বাতাসের কানে ফিসফিস শব্দ। অন্ধকার ফুঁড়ে মাটিতে,বালিতে ঘষা লেগে এগুচ্ছে একদল মাতাল। পেছনে ছুটছে সদ্য নয়ে পা দেওয়া ঝুমুর। কান্নার শব্দ নেই গলায়। দৌড়ের দিক ঠিক রাখতে হোঁচট খেলো বারকয়েক। মাতালগুলো কাঁদছে, কিন্তু ঝুমুরের মনে হলো কুকুরের ডাক। গলির মোড়ে মাঝরাতে অনেকদিন এমন কুকুরের কান্না শুনেছে ঝুমুর। মায়ের ঘরে তখন যাওয়া বারণ থাকতো ঝুমুরের। মাঝে মাঝে সারারাতেও মা আসতো না কাছে। তখন ঘুম আসতো না ওর। মা যতটুকু সময় থাকতো, খুব আদর করতো ঝুমুরকে। কিন্তু কতটুকুইবা পেতো ঝুমুর!
ওদের এই পল্পীর বড় আপা মানে ঝুমুরের বড় খালা কেমন অদ্ভুত, বুঝতে পারে না সে। সব খালাকে সারাক্ষণ ঘর বন্ধ করে কাজ করায়। অফিসের নানা মিটিং থাকে সারাক্ষণ। তার মাকে দিয়ে কাজ করাতো সবচেয়ে বেশি। ঝুমুরকে কাছে ঘেষতে দিতো না। মা একটু আদর করলেই মাকে বকাঝকা করতো। ঝুমুর বুঝতে পারে না, কেন এমন করে বড় খালা। যেদিন ঝুমুর মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারতো, সেদিন কত গল্প করতো। বলতো, মা, এখান থেকে আমরা অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকি চলো। তুমি অন্য একটা চাকরি খুঁজে নিও। ও মা, চলো আমরা আমাদের দাদা বাড়ি চলে যাই। আচ্ছা মা, আমাদের দাদাবাড়ি কোথায়?
মা কোনো কথা বলতো না। বুকের মধ্যে ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যেতো। ঝুমুর আর দুঃখ দেবে না বলে চুপ করে থাকতো।
ঝুমুর দেখলো মাতাল দলের সর্দার মানে রাসেল কাকা হঠাৎ করে বালি খুঁড়তে শুরু করলো। টর্চের আলোতে কোদালের ফলাটা চকচক করে উঠলো। তারপর মায়ের শাড়িটা দেখতে পেলো দূর থেকে ও। মাকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে দিচ্ছে ওরা। ঝুমুর দৌড়ে কাছে আসতেই মাতালের দলটা দৌড় লাগালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামিদা খালা ঝুমুরের হাত ধরে ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো একজন। ঝুমুর মায়ের কাছে যেতে পারলো না। মায়ের ফুল, পাতা আঁকা শাড়িটাও আর দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আলো ছাপিয়ে একগুচ্ছ মশালের আলো আর লোকজনের চিৎকার, চেঁচামেচি কাছে আসতে লাগলো ঝুমুরের।
০২.
দৌলতদিয়া রেলগেট পার হয়ে পূর্বদিকে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই নীল আর গোলাপি রঙের করা দুই সারি টিনশেড ঘর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পশ্চিমে প্রমত্ত পদ্মা। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। মানুষের ব্যস্ততা, হাঁকডাক, দোকানিদের চিৎকার, খাবারের ঘ্রাণ, যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া। উত্তর-দক্ষিণে ভদ্র লোকদের বসবাস। পূর্বদিকের এ পাড়াটি একেবারেই নিঃসঙ্গ। আশেপাশে কোনো ভদ্র পাড়া নেই। গুটিকতক দোকানপাট গড়ে উঠেছে। দোকানগুলোর পেছন দিকটাতে বেশ ফাঁকা জায়গা, বালুময়। সেটা পেরিয়ে ঘন আম বাগানের পরে দু’চার ঘর গৃহস্থের অস্তিত্ব দেখা যায়। তবে তারা টিন দিয়ে বিশাল প্রাচীর গড়ে ঘিরে রেখেছে নিজেদের। এ পাড়ার বাতাসটুকুও যেন ওদিকে না যায়, সেটা আটকানোর চেষ্টা।
‘আরে শালা তোরা ভদ্রলোকেরা আইসাই তো আমগো অপবিত্র বানাইছোস,তোগো ছোঁয়ায় আমরা পতীতা কিন্তু তোরা ভদ্রলোক! হায়রে দুনিয়া।’
নীল,গোলাপি টিন শেড ঘরের সারির পাশ দিয়ে সরু একটি খাল বয়ে গেছে আপনমনে। পদ্মাার সঙ্গে সংযোগ পেয়েছে শেষ মাথায় গিয়ে। প্রবল জোয়ারের সময় খালটি কানায় কানায় ভরে ওঠে। তখন এই খালের পানিতে সবাই কাজ সেরে নেয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। মেয়েরা ধোয়ামোছা,গোসলসহ সব কাজ সারে।
এই খালটির বাম দিকে ২য় নীল রঙের ঘরটি সালমার। মেয়ে ঝুমুরকে নিয়ে থাকে সে। ঝুমুরকে দৌলতদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণীতে ভর্তি করিয়েছিল সালমা। নিজের মতো মেয়েটার জীবন না হোক, সারাক্ষণ এই এক চিন্তা তার। গোসল সেরে পরিষ্কার লাল রঙের শাড়ি পরে নিলো সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা বুক থেকে নামিয়ে নিলো বেশ কিছুটা। তাতে বুকটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। দামি সুগন্ধী লাগিয়ে গেটের পাশে বিশেষ কায়দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কত সহজেই সালমা এখন এই ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। সবার চেয়ে তাকেই সুন্দর লাগে। এমন আবেদনময়ী এখানে আর কেউ নেই। সন্ধ্যা হলেই এ পাড়ার রাস্তায় বিভিন্ন সুগন্ধীতে মৌ মৌ করে। তার সঙ্গে যোগ হয় হাসির ফোয়ারা। সালমাকে সবার আগে পছন্দ করে কাস্টমার। দুধে আলতা গায়ের রঙ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক এবং রুচিশীলতায় সালমা নজর কাড়ে কাস্টমারের। তাই দলের নেত্রী মানে বড় আপার কাছেও সালমার কদর অন্যরকম। এসব দেখে হিংসা করে বাকিরা। একই কাজ করলেও সালমার ভাবসাব যেন অন্যরকম। তবে হামিদা আলাদা সবার চেয়ে। সে ভালোবাসে সালমাকে, ভালোবাসে মেয়ে ঝুমুরকে।
আজ সালমার মনটা বিষণ্ন। ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা টেনে লাইনে দাঁড়ালেও বুকের মধ্যে চাপা কান্না। দুপুরে মেয়েটা স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিল। স্কুলে মেয়ের পাশে কেউ বসে না। কেউ কথা বলে না। ঝুমুরের কোনো বন্ধু নেই। তাতেও সমস্যা হতো না। ঝুমুর চুপচাপ ক্লাস করতো। কিন্তু আজ অভিভাবকরা আন্দোলন করেছে। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে সবাই মিটিং বসিয়েছিল। সালমাকে ডাকা হয়েছিল স্কুলে। প্রধান শিক্ষক বুঝিয়ে বললেন, আমরা চেষ্টা করেছিলাম ঝুমুরকে রাখতে স্কুলে কিন্তু নিরুপায়। আমরা শিক্ষক আমাদের কাছে সব শিক্ষার্থী সমান। কিন্তু এমন সমস্যার মুখে আমরা নিরুপায়। ভদ্র লোকদের ভাবনা আর মানসিকতা দেখে অবাক হয়েছে সালমা। কোর্টটাই পরা ভদ্রলোক, তাদের স্ত্রীরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। একজন জোরে জোরে বারবার বলছে, ‘একজন নটীর মেয়ে এই স্কুলে পড়লে এখানে কোনো ভদ্র লোকের ছেলেমেয়েরা পড়বে না ।’ঝুমুরকে হাত ধরে বাড়ি ফিরেছিল সালমা। ঝুমুর এত কিছু বোঝে না। শুধু বোঝে তার স্কুলে পড়া হবে না আর। মাকে কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞেস করেছিল, মা, নটী কী?
কী বলবে সালমা, ভেবে না পেয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিল বুকে। কিছুই বলার নেই সালমার আজ। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ঝুমুর। সালমা উদাস হয়ে ঘরের চালার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী পাপ করেছিল সে? কিসের শাস্তি দিচ্ছে আল্লাহ তাকে? এ জীবন কি সে চেয়েছিল? অভাবের তাড়নায় মা-বাপ না খোঁজ নিয়েই এক মাতালের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। ঢাকা শহর দেখানোর নাম করে সেই মাতাল তাকে বেচে দিয়েছিল এই পল্লীতে। ঝুমুর তখন ২ মাসের পেটে। কত হাতে পায়ে ধরেছে এখানকার সবাইকে। মুক্তি ভিক্ষা চেয়েছে। তারা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিল সালমাকে। ছাড়বে কেন? সালমার যাওয়া হয়নি কোথাও। মেয়েটাকে নষ্ট করার চেষ্টা করেছে সবাই। কত যুদ্ধ, কত অত্যাচার সহ্য করে মেয়েটাকে পৃথিবীতে এনেছে। কিন্তু এখন মনে হয় সালমার, মেয়েটাকে পৃথিবীতে না আনলেই ভালো হতো। আরেকজন পতিতার সংখ্যা বাড়ালো সে। যতই চেষ্টা করুক সালমা,কতদিন পারবে ঝুমুরকে আড়াল করে রাখতে। ভাবতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে সালমার। ঘুমন্ত মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু খায়। যে করে হোক ওকে বের করতে হবে এ অন্ধকার জীবন থেকে। এমন সময়, দরজার সামনে নুপুরের গলা। সূর্য ডুবে গেছে, নিজেকে রাঙিয়ে খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করার প্রস্তুতি নিতে হবে।
মেয়েকে বুকের ওপর থেকে নামিয়ে কাঁথা টেনে দেয় সালমা। খাবার বেড়ে রেখে চিরকুট লিখে বাইরে থেকে তালে দিয়ে দেয়।
০৩.
ঘরে বসেই লেখাপড়া করে ঝুমুর এখন। মা ঘরের মধ্যে টিভি এনে দিয়েছে। পড়ালেখা, খাওয়া দাওয়া আর টিভি দেখা। ঝুমুরকে বাইরে বের হতেই দেয় না মা । কিন্তু ঝুমুরের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে ভীষণ। এমন বন্দি জীবন একদম ভালো লাগে না। খেলতে ইচ্ছে করে, স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে, ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করে। মা তাকে কেন যে বন্দি করে রাখে কিছুতেই বুঝতে পারে না সে। ঝুমুরের ভালো লাগে সাজতে। কিন্তু সাজে না। একদিন সেজেছিল মায়ের লিপিস্টিক, কাজল দিয়ে। মায়ের তেমন রূপ আর কোনোদিন সে দেখেনি। ঝুমুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সালমা। আঁচড়ে, কামড়ে পাগলের মতো করেছিল। ভয় যতটা পেয়েছিল ঝুমুর, তার চেয়েও অবাক হয়েছিল বেশি। আর কোনোদিন ও সাজবে না, সে প্রতিজ্ঞা করেছিল নিজে নিজে।
সকাল থেকেই খুব চিৎকার, চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। সালমা সকালের দিকে এসেই ঘুমিয়েছিল মেয়ের পাশে। সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল। মেয়ে তার স্কুলের ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাচ্ছে। হাসিমাখা মুখ দেখে সালমার ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা দেখা দিলো। এর মাঝেই ঘুম ভেঙে গেলো চেঁচামেচির শব্দে। বেরিয়ে দেখলো গেটের কাছে সবাই জড়ো হয়ে একসঙ্গে কথা বলছে। সবার একসঙ্গে কথা বলার কারণে একটা কথাও উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। কাছে এগুতেই রেণুকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখলো সালমা। এ কী চেহারা রেণুর! আঁতকে উঠলো সে। মাথার চুল ন্যাড়া, মুখে-মাথায় কালি মাখানো। বড় আপা রাগে লাল হয়ে আছে। গালাগালি দিচ্ছে ইচ্ছেমতো। নতুন মেয়েগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
‘আমগো কাছ থেইক্যা দুদিন পরপর চান্দা নিয়া যাও, সেই টাকা দিয়া অনুষ্ঠান চালাও,তাতে গন্দ লাগে না? আমগো শরীলডা রাইতের আন্দারে বেহেশতের হুর অইয়া যায়,দেবী অইয়া যায়, দিনের আলোতে আমরা পাপি? শালা ভণ্ডের দল।’
বড় আপার সঙ্গে সঙ্গে হামিদা গলা মিলিয়ে বললো, ‘আরে শালা তোরা ভদ্রলোকেরা আইসাই তো আমগো অপবিত্র বানাইছোস,তোগো ছোঁয়ায় আমরা পতীতা কিন্তু তোরা ভদ্রলোক! হায়রে দুনিয়া।’
সালমা চাঁদা তোলার বিষয়টা জানে। এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দোহাই দিয়ে দুদিন পরপর চিঠি দিয়ে চাঁদা তোলা হয় ওদের কাছ থেকে। এই-এক যন্ত্রণা। পুলিশের কাছে বলেও তেমন লাভ হয়নি। সালমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘যে টাকা রোজগারের জন্য আমরা অস্পৃশ্য, সমাজে ঘৃণিত, সেই টাকা তুলে করা হয় ভদ্রলোকের সম্মানে অনুষ্ঠান! টাকার গায়ে কখনো পাপ লাগে না, যত পাপ পৃথিবীর দুর্বল মানুষের গায়ে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু আজকের ঘটনা চাঁদা নিয়ে নয় সেটা স্পষ্ট। রেণুর ভয়ঙ্কর চেহারা বলে দিচ্ছে মারাত্মক কিছু ঘটেছে। পুরো ঘটনা শুনে সালমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, সামনে কি ঝড় ই না উঠতে যাচ্ছে।’
কিন্তু এ ভদ্র সমাজের মানুষগুলোর রাতের অন্ধকারে চেহারা বদলে যাবে যতদিন, মুখ আর মুখোশ আলাদা হবে যতদিন, এমন পল্লী বেঁচে থাকবে ততদিন। এ আমি কেমনে ফেরাবো মা?
এলাকার এক ছেলে প্রেমে পড়েছে রেণুর। রেণুও তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসা এ পল্লীর মেয়েদের জন্য পাপ। এত বড় ভুল কী করে করলো রেণু! ঘরবাঁধার স্বপ্ন দেখতে নেই এটা কেমন করে ভুলে গেল তা ভেবে পায় না সালমা। আসলে কার মনে কখন ভালোবাসা জন্মায় সেটা বোঝা মুশকিল। মন যে সবসময় শাষণ মানে না। রেণুর ভালোবাসার কথা জানাজানি হওয়াতে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ছেলেটা রেণুকে নিয়ে ঘরবাঁধবে বলে এ অন্ধকার জীবন থেকে হাত ধরে আলোতে নিয়ে পালিয়েছিল কিন্তু বাস্তবতা রেণুর মাথা মুড়ে সারা শরীরে কালি লেপে আবার সেই অন্ধকারেই ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।
০৪.
বেশ কিছুদিন চলছিল সব একই নিয়মে। সন্ধ্যার পরপরই দামি দামি সুগন্ধীতে মাতোয়ারা এ পল্লীর অলিগলি। আর বিভিন্ন ঘর থেকে বেজে চলা পুরনো, আধুনিক, হিন্দি, ব্যান্ড গানের সুরের মিশ্রণে অন্যরকম আলো আঁধারের এ জগৎ। কিন্তু অনেকদিন পর আজ আবার চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্নার শব্দ। ঝুমুরের ঘরবন্দি জীবনে শুধু কৌতূহল বাড়ে। ঝুমুর সতর্ক হয়ে শোনার চেষ্টা করে কী হয়েছে। মা এখনো ফেরেনি ঘরে। সবার কথা শুনে বেশ বুঝতে পারে ঝুমুর যে রেণু খালাকে কেউ গলা কেটে মেরে ফেলে গেছে। সবাই ধারণা করছে তার প্রেমের পরিণতি এই হত্যা কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই কারও কাছে। কেউ পাশে দাঁড়াবেও না। এমন মেয়েদের কপালে এর চেয়ে ভালো কি হতে পারে? উৎসুক জনতার মাঝখান থেকে বলে গেল কারা যেন।
বড় খালা চিৎকার করে বলছে, ‘তোদের মধ্যে ভালোবাসার, ঘরবাঁধার শখ কারও হবে আর?’ সবাই কাঁদছে। রেণু খালার মুখটা মনে পড়ছে ঝুমুরের। মা আর হামিদা খালার কথা শুনতে পাচ্ছে ঝুমুর।
-মরার পরও যদি জানাজা আর একটু মাটি পাওয়া যাইতো! কী জীবন আমগো!
কোনো মানুষ পাওয়া যায়নি জানাজা পড়াতে। কোথাও কবর দেওয়ার সুযোগ নেই। কবরস্থানে পতিতাদের মাটি দেওয়া যাবে না। এখানকার লাশ এরা গলায় কলসি বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয় অথবা বালি চাপা দেয়। রেণু খালার লাশ নিয়ে কী হয়েছিল ঝুমুরের জানা হয় না আর।
০৫.
বহুবছর পার হয়েছে। ঝুমুর এখন প্রেস, মিডিয়ার সামনে এই পল্লীর মেয়েদের দুঃখ, কষ্ট, অধিকার নিয়ে কথা বলে। কেউ ইচ্ছে করে এ পেশায় আসে না। যারা রাতের অন্ধকারে এখানে আসে, তাদের গায়ে কোনো কালিমা লাগে না, অথচ এরা থেকে যায় অস্পৃশ্য হয়ে। ঝুমুরের ওপর হামলা হয়েছে অনেক, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঝুমুর তার কাজ থেকে একপা পিছপা হয়নি। ঝুমুর জানে, তার মা তাকে ভালো জীবন দিতে কত কষ্ট করেছে। মামা বাড়ি তাকে সঙ্গে নিয়ে হাতে-পায়ে ধরেছে। সব খরচ দিতে চেয়েছে। শুধু একটু ভালো পরিবেশে যেন ঝুমুর বড় হতে পারে, রাখেনি মামা, খালারা। অথচ ঝুমুরের কি কোনো দোষ ছিল! মায়ের এত কষ্ট বাঁচাতে পারেনি ঝুমুরকে এ অন্ধকার জীবেন থেকে। কিন্তু ঝুমুর চায় মারা গেলে অন্তত জানাজার অধিকার পাক, একমুঠো মাটি পাক। যে স্বপ্নটা মা দেখতো, সেটা পূরণ করার জন্য যত কষ্ট করতে হয় করবে ঝুমুর। এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখায় ঝুমুর। থানায় এখন পরিচিত মুখ সে। সেই রাতের মায়ের ফুল, পাতা, ছাপার শাড়ির বালিচাপা দেওয়া প্রায় প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখে ঝুমুর। এ যন্ত্রণা কাউকে বোঝানো যায় না।
দৌলতদিয়া থানার ওসি সেলিম মিয়া ও রাজবাড়ীর ডিআইজি হাবীবুর রহমান পাশে দাঁড়ায় এদের। কথা শোনে ঝুমুরের। তারই ফলে আজ এ পল্লীর ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু। হামিদা খালার লাশ জানাজা পেলো, মাটি দিতে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। ওসি তার থানার লোকজন নিয়ে এসে জানাজায় শরিক হয়েছেন। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এলাকার কিছু দোকানদার। ইমাম সাহেবকে নিয়ে এসেছে পুলিশ।
ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা আটকে বসে থাকে মায়ের ছবির সামনে। মা, তুমি দেখছ তো? হামিদা খালা জানাজা পেয়েছে, মাটি পেয়েছে। তোমার স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে । কিন্তু এ ভদ্র সমাজের মানুষগুলোর রাতের অন্ধকারে চেহারা বদলে যাবে যতদিন, মুখ আর মুখোশ আলাদা হবে যতদিন, এমন পল্লী বেঁচে থাকবে ততদিন। এ আমি কেমনে ফেরাবো মা?
বাইরে টিভি রিপোর্টারদের ভিড়। অনেক চ্যানেলে নিউজ কভার হচ্ছে। ডিআইজি, ওসির জয়জয়কার। এর মধ্যে সবাই খুঁজছে ঝুমুরকে। তার কথা শুনতে চায় সবাই। কিন্তু কী বলবে সে, আজ আর কিছু বলার নেই তার।