খানিক তাজ্জব বনে যাই আমরা। তাজ্জব হওয়ারই কথা!
যে মানুষ মাস শেষ না-হতেই ছুটি প্রার্থনা করে বাড়ি যাওয়ার—দু’মাস পার হলেও নীরবতা পালন করছে দেখে আমরা বিস্মিত হতে বাধ্য হই। বছর ছয়েকের চাকরি জীবনে, মাস শেষ হলে বেতনের টাকা নিয়ে পটিয়ার গাড়ি ধরেন দিন তিনেকের জন্যে—এটাই নিয়ম, অন্তত তার রুটিনে। সঙ্গে থাকে হয়তো পাইকারের দেওয়া বকশিস, মালিকের দেওয়া বিভিন্ন উপহার, দিনখরচের অবশিষ্ট টাকাটাও। বেতনই বা আর কত? এই বাড়তি খরচার যুগে চার-পাঁচজন ছেলেমেয়ের পড়ালেখা অব্যাহত রেখে, সমাজ-সংসারের নানাবিধ রীতি ম্যানেজ করে চলা কম হিম্মতের কথা নয়! তবু মুরব্বির বুকে দুঃখ নেই, মুখে হাসির মৃদু ফোয়ারা ক্রমাগত উদগীরণ করে যায় উজ্জ্বল বিচ্ছুরণ। লোকটার নাম আলগীর হোসেন। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবার চেয়ে বয়সে বড় বলে তাকে মুরব্বি সম্বোধনেই অভ্যস্থ হয়ে উঠি প্রথম দিন থেকে—তাতে অবশ্য তার আপত্তি নেই। কখনো-সখনো মহিলা ক্রেতা এলেই কেবল মুরব্বি না ডেকে ভাই ডাকলেই হলো!
কাঁচা ফলের ব্যবসাটা বড় আজব। দিন নেই, রাত নেই। ট্রাকভর্তি আপেল, কমলা, আঙুর নামাও, দানাপানি ভুলে গিয়ে বিক্রি করো—অতপর লাভের টাকা পকেটে ভরো। সরকারি ছুটি, তাতে কী? স্বাধীনতা-বিজয়-শহীদ দিবস এখানে গোনায় থাকে না। আত্মীয়-স্বজনের কেউ মারা গেলেও হয়তো মালিক-আমদানিকারক গোছের কেউ বলে বসবে—আগে কন্টিনার বিক্রি করি, তারপর না-হয় দাফন-কাফন হবে। টাকার অলঙ্ঘনীয় নেশা ওদের পেয়ে যায় মনে-মগজে। চাকচিক্যময় জীবনে তারা অভ্যস্ত, একটাকার খাতে চার টাকা খরচে যারা পটু—ক্ষেত্রবিশেষে অপচয়ও করে দু’হাতে, তাদের কাছে টাকা অর্জনের পথটাও হয়ে ওঠে অবিরাম লেগে থাকার বিষয়। বহু লোকের কর্মসংস্থানের ভিড়ে, কোলাহল ও অবিশ্রান্ত জোয়ারে আমাদের আলমগীর হোসেন ওরফে মুরব্বিও হাজির হয় পেটের তাগিদে—মিথুন সাহেবের প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে। একসময় নিজেও ব্যবসা করতো—তরিতরকারির। পারিবারিক গ্যাঞ্জামে পড়ে, মামলা ঠেলতে ঠেলতে ব্যবসা তার লাটে ওঠে, থাকার ঘরটাও যাওয়ার উপক্রম। বউকে বুঝিয়ে দেয়—জান দেবা মাগার ঘর দেবা না। ঘটনাও মারাত্মক। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব। বড়োরা জোর করে বাপের সম্পত্তির দখলে নেয় পুরোটা। আলমগীরও ভাইয়ের ভাই কিন্তু ঘর পাবে না! যৌবনের প্রথম কালে আলমগীর নিজেকে নিয়োজিত রাখে পার্শবর্তী সাতকানিয়া উপজেলায় ক্ষেত-খামারের কাজে। হয়তো বা কাজ করতে করতেই কারও ঘরের ছেলে হয়ে যায় একসময়। বাবা নেই সংসারে, মা থাকে ভাইদের কাছে—ঘর সেভাবে টানেও না তাকে। গা-গতরে মাশাল্লাহ। জোয়ান মানুষের উপযুক্ত সময়ে সংসারী হওয়াই উত্তম মনে করে কামলা-দেওয়া ঘরের কর্তাটি আলমেরই অজান্তে মনে মনে পছন্দ করে রাখে পাত্রী। পাশের গ্রামের বাবাহারা এতিম মেয়ে। ভাই-টাই নেই, বাপ-দাদার যা আছে মেয়েগুলোই তো পাবে। শুভাকাঙ্খী হোক আর অভিভাবকই হোক, কর্তার ইচ্ছায় অমত রাখে না আলমগীর। তাছাড়া এই ছন্নছাড়া জীবনে যদি স্থিতি আসে ঘরবাড়ি-বউসহ তো খারাপ কী! বাপের রক্তের কেউ তো আর খবর রাখে না! তবু মা-ভাইদের জানিয়ে দিনক্ষণে কবুল বলে বসে সে। বিবাহসূত্রে শ্বশুরালয়ে থাকার বন্দোবস্তকে কাজে লাগায় আলমগীর। চাষবাস আর কামলা দিয়েই কেটে যায় বেশ; নিজেদের সাংসারিক চাষে আসে বংশধর। ছেলেমেয়েরা বড় হলে আলমগীরের বুঝ আসে এবার বাপের ভিটায় ওঠা উচিত। না, ভাইয়েরা ঘরজামাই ভাইটাকে ঘরে জায়গা দেবে না। বাপের কষ্টে কেনা জমিতে ভাদাইম্যাকে জায়গা দিলে কবরস্থানে শুয়ে থাকা বাপই কষ্ট পাবে। বিচার-সালিশের পর, আলমগীর থাকার একটুকরো ঘর পায় বিশেষ বিবেচনায়। ভাইয়েরা মানতে পারে না—ও কেন বাপের ভিটায় থাকবে? ঘরজামাই থাকার সময় কী বলেছিল? মা-ভাইদের তো তখন না পারতে ডাকছিল, বউয়ের গোলাম হয়ে থাকতেই তো তার আনন্দ, এখন মরতে আসলো, অ্যাঁ? আলমগীর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করায়। স্বপ্ন এই—একদিন এরাই পিতৃ-অপমানের বদলা নেবে বিদ্যারগুণে। সেই থেকে ফলমণ্ডিতে বেতনভুক কর্মচারী হয়ে দিন গুজরান করে আলমগীর। মালিকের এলাকায় তো চাচা হয় সে। পাশাপাশি পাড়ায় বসবাস। জুমা আদায় করে একই মসজিদে। তাছাড়া তুহিন সাহেবদের ঘরদোরের ম্যালা কাজই তো তারা করে দেয় রোজ। পারিবারিক মেজবান হোক বিয়েশাদি হোক, মুরব্বিরা হাত লাগায়, পাশে থাকে। মালিক চোখশরমেই হোক বা বিনয়াবত হয়েই হোক আলমগীরকে মুরব্বি বলেই ডাকেন। প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য লোকজনও সেই থেকে ভুলে যায় আকিকা করা নাম আলমগীর হোসেন, মুখেমুখে রটে যায় মুরব্বি।
রীতিমতো পেটের ভাত চালই থেকে যায় আমাদের। বেচাবিক্রির অবসরে মিটিং-এ বসি। ব্যাপার কী—মুরব্বি ছুটি নেয় না কেন? ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান—ছুটি সংক্রান্ত কোনো দাবি এখনো পর্যন্ত মুরব্বির কাছ থেকে আসেনি। বেলাল, শরিফ, রহিম ও আমি ভাবনার অতলে হাবুডুবু খাই, কূল পাই না। ইউরেকা ডাকের মতোই বেলাল বলে ওঠে—আমি জানি, মুরব্বি কেন বাড়ি যায় না।
কেন—শরিফ ভাইয়ের প্রশ্ন।
—সামনে মেয়ের অনার্স পরীক্ষা, অনেক টাকা খরচ, জোগাড় করতে পারেনি, তাই। মুরব্বি আসলেই কষ্টে আছে। পাঁচটা ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েরা সবাই আবার পড়ালেখায় আছে। এত করে বললাম একটা ছেলেরে চাকরিতে লাগাও, শুনে না। আর দেখেন না, এই যুগে কেউ এত ছেলেমেয়ে নেয়! শালারে তো পুলিশে দেওয়া উচিত। শরিফ ভাইয়ের বিশ্লেষণ।
মরে গেলেও পোলামেয়েরে পড়াবো আমি। দেখি কপালে কী আছে। মুরব্বির কড়া জবাব।
বসের আগমনরেখার ইঙ্গিত পেয়ে, স্বশরীরে প্রতিষ্ঠানের বসকে দেখতে পেয়ে আমরা আলাদা হয়ে যাই। বস থাকলে আমাদের তেমন জমে না। চোখ কেবল কাস্টমারের দিকে। অন্যসময়ও চোখ সচল থাকে তবে সিরিয়াসনেসের ভেতরেও উঁকি দেয় বিনোদনের মৃদু ঝলকানি। মূলত মুরব্বিকে কেন্দ্র করেই আমরা মেতে থাকি আনন্দে। বিক্রি-বাট্টা কম হওয়ার বেদনাও মূলত মুরব্বিকে দিয়ে ঢাকতে থাকি আমরা। কোনো কোনো পাইকার—যাদের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের ব্যবসা ও পরিচয়, তারাও মুরব্বিকে বোঝে; সুতরাং সুযোগ পেলেই মুরব্বিকে ক্ষেপায়। হয়তোবা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাল ডেলিভারির পর তাকে দশ-বিশ টাকা বকশিসও দেয়। মুরব্বি হাসে, ভুলে যেতে চায় মশকারাজনিত ব্যাপার-স্যাপার। বাধ সাধে শরিফ ভাই। মুরব্বিকে চ্যাতানো লাগবেই তার! কখনো আব্বা, কখনো মাগির পুত বলে মুরব্বির ধৈর্যচ্যূতি ঘটাতে পারলেই শরিফ ভাই বাঁচে। আমরা, তার সুযোগ নেই ষোলআনা; বেলাল ভাই বিবৃত করে—ছোটরা সওয়ালের জবাব দিয়ে যাই। হাসি, ঠাট্টা আর রাগারাগিতে যেন আমরা যূথবদ্ধ থাকি—একই প্রতিষ্ঠানে, কাঁচা ফলের ঘ্রাণ আর অম্লমধুর অভিজ্ঞতায়।
প্রতিদিনের মতোই—হাজি সাহেব—বসের মেঝোভাই ফলমণ্ডিতে আসেন ব্যবসার কাজে। তিনিও ফলের ব্যবসায়ী, তবে তার আয়তন ছোট, দূরের কোনো জংশন সংলগ্ন এলাকায় তার দোকান। ভাইয়ের দোকান হিসেবে আসেন, যান ক্রেতা হয়ে। সুবিধার পণ্য কেনার পর হাজি সাহেব—যিনি কি না কথা-কাজে বরাবরই বিনয়ী, অনেকটা হিসাবীও; বলে বসেন—ও মুরব্বি, বয়স কত হলো হিসাব আছে?
শরিফ, বেলাল এই ফাঁকে বেফাঁস মন্তব্য করে মেঝোভাইয়ের প্রশ্নকেই যেন উসকে দেয়। মুরব্বি কিছুটা বিব্রত, মেঝোভাইয়ের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে। নীরবতার অবসরে প্রশ্নেরই লম্বা ফর্দ খুলে বসেন মেঝোভাই। ছেলেমেয়ে বড় হলো, বয়সও প্রায় শেষের দিকে, নামাজ-কালাম ধরবে, দাড়ি রাখবে—তা না-করে মুরব্বি আছে ফাজলামোর তালে। বলি—দুনিয়া দুদিনের রঙ্গখানা, আসল জীবন ওপারে। প্রশ্নের আকস্মিক উত্তেজনায় মুরব্বির চেহারা মলিন, হয়তো বা নিজেকে গুটিয়ে নিজেরই ভেতর অথবা কানকে বলে নিষ্ক্রিয় হতে খানিক সময়ের জন্যে। আমরা উৎসাহী দর্শক হয়ে মজা নেই, মুরব্বিকে এরচে বড় ফাঁদে আর কে ফেলতে পারলো!
বেলাল সাহস দেখিয়েই মেঝোভাইয়ের জবানের উত্তরে বলে—হাজি সাহেব, সামনের সপ্তাহেই দেখবেন আমার মুখে দাড়ি কতটুক হলো। মুরব্বিরে বলে লাভ নেই, ও জোয়ান ব্যাটা তো, দাড়ি রাখবে না। মেঝোভাই আনন্দিত, কিছুটা বিব্রতও বোধহয়। মুরব্বির প্রতি শ্লেষের বিপরীতে বেলালের জন্য স্নেহ আর শ্রদ্ধাই যেন নিবেদন করে বসেন স্বয়ং বসের মেঝোভাই হাজি সাহেব।
লজ্জা থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে অথবা বেলালের বীরত্বকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে মুরব্বি আরও বেশি অবাক করার আয়োজন রাখে নিজের ভেতর, অল্প সময়েই। হাজি সাহেব, আমিও দাড়ি রাখবো, ইনশাল্লাহ। চোখ দেখাদেখি করি আমরা। শরিফ তো চুপসে যাওয়া বেলুন, বেলালের চেহারার ঔজ্জ্বলতাও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে ইতোমধ্যেই। হাজি সাহেব জোহরের আজান শুনে, মুরব্বির দাড়ি রাখার খবরে খুশি মনে মণ্ডি ছাড়ে সে দিনকার মতো।
রুক্ষ মাটিতে বৃষ্টির পর, মাটির অলৌকিক যৌবন প্রাপ্তির লক্ষণ জানিয়ে সতেজ ঘাসের মাথাতোলা উঁকিঝুঁকি। মেঝোভাইয়ের শরিয়তি আলোচনার পর থেকেই কিছুটা খোচা আর অগোছালো শ্মশ্রুকণা মুরব্বির থুতনি বরাবর আবিষ্কার করতে থাকি আমরা। মৃদু উত্তেজনার রেশ সবার মধ্যেই। বেলাল তারও আগ থেকে দাড়ি রাখা শুরু করেছে। সে-ও এখন খুশিতে আটকানা—অন্তত সুন্নতি কারবারে সঙ্গি পাওয়া গেলো চাকরিরত প্রতিষ্ঠানেরই সবচেয়ে বয়েসী কাউকে। শরিফ, আমি মুরব্বিকে সালাম দেই দিনের প্রথম সাক্ষাতে। হাসিমুখে উত্তরও আসে। মুরব্বি হয়তো বুকের ভেতরইে লুকিয়ে রাখে চাপা ক্ষোভ, বয়স বেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা!
চক্রাকারে প্রতিষ্ঠানের অন্য লোকেরা ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে আসে দেশগ্রাম থেকে। মুরব্বির ছুটি নেওয়ার নামগন্ধ নেই। বেলাল কথাটা তোলে সবার সামনে, বেচাবিক্রির অবসরে। ততদিনে মাশাল্লাহ বেলাল ভাইকে মুখভর্তি দাড়িতে যা মানিয়েছে—ফিল্মে রাজ্জাককে মেয়ের বাপ সাজলে যে রকম লাগে!
—ও, মুরব্বি দেশে যাবা না?
—না ভাই, এখন না।
—আব্বা এবার যাবে না, আম্মার থেকে ছুটি পায়নি। শরিফ ভাইয়ের রসিকতাভরা জবাব।
—এই শরিফ কথা হিসাব করে বলবি—মুরব্বির চোখ রাঙানি।
এই এক সমস্যা শরিফ-মুরব্বিকে নিয়ে। শরিফ আব্বা ডাকলেই ক্ষেপে যায় মুরব্বি। শরিফের আব্বা ডাকের মূল মুরব্বির অনার্সপড়ুয়া কন্যা। সেদিকে শরিফের বিশেষ দুষ্টামিপূর্ণ ইঙ্গিত থাকলেও সে বিবাহিত, এককন্যা সন্তানের জনক। এক সময় শরিফ এলাকা সূত্রেই মুরব্বিকে তালতো সম্বোধনে অভ্যস্ত ছিল। এক জায়গায় অনেক পুরুষ থাকলে যা হয়—তালতো ডাকের সামাজিক অবস্থানের কল্যাণেই শরিফ পেয়ে যায় মুরব্বির গৃহিনীকে নিয়ে মশকারা করার অলিখিত অধিকার। একসময় হয়তো অন্যের উসকানিতে, মুরব্বির স্বভাবজাত নিরীহ রূপটাকে জাগিয়ে দিতে শরিফ এবার মেয়ের মাকে নিয়ে নয়, কল্পিত আশাকারা শুরু করে দেয় মেয়েকে নিয়ে! বিবাহ-উপযুক্ত মেয়ে, শহরের কলেজে পড়ে—এই তথ্যে আমাদের আগ্রহ না থাকলেও শরিফ হয়তো আড্ডায় নতুন রস আমদানি করতেই ওদিকে বিশেষ নজর দেয়। তার জোরালো আব্বা ডাকে মুরব্বি খুব বেশি টাস্কিত হয় না বরং শরিফকেই দুর্বল-অনুপযুক্ত পাত্রজ্ঞানে তৎপর হয়ে ওঠে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে কিংবা পচাতে।
তোর মতো ব্যাটার কাছে মেয়ে না দিয়ে হাত-পা বেঁধে মেয়েরে গাঙে ভাইসা দেবো।
কথা না ঘুরিয়ে আসল কথা কও—বেলালের হঙ্কার।
—কী কথা? মুরব্বির নিচুস্বরে জবাব।
—বাড়ি যাও না ক্যা? মেয়ের মা কি মানা করছে?
আমাদের ক্ষুদ্র মজলিশ থেকে মুরব্বি উঠে দাঁড়ায়। ভেতরের দিকে গিয়ে খানিক কী যেন ভাবে। চেহারায় ভয় আর আত্মবিশ্বাসহীনতার চাপ স্পষ্ট। আবারও ফিরে আসে আড্ডায়। দেহ তার আড্ডায়, মন পর্যটন সারছে দূরে কোথাও— সংসারজীবনের পোড়-খাওয়া চলমানতায় অথবা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতে। অনেকটা নিরাসক্ত জীবনই তো সে যাপন করে। কারও সাথে নেই, কারও পাছে নেই। ঝগড়া-ফ্যাসাদেও নিজেকে জড়াতে দেখিনি কখনো। যা বেতন পায়, যা কিছু উপরি ইনকাম, তার সবই মাস শেষে তুলে দেয় বউয়ের হাতে। দুটো দিন ছুটি কাটিয়ে দাম্পত্য জীবনটা যথাসম্ভব উপভোগ করে। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, খরচে কুলোয় না, তবু দুঃখ নেই মুরব্বি কী তার বউয়ের সংসারে। পড়ৃয়া সন্তানেরা একদিন ফিরিয়ে দেবে অনেকানেক সুখ—এই ভরসা খেলে যায় দুইজোড়া চোখে।
মুরব্বির এই হারিয়ে যাওয়া বেলাল ভাইয়ের চোখ এড়ায় না।
—এই বুড়া, কথা কওনা ক্যা?
—আমি বুড়া না। আয়নায় দেখো, কে বুড়া। বাড়ি যাবো না বললাম তো।
—ওর ছুটি নাই, আম্মা মানা করছে—শরিফের রসিকতা।
এবার ম্যানেজার বলে—বলেন তাহলে মুরব্বি সমস্যা কোথায়?
থুতনির দাড়ি বেশ লম্বা হয়েছে মুরব্বির। দেড়মাস বয়েসী দাঁড়িতে হাত বোলায় সে। সেলুনে গিয়ে কাঁচাপাকা দাড়িগুলোর সুন্দর একটা সাইজও করে নিয়েছে বোঝা যায়। মুরব্বিকে এখন সত্যিই মুরব্বি মনে হচ্ছে। দাড়িতে বয়স বেড়ে গেছে অনেক! আমরা আগ্রহ ভরে চেয়ে আছি মুরব্বির মুখের দিকে, কী জবাব আসে দেখি।
—বলেন সমস্যা কী? আবারও তাড়া দেয় ম্যানেজার।
—দাড়ি রেখেছি তো মেয়ের মারে না জানিয়ে; আয়নায় দেখছি দাড়িতে আমারে বুড়া লাগতাছে। কোনমুখে আমি এখন বাড়ি যাবো? কী বলবো মেয়ের মারে? আমি সেদিন হাঁচা হাঁচা ইনশাল্লাহ বলিনি, মেঝো ভাইয়ের চাপে বলেছি। আপনাদের শরমে বলেছি। এই সাদা দাড়ি আমারে মানায়নি। আমার বয়স কি আর দাড়ি রাখার মতো হলো? আমি কিভাবে বাড়ি যাবো?
বেলালের সেইরকম গলা। এক চিৎকার করে ওঠে—এই দেখছো, এই নাকি মরদ, বউয়ের কথা ছাড়া পা-ও দেবার পারে না।
আড়চোখে আমি দেখি মুরব্বির মুখের দিকে—ছলছল করছে চোখজোড়া; ওখানে হয়তো অব্যক্ত হয়েই ক্ষমা চায় যাবতীয় পার্থিব জোরাজুরি থেকে!