মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রতীকনির্ভর গল্প
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমাকেও লিখতে হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা যে সহজ কাজ নয়। অনেকটা ভয়ে ভয়ে লিখতে শুরু করি ‘তালগাছ ও দিব্যা ভারতী’ গল্পটি। এখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটা খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তবে এ গল্প বাস্তব কোনো ঘটনা থেকে নির্গত হয়নি। বলা যায়, পুরোটাই কল্পনা থেকে নেয়া। তারপরও কেন যেন মনে হয়, কোথাও না কোথাও এর বাস্তবতা লুকিয়ে আছে।
মূলত এটি প্রতীকনির্ভর একটি রহস্যগল্প। তালফল ও তালগাছের প্রতীকে অসুর বিনাশের একটা সুক্ষ্ম ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। সেইসঙ্গে গল্পের নায়ক আইনুদ্দিনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের সুপ্ত প্রতিভার কথা তুলে ধরা হয়েছে। স্থানবৈষম্যের বিষয় উঠে এসেছে। অনেকে হয়তো ভাববে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরাট ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ‘দিব্যা ভারতী’র নাম এলো কেন? ভারতীয় চলচ্চিত্রের নব্বই দশকের সুপারস্টার এ নায়িকার সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কী সম্পর্ক। এ প্রশ্নের জবাব আমি গল্পের ভেতরেই দিয়ে দিয়েছি।
গল্পটা শুরু করেছি ইসলামী মিথের ঐতিহাসিক একটা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তালগাছের তুলনা করে, যেমন,‘আসহাবে কাহাফের কুকুর বেহেস্তে যেতে পারলে তালগাছ বেহেস্তে যাবে না কেন?’ গল্পের শুরুতে এ ধরনের বাক্য কিছুটা খটকা লাগালেও পড়ার পর তা কেটে যাবে। আমাদের মাতৃভূমি যে বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছে, মুক্তিযুদ্ধ যে ব্যাপক ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী—সেটাই আমি গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি। সমাজের একজন সাধারণ মানুষও আমাদের সকল অর্জনের অংশিদার হতে পারে, সে বিষয়টা গল্পচ্ছলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া শকুন যে সবখানে, সব দেশে, সব সংস্কৃতিতে হিংস্র পাখি হিসেবে গণ্য হয় না, শকুনেরও যে ভালো দিক আছে; মানুষজাতি যে নিজেদের অপকর্মের দায় শকুনের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে—এ বিষয়টাও গল্পে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমার বিশ্বাস ‘তালগাছ ও দিব্যা ভারতী’ গল্পটির আবেদন আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে এখনও বিদ্যমান। বিশ্বচিত্রের দিকে নজর করলেও এ গল্প প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।
তালগাছ ও দিব্যা ভারতী ॥ রফিকুজ্জামান রণি
আসহাবে কাহাফের কুকুর বেহেস্তে যেতে পারলে তালগাছ বেহেস্তে যাবে না কেন?
এমনতর কথার ওপর কতক্ষণ তর্ক করা যায় কিন্তু সে তর্কে বিজয় অর্জন করা যায়। কেননা, আইনুদ্দিন খোঁড়া যুক্তি পছন্দ করেন না। কারো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে দালিলিক বা বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা খুঁজে না পেলে সুকৌশলে নিজেকে গুঁটিয়ে নেন তিনি, বিবাদমুখি বিতর্কে জড়ানোর আগে-আগেই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেন। কিন্তু নিজের মত ও পথ থেকে তিল পরিমাণও সরে দাঁড়ান না।
আইনুদ্দিন চাকলাদারের তালগাছপ্রীতির ঘটনা বহু আগেই রাষ্ট্র হয়ে গেছে। তার বাড়ির চারপাশ জুড়ে, আঙিনার আনাচে-কানাচে তালগাছ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো বৃক্ষলতার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বাড়ির পশ্চিম পাশে তিন কানি জমির ওপর বিশাল দীঘি, স্থানীয়দের ভাষায় আন্দি। সে আন্দি-দিঘির চতুরদিকে নজর করলে দেখা যায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। ছোট-বড়-মাঝারি হাজার কিসিমের তালগাছে ঘিরে রেখেছে মৎস্যবহুল মস্ত দিঘিটি। পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে, যেখানেই একটু ফাঁকা জায়গা পান, সেখানেই গেজ-ওঠা তালের বীচি একখান পুঁতে দিয়ে আসা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্যদেরও পরামর্শ দেন বেশি বেশি তালগাছ লাগাতে। এই একটি মাত্র গাছের দিকে আইনুদ্দিনের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই একরোখা যে, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে/ মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়, একেবারে উড়ে যায়, কোথা পাবে পাখা সে’—বোধকরি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে তার কর্মকাণ্ড দেখে হয়তো এ কবিতাখানি আরেকটু ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে লিখে বাধিত করতেন।
মজার বিষয় হলো, শত শত গাছের হাজার হাজার তালফল তিনি বাজারে বিক্রি করেন না। নিজেও খান না। বিলিয়ে দেন জনসাধারণের মাঝে। ধনিগরিব, বড়-ছোট, হিন্দু-মুসলিম সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এগুলো। গাছ থেকে কেউ তালের ফানা-ফাইর কেটে নিয়ে গেলেও রাগ-গোস্সা করেন না। ডাক-দোহাইও দেন না। গরমের মৌসুমে কচি কচি তালশাঁস খেতে প্রায় সব বয়েসী ছেলেপেলেরা আইনুদ্দিনের দরোজায় এসে হানা দেয়।
—অ..আনু চাচা, তালের লেপা খাওনের খুউব ইচ্ছা জাগছে। আমনের দুয়ারে ধন্না দিলাম তাই।
আইনুদ্দিন শব্দ করে হাসেন। প্রয়োজন ব্যতিত আঞ্চলিক ভাষাটা মুখ থেকে বের হয় না তার। অথচ মনে আনন্দফূর্তি জাগলে আঞ্চলিক ভাষাটাই আগে ব্যবহার করেন তিনি।
—আরে বাপজানেরা, গাছ তো তোমাগো লি¹াই রুইছি, এগিলা নিয়া তো আর কব্বরে যামু না। খাও খাও, যত মোন চায় খাও, তয় এম্নে কইয়া কইয়া খাইলেই ভাল্লাগে। অনেকে তো এট্টু জিগায়ও না। আমি কি কাউরে না করুম খাওনের লি¹া, কও ছে দেহি?
ভাদ্র মাস এলে আশেপাশে দিন রাত ধপাস ধপাস তাল পড়ার শব্দ শোনা যায়। দূরবর্তী মানুষজন আতংকিত হয়ে উঠলেও আইনুদ্দিনের এসব সয়ে গেছে। তার বরং ভালোই লাগে। কখনও কখনও গাছের গোড়ায় পাতিল-কালো তালফল পড়ে ভেংচি কেটে থাকলে মনে তার আনন্দ হয় ভীষণ। পরক্ষণেই মনটা আবার আর্দ্র হয়ে ওঠে অজানা কারণে। তখন কিছুটা দূর-মনা হয়ে পড়েন তিনি। বর্ষাজলে ছিটকে পড়া খয়েরি-কালো তালফল যখন শুশুকের মতো হাবুডুবু খায়, আইনুদ্দিনের খুব সুখ জাগে মনে—একই সঙ্গে চিকন একটা দুঃখবোধও হুল ফুটায় বাম বুকের কোণে। এসব তিনি কারো কাছে বলে বেড়ান না। নিজের ভেতরেই গচ্ছিত রাখেন।
আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে, বর্তমান যুগে মানুষ যখন আত্মপ্রচারে ব্যতিব্যস্ত। অর্থকড়ি ঢেলে, লবিং কারসাজি করে, ছলছাতুরির ফাঁদ পেতে নিজের সাধারণ কাজটা যখন প্রচারের গুণে অনেক বেশি অসাধারণ করে তুলবার ধান্ধায় মত্ত থাকে মানুষ, ঠিক সে যুগে এসে আইনুদ্দিন চাকলাদার সবার থেকে আলাদা। প্রচারবিমুখ তো বটে, এসব জিনিস তার বরং বিরক্তি বাড়ায়।
রসিয়ে আড্ডা দেওয়া, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি-দর্শন এবং বৈজ্ঞানিক বিষয়াশয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। অবশ্য পাড়াগাঁয়ে সে ধাঁচের মানুষজন খুঁজে পাওয়াটাও দুষ্কর। তবে সম্পর্ক যত ভালোই থাকুক, তালগাছ বিষয়ক প্রশ্ন সব সময় এড়িয়ে চলেন তিনি। এই একটা গোমর কারো কাছে ফাঁস করতে রাজি নন আইনুদ্দিন। সময় সময় এ-জাতীয় প্রশ্ন কেউ করে বসলেও তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। অন্যদিকে কথা ঘোরাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নানান কিসিমের গল্প-কথার ফুলঝুড়ি ফোটে মুখে।
এই তো কদিন আগের ঘটনা, শহর থেকে একদল ভদ্র-লোক এলো তার ডেরায়, হাতে বড় বড় ক্যামরা। ইতিপূর্বে লোকমুখে আইনুদ্দিনের অরণ্যপ্রতীম তালবাগানের প্রশংসা শুনেছে তারা। সরেজমিনে এসে, এ নিয়ে মিডিয়ায় বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছিলো লোকগুলো। আইনুদ্দিন যেন তাদের কথা শুনেও শোনেন না, দেখেও দেখেন না। তার এক কথা,—যত মন চায় ছবি তোলেন, ভিডিও করেন, ফল-টল পেড়ে খান, দরকার হয় জাল মেরে দিঘির মাছও ধরে নিয়ে যান কিন্তু তালগাছ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না। এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। আমি কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে এসব জোড়াইনি।
আইনুদ্দিনের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে তারা। তার কথা বলার ঢং, বুদ্ধির জোর, সাদামাটা চলাফেরা এবং উদার মন-মানসিকতা দেখে মুগ্ধ হয় তারা। সুযোগ পেলেই চারবন্ধু মিলে আইনুদ্দিনের বাড়িতে হাজির হয়।
তারপরও একরোখা টাইপের তরুণ এক সংবাদকর্মী তার মুখ থেকে কথা বের করতে খুব খাতির জমানোর চেষ্টা করলো। বিশেষ লাভ হলো না তাতে। কথার ফাঁকে অনেকটা আব্দার খাটিয়ে বলেছিলো সে:
—চাচাজি, আমরা আপনার সন্তানের মতো। সন্তানকে এড়িয়ে যাওয়া কি পিতা-মাতার সাজে?
—কই, আমি আপনাদের এড়িয়ে গেলাম কখন? আমি তো আপনাদের কাছেই আছি। বললাম তো, যতক্ষণ ইচ্ছে হয় এখানে থাকেন। আমার আপত্তি নেই। চা নাস্তার আয়োজনও আছে। প্রাণ-খুলে বাতাস নেন কেউ কিছু বলবে না।
—আসলে আপনার তালগাছপ্রীতি, পৃথিবীতে হাজার প্রজাতির গাছগাছালি থাকতে এই একটা মাত্র গাছের প্রতি সীমাহীন ঝোঁক আপনার, বিশাল তাল-সম্পদও জনস্বার্থে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, এসব আমরা শুনেছি। কিন্তু কেন, কোন কারণে এতটা তালগাছপ্রিয় মানুষ হয়ে ওঠলেন আপনি, দয়া করে একটু জানান, প্লিজ। জানালে খুব খুশি হবো আমরা।
—আমি কি আপনাদের খুশি কারানোর জন্যে পৃথিবীতে এসেছি?
—না চাচা, মানে…প্লিজ, বিষয়টা বাজেভাবে নেবেন না। আসলে অফিস থেকে এসাইনমেন্ট পেয়ে এসেছি তো, ফিরে গেলে অফিস আমাদের কাছে কৈফিয়ত চাইবে। তখন কী জবাব দেবো। প্লিজ…
—ও, তাই! আচ্ছা, ঠিক আছে অফিসে গিয়ে বলবেন যে, তালগাছ হচ্ছে এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন এক ধরনের উপকারী বৃক্ষ বিশেষ। এ গাছের ফলকে তাল বলা হয়। এরা এরিকাসি পরিবারভুক্ত বরাসুসগণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এরা সাধারণত নারী-পুরুষ উভয় জাতের হয়ে থাকে। এদের আদিবাস মধ্য আফ্রিকা। তালগাছ পাম গোত্রীয় বৃক্ষবিশেষ। তাল একটি উপকারী ফল, তাল দিয়ে চমৎকার পিঠা তৈরি হয়, তালের রস দিয়ে মিচরি তৈরি হয়, রস আবার নেশার কাজও করে ভালো, তালগাছের গোড়ার অংশ দিয়ে কোষা নৌকা বা কোন্দা নৌকা বানানো হয়। তালগাছের কাণ্ড-পাতা-ডোঙা-বাগ্গা জ্বালানির জন্য বেশ উপকারি, কৃষাণিরা কাতাও বানায়। গ্রাম-গঞ্জে টিনের ঘর, সেমিপাকা বাড়ি তৈরিতে তালগাছের শক্ত টেকসই কাঠের ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়, কাঁচাঘর তৈরিতেও খড়ের বিকল্প হিসেবে দরিদ্র পরিবারগুলো তালপাতা ব্যবহার করে থাকে। তালপাতা দিয়ে হাতপাখা বানানো হয়, সুন্দর বাঁশিও হয়। তালগাছে বাবুই পাখি বাসা বেঁধে সংসার পাতে এবং তালগাছ প্রকৃতিকে বজ্রপাতের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা করে। মানুষকে নিরাপত্তা দেয়। তাছাড়া তালের বাড়া থেকে যে ফোস্কা বের হয় তা দিয়ে খাটা রান্না করে খাওয়া যায়, বিয়ে বাড়িতেও এ ধরনের খাবার খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিলো এককালে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
—চাচাজান, এসব মুখস্থ রচনা আমরা সবাই কমবেশি জানি, অফিসও জানে। কিন্তু আমরা মূলত জানতে এসেছি আপনার এই গাছটার প্রতি বিশেষ দুর্বলতার কারণ? কেন এই গাছ নিয়ে আপনার এত বেশি আগ্রহ? অন্য গাছ নিয়ে কেন নয়? তালগাছ ছাড়া অন্য গাছ কেন আপনার এখানে জন্মাতে দেন না।
—আপনার নামটা কী যেন বললেন?
—মিথেন বড়ুয়া।
—মনে কিছু নিবেন না, আপনি তো বৌদ্ধধর্মের মানুষ তাই না?
—জি।
—আপনি কি জানেন, আপনাদের ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ ত্রিপিটকভুক্ত মহামুনি গৌতম বুদ্ধের মূল্যবান বাণীগুলো সর্বপ্রথম কোথায় এবং কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো?
—এসব নিয়ে অনেক মতবাদ শোনা যায়।
—কোনো মতবাদ শোনা যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে কি কোনো কাগজ-কলম ছিলো?
—না, তখন এগুলো অনাবিষ্কৃত ছিলো।
—পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধধর্মের মহাগ্রন্থ ত্রিপিটক যে সর্বপ্রথম লেখা হয়েছিলো তালপাতার বুকে, সেটা কি জানেন?
—জি, শুনেছি।
—তখন তো কাগজ-কলম আবিষ্কার হয়নি। গৌতম বুদ্ধের মূল্যবান কথাগুলো হারিয়ে যাবার ভয়ে অনুরাধাপুরের রাজা ভালগম্বা মহোদয় উদ্যোগ নিয়ে প্রবীণ এবং বিশ^াসযোগ্য ভিক্ষুদের মুখে শোনা ত্রিপিটকের বাণীগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন তালপাতায় লিখে। এখন তা সময়ের বিবর্তনে বইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এবার বলুন, তালগাছ কি শুধু আমিই ভালোবাসি, আমিই কদর করি? হাজার হাজার বছর আগের মুনিঋষিরা কি তালগাছ ভালোবাসেননি? অন্য গাছের পাতায় লিখেছিলেন ত্রিপিটক?
—বুঝেছি চাচা, আপনার সঙ্গে কথায় পারা যাবে না। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া আপনাকে ধরা যাবে না। আজ বরং আসি? অন্যদিন কথা হবে। তখন কিন্তু আপনাকে ছাড়বো না। হুম, হা হা।
এভাবেই একের পর এক মানুষ বশ মানে আইনুদ্দিনের কাছে। চেহারা-সুরত এবং চলাফেরা দেখলে মনেই হবে না এই লোক এতটা বাকপটু, এতটা প্রাজ্ঞ। কেবল নাড়া দিলেই বেজে ওঠেন আপন মহিমায়!
দুই.
লোক-সমাগম বাড়তে থাকায় এবং বড় বড় ব্যক্তিবর্গের পদচারণায় এলাকাটা মুখরিত হয়ে উঠায় স্থানীয়দের কাছে আইনুদ্দিনের গুরুত্ব বেড়ে যায়। আগে তাকে সাধারণ মানুষ মনে হলেও এখন মনে হয় লোকটা আসলেই অসাধারণ কোনো কাজ করে বসে আছেন। নইলে দূরদূরান্ত থেকে এত মানুষজন এখানে ছুটে আসবে কেন। যে ফুলে মধু থাকে সে ফুলের দিকেই ছুটে যায় মৌমাছি। সুতরাং নিজেদের প্রয়োজনেই, অজানাকে জানার তাগিদেই একসময় প্রগতিশীল চিন্তাধারাসম্পন্ন তরুণ শিক্ষার্থীর দল আইনুদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে শুরু করে। তার কাছে ঘেঁষতে শুরু করে। ছোট-বড় ভেদবিচার না করে সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন আইনুদ্দিন। ভালো কাগজে দেন উৎসাহ। যার ফলে অল্পদিনেই—অন্তু, গণেশ, সিফাত এবং মহিনের মতো কজন অন্ধভক্ত জুটে যায় তার। আইনুদ্দিনের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে তারা। তার কথা বলার ঢং, বুদ্ধির জোর, সাদামাটা চলাফেরা এবং উদার মন-মানসিকতা দেখে মুগ্ধ হয় তারা। সুযোগ পেলেই চারবন্ধু মিলে আইনুদ্দিনের বাড়িতে হাজির হয়। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, সম্পর্ক গাঢ় হয়। কখনো কখনো বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি আঙিনায় বসে আড্ডাও হয়। কথা হয় বিচিত্র সব বিষয়াশয় নিয়ে। পাড়াগাঁয়ের বয়স্ক আইনুদ্দিনের মেধাশক্তি এবং পঠনপাঠনের বহর-পরিধি দেখে বিস্মিত হয় তারা।
আইনুদ্দিনকে ঘিরে একবার উঠোনে চেয়ার পেতে আড্ডা দিচ্ছিলো তারা। আইনুদ্দিনের স্ত্রী সুরাইয়া খানম রোজকার মতো এবারও ট্রে পেতে চা-বিস্কুট, পিঠা-সেমাই দিয়ে যান। আবেগ সংবরণ করতে না পেরে কথার ফাঁকে অন্তু তো একবার বলেই বসলো:
—চাচাজি, আপনাকে দেখে সত্যিই অবাক হই। আপনার জানাশোনা, বলবার ধরন এবং যুক্তি-ব্যাখ্যা সবকিছু কেমন মুগ্ধ করে রাখে আমাদের। গাঁও-গেরামে পড়ে থেকে এত কিছু যে কিভাবে শিখলেন! গ্রামে বসবাস করেও যে এতটা সু-বিদ্যা অর্জন করা যায়, বিশ্বাসই হয় না।
—কী যে বলো বাবা, আমি আর কী জানি? কত বড় বড় জ্ঞানী-গুণী মানুষ যে চোখের অগোচরে পৃথিবীতে পড়ে আছেন, তাদের কাছে সমুদ্রের এক ফোঁটা পানিও না আমি। তবে মনে রেখো কিছু জানতে হলে যে কেবল শহরেই যেতে হয়, এটা কিন্তু ভুল ধারণা, গ্রামেও জ্ঞানী লোক থাকে, শহরেও মূর্খ লোক বাস করে। বিদ্যাদেবী সরস্বতী শহর-গেরাম সবখানেই যেতে পারেন টিকেট-বিমান ছাড়া, তাঁর গাড়ি ভাড়াও লাগে না, হা হা।
বিস্কুটে কামড় বসিয়ে সিফত বললো:
—চাচাজান যে কী বলেন, আমি জীবনেও আপনার মতো গুণী মানুষ চোখে দেখি নাই।
—তোমার বয়স আর কতই বা হবে বাপু, মাত্র তো দেখা শুরু, সামনে কত কত জিনিস পড়ে আছে। তখন দেখবে। এই চাচার জ্ঞানটুকু একেবারেই তুচ্ছ মনে হবে তখন। চলো, আজ একটা চমৎকার জিনিস দেখাবো তোমাদের। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত জিনিস। এতদিন কাউকে দেখাইনি।
—কী?
—আরে গেলেই তো দেখতে পাবে। চলো…
আধাপাকা ঘরের ভেতর দিয়ে আইনুদ্দিনকে অনুসরণ করে এগোতে লাগলো তারা। আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে ঘরের শেষপ্রান্তে, বড় একটি কক্ষে প্রবেশ করলো সবাই। বাতি জ্বালানোর পর হা করে তাকিয়ে রইলো তারা—একি! এ যে সাধারণ কোনো রুম নয়, বড়সড়ো একটা লাইব্রেরি! তাকভর্তি বই আর বই। শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, আইন, ধর্ম ও চিকিৎসাশাস্ত্র কী নেই এখানে! বইয়ে বইয়ে ঠাসা কক্ষটি চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। সাধারণ একজন মানুষ আইনুদ্দিন কিন্তু ঘরের ভেতরে অসাধারণ সব বইপত্র! এ যে রীতিমতো অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার! দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আরও বেশি অবাক হতে হলো। দেওয়ালের একপাশে বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী-দার্শনিকের ছবি ঝোলানো, বাকি তিনপাশে কেবল ভারতের অকালপ্রয়াত নায়িকা দিব্যা ভারতির ছবি সাঁটানো! উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে দেওয়ালের তিনপাশে ঝুলে আছে এক সময়ের হিন্দি চলচ্চিত্রের এই খ্যাতিমান তারকা, চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। এত বছর পরও তার চেহারার লাবণ্যপ্রভা ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে পুরো রুমটিতে।
আমি হাসলাম, তারপরও অভিমানের সুরে বললাম, এত পাগলামোর মানে কী? তুমি ওই টিভির মেয়েটার জন্যে এত উতলা কেন? ওর জন্যেই যদি পাগল হলে, আমারে ঘরে আনলে কেন?
জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকদের পাশে দিব্যা ভারতিকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে টানিয়ে রাখার বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না গণেশ। বুড়ো বয়েসে তরুণী নায়িকার প্রতি আইনুদ্দিনের এমন বাড়াবাড়ি তাকে হতবাক করেছে। আইনুদ্দিনের তীক্ষ্ম মেধার জৌলস, অপার বিচারবুদ্ধির জোর এই নিচু মানের রুচিটুকু যেন একেবারেই ক্ষীণ করে দিয়েছে। তিনি কি জানেন না দিব্যা ভারতি অনেক আগেই গত হয়েছেন? এখন আর পৃথিবীতে নাই এ সুন্দরী নারীটি? কৌশলে গণেশ প্রশ্ন করে বসলো।
—চাচা, দুনিয়ার বড়-বড় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে দিব্যা ভারতির ছবি এভাবে টানিয়ে রাখার মানে বুঝলাম না? বিষয়টা কেমন হালকা হয়ে গেলো না? আর কোনো নায়ক-নায়িকার ছবিও তো এখানে দেখছি না।
—কেন? তোমার কাছে কি দিব্যা ভারতিকে ছোট মনে হয়? মাত্র ১৯ বছর বেঁচেছিল এটাই কি তার দোষ?
—না না চাচা, বলছিলাম যে, একপাশে পৃথিবীর সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি। আর বাকি তিনপাশেই কেবল দিব্যা ভারতির ছবি। বিষয়টা খুব ভাবিয়ে তুলছে আমাকে।
—দিব্যাকে আমার ভালো লাগে, তাই রাখলাম।
সজোরে হেসে ওঠলো সবাই। পরস্পর চোখ টিপাটিপি শুরু করলো। বিব্রত হলেন আইনুদ্দিন। লজ্জাও পেলে বৈকি।
—আসলে তোমরা যেই ভালোলাগার কথা চিন্তা করো সে রকম কোনো ভালোলাগা নয়। ওর অভিনয় খুব ভালো লাগতো, বেশিদিন করতে পারেনি অভিনয়, তিন বছরেরও কম সময় সুযোগ পেয়েছে কাজ করার, তারপরও মানুষের মনে গেঁথে আছে মেয়েটা। মৃত্যুর প্রায় আড়াই যুগ পার হয়ে গেলো, মানুষ তাকে মনে রেখেছে এখনো। কতটা সফল অভিনয়শিল্পী হলে এমন হতে পারে—একবার চিন্তা করে দেখো? মূলত দিব্যা হাসিটাই আমাকে বেশি মুগ্ধ করে। জুহি চাওলা, শ্রীদেবী কিংবা মাধুরী দীক্ষিতের হাসিও আমাকে এত বেশি টানে না। যদিও মকবুল ফিদার মতো জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মাধুরীর হাসিকেই মোনালিসার হাসির চেয়ে বেশি সুন্দর দাবি করেছেন কিন্তু আমার মনে হয় দিব্যা ভারতির হাসিটাই মোনালিসার চেয়ে বেশি সুন্দর, এমনকি মাধুরীর চেয়েও…
একমনে কথাগুলো বলতে বলতে আইনুদ্দিনের মুখটা বিপন্ন হয়ে উঠলো। খেয়াল করলো মহিন।
—আসলে চাচা, আমরা স্যরি। বুঝতে পারিনি। মনে কিছু নেবেন না, প্লিজ।
—জানো মহিন? দিব্যা জীবনে সবচেয়ে বড় বোকামি করেছে ধর্মত্যাগ করে। স্রষ্টা হিন্দু করে পাঠালেন, ধর্ম ত্যাগ করে হলো মুসলিম। স্রষ্টা কি তার চেয়ে কম বোঝেন? লাভ হলো কী, আবেগে মুসলিম হয়ে বিয়ের ১১ মাসের মাথায় আত্মহত্যা! ধর্ম ছাড়লো, লাল পানি খাওয়া ছাড়লো না। অকালেই ঝরে গেলো বিরল এক প্রতিভা। খুব মন খারাপ হয় মেয়েটার জন্যে।
গণেশ কিঞ্চিৎ প্রতিবাদী হয়।
—দিব্যা আত্মহত্যা করেনি চাচা। তাকে খুন করে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে। সব দোষ তার স্বামী সাজিদ নাদিওয়ালার।
মহিন: না না, দিব্যা অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে টাল সামলাতে না পেরে বারান্দা থেকে ছিটকে পড়ে মারা যায়। কেউ তাকে হত্যা করেনি। সে নিজেও আত্মহত্যা করেনি। স্রেফ দুর্ঘটনা ছিলো ওটা। নতুন বাড়ি কেনার আনন্দ তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলো সে রাতে।
আইনুদ্দিন: সে যাই হোক, জীবননান্দ দাশ তো কবেই বলেছেন—আকাশের আড়ালে আকাশ থাকে। হয়তো তাই হবে। তার মৃত্যুটা হয়তো সে রকমই একটা কিছু হবে। আমরা যা শুনি, যা দেখি তার বাইরেও অনেক কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। আমাদের বাংলাদেশের সালমান শাহকে নিয়েও কি কম ঘোলা হয়েছে জল?
দরোজার মধ্যভাগে একটা শকুনের ছবি আঁকা, তার পাশে লেখা ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ/ ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা’—দেখে চমকে ওঠে অন্তু। বিদগ্ধ একজন মানুষ শকুন আর বকের পার্থক্য বোঝেন না? বিষয়টা অবাক করার মতো তো! তাছাড়া শত-শত মনীষীর অসাধারণ বাণী-উদ্বৃতি জানার পরও সাধারণ শিশুতোষ একটা ছড়াকবিতার লাইন ঝুলিয়ে রাখলেন তিনি, মানে কী? বিষয়টা ধোঁয়াশার মতো ঠেকলো। অন্তু জানে তালগাছ ছাড়া পৃথিবীর যাবতীয় সব প্রশ্ন করলে অনায়সে উত্তর দেয় আইনুদ্দিন। কিন্তু তালগাছের রহস্য-ভেদের আগ্রহটাই যে সবচেয়ে বেশি তার। বন্ধুবৎসল মুহূর্তটিকে সে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো হঠাৎ।
—আচ্ছা চাচা, আমরা তো আপনার দূরের কেউ নই। আপনার তালগাছের ইতিহাসটা আমাদের কাছে বলতে আপত্তি কোথায়? কেন আপনি এই গাছটাকে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, জানলে আমরাও না হয় গাছ লাগানোর কর্মসূচি হাতে নিতাম।
—তুমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, এটা কী বলে পারো?
—পড়ার কক্ষ, অবশ্য পাঠাগারও বলা চলে।
—বলতে পারবে আমাদের বাংলা সাহিত্যের আদি নির্দশন কী?
—চর্যাপদ। চর্যাপদের আগে কোনো বাংলা সাহিত্যের নির্ভরযোগ্য অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
—চর্যাগীতি কিসের মধ্যে লেখা হয়েছে জানো?
—না, মানে, মানে হলো গিয়ে…
—তালপাতা, আরে তখন তো এমন বই-পুস্তকের যুগ ছিল না। তাই তালপাতায় লেখা হয়েছিল এসব পুঁথি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিন-তিনবার চেষ্টা করে নেপালের রাজসভার গ্রন্থাগার থেকে ১৯০৭ সালে চর্যাপদ নামের সেই মুনিদত্তের পুঁথিগুলো আবিষ্কার করেন। প্রায় হাজার বছর আগে লেখা হয় পদগুলো। তখন কাগজ-কলম ছিল না বলেই তালপাতায় লেখা হয়েছিল। এবার তুমিই বলো, তালগাছের প্রতি আমার আগে কাদের দরদ বেশি ছিল? হাজার বছর আগের মানুষও যে তালগাছ এবং তালপাতা ভালোবাস তো সেটা নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নাই কিন্তু আমি বাসতে গেলেই যত কৈফিয়ত শুনতে হয়!
চুপসে যায় অন্তু। ধারণা ছিলো এই যাত্রায় উত্তরটা পেয়েই যাবে। ধুর, এই লোকের সঙ্গে তর্ক করাই বৃথা। হার মানা ছাড়া গতি নাই। লোকটা যে কী দিয়ে গড়া!
—বুঝলা ভাস্তেগণ, আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত আমাদের জাতীয় পাখির নাম রাখতাম শকুন, দোয়েলের মতো নিরীহ গোছের একটি ভীতু জীব জাতীয় পাখির মর্যাদা পাওয়া যোগ্যতা আছে বলে আমার মনে হয় না।
আইনুদ্দিনের কথায় চমক ভাঙলো সবার। প্রায় সমবেত সুরে।
—কী বলেন চাচা! শকুন তো হিংস্র পাখি। এটাকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়া কি ঠিক?
—কেন ঠিক নয়? মানুষ কিন্তু শকুনের চেয়েও হিংস্র, সুতরাং হিংস্র জিনিসকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শকুনের চেয়ে বেশি মানুষই মানুষের রক্ত-মাংস খায়। শকুনেরটা দেখা যায়, মানুষেরটা দেখা যায় না। তাছাড়া তিব্বতিরা যে যে মারা গেলে মৃতদেহ কেটে শকুনকে খাইয়ে দেয় এটা জানো? তারা কিন্তু শকুনকে খারাপ চোখে দেখে না। তারা বরং দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রাণি মনে করে শকুনকে।
আচানক এক নীরবতা নেমে এলো ঘরে। কারও মুখ থেকে একরত্তি কথা বেরোয় না। বলবেই বা কী? যে ব্যক্তি বুড়ো বয়েসে দিব্যা ভারতিকে চেনেন, জুহি চাওলার সিনেমা দেখেন, শ্রীদেবীকে জানেন এবং মাধুরী দীক্ষিত সম্পর্কে ভালোমন্দ খোঁজ-খবর রাখেন তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বা তর্ক করা অত সহজ কাজ নয়। সুতরাং চুপ থাকা ছাড়া উপায় কই? নীরবতা ভাঙলো আইনুদ্দিন নিজেই।
—ভাস্তেগণ, এই পাঠাগার আজ থেকে তোমাদের জন্যে খুলে দিলাম। শুধু তোমরাই এখানে ঢোকার অনুমতি পাবে। বিষয়টা অন্যদের বলা যাবে না। মানুষ জানলে এটা নিয়েও খোঁচাখুঁচি শুরু করবে। যখন যে বই মন চায় নিয়ে পড়বে, পড়া শেষে ফেরত দিতে হবে কিন্তু। বেঁচে থাকলে আমার মায়ের নামে এই এলাকায় বড় একটি পাঠাগার দেবো। দেশ-বিদেশের অনেক মূল্যবান বইপত্র রাখবো সেখানে। সেটা সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দেবো। আপাতত এটা শুধু তোমাদের জন্যেই অবারিত করে দিলাম।
সংবাদটা অতীব আনন্দের। এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!
তিন.
খবরটা গণেশই পেয়েছিলো আগে। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। চারবন্ধু একজোট হয়ে ছুটলো আইনুদ্দিনের বাড়ি। কোনো রকম অসুখবিসুখ ছাড়া, সামান্য বুক-ব্যথা উঠে মরে গেলো আইনুদ্দিন! এলাকায় এ নিয়ে তোলপাড় পড়ে গেলো। তরতাজা একজন মানুষ হুট করে মরে গেলো! রহস্যমানব আইনুদ্দিনের মৃত্যুটাও যে রহস্যের চাদরে ঢাকা পড়ে গেলো।
আইনুদ্দিনের মৃত্যুতে অন্য সবার চেয়ে তরুণ চারবন্ধুই মর্মাহত হলো বেশি। অল্পদিনে খুব আপন হয়ে উঠেছিলেন লোকটা। ছিলেন বিশাল মনের অধিকারী, সদালাপি ও নিরংকারী। পাড়াপড়শিরা তাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে না পারলেও চারবন্ধু ঠিকই চিনতে পেরেছে আইনুদ্দিন যে কী জিনিস। দুদিন আগেও রসিয়ে আড্ডা দেওয়ার লোকটা নাই হয়ে গেলো হঠাৎ, এ যে মেনে নেয় কঠিন!
সুরাইয়া খানম দিনরাত স্বামীশোকে বিলাপ করে মরেন। ছেলেপেলেও নাই যে দেখাশোনা করবে। ফলে নতুন করে আবার তারা আইনুদ্দিনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে। অল্পদিনে আবার মধুচক্র গড়ে ওঠে। আড্ডা হয় সুরাইয়া খানমের সঙ্গে। আবারও প্রাণ ফিরে পায় তারা। কারণ, সুরাইয়া খানম সাধারণ কোনো মহিলা নন, তারও জানাশোনার জগত অনেক বিশাল। আইনুদ্দিনের সেবায় জীবন কাটিয়ে দেওয়ায় এই নেপথ্যচারিণীর বিদ্যাবুদ্ধির হদিস অতলেই ঢাকা পড়েছিলো এতদিন। আপাতদৃষ্টিতে তাকালে মনেই হবে না খুব বেশি শিক্ষাদিক্ষার আলো পড়ছে তার ভেতরে। অথচ আইনুদ্দিনের মৃত্যুর পর জানা গেলো সুরাইয়া খানমের প্রেরণাতেই সিনেমাপাগল আইনুদ্দিন বইয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। বই কিনে কিনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভাগাভাগি করে পড়তেন। সুরাইয়া খানমের পীড়াপিড়িতেই মূলত এ ঘরে বইপত্র ঢোকা শুরু হয়।
সান্ধ্যাকালীন এক আসরে সুরাইয়া খানমকে প্রশ্ন করলো সিফাত:
—চাচিমা, তালগাছের বাতিক সম্পর্কে কি কখনো জিজ্ঞেস করেছিলেন আনু চাচাকে? কিছু বলেছেন আপনাকে এ বিষয়ে?
—সে অনেক বড় ঘটনা বাপু। শুনলে অবাক হবে। হয়তো বিশ্বাসও করবে না। অনেক খোঁচাখুঁচির পর মুখ দিয়ে কথা বের করিয়েছিলাম। বলতে পারো যে, সংসার টেকানোর জন্যে এক প্রকার বাধ্য হয়েছিলেন বলতে।
—মানে? এখানে আবার সংসারের সম্পর্ক কী?
—আছে আছ। বিয়ের পর, প্রথম প্রথম দেখি দিব্যা ভারতির ছবি টানিয়ে পুরো ঘর একাকার করে রেখেছেন তিনি। আমি খুব চটেছিলাম। আমি তো দিব্যাকে চিনতাম। বই পড়ার শখ ছিলো কিন্তু বিদেশি সিনেমা দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। ভাবতাম এই ছবির মেয়ের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক। এ নিয়ে কত তর্কাতর্কি, ঝগড়া-বিবাদও বেঁধেছে! একদিন বাজার থেকে ভিডিও ক্যাসেট এনে আমাকে চুপিচুপি বললেন, তোমার জন্যে দারুণ একটা চমক আছে, আসো, জলদি আসো। আমি তো গিয়ে অবাক! আরে এই তো সেই মেয়ে, যার ছবি আমাদের ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ঝুলছে! তোমাদের চাচার সেকি হাসি! বললেন,—এবার হলো তো গিন্নি? টিভির মেয়েকে চিনলে তো? হে হে।
আমি হাসলাম, তারপরও অভিমানের সুরে বললাম, এত পাগলামোর মানে কী? তুমি ওই টিভির মেয়েটার জন্যে এত উতলা কেন? ওর জন্যেই যদি পাগল হলে, আমারে ঘরে আনলে কেন?
আমার পষ্ট মনে আছে, এ কথা শোনার পর তোমাদের চাচা চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন? আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বললাম, তোমার কী হয়েছে? কাঁদছো যে?
তিনি বললেন—এই মেয়েটাকে দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে! মায়ের মুখটা ঠিক ওর মতো ছিলো দেখতে! মায়ের হাসিটা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে মেয়েটা। সে নায়িকা না, আমার মা। মায়ের ছবি ঘরে রাখবো না তো কার ছবি রাখবো? ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম এবং ক্ষমা চেয়ে বললাম—আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দাও প্লিজ। তারপর থেকে আস্তে আস্তে সবকিছু খুলে বলেছেন।
দীর্ঘমেয়াদি এই সুপ্ত বাসনা এবং দারুণ প্রতিকী-প্রতিবাদের বিরল ইতিহাস বোধকরি অজানাই থেকে যেত আকস্মিক আইনুদ্দিনের যদি মৃত্যু না ঘযত; এরপরও তার মৃত মুখটা স্মরণ করতে গিয়ে তরুণ চারবন্ধুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো!
—ও…তাহলে দিব্যা ভারতি ছিলেন তার মায়ের মতো দেখতে? সে কারণেই এত পাগল ছিলেন চাচাজান! মায়ের মতো শ্রদ্ধা-ভক্তি করেই কি তার ছবিগুলো টানিয়ে রেখেছিলেন পাঠাগারে? উফ, আমরা আরো এ-নিয়ে খুব হাসি-ঠাট্ট করেছিলাম। আহারে!
—তোমাদের আর দোষ কী। আমি নিজেই তো এক সময় ভুল বুঝেছিলাম। আসলে লোকটা আপদমস্তক ছিলেন রহস্যমানব। তার সব রহস্যের কূলকিনারা আমি নিজেও খুঁজে বের করতে পারিনি। দিব্যার মৃত্যুর পর অবোধ শিশুর মতোন রাতদিন কত যে কেঁদেছেন। এমন আজব মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। আসলে মায়ের প্রতি খুব টান ছিল তো, তাই হয়তো…
অন্তু : চাচিমা, আনু চাচার পড়ার ঘরে দুয়ারের মধ্যে লেখা দেখলাম ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ/ ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা’—এত বড় একজন মানুষ, এত অভিজ্ঞ একজন ব্যক্তি, দিনদুনিয়ার কত কিছুই তো জানতেন তিনি কিন্তু সেগুলো না দিয়ে গুটিকয় শিশুতোষ ছড়ার লাইন দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখার মানেটা কী? সঙ্গে দেখি একটা শকুনের ছবিও আঁকা। বক আর শকুন চিনতে চাচাজানের মতো বিজ্ঞজন কিন্তু ভুল করার কথা নয়। শুধু তালগাছ শব্দ দেখেই কি এমন আচানক কাণ্ড করে বসেছেন তিনি?
—তোমাদের বয়স তো অনেক কম, তাই এমনটা মনে হয়েছে। মনে রেখো, ইতিহাসগ্রন্থের বুকেও সব ঘটনা দেওয়া নাই। এমনো ঘটনা আছে যেখানে ইতিহাস ঢুকতে পারে না। তা ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে যায়। তাই এসব দেখে চমকে উঠলে তোমরা।
—মানে? কথাটা ঠিক বুঝলাম না চাচি, একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
—একাত্তরের ঘটনা জানো?
—পাঠ্যসূচির বইপত্রে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা। কিন্তু খুব বেশি জানি না।
—পাঠ্যপুস্তকে কি এই গ্রামের কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ আছে?
—কই, না তো? আমাদের গ্রাম সম্পর্কে তো কিছুই বলা নাই।
—বললাম না, ইতিহাস মাঝেমধ্যে সব ঘটনার কাছে যেতে পারে না। ইতিহাসের ধারণ ক্ষমতা খুবই কম, সব ঘটনা সে ধারণ করতে পারে না, মানুষ নিজের প্রয়োজনেই তার ধারণ ক্ষমতা সংকীর্ণ করে রেখেছে। মানুষের চেয়ে বেশি অসহায় এখন ইতিহাসগ্রন্থগুলো।
—কী বলেন এসব, কিছুই তো বুঝি না? মাথাটা কেমন ঝিমিয়ে আসছে।
—তাহলে শোনো, ১৯৭১ সালে যখন সারাদেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন এই সোনাকান্দা গ্রামটি ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি অঞ্চল। পাকিস্তান আর্মি যখন তখন ঢুকে পড়তো রাজাকারদের সহযোগিতায়। এখানকার কুখ্যাত রাজাকার নেতা ছিল শরফুদ্দিন মোল্লা। তুলনামূলকভাবে বয়সও ছিল কম, তাকে দেখলেই ভয়ে কেঁপে উঠতো মানুষ। আতঙ্কিত হয়ে পড়তো চারপাশ। ঘরে ঘরে ঢুকে সে খোঁজ-খবর নিতো, কে মুক্তিবাহিনীতে গেছে, কে কে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঘরে রাখে, কার মুখে জয়বাংলা শোনা যায়, পাকিস্তান পতাকা কে কে রাখে না, কে কে পাকিস্তানবিরোধী কাজকর্ম করে, সব তথ্য সে মিলিটিরি ক্যাম্পে পাচার করে দিতো। কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার বিরুদ্ধে আজেবাজে কথা বলে মিলিটিরিকে ক্ষেপিয়ে তুলতো, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সুন্দরী নারীদের গনিমতের মাল বলে ক্যাম্পে তুলে দিতো।
—তাই নাকি! আমাদের গাঁয়ে এমন বদলোক ছিলো! ছিঃ ছিঃ! সেটা তো জানতাম না!
—জানবে কিভাবে। ইতিহাসও কখনো কখনো অন্ধবধির হয়ে যায়। তাই জানো না। তবে শোনো, এই শরফুদ্দিন রাজাকারের মায়ের এক চোখ কানা ছিল, লোকে তারে কানিবুড়ি বা কানিভিখারী নামে চিনতো। রাতদিন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে খয়রাত করে, লোকের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ছেলেটাকে মাদ্রাসায় পড়িয়েছিলো। ছাত্র ভালো ছিল। শিক্ষকরাও তার প্রতি ছিলেন আন্তরিক। এলাকাবাসী যেই ছেলেকে মানুষ করতে দুই হাত উজাড় করে সহযোগিতা করেছিলো সেই ছেলে বড় হয়ে আলেম হয়েছে ঠিক কিন্তু পাশাপাশি এলাকাবাসীর জন্যে কালসাপও হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাজাকারে যোগ দেয় শরফুদ্দিন। ইসলাম কায়েমের নামে রাতারাতি টাকা পয়সার মালিক হয়ে যায়। সুযোগ পেলে ঘরে ঘরে হানা দেয়, লুটপাট করে, আগুন দিয়ে আল্লাহর নাম জপে, খুন-ধর্ষণে দক্ষ হয়ে ওঠে, সুন্দরী মেয়েছেলেদের পাকিস্তান আর্মির হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানবিরোধীদের কাফের মুদ্দাত ফতোয়া দেয়। একাকাবাসী তার ভয়ে তটস্থ। আফসোস করে, কাকে মানুষ করতে অর্থকড়ি ঢেলেছে তারা! এ যে কালকেউটে পরিণত হয়েছে। কানি ভিখারিনীর ছেলে হয়ে গেলো এলাকার সবচেয়ে বড় নেতা! স্বঘোষিত ইসলামের কান্ডারি! তার কথায় উঠ-বোস করতে হয় সবশ্রেণির মানুষ,—যাদের পাতিলের ভাত খেয়ে খেয়ে বড় হয়েছে সে, তারাই এখন তার কাছে জিম্মি।
মহিন: বুঝেছি! চাচাজান তাহলে সেই কানিবুড়ির ছেলে শরফুদ্দিন রাজাকারকে ইঙ্গিত করেই ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ/ ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা’—লিখে ঝুলিয়ে রেখেছেন ঘরে। দারুণ এক প্রতীকী প্রতিবাদ তো!
সিফাত: কিন্তু সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু তার তালগাছের সঙ্গে যে প্রেম—এটার মানে কী? এটার তো আগামাথা কিছুই খুঁজে পেলাম না। বকের পরিবর্তে শকুন কেন?
—খুঁজে পাবে না কেন, অবশ্যই পাবে। শরফুদ্দিন রাজাকার দিনের পর দিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। লুটপাটের অর্থবিত্ত নিয়ে চীনা জোঁকের মতো ফুলে-ফেঁপে মোটাসোটা হয়ে ওঠতে লাগে। তার সাঙ্গপাঙ্গদের উৎপাতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পায় না। কারণ, তারা মিলিটিরির লোক, যা বলে চোখবুজে পাকিস্তান মিলিটিরিরা তা বিশ^াস করে নেয়। এদেশের মানুষগুলিকে তারা সহ্যই করতে পারে না। হিন্দুদের তো মানুষই মনে করতো না, মালাউন বলে গালি দিতো।
পাকিস্তান আর্মির কাছে ভালো সেজে সুযোগ সুবিধা নেয়ার লোভে যুবতী মেয়েদের খুঁজে খুঁজে তালিকা করে গোপনে ক্যাম্পে জানিয়ে দিতো। হায়েনার দল এসে তুলে নিয়ে যেতো তাদের। এক বিকেলে তোমাদের চাচার বাড়িতে মিলিটিরি বাহিনী নিয়ে হাজির হয় শরফুদ্দিন রাজাকার। তোমাদের চাচার বয়স তখন ১২ কি ১৩ হবে। কোনো রকমে জান নিয়ে পালাতে পারলেও বাড়ির সবকিছু এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। শরফুদ্দিন জোর করে তার মাকে তুলে দেয় মিলিটিরির হাতে। অনেক সুন্দরী ছিলেন আমার শ^াশুড়িমা। টেনেহিঁচড়ে মিলিটিরা তাকে গাড়িতে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে যায়, লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি আর।
সুরাইয়া খানম চোখের পানি মুছতে লাগলেন। পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে গুমোট হয়ে গেলো। সবাই শব্দহীন এক আজব কোলাহলে বসে রইলো। গণেশ বিক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো—
—তাই নাকি! ওই শরফুদ্দিন শুয়োরের বাচ্চা এখন কোথায়? ওর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবো পাইলে।
—শরফুদ্দিন টাকা পয়সার মালিক হয়েছে ঠিক কিন্তু ভোগ করে যেতে পারেনি। তোমাদের চাচার মা মাজেদা বেগমকে মিলিটিরির হাতে তুলে দিয়ে বাড়িঘর লুটপাট করে ফেরার পথে উঠোনের বড় তালগাছটা থেকে তিনচারটা তাল একসঙ্গ তার মাথার ওপর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জানোয়ারটা। তখন চারোদিকে মরা মানুষের লোভে গাছে গাছে হানা দিতো শকুন। কয়েকটা শকুন গাছে বসে হাশপাশ করছিলো। মূলত তাদের ভারেই গাছ থেকে ছিটকে পড়েছিলো তালগুলো। পরপর দুটি তাল পড়ে শরফুদ্দিনের মাথায়। সঙ্গ সঙ্গ সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তালের সঙ্গে বড় একটি ডাণ্ডাও পড়ে তার ওপরে। তার পাশে থাকা আরেক রাজাকারও তাল পড়ে মারা যায় সেদিন। বাকি সব পালিয়ে বাঁচে। শকুনের আর খাবার খুঁজতে হয়নি। তাজা দুটি লাশ পেয়ে গেলো গাছের নিচেই।
—আচ্ছা! এই ঘটনা! চাচাজানের তালগাছের প্রতি প্রবল টান থাকার পেছনে তাহলে এই রহস্য লুকানো ছিল! উফ, কি নির্দয় সত্য! প্রকৃতির কী নিদারুণ প্রতিশোধ, নান্দনিক প্রতিরোধ!
মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা নিথর হয়ে গেলো। কেউ কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কালের গর্ভে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও আইনুদ্দিনের তালগাছপ্রীতির ইতিহাস যেন গর্ত থেকে সাপ বের করে আনলো। নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এক একটি তালগাছ। মায়ের আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে আইনুদ্দিন কখনো তালগাছ রোপণের রহস্য দ্বিতীয় কারো কাছে বলে যাননি। পাছে তার মায়ের অমর্যাদা হয়। তালগাছ রোপণের মাধ্যমে গোপনে গোপনে তিনি অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন, নিরবে-নিভৃতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন দিনের পর দিন। নিশ্চিয় তার ধারণা ছিলো, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ কিংবা কোটি কোটি তালগাছ পৃথিবীতে থাকলে দলে দলে নিধন হবে শরফুদ্দিনদের মতো অসুরশক্তি। গাছ থেকে ছিটকে পড়া তালের আঘাতে বিনাশ হবে অপশাসনের নিগড়। সে কারণেই হয়তো তালগাছ লাগানোর নেশায় পৃথিবীর অন্য সকল গাছপালার কথা বেমক্কা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।
দীর্ঘমেয়াদি এই সুপ্ত বাসনা এবং দারুণ প্রতিকী-প্রতিবাদের বিরল ইতিহাস বোধকরি অজানাই থেকে যেত আকস্মিক আইনুদ্দিনের যদি মৃত্যু না ঘযত; এরপরও তার মৃত মুখটা স্মরণ করতে গিয়ে তরুণ চারবন্ধুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো!