নয়টার কাছাকাছি। এক মধ্যবয়সী দম্পতি আমানত শা’র মাজারে এসে পৌঁছোয়। ভদ্রমহিলার পরনে তাঁতের নীলাভ শাড়ি―মাথা, বাহু, হাত ঢাকা। ভদ্রলোক সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা―মাজারের এতিমখানার খাদেম জাফর হুজুর তাঁদের দেখে এগিয়ে আসেন; সালাম দেন।
হুজুর তাঁদের খাস কামরায় নিয়ে যান।
বলুন, কেমন আছেন? আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?
হুজুর আমরা বাঁশখালী-নাপোড়া থেকে এসেছি। একটি বিশেষ অনুরোধ আছে আমাদের।
বলুন, আমি আপনাদের কী খেদমত করতে পারি? ভাই বলুন।
আপনি অনুমতি দিলে আমরা এই এতিম শিশুদের এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে চাই।
আলহামদুলিল্লাহ। আমি ব্যবস্থা করছি, বলে তিনি মৃদু হাসেন; আর ডান হাত গোঁফ বরাবর তুলে কাঁচা পাকা দাড়ির ওপর কয়েক বার বোলান।
তসবিহর দানাগুলো সাদা আঙুরের মতো জ্বলছে টেবিলের ওপর। বলপেনটি হাতে নেন তিনি। এতিমখানার ছাত্রশিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা গোনেন―পাঁচ আঙুলের দাগে বুড়ো আঙুল রেখে রেখে―একশত এগার জন। ড্রয়ার টেনে দুটি মেন্যু বের করে দেখান―সাশ্রয়ী ও শৌখিন। কোনো একটি বেছে নিতে বলেন। দুজন কর্মচারী নিয়ে তাঁরা রিয়াজুদ্দিন বাজারে পাঠান। খাবার দাবারের ব্যবস্থা করেন। তাঁরা আপ্যায়ন পর্ব শেষে মেজোভাই মৌলানা নুরুল ইসলামের জন্যে দোয়া চান। আজ তাঁর চল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। মুনাজাতে তাঁরাও হাত ওঠান; শরিক হন। দোয়া শেষে দুজনেই হুজুরের সামনে দাঁড়ালেন; হুজুর, বেয়াদবি মাফ করবেন―আমরা অমুসলিম। আমি দিলীপ কুমার দে ও শশীরানি―আমার স্ত্রী।
দুই.
নুরুল ইসলাম মায়াবিবির একমাত্র সন্তান। আশে-পাশের কয়েকটি গ্রামে তিনি ‘মেজোভাই’ হিসেবে বেশি পরিচিত। গ্রামের মুরুব্বি মামা আবদুল কাদির তাঁর ছেলেমেয়েদের নুরুকে ‘মেজো ভাই’ বলে ডাকতে শেখান। এই সূত্র ধরে গ্রামের হিন্দুদের অনেকেই তাঁকে ‘মেজ দা’ বলেই ডাকেন। নুরুর জন্মের তের দিনের মাথায় বাবা মৌলানা শফিকুল্লাহ মারা যান। মামা আবদুল কাদির নিজ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাকেও ‘মানুষ’ করার দায়িত্ব নেন। পাড়ার মকতব শেষ করে নুরু যখন ষোলশহর সুন্নিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়, তখন তার দুই মামাতো ভাইসহ পাড়ার কেউ-কেউ মহসিন কলেজে আসতে শুরু করেছে―সাধন মুহুরিও তখন একই মহল্লায় মামার বাসায় থেকে কলেজে পড়েন; আর প্রতিবেশী শিশু দিলীপকে অঙ্ক-ইংরেজি পড়ায়। স্বল্পভাষী সাধন খুব সহজে নুরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নুরুর বাবা নেই, তাঁকে সে দেখেনি―মামার বাড়িতে আশ্রিতা তার মা। কুরআন, হাদিস ও আরবির পাশাপাশি বাংলা-ইংরেজির প্রতিও তার আগ্রহ জন্মে―বন্ধু সাধনের সাহচর্যে। সে ফাজিল শ্রেণীতে উর্দুর বদলে ইংরেজি নেয়। মামা ব্যাপারটি মেনে নিতে পারে না। কুরআন হাদিসের সঙ্গে বাংলা ইংরেজি পড়ে যদি ছেলে দ্বীনের খাদেম হতে পারে তাতে মায়ের আপত্তি নেই; আপত্তিটা মামার। নুরুকে র্উদু-ফারসিও পড়তে হবে। তার আধুনিক শিক্ষার দরকার নেই।
খন্দকার রমিজুদ্দি বেশ আছে। মসজিদে যায়―আজান দেয়। মকতবে ছেলেমেয়েদের আরবি পড়ায়; নামাজ-কালাম, দোয়া-দরুদ শেখায়। তালেব মেম্বারের বাড়িতে খায়; দেউড়িতে ঘুমায়। কখনো-সখনো কেউ ডাক পাড়লে গৃহস্থের বাড়ি যায়―বিপদে-আপদে দোয়াপড়া দেয়, পানিপড়া দেয়, তাবিজতুমার করে। জিনপরির আছর, ভূতের ভয় তাড়ায়―সোলেমানি চিকিৎসায় তাঁর প্রসার পরিচিতি গ্রাম জুড়ে। সে বাংলা জানে না। উর্দু বলতে পারে। মাথায় পাগড়ি চেপে লম্বা কুর্তা পরে যখন পাড়া-পাড়া গলিতে গলিতে হাঁটে ছেলে বুড়ো সবাই তাকে বেশ কদর করে। সালাম করে মুলাকাত করেন। তখন তার বেশ ভালো লাগে। স্কুলমুখো ছেলেমেয়েগুলো ভালো লাগে না―মৌলানা নুরুল ইসলামকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। সে বলে বেড়ায়― দাড়ি রাখলে কেউ আলেম হয় না―নুরুল ইসলাম হক্কানি আলেম নয়; একজন মডার্ন মৌলানা। সে ইংরেজি কাগজ পড়ে, হিন্দু-বৌদ্ধদের সঙ্গে বসে আড্ডা মারে। তাই সে প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি যায়, দ্বীনের দাওয়াত দেয়―ইমান আকিদার বয়ান করে। তখন তার দিলের ভেতর ইমানের রোশনাই ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
নুরুল ইসলাম জানতে পারেন মুসাদ্দিকাকে স্কুলে সবাই মিতা বলেই ডাকছে। প্রথমে তা শশীর মুখে শোনেন; এটি মা ছেলেকে জানালেও নুরুল ইসলাম তা তেমন আমলে নেননি। তিনি মেয়েকে প্রাইমারি শেষে কেন হাইস্কুলে পাঠিয়েছেন এলাকায় তা অনেকের বেদনার কারণ। মিতু মায়ের তদারকি ও ভালোবাসায় বেশ এগিয়েছে―শিক্ষকদের স্নেহ আর স্বীকৃতি তাকে বেশ অনুরাগী করে তুলেছে।
তিন.
কয়েক মাস ধরে এক অচেনা আতঙ্কে বানিয়াকাটা কাঁপছে। কাঁপছে পাশের আরো দুই গ্রাম―হরিয়ারছড়া ও পুঁইছড়া। হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রাম দুটোয় কয়েক শত নারীপুরুষের বসবাস। এই তিন গ্রামের মানুষ সবাই একই বাজারে সকালসন্ধ্যা কেনাকাটা করে, একই স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়লেখা করতে পাঠায় আবার একই ওয়ার্ডের ভোটার বলে মিলে মিশে মেম্বার-চেয়ারম্যান নির্বাচন করে। এমন কি তাঁদের ভোট কেন্দ্রও একটি। তবে ধর্ম তাঁদের আলাদা।
কিন্তু সতর্ক শশী কখনো তা মিতুকে বুঝতে দেয়নি। অন্যদিকে সে সরাসরি ভালোবাসার আকুতি জানিয়ে দিলীপবাবুকে চিঠি লিখে। মিতুই ছিল তরুণ দিলীপবাবুর পছন্দের শীর্ষে। সাধনমুহুরি তাঁর পাত্রী তালাশে পুরো তল্লাট যে চষে বেড়াচ্ছে তা হুজুরস্যারেরও অজানা নয়। স্কুল জীবনের গেল চার বছর এভাবেই কেটেছে― কখনো শশী, কখনো মিতা ফার্স্ট হয়েছে। শশীর মা, ও শশীর মা উড, তরাতরি উড। শশীরে ডাক। তরাতরি উড উষারানি সঙ্গে সঙ্গে উঠে মেয়ে শশীকে জাগায়, নিশিকে জাগায়।
পাড়ার বাড়িঘর দিনদিন পুরুষশূন্য হতে শুরু করেছে। শিশু, নারী আর বুড়োরা অনেকটা অনাথের মতো অপেক্ষায় থাকেন। কখন কী করতে হবে, কোথায় পালাতে হবে তা কেউ জানে না, বোঝে না। দেশের মানুষ এখন দুভাগে বিভক্ত― পাকিস্তানবাদী ও স্বাধীনতাপন্থী। পাকিস্তানপন্থীরা পাকজমিনের হক আদায়ে মরিয়া অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার শপথে মশগুল, ধর্ম তাঁদের প্রধান অস্ত্র; স্বাধীনতাপন্থীরা দেশের স্বাধীনতা চায় বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে-মন্ত্রে নিবেদিত; ‘জয় বাংলা’ তাঁদের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর এই ভেদরেখা আরো বিশাল হতে শুরু করেছে। মুসলিমলীগের পাকিস্তানপন্থী লোকজন পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে দালাল নিযুক্ত করেছে―প্রতিটি মানুষের ছায়ার সঙ্গে মিশে আছে এই টিকটিকির দল।
নুরুল ইসলাম মায়ের চিকিৎসার জন্যে জেলা সদরে ছিলেন―বাড়ি ফিরেন সন্ধ্যায়। বিষয়টি তিনি শুনে নির্বাক। বাবু গত নির্বাচনে তালেব মিয়ার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সৎ সাহসী নিপাট ভদ্রলোক নাথবাবু এলাকার হিন্দু মুসলমানদের দলাদলির ঊর্ধ্বে থাকেন। হিন্দুদের পাশাপাশি পাড়ার সাধারণ মুসলমানরাও তাঁকে পছন্দ করত। এটি তালেব মিয়া কখনো সহ্য করতে পারেননি। এই সুযোগে সে তাঁর চেলাচামুণ্ডা নিয়ে প্রেমনাথবাবুকে জবাই করে খুন করে―চিকচিকে রামদা হাতে খন্দকার রমিজুদ্দি তাঁর পেছন পেছন ছোটে। লাশটি কালিবাড়ির সামনে ফেলে রাখে। শেয়াল কুকুরের কামড়ে শরীরের হাড়মাংসের বিভিন্ন খণ্ড রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়; পচেগলে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে।
শশী আর মিতা তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। শশীর মা উষারানিও মিতার বাবার স্কুলছাত্রী ছিলেন। শশীর স্কুলে যাবার পথে মিতাদের বাড়ি―দুজনেই বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। বিএসসি স্যার দিলীপবাবু তাদের এক মাত্র ভরসা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে স্যার স্যার বলে মিতু হরহামেশা দিলীপ বাবুর পেছনে পেছনে ছুটোছুটি করছে―শশী কয়েকদিন ধরে বিষয়টি খেয়াল করছে; তেমন গায়ে মাখেনি। হঠাৎ মিতুর অঙ্ক খাতার পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে সে দেখে একটি বাক্য; ‘মিতু, তুমি এখন দিলীপ দিওয়ানা’। এইভাবে দুইবান্ধবী জড়িয়ে পড়ে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ― প্রণয়ে ও পাঠে। কিন্তু সতর্ক শশী কখনো তা মিতুকে বুঝতে দেয়নি। অন্যদিকে সে সরাসরি ভালোবাসার আকুতি জানিয়ে দিলীপবাবুকে চিঠি লিখে। মিতুই ছিল তরুণ দিলীপবাবুর পছন্দের শীর্ষে। সাধনমুহুরি তাঁর পাত্রী তালাশে পুরো তল্লাট যে চষে বেড়াচ্ছে তা হুজুরস্যারেরও অজানা নয়। স্কুল জীবনের গেল চার বছর এভাবেই কেটেছে― কখনো শশী, কখনো মিতা ফার্স্ট হয়েছে। শশীর মা, ও শশীর মা উড, তরাতরি উড। শশীরে ডাক। তরাতরি উড উষারানি সঙ্গে সঙ্গে উঠে মেয়ে শশীকে জাগায়, নিশিকে জাগায়।
মাঝ রাতে সাধন মুহুরির আচমকা ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গে তাঁদের। তাঁরা বুঝতে পারে আর নিস্তার নেই রেহাই নেই; এবার পালাতে হবে, কোথায় পালাবে কিভাবে পালাবে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না উষারানি। আরও দুজন আমবনের ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে হাশেম আর সিদ্দিক। সাধনমুহুরি হাশেমের হাতে শশীকে তুলে দেয়, এক কাপড়ে ভয়ে-উৎকণ্ঠায় নীল উষারানি নিশির হাত ধরে কাঁপছে, কাঁদছে। নিশি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী।
মৌলানা নুরুল ইসলাম বানিয়াকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ―হুজুর স্যার। এখন একমাত্র ভরসা। আশে পাশের কয়েকটি গ্রামের হিন্দু মুসলমান তাঁর বাড়িতে আসে; বুদ্ধিভরসা খোঁজে। ফজরের নামাজের আগে যখন পূর্ব দিগন্তে আলোর রেখা ফুটতে থাকে, তখনই তাঁর বাড়ির উঠানে, পুকুরের পাড়ে নানা বয়সের লোকজন অপেক্ষা করতে থাকে ―কৌতূহলী রমিজুদ্দির বিষয়টি সবার আগে চোখে পড়ে; সে তালেব মেম্বারকে বলে। মাঝে মাঝে আজনবি লোকজনও তাঁর কাছে আসে। এটি অনেকের জানা; তারপরও কেউ কিছু বলে না।
হাশেম মধ্যরাতে শশীকে নিয়ে বানিয়াকাটা আসেন। মায়াবিবি ওকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ ভরে গ্রহণ করেন এবং তাঁরা বিছানায় এক সঙ্গে ঘুমান; মিতু জানে না পাশে এখন কে শুয়ে আছে। প্রিয় স্কুলটি বন্ধ অনেক আগেই। শশীর পুরো শরীর এখনো কাঁপছে। মায়ের কথা মনে পড়ে; বারবার নিশির কথা মনে পড়ে। এক অনিশ্চিত আগামীর দিকে তারা ছুটে চলছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তাদের গ্রামেও। চেনাজানা এই মানুষগুলো হঠাৎ করে বদলে গেছে, এখন সবাই যেন শুধু মুসলমান ―মানুষ নয়। অনেকে মুসলমান হচ্ছে। মুসলমান হতে হয় প্রাণের ভয়ে অনিচ্ছায়। জীবনের চেয়ে ধর্ম বড় নয়। তাঁরা নাম বদলায়, দাড়ি রাখে, ‘কলেমা’ শেখে। কিন্তু হুজুর স্যার আগের মতোই একান্ত আপন, গভীর-গম্ভীর-চিন্তাশীল অন্যরকম মানুষ। সারারাত জেগে থাকেন ―রেডিওটি তাঁর নিত্যসঙ্গী, প্রিয় আকাশবাণী, প্রিয় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র। সে ভাবে দিলীপস্যার কি জানেন, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে? স্যারের সঙ্গে কি আর কখনো দেখা হবে না?
চার.
মায়াবিবির ঘুম আসে না। তাঁর মুনাজাত দিন দিন দীর্ঘ হতে থাকে। পুত্রবধূ মুহসিনার মুখখানি ধীরে ধীরে ম্লান হতে হতে শুকিয়ে যাচ্ছে। বেয়াই মুফতি সাহেব পাশের ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান; বেশ ব্যস্ত প্রতিদিন তিনি থানা অফিসে যান এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলার রিপোর্ট দেন, পরিবেশ পরিস্থিতি তদারকি করেন। আবার নুরুর বক্তব্য আলাদা, সে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখে শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার মূলমন্ত্র তাঁর হৃদয়ে; ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে তাঁর। এশার নামাজের পর ছেলেকে ডেকে একান্তে বসেন― নুরু, অফুত; আঁই খত খতা উনির। তোরে ত ইতারা ন রাখিব। মারি ফেলাইব।
না, মা। অনে ন ডরাইয়ন― আল্লা দিলে আঁর কিছু ন অইব। অনে একটু খাস দিলে দোয়া গইরগন। অনে ত জানন, আল্লা এত্তো জুলুম খুন, জালন-পোড়ন খ-ন দিন নশইব।
অফুত, আঁই বউর খাঁদানি, নাতির খাঁদানি আর শইত নফারির। তুই ইবার মা বাফরে খবর দে। ইবার একখান ব্যবস্থা গর। আঁত্তুন শরম লাগে ―খত জনে আজেবাজে খত খতা খয়।
―ঠিক আছে, মা। অনে ন ডরাইয়ন; আঁর ফোয়া-ছারে দোয়া গইরগন। আঁই একখান ব্যবস্থা গরির। দুই একখান দিন সময় দন।
এদিন্না রাহেলা খদ্দে তোর উয়র বলে তিন গুলির উকুম হইয়ে। মায়াবিবি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন― তাঁর এই কান্না আর থামে না।
নুরুল ইসলাম বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবেন। শশীকে কিভাবে অন্য কোথায় রাখা যায়। নিজে একজন আলেম বলে তাঁকে অনেকে সম্মান করেন, ভালোবাসেন; তাঁর কাছে শশী আশ্রয় নেবে এটা কেউ হয়তো ভাববে না। কিন্তু তাঁরও তো শত্রু আছে, আছে স্বাধীনতার শত্রু, দেশের শত্রু তিনিই শুধু জানেন শশীর বাবামা কোথায় লুকিয়ে আছেন। এখন হরিয়ারছড়া ও পুইছড়ার বাড়িঘরশূন্য সবাই জিনিসপত্র বড় বড় গর্ত খুঁড়ে কিছু মাটির নিচে আর কিছু পুকুরের তলায় লুকিয়ে রেখে পাহাড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে গ্রামগুলো ভস্মীভূত হয়ে যাবে।
গভীর রাত। জামগাছের ডালে হুতোম পেঁচাটি আজও ডাকছে এক অলক্ষুণে কণ্ঠে। একি কোনো পাখির ডাক, না আঁধার উপত্যকায় মৃত্যুর পদধ্বনি; পলে পলে প্রলম্বিত হচ্ছে নীল আতঙ্কের দীর্ঘ অপচ্ছায়া। ল্যাম্পের টিমটিমে আলোয় ভেজা চোখে মুহসিনা শশীকে বোরকা পরিয়ে দিচ্ছেন, শশীর ডান হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মায়াবিবি। এক পাথর মূর্তি যেন ঠায় দাঁড়িয়ে এই ছয় মাস সে বেশ নিরাপদে-নিভৃতে কাটিয়েছে এখানে। মিতু অস্ফুটস্বরে কাঁদছে; মাঝে মাঝে ঢুকরে উঠছে সে।
হুজুরস্যার পাড়ার দক্ষিণপ্রান্তের প্রবেশপথে একা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন। হাশেম ও সিদ্দিক শশীকে নিয়ে রাতের আঁধারে শাপলার বিল দিয়ে দ্রুত ছুটছেন। নদীরঘাটে সাধন মুহুরির হাতে তারা শশীকে তুলে দেবে দিলীপবাবু নৌকার গলুইয়ে বসে অপেক্ষা করছেন। নৌকা ছেড়ে দেয়― জোছনা মাখা চাঁদ চুয়ে চুয়ে নদীর ঢেউয়ে লুটিয়ে পড়ছে; রুপোলি জলের ধারা নীল নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ছলাত ছলাত স্বরে হাসিতে ফেটে পড়ছে।
পরদিন এশার নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন তিনি। ‘পাকিস্তান জিন্দবাদ’, ‘‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠছে; অদূরে পুঁইছড়ার কমলহরি মহাজনের বাড়িটি দাউদাউ করে জ্বলছে, জ্বলছে মাটি, জ্বলছে আকাশ। নারীপুরুষের আর্তনাদ―আগুনের কালো ধোঁয়ায় রাতের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। পেছনে হঠাৎ গুলির শব্দ, ―রক্তাক্ত শরীরে নুরুল ইসলাম মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নৌকোটি এখনও মাঝ দরিয়ায় অন্ধকারের নিকষ গহ্বরে উথালপাতাল ঢেউ ভেঙে ছুটছে। পূর্বদিগন্তে আলোক-উদ্ভাস এখনো অনেক দূর।