিসফিস করে বলে, মনে হয় জ্বীনের ডাক। নাইলে এমন বিকট শব্দে কেউ চিক্কুর দেয়, মা গো মা, শরীর এখনো কাঁপতেছে। আজিবর কোনো কথা বলে না, কেবল রইসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোয়াল শক্ত, হাতের লাঠিতে শক্ত করে গেঁড়ে বসেছে আঙুল। মনে হইলো নদীর কাছ থেকে আসছে চিৎকারটা, একবার গিয়া দেখতে হয়। রইস তার কাঁধে থাকা গামছাটা কোমরে পেঁচিয়ে বলে, জ্বীনপরী কিছু না। মনে হয় কেউ বিপদে পড়ছে। আজিবর নোলককে বলে, যাতো ভিতর থেইকা দা নিয়া আয়। নোলক কথা বলে না। কেবল নিঃশব্দে ঘরের ভেতর থেকে একটা দা হাতে স্বামীর পাশে দাঁড়ায় এবং বলে, আমিও যামু তোমাগো লগে। যেন সে ধরেই নিয়েছে আজিবর এবং রইস তাকে সঙ্গে না নিয়ে পারবে না। রাত তখন ঠিক কতটুকু কে জানে? কেবল আকাশে খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ একবার চাঁদকে ঢেকে দিয়ে পরক্ষণে হয়তো সরে যাচ্ছিল মুখলজ্জায়। আম-কাঁঠালের ওই ছায়া ছায়া অন্ধকারে দুই যুবক আর এক নারী রওনা দেয় অজানা সেই চিৎকারের উৎসের সন্ধানে। অন্যদিকে একই গ্রামের ইলিয়াস খনকার তার সদ্য বিয়ে করা দ্বিতীয় বউকে বিছানায় ফেলে কোনো একটা অজানা ভয় মেশানো রহস্যের গন্ধে যেন বাইরে চলে আসে। তখনো তার ঘরের একপাশ থেকে প্রথম বউ আজিজার কাঁতরানি মেশানো কান্নার বিচিত্র শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিকেলে ইলিয়াস খনকারের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে গজারির লাকড়ি দিয়ে স্বামীর হাতে বেদম পিটুনি খেয়েছে সে। ইলিয়াস খনকার আজিজাকে উঠানে ফেলে গলায় পা চেপে ধরেছিল। লোকজন এসে তাকে সরিয়েছে বলে রক্ষা। সেই থেকে কখনো কখনো শরীরের রক্তাক্ত ব্যথায়, কখনো বা নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করতে করতে গুনগুন করে কাঁদছে সে। কেবল মাঝখানে এই অন্ধকার মধ্যরাতে তার কান্নাকে যেন ছাপিয়ে গেল অদ্ভুত রহস্যময় ওই মরণ চিৎকার।
আজিবর বিরক্ত হয়ে বলে, মানুষও হইবার পারে, দেখতে যাইতেছি
ঘরের বাইরে ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা হয় আজিবরদের। আজিবর ইলয়াসকে দুচোখে দেখতে পারে না। লোকটা যেমন নীচ, তেমনি হারামি। আগে তার বাপ-দাদারা করত খনকারগীরী।আর এখন বাজারে কাপড়ের দোকান আর সুদের ব্যবসা করে খানিকটা টাকা-পয়সার মালিক যদিও হয়েছে তবু আগের সেই খনকারি স্বভাব যায়নি। ইলিয়াস তার লুঙ্গি ঝাড়তে ঝাড়তে ওদের প্রশ্ন করে-কিসে চিক্কুর দিল এমন কইরা! শুইনা মনে হয় মাইয়া মানুষের চিক্কুর। আজিবর, রইস, নোলক কেউ কথা বলে না। ইলিয়াস খনকার তার হাতে থাকা টর্চ লাইটটা নোলকের মুখে তাক করে। কিন্তু ওই অদ্ভুত চিৎকারটা হয়তো মানুষগুলোকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে ইলিয়াস খনকারের সামনেও নোলক নিজের ঘোমটাহীন মাথা ঢাকতে ভুলে যায়। ওদের চোখে মুখে তখন কিসের যেন একটা পরিবর্তন, সম্মোহন। ইলিয়াস তার কথা বাড়ায় না, শুধু তিন জনের দলটি চারে রূপান্তরিত হয়ে এগিয়ে চলে সেই ভয়ঙ্কর চিৎকারের উৎস সন্ধানে। ঝোপেঝাড়ে তখন আশ্চর্য এক স্তব্ধতা। কেবল জোনাকিগুলো জ্বলে আর নিভে ইতস্তত আকাশের নক্ষত্রগুলোর মতো। ওরা এগিয়ে চলে। রহিমাদের বাড়ি থেকে তখন আরেকটি চাপা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে। গর্ভবতী রহিমার মা ছটফট করছে প্রসব যন্ত্রণায়। সন্ধ্যে থেকে হালকা একটা অস্বস্তি অবশ্য ছিল। হঠাৎ ব্যথাটা সে অনুভব করে আজানের পর। রহিমার বাপ পাশের গ্রাম থেকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে সমিরন দাইকে। রাতের দিকে ধিরে ধিরে ব্যথা বাড়তে থাকে রহিমার মায়ের। কিন্তু ওই মধ্যরাতে হঠাৎ শূন্যে ভেসে যাওয়া প্রাণবিদারী চিৎকার ব্যথাটা যেন বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। দক্ষ সমিরন দাইয়ের বুঝতে বাকি থাকে না যে সময় ঘনিয়ে এসেছে। রহিমা আর তার বাপ রাইসুল যখন তাদের উঠানে হাঁটাহাঁটি করছে, তখন রান্নাঘরের লাকড়ির চুলায় ডেকচিতে ফুটছে জল। সদ্য ভূমিষ্ট শিশুটিকে হয়তো স্নান করাতে কাজে লাগবে। ঘরের পাশের রাস্তা দিয়ে আজিবররা যাওয়ার সময় হাঁক দেয়। ও রাইসুল কাকু, কাকির অবস্থা কী? এইতো সবেমাত্র ব্যথা উঠল। আঁতকা ওই চিক্কুরে ভয় পাইয়া ব্যথা বাড়ছে। কিন্তু এমন চিক্কুরটা দিল কে? ইলিয়াস খনকার বলে, মনে হয় কোনো মেয়ে মানুষের। পরীও হইবার পারে। নাইলে বাপরে বাপ গলায় এরম জোর পাইলো কেমনে! আজিবর বিরক্ত হয়ে বলে, মানুষও হইবার পারে, দেখতে যাইতেছি।
রাইসুল তার ঘরের দিকে একবার তাকায়, আরেকবার মেয়ের দিকে। সে ঠিক বুঝতে পারে না কোন দিকে তার যাওয়া উচিত। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে মিটিমিটি আলো দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে থেমে থেমে চাপা গোঙানি। একবার ভাবে যেয়ে কাজ নেই। যদি ছেলে হয়, তাহলে এই অন্ধকার রাতেতো তাকেই আজান দিতে হবে। আর যদি মেয়ে হয়! মেয়ের ভাবনা মাথায় আসতেই রাইসুল যেন আর কিছু ভাবতে পারে না। ছোট্ট রহিমার লালচে হয়ে যাওয়া চুলে সে হাত রেখে বলে, যা তো মা পাকঘর থেইকা একটা আগুনের লাকড়ি নিয়া আয়। রহিমা দৌড়ে গিয়ে পাকঘর থেকে একটা জলন্ত চেলাকাঠ নিয়ে আসে। আগুনের আঁচে ওর কচি মুখটা লাল দেখায়। হঠাৎ একটা বাউরি বাতাস বয়ে যায় চারদিক। ঘুমভাঙা রাতের এই অনুসন্ধানী যাত্রীদের মনে হয়, কারও যেন আকুল করা একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেলো চারদিক। ওদের শরীরে কাঁটা দেয়, তবু মুখে কারো কথা ফোটে না। কেবল রাইসুল তার মেয়ের হাত ধরে বলে, চলো, আমিও যামু তোমাগো লগে। ওরা ছয়জন এগিয়ে চলে ওই চিৎকারের উৎস সন্ধানে। আকাশে তখন চাঁদ নেই। এমনকি তারাগুলোও যেন হঠাৎ ভয়ে লুকিয়েছে কোনো অজানা গোপনে। কেবল ঝিঁঝিঁগুলোর একটা শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কখনো প্রলম্বিত, কখনো বা ধীরলয়ে। যেতে যেতে নোলক বলে, মনে হয় চিক্কুরটা আইছিল নদীর দিক থিকা। নদীতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে নাইতো! ওর সঙ্গের কেউ কথা বলে না। যেন কথা বললেই হঠাৎ লাফ দিয়ে দূরে সরে যাবে আগত রহস্য। নদীতে যাওয়ার পথে মসজিদের সামনে অর্ধশত বছর পুরনো একটা পাকুড়গাছ। ওটার ছায় ছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল মায়মুনা ও তার বুড়ো দাদা সলিম জোদ্দার। রাতবিরেতে ওই বিদির্ণ চিৎকার ওদেরও ঘরে থাকতে দেয়নি। যেন মগজের কোষে কোষে কেউ ধাক্কা দিয়ে বলছে, যাও খুঁজে দেখো। মায়মুনার বয়স মাত্র চৌদ্দ। বাবা-মা মারা গেছে সেই কবে। তারপর থেকে সে দাদার কাছেই মানুষ। প্রতিদিনের মতো রাতের খাওয়া শেষ করে সলিম জোদ্দার বিছানায় গিয়েছিল। আর সকালে তলপেটের আবছা ব্যথাটা যখন সন্ধ্যায় প্রথম দূষিত কালো রক্ত হয়ে ধরা দিল মায়মুনার হাতে, সেই থেকে ও কেবলই ভাবছিল অন্য কোনো কিছু। রাতে কুপি জ্বালিয়ে একটা ময়লা কাপড়ের খণ্ড যখন ভাঁজ করছিল ঠিক তখনই ওই চিৎকারটা বাতাস আর নিস্তব্ধতা ভেঙে চলে গেছে। মায়মুনা কোনোমতে কাপড়টা লুকিয়েছে আর সলিম জোদ্দার তার ছানিপড়া চোখ নিয়ে উঠে বসেছেন। তারপর কোনো এক অদ্ভুতের সন্ধানে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে দাদা-নাতি। রইস তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, সলিম দাদু চিক্কুরটা শুনছোনি? বুড়ো সলিম মাথা নাড়েন।
শুনছি, বহুত দিন পর দাঁতাল ডাক দিছে। বহুত দিন পর। সবাই সাবধান হইয়া যাও। সাবধান, আবার খরা, আবার মরণ ধায়া আইতাছে সবার দিকে। আজিবর এগিয়ে আসে। তার চোখেমুখে তখনো রহস্যের ডাক। দাঁতাল আবার ডাক দেয় কেমনে? ওর চোখ আছে, না মুখ আছে? আছেতো খালি গতর ভরা পানি। তারমধ্যে সবুজ শ্যাওলা, চকমকি মাছ। বুড়ো সলিম নাতি মায়মুনার কাঁধে ভর করে পাকুর গাছের তলায় বসে। বাকিরা কোনো একটা জমাট রহস্যের জট খুলতে যেন ঘিরে ধরে তাকে। কেবল মায়মুনা ভেতরে ভেতরে টের পায় তার তলপেটের সেই ব্যথাটাকে। সলিম জোদ্দার বড় করে শ্বাস নেয়। ছোট্ট রহিমা তার হাতের জ্বলন্ত লাকড়িটাতে ফুঁ দেয়। রাতের কালো মেশানো একটা কমলা রঙ হঠাৎ খেলে যায় প্রত্যেকের মুখে। সলিম জোদ্দার বলতে থাকে এক অজানা নদীর কথা। তার আগ্রাসী মাটিখেকো রূপের গল্প। সেই কবে কে কোনকালে কিভাবে যেন এই নদীটার নাম রেখেছিলো দাঁতাল। ভরা জলের যৌবন আর ঘোলা পলির মৌবনও এই আগ্রাসী নামটাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কী সুন্দর নদী! টলটলে ঘোলা জল, তীরে তীরে তার সবুজ জনপদ। ধান, সর্ষের খেত, গরু বাছুর, কৃষকের ছোট্ট ঘর, সুখের গ্রাম। তবু প্রতি বর্ষায় দাঁতালের কাছে কিসের যেন খবর আসে। কে যেন গোপন বার্তা পাঠায়। ছোট্ট শিশুর কচি দুধদাঁত যেমন কামড়ের স্বাদ চায়, বর্ষায় তেমনি দাঁতালও হন্যে হয়ে কামড়ের মাংস খোঁজে। জলের দাঁতে সে এক কামড়ে উপরে নেয় মাটি, ফসলের খেত, জনপদ, মসজিদ, মন্দির। মানুষ করুণা ভিক্ষা করে, চোখর জল বিসর্জন দেয় নদীতে। এভাবে কতদিন, কতকাল যে দাঁতাল তার দাঁত বসিয়ে গেছে নির্বিচারে। কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি তার। অবশেষে আজ থেকে অনেককাল আগে এক কামেল ফকির নাকি আশ্রয় নিয়েছিলো তার পাড়ে। তিনি নাকি আল্লাহর ধ্যানে পেয়েছিলেন নূরের তলোয়ার। এই দাঁতাল পাড়েই গড়ে উঠেছিলো তার দরগা। কিন্তু দাঁতাল কি পোষ মানে? ঘোর বর্ষায় কামড়ের সুখে এক রাতে সে দাঁত বসায় ফকিরের দরগায়। কামড়ে কামড়ে দলা দলা উপড়ে আসে মাটি, ভেঙে পড়ে তাল-সুপারির গাছ। ঘোলা জলের ঘুর্ণিপাকে ঘুরপাক খায় চাঁনতারা গিলাপ দেয়া ফকিরি সিংহাসন, দরগার দেয়াল। কামেল ফকির তার নূরের খোলা খঞ্জর হাতে হাঁক দেন। আকাশে বিজলি চমকায়। দাঁতাল যতক্ষণে টেনে নেয় তাকে ততক্ষণে খঞ্জরের ঘা পড়ে নদীর শরীরে। কামেল ফকির তলিয়ে যান। আর মানুষ সেদিন শুনতে পায় দাঁতালের তীব্র চিৎকার। সেই থেকে ওর গতিপথ বদলে গিয়েছিল। শুকিয়ে গিয়েছিল ধারাগুলো। তবু দাঁতাল কিন্তু মরে যায়নি। নিজের জলে কামেল ফকিরি ছোঁয়ার গুণে একশ বছর আগে আবার জিন্দা হয়ে ওঠে সে। আবার গজায় দুধদাঁত, ঢলঢলে জলের যৌবন। আবার একে একে ভাঙতে থাকে পাড়, সবুজ মাঠ, জনপদ সব। ঠিকই তো চলছিল, তাহলে আজ কি তবে আরেক কামেল ফকির তার গতরে ঘা দিয়েছে নূরের খঞ্জর দিয়ে! নয়তো ওই চিৎকার কিসের। দাঁতাল কি তবে আবার মরণাপন্ন! সলিম জোদ্দারকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা শোনে।
তীব্র জিঘাংসা নিয়ে জ্বলছে ধিকিধিকি
মনে হয় কতকাল আগে ফেলে আসা তাদের নিজস্ব জীবনের রূপকথা। কিন্তু দাঁতাল যে শুধু তাদের জনপদের মাংস ছিঁড়ে খেয়েছে তাতো নয়, কখনো কখনো রাক্ষসীটা দেবীর মতো উদার হস্তও হয়েছে। একপাড় ভেঙে অন্যপাড়ে গড়েছে চর। অফুরন্ত পলির প্রসাদে ধানের খেত করেছে সবুজের চেয়ে সবুজ। জালে দিয়েছে রূপালি উপঢৌকন। সলিম জোদ্দারের শ্রোতারা ঠিক বুঝতে পারে না ওরা কী করবে। সুখে-দুঃখে রাক্ষসীটা ওদের রক্ত-মাংস দিয়েই নিজের শরীর গড়েছে। আজ সেই কামেল ফকির নেই। তবে কে আঘাত করেছে ওর গায়ে খোলা খঞ্জরে! আজিবর সবার আগে কথা বলে, আমাগো গিয়ে একবার দেখা উচিত। প্রত্যেকে যে যার দিকে তাকায়। সবার মনে হয় আজিবরের কথাই ঠিক। কারণ, দাঁতাল তার দুধদাঁতে জনপদের কচিমাংসে যতই দাঁত বসিয়ে যাক, আহত নদীর গতিপথ পাল্টালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তখন আর ফসলের মাঠ সবুজ থাকবে না, হয়ে যাবে রুক্ষ মরু। জলে চলবে না নৌকা, মিলবে না মাছ। গ্রীষ্মের দমকা বাতাসে কেবল উড়বে মরা নদীর ধুলো। বুড়ো সলিম নাতির কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চলো মিয়ারা, দাঁতাল পাড়ে চলো। রাক্ষুসীটা মরলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সকলে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে একটা মিছিল এগিয়ে চলে নদীর দিকে। যেন রহস্যভেদী দৃঢ়প্রত্যয়ী একটুকরো জনপদ। যারা দাঁতাল নামের রাক্ষুসীরও প্রাণ ভোমরাকে বাঁচাতে চায় ভিনদেশি কোনো ডালিমকুমারের হাত থেকে। রাতের অন্ধকার তখন ফিকে হয়ে আসছে ক্রমেই। গাছে গাছে দীর্ঘশ্বাসের মতো নিঃশব্দ বাতাস। দলটা এসে পৌঁছায় নদীর ধারে। দাঁতালের জল ছলাৎ ছলাৎ করে। যেন দোদণ্ড প্রতাপশালী কোনো মহানায়কের বেঁচে ওঠার শেষ তীব্র চেষ্টা। দলটা দেখে তারা শুধু নিজেরাই নয়, দাঁতালের দাঁতের দাগ নিয়ে খুবলে খাওয়া এবড়ো-খেবড়ো পাড়ে জড়ো হয়েছে গ্রামের আরও মানুষ। ওদের প্রত্যেকের মুখে নিঃশব্দের ছায়া। যেন কোনো শেষকৃত্বের শবযাত্রী সবাই। নদীর ওই পাড়ে জ্বলছে বড় বড় দুটি সার্চলাইট। তার আলোতে দাঁতালের জল রূপালি হয়ে নড়ে নড়ে উঠছে। ও দুটো যেন দাঁতালের চেয়ে শক্তিশালী কোনো রাক্ষসের চোখ। তীব্র জিঘাংসা নিয়ে জ্বলছে ধিকিধিকি।
গ্রামবাসী এ পাড় থেকেই শুনতে পায় মেশিনের লোমহর্ষক ঘরঘর শব্দ। নতুন দিনের নতুন কোনো ফকিরি অভিশাপ যেন চাইছে আবার বাগে আনতে দাঁতালকে। বাঁধ দিয়ে গতি পরিবর্তন করা হচ্ছে ওর। এভাবে কতক্ষণ ওরা নদীর পাড়ে নির্বাক কাটিয়েছে কেউ জানে না। তবে আজিবর যখন আকাশের দিকে তাকালো, তখন সেখানে ভোরের ঠাণ্ডা ফিকে অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো আলোর বন্যায় ভেসে যাবে চারদিক। বাচ্চা কাঁখে নারী, লাঠিতে ভর দেওয়া বৃদ্ধ, ঘোমটা দেয় গেরস্ত বধূ, মাথাল পরা চাষি, লাঠি হাতে যুবকসহ কয়েকশ মানুষ তখন তাকিয়ে আছে দাঁতালের তেজি স্বত্বাকে বেঁধে ফেলার এই করুণ প্রয়াসের দিকে। হঠাৎ কে যেন একজন গ্রামের দিক থেকে দৌড়ে আসে ওদের দিকে চিৎকার করতে করতে—ফাঁস নিছে রে ফাঁস নিছে, ইলিয়াস খনকারের বউ আজিজা ফাঁস নিছে। এমন সময় দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজান। রহিমাদের বাড়ি সদ্য ভূমিষ্ট এক মানবশিশু কান্না জুড়ে দেয়। দাঁতালের জলে ঝপ করে আরও একটা ব্লক পড়ে। নদীর আহত ঢেউ বাড়ি খায় পাড়ে পাড়ে। আর সবাই আবার শুনতে পায় একটা তীব্র আর্তচিৎকার, ভোরের নতুন আলোকেও যেন ফুটো করে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা।