কালা মিয়া জাদুকর—এই নামেই চেনে সবাই। যদিও ম্যাজিক দেখানোই তার কাজ। ম্যাজিক দেখিয়েই চলতো তার সংসার। হঠাৎ করেই তার পেশা বদলে গেলো। কবিরাজি শুরু করলো সে। জাদুর মাধ্যমে মানুষের নানা সমস্যা সমাধান করতে পারে কালা মিয়া; এমন কথা চার দিকে প্রচার হতে লাগলো। মানুষও হুমড়ি খেয়ে পড়লো তার কাছে। নানান বিপদে পড়ে মানুষ তার কাছে আসতে থাকে জাদু করার জন্য। প্রেমিকাকে পেতে প্রেমিক যুবক আসে। স্বামীকে নিজের ভক্ত বানাতে স্ত্রীরা আসে। জমি-জমা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েও আসে কিছু মানুষ।
শত্রুকে ব্যাধ মেরে ধ্বংস করতে আসে কেউ কেউ। আবার অন্যের অনিষ্ট করতে, অন্যের সংসারে সমস্যা তৈরি করতেও আসে এক ধরনের লোক। এই টাইপের মানুষকে কালা মিয়া একদম দেখতে পারে না। এরা এলে কালা মিয়া বসতেও দেয় না। ওদের কাছ থেকে টাকা রাখে; কোনো কাজ করে না। তবে জাদুর ‘জ’ না জেনেও কালা মিয়া দিব্য কবিরাজি করে। কলার মুছাকে কাফনের কাপড় পরিয়ে নতুন কবরের ওপর কবরস্থ করে ব্যাধ মারতে। কলার মুছা পচতে পচতে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির ফুসফুস পঁচে যাবে—এমন কথাই বিশ্বাস করে মক্কেল।
কোরবানির গরুর হাড়কে সাদা কাপড়ে কাফন পরিয়ে কবর দিতে বলে পাগলের চিকিৎসায়। দুইটি শিং মাছের পেটে দুই জনের নাম লিখে দু’টি কবজে ভরে দুই নদীতে ছেড়ে দেয়। এতে করে এই দুই শিং মাছ যতদিন একত্রিত না হবে ততদিন এই দুই ব্যক্তির মধ্যে মিল মহব্বত হবে না। ষাঁড়ের লড়াইয়েও যায় জাদু করতে। যদি ষাঁড় জিতে যায়, তাহলে তো তার আদরের সীমা থাকে না। ষাঁড় হেরে গেলে পালিয়ে আসতে হয়।
কালা মিয়া ম্যাজিক দেখানো বাদ দিয়ে এখন পুরোদস্তুর কবিরাজ। নানান প্রান্ত থেকে ডাক আসে কবিরাজির জন্য। ব্যস্ত সময় কাটছে তার। মাঝে-মধ্যে ঘরে ফিরলে বউ বলে, “কিগো! এমনে কতদিন চলবে? মাইনষেরে ঠগায়া যে পয়সা কামাইতাছো এগুলান দিয়া তোমার দিন যাইবো?”
—আরে, আমি কি জোর কইরা মাইনষেরে কই আমার কাছে আইতে? হেরা কেরে আইয়ে আমার কাছে? কিছু উপকার তো অয়। নাইলে আইবে কেরে?
—আচ্ছা তুমি কও তো! জাদুর বা কবিরাজির কিছু তুমি জানো? কেন মাইনষের বিশ্বাস লইয়া খেলতাছো? এই যে তুমি উড়তাছো, এই উড়ালের বিপদ কিন্তুক আছে! নিচে তাকায়া দেইখো। নাইলে একদিন ঠিকই পইড়া যাইবা। আর উইঠ্যা খারইতারতা না। তাই আমি কই কী, আমাগোর হেই ম্যাজিক দেহানোডাই বালা। চল তোমার ছেরিও বড় হইছে। হেরেও আমি কিছু খেলা শিখাইছি। এক চাকার সাইকেল চালাইতারে ছেরি। রশি দিয়া হাঁইটা যাইতারে পনেরো বিশ হাত। তুমি চাইলে হেরে আরও কিছু শিখাইতে পারবা। বাজারে বাজারে, ইস্টিশনে ইস্টিশনে খেলা দেহাইতে দেহাইতে যুদি কোনোদিন টিভিতে যাইতারো, তাইলে তোমার এইসব কবিরাজি কুনু দরহার আছে?
—কতাডা মন্দ কইছো না। আমি কি টিভিতে যাইতে পারুম! টিভিতে আমারে নিবে?
—তুমি যত খেলা জানো আর তোমার হাতের যে খেল; আমি বিশ্বাস করি, একটা সুযোগ পাইলেই তুমি সারাদেশ কাঁপায়া ফালবা।
—তাইলে তুমি ছেমরিরে তৈরি করো। ত্রি-ফলা বর্শাডাও শিখাও। কয়েকটা ‘হারের নাড়াই’ আছে; শেষ কইরাই মাঠে নাইমা ফরুম।
—তাই করো। নাইলে কোনদিন কোন সেনা বেডার আতে ধরা ফরো কে জানে? জীবনডাই বরবাদ অইয়া যাইবো গা। তার চেয়ে নিরাপদ ম্যাজিক খেলাই ভালো।
মানুষের পকেটের টাকা বের করে আনতো কালা মিয়া। নিজের পাঁচ আঙুলের কারসাজিকে মানুষের কাছে বিশ্বাযোগ্য করে তোলার জন্য তার মুখেও চলতো চটকদার কথা। কখনো কখনো ভয়ঙ্কর সব আজগুবি কথাও চলতো তার মুখে। হাত সাফাইয়ের সঙ্গে সমানতালে চালাতো মুখ সাফাইও। এখানে থাকে তার দু’টি উদ্দেশ্য। একটি মানুষের পকেটের টাকা আদায়। অন্যটি অতি চালাক কোনো মানুষের কাছে আঙুলের খেলায় ধরা না খাওয়া। সেই কালা মিয়া কবিরাজিতে এসেও তার জাদুকরি কথার স্টাইল ধরে রেখেছে। মানুষ অল্পতেই তার কথায় মোহাবিষ্ট হয়ে যায়। তবে তার একটি নীতি আছে। যেখানে একবার কবিরাজি করে, কয়েক বছর সেখানে আর ভুল করেও যায় না কালা। যদিও কবিরাজিতে আসাটা কালা মিয়ার আকস্মিক ঘটনা। তবু এলাকায় কিছু চালাক ধরনের মানুষের কাছে প্রচলিত আছে—কালা ম্যাজিক দেখাইতে গিয়া কয়েক জায়গায় অল্প বয়সের কিছু ছেলের কাছে ধরা খেয়ে যায়। সেই ধরা খেয়েই কালা ধরে নেয় হাত সাফাইয়ের দিন শেষ। মানুষ এখন এসব কারসাজি ধরার জ্ঞানে উন্নিত হইছে। তখন এলাকার কিছু লোক কালাকে নিয়ে একটা জুয়া খেলা শুরু করে। কিছু মানুষ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে প্রচার করতে থাকে কালা মিয়ার গুণগান। এতেই জমে ওঠে তার কবিরাজির পসরা। যদিও কালা মিয়া স্ত্রী সুবর্ণ রেখার কাছে এসব কথা অস্বীকার করে। বলে, নিন্দুকেরা এসব আবিজাবি কইবোই। সব কথায় কান দিও না। শোনো, যখন যেই কামে যশ আইয়ে, তখন হেইডাই করা দরকার। তোমার কোনো সমস্যা থাকলে কইও।
—আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে বাবার কাছ থিকা শিখা আমার এইসব খেলা তো একদিন ভুইলা যামু। যদি কোনো দিন তোমার কবিরাজি খেলার এই যশ পইরা যায়; তহন তো আবার এই খেলায়ই ফিইরা আইতে অইব। তহন যদি আমার খেলা আমি ভুইলা যাই কেমনে তুমি আসর জমাইবা?
স্ত্রীর এসব কথায় কালা মিয়া চিন্তামগ্ন হয়। আবার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীকে বলে, সামনের মাসেই আবার মাঠে নামমু। এসব কবিরাজি-টবিরাজি ছাইড়্যা ম্যাজিকেই ফিইরা আসমু। পুরান চাউল ভাতে বাড়ে। পুরান পেশাও সুখ বাড়াইবো। বলেই হা হা হা করে হেসে ওঠে কালা মিয়া। হেসে ওঠে সুবর্ণরেখাও।
কালা মিয়া ষাঁড়ের লড়াইয়ে। ইত্যাবসরে আমরা একটু পেছনে ঘুরে আসি। জেনে নেই কালা মিয়ার ম্যাজিসিয়ান ও সার্কাসম্যান হওয়ার কাহিনী। জেনে নেই সুবর্ণরেখার সঙ্গে কালার সম্পর্কের উপাখ্যানও।
দুই.
কালা মিয়া তখন ষোল-সতের বছরের যুবক। সার্কাসে সার্কাসে ঘোরে। কোনো কাজ করে না। হঠাৎই তাকে বাপের সঙ্গে কাজে-কর্মে দেখা যায়। এই নিয়ে কালা মিয়ার সঙ্গে বাবার খিটিমিটি লেগেই থাকে। বাড়িতে এলেই চাচাদের নিয়ে সালিশ হয়। কালা মিয়াকে কিছু মারধরও করা হয়। কিন্তু কালা মিয়া যেই সেই। বাপে জিজ্ঞেস করে, কিরে কালা, আর কত এভাবে চলবি? এবার বিয়ে শাদি করে সংসারী হ।
—আব্বা, আমি তো চাইই। আপনেগোর কথা মতো চলতে। কিন্তু পারি না। পিনিকটা উঠলেই আর কুন্তা মনে থাহে না। সার্কাস আমারে ডাহে। তহন আর থাকতে পারি না। চইলা যাই। আমার মনে অয় সংসারি করা অইতো না।
—হারামজাদা! তুই আমার সামনের থিকা যা। তর মুখ যেন আমি আর না দেহি। মরণের সময়ও তুই আমার মুখ দেহিস না।
কালা মিয়া বাবার এই কথায় রেগে যায়। রাতে মায়ের আঁচল কেটে আবার নিরুদ্দেশ হয়। মায়ের কোনো কাকুতি মিনতিই আর সে রাখে না। বলে, তোমার জামাই আমারে কইছে হের মুখ না দেখতে। হে আমারটাও দেখতো না। আমি গেলাম গা। দেহি হে কার মুখ দেইখ্যা বাঁচে! বাপের একমাত্র সন্তান কালা। সবাই ধরে নয়ে কয়েকদিন পরেই হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু কালা মিয়া ফিরে না প্রায় চার বছর হতে চললো।
তিন.
সেই রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে কালা মিয়া চলে যায় আঠারবাড়ি রেল স্টেশনে। উদ্দেশ্য কিশোরগঞ্জে অপূর্ব সার্কাসের খেলা দেখবে। সেই সঙ্গে সে নিয়ত করে। সার্কাসের দলে যোগ দেবে। স্টেশনে আসতে আসতে রাত শেষ হয়ে যায়। ময়মনসিংহ থেকে ট্রেন আসতে আসতে সকাল দশটা বাজবে। কালা মিয়া ভাবে কী করা যায়! ঘুমানোর জন্য সে প্ল্যাটফর্মে একটা যুতসই জায়গা খুঁজতে থাকে। এমন সময় দেখে স্টেশনের পেছনে একটা জটলা। এগিয়ে যায় সে। দেখে এক মধ্যবয়সী মজমা জমিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। সঙ্গে আছে একটি আট-দশ বছরে মেয়ে। মেয়েটিও বাপের সঙ্গে নানা খেলা দেখাচ্ছে। কালা মিয়া গিয়ে সবার সমানে বসে। মনযোগ দিয়ে খেলা দেখতে থাকে। ম্যাজিসিয়ান এক একটা খেলা দেখায় আর কালা মিয়া চিৎকার করে ওঠে। বলে বেশ! বেশ! একসময় খেলা দেখানো শেষ হয়। কালা যায় সেই মধ্যবয়সীর কাছে। বলে, আমারে যুদি খেলা শিহাইন আমি আফনের হুইট-হরমাইশ কইরা দিমু।
—বলে কী? এসব খুব ভাল কাজ না। আমি শিইখ্যা ফালাইছি। আর কিছু জানি না। তাই এইসব কইরা বেড়াই। তুমি কেন এসব শিখবে। যাও ঘরে যাও। অন্য কিছু করো।
—না। আপনের যুদি কোনো সমস্যা না থাহে। তাইলে আমি এইডাই শিহুম। আমার আর কোনো কিছুর দরকার নাই। আমি আফনের গোলামি করমু। তবুও ম্যাজিক শিখমুই।
বাপের পাশে বসে বসে মেয়েটি এতক্ষণ হাসছিল। এবার সে তার বাবাকে বললো, বাবা, আমরার দলে পুলাডারে লইয়া লও। পুলাডা ভালো মানুষ মনে অইতাছে। আর আমগোর তো একজন লোকের দরকারও। নানান জায়গায় লোকের সমস্যা তো হয়ই। মেয়ের কথা শুনে ফজু মিয়া কিছুটা নরম হয়। জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী?
তারপর পরিচয়। একসঙ্গে থাকা চলা। কালা দ্রুতই প্রতিটি খেলা শিখে নেয়। তাস গায়েব করা, নিজের পা কাঁধের ওপরে ওঠানো, এক চাকার সাইকেল চালানো, দড়ি বেয়ে হাঁটা, কয়েন গায়েব করা, ফু দিয়ে আগুন জ্বালানো, খালি কৌটা থেকে চানাচুর লজেন্স বের করা, মার্বেলকে পাখি বানানো ইত্যাদি খেলা দ্রুতই শিখে ফেলে সে। কিন্তু গোল বাধে ত্রিফলা বর্শা শিখতে গিয়ে। এইটা শিখতে শিখতে তার চার বছর সময় লেগে যায়। তবু জনসম্মুখে এইটা দেখানোর সাহস সে করে না। সাধারণত সে নানা কথার ফাঁদে মানুষকে আটকিয়ে ত্রিফলা বর্শা না দেখিয়েই মজমা ভাঙতে চায়। কিন্তু যদি মানুষ জোর করে ধরে তাহলে হয়তো তার উস্তাদ নয়তো উস্তাদের মেয়ে ত্রিফলা বর্শা খেলাটা দেখায়। কালা বলে, ধারালো তিনডা কিরিচের মতো ফলা দেখলেই আমার কইলজা কাঁপতে থাকে। একথা শুনে ফজু মিয়ার মেয়ে হাসতে হাসতে বলে, পুরুষ মাইনষের এত ডর থাহন লাগে না। কালা বলে, কী করুম আল্লায় আমারে ডরুক বানাইছে! তবুও যেহেতু শিইখ্যা ফালছি। আস্তে আস্তে ডর ভাইঙ্গ্যা যাইবোগা। ফজু মিয়া বলেন, থছেন, সবাই সব কিছু ফারে না। মেয়েটা বলে, হু! অহন দেহি আমার থিকা কালা বাইয়ের দরদ তোমার বেশি অইয়া গেছেগা।
এভাবেই কালা, ফজু মিয়া ও তার কন্যা বাজার থেকে বাজার, স্টেশন থেকে স্টেশন খেলা দেখিয়ে চলতে থাকে। ফজুর স্ত্রী মারা গেছে সাত বছর। এখন এই তিনজনেই ফজুর সংসার। হঠাৎ একদিন একটা অষ্টমিতে খেলা দেখানোর অফার পায় ফজু মিয়া। শর্ত হল, ত্রিফলা বর্শা চারবার দেখাতে হবে। বড় অঙ্কের টাকার চুক্তিও হয়। পাঁচ হাজার টাকার বায়নাও করা হয়।
বৃহস্পতিবার বিকেল। আরও অনেক ম্যাজিসিয়ান আছে। তাদের সবার খেলা দেখানো শেষ। দুপুর গড়িয়ে বিকেলও শেষের পথে। এমন সময় মাইকে ঘোষণা হয়, এখন সার্কাস দেখাবে ফজু জাদুকরের দল। চার দিকে তুমুল করতালিতে মাঠে প্রবেশ করে ফজু মিয়া, কালা আর ফজুর মেয়ে সুবর্ণরেখা। সুবর্ণর কণ্ঠ ভালো। গাইতেও পারে বেশ। মাঠে প্রবেশ করেই গানে টান দেয় সুবর্ণ। আধা ভাঙা মজমা আবার জমে যায়। পুরো মাঠ ভরে ওঠে। দুয়েকটি খেলা দেখানোর পরেই আসে ত্রিফলা বর্শা। তিনবার দেখায় সুবর্ণ। চতুর্থবার ফজু যায়। বাঁশের খোটার আগা থেকে বর্ষা ছেড়েই শুয়ে পড়েন ফজু মিয়া। কিন্তু সন্ধ্যার আলো-আঁধারি প্রতারণা করে ফজু মিয়ার সঙ্গে। তলপেটে ঢুকে যায় বর্শার একটি ফলা। সুবর্ণ চিৎকার করে ওঠে। আশ্চর্য! মাঠের একটি মানুষও আর অপেক্ষা করেনি! সবাই যার যার মতো চলে যায়। মাঠে শুধু তারা তিনজন। আর একজন শুধু বায়নার বাকি টাকা দিয়ে চলে যায়। অসহায় তিনটি মানুষ বিরান মাঠে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে। কোথাও কেউ নেই। কালা মিয়া একটা ভ্যান গাড়ি এনে ফজু মিয়াকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে যায়। হাসপালের ডাক্তার রোগী দেখে জানায়, খুব বেশি ভয়ের কিছু না। আশা করি ভালো হয়ে যাবে।
তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছে ওরা। তৃতীয় দিন কালা মিয়াকে কাছে বসায় ফজু মিয়া। বলে, বাবা, এই বর্শার এমনই নিয়তি। এইটা যে আবিষ্কার করেছে, সেও এভাবেই মরেছে। আমার উস্তাদও এই ঘাতক বর্শার শিকার। কিছু করার নেই। আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়িই চলে যামু। আমার যা আছে, সব তোমারে দিয়া গেলাম। সুবর্ণকেও দিলাম। তুমি ওরে যতনে রাইখো। পারলে অন্য পেশায় চইলা যাইও। এই কথা কয়টি বলার পরই প্রচণ্ড হেঁচকি ওঠে ফজু মিয়ার। সুবর্ণ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এই কান্নার ভেতরেই ফজু মিয়ার নশ্বর সফর শেষ হয়ে শুরু হয় অবিনশ্বর সফর। হাসপাতালের নিজস্ব কবরস্থানে দাফন করা হয় ফজু মিয়াকে।
চার.
সুবর্ণকে নিয়ে কালা মিয়া বাড়ি ফিরে আসে। চার বছর ধরে নিখোঁজ ছেলেকে পেয়ে পরিবারে উৎসবের জোয়ার আসে। কিন্তু যখনই কালা মিয়ার চার বছরের জীবনের খতিয়ান প্রকাশিত হয়; তখনই পুনরায় কালা বাড়ি ছাড়া হয়। আঠারবাড়ি স্টেশনের পাশেই একটি রুম ভাড়া নিয়ে শুরু হয় কালা-সুবর্ণের সংসার।
পাঁচ
রক্তাক্ত অবস্থায় কালা মিয়া ঘরে ফেরে শেষ রাতে। সুবর্ণ আঁতকে ওঠে। কালা মিয়া বলে, তেমন কিছু হয়নি।
—কী হইছে কও!
—আরে সেই যে চৌধুরীর মেয়ের জন্য খাঁ সাবের পুলায় তাবিজ নিছিল না! তয় মেয়েডা খাঁ সাবের পুলার লগে চইলা গেছে। অহন হেরা কেমনে যেন খবর পাইছে আমি তাবিজ করছি। নাড়াই থিকা ধইরা আইন্যা আমারে চৌধুরী বাড়িতে আটকাইছিল। কিছু মাইরও দিছে। মাইঝ রাইতে চৌধুরীর বউ আমারে ছাইড়া দিছে।
—খোদার কসম লাগে তুমি আর এসব ঠক-বাটপারিতে যাইও না। তুমি না পারলে আমি আর তোমার ছেরি তোমারে বয়া বয়া খাওয়াইবাম। তেও তুমি এইসব ধান্দালি ছাইড়া দেও।
ছয়.
আজ তিন বছর নতুন করে কালা মিয়া ম্যাজিক দেখানো শুরু করছে। কালা মিয়া, সুবর্ণ আর তাদের মেয়ে কেয়া এই তিনজনের দল। এই তিন বছরে টিভিসহ নানান বড় বড় জায়গায় তারা শো করেছে। সংসারেও সচ্ছলতা এসেছে। অদ্ভুত এককণ্ঠ পেয়েছে কেয়া। সার্কাস ও ম্যাজিকের পাশাপাশি কেয়ার গান এখন নিত্য অনুষঙ্গ।
এবার পহেলা বৈশাখে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজে শো করার অনুমতি পেয়েছে কালা মিয়া। বেশ ক’দিন আগে থেকেই প্রস্তুত হয় পুরো পরিবার। ইতোমধ্যে কেয়া ত্রিফলা বর্শায় নতুন নতুন সংযোজন করেছে। এতদিন সবাই তিনটি ফলা ছেড়ে দিয়ে কোমরের দুই পাশে দুটি ফলা আর দুই উরুর মাঝখানে একটি ফলা রেখে শুয়ে পড়তো। ফলা তিনটি মাটিতে দেবে যেতো। কিন্তু কেয়া মাথার দুই পাশে দুই ফলা আর ওপরে একফলা ফেলতে পারে। কোমর কে বাঁকিয়ে পেছনের দিকে দুই ফলা রেখে সামনে এক ফলা ফেলে খেলা জমাতে পারে। এমনকী তাকে যেখানে দর্শকরা বলে, সেখানেই বর্শ ফেলে খেলা দেখাতে পারে।
সাত.
পহেলা বৈশাখ। ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজের ময়দান। উন্নত সাউন্ড সিস্টেমে কেয়ার গলায় শুরু হয় গান। সুবর্ণও গাইছে। চারপাশে মানুষের মজমা জমে উঠেছে। কালা ও সুবর্ণ’র কথার জালে আটকে গেছে জনতা। পেটের দায়ে এই খেলা দেখাই—এমন কথাও বলেছে কালা। শুরু হলো তাদের শো। মানুষ করতালি দিয়ে কান ফাটিয়ে দিচ্ছে।
অপেক্ষাকৃত তরুণরা তীব্রভাবে মোহিত হচ্ছে তাদের খেলায়। বর্তমান কর্পোরেট যুগে স্ট্রিট ম্যাজিসিয়ানের জৌলুস কমতে শুরু করেছে। রেল স্টেশন ছাড়া তাদের আর কোথাও তেমন একটা দেখা যায় না। শহুরে অনেকেই এমন স্ট্রিট ম্যাজিসিয়ানের খেলা দেখেনি। জমে উঠেছে সার্কিট হাউজের মাঠ। কালা মিয়ার মনে ফুর্তি। প্রতিটা খেলা শেষ হতেই টাকা-পয়সার বৃষ্টি নামে। টাকা কুড়াতে কুড়াতে কালা নতুন ফন্দি আঁটে। মনে মনে বলে ত্রিফলা বর্শা তো এখনো বাকিই আছে।
একসময় শুরু হয় ত্রিফলা বর্শার প্রদর্শনী। কালা দুইবার দেখায়। সুবর্ণও দুইবার দেখায়। প্রতিবারই জনতার টাকার বৃষ্টি নামিয়ে তাদের উৎসাহ দেয়। কালার মাথায় কূটবুদ্ধি খেলে যায়। সুবর্ণের সঙ্গে কানাকানি করে। বলে, কেয়া চাইর নম্বরে একটা ফলা তার পায়ে ফেলে দেবে। দেখবে টাকার পাহাড় হয়ে যাবে।
—দেখো, তুমি জীবনে যত বাজি ধরেছো, সবগুলোই জিতেছো। সবসময় তুমি জিততে জিততে তোমার মাথা বিগড়ে গেছে। আমি আমার মেয়েকে কোনোভাবেই এইটা করতে দেব না।
—আমি ডাক্তারে সঙ্গে কথা বলেছি। এখানেই ডাক্তার আছে। কোনো সমস্যা হবে না। একটিবারে জন্য আমাকে এই বাজিটা ধরতে দাও। বলেই কেঁদে ওঠে কালা। স্বামীর কান্নার কাছে মাতৃহৃদয়ের স্ত্রী হেরে যায়।
কেয়া বাবার এক কথাতেই রাজি। শুরু হয় কেয়ার বর্শা-খেল। প্রতিবার বর্শা নামে আর টাকার বৃষ্টি নামে। চারবারের সময় বর্শার একটি ফলা কেয়ার হাঁটুর একটু নিচে ঢুকে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে।