মৃত্যু তাকে টানছিল।
কেননা রহম আলীর মা ছায়েরা খাতুন তার একমাত্র ছেলেকে বাতাস পড়ে আসা এক গভীর কালো রাতে নিজের গ্রাম রাহেলার পূর্বদিকে দিঘিরপাড় পর্যন্ত ঠিকই দিয়ে আসে আর বলে দেয়, বাজান, দিঘিরপাড় হয়া বাজিতপুর চইলা যাবি। দেহিস, এদিক-সেদিক করিস না।
তিনি জানেন, বাজিতপুর থেকে কোনোমতে সরারচর যেতে পারলেই মিলবে ঢাকা যাওয়ার লোকাল ট্রেন। ঢাকায় তার সম্পর্কের এক ভাগ্নে আছে। কদিন আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। ছেলেকে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, ভাগ্নের সঙ্গে দেখা করতে পারলে সে তাকে যে করেই হোক ইন্ডিয়া যাওয়ার পথ করে দেবে।
রহম আলীও মায়ের কথামতো দিঘিরপাড়ের দিকেই এগিয়ে যায় কিন্তু দিঘিরপাড় যেতে পথে দু’গাঁয়ের এক এজমালি গোরস্থান, এর একটু দূরে থাকতেই কী মনে করে সে আর এগোয় না। থমথমে অন্ধকারে কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করে উল্টা ঘুরে নিজের গ্রামের পাশ দিয়ে সে কৈলাগের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। কৈলাগ থেকে সোজা সড়ক চলে গেছে বাজিতপুর উপজেলা সদরের দিকে। সড়কের মাঝখানে পড়ে বড়খাল। বড়খালে পারাপারে রয়েছে টানা রশির গুদারা। কোনোমতে খালটা পার হতে পারলেই হলো।
রহম আলীর চিন্তা হয়তো ঠিকই ছিল। যদি মৃত্যু তাকে এখানে টেনে না আনতো তবে কেউ কিছু টের পেতো না। বড়খালে গুদারা না থাকলে সে বড়জোর গামছা পরে এক হাত শূন্যে রেখে বুকের ভরে একটা ছোট্ট সাঁতার দিত, ব্যস। কিন্তু কৈলাগের পর বড়খালের একটু আগে নির্জন সড়কের এক পাশে হেলে পড়া নিশ্চুপ গাবগাছের নিচে যে তার অন্তিম রাত্রিটি শিকারী কুমীরের মতো ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে, সেটা কেন তার অনুমানে আসেনি? মৃত্যু না মানুষকে গাওয়া দেয়! তবে তাকেও নিশ্চয় দিয়েছিল, হয়তো টের পায়নি। আবার এমনও হতে পারে, দিঘিরপাড় যেতেই সে মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিল বিধায় সে সজাগ হয়ে মায়ের দেখানো অবশ্যমান্য নির্দেশনা বাতিল করে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে রওয়ানা দিল?
বর্ষা নেমে যায় যায়।
উপজেলা সদরের দিকে ধাবমান সড়কের এক পাড়ে বিস্তৃত জলরাশি থেকে হেলেদুলে আসা শেষ বর্ষার ছোটছোট ঢেউ এসে লাগে। এক পাড়ে মৃত মৃৎপাত্রের অজস্র টুকরো আর ছোটবড় শামুকের কঙ্কাল স্তরে স্তরে পড়ে রয়।পরদিন সকালে এসব টুকরো আর শামুকের পাশে নরম মাটিতে মানুষের অসংখ্য দেবে যাওয়া এলোমেলো পদছাপ দেখে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া কলেজপড়ুয়া দুটি ছেলেমেয়ে একে অন্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ছেলেটার মনে কিছু একটা সন্দেহ জাগলে সড়কের উল্টো পাশে যেখানে খসখসে পাতার পুরাতন গাবগাছ রয়েছে গলা বাড়িয়ে সেদিকে তাকায় আর তাকিয়েই ‘হায় আল্লাহ’ বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
গাবগাছের পেছনে রক্তভেজা মাটির ওপর রহম আলী পড়ে রয়েছে। ফাঁড়া পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে নাড়িভুড়ি আর এক কাঁধ থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো অংশটা অন্য কাঁধে কোনোমতে আটকে রয়েছে। ছেলেটা আর মেয়েটা রহম আলীরই গ্রামের। ফলে তাজা লাশ দেখে ভয়াল আতঙ্ক ও উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেও ওরা ওকে চিনতে পারে।
রহম আলীর পা দুটো তখনো পানিতে ভাসছে। এ পাড়ের স্থির জলে গর্দান চুইয়ে পড়া রক্তের রঙ লেগে আছে। মেয়েটি দেখে, লাশটির পাশে ও পাড়ের মতোই অসংখ্য পদছাপ রহম আলীকে ঘেরাও দিয়ে রেখেছে। এ দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। মেয়েটা বিচলিত হয়ে পড়ে। তার তীব্র কাঁপুনি শুরু হয় আর ‘উহ. মাগ্গো’ বলে টলতে টলতে উপজেলা সদরের দিকে আধাদৌড়ে হাঁটা দেয়। আর মেয়েটার দেখাদেখি ছেলেটাও হাঁটতে শুরু করলে নরম রোদ উঠতে থাকা সকালে গাবগাছের নিচে আরো কিছুক্ষণ রহম আলীর নিষ্প্রাণ চোখ আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।
ছেলেটা আর মেয়েটা চলে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সড়কটা সরব হয়ে ওঠে। রহম আলীর মুখের দিকে তাকালে মনে হবে, এই মাত্র কেউ তাকে খুন করে গেছে। রহম আলীর মৃত্যুর খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খবর যায় রহম আলীর গ্রাম রাহেলায়, রাহেলার পূর্বে দিঘিরপাড়, পশ্চিমে কৈলাগ আর কৈলাগের সোজা দক্ষিণে উপজেলা সদরের সরকারী বাসায় স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বাস করা উপজেলা চেয়ারম্যানের কানে। খবর শুনে রহম আলীর মা ছায়েরা খাতুন বিলাপ করে কাঁদে আর কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং কিছুতেই বুঝতে পারে না,দিঘিরপাড়ের পথে যেখানে রহম আলীকে তিনি নিজে রেখে এলেন সেখানে এর উল্টা পাশের কৈলাগের সড়কের সেই নির্জন গাবগাছের নিচে তার ছেলে যায় কী করে! মায়ের ভাবনাগুলো তার জোরালো চীৎকার ও সুর করে করা কান্নার সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে। যারা শোনে তারা রহম আলীর মায়ের মতোই ভাবে, যদি দিঘিরপাড়েই যায়, তবে কৈলাগের সড়কে সে আসে ক্যামনে? যদি ভৌতিক কিছু না ঘটে থাকে তবে মৃত্যুই তারে টাইনা আনছে।
রহম আলী মরতোই। আজ না হয় কাল। সেটা রহম আলী টের পেলে বা না পেলেও পেয়েছিল তার মা অথবা এমনও হতে পারে, হাসতেহাসতে বহু মৃত্যু কাছ থেকে দেখা রহম আলীর হয়তো মৃত্যুভয়ই ছিল না। নাকি মৃত্যুরই আছে কোনো অমোঘ প্রাণ আর আছে শক্তিমান অভিকর্ষজ টান, যে তার দিকে চলে যাওয়া লোকটাকে যথাসময় যথাস্থানে নিয়ে আসে? না হলে রহম আলী, যে বহুদিন পর চুরি করে বাড়ি ফিরলো, মা আর স্ত্রীর সঙ্গে পেট ভরে হাঁসের ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেলো, কুপি বন্ধ করে স্ত্রী-সঙ্গম সারলো আর মাঝ রাতে কোচড়ে কিছু টাকা আর কাপড়ের একটা বোচকা নিয়ে মায়ের সঙ্গে দিঘিরপাড়ের পথে গোরস্থানের আগ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে গেল, সেখান থেকে এতদূরের উপজেলা সদরের দিকে লম্বমান কৈলাগের সড়কে সে ফিরে আসবে কেন? কেনই বা সে দিক পাল্টাবে? এইসব প্রশ্নের কোনো জবাব আপাতত কেউ না জানলেও রহম আলীর মায়ের বিলাপে গভীর রাতে মাতা-পুত্রের সতর্ক-যাত্রার বৃত্তান্ত জানা হয়ে গেলে মৃত রহম আলীকে দেখতে আসা মানুষের ঢল থেকেও একই অনুমান স্পষ্ট হয়, মরণই তারে টাইনা আনছে।
সকাল নটার মধ্যেই পুলিশ আসে। পুলিশকে আসতেই হয়। বড়খালের এই গাবগাছটার নিচে একই কারণে তাদের আরও কয়েকবার আসতে হয়েছে। সড়কের পাশের এই নিঃসঙ্গ গাবগাছ বহু মৃত্যুর একলা সাক্ষী। গাবগাছের বাকশক্তি নেই বলে এই খানে ঘটে যাওয়া অনেকের মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী থেকেও অনুপস্থিত থাকে। একারণে কোনো মৃত্যুরই কূলকিনারা হয় না। গ্রামের লোকজন জানে, রহম আলীর মৃত্যুও অন্য অনেক মৃত্যুর মতো কিছুদিনের মধ্যেই একটুখানি অতীত হয়ে যাবে। শুধু এইটুকু সবার মনে থাকবে যে, অন্য মৃত্যুর বা লাশের মাথা খুঁজে না পেলেও নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যাওয়া রহম আলীর এক কাঁধে তার মাথাসমেত রক্তঝরা গর্দানটা লটকে ছিল।
এখন যদি রহম আলীর মৃত্যুর ইনভেস্টিগেশন করতে হয়, তাহলে কোথা থেকে শুরু করবে পুলিশ—এটা একটা প্রশ্ন। প্রথমত করতে হবে রহম আলীর আইডেন্টিফিকেশন, যেমন সে পুলিশের খাতায় সাতটা মার্ডার কেসের দাগী আসামি, এই পরিচয় জানার পর রহম আলীর লাশ নিতে আসা নতুন একজন সাব ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দুজন সিপাহী, যারা রহম আলীকে কখনোই দেখেনি, তারা তাকে এক পলক দেখামাত্র আঁৎকে উঠবে এই ভেবে যে, মাত্র পাঁচ ফুটের লিকলিকে শরীরের এই লোকটার নামে যেসব দুর্ধর্ষ ঘটনার রটনা আছে তা আদৌ সত্য তো! তারপর রহম আলীকে মর্গে নেওয়া হবে। এরপর কাটাছেঁড়ার রিপোর্ট। আইনগত আরও কিছু প্রসেস। এই। তারপর তদন্ত আর এগুবে না।
২.
সবরিকান্দার চরে তিন দফায় চারটা খুন আর আরও তিন দফায় উপজেলা সদরের দিকে যাওয়া এই সড়কের পাশে তিনটা খুনের প্রধান আসামি রহম আলী শেষ মানে তো একটা নির্বোধও জানে, চলমান মামলাগুলোই শেষ! কিন্তু থানা থেকে আসা একজন সাব ইনস্পেক্টর ও দুজন সিপাহী, যারা রহম আলীর লাশ নিতে পুরাতন গাবগাছের নিচে নেমেছে, যারা তার সৎকারে অংশ নেবে আর ডায়েরি লিখবে তাদের জানা দরকার, রহম আলীর মৃত্যুর ঘটনাটা অন্য আরও অনেক মৃত্যুর মতো রাতের অন্ধকারে ঘটলেও ইচ্ছে করলে এই মৃত্যুর পথ ধরেই আরও কয়েকটি অতীতমৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব। ভবিষ্যতের আরও কয়েকটি মৃত্যু আটকে দেওয়াও সম্ভব হতে পারে। এমনকি রহম আলীর গ্রাম রাহেলার পূর্বে দিঘিরপাড় ও পশ্চিমে কৈলাগ—এই তিনটি গ্রামেই খুনোখুনির কালো ছায়া চিরতরে মুছে গিয়ে শান্তির সুবাতাস বইতে পারে। আর এটা তখনই সম্ভব যখন জানা যাবে, রহম আলী কী কারণে পূব ছেড়ে পশ্চিমে এসেছিল।
কিন্তু গ্রামের লোকজন জানে, এটা কখনো হওয়ার নয়। আরও অনেক মৃত্যুর পেছনে এমন অনেক কারণের জবাব কেউ কোনোদিন পায়নি। প্রকাশ্যে সাহস করে কেউ চায়নি। অথচ রহম আলী, দিঘিরপাড় থেকে কৈলাগের সড়কে অনিবার্য মৃত্যু যাকে টেনে এনেছে, হয়তো আরও কয়েকটা জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবনটা সে পেতে পারতো। এমনই নির্দেশ ছিল কিন্তু রহম আলী অসময়ে ফিরতে চাইছে, রহম আলী হাতের রক্তাক্ত ডেগার ছাড়তে চাইছে, তার ছয় বছরের শিশুকন্যাকে বিদ্যালয়ে পড়াতে চাইছে। এতসব চাওয়া একটি মাত্র আপত্তির কাছে হার মেনে যাবে, রহম আলী কিন্তু জানতো। আর এ কারণেই সে পালাতে চাইছিল অথবা চাইছিল থানায় ধরা দিতে।
সবরিকান্দার চরে বসেছিল তাদের বৈঠক। চারপাশে জলঘেরা এই চরের কয়েকটি কড়ই গাছ সেদিন এক দল ডাকাতের পদচারণায় সরব হয়। চরে আসার আগে দলটি এক গ্রাম থেকে দুটি খাসি তুলে এনেছে। সন্ধ্যার পর দুটি খাসিরই রান্না হবে এখানে। দলের সদস্যসংখ্যা আট। সবরিকান্দার চরে খাসি জবাইয়ের সেই রাতে দলের সাতজনই রহম আলীর মনের পরিবর্তিত অবস্থা বুঝতে পারে কিন্তু বুঝেও পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলে না আর রহম আলী কিভাবে ফিরতে চায় বা ফিরতে পারবে, এ ব্যাপারে অন্যদের কোনো আগ্রহ বা সাড়া না পেয়ে সেও আর কিছু বলে না। রহম আলীর মনেরটা মনে আর অন্যদের মনেরটাও মনেই রইলো।
রহম আলীর মৃত্যুরহস্য বের করতে হলে খাসি জবাইয়ের সেই দিনটিরও খোঁজ করতে হবে। কেননা তারপরদিনই সরকারি বাসায় থাকা উপজেলা চেয়ারম্যানের কানে কেউ একজন রহম আলীর ব্যাপারটা দিয়ে দেয়। বিবরণ শুনে উপজেলা চেয়ারম্যান কী সিদ্ধান্ত দেন, তা দলের আর কেউ জানতে পারে না। তবে যে সদস্যটি খবর দিয়ে আসে সে খুশিমনে ফিরে যায়। কেননা চেয়রম্যান সাহেব তাকে সামনে বসিয়ে নিচু স্বরে একবার শুধু বলেছেন, যা, আজ থেকে তুইই সর্দার।
এটি জানতে পারলে আরও জানা যাবে যে, রহম আলী দিঘিরপাড়ের পথ ছেড়ে কৈলাগের সড়কে এসে নিজেই নিজের মৃত্যুকে টেনে এনেছে বলে গ্রামের লোকজন যে ধারণা করছে, তা শেষমেষ সত্য নাও হতে পারে। কেননা কেউ জানে না, সে রাতে সাতজনের দলটি দুভাগ হয়ে চারজন কৈলাগের সড়কের গাবগাছে ও বাকি তিনজন দিঘিরপাড়ের পথে এজমালী গোরস্থানের ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বহু মৃত্যু দেখা, ফিনকি দিয়ে ছোটা লকলকে রক্ত দেখা রহম আলী অনেক আগেই মৃত্যুর ঘ্রাণ পায়নি, এটা আর বলা যাবে না। বরং বলতে হবে, সে অনেক আগেই পেয়েছিল আর পেয়েছিল বলেই এক কিলোমিটার দূরে দিঘিরপাড়ের মৃত্যুটাকে উল্টা পথে এসে তিন কিলোমিটার দূরের কৈলাগের সড়কে নিয়ে আসতে পেরেছিল।
উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্দেশ কী ছিল—তা দলের আর কেউ না জানলেও রহম আলীর দলের নতুন সর্দারের ইচ্ছাটা সবাই বুঝতে পারে, আরও বুঝতে পারে যে, দুয়েকদিনের ভেতর ঘটনাটা ঘটবে এবং ঘটার আগ পর্যন্ত নতুন সর্দারের পরিচয়টা গোপন রাখতে হবে। কারণ সবাই বুঝে নেয়, নতুন সর্দার রহম আলীর কাছ থেকে শেখা বিদ্যা রহম আলীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে রহম আলীরই সর্দারি কব্জা করতে চায়।
৩.
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে সবরিকান্দার চরে কোনো একটি লোক যাকে তারা ধরে আনতো, তার রক্তের খলবলানি দেখতে রহম আলী তার দলের তিনজনকে বলতো, লোকটাকে শুইয়ে দিতে। লোকটার হাত-চোখ-মুখ বাঁধা থাকতো বলে সামান্য গোঙানি ছাড়া প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের আর কোনো উপায় থাকতো না। রহম আলী তার বাম হাতে মুঠো করে একহাতি ডেগারটা চেপে ধরে অন্য একজনকে বলতো,দম ধর।
একজন লোকটার গলা চেপে ধরলে রহম আলী গলার ওপর দিয়ে ছুরি চালিয়ে মুহূর্তে লোকটাকে নিস্তেজ করে দিত। একবার দুবার করার পর এই কাজটা সে অন্যদের দিয়ে করিয়েছে। তো, নতুন সর্দার, যে এই কাজটায় বহু আগেই পাশ দিয়েছে, সে রাতে, যে রাতে তারা রহম আলীর বিরুদ্ধে নামে, আরও তিনজনকে নিয়ে উপজেলা সদরের দিকে যাওয়া সড়কের পুরাতন গাবগাছে অপেক্ষা করে। সর্দারির মুরদ বুঝতে এইটা তার একটা প্রথম পরীক্ষা যে, সে দেখতে চায় তার অনুমান সঠিক করে দিয়ে রহম আলী এই পথেই আসে কি না। নইলে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে তার সর্দারির সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সে কায়মনে চায়, গোপন প্রতিপক্ষ হলেও তার ওস্তাদ রহম আলী এই পথ দিয়েই আসুক।
নতুন সর্দরের অনুমান ভুল হয়নি। দুভাগে বিভক্ত হওয়া যে দলটি নিয়ে নতুন সর্দার গাবগাছে অপেক্ষা করছিল রহম আলী তার মৃত্যুকে কবুল করতে বা নতুন সর্দারের অনুমান ঠিক প্রমাণ করতে বা যেকোনো কারণেই হোক, এই পথেই আসে। রহম আলী গাবগাছের পাশে আসামাত্রই পাঁচ ব্যাটারির লাইটের তীব্র একটা ফোকাস এসে তার চোখে ধাক্কা দেয়। হঠাৎ পড়া ফোকাসের ধাঁধাঁয় সে কেবল চোখের সামনে ডান হাতটা এনে আলোটা ঢেকে দিয়ে একবার ধমকে ওঠে, এই কেডারে? এরপরের ঘটনাটা কয়েক মিনিটের। নতুন সর্দার তার তিন সঙ্গী নিয়ে রহম আলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রহম আলী লুঙ্গি কাছা দেওয়ার সময় পায় না। সে দৌড়ে উপজেলা সদরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুখে হাঁটুতে লুঙ্গির প্যাচ খেয়ে পড়ে যায়। তখন সে হাতের পোটলা ফেলে দিয়ে সড়কের ওপর কেবল উঠে আসতে পারে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে সে তার দূরত্ব বাড়াতে পারে না। নতুন সর্দার ও আরও তিনজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে করতে রহম আলী সড়কের নিচে গড়িয়ে পড়ে। সড়কের নিচে অপেক্ষা করে থাকে খসখসে পাতার এক পুরাতন গাবগাছ।
রহম আলী পুলিসের হাতে ধরা দিলে কী হতো? সে কি নিয়ত করেছিল থানায় যাবে? সত্য স্বীকার করবে? যদি তাই হতো তবে এটাই হতো সমস্যা। কেননা রহম আলীর ক্ষমা চাওয়া মানেই যে তার সঙ্গী সাতজন ও তাদের আড়ালে ক্ষমতাধর অদৃশ্য উপজেলা চেয়ারম্যান স্পষ্ট হয়ে ওঠেন, এইটা রহম আলী জানতো। রহম আলী চাইলে সাতটা খুনের রহস্যের উদঘাটন সম্ভব হতো এবং এটাও জানা যেত যে, পরবর্তী সাতটা নামের কে কত নম্বরে আছে। অথবা পুলিশের হাতে ধরা দিলে এমনও হতে পারতো, পুলিশই ওকে মেরে ফেলতো আর ধরা না দিলে চলে যেতে পারতো ইন্ডিয়াতেও। কিন্তু এসবের কিছু যখন হলোই না তখন কৈলাগ-রাহেলা-দিঘিরপাড়ের চেয়ারম্যানবিরোধী পরবর্তী সাতটা নাম কে কবে লাশ হবে আপাতত সেই তথ্য ফাঁসের সম্ভাবনাও অনিষ্পত্তি হয়ে গেল।
কিন্তু কৈলাগের সড়কে গাবগাছের নিচে পড়ে থাকা নিজ গ্রামের রহম আলীকে গর্দান কাটা অবস্থায় প্রথম দেখা কলেজপড়ুয়া ছেলেটা আর মেয়েটা এখন কোথায়! মেয়েটা গতকাল কথা দিয়েছিল, জীববিজ্ঞান ক্লাসের আগে ফাঁকা ঘণ্টায় কলেজমাঠের শেষ মাথায় একটা জলপাই গাছের নিচে ছেলেটাকে প্রথম চুমু খেতে দেবে। কিন্তু কলেজমাঠের শেষ মাথায় জলপাই গাছের নিচে জীববিজ্ঞান ক্লাসের আগে ফাঁকা ঘণ্টায় তারা যখন পাশাপাশি বসে তখন মেয়েটা ছেলেটার দিকে তাকাতে চোখ তোলে আর তার চোখে জলপাই গাছের গাঢ় সবুজ পাতা ফুটে ওঠে। জলপাই গাছের পাতাকে তখন তার মনে হয় গাবের পাতা। আর ছেলেটা, অবশ্যই চুমু খেতে নয়, মেয়েটার চেহারার আতঙ্ক মুছে দিতে দুহাত দিয়ে তার গাল স্পর্শ করতে চায় আর তখন মেয়েটা দেখে, ছেলেটার গর্দান তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে খুলে আসছে। ছেলেটার হাত মেয়েটার হাত স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা অড়োড়োড়োড় শব্দে বমি করে জলপাই গাছের গোড়া ভাসিয়ে দেয়। মেয়েটার মুখ দিয়ে ভোরবেলা খেয়ে আসা পান্তা ভাত আর দই বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ বমির দিকে তাকিয়ে এক দৌড়ে একটু দূরে গিয়ে মেয়েটার থেকেও দ্রুত ও জোরে জোরে ছেলেটাও বমি করতে শুরু করে।