কী প্রবল দাবদাহ চলছে কদিন ধরে। অথচ নিধি যখন কাল বাড়ি ফিরলো, তার পরপরই আকাশ ছেয়ে গেলো কালো মেঘে। আর তুমুল হাওয়া। মেঘের এই আড়ালটুকু নিধিও চেয়েছিল! না হলে খরতাপেই পুড়ে যেতো ও। এরপর বৃষ্টি কখন নেমেছে, বজ্র-বিদ্যুৎ নিয়ে সে বৃষ্টি একসময় ধরেও গেছে। কেবল বন্ধ চোখের পাতা গড়িয়ে নামা নোনাপানি নিধিকে ভিজিয়ে চলেছে তখনো। কাল যে সময় বাড়ি ফিরেছিল সে, আজ কিন্তু ঠিক সে সময়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। কাল ছিল নিজের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলার লড়াই আর আজ নিধি চেয়েছে নিজেকে প্রকাশ করতেই।
বাড়ি ফেরার পর থেকে নিধি ঘরে শুয়ে। মা অফিস থেকে ফোন করেছিল। ও কেটে দিয়ে টেক্সট পাঠিয়েছে, পরে কথা বলব। আসলে তালগোল হারিয়ে ফেলছে তখন সে। ফোন ধরে মাকে কী বলতো! বলার আগেই হয়তো চিৎকার করে কাঁদতো আর মা অফিসে বসে হঠাৎ অমন কান্নায় ভয় পেয়ে যেতো। তাই আড়াল। টেক্সট অবশ্য নিধিকেও একজন করেছিল কাল। নিধি সেসব আর খুলে দেখেনি। দেখতোও না। ফোন এলেও ধরেনি। তার কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। সন্ধ্যার মুখেমুখে সে বারান্দায় এসে যখন দাঁড়িয়েছিল, আকাশ তখনো মেঘলা। বারান্দার উচ্চতা ছুঁয়ে উঠে আসা এক আমলকি গাছ যে আসলে নিধির বন্ধু, তাকে দেখে ডালপালা মেলে হাওয়া লাগিয়ে দুলে উঠেছিল হয়তো আনন্দে। চিরল পাতাগুলোর গা থেকে তখনো টুপটাপ বৃষ্টির পানি ঝরছে। নিধি কথা বললে দহনের পর এই ভিজে ওঠাটুকুর কথা গাছ তাকেই বলতো। কথা কিছু নিধিরও বলার ছিল। কিন্তু হাসিখুশি তরতাজা সেই গাছকে নিধির মন খারাপের ভেতর টেনে আনার ইচ্ছে তখন নিধির নেই। তাই কেবল শুকনো কুশল বিনিময়।
আর তখুনি দরজায় বেল এবং ঘনঘন। মা বোধহয়। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে মনে পড়েছিল, মার কাছে চাবি আছে। নিধি বা মা আগেপিছে ফেরে বলে দু’টো চাবি দু’জনের কাছে থাকে। ফিরে এসে কেউই আর বেল বাজায় না। যে যার মত দরজা খুলে নেয়। তাহলে কে হতে পারে? আবার বেল। ভীত পায়ে সে দরজার কাছে যায়। দরজার বাইরে যে দাঁড়িয়ে তার অসহিষ্ণুতা টের পাওয়া যায় আরও দু’তিনবার বেল একসঙ্গে বেজে ওঠায়। নিধির কেমন ভয় করে। ঘরে আলো জ্বালানো হয়নি। ডাইনিং স্পেসে ফিরে গিয়ে হালকা আলোটা জ্বেলে ফিরে আসে দরজার কাছে। কি-হোলে চোখ রেখে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জমে যায় পুরো। বুক ধড়ফড় করে ওঠে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কে দরজায়? কেন? ফ্ল্যাট পর্যন্ত এসে গেছে? কী করবে এবার নিধি? এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লক করে দেয়। সারা শরীর ঘাম শপশপে। আতঙ্কে ঘরের এক কোণে সিঁটিয়ে যায় নিধি।
বাদামি রঙা কাগজের ব্যাগ থেকে সোনালি মেরুন চৌকো বক্স উঁকি দেয়। তারপর একটু একটু করে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ খাবার কথা নিধির একবারও মনে হয়নি
যদিও বেল থেমে গেছে তারপর, তবু নিধি দরজা লক করেই। আর সাহস হয় না নিজের ঘর থেকে বেরোনোর। নিঃসাড়ে সময় পেরোচ্ছে। কত সময় পেরিয়ে দরজার ল্যাচ খোলার শব্দে ও ফের কেঁপে উঠেছিল। ড্রয়িংরুমের আলো জ্বলার পর যেটুকু হালকা আলো ওর দরজার তল দিয়ে আস্তে ঢুকে পড়ে তার সঙে্গে সন্ধি করতে চাইছিল সেটুকু আলোও তখন ওর কাছে সহনীয় নয়। কিন্তু আগের চেয়ে কিছুটা হয়তো সে ধাতস্ত। দরজা খোলার সাহস তখন পর্যন্ত নেই কিন্তু উৎকর্ণ হয়ে আছে কান। মা-ই তো? কী জানি যদি মায়ের বদলে অন্য কেউ ঢুকে পড়ে? থম মেরে বসেই থাকতো ও যদি না-চেনা সুরে মোবাইলটা বেজে ওঠার পর মার কণ্ঠ না শুনতে পেতো। মা হ্যালো বলতেই নিধি নিজের মধ্যে ফে্রে, হ্যাঁ মা-ই। এবার উঠে দাঁড়ায়। তখনই মনে পড়ে সারাদিন ধরে ইউনিফর্ম পরে ও। ড্রয়ার থেকে ঘরে পরার একটা টিশার্ট আর স্কার্ট টেনে নেয়। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নেয়। বাজে অনুভূতিগুলো সাবানে ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে চায়। অসময়ে শাওয়ার নিলে মা বকে। আজ সেসব কথা ওর মনেই আসে না। বাথরুম থেকে বেরিয়ে, চুল আঁচড়ে ডাইনিংয়ে এসে দাঁড়ায়।
—কখন ফিরলি?
—যাইনি মা। শরীর খারাপ লাগছিল।
—যাসনি? কী হয়েছে? জ্বর এলো নাকি? চোখমুখ অমন লাল? আবার অবেলায় শাওয়ার?
—মাথাব্যথা খুব মা, তাই। একটু চা খেলে ভালো লাগতো।
নিধির কপালে হাত রাখে মা। কই জ্বর তো নয়। বোধহয় অত গরম থেকে মাথা ধরেছে তোর। এত বৃষ্টি হলো আজ, গরম কমে না তবু দ্যাখ! বলতে বলতে মা গ্যাসে চা বসায়। হঠাৎ অপরাধবোধে আক্রান্ত হয় নিধি। অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়ে মা কাজে লেগে গেছে। আর ও কী রকম, মাকেই তো বরং ও চা করে দিতে পারতো। আশ্চর্য নিধি! বোধবুদ্ধি সব গেলো তোমার নাকি! নিজেকে শাসন করা অবধিই। মাকে সরিয়ে চা বানাতে ওর শরীর চলে না। বরং ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার সশব্দে টেনে ও ধপাস করে বসে পড়ে। বসে বসে ভাবে, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সাহস কী করে হয়! পরক্ষণেই বিভ্রান্তির শিকার হয় আবার, দরজার বাইরে যাকে দেখেছে তা কি ঠিক দেখেছে? কিন্তু ভুলই বা কী করে হয়? স্পষ্টই দেখেছে ব্লু টিশার্ট আর জিন্স, সুজনই। চায়ের সঙ্গে এনার্জি প্লাস দুটো বিস্কুট মা নিজের জন্য বের করে চকচকে নেভি ব্লু প্যাকেটটা নিধির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তখন। নিধি বিস্কুটের প্যাকেটটা দু’হাতে ধরে বসে থাকে। কী মনে করে, নিধির মা, এই যাহ—বলে বেডরুমের দিকে তখন দৌড়ায়। ফিরে আসে ওয়েল ফুডের একটা ক্যারি ব্যাগ হাতে নিয়ে।
—তোর জন্য চিকেন প্যাটিস। ভালোবাসিস বলে আনলাম। আর দেখ বের করতেই ভুলে গেছি।
বাদামি রঙা কাগজের ব্যাগ থেকে সোনালি মেরুন চৌকো বক্স উঁকি দেয়। তারপর একটু একটু করে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ খাবার কথা নিধির একবারও মনে হয়নি। এখন প্যাকেট খুলে মাকে প্যাটিস প্লেটে তুলতে দেখে তার একটু একটু ক্ষিদে পায়। কিন্তু ঠিক দুটো কামড়। তারপরই গা গুলিয়ে ওঠে। একদৌড়ে বাথরুমের বেসিনে গিয়ে হড়হড় করে বমি। পেছন-পেছন মা। নিধির মার কেমন নার্ভাস লাগে। সকালে সুস্থ মেয়ে রেখে অফিসে বেরুলো। হঠাৎ কী হলো তার? কী রে বাইরে কিছু খেয়েছিলি? নিধি মাথা নাড়ে। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, আমি একটু ঘুমাই? আলো নিভিয়ে দেবে মা? বলেই শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। মা আলো নিভিয়ে নিধির কপালে হাত রাখে। নিধি মার ওই হাতটাই কপাল থেকে টেনে বুকের কাছে আনে।
তার কেবল ঘুম পেতে থাকে তখন…গভীর ঘুম।
শরীরে জ্বর নেই অথচ পরদিনও নিধি একই কথা বলে, শরীর খারাপ। কলেজে যাবে না। নিধির মার চিন্তা হয়। সাধারণ জ্বরজারি নিয়ে যে মেয়ে কখনো স্কুল কলেজ কামাই করেনি, তার হলোটা কী! রাতে মেয়ের কাছেই ঘুমিয়েছে। জ্বর ছিল না। এখনো জ্বর নেই। মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করে খুব সদুত্তর পাবে না জেনেও প্রশ্ন করে। উত্তর পায় না। একা একা থাকে বলেই কি এত চাপা মেয়েটা—একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে। কেন যে লোকটা সব দায়িত্ব তার কাঁধে চাপিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকে। বাইরে বাইরে থাকায় বাবার সান্নিধ্য পেলো না মেয়েটা। কোনো একসময় নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে নিধির মা রেশমী নিজেই নিধির বাবার সঙ্গে বাইরে সেটল্ড করতে রাজি হয়নি—এ কথা যেমন সত্যি, তেমনই সেসব অনেক আগের কথা। সময় গড়িয়েছে। নিধির বাবাকে সে বহুবার ফিরতে অনুরোধও করেছে। আর ছ’মাস, আর ন’মাস, আসছি, আসব করে নিধির বাবা আর আসে না। হয়তো এতবছর ধরে স্বাধীন, দায়িত্ব পালন না করা একক জীবন কাটিয়ে লোকটা এখন দায়িত্ব এড়াতে চায়। বছরে দুবার আসাকে্ই সে হয়তো দায়িত্বপালন বলে মনে করে। কিংবা হতেই পারে রেশমী-নিধির চেয়েও আরও বড় কোনো কারণ আছে, যা তাকে দেশে ফিরতে দেয় না। উড়ো কথা কম তো কানে আসে না।
না হলে…একটা খচখচে অস্বস্তি কাঁটার মতো বুকে বিঁধিয়ে নিধির মা অফিসে চলে যায়। নিধি বারান্দায় বসে থাকে সারা সকাল। মনের ভেতর সিলগালার মতো সেঁটে থাকে গতকালের দুপুর। মুছতে পারছেই না। সেই কবে থেকে কো-অ্যাড স্কুলে পড়ে আসা নিধির কখনো ছেলেমেয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে আলাদাকরণের ভাবনা ছিল না। বরং ‘মানুষ’ শব্দের ওপর জোর দিয়েছিল মা। বয় আর গার্ল নয়, সবাই মানুষ। সবাই বন্ধু। সেভাবেই সুজন ওর সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। এবং ভালো বন্ধু। কাজে থাকা যেসব মায়েরা কোচিংয়ে আনা নেওয়া সেভাবে করতে পারে না, তাদের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই এই স্কুল থেকে যে স্পেশাল কোচিং দেওয়া হয়, সেখানেই পড়ে। সন্তান সারাদিন স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরই আছে হয়তো এটা মায়েদের স্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। ছুটির পর স্কুল বাস ওদের যে যার গন্তব্যে নামায়। নিধির এবার এ লেভেল চলছে। সামনেই এ টু এক্সাম। গতকাল কোচিংয়ে ঢুকবে বলে নিধি যখন ক্লাসরুম থেকে বেরুবে ভাবছে, তখন সুজন ওকে একটু দাঁড়াতে বলেছিল। গতসপ্তাহে সুজন অসুস্থ থাকায় দুটো ক্লাস মিস করেছে। কোচিং শুরু হওয়ার আগে সেটা সে তুলে নিতে চায় নিধির খাতা থেকে। এ চাওয়া খুব সহজ-স্বাভাবিক চাওয়া। কথা এটুকুই ছিল। ততক্ষণে বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্লাসরুমের বাইরে কেউ কেউ, কেউ সোজা কোচিং সেকশনে চলে গেছে। ক্লাসরুমটা হঠাৎই ফাঁকা। কপি করার ফাঁকে ফাঁকে ওরা গল্প করছিল আর যে যার টিফিন বক্স খুলে খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ খাতা ছেড়ে সুজন নিধির টিফিনবক্সের দিকে চোখ রাখে…ফ্রেঞ্চ টোস্ট! আহ্ ইয়ামি…লাভ ইট…দে তো খাই… বলতে বলতেই সুজন নিধির সামনে। আর হঠাৎই ফ্রেঞ্চ টোস্ট ছেড়ে ও চুপ হয়ে যায়। কী যেন দেখে নিধির মুখে। শরীরে। নিধি এর আগে এমন কিছু অনুভূতির মুখোমুখি হয়নি, যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। আজ অস্বস্তি হয়। উঠে দাঁড়াতে যায় ও। সুজন বলে ওঠে, হেই বেইবি! হোয়াট’স দ্য ম্যাটার! এত বড় হলি কবে! কী সেক্সি লাগছে আজ তোকে। নিধির মুখ হা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বলে ওঠার আগেই—মুহূর্তে নিধিকে সটান বুকে টেনে চুমু। কেবল চুমুই কি! সুজন নিধির বুকেও হাত দিয়েছে। চোখ ভরে ওঠে পানিতে। শরীর ঘিনঘিন করে। ঘুরে একটা চড় লাগাতেও পারেনি ও সুজনকে। কোনোরকম টিফিনবক্স ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে ক্লাসরুম থেকে। কেন অন্য কাউকে সে জানাতে পারেনি্—ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কান্না সামলায়।
—বন্ধু ছিলি না তুই কখনোই আমার। ছিলি না।
একটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অচেনা মানুষগুলোর হাত কখন যেন এক হয়ে উঠছে। নিধিও কখন পায়েপায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তার।
সকালে ঘুম ভাঙার পর মোবাইলে সুজনের পাঠানো মেসেজগুলো সে দেখেছে। ঘটনাটা সাডেনলি ঘটেছে এবং তা অন্যায় বলে ক্ষমা প্রার্থনার মেসেজ বারবার। সকালেও মেসেজ এসেছে। মিসড কল অজস্র। নাম্বারটা ব্লকলিস্টে দিয়ে ও বারান্দায় এসে বসেছে। ফ্লাইওভার ধরে তখন রেসের গাড়ির মতো গাড়ি ছুটে চলেছে। নগরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। নিধিরা যেদিকটায় থাকে, খিলগাঁওয়ের এসব গলিতে সকালগুলো এখনো কিছুটা যেন সহজ। ও তাকিয়ে থাকে নিচের দোকানগুলোর দিকে। গলির মোড়ে পাশাপাশি দুটো দোকানে সকালের নাস্তায় রুটি, পরোটা, ভাজি, ডাল, বিক্রি হয়। বড়সড় দু’টো কেতলিতে চা—সকাল থেকেই। কেউ কেউ সকালের নাস্তা কিনে নিয়ে চলে যায। কেউ ভেতরে ঢুকে পরোটা-ভাজি-চা খায়। কাল থেকে প্রায় না খেয়ে নিধি। কিছু একটা খাওয়া দরকার, শরীর জানান দিলেও ও নড়ে না। বরং মানুষের শোরগোল আর প্রাণীর ভয়ার্ত গলা থেকে উঠে আসা ‘কেউউউ’ আর্তনাদে ওর চোখ চলে যায় ডানপাশের দোকানের পাশে শুয়ে থাকা কুকুরটার দিকে। ক’দিন আগে একটা গাড়ি ওর পা মাড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই দোকানের পাশে ও শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দোকানি উচ্ছিষ্ট খেতে দেয়। দোকানে ফাইফরমাশ খাটে যে ছোট ছেলেটা, সে ওকে প্রায়ই তাড়া করতে এটা-ওটা ছুড়ে মারে। অসুস্থ প্রাণীর সে শক্তি কই যে সে তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাবে বা প্রতিবাদ করবে। সহ্য করে অত্যাচার। দোকানির চোখ পড়লে অবশ্য সে ছেলেটাকে ধমকে দোকানে ফেরায়। খদ্দের সামলানো ছেড়ে এইসব হুটোপাটির জন্য তাকে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকার সাময়িক শাস্তিও দেয়। ক’দিন আগে চায়ের লিকার ছুড়ে মেরেছিল ওই ছেলেটাই। কুকুরটার চোখে ঢুকে যাওয়ায় একটা চোখ দিয়ে জল গড়ায় ক্রমাগত। হয়তো মালিক নেই, সেই সুযোগে আজ পাশাপাশি দু’দোকানের দুটো ছেলেই কুকুরটাকে কিছু একটা করেছে, যার ফলে কুকুরটা ‘কেউউউ’ শব্দে পুরো শরীরটাকে মুচড়ে সরে যেতে চাইছে আর দু’ চারজন জুটিয়ে ছেলেদু’টো হাততালি দিয়ে উঠছে। আবার কিছু একটা ছুড়ে মারে ওরা। ওপাশের দোকানি তাড়া মেরে ওদের দলছুট করে। ছেলে দু’টো যে যার দোকানে ঢুকে পড়ে। পথচারী ফের চলতে শুরু করে। আর কুকুরটা প্রাণপন চেষ্টায় শরীরটাকে দাঁড় করায়। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে রাস্তা পার হয়। দৃশ্যটা অনেক সময় ধরে ঘটা কোনো কিছু নয় তবু দেখতে দেখতে শরীরে তীব্র ঝাঁকুনি লাগে নিধির। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। সোজা নিজের ঘরে। বই তুলে নেয় ব্যাগে। জামা বের করে শাওয়ারে যায়। বেরিয়ে এসে ফ্রিজ থেকে ব্রেড আর বাটার বের করে। টোস্টারে ব্রেড দিয়ে, গ্যাসে চায়ের পানি ফোটাতে দেয়। তখনই ডোরবেল রিনরিন করে আজ আবার বেজে ওঠে। একটা ম্যাগি নুডলস ঝটপট সেদ্ধ করে পেঁয়াজ কুচিয়ে ঝুরো ডিমের সঙ্গে সে তখন সাঁৎলাচ্ছিল। গ্যাস বন্ধ করে আজ সোজা দরজা খুলে দেয়। সুন্দরবন কুরিয়ারের কমবয়সী একটা ছেলে। হাতে পার্সেল। সেন্ডার, বাপি। মানে সামনে তার জন্মদিন বলে বাপি কিছু গিফট পাঠিয়েছে। গত সন্ধ্যায় এসে বহুবার বেল বাজিয়ে ফিরে গেছে বলে কুরিয়ারের ছেলেটা। নিধি ফিরছে তখন নিজের ভেতর, কাল অত ভয়ে সে এই ছেলেটাকেই ভুল করে তাহলে সুজন ভেবেছিল। নিজের বোকামোতে নিজেকে শাসন করতে করতে পার্সেল মার ঘরে রেখে আসে। রাতে খোলা যাবে। বহুদিনের অদর্শনে থাকা বাপির জন্য তখন তার মন হু হু করছে। কতদিন বাপি আসেনি। টিফিন বক্সটা কাল থেকে ব্যাগে পড়ে। ধুয়ে মুছে তাতে ম্যাগি ভরে ব্যাগে তুলে দেয় বক্স। ব্রেডে মাখন লাগায়। গরম চায়ের সঙ্গে খাবার খায় প্রায় সাড়ে একুশ ঘণ্টা পর বেলা সাড়ে এগারটায়। তারপর সব গুছিয়ে দিয়ে ঘড়ি দেখে ও। বারটা। আজ দু’টো থেকে কোচিং।
বাইরে দুপুরের চড়া রোদ গনগনে আঁচ ছড়াচ্ছে চারদিকে। যেন ঝলসে দেবে সব। নিধিও উত্তাপ বয়ে চলেছে বুকের ভেতর। কেবল গতকালের মরে যাওয়ার ইচ্ছেটা আজ জিতে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিসের ভয়? সম্মান হারানোর? কার কাছে? সেক্সুয়াল এসাল্ট যারা করে, যারা নিজেরাই অমানুষ? কিসের ক্ষমা? টেক্সট করে ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা করা এদের যায় না। প্রতিবাদ করতে হয়। করবেও আজ। সবার সামনে মুখোশ টেনে খুলে দেবে সুজনের। প্রয়োজনে আজ স্কুল অ্যাডমিনের কাছে যাবে, সুজনের বাবা-মাকে ডাকতে বাধ্য করবে। চোরের মতো লুকিয়ে থাকবে না।
এতসব ভাবনার মাঝে নিধি নেমে এসেছে নিচে। লিফট থেকে বেরিয়ে গেটের বাইরে পা ফেলতেই দেখতে পায় গেটের বাইরে পানের দোকানের সামনে সুজন দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সুজনের চোখে চোখ পড়ে নিধির। রাগে রি রি করে উঠছে শরীর। সুজনের চোখে কি অনুনয়? অত বোঝার মন নিধির নেই। বরং নিধি আজ প্রত্যয়ী। কোনো কিছুতেই আজ আর ভয় নয়, ক্ষমাও নয়। সুজনকে দেখে দাঁড়ানোরও কিছু নেই তাই। সোজা হাঁটতে শুরু করে নিধি। পেছন পেছন আসতে শুরু করে সুজন। কেবল আসা নয় পেছন থেকে ডেকেও চলে, নিধি অ্যাই নিধি, একটু থাম। আমার কথাটা শোন। প্লিজ। একবার। নিধি থামে না। নিধি থামবে না। এখানে কোনো কথা নয়। যা কথা কোচিংয়ে সবার সামনে হবে। রেলগেটের সামনে এসে দাঁড়ায় নিধি। রাস্তার ওপাশেই বাসস্ট্যান্ড। একটা বিআরটিসি বাস ছাড়বে ছাড়বে করছে। ওকে বাসটা ধরতে হবে। দুপুরের এ সময়টায় অত জ্যাম থাকে না এদিকে। রাস্তা প্রায় ফাঁকাই। ডানেবামে একবার দেখে নিয়ে রাস্তা পেরুতে দ্রুত পা চালায় নিধি। ওপাশে পৌঁছেও যায় প্রায়। আর তখুনি উল্টোদিক থেকে ভেসে আসে একটা বাসের চাকা ঘষটে চলার শব্দ, একটা আর্তনাদ। এ সমস্তকে ছাপিয়ে ওঠা সমবেত চিৎকার।
বাসচাপা পড়েছে কেউ। আর ব্রেক না কষে স্পিড বাড়িয়ে চলে যাচ্ছে এক ঘাতক বাস। কিছু লোক বাসের পেছনে ধাওয়া করে। ধরতে না পেরে ফিরে আসে। গাড়িগুলো থেমে থাকে রাস্তায়। কিছু সময়ের ব্যবধানে পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের ইমারজেন্সি সাইরেন, মানুষের ভিড়ে চেনা রাস্তাটা অচেনা হয়ে ওঠে নিধির কাছে। বাড়ছে মানুষের গুঞ্জন। চাকায় পিষ্ট কোনো মানুষকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অচেনা মানুষগুলোর হাত কখন যেন এক হয়ে উঠছে। নিধিও কখন পায়েপায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। প্রতিটা অচেনা মানুষের মুখ ধরে ধরে সে খুঁজে চলেছে চেনা সেই মুখটিকে!