প্রথম পর্ব
শুরুটা ছিল অনেকটা শীতের হা-ভাতে বিকেলের মতো, টেট্রন কাপড় যেমন খসখসে হয়, ঠিক তেমনি। জীবন চলছিল শামুকের গতিতে। বয়সের খাতায় অলরেডি পঁচিশ আসন গেঁড়ে নিয়েছে । হন্যে হয়ে ঘুরছি এদিক-সেদিক। মায়ের মুখে দুমুঠো হাসি ফোটানোর রেস্পন্সিবিলিটি কাঁধে নিয়েছি, ইচ্ছাকৃতে। কিসের কী? অবস্থাদৃষ্টে যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে চিরাচরিত সংকটের অতলে ডুবে থাকা মধ্যবিত্ত আর কোনো দিন হাসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বিপদে পড়ে সামাজিকতা রক্ষার্থে হাসলেও তাদের মুখটা হয়ে থাকে ক্রনিক কনস্টিটিপেশানে ভোগা রোগীর মতো।
পরিশ্রম নাকি কিসের চাবিকাঠি, বইয়ের কথা, আমার ইতিহাস হয়ে যাওয়া বাবা নিজের মতো করে বলতেন। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখলে তার মান থাকে না। দেখা যাক না! মাস তিনেক আগে শ্বাসকষ্টে ভোগা ঘাম চিটচিটে স্বপ্নকে, প্লাস্টারহীন সিঁড়ি বানিয়ে মফস্বল থেকে পাড়ি জমিয়েছি রেড কার্পেট মোড়া রাজপথে। আমার মতো একজন বেকারকে এই শহর যে জায়গা দিতে সম্মত হয়েছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। বাপের উপদেশের সিক্স প্যাককে মনের গভীরে জায়গা না দিয়ে, ঘাড়ে ঝুলিয়ে শুরু হলো যাত্রা, যদিও এই বিশিষ্ট ভদ্রলোকের প্রতি আমার বিশ্বাসের কোনো কমতি ছিল না কখনো। কিন্তু তার উপদেশ শোনা আর গান্ধীজীকে আবার এই বাংলার বুকে ইনভাইট করে আনা একই কথা। অবশ্য যা শুরু হয়েছে তাতে একজন ওই টাইপের কাউকে খুব দরকার এই অসভ্য ইতরের দেশে।
ভার্সিটির প্রাক্তন বড় ভাইয়ের কল্যাণে এক টুকরো আশ্রয় মিলে গেলো, এক চিলেকোঠায়। চিলেকোঠার সাইজ অনেকটা মাঝবয়সী কবরের সমান। কবরের কি কোনও ফিক্সড সাইজ আছে? কারও কি জানা আছে এর ল্যান্থ অ্যান্ড ওয়াইড কত হওয়া প্রয়োজন? কখনো ঘুমাইনি, বলতে পারব না! চিলেকোঠায় একটা চৌকি। চৌকির মাপ যা, তাতে কাউকে কাফন পরিয়ে আঁটসাঁটো করে বেঁধে দিলে যে রকম হয়, ঠিক সেভাবে শুয়ে না থাকলে ধপাস হওয়ার আশঙ্কা আছে বই কি! সাঁট হয়ে ঘুমালেও পা দুইঞ্চি বাইরে থাকে! রুমে আমি একা না, রুমমেট আর একজন আছেন? প্রতিদিনই তার সঙ্গে আমার ছোটখাটো ক্যাচাল বেঁধে যায়। তিনি কেউ নন, তিনি হচ্ছেন তিন ফিট বাই আড়াই ফিট অ্যাটাচড টয়লেট।
আমি তাতেও খুশি! কম্প্রমাইজ করা মধ্যবিত্তের রক্তে মিশে আছে। ছোটোবেলায় তিন ভাই আর ছোটো চাচা একসঙ্গে অনেকটা গোয়াল ঘরের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে বড় হয়েছি, কোনো অসুবিধা ছাড়া তো দিব্যি পার করে দিয়েছি। কলেজের হোস্টেলে তো গণকবরে ছিলাম বেশকিছু দিন। আটাশ জন জীবন্ত লাশ এক হলরুমে!
ঢাকা শহরে নতুন, এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছি। শহরের গুহামুখ, গোড়ালি, হাঁটু, কোমর, পেট, বুক, ঘাড় সবটাই চিনে নেওয়ার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । টিউশন জুটেছে দুটো, তাতে যা আসে ডায়রিয়ার মতো খসে যায়, তবু চলছে। এই শহরে কথা শুনতে গেলেও টাকা লাগে, বাতাস পানি কোনো কিছুই বামহাতের লেনদেন ছাড়া নড়ে না। মফস্বল থেকে এই শহরকে আন্দাজ করা অসম্ভব। আমি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, শহরও আমাকে মেনে নিচ্ছে একটু একটু করে। এ সিস্টেমে এই শহর খুশি থাকতে পারলে আমি কেন পারব না? আমি ভাগ্যের সঙ্গে লেগে আছি চিবাতে থাকা ক্লান্ত চুইঙ্গামের মতো, উপায় তো নাই।
রোজ রোজ চাকরি বানানটা কমপক্ষে উনত্রিশবার আওড়ায়, তসবির গুটিতে আল্লাহর নাম জপা বাদ গিয়ে মামা চাচা খালুর নাম জপতে হবে মনে হচ্ছে। রাতদিন মামা চাচা খালু খুঁজে বেড়াই, প্রাক্তন বড় ভাই উধাও! অ্যাপ্লিকেশান করি, ইন্টারভিউ দেই, নাহ, গিঁট খোলে না।
সৌভাগ্য কখন বয়াম বন্দী হয় তা কেউ জানে না? তাই ছুটে চলা বন্ধ হয় না, বখতিয়ারের ঘোড়ার খুরের মতো শত চড়ায় উৎরাই পার হওয়ার জন্য এ পা দুটো সর্বদা ফিট।
আকাশের মা মরেছে! কন্টিনিউয়াস কেঁদে চলেছে, চারিদিক সয়লাব। বৃষ্টি হলেই এ শহরের ড্রেন আর ম্যানহোলগুলো ফেঁপে ওঠে। ম্যানহোলের কনটেন্ট মিলেমিশে একাকার হয়, তাদের উচ্চতা হাঁটু ছড়ায় মাঝে মাঝে, বস্তিতে হাজারো স্বপ্ন ছারখার হয়। এত বৃষ্টি অনেকদিন দেখেনি এ শহর। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে তাতে একথা নিশ্চিত এ শহরের দখল নেবে নৌকা। খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে বাধ্য হয়েই বেরুতে হলো। ছ্যাপ ছ্যাপ আওয়াজ তুলে এই শহরের রোবটগুলো ছুটছে আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে গালি ছুঁড়ে দিচ্ছে! হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়লাম, না শরীরের ফুয়েল এখনো গ্রিন দাগেই আছে।
একটা সার্কাস হচ্ছে। বেশ দর্শকও জুটে গেছে, এই শালা বাঙালী খুব খারাপ জাত, মা মরার খবরও যদি আসে, আর পথে যদি কোন হকার, ওঝা বা কবিরাজকে কেন্দ্র করে কোন জটলা দেখে, দাঁড়িয়ে পড়বেই। আমিও তো তাদেরই দলের একজন। অতএব দাঁড়াও।
হকার কবিরাজ না, এতো সাক্ষাৎ মা দুর্গা, মা রুদ্র মূর্তিতে, তাকে ঘিরেই এই জটলা। হাফ ডুবো একটা চকচকে প্রাইভেট কার মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে। উনি পদার্পণ করবেন কিন্তু পারছেন না ডুবো নোংরা জলের জন্য। বহুত চেষ্টা হল, নাহ কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, দেবীর পা যদি একবার এই পানি ছুঁয়ে ফেলে তবে তো নির্ঘাত পচন ধরবে। আহাম্মক ড্রাইভার দাঁড়িয়ে বহুত কসরত করে যাচ্ছে, ঠেলাঠেলি করেও কিছু হচ্ছে না, সে তো কাজের সংজ্ঞা জানে না। দেবীর বয়স কত হবে? আন্দাজের বাইরে। বয়স ঠাওরানোর রিস্ক নেওয়া যাবে না। এই আজব চিড়িয়াখানায় মাঝেমাঝে মা-মেয়ে গুলিয়ে যায়। মা কে মনে হয় মেয়ে আর মেয়ে কে মা। ভয়ে তাকাতে পারছি না। এত সুন্দরও কেউ হয়? এর ওর ঘাড়ের ফাঁক গলে খরাপীড়িত পঁচিশ বছর বয়সী বসন্ত তবু ঠিকই দেবী দর্শন করে যাচ্ছে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে ইতোমধ্যে।
হঠাৎ মুখ খুললেন তিনি, যেন মুক্তো ঝরছে, হাতও নাড়লেন, নেড়ে বললেন, ‘এই যে এদিকে আসুন’। সব উৎসুক দৃষ্টি স্থির হলো সেই দিকে, যেন মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন দেবী।
এই যে আপনাকে বলছি, ‘এদিকে আসুন।’
কেউ এক পা-ও এগোলো না, যেন সব জমে বরফ!
আপনাকেই তো, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই, ‘এই যে টি শার্ট এদিকে আসুন।’
সামনে পেছনে ডানেবামে তাকিয়ে টি শার্ট খুঁজতে লাগলাম হন্যে হয়ে। টার্গেট কি তাহলে আমি!
আমাকে বলছেন? আমি কেন ট্রিগারের মুখে! কী দোষ করলাম বাবা? আশেপাশের মুখগুলো পাংশু হয়ে গেলো, সাহস করে এগিয়ে গেলাম! দেখি কী হয়!
‘জি আমাকে বলছেন’
হ্যাঁ আপনাকেই তো, ‘এগিয়ে আসুন এদিকে’, এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন যেন আদেশ মান্য করা ছাড়া এই মুহূর্তে মরণডাকে সাড়া দেওয়াও হবে চরম গর্হিত অপরাধ। লোক দেখানো কনফিডেন্স দিয়ে এরা সব কিছু দখলে নিয়ে নেবে!
‘কোনো কিছু না বুঝেই এগিয়ে গেলাম আমি’, যেন রোবটের রিমোট টিপে কেউ ঘোরাচ্ছে আমাকে।
তিনি যা বললেন, তা অনেকটা এ রকম, তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে এবং এটা মহারানির আদেশ। নর্দমা উপচেপড়া পচা পানিতে হড়হড়িয়ে নামতে যাব, এমন সময় হৈ হৈ করে বললেন, ‘গাধা নাকি? স্যান্ডেল খুলুন, প্যান্ট গুটিয়ে এদিকে আসুন।’
আমার ঘাড়ে ভর দিয়ে, নোংরা স্পর্শ না করেই উদ্ধার পেলেন দেবী। আমার ঘাড় কি এত চওড়া? নিজেকে আমার বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেবী এগিয়ে গেলেন। রাম্পে হাঁটার ভঙ্গিমায় হেঁটে গেলেন রাস্তা সংলগ্ন অফিসের গেটে। ঢুকে পড়লেন অফিসে। হেঁটে চলে গেলেন হনহন করে, কিছু না বলে, একবারও পেছনে না তাকিয়ে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলাম চলে যাওয়া, আমার প্যান্ট চুয়ে নোংরা পানি ঝরছে এখনো। এরা কি এভাবেই ব্যবহার করে যাবে আমাদের!
ভিড় ততক্ষণে যার যার ঠিকানা খুঁজে নিচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে এর চেয়ে বড় আহাম্মক আর কোনো দিন মনে হয়নি। দাঁড়িয়ে আছি নিষ্পলক বোকা বালকের মতো, নিঃস্ব। আরে কি জঘন্য অদ্ভুত!
হঠাৎ ঝড়ের বেগে কাঁপুনি তুলে আবার এগিয়ে আসছেন আমার দিকে, আবার কি আদেশ হয় কে জানে!
আপনার নম্বরটা বলুন তো, তাড়াতাড়ি।
হড়হড় বলে গেলাম মোবাইল নাম্বার।
কোনোকিছু না বলেই যথারীতি বিদায় নিলেন তিনি। কিছুই বুঝলাম না। মনে মনে নিজেকে গালি দিতে দিতে আর নোংরা ছড়াতে ছড়াতে শবযাত্রায় মিশে গেলাম, ছুটতে থাকলাম গন্তব্য অভিমুখে। কোথায় আমার গন্তব্য!
যতই রাগ উঠছে, ততই মনে পড়ছে মুখটা, যতবার আহাম্মক হওয়ার কথা মনে হচ্ছে ততবার সেই ডাকটা শুনতে পাচ্ছি, এই যে টি শার্ট এদিকে আসুন! যন্ত্রণা!
বাবা-মায়ের দেওয়া নামটা হল টি শার্ট। মনের মধ্যে একটা ছটফটানি ভাব আসছে! কী হলো আমার? নোনা জল অযাচিত ঢুকে পড়ছে মনে!
দৌড়ঝাঁপের মধ্যে কয়েকদিন ভালোই ছিলাম। মাঝেমাঝে এলেও খুব বেশি পেয়ে বসেনি, বেঁচে যাচ্ছি বোধ হয়! আস্তে আস্তে বিস্মৃত হয়ে চর পড়ে যাচ্ছে মনে, সেই দেবী চেহারা আর কোনো ঝামেলা পাকাতে পারছে না, যাক বাবা!
বিপত্তি এলো কল হয়ে। হ্যালো, আপনি সেই টি শার্ট তো ?
বুকের মধ্যে ধাক্কা খেলাম, হ্যাঁ, না, মানে!
কি হ্যাঁ না মানে করছেন!
মনের মধ্যে সেই ছটফটানি ভাবটা আবার আসছে! কী যে হলো আমার? বাঁধ কি তবে ভেঙে গেলো! এই শালা মধ্যবিত্তকে নিয়ে যত ঝামেলা!
শুনুন সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে ধন্যবাদটা দেওয়া হয়নি আপনাকে। কাল আপনি ফ্রি আছেন? উত্তরের ধার না ধরেই বলে চললেন আগামীকাল দুপুর সাড়ে তিনটার সময় ঠিক যেখানে আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সেখানে দাঁড়াবেন, আমি এসে ফোন দেব। আর হ্যাঁ ওই টি শার্টটাই পরবেন, আপনার চেহারা আমার মনে নাই, টি শার্ট দেখে আমি ঠিক চিনে নেব!
নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে, কে বড়, টি শার্ট না আমি, আমি না টি শার্ট? আভিজাত্যের তোড়ে এরা আমাদের এভাবে নিলামে চড়াবে?
সিদ্ধান্ত ফিক্সড, কোথাও যাব না, কিসের নিউমার্কেটের গেট, কিসের টি শার্ট, গুষ্টি কিলায়! মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো!
যতই রাগ বাড়ছে, ততই মনে পড়ছে মুখটা, যতবার আহাম্মক হওয়ার কথা মনে পড়ছে ততবার সেই ডাকটা শুনতে পাচ্ছি, এই যে টি শার্ট এদিকে আসুন! যতবার নিলামের কথা মনে হয়ে কষ্ট পাচ্ছি ততবার বিকাল সাড়ে তিনটা ডাকছে, যতবার মনে পড়ছে সে কথা, আপনার চেহারা আমার মনে নেই, ততবার টি শার্ট গায়ে জড়াতে ইচ্ছা করছে, নিউমার্কেটের গেটকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে দর্শনীয় স্থান!
কী যন্ত্রণা! মনের মধ্যে ছটফটানি ভাবটা তোলপাড় করছে! কী হলো আমার ?
পরদিন ঘড়ির কাঁটাকে সাড়ে তিনটায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবার জন্য কি হাপিত্যেশ। আগে তো কখনো এরকম হয়নি!
দুপুর বারটা নাগাদ টি শার্টের মধ্যে ঢুকে বসে আছি!পৃথিবীর সবচাইতে দর্শনীয় স্থানে সেরা সৃষ্টি দেখার জন্য আর তর সইছে না! যদি না আসে, যদি বিশ্বাস নিলামে চড়ানোর জন্য এটি আর একটা খেলা হয়! মধ্যবিত্তের কনফিউশন দূর হবে না, এটাই কুরেকুরে শেষ করে দিচ্ছে এদের! আশাই আবার এদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
টি শার্টসমেত আমি দুপুর দুইটা থেকে নিউমার্কেটের গেটে, মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বলছে তুই তো শেষ! বাতিলের খাতাই নাম লেখালি।
পুরো হার্টটাই দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলছে!
দাঁড়িয়েই আছি, কোনও খবর নাই, কী যন্ত্রণা, না পারছি চলে যেতে, না থাকতে।
সাড়ে তিনটা পেরিয়ে বিকেলে ঠেকেছে সময়, খিস্তি আওড়াতে খুব মন চাইছে, এমন অপমান! এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা!
উঠুন, আভিজাত্যের তোড়ে ফুঁসতে থাকা একটা লাল রঙা এলিয়েন এসে পাশে দাঁড়িয়ে সেই দখল করে নেওয়া টোনে আবারও বলল, এই যে টি শার্ট উঠুন!
গুরু ভক্তিতে নতজানু ভক্তের মতো উঠে গেলাম, কী জানি হয়ে গেলো!
এরপর মাঝে মাঝে কথা হতো। না মাঝে মাঝে নয় প্রায়ই কথা হতো, প্রায় না প্রতিদিনই কথা হতো। দিনে এগার বার রিং, সাত বার মিসড কল, সপ্তাহে সাড়ে তিন বার দেখা, মাঝে মাঝে হাতের মধ্যে, মাসে একবার চিলেকোঠায়, একে অন্যের মাঝে নির্ভরতা খুঁজে নেওয়া। নেহাত মন্দ না। এগুলোই যদি প্রেমের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে তবে মনে হয় প্রেম করছি খুব!
একটা প্রশ্নের উত্তর আজও দেয়নি সে, সেদিন কী জন্য টি-শার্টকে কাছে ডেকে নিয়েছিল? উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আছি!
জলেশ্বরীতলা লেন, থার্টিন বাই টু, একান্ত আপনের গেট মাঝেমাঝে দীনহীন মধ্যবিত্ত টি-শার্টের জন্য উদোম হচ্ছে ইদানীং…
দেখা যাক মধ্যবিত্ত টি-শার্ট কোথায় গিয়ে ঠেকে? একটা চাকরির প্রয়োজন ছিল খুব।
অন্তিম পর্ব
ভালোবাসার প্রারম্ভিক চুক্তিগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর আমাদের প্রেম একটা চেহারা নিয়েছিল, ইলেক্ট্রিক রেলের গতিতেই চলেছে। কেএফসি, অ্যানড্রয়েড ফোন, সিনেপ্লেক্স ছাড়া এ প্রেম জমবে? তারপর আমার মতো চুলোহীন, চালের খরচ তো বাদই দিলাম।
গত তিনমাস তোমাদের জলেশ্বরীতলা লেনের থার্টিন বাই টু, একান্ত আপন-এর পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তোমার দেখা পাইনি। জলেশ্বরীতলা লেন, থার্টিন বাই টু, একান্ত আপন। দিনে ন’বার প্রদক্ষিণ করেও কালো বাটনের কলিং বেলটাকে ডিস্টার্ব করার সাহস জোটেনি। অ্যালসেসিয়ানটা যদি ফুঁড়ে আসে আভিজাত্যের তোড়ে!
ফোন ধরছ না, এসএমএস-এর উত্তর দিচ্ছ না। গত তিনমাস তোমার দেখা পাইনি। এদিক-সেদিক ঘুরেছি, করপোরেশনের ঊনত্রিশ নাম্বার ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়েছি, যেখান থেকে তোমার জানালাকে দেখা যায় দিব্যি, যদি একবারও দেখা হয়ে যায়, যদি মুক্তি মেলে অদ্ভুত আসক্তি থেকে! মোবাইল কল রেসপন্স করছ না। যাকে চাই না সে হাজারো ফিরিস্তি শোনাচ্ছে, বাংলায় চাইলে এক, ইংরেজিতে দুই। পেটে শুধু ইঁদুর খেলা করেছে প্রতিদিন। কিছু না পেয়ে শূন্য গুদাম থেকে ফিরে গেছে নিঃশব্দে, খিস্তি আওড়াতে আওড়াতে। মানিব্যাগের তলানি ঘেঁটে আর কিছু মেলে না, টিউশন পার্মানেন্ট ছুটি নিয়েছে, ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় দিন কাটছে। আর কতকাল অপেক্ষায় কাটাতে আমাদের। তোমাদের লোহার রাশভারী গেট গলিয়ে নতুন মডেলের এলিয়েনকে মাঝে-মাঝে অজানার দিকে ছুটে যেতে দেখা গেছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে, আশেপাশে ভ্রূক্ষেপ না করেই। সুযোগ বুঝে গাড়ির জানালায় চোখ মেলেছিলাম, জানালার অহঙ্কারী গ্লাস আমার চেহারাকে কাবাব বানিয়ে আবার আমাকেই ফেরত দিয়েছিল।
জলেশ্বরীতলা লেন, থার্টিন বাই টু, একান্ত আপনকে আমি ভুলে যাব! চাইলেও পারছি না, আমাকে জানতেই হবে। দেখি বিশ্বাস নোনা জলে ভেসে কোথায় গিয়ে ঠেকে, কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এড়িয়ে গেলে কিভাবে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব না, ইদানীং লোহার রাশভারী গেট পেরিয়ে তোমার গাড়িটিকে আর দেখা যাচ্ছে না! তোমার। নিয়ম করেই দাঁড়াচ্ছি, জানালাটা বন্ধ থাকে এখনো।
অনেকদিন পর এসএমএস পেয়ে ছুটছি, অদ্ভুত আসক্তি থেকে মুক্তি মিলবে নিশ্চয়! ঠিকানা খুঁজে নিতে দেরি হলো না! কেন তুমি এড়িয়ে গেছ আমাকে, এই প্রশ্নের উত্তর তো আমার চাই। কিন্তু এখানে কেন?
ঠিকানা অনুযায়ী ঢুকতেই চোখে পড়লো অনেককে, শুধু তোমাকে আর তোমার বাবা-মা কে দেখছি না, পরিবারের অন্য সদস্যদের সবাইকেই চিনি আমি। মনে হলো সবাই এখানে, তোমার বাবার কোনও অসুখ বা অ্যাকসিডেন্ট? কে জানে!
কেউ একজন আমাকে কেবিনটি চিনিয়ে দিলো, তোমার মা-ও তো অসুস্থ ছিলেন, তুমি কি মায়ের পাশে? তবে কি তিনি!
কেবিনে ঢুকেই তোমার মাকে দেখলাম, তোমার বাবা আর তোমাকে দেখছি না। কোথায় তুমি, কতদিন পর তোমায় দেখব, উত্তেজনায় আমার সমস্ত রাগগুলো পেঁজাতুলোর মতো উড়ে গেছে! মিলনের তীব্র সুখানুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ক্রমশ। অদ্ভুত আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছি আমি! সমস্ত অবহেলার কথা মন থেকে ধুয়ে যাচ্ছে ফেনিল ঢেউয়ের মতো, তোমাকে দেখবো…তোমাকেই! তুমি কই, এই যে টি-শার্ট বলে আবার তুমি ডাকবে, গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে উধাও হয়ে যাবে, আমার হাতটি ধরে রাখবে পরম আগ্রহে, সিগারেট কেড়ে নিয়ে ছুড়ে মারবে, সব মনে পড়ে যাচ্ছে আমার, স-ব। তুমি কি ফ্রেশ রুমে গেছ, আমার দৃষ্টি বারবার চলে যাচ্ছে টয়লেটের দরজার দিকে, কেবিন লাগোয়া বারান্দার দরোজাটা খোলা, তুমি কোথায়? আর ধৈর্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না! মাকে জিজ্ঞেস করতে যাব, সেই মুহূর্তেই, কেউ একজন এসে ঢুকল কেবিনে, আমার দেখার সময় নেই, আমি খুঁজে চলেছি তোমাকে! ডাক্তার হতে পারেন।
স্যরি মা, আমাদের যা কিছু করার ছিল আমরা সবকিছুই করেছি, কিন্তু! বলল ডাক্তার! উনি আইসিইউতে আছেন, আপনি দেখতে যাবেন, তোমার মা না সূচক মাথা নাড়লেন, কাঁদছেন তিনি।
কার কথা বলছেন ডাক্তার, কার কী হয়েছে? তোমার বাবা অসুস্থ ছিলেন, উনি মারা গেছেন? তুমি তবে আইসিইউতে তার সঙ্গেই আছ?
ডাক্তার বেরিয়ে যেতেই পিছু নিলাম তার, আইসিইউয়ের গেটে কেউ আটকালো না, ড্রেস পরিয়ে নিয়ে গেল বিছানাটার কাছে, এখানেও তুমি নেই! তোমার বাবার লাশটা ঢাকা আছে সাদা কাপড় দিয়ে।
সিস্টার সাদা চাদরটা মুখ থেকে সরিয়ে দিল। মুহূর্তেই আমার সমস্ত পৃথিবী কালো কাফনে ডুবে গেল। ডাক্তারকে মনে হলো মৃত্যুদূত, মুখস্তের সুরে তিনি বলে গেলেন, গত তিনমাস তুমি নাকি এই বিছানাতেই ছিলে!