চারমাস বয়সী পোলাডা কোঁতকোঁত কইরা মাই চুইষা খাইতাছে জয়গুন বিবির। গালের কষ বাইয়া পড়তাছে হইলদা-সাদা দুধ। অত্তো বড় পুষ্ট মাই থনে খলবলাইয়া দুধ নামবো, এইডাই তো স্বাভাবিক। আফসোসের সঙ্গে ডাইন হাতডা বুকে ঘষে মতিন মেম্বার।
আহা! দ্যাখতেও কতলা সুখ! বুকটা ভইরা যায়। মনডাতে আইটাই আইটাই করে!
পোলায় তার জোরে জোরে মাই টাইনা খায় বিবি জয়গুনার! কী সুখ! কী সুখ! আহারে বিবি জয়গুনা! তোমারে অতো কইরা কাছে ডাহি। তুমি ক্যান দাও না ধরা! ক্যান?
লুঙির ওপরডা খামচা দিয়া ধরে মেম্বার। মাই দুই খানের লাইগাই জয়তুনের লগে রাইত কাডাইতে মন করে মতিন মেম্বারের। শুধু একখান রাইত। শুধুই একখান। কল্পনায় গভীর সুখে তলিয়ে যেতে থাকে মতিন।
আছর-অক্তের কালে নাপাকনি হইয়া গেলো মেম্বার! গলা খাঁকারি শুনে সাবধানী হলো জয়গুন। আঁচলে ঢাকলো ঘুমন্ত বাচ্চার মুখে পোড়া মাইয়ের বোঁটা।
আশাহীন আর অসহায় দৃষ্টিতে পুরো দৃশ্যটা দেখলো কুলসুমা। মতিন মেম্বারের এই চোখ সে চেনে। ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে কামনার আগুন। এমনটা প্রায়ই করে মেম্বার। নিঃশব্দে এসে জয়গুনের মাই দেওয়া দেখে। যেন এর চেয়ে সুখের দৃশ্য পৃথিবীতে আর নাই।
জয়গুনের কোল থেকে ছেলেকে পাঁজাকোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় কুলসুম। কপালে চুমু খায়। আহ্লাদ দেখে মেজাজ খিঁচড়ে যায় মতিন মেম্বারের।
চ্যাটের মা হইছে! বালের মা হইছে! বুহে নাই অ্যাকটুকও রস। হুগনা খটখইট্যা। আরে, দুধ না খাওয়াইতারলে কিয়ের মা আর কিয়ের মাইয়া মানুষ! যত্তসব বালছাল মাইয়ালোক জুটছে তার কপালে! কীসব আজিব আজিব রোগের কিস্তা কয় ডাক্তরে, এইসব কডিন কডিন কতা হুনতে ভাল্লাগে না। আজাইরা এক্কেরে! হারা দুইন্যাদারির মাইয়ালোকের বাইচ্চা হইলে হড়হড়াইয়া দুধ নামে, আর হেরে ধরসে বালের অসুখ। বুকডাতে হাত দিয়াও কুনো সুখ নাই। ফসফইস্যা পোতাইন্যা দুধ। হেই কারণে হুইয়াও আরাম লাগে না কুনো।
ঝোপে-ঝাড়ে শিস বাজে। এই ইশারা অচেনা, অজানা নয় কোনো নারীর। ঘুমের ভেতরেও ইঙ্গিতগুলো তাড়া করে ফেরে। কিছুতে শান্তি পায় না জয়গুন।
জয়গুন চলে যায় না তখনই। ঘরে চাউল নাই। কুলসুমের জন্য অপেক্ষা করে। ছেলের গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে জয়গুনের দিকে তাকায় কুলসুম। দুজনের চোখে-চোখে কী কথা হয়, তা শুধু দুজনেই জানে!
জয়গুনকে কি ঈর্ষা করে কুলসুম? তার ওই ঠাস-বুনোনের বুক দুইটাকে কি হিংসা করে? উপচেপড়া দুধের নহরকে কি হিংসা করে? জানে না কুলসুমা। কিছুই জানে না। কিছুই ভাবতে পারে না সে।
সবই তার কপালের দোষ। মা হওয়ার সাধ তো মিটেছে। কিন্তু মাতৃত্বের সাধ কি মিটেছে? বুকটা খাঁ খাঁ করে কুলসুমের। অনেক টিপেটুপেও একফোঁটা দুধ বের করতে পারেনি। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে আঁচড়ে, খামচে মাই দুইটা রক্তাক্ত করে, ছিঁড়ে ফেলে। জেনে-বুঝে কখনো কারও কোনো ক্ষতি করেনি কুলসুম। পারলে সাহায্য করেছে। মানুষের দুঃখেকষ্টে পাশে দাঁড়িয়েছে। অথচ তার হলো কি না—এমন একটা বিরল রোগ। এই কেমন বিচার মাবুদ! প্রতি অক্তের নামাজে জায়নামাজে বসে ফরিয়াদ জানায় কুলসুম। তার কথা মাবুদের কাছে পৌঁছে কি না—বুঝতে পারে না কুলসুম।
জয়গুনের শাড়ির কোঁচড়ে চার পট চাউল ঢেলে দেয় কুলসুমা। দুইটা হাঁসের ডিমও দেয় সঙ্গে। যত যাই হোক, ছেলেটা তার মরতে মরতে বেঁচেছে জয়গুনের জন্যই। জন্মের পরপরই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। বোতলের দুধ খাওয়াতে কঠিনভাবে নিষেধ করে দিলেন ডাক্তাররা। ওই সময় জয়গুনকে না পেলে সত্যিই বিপদ হতো।
কাম সাইরা তাড়াতাড়ি আসিসরে জয়গুন। মোলায়েম স্বরে মনে করিয়ে দেয় কুলসুম। বাইরের দরোজার কাছে জয়গুনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মতিনের। অনেকটা ইচ্ছে করেই ধাক্কাটা দেয় মতিন! শরীরে তার আগুন ধরানো জ্বালা। মেম্বারের কাঁধের ওপর দিয়ে কুলসুমের অসহায় মুখটার দিকে তাকায় জয়গুনা।
হঠাৎ মনে হয়, সবকিছু থেকেও যেন কিছুই নেই কুলসুমের। বড় রহস্যময় এই জগৎসংসার! কাউরে কিছুই দেয় না, আবার কাউরে সবকিছু দিয়াও কাইড়া লয় মাবুদ।
মতিনও বেরিয়ে যায় জয়গুনের পেছন পেছন। দিনের আলো কমতে শুরু করেছে। মাদার গাছের সারি পেরিয়ে অনেকদিনের পুরনো বটগাছটার নিচে আসতেই, পেছন থেকে জয়গুনকে জাপটে ধরে মেম্বার। আমি তরে বিয়া করতে চাই জয়গুনা। তুই আর না করিস না। জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় জয়গুন—কুলসুম আফার মতো এত ভালো একটা বউ থাকতে এসব কী কন আফনে? হাঁপাতে থাকে জয়গুন। মতিনের মাথা যেন খারাপ হওয়ার জোগাড়—তরে আমি অনেক সুখে রাখুম জয়গুন। তুই শুধু রাজি হইয়া দ্যাখ। বলতে বলতে লুঙ্গির গিঁট থেকে দুইটা চকচকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে মতিন। এই টাকা কয়ডা রাখ। কথার মধ্যেই মতিনকে আর সুযোগ না গিয়ে দ্রুত পা চালায় জয়গুন।
মেয়েটাকে গর্ভে রেখে সেই যে দু ইচোখ বুজল জামাইডা! জায়গাজমির বিবাদে দুই পক্ষের মারামারিতে ছুরিকাহত হয় তার জামাই ইদ্রিস আলী। খুব ভালা পাইতো জয়গুনরে। আদরে আদরে ভইরা দিতো। স্বামীসুখ সইলো না বেশিদিন। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সময়ের আগেই প্রসববেদনা উঠে গিয়ে জন্ম নেয় ইদ্রিস আলী আর জয়গুনার মেয়ে। গত দুই বছরে তিন তিনটা পেট চালাতে হেন কোনো কাজ নেই, যা জয়গুন করেনি। যে যা বলেছে, সব মুখ বুজে করেছে।
মেয়েটার বয়স যখন পাঁচ মাস, তখন অবস্থাপন্ন এক পরিবারে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হয়। সেই বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়া থেকে শুরু হয় জয়গুনের এই মাই বিক্রির কাজ। পয়সা ভালোই পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে উপরি হিসেবে রয়েছে শাড়িকাপড়সহ নানান উপহারসামগ্রী। এরপর থেকে এই কাজ করে চলেছে জয়গুন। গত চার মাস যাবত মেম্বারের ঘরে কাজ পেয়েছে জয়গুন। মেম্বারের একটাই শর্ত, তার ছেলেকে দুধ দেওয়া অবস্থায় অন্য কোনো বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারবে না। এজন্য সে বাড়তি খরচ দেবে। গত চার মাস তাই এই বাড়িতেই যাতায়াত।
ঘরে ঢুকে সায়া, ব্লাউজ টেনে হিঁচড়ে নিজেকে উলঙ্গ করে ফেলে জয়গুন। সুপুষ্ট শরীরটাতে দীর্ঘসময় নিয়ে হাত বোলায়। ভয়ঙ্কর উত্তাপ শরীরে। বড় বেশি বাচাল এই শরীর। বড় বেশি কম্পনের অনুভব। কোনো নিষেধ শুনতে চায় না। কোনো বাধা মানতে চায় না।
একবার স্বাদ পাইলে নারী আর পুরুষ কি আর একা থাকতে পারে? দিন কোনোরকমে কাটলেও রাত কাটতে চায় না কিছুতে। তেলচিটা পড়া লোহার মতো শক্ত বালিশটার ওপর প্রচণ্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়গুন। যেন আগুন নেভানোর সব দায়ভার ওই পোড়ামুখী বালিশটার!
পাড়ার পুরুষ মানুষের চোখ রোজ তার দেহ চাটে। রাত হলেই টিনের চালে ডেলা পড়ে। ঝোপে-ঝাড়ে শিস বাজে। এই ইশারা অচেনা, অজানা নয় কোনো নারীর। ঘুমের ভেতরেও ইঙ্গিতগুলো তাড়া করে ফেরে। কিছুতে শান্তি পায় না জয়গুন।
শুধু মেম্বার কেন, যে ডাকবে তার কাছেই ধরা এদবে আজ! পুরুষ হলেই হলো।
বিষাক্ত গোখরোর মতো ফুসে ওঠে আজ জয়গুন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ধরা দেবে সে। খুব দরকার তার। খুউব। একবার, দুই বার, তিন বার, চার বার, যতবার চায় মতিন মেম্বার, ততবার। হাজার হাজার বার, লক্ষ, কোটিবার। আর পারবে না জয়গুন। আর পারতে চায় না জয়গুন। সব পারাতে আনন্দ থাকে না। না-পারাতেও কিছু আনন্দ থাকে। হেরে যাওয়াতেও কিছু সুখ থাকে। জেগে ওঠা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভার উদগীরণে বাধা দেবে না আর। ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য উদগীরণ প্রয়োজন। ভীষণভাবে। নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়ে জয়গুন। গোসলে ঢুকে অনেকক্ষণ পানি ঢালে গায়ে।
বৃদ্ধ মা আর আড়াই বছরের মেয়েটাকে ভাত খাইয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুইয়ে দেয় আজ। একটু সময় নিয়ে তৈরি হয় জয়গুন। টিমটিমে কুপির নিচে সস্তা লিপস্টিক মাখা ঠোঁটটা রক্তাক্ত দেখায়। চুলটা হাতে পেঁচিয়ে আলগা খোঁপা করে নেয়। বুক আর নিতম্ব স্পষ্ট করে পরে শাড়িটা।
দুয়ারডা দিয়া দিয়ো, মা। রাইতের দুধটা খাওয়াইয়া আহি। বেশি রাইত অইলে এক্কেরে বিহানবেলা ফিরুম নে। বুড়ো মায়ের চোখে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে জয়গুন। ধ্বক করে ওঠে তার বুক! বোবাচোখেও অনেক কথা লেখা থাকে। জয়গুনের মা-ও অল্পবয়সে বিধবা হয়েছে। এক বঞ্চিত নারীর দুঃখ কেবল অন্য নারীই বুঝতে পারে।
টগবগ করে ফুটতে থাকা উত্তাপের কাছে এইসব চাহনি তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হয় জয়গুনের! আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্তে পতঙ্গ কি অত ভাবে? জয়গুনও আজ পতঙ্গ হবে। পুড়ে ছাই হবে। নিঃশেষিত হবে। সাত-পাঁচ ভাববে না। সর্বস্বান্ত হবে। তা না হলে কিসের সুখ নারীর?
জয়গুন বিবির ঠোঁটে বিপুল রহস্যের হাসি। এই অধরা-রহস্য নারীর অহঙ্কার। গৌরব। শুধু মেম্বার কেন, যে ডাকবে তার কাছেই ধরা এদবে আজ! পুরুষ হলেই হলো।