প্রতিভাপর্ব
দুপুর অনেকটাই শেষ।
সকাল থেকে ঢাকার আকাশে বৃষ্টি থাকায় বোঝা দায়, সূর্যটা ঠিক কোথায়। সুমিত হাতের ঘড়ি থেকে সময় জানে—বিকাল ৪টা। লালবাগ চৌধুরীবাজার থেকে রিকশা এসে যখন নিউ মার্কেটের দক্ষিণ গেটে থামল, বৃষ্টিআবহ ভেঙে সুমিত ততক্ষণে রিকশাঅলাকে জিজ্ঞেস করে, চলে আসছেন?
রিকশাঅলা বৃষ্টির পানি আর ঘামের জল একসঙ্গে গামছা দিয়ে মুছে বলেন, হ মামা, আপনি কই ছিলেন। ইরাকি মাঠের হাঁটুসমান পানি সরাইয়া আইলাম। নিউ পল্টন লাইনে ক’বার আটকা পড়ল গাড়ি। টের পাইলেন না!
সুমিত ভাড়া মিটিয়ে নিউ মার্কেটের প্রবেশমুখের ডান পাশে পত্রিকাস্টলে ঢু দেয়। স্টলের সামনে কাঠের ছোটখাটে পাতিয়ে রাখা ম্যাগাজিনগুলোর ওপর চোখ যাওয়ার আগেই চোখ পড়ে সামনের নারীর ওপর। সুমিতের চোখ মধ্যবয়স্ক নারীর দিকে পড়ে থাকে। নারীও সমানে-সমান। বৃষ্টি তখনো ঝিরিঝিরি। স্টলের সামনে দিয়ে এদিক-ওদিক পথচারী হাঁটতে গিয়ে সামনাসামনি নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নারী-পুরুষের শরীরে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে গেলেও তাদের ঠাই দাঁড়িয়ে থাকায় পরিবর্তন আসে না।
বৃষ্টি ছাড়লে মুহূর্তেই মানুষ-ক্রেতা বেরিয়ে পড়ে। এতক্ষণে এ দোকানে-ও দোকানে ঝুম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন বৃষ্টির জলভরা নিউ মার্কেটের দক্ষিণ চত্বরের ইটপাকা পিচগুলোর স্বচ্ছ পানি ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে; কালো রঙ ধারণ হচ্ছে, বেরিয়ে পড়তে উন্মুখ মানুষগুলোর জুতোর ময়লায়। ফুচকার দোকানগুলোর ছোট ছোট শিশুরা ক্রেতা আকর্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে—আফা, আসেন ফুচকা, চটপটি। ভালো হইবো। কফিও আছে। বসেন! কফি শব্দ কানে আসতেই পাশাপাশি হাঁটা সুমিত আর ওই নারী চোখ ফেরায়।
অদ্রি
চোখ তুলে অদ্রি সম্মতি দেয়। অদ্রি এভাবেই সুমিতকে সম্মতি জানিয়ে আসছে। এবারও ব্যত্যয় ঘটেনি। সুমিত কফি শপের ভেতরে ঢুকেই—এই ছেলে দুটো কফি দাও, চিনি কম দিয়ে! সুমিতের অর্ডার শেষে তারা দুজনেই মুখোমুখি এক টেবিলে বসে পড়ল। যদিও বসে পড়ার মধ্যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো কিছুটা অনূভিত হলো। সুমিত বসেই ভাবে—চাইলে অদ্রি তো পত্রিকা স্টলের সামনে ওকে দেখেই সম্বিত হারাতে পারত। অদ্রি চেয়ারে বসতেই একটা নিচু শব্দ হলো।
হালকা নীল আর সাদা রেখার শাড়িতে অদ্রির ব্লাউজ ওর কনুইঅবধি প্রলম্বিত ছিল। সুমিত একটু ভেজা না থাকলে ওর গায়ের শার্টের রঙ হালকা সবুজই থাকত। পরনের জিন্সও অতটা গাঢ় দেখাত না। ভিজলে হালকা সবুজ অনেকটা গাঢ় হয়।
চেয়ারে বসেই চশমা খুলে কফিশপের টেবিলে রাখা টিস্যুতে দুটো গ্লাস মুছে দিল সুমিত। জলভেজা চশমায় অদ্রিকে এতটা সময় দেখেনি সুমিত। এই প্রথমবার ঘটল।
তোমার স্বাস্থ্য তো দেখি আগের মতোই। বাচ্চারা কী করে?
শরীর ভালো। তোমার খবর কী? অদ্রি সুমিতের দ্বিতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। সুমিত হাসে, ফের প্রসঙ্গ তোলে।
বাচ্চাদের কথা তো বললে না?
তোমার?
আমার আবার? আমি তো বলেই ছিলাম, বাবাটাবা হতে পারব না। এত বড় দায়িত্ব আমার জন্য নয়। তোমার আকাঙ্ক্ষা তো বেশি ছিল।
সে তো ছিলই। কিন্তু তুমি তো এখন অনেক বড়, বয়সও হয়েছে। এখনো বুঝতে পারলে না?
সে আমি বুঝেই সন্তান নেইনি। কারণ, বাবার মর্যাদাগুলো আমি জানতাম, উপলব্ধিতে আসেনি কখনো, তাই। আমার বাবাকে তো আমি মিস করি না কখনো!
তর্কে তো পারব না আমি, কিন্তু তোমার কি ভালো লাগছে?
একা লাগছে, কিন্তু খারাপ লাগছে না। প্রিয়কাজগুলো তো এখনো সহকর্মী হয়ে আছে। এই যে, আজকেও এলাম কিছু কালারফুল জিনস কিনব বলে।
ও, এখনো জিন্স তোমার প্রিয়?
নীল জিন্স।
লাইটের আলোয় না হয়ে দিনের আলো হলে অদ্রির দাঁতগুলো এখনো আরও সুন্দর দেখাত। অদ্রি হাসে, দাঁত উপচে হালকা গোলাপি দাঁতমাংসও বেরিয়ে আসে সুমিতের উত্তর শুনে।
সুমিতের চোখ আঠার মতো অদ্রির দাঁতে লেগে থাকে। ৪৫ উর্ধ্ব নারীও হাসলে শিশুর মতো দেখায়। বাচ্চা মেয়ের মতো। সুমিত চোখ ফিরিয়ে কফিতে চুমু দেয়। অদ্রি কফিরগ্লাসে হাত লাগিয়ে বসে থাকে। প্রায় ঠাণ্ডা হলেই কফির কাপে ঠোঁট ভেজাবে অদ্রি।
সুবোধ ঘোষের গল্প কিনতে এসেছি। ম্যালাদিন ধরেই ভাবছি, কিন্তু আসা হয় না। আজ বৃষ্টি দেখেই বের হয়েছিলাম। গাড়ি নিয়ে এসেছি। তাই কাদামাটি থেকে বেঁচে গেলাম।
অদ্রির কথাগুলো মিলিয়ে ভাবার চেষ্টা করে সুমিত। দ্রুত মেলায়, অদ্রি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে মাইলদুয়েক রাস্তা অনায়াসে হেঁটে যেত বাসায়। ভাসানটেক। জাহাঙ্গীরগেট দিয়ে ঢুকে ক্যান্টনমেন্টের পরিপাটি রাস্তা ধরে নিবিড়মনে।
এখন তো নিশ্চয় চাইলেও হাঁটতে পারবে না অদ্রি। সুমিত কফির কাপে ঢোক গেলে আর চিন্তায় রপ্ত হয়। অদ্রিও চুপ থেকে কফির কাপে নিবিষ্ট হয়। জাহাঙ্গীর গেট এখন আরও সামনে চলে এসেছে। কারওয়ানবাজার মোড় থেকে ফার্মগেট যাওয়ার রাস্তাটি এখন সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ। ক্যান্টনমেন্টের গাড়ি সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমজনতার জন্য শাহবাগ পর্যন্ত খোলা থাকে সব সময়। কারওয়ানবাজার কাঁচাবাজারের এখন বিশাল তিনটি ভবন। একটি ফেসবুক বাংলাদেশ, অন্যটি ইউটিউব বাংলাদেশের আঞ্চলিক কার্যালয়। তবে সবচেয়ে বড় যে ভবনটি, আগের পেট্রোবাংলা কার্যালয় থেকে একেবারে তেজগাঁও রেলগেট অবধি। পুরোটাই কাঁচাবাজার। তবে সুপারমল। সব মিলিয়ে দশটি সুপার মল এই ভবনে। ক্যান্টনমেন্টের সুবিধার জন্য কাঁচাবাজারটি বড় করা হয়েছে। সুমিত একবার গিয়েছিল ওদিকটায়। এখনকার প্রহরা বেড়ে গেছে একশগুণ। ওর তরুণবয়সে বাইক চালিয়ে কচুক্ষেতের ভেতর গিয়ে মহাখালী নতুন ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার নিরিবিড়ি সড়কে ধোঁয়া উড়ালেও গত দশ বছরে ক্যান্টনমেন্টের বাইরের একটি মার্সেডিজও প্রবেশ করতে পারেনি।
সুমিত ভাবে, এখন তো অদ্রি হাঁটবে না। এক মিনিটও না। গাড়ি চালিয়ে ৫ মিনিটের দূরত্বের পথ গাড়ি করে আসতে হয়। এই বয়সে সুমিত তার বাবাকে আইলে রেখে ক্ষেতে ধানের চারা রোপন করেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আরও বিশ বছর আগে বাবার বয়স তেষট্টি হলেও পিঠগুজে কাদামেখে আউষের চারা দিয়েছেন ক্ষেতে।
কী ব্যাপার, এতক্ষণ চুপ থাকলে চলবে? কী ভাবছ?
না, এম্নি। তোমার কফি খাওয়া হলো? বাইরে যাই চলো। একটু মুখাগ্নি জ্বালাতে হবে।
নীরব সম্মতি দিয়ে অদ্রি কফিতে টানা চুমুক দিয়ে চলে। আবার নিউ মার্কেটের প্রবেশমুখের বাম পাশে সিগারেট দোকানে গিয়ে বেনসন লাইট ধরিয়ে লম্বা টান দেয় সুমিত।
গল্প
আর কতক্ষণ চুপ থাকবি? আমি চলে যাব?
লাস্যমুখে রাগ এনে টেনে টেনে অদ্রি সুমিতকে ঠেঙানোর চেষ্টা করে। সুমিত গাল থেকে হাত নামিয়ে সোজাসুজি অদ্রির মুখে তাকায়, আচ্ছা আমরা কি বিশ বছর পরেও এক হতে পারি না। যদি বিধুর আর সীমানা না থাকে?
সুমিতের প্রশ্ন আর প্রসঙ্গে আকস্মিকতায় অদ্রি অবাক-নির্বাক হয়—কী বলছিস এসব। পাগল। চল, চল, বাসায় যেতে হবে। বিধুর বাসার আসার সময় হইছে। না পাইলে আম্মাকে কল দেবে।
সুমিত ইচ্ছে করলেও দেরি করতে পারছে না। মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় ক্যান্টনমেন্ট প্রহরীদের এলান—রাত আটটার মধ্যে বহিরাগতরা ডিওএইচএস ছাড়ুন। এরপর কাউকে পাওয়া গেলে বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্টোরি অব অদ্রি-সুমিত
শাহজাহানপুর সরকারি কলোনিতে অদ্রিকে রাত সাড়ে আটটায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় সুমিত অর্ক। তখনই ওর ফোনে মেসেজ আসে এক গোয়েন্দাকর্মকর্তার। এনি টাইম উইল আর্মি ক্যু। প্লিজ বি সেইফ। মেসেজের কাছাকাছি সময়েই সীমানার কল।কোথায় আছ তুমি? সিরিয়াল তো গেল, আজকে আমার পার্ট। কি সুন্দর লেগেছে আজকের এপিসোডে! দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না।
আসছি—বলেই ফোনের লাইন কেটে দিয়ে লাস্ট এডিশন ধরাতে অফিসের দিকে গাড়ি ছোটায় সুমিত অর্ক। শাহজাহানপুরের সড়ক ছেড়ে মালিবাগ মোড়ে আসতেই গাঢ় সবুজ ট্যাংকগুলোকে উল্টোপথে যেতে দেখে সুমিত। সুমিতের মাথায় ঘুরতে থাকে শিরোনাম—রাজধানীতে মধ্যরাতের ফেরেশতা।