জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করেন?
এ গল্প এখন পর্যন্ত এক আমার বাইরে আর কেউ জানে না। এমনকি পার্লিয়াকেও বলিনি। আমার সর্বশেষ বিদ্যাপিঠ আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে শুরু করার আগে, বাবার ইচ্ছায় নিমরাজি হয়ে আমি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রামের ঢাকা ক্যাম্পাসে কিছুকাল পড়েছিলাম। বিষয় তড়িৎ প্রকৌশল। ক্যাম্পাসের কম্পিউটার ল্যাবটা ছিল চমৎকার। আমার অশান্ত মন সেখানেই কেবল খানিক শান্তি খুঁজে পেতো।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটায় একটা বাতাসসুগন্ধীর সঙ্গে চটের মাদুরের একটা মিলিত গন্ধ ভেসে বেড়াতো। আমি হেঁটে হেঁটে ল্যাবের শেষ প্রান্তে গিয়ে আমার পছন্দের একটা কম্পিউটারের সামনে চেয়ার টেনে বসতাম। পর্দা সরানো কাচের জানালার বাইরে অনেক নিচে গাড়িঘোড়া চলতো। তার একটা চাপা শব্দ শুধু কানে আসতো। এর বাইরে, ঘরে একটা বুক ঠাণ্ডা করা শীতল নীরবতা।
প্রথমে আমি ইমেইলে ঢুকতাম। উইকিপিডিয়ার একটা চুক্তিতে ক্লিক দিয়েছিলাম। সেই থেকে প্রতি সকালে একটা করে প্রবন্ধ আসতো আমার নামে। সেখানে আমি রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়ি, ঋতুচক্রের আখ্যান পড়ি। একসময় ঘড়ি বলে, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে, ওঠো ওঠো!
তাকে দেখে আমার বৃদ্ধা এসমেরালদার কথা মনে পড়ল; মানে এসমেরালদা যদি তরুণী অবস্থায় আমাকে আমাকে চোখের জলে না ভাসিয়ে বৃদ্ধা হওয়ার অবকাশ পেতেন, তো কে জানে, তার মুখটা হয়তো অমন হতো।
ক্লাসে যেতে আমার মন চাইতো না। তবু উঠে ব্যাগ রাখার তাকের কাছে গিয়ে নম্বর লেখা হলদে শক্ত কাগজের টিকিটটা জমা দিয়ে আমার ব্যাকপ্যাকটা তুলে জুতো পরে বেরিয়ে আসতাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বেরোনোয় ঘেমে উঠতাম কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। বিকেলের আগে সব ক্লাস শেষ হলে আবার কম্পিউটার ল্যাবে আবার ঢোকার সুযোগ হতো।
তেমনই একদিনের কথা—
জুতো খুলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সেই চেনা ঘ্রাণ আর নরম একটা আলো। দেয়ালঘেঁষে ব্যাগ রাখার খোপ খোপ অন্ধকার তাকের ভেতর ব্যাগটা রেখে টিকিট নিয়ে এগোতে থাকলাম কোণের কম্পিউটারের দিকে। আমার জায়গায় গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলাম। দুপুরের আবহ তখনো কাটেনি। অন্যদিন সকালে বসি বলে সূর্য পূর্বদিকে থাকায় পর্দা বেশি সরাতে পারি না। সেদিন সূর্য ছিল পশ্চিমে। তাই পর্দার অনেকটা সরিয়ে দিতে পারলাম।
বাইরে ভবনের একটা বাড়ানো অংশ ছিল। সেখানে মাটি জমিয়ে একটা বিগানবিলাস লাগানো হয়েছিল। বাগানবিলাসের গোলাপি পাপড়ি আর সবুজ পাতা আমার মন ভালো করে দিলো।
ইমেইল খুলে উইকিপিডিয়ার প্রবন্ধটা পড়তে শুরু করলাম। সেদিনেরটা ছিল মহাদেশীয় বিভাজন নিয়ে। সেই আদিম অবিভক্ত মহাদেশ প্যানজিয়ার প্রতি আমার আগ্রহ অশেষ। লেখাটা ডালপালা মেলতে মেলতে বেশ কিছু অসমর্থিত সূত্রের কাছে কাছে আমাকে নিয়ে গেল। এই সূত্রগুলো নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা লেখা থাকে সাধারণত একইরকম অবিশ্বস্ত সব ওয়েবসাইটে। তবে সেখানে প্রবন্ধগুলো সব যে আগাগোড়া চটুলতাপূর্ণ তা নয়। গুড কোলেস্টেরলের মতো একটা দুটো তথ্য পাওয়া যেত যেগুলো ভীষণ জরুরি। যেমন, সেদিন আমি বরফযুগে হেঁটে সমুদ্র পেরিয়ে যাওয়া মানুষের কথা পেলাম। লেখাটা যখন শেষ করেছি, দেখি নিচেই একটা বিজ্ঞাপন। একটা রুপালি গোল কাচের ছবি। যাযাবর তাঁবুর নিচে এমন কাচের সামনে বসে জিপসি নারীরা মানুষের ভবিষ্যৎ বলে থাকেন।
বিজ্ঞাপনে কাচের বলটার ওপর দু’হাত রেখে ঠিক আমার চোখে চোখে তাকিয়ে আছেন এক প্রাচ্য-চেহারার নারী। তাকে দেখে আমার বৃদ্ধা এসমেরালদার কথা মনে পড়ল; মানে এসমেরালদা যদি তরুণী অবস্থায় আমাকে আমাকে চোখের জলে না ভাসিয়ে বৃদ্ধা হওয়ার অবকাশ পেতেন, তো কে জানে, তার মুখটা হয়তো অমন হতো।
জ্যোতিষ সম্রাজ্ঞী লায়লা আমার ভবিষ্যৎ বলে দিতে প্রস্তুত।
অবিশ্বাস্য প্রস্তবনাটি হচ্ছে, শুধু বিশ্বাস জন্মানোর খাতিরে তিনি প্রথমবার ভিবিষ্যৎ বলবেন বিনামূল্যে। আমি কি তার সঙ্গে যোগাযোগে ইচ্ছুক? নিজের ভবিষ্যৎ জানতে কে না চায়। আমার মনে সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো। আমি ‘হ্যাঁ’ বোতাম চাপলাম।
নতুন একটা জানালা ভেসে উঠলো। সেই জানালার ওপাশে অলৌকিক আভা ছড়াচ্ছেন লায়লা।
বাহ, শুরুতেই প্রেমের কথা! আমার বয়েসে সবাই এসব কথাই আগে শুনতে চায়। বেশ, দেখা যাক, এর পর কী লিখেছে।
জ্যোতিষশাস্ত্রে আস্থার প্রশ্ন নয়। স্রেফ একটা আনন্দের উপকরণ জড়ো করতে আমি লায়লার প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর জমা দিতে থাকলাম। এ সমস্ত সাইটে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিটা কেন নিয়েছিলাম তার সঠিক উত্তর আমার কাছে নেই।
লায়লা আমাকে বললেন, আমাকে একটু সময় দাও হামিম কামাল। আমি যত্নসহকারে কিছু গণনার কাজ সমাধা করবো। তারপর কাল তোমার ইমেইলে যোগাযোগ করবো। আশা করি আমি তোমাকে নিরাশ করবো না।
পরদিন—
বাস থেকে ধানমণ্ডি-৩-এ নেমে অনেকটা পথ হেঁটে ঘেমে নেয়ে গেলাম। সেদিন ক্যাম্পাসে পৌঁছে প্রতিদিনের মতো আর আগে কম্পিউটার ল্যাবে ঢুকলাম না কারণ ঘর্মাক্ত অবস্থায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকে আমি অনেক ভুগেছি। আমি করিডোর ধরে সোজা হেঁটে শেষপ্রান্তে ভবনের খোলামেলা বর্ধিত অংশে চলে এলাম, ওখানে টেবিল টেনিসের একটা প্লট ঠিক মাঝখানে রাখা। দুটো ছেলে খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে একে অন্যের বল ঠেকাচ্ছে। খেলা জমেছে। দশ গজ দক্ষিণে প্লাইকাঠের আড়ালে রাখা দুটো স্টোভ। সেখানে আগুন আর তেলের শব্দ উঠছে। ভাজা হচ্ছে শিঙাড়া, সমুচা, সবজির রোল আর মুরগির মচমচে মুরগির মাংসের একটা পদ। চারপাশ খাবারের সুঘ্রাণে ম ম।
এখানে তিনদিকে দেয়াল নেই। বাহিরটা খোলা। দূরে ধানমণ্ডির বনজ অংশের শোভা। হাওয়া আসছে। একটা চেয়ার টেনে বসে দুটো শিঙাড়া অর্ডার করে আমি ব্যাগ খুলে মির্চার লা নুয়ে ব্যাঙ্গলি নিয়ে বসলাম। পড়তে পড়তে ক্লাসের সময় হয়ে এলো। পরপর বেশ ক’টা ক্লাসের পর মনে এমন ক্লান্তি জমে গেলো যে ক্লাস শেষ হওয়ার জন্যে একটা স্কুল বালকের মতো অপেক্ষা করতে থাকলাম। নিজেকে বললাম, তোমার ইমেইল বোধয় চলে এসেছে।
আচ্ছা, কী লেখা থাকবে ওখানে তোমার প্রেমের কথাটথা?
একটা প্রেম বড় দরকার তোমার, তাই না? নয়ত এই মনটাকে নিয়ে তুমি কী করবে? এতো প্রেমিক একটা মন!
ক্লাস শেষ হলে তাড়াতাড়ি ল্যাবে পৌঁছে গেলাম। আর কোনো বাধা নেই। আমার চেয়ার টেনে বসে কম্পিউটার অন করলাম। সব ঠিকঠাক চালু হলো। লায়লার ইমেইল এসেছে। গণনা শেষ।
এক মন বলল, নিশ্চয়ই আন্দাজে কিছু কথা ছুড়ে দিয়েছে, গথবাঁধা। আরেক মন বলল, কেন এমন ভাবছ? জগৎ রহস্যময়। তৃতীয় মনটি সুচারু। সে বলল, সত্য মিথ্যা জানি না, কল্যাণ-অকল্যাণ বুঝি না। বুঝি শুধু আমি একটা খেলা খেলছি, যার শেষটা দেখতে চাই।
আমি ইমেইল খুললাম।
বেশ রঙচঙে একটা পাতায় নিয়ে গেল আমাকে। ঝিলমিল করছে হলুদ, সবুজ, ময়ূরকণ্ঠী নীল আর বিন্দু বিন্দু লাল। প্রথমে বড় কালো অক্ষরে আমার নাম ধরে অভ্যর্থনা। একটা ফেনিয়ে তোলা ভূমিকা। তার নিচে ইংরেজি কালো ক্যামব্রিয়া ফন্টে লেখা আমার ভবিষ্যৎ। ‘জানি তুমি মনে মনে তার অপেক্ষায় আছো। সে আছে। সে আসছে। সে অকল্পনীয়। তুমি তাকে চেনো না। তুমি তাকে এখনো জানো না।’ বাহ, শুরুতেই প্রেমের কথা! আমার বয়েসে সবাই এসব কথাই আগে শুনতে চায়। বেশ, দেখা যাক, এর পর কী লিখেছে—‘বর্তমান স্থান-কালে তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে এমন বলা যায় না। দেখা হলেও চিনবে না তাকে, আর সেও চিনবে না তোমাকে। এসব হলো অদৃষ্টের বিচিত্র গতিপথের ফের। এর রহস্যের শেষ নেই। তবে যখন সে আসবে, সর্বতভাবে আসবে। তুমি বুঝতে পারবে। তুমি তখনই কেবল তাকে চিনতে পারবে। সেও তোমাকে ।’
সেই মতোন দাপ্তরিক অসহযোগিতা চালিয়ে সময়টা ব্যথাতুর করে তুললো। তবে অনেক নাটকীয়তার পর শেষপর্যন্ত আমি ওখান থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম।
হুড়োতাড়া কোরো না। ভাগ্যের গতিই তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। মনে রেখো, সে-ই হবে তোমার ভবিষ্যতের চাবি। পৃথিবীর প্রতি তোমার ভূমিকা, তোমার নিয়তির পরিপূরণ, তার সঙ্গে বাঁধা। তোমার অবগতির জন্যে জানাই, প্রকৃতি কোনো অনুরোধের আসর নয়। প্রকৃতি বিনিময়ের ক্ষেত্র। সত্যিকার ভালোবাসার বিনিময় মূল্যটা কিন্তু বেশ বড়। বেশ বেশ বড়। তুমি প্রস্তুত?’
আমার বুকের ভেতর ধড়ফড়। ‘সে আসবে’-এ বাণী হৃদপিণ্ডে পৌঁছে গেছে। এই ‘সে’ যে কে, তা মনে করে তো সেই কৈশোর থেকে মাথা ঠুকছি। আমার প্রতিটি প্রেমের বেলাতেই আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম এই বুঝি ‘সে’। কিন্তু জীবন প্রতিবার চোখ টিপে হেসেছে।
এক মন বলল, কী শিহরণ! তার মানে পৃথিবীর প্রেমের উপন্যাসের পাতায় আমিও নায়ক চরিত্রে আছি! আরেক মন হাসিতে ফেটে পড়ল। বলল, বাড়ি যাও খোকা। সে তোমার অপেক্ষায় আছে, হা হা হা হা! হা হা হা হা! তৃতীয় মন নীরব। তার রহস্যময় নীরবতা আমাকে অবাক করলো।
যাই হোক, সেদিনের মতো আরও কিছু এলোমেলো ঘোরাফেরা করে যখন ওই জ্যোতিষের জানালাটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি, একটা বক্স ভেসে উঠলো, ‘তুমি কি আরো ভবিষ্যৎ জানতে চাও?’
এবার তা আর বিনামূল্য নয়। আমি রাজি কী করে হই? লায়লার জন্যে ভালোবাসা, কিন্তু আমার যে পকেটে কিছু নেই।
আহা তরুণ মন—
সেদিন থেকে আমার অপেক্ষা শুরু হলো। বিনিময় মূল্যটা বড়? তো কী। যে কোনো মূল্য সইতে রাজি আছি। আমি ভিখারি হয়ে যেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
ওদিকে আইআইইউ,সি’র ধর্মরাজনৈতিক গোঁড়া পরিবেশে আমার মন হাঁপিয়ে উঠেছিল। আমি মুক্তি চাইছিলাম। আমার মন পড়তে পেরে মা তার হজফান্ডের জমানো টাকা ভেঙে আহসানুল্লাহ বিশ্ববদ্যালয়ে ভর্তি করাতে রাজি হয়ে আমাকে বাঁচালেন, কিন্তু আইআইইউসি আমায় ছাড়তে অপারগতা জানিয়ে দিলো। সেই মতোন দাপ্তরিক অসহযোগিতা চালিয়ে সময়টা ব্যথাতুর করে তুললো। তবে অনেক নাটকীয়তার পর শেষপর্যন্ত আমি ওখান থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম।
আহসানুল্লাহর ক্যাম্পাসটিকেও আমি আমার চেতনার রঙে রাঙানোর মতো যথেষ্ট উৎসাহ শেষতক ধরে রাখতে পারিনি। তবে ওখানে আমার দীর্ঘশ্বাসগুলো তত দীর্ঘ ছিল না।
ক্যাম্পাসের শেষ বছর। আমরা ছয় বন্ধু পরিকল্পনার করলাম প্রথমে পাহাড়ে যাব, তারপর সাগরে। আর এই করে আমরা এমন এক স্মারক-ভ্রমণের সাধ মেটাব, যুগ যুগ কেটে যাবে যার রোমন্থনে।
২০১১ সাল। শীত মাত্র বিদায় নিয়েছে। পাহাড়ের কোলে কোলে তখনো কুয়াশা। সবুজ অন্ধকারের ভেতর সুন্দরের জ্বলজ্বলে চোখ। একবার চোখাচোখি হলে সে যা-তা করিয়ে নিতে পারে। আর সাগরের ধারে তখন কাচকাটা আলো। সে আলো হৃদয় জোড়া লেগে যায়। আর বাতাসে চড়ে সাগরের ঘ্রাণ যখন বুকে এসে ঢোকে, বুকটাও সাগর হয়ে যায়।
তেমন তেমন ঘটবে মনে এই বাসনা নিয়ে আমরা চললাম বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ে। গিয়ে শুনি আমাদের ক্যাম্পাস থেকে আরেকটি দলও এসেছে বান্দরবান। তাদের সঙ্গে দৈবে আমাদের দেখা হয়ে গেলো। এরপর আমরা গেলাম কক্সবাজারের নীল সাগরে। দৈব তাদেরও পাহাড় ঘুরিয়ে সাগরে নিয়ে গেলো। সেই দলে ছিল সহপাঠিনী পার্লিয়া, জ্যোতিষী লায়লার স্মিত হাসির মতো।
আমি জাদুকরের রুমাল নড়তে দেখেছি। পায়রাটাও শব্দ করে চোখের সামনে উড়ছে। হাত তালি দেবো না এমন মানুষ আমি নই।
আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধুবাদ জানানোর সবচেয়ে বড় উপলক্ষটি হচ্ছে, এখানেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় রত্নটিকে অর্জন করেছি। সেই থেকে বলি, আমার শিক্ষাজীবন আমাকে একজন জীবনসাথী দিয়েছে। রক্তমাংসের এ মানবী আমার অমূল্য দীক্ষা। পার্লিয়া বলে, এখানে তোমার আমার দেখা না হলেও কোথাও নিশ্চয়ই হতো। তোমার আমার নিয়তিরেখা অসংখ্য জায়গায় পরস্পরকে ছেদ করে গেছে। সময় গড়ালো। নিয়তির নীলচে সবুজ রেখায় রেখায় চলতে থাকলো রহস্যময় কাটাকুটি খেলা।
প্রেমের সঙ্গে প্রাণীর জন্ম কাছাকাছি বলে, মৃত্যুও কাছাকাছি। যেকোনো প্রেম। তা হোক কোনো মানব বা মানবীর সঙ্গে বা কোনো প্যাশনের সঙ্গে। এক ভিন্ন স্থান, ভিন্ন কালের পেতে দেওয়া ক্ষেত্রে আমি সত্যিই ‘তার’ দেখা পেয়েছিলাম, যার সূত্র ধরে পৃথিবীতে আমার কাজ তার বাঁক বদল করেছে। যার হাতের চাবি এমন এক জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত ভাগ্যদুয়ার খুলে দিয়েছে, যে জগতের জাগতিক হওয়ার সাধ আমার চিরকালের।
ওকে পাওয়ার আগে চলতি সমাজের সঙ্গে আমি অনেকখানিক খাপ খেয়ে গিয়েছিলাম। আমার তাই নিজেকে বদলে নিতে হচ্ছিল। রূপান্তরের সময়টা মানুষের গোটা জীবনকালে সবচেয়ে যাতনাময়। আমি সেই মৃত্যুমতি সময় আমি অতিক্রম করতে থাকলাম। আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকলো। আমি বুক পেতে দিলাম। হাঁটু ভেঙে পড়ে গিয়ে পিঠ উন্মুক্ত করে দিলাম।
যখন রক্তাক্ত, তৃষ্ণার্ত পড়ে থাকতাম, তখন একেক রাতে মনে হতো, এত কষ্ট কি আমি একাই পাচ্ছি? পৃথিবীতে এত এত লোক, তারাও কি এর ভেতর দিয়ে যায়? সব শেষে এই জেনেছিলাম, সত্য ভালোবাসা শুরুতেই অমূল্য নয়। প্রথমে সে বহুমূল্য। অতপর অমূল্য।
যে আমার—
‘ভবিষ্যতের চাবি’, ‘পৃথিবীতে আমার ভূমিকা আমার নিয়তির যে পরিপূরণকারী’, ও ‘অতুল বিনিময় মূল্যে পাওয়া সত্য প্রেম’, তার জন্মদিনে আমার ব্যক্তিগত শুভেচ্ছাবাণীর পূর্বকথা হিসেবে এ লেখাটি তুলে দেওয়ার কালে অন্তর্জালসাগরের ওপারে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকা সেই যাযাবর নারী লায়লার কথা মনে পড়ছে।
হয়তো মনভোলানো কিছু কথাই সে বলেছিল মাত্র। হয়তো লায়লা নামে ছিল না কোথাও কেউ, সব শুভঙ্করের ফাঁকি। তাতে কী। আমি জাদুকরের রুমাল নড়তে দেখেছি। পায়রাটাও শব্দ করে চোখের সামনে উড়ছে। হাত তালি দেবো না এমন মানুষ আমি নই।