জায়গাটার নাম ঢুলিগঞ্জ ঠিক কবে হলো, তা কেউ জানে না। অতসব খুঁজতে গেলে পাঁজি-পুঁথি বা ইতিহাস ঘেঁটে বের করতে হবে হয়তো। তারপরও পাঁচ গ্রাম ছাড়িয়ে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদিন আগে। দোলাইয়ের তীরঘেঁষে কাঁচা-পাকা ইমারতের ফাঁকে ফাঁকে তখন গড়ে উঠছিল চালের বিশাল বড় মোকাম। মহাজনদের চালকলের গদিঘর ছেড়ে অল্পদূর গেলেই এখন যে খেয়াঘাট দেখা যায়, আজও সেখানে ভিড় করে রাজ্যের বড় বড় যত ইঞ্জিনের নৌকা। সবাই আসে ব্যবসাপাতির নানারকম বায়না নিয়ে, যারা সবসময় সরগরম করে রাখে বাজারের চৌহদ্দি। দূর থেকে বাণিজ্য করতে আসা এসব ব্যাপারি আর বারোয়ারি মানুষের জন্যে সারি সারি গড়ে উঠছে হোটেল, সরাইখানাসহ মেয়েছেলের গোপন কোঠাও। আসলে জীবিকার অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসা মানুষের নৈমিত্তিক দিনযাপনের সব চাহিদার নির্ভেজাল সওদা চলে ঢুলিগঞ্জের বাজারে।
বাজার পেরিয়ে নারানখালীর কাঠের সাঁকো—যেখান থেকে মাটির রাস্তাটা দুভাগ হয়ে চলে গেছে সোজা পুবে আর পশ্চিমে। ফণা তোলা সাপের লকলকে চিরল জিভের মতো ঠিক দুভাগ; যার পুবদিকে দোলাই নদীর ধার ঘেঁষে ঢুলিগঞ্জের এক চিলতে ধাম। আর নারানখালী তারও কয়েক ক্রোশ দূরে, একেবারে পশ্চিমের ঝাপসা দিগন্তের কাছে। এদিকে টলটলে শান্ত জল নিয়ে বয়ে চলেছে যে দোলাই, তার কোল ঘেঁষে দূরের অন্য বসতিগুলো দাঁড়িয়ে থাকে নিস্পন্দ, প্রাণহীন; এক একটা বিচ্ছিন্ন মায়ার মতো। এ বিচ্ছিন্নতা সহজেই চোখে জ্বালা ধরায়, গভীর শূন্যতা ধরায় বুকের জমিনে। তারপরও সাঁকোয় দাঁড়িয়ে ডানে তাকালেই আবছামতো ঠাওর করা যায় মধু গায়েনের ঘর। ঘর হলেও ঠিক ঘর নয় যেন—বাঁশ-খড়ের কয়েকটা ছাউনি বেঁধে মাথা গোঁজার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা মাত্র।
মধু গায়েনের ছাপরার চারপাশটা কেমন উদোম, ছন্নছাড়া। সত্যিকার ঘরের মানুষ নেই বলে শূন্য ঘরের প্রতি টানও হারিয়েছে সে বহু আগে। এখন যেখানেই তার রাত, সেখানেই বুঝি ঘর। দোলাই নদীর খেয়ালি গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ঢক্কানিনাদ বাজে কি না, কে জানে, তবে রাত-বিরেতে মধু গায়েনের উঠান থেকে তার আবেগি কণ্ঠের সুর ভেসে আসে। মাটির দাওয়ায় বসলে নদীর কোমল হাওয়া ঝাপটা দেয় বুকে। সে হাওয়ার সঙ্গে সখ্য পাতিয়ে বেজে ওঠে সারিন্দা। সারিন্দায় বাঁধা ভবঘুরে জীবন নিয়েই যে তার জীবিকার অনুসন্ধান হয় প্রতিনিয়ত।
দুই.
সুলতানপুরের নায়েবদের কবিগানের আসর শেষ করে মধু ফিরছিল সেদিন বাজারের ওপর দিয়ে। দুপুরের দিকে জিরিয়ে নিতে খানিক বসেছিল বাগদিদের চালকলের গদিঘরে। সেখানেই আবার দেখা আরতির সঙ্গে। বহুদিন বাদে একেবারে ভিন্নরূপে ভিন্ন পরিচয়ে। ছোট্ট গাঁয়ের মধ্যে আরতির ইতিবৃত্ত কারুরই বিশেষ অজানা নয়। খানিকের বিশ্রাম শেষে আগপাছ কিছু না ভেবেই আরতিকে নিয়ে মধু বাড়ির পথ ধরে—সহজিয়া মানুষের সহজাত আচরণের মতো। এদিকে বাজারের কোঠা থেকে ইজ্জত-সম্ভ্রম বাঁচিয়ে আরতিকে তুলে আনায় গাঁয়ে শুরু হয়ে যায় নানান হুজ্জত।
ভোলারাম ময়রার দোকানে বসা নায়েবদের বড় কর্তা চোখ কপালে তুলে পিছন থেকে শুধায়—যায় কিডা? গায়েন না কি?
—হাঁ গো কর্তা।
—তা, তুমার সাথে মেয়িডা কে গো? বাগদিদের ওই নষ্টা মেয়ি আরতি না? ছিঃ ছিঃ। এদ্দিন তো শুনিচি, সে নাকি তাদের চালকলের এক ছাপরাঘরেই থাকতো। তা, তুমার সাথে কুতায় চলিচে গো?
সব শুনে মধু হেঁয়ালি করে বলে, উ যে আমার সাধনসঙ্গিনী কর্তা, আমার গুরুর উপহার। তারপরেই রহস্য করে বলে, না গো কর্তা, উ আমার ধর্মের বুইন লাগে। আমার ঘরে আলো জ্বালানির জন্যি উকে সাথে নিয়ি এসিচি গো।
কিন্তু, কে শোনে তার কথা? মনোরঞ্জন বাগদির গদিঘরের খোঁয়াড় কিংবা বাজারের ছিনালি মেয়েছেলের কোঠা সব তো ওই একই হলো। সে তো কোনো অগম্য স্থান কিংবা মন্দির-দেবালয় নয়। জাত-পাত শিকেয় তুলে সেখানে মুসলমান, হিন্দু থেকে শুরু করে সব রকম মানুষেরই যোগাযোগ ঘটে অনায়াসে; বিনা বাধায় যাতায়াতও থাকে নিত্য।
আরতির ফেরার ঘটনা চারদিকে রটে গিয়ে তোলপাড় তোলে গাঁয়ে। মুখ ঝামটা মেরে কেউ তখন বলে, মধু আবার গায়েন নাকি? ছিনালি মেয়ি মানুষ ঘরে রেইখি ধর্মের বুইন পাতিয়েছে। যত্তসব অধর্মের কাজ। উর বদ মতলব বুঝতি কারও আর বাকিন্যাই। উর কুনো জাত আছে নাকি? নাম রেইখিচে মধু গায়েন। উ বেটা অধর্মেরও বাড়া।
আসলে জাত-পাত, ধর্ম-কর্ম অতসব তত্ত্বকথা বোঝে না মধু; ওসবে কানও দেয় না সে। সে বিশ্বাস করে, মানুষ ভজলেই তবে সোনার মানুষ হওয়া যায়। মানুষের ওপর মানুষের মায়াই যে তার গুরুর আজন্ম দীক্ষা। সেই দীক্ষার সাধনায় পরম আত্মাকে নিজের মাঝে স্থান দিয়ে ভগবানের আরেক মূর্তিকেই তো সে ঠাঁই দিয়েছে ঘরে। এতে অধর্ম কোথায় হলো, তাই সে বুঝতে পারে না। তারপর ধ্যানমগ্ন বকের মতো থির দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে মধু গায়েন।
একসময় হাতে ওঠে তার গুরুর দেওয়া ময়ূরপঙ্খী সারিন্দা। হাতের ছড় দিয়ে তিন তারে বেজে তোলে অচিন কোনো রাগিণী অথবা নতুন জীবনের মুখর কোনো তান। যেখানে মৃত্যু নেই, ক্ষুধা নেই, বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা নেই; লেখা আছে শুধু মায়ার এক আকুতি। প্রাণহীন এক কাঠের অবয়বে নতুন করে প্রাণের একতান বাজে অনিশ্চয়তার বুক চিরে চিরে। ওদিকে রাতের অন্ধকার ভেদ করে জীবনের সেই সুর মিশে যায় দোলাইয়ের শান্ত কালো জলে। কিংবা তারও পরে ঢুলিগঞ্জের থমথমে বাতাসে।
তিন.
মধু গায়েনের কথায় আজ দিন শুরু হয়নি। দিন এসেছে দিনের নিয়মে, তার আপন খেয়ালে। সময়ের চরকা গড়িয়ে দিয়ে সকাল ফেলে সে দুপুরকে ডেকে এনেছে—যেন দ্রুতই আবার সন্ধ্যাশেষে রাজ্যপাট বসিয়ে মধুর ওপর খবরদারি করতে পারে। রাতের সুনসান নীরবতায় তার অনন্ত প্রকাশ্যের কথা মধুর অজানা নয়। এমন নিশুতি রাতের থমথমে অন্ধকারের মধ্যেই তো একদিন তার সঙ্গে সন্তর্পণে এসে হাজির হয়েছিল আরতি।
মধু একবার নিজেই ভাবে, অদ্ভুত মানুষ সে। তার এই খেয়ালি স্বভাবের জন্যে ঘর-সংসার হলো না কোনোদিন। আজ আর সে ইচ্ছাও নেই মোটে। কিন্তু, আপন ভিটার জিরজিরে মায়া কেমন জানি শরীর আগলে ধরে; যে মায়া ত্যাগ করার শক্তিও তার নিঃশেষ হয়ে গেছে। মনোরঞ্জন বাবুর গদিঘরের পেছনের ছাপরা থেকে হঠাৎ আরতির উদয় হওয়া, সেখানে তার ক্ষণিকের বিশ্রাম—সবই যেন তার গুরুর কৃপা। তাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠেও সাতপাঁচ না ভেবে আরতিকে নিয়ে এসে এখন সে ভাবছে কোনো ভুল করল কি না?
আরতিই তো সেদিন তার পিছু ছাড়েনি। মধু গায়েনকে সে সামান্যই চিনে। সেই ভরসা থেকে আগলে ধরেছিল তার বাড়ি ফেরার পথ। আরতির চোখের দিকে তাকিয়ে নিমিষেই সে বুঝেছিল এ খাঁচা থেকে তাকে মুক্তি দিতে হবে। তার ঘোলাটে চোখে সেদিন বিপদের খড়্গ ছিল সমাসীন। তাই এ নরকযন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে নিয়েছিল একলা নিজেই। পরক্ষণেই আর দেরি না করে পথ হেঁটেছিল ঢুলিগঞ্জের দিকে।
দোলাইয়ের বুকে সূর্য তখনো হেলে পড়েনি; মধু একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট একটা বোঁচকা হাতে নিঃশব্দে পিছু নিয়েছে আরতি। দ্বিধাগ্রস্ত কাঁপা গলার নিচু স্বরের সম্বোধনহীন সে ডাক বাতাসে ভেঙে ভেঙে যায়।
—শুনেন, আমি গাঁয়ে ফিরি যাবু। আমারে সাথে নিয়ি যান।
উদ্ভ্রান্তের মতো পেছনে তাকিয়ে মধু বলে—তুমারে রাখবু কই? খাইতে দিবু কী? মাথার ওপর একটু ছাপরা ছাড়া আমার তো আর কিছুই ন্যাইকো।
ডুকরে কেঁদে ওঠে আরতি। হাতের মুঠোয় গোঁজা কয়েকটা টাকা নিঃশব্দে এগিয়ে দিতে চায় মধু গায়েনের দিকে। কিন্তু, সেদিকে না তাকিয়েই খানিক ভেবে মধু বলে—আমার ট্যাকা লাগবু না। ঠিক আছে, চলো বুইন। নিয়তি যেইদিক নিয়ি যায় সেইদিকই না হয় যাবু।
ভুল করে ভুল পথে হাঁটার মাশুল জীবনভর দিয়ে এসেছে মধু। আজ না হয় সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হলোই বা একটুখানি।
—আহা, আবার কান্দ ক্যানে?
আঁচলের খোঁট দিয়ে একাকার হয়ে যাওয়া নাক-চোখের জল মুছে নিরুত্তর চেয়ে থাকে আরতি। হঠাৎ মধু গায়েনের ওপর এ ভরসার আদি-অন্ত সে খুঁজে পায় না। দুই-একবার গানের আসরে দেখা বা তার নাম শোনা ছাড়া তেমন কোনো আলাপ পরিচয় ছিল না। তারপরও অজানা উৎস থেকে উৎসারিত এক বিশ্বাসের স্রোত ধারায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল আরতি। সে সুধায় কোনো পাপ ছিল না, ছিল শুধু অগাধ এক ভক্তি, আস্থা ও বিশ্বাস। আর সে কারণে দিক্ভ্রান্ত এক মানবীর মতো মনের দিগ্বলয়ে আলোর রেখা ফুটে উঠতেই সাঁঝের অন্ধকারে অচেনা গায়েনের পিছু পিছু তার বাড়ির পথ অনুসরণ করে সে।
শেষ বিকালের দিকে নারানখালির সাঁকোর একটা ভঙ্গুর দীর্ঘ ছায়া পড়েছিল তিরতিরে জলের বুক ছুঁয়ে। কিন্তু, হঠাৎ মেঘ এসে কখন যে সেটা গিলে নিয়েছে, একদমই খেয়াল করেনি মধু। তাই আরতিকে নিয়ে কপট অন্ধকার হাতড়ে আরও দ্রুত পা চালায় সাঁকো পেরিয়ে তার শূন্য ভিটার দিকে। একসময় দোলাইয়ের শান্ত নদীর কিনারে কিনারে সন্ধ্যার জমাট অন্ধকারটা আরও ঘন হয়ে নেমে এলে হলুদ জোনাকিগুলো সেখানে সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে দেয় ভীষণ যত্ন করে।
—বুইন, যাও, জলে একখান ডুব দিয়ি আইস। কুনো কষ্ট আর থাকবি না। আমার সব দুখ আমি আগেই ভাসিয়ে দিয়িচি ওই জলে।
—আপনি কিভাবে বুজবেন মেয়িছেলির দুখ?
—আমি না বুজলিও আমার সারিন্দা বুইজবে। উই তো আমার সাথে সারাদিন কথা বুলে। উ ঠিক কাইন্দি বুলবে তুমার কথা। আমারে একবার বুলো দেখি। আমি তুমার দুখ বুঝতি পারি কিনা?
গুমরে কেঁদে ওঠে আরতি। বলে—আমারে জুর করে বাবুদের ছাপরায় নিয়ি গিয়িছিলু আমার দাদা। কাজের দুহাই দিয়ি ওই বাবুর কাছে বেইচিছিলু আমি জানি। আপনি আমারে বাঁচিছেন। আমার ভগবান আপনি। আমি কুনুদিন বাড়ি ফিরি যাবু না।
—আমি বাঁচাইনি বুইন। উপরে একজন আছেন, এ সব তেনার কাজ। তিনিই সবার কর্তা গো।
একসময় নিরাভরণ রাতের বুক চিরে মধু গায়েনের সারিন্দায় বেজে ওঠে অজানা গানের সুর। সেই সুরে দোলাইয়ের জলে অলক্ষে মিশে যায় আরতির লুক্কায়িত ব্যথা। লীলায়িত সে তরঙ্গের মাঝে ভেসে ওঠে রূপালি মাছ আর রূপার থালার মতো ভাসে বিশাল বাদামি চাঁদ। রাতের এ অনন্ত বিস্তারের মধ্যে মধু কিংবা আরতির অনতিব্যক্ত করুণ কথামালা বিমূর্ত সন্ধ্যাভাষার মতোই অস্ফুট থেকে যায়।
সারিন্দার সুরে সুরে অহর্নিশ দুর্বোধ্য সে ভাষার সন্ধান করে করে জীবন খুঁজে নেয় মধু গায়েন। রাতের এই নিস্তব্ধ ভাষাই তো তার সুর বাঁধার প্রকরণ, জীবনের অনিবার্য উপাদান। তাই দিনের চেয়ে রাতকেই তার বেশি আপন মনে হয়। মাঝে মাঝে নদীর চারধারের থকথকে অন্ধকার ধেয়ে এসে গ্রাস করে নিতে চায় সকল সুর। কিন্তু, বেঁচে থাকার বিপুল মায়াকে নিজের কাছে যত্নে আগলে রেখে সব দুঃখ-কষ্টকে সে ঠেলে দেয় অন্ধকারের গহীন উদরে। কেননা, সুরই যে তার জীবন; যা এখন তার জীবিকার অন্য নাম হয়ে গেছে।
চার.
কথাটা বাজার থেকেই শুনে এসেছে রঘু দফাদার। আর শুনে এসে অবধি তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে চরকির মতো। ঘুণাক্ষরেও যদি তা মনোরঞ্জন বাগদি জানতে পারে তবে মধু গায়েনের হাড্ডি-মাংস সব এক করে ছাড়বে। এসব কথা কখনও চাপা থাকে না, বাতাসের আগেই ছোটে। রঘুইবা কী জবাব দিবে বাবুকে। আরতির পেছনে কি আর শুধু শুধু ট্যাঁকের কাঁচা পয়সা অমন উজাড় করে দিয়েছে লোকটা? ওর যে হাড়ে হাড়ে শয়তানি রঘু তা বিলক্ষণ জানে।
ঢুলিগঞ্জের বনেদী গৃহস্থ পরিবার হয়েছে ওই বাগদিরা। পূর্বপুরুষের জাত পেশা ছেড়ে একটু-আধটু সচ্ছলতা উঁকি দিচ্ছিল তাদের ঘরে। তবে সব বাগদিরা নয়, একা মনোরঞ্জন বাগদি। চাঁছাছোলা স্বভাবের কদাকার মানুষটা বেশি সুবিধার নয়। মেয়েছেলে দেখলেই খালি ছোঁক ছোঁক করে। নগদ কাঁচা পয়সা হয়েছে দু’হাতের আঙুল ফুঁড়ে, যার গন্ধে এখন তার ঘুম হয় না ঠিকমতো।
বাজারের খেয়াঘাট ঘেঁষে দুইটা চালকল বসিয়েছে বাগদি। সারাদিন সে কলের ঘর্ঘরানি শোনা যায়। চালকলের ঠিক বিপরীতে খেয়াঘাটের মুখোমুখি শোভা পায় খাবার হোটেলের সাইনবোর্ড, যার ওপরেই আছে অতিথিশালা। সবখানেই মনোরঞ্জনের নাম লেখা। শোনা যাচ্ছে, বাজারের মূল খেয়াঘাটের ইজারা নিতে মরিয়া হয়ে পয়সা ঢালছে দেদার। হাত ঝাড়া দিলেই ঝনঝনানি আওয়াজ পয়সার, খরচও করছে বিস্তর। তাই বাগদি থেকে এখন বাবু হয়েছেন তিনি।
আরতির দিকে আগে থেকেই কুনজর ছিল বাগদির। সে ভালো করেই জানে, জ্ঞাতিগুষ্টির বাইরে গিয়ে সামাজিক মতে আরতিকে ঘরে তোলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সুবলকে কাজের নামে অর্থের প্রলোভনে এক প্রকার হাত করেই রীতিবিরুদ্ধ সাময়িক এ টোটকা ব্যবস্থা। এতে বাগদিদের জাতের ক্ষয় হলো না, ধর্মও রক্ষা হলো বটে।
মনোরঞ্জন বাবুর সামনে সাহস না পেলেও পেছনে অনেকেই বলাবলি করে তার পীড়াপীড়িতেই সুবল অধর্মের কাজটি করেছে। আর আরতি তো অচ্ছুৎ কেউ নয়, শুধু মুখরা বলে আপনজনদের সঙ্গে ঠিকমতো বনিবনা হয় না তার। খুঁজতে গেলে এতটুকুই ছিল তার দোষ। দফাদার রঘু আর আরতি তো ঢুলিগঞ্জেরই মানুষ। এসব কথা নতুন করে জানানোর প্রয়োজন কী? সবাই তা জানে। গাঁয়ের গণ্ডি বেশি বড় নয়। সকালে যা ঘটে সাঁঝ না মেলাতেই তা ছড়িয়ে পড়ে আলো-হাওয়ার বুকে ভর দিয়ে। বহুরূপীর মতো রঙ পালটে দিক পালটে সারাদিনে বিচিত্র রঙ ধারণ করে খবরগুলো। আরতিকে নিয়ে এর আগেও যখন শালিসের ঘটনা ঘটেছিল সেটাও কানে আসে দুপুর গড়িয়ে বিকাল না যেতেই।
ঢুলিগঞ্জের মাটিতে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। দাদা সুবলের সংসারে অন্ন ধ্বংস করে আইবুড়ো পড়ে ছিল আরতি। বিয়ে-থাওয়া হয়নি। সে নিয়ে অশান্তিও কম হয়নি দাদার সংসারে। কারণে অকারণে তার ওপর তেড়ে-ফুঁড়ে আসতো সুবলের বউ গীতা। এ নিয়ে বিচার-সালিশ, নিন্দেমন্দ কম হয়নি। কিন্তু, কোনো কিছুতেই তার হেলদোল ছিল না। নির্জীব পাথরের মতো মুখ বুঁজে সইছিল সব। তারপর একদিন কোত্থেকে যে কী সব ঘটে গেলো!
সুবল কাজ করতো বাগদিদের একটা বড় চালকলে। সেই সূত্রে আরতির ওপর নজর যায় মনোরঞ্জন বাবুর। চালকলের চাল শুকানো ও ঝাড়ার কাজ দিয়ে আরতির ওপর অনেক জবরদস্তি করেছিল সুবল। কয়েকদিন কাজ করেই বাবুর কুমতলব টের পেয়ে আরতি আর ওমুখো হয়নি। সেই থেকে সুবল ভীষণ খ্যাপা তার ওপর। পেটে দানা পড়ে বাঁচলে তবেই না সম্ভ্রম। ক্ষুধায় জ্বলে মরলে অত ইজ্জত বাঁচিয়ে লাভ কী? তার কিছুদিন পরে এই বাগদির সঙ্গেই শলা করে অপবাদ রটিয়ে এক প্রকার জোর করেই তাকে ঘরছাড়া করে সুবল। আর অমনি মনোরঞ্জন বাবু ত্রাতা সেজে আবির্ভূত হয়ে যায় আরতির সামনে। বাবুর কথাই শেষ কথা বলে সাব্যস্ত হলে তার ঠাঁই হয় বাজারের চালকলের পেছনে ছাপরামতো একটা ঘরে।
গাঁয়ের লোক মুখ বাঁকিয়ে বলে, দাদার সংসারে আর কদ্দিন? যা, কোঠায় গিয়ি এবার খানকিগিরি করে খা। সত্যিই তো, গ্রাম থেকে তো আর তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। গাঁয়ের সীমানার কাছেই বাজারের মধ্যে বাবুর গদিঘরের এক কোণায় মুখ বুঁজে পড়ে থাকবে সে। এতে আপত্তির কী আছে? বাবু তো সাক্ষাৎ ভগবান, নইলে এমন কাজ কি কেউ করে? তাও আবার আরতির জন্যে।
সেদিন কেউ টুঁ শব্দটি না করলেও রাগে ফুঁসে উঠে কথাগুলো বলেছিল এক গফুর ডাক্তার। গাঁয়ের বৃদ্ধ কবিরাজ বলে সবাই মান্যি করে তাকে। সে এগিয়ে বলে, এ কিসের বিধান তুমাগো? এমন অনাচার তো খোদাও সইবি না। এ নিশ্চয় বাবুর বদ মতলব। বাগদির কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়াটাই তাইলে আরতির দুষ?
আরতিকে বরাবর মেয়ের চোখে দেখতো বলে এ বিধান মানতে সে নারাজ। মুখরা হলেও ওর শ্যামা মুখে এক রত্তি মায়া লেপটে থাকতো সব সময়। কিন্তু, বাগদি আর সুবলের জোরাজুরি ও অন্যায় অন্যায্য দাবির কাছে সেও শেষে পরাস্ত হয়ে যায়। একসময় চুপ মেরে সুবলের উঠান থেকে বের হয়ে যায় বিরক্তমুখে।
পাঁচ.
সকালের একফালি রোদ মধুর উঠানে এসে ঠিকমতো না পড়তেই সটান হাজির হয়ে যায় রঘু। মধু গায়েনের জন্যে আগাম বার্তা নিয়ে এসেছে সে।
—গায়েন বাড়ি আছ? আমি রঘু, রঘু দফাদার।
দরজার কপাট ভেঙে উঁকি দেওয়া সূর্যের মতো চোখ রগড়ে বের হয় মধু। যেন আগেই জানত এমনটা হবে।
—আরতি নাকি তুমার ঘরে আছে?
—হুঁ, কী হয়িচে তাতে?
—তুমিই বুলো কী হয়িচে? গাঁয়ে তো ঢিঢি পড়িচে। এই কথা বাবু জানলে তুমার অবস্থা যে কী হইবু ভগবানই জানে!
—আমার অতসব জানার কাজ ন্যাই গো? আর উ কি বাবুর বান্ধা মেয়িমানুষ নাকি? অত সুহাগ থাকলি উকে ঘরে নেয় না ক্যানে?
রঘু জবাব না দিয়ে মাথা হেঁট করে চলে যায়। ফিরে গিয়ে বাবুকে কিভাবে সামাল দিয়েছে সেটা জানা না গেলেও সেই থেকে আরতি আশ্রিত থাকে মধুর একচালা ঘরের কোণে।
আরতি যে পোয়াতি রাতের অন্ধকারে সেদিন ভালো করে লক্ষ করেনি মধু। কয়েকদিন বাদে এ কথা জানতে পেরে তার ঘর বাঁধার ভীষণ অলীক স্বপ্ন জাগে। পিতৃমাতৃহীন জীবনের দিনগুলো কিভাবে যে কেটে গেলো একলা, সেই হিসাব করতে বসে সে। ততদিনে বোনের স্নেহ ও মায়ায় আরতিকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে বেঁচে উঠেছিল সে। বহুদিন পরে হলেও সংসারের মতো এক বিচ্ছিন্ন মায়ার গন্ধ টের পায় তার মাটির বসতে।
মধু না থাকলে আজকাল রঘু দফাদার এসে প্রায়শই খোঁজ-খবর রাখছে আরতির। তার ভেতর যে দ্বিতীয় সত্তা জেগে উঠছে তার খেয়াল রাখছে পিতৃসম গফুর ডাক্তার। মাঝে মাঝে সে এসে আরতির নাড়ি টিপে পরীক্ষা করে যায়, সঙ্গে সাহস যুগিয়ে যায় নতুন করে বাঁচার। এভাবে দিন গড়িয়ে রাত, রাত পেরিয়ে দিন হয়। তারপর আরেকটা দিন, আরেকটা। তারপর অনেক দিনশেষে বেশ কত মাস হয়। আরতি নিরুপদ্রব থেকে যায় মধু গায়েনের ঘরে আর বাঁচার জন্যে নিজেকে বাঁচিয়ে তোলে প্রাণপণে।
শীতের এক দুপুরে মধু গায়েন বিবাগী হয়ে আবার নিরুদ্দেশ হওয়ার বাহানা খোঁজে। সবকিছু ফেলে যাওয়ার আগে রঘুকে ডেকে বলে যায়—দেখিস, বুইনটার যেন কুনো অযত্ন না হয়।
—আরতি তো আমারও বুইন। তুমি যাও গায়েন। আমি তার খেয়াল রাখবু। রঘু আশ্বস্ত করে।
কাঁধে সারিন্দা ঝুলিয়ে মধু গায়েন তারপর ঘর ছাড়ে। বিচারগানের বায়না নিয়ে পাড়ি দেয় নারানখালীর শূন্য প্রান্তরের দিকে। এদিকে আরতি থেকে যায় রঘু দফাদারের ওপর ভরসা করে। সেও যে তার ধর্মের ভাই। এভাবে মধু গায়েনের শূন্য ভিটায় পালা করে শুধু দিনরাতের রাজত্ব চলে।
রাতের আকাশে সেদিন পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। অন্ধকার সরিয়ে জোনাকির দল আলো করে রেখেছে মধু গায়েনের উঠান। ওদিকে আলো-আঁধার কিংবা আশা-নিরাশার সন্ধি চলছে তার মাটির ঘরের বুকে। টিমটিমে কুপির আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরতির ভীতিগ্রস্ত বিবর্ণ মুখ। কারণ, এখন আর সে একা নয়। দুটি জীবনকে একসঙ্গে বয়ে চলছে তার সংগ্রামী সত্তা। গহীন অন্ধকার ঠেলে কঠিন সে সময়ও এগিয়ে আসছে শঙ্কিত পায়ে হেঁটে। কিন্তু, সব সত্যের মুখোমুখি হওয়ার আনন্দে অদম্য সাহস বুকে নিয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষার প্রহর গুনে যায় সে।
একসময় অস্থির ব্যথায় পাংশু হয়ে ওঠা আরতির গোঙানি মিশে যায় সারিন্দার করুণ আওয়াজের সঙ্গে। খবর পেয়ে সাইকেলে টুংটাং শব্দ তুলে আগেই হাজির হয়ে গিয়েছিল রঘু দফাদার। কিন্তু, ওদিকে গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে দাওয়ায় বসে থাকে মধু। রঘুর দিকে না তাকিয়ে থমথমে গলায় একবার বলে—আমার বুইনটার সময় হয়িচেরে রঘু। গফুর ডাক্তাররে একখান খবর দেওয়া দরকার।