ফজর আলী ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে শঙ্খনদীর তীরে কিছু একটা ভাসতে দেখলেন। কৌতূহল হলেও উঁকি দেওয়াটা সমীচীন মনে করলেন না। গ্রামের সম্মানিত মুরব্বি তিনি। উঁকি দিতে গিয়ে কী না কী দেখে ফেলেন! পরে না কোনো কেলেঙ্কারী হয়ে যায়! গলা খাঁকারি দিয়ে জমে থাকা শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে নিলেন।
-ও জমির, ইবা কী, চ’ত’। বলেই নদীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। ফজর আলীর চেয়ে একটু এগিয়ে থাকা জমিরের চোখ চকচক করে উঠলো। দ্রুত বাঁধের ঢাল ধরে নেমে গেলো তীরে। ঢালু জায়গায় দ্রুত নামতে গিয়ে তাল সামলাতে পারলো না। কিছুটা হুমড়ি খেয়ে পড়লো পানিতে। বিস্ময়ে ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে গেলো জমিরের। তবে, তাকে যেন একটু খুশি খুশিও মনে হলো। চাচা, চাঁই যঅ, মাইয়াফোয়ার লাশ উগগো পরি থাইক্যে। তাই ভেবেছিলেন ফজর আলী। কিন্তু হাবভাবে সেটা বুঝতে দিলেন না।
সম্মানিত হতে গেলে অনেকগুলো চেহারা রাখতে হয়। জমিরদের মতো ভেতরের ভাব প্রকাশ করে ফেলা যায় না। অনেক সাবধানী হতে হয়। ভালো অভিনেতা হতে হয়। ফজর আলী দাঁড়িয়ে পড়লেন। দাড়িতে হাত বোলালেন বারকয়েক। তাঁকে সঙ্গ দিতে আরও কয়েকজন মুরব্বি গোছের লোক পাশে এসে দাঁড়ালেন। আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! লা’নত! আল্লার দুইন্যাত ই’ন কী’অর গজব! শেষ পর্যন্ত এই গ্রামে উলঙ্গ মেয়ের লাশ! এ কিসের আলামত? কিসের ইশারা? কেমন পরীক্ষা নিচ্ছেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন? সব প্রশংসা তাঁর। তিনিই ভালো জানেন।
দুই.
ঘটনা ছড়াতে দেরি হলো না। আলোর বেগে ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তের মধ্যে। যদিও ব্যাপারটা ব্যাপক অন্ধকারাচ্ছন্ন! যারা মসজিদ থেকে ফিরছিলেন, তারা তো বটেই, যারা এই শীতের ভোরে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’কে অস্বীকার করে ঘুমিয়ে ছিল, তারাও জড়ো হলো। জমিরের মতো তারাও বোধকরি খুশিই হলো! নিরুত্তাপ শীতের ভোরে আগুন পোহানোর মালশা পেলো যেন! বেশ উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে সবার মধ্যে। গুঞ্জনে ভরে উঠলো পুরো গ্রাম। গ্রামের একেবারে লাজুক ছেলেটাও এক ফাঁকে লুকিয়ে দেখে নিলো বিবস্ত্র তরুণীর ভেজা শরীর।
আসলে চাঙা হওয়ার মতো কিছুই ঘটছিল না বহুদিন। এভাবে কি থাকা যায়! হাঁপিয়ে উঠেছিল মানুষজন। গ্রাম্য মাতবরদের কদরও যাচ্ছিল কমে। কিছু অরাজকতা, অন্যায়, অনিয়ম, ব্যত্যয় না ঘটলে তাদের কাজকর্ম কমে যায়। বেকার জীবন নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ, পানসে হয়ে যায়। সেই কবে কোনকালে হিন্দুপাড়ার ছেলের সঙ্গে মুসলমান মেয়ের প্রেম হয়েছিল বলে সালিশ বসেছিল। এতদিন পরে শঙ্খের পাড়ঘেঁষা এই গ্রামে আবার একটু উৎসব উৎসব আমেজ এসেছে। তবে এই গ্রামের
দারুণ একটা বদনাম আছে। কোনো প্রসঙ্গেই এরা সহজে একমত হতে পারে না। অতীতের অনেক অভিজ্ঞতা তাই বলে। অনেকটা নানা মুনির নানা মতের মতো।
বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করা গ্রামবাসীরা অতীতে অতি অল্পকিছু বিষয়েই একমত হতে পেরেছিল। তবে আজকের ঘটনায়, তারা বিনাদ্বিধায় সম্পূর্ণরূপে একমত হলো যে, ‘দোষ ব্যায়াজ্ঞিনমাইয়াফোয়া ইবের’!
পুলিশও হিমশিম খাচ্ছে গ্রাম ভেঙে আসা মানুষের ভিড় সামলাতে। চলছে জল্পনা-কল্পনা। ক্ষেত-খামার, পথ-ঘাট থেকে শুরু করে পুকুরপাড়, কলতলার নারীরা পর্যন্ত, কেউ বাদ যাচ্ছে না মুখরোচক আলোচনায় শামিল হতে!
তিন.
কলতলায় শমসুকে দৌড়ে আসতে দেখে শাফিয়ার মা-সহ অন্যরাও নড়েচড়ে বসলো। শমসু হলো এই গ্রামের মহিলাদের বিবিসি, সিএনএন। ওর কাছে সবার খবরাখবর থাকে। মেয়েটার সংসার হয়নি। পুরুষালী ধাঁচের বলে বিয়ের ঘর এসে ভেঙে যেতো। এদিকে বয়স তো থেমে থাকছিল না। শেষে বিরক্ত হয়ে দুই সতিনের ঘরে পাঠালো ভাইয়েরা। সন্তানাদি হলো না বলে সেখানেও টিকতে পারলো না বেশিদিন। ফিরে এলো এই গ্রামেই। ভাইদের সংসারে থাকলেও নিজের খাবারের ব্যবস্থা সে নিজেই করে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে গৃহস্থদের ফাইফরমাশ খাটে, এটা-সেটা করে দেয়। অনেকটা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো। হাঁস- মুরগীর খোয়ারে ঢোকার মতো রোজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। ভাই-ভাবিদের সঙ্গে কথা হয় কী হয় না, ফিরেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো কোনো দিন খাবার না জুটলে না খেয়েই কাটিয়ে দেয়। তবে এমনটা সচরাচর হয় না। কিছু না কিছু জুটেই যায়। অনেকে আবার কাজে ডাকার ছলে এ বাড়ির ও বাড়ির অন্দরের খবর কৌশলে জেনে নেয়। শমসুও সুযোগটা ভালোই কাজে লাগায়। কে কী শুনতে চায়, খুব ভালো করেই জানে ও। এ বাড়ির গল্প ও বাড়ি চালাচালি করে বাড়তি কিছু বখশিশও আদায় করে।
সেই শমসু যখন আজকের সকালে কলতলায় দৌড়ে আসে, তখন নড়েচড়ে তো বসতেই হয়। সারা গ্রাম চাউর হয়ে গেছে ভেসে আসা যুবতীর লাশের গল্প। দম নেওয়ার সুযোগ পেলো না শমসু। এর আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই। নিজের চোখে না দেখেও অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিলো। ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিলো না যে সে নিজে কিছুই দেখেনি।
-অ-বুক! যে সুন্দর ফুটফুইট্যা মাইয়াফোয়া! ব্যায়াজ্ঞুনে খদ্দে মাইয়ার চরিত্র ভালা ন’আছিল। জেনা গরিয়েরে এইল্যা অইয়ে! উপস্থিত সবাই সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতে দুইগাল স্পর্শ করলো তওবা করার ছলে। সত্যিই তো! কী দিন যে এলো! মেয়েরা না করে পর্দা, না মানে প্রথা। এই সবকিছু বেলেল্লাপনার ফল। মেয়েরা নাকি এখন স্বাধীন হতে চায়! যাকে ভালো লাগে তার সাথে থাকে, সময় কাটায়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। দুনিয়াতে এ কী অরাজকতা! খেয়াল খুশিমতো যা খুশি তাই করছে তরুণ-তরুনীরা! ইতোমধ্যে আল্লাহর গজবের নানান নমুনা দেখা যেতে শুরু করেছে। এ সবই পাপের ফল। পাপে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। কেউ বাঁচতে পারবে না পাপের শাস্তি থেকে। কেউ না। জিনাকারীর শাস্তি হবে ভয়াবহ! এ যে কবিরা গুনাহ!
চার.
তদন্ত কমিটি আর পোস্টমর্টেম-রিপোর্ট থেকে ঘটনাটি বোঝা যাবে পুরোপুরি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ঘরে ফিরে ফজর আলী পানির গ্লাস হাতে সমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, তার পরিবারের দিকে তাকালেন। হঠাৎ কেন যেন মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো তার। চোখের সামনে এক ঝলকের জন্য ভেসে উঠলো মৃত যুবতীর তরতাজা নগ্নদেহটা! ডানহাতে বুকের বা-দিকটায় হাত বোলালেন। মনে মনে ভাবলেন, মাইয়াফোয়ার রূপকচুফাতার ফানি্।
ফজর আলীর ঘরের দাওয়ায় জরুরি মিটিং ডাকা হয়েছে। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা একে একে সবাই এসেছেন। ফজর আলী বরাবরই মেয়েদের পড়ালেখা করার বিরুদ্ধে। তিনি সবসময়ই বলে থাকেন, সাবালক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েমানুষের বিবাহ দেওয়া উচিত। কে শোনে কার কথা! আজকাল ভালো কথার দাম নাই। এখানে জড়ো হওয়া অনেককেই তিনি জানেন, যারা তার সঙ্গে কথায় কথায় মাথা নাড়লেও ঘরের বউঝিদের ঠিকই পড়ালেখা করতে স্কুল-কলেজে পাঠাচ্ছেন।
আজ তার দিন। আজ তিনি আবার প্রমাণ করবেন, এইসব জঘন্যতম ঘটনার মূলে মূলত মেয়েদের বে-আব্রু চলাফেরা, বাড়ির বাইরে যাবার প্রবণতাই দায়ী। ইদানীং গ্রামের কিছু ছেলেপেলে শহরে পড়তে গিয়ে, চাকরি করতে গিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। তাদেরই দু’একজনের অভিভাবকেরা একটু অমান্য করার চেষ্টা করে। এই যেমন, মহসিনের বাবা আব্দুল গণি তো বলেই বসলো, এই ঘটনায় শাস্তি হওয়া দরকার ছেলেটির, যে ধর্ষণ করেছে, হত্যা করেছে। মেয়েটির দোষ-গুণের প্রসঙ্গ নাকি এখানে আসাই উচিত না।
-এদের জ্ঞান দাও প্রভু। এদের চক্ষু খুলে দাও। মেয়েমানুষ যদি পুরুষদের দেখিয়ে দেখিয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করে, পুরুষের কী দোষ? এরকম কাজ-কারবার তো তখন হবেই! মিডা জিনিসত মাছি বইবু, ইয়ান স্বাভাবিক।
পাঁচ.
শমসু সারাদিন ঘুরে ঘুরে অনেক তথ্য সংগ্রহ করলো। কলতলার দক্ষিণ পাশে পেয়ারাগাছের নিচে কয়েক পাড়ার বউ-ঝি’রা একত্রিত হয়েছে। সেখানে গিয়ে যেন বোমা ফাটালো শমসু। ও খোদা! য়ুইন্নো না, মাইয়াফোয়া ইবারবলে ফোয়া ফেডত আছিল! এগিন ই’তির ফাফ’র ফল। ছি, ছি, ছি!
হায় আল্লাহ! সবার চোখ কপালে উঠল! ওই মেয়ের সঙ্গে এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। সেই থেকে মেলামেশা। একপর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে গেলে ছেলেটিকে বারবার চাপ দিতে থাকে বিয়ের জন্য। ছেলেটি তার আরো কয়েকজন বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করার পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মেয়েটিকে। রসালো করে এসব কাহিনি বলার জুড়ি নেই শমসুর। যতটা না জেনেছে, তার তিনগুণ, চারগুণ করে রসিয়ে রসিয়ে বললো। মুখরোচক গল্পে, বিকৃত রস আস্বাদনে মগ্ন হলো সবাই। মেয়েদের কী কী করা উচিত, কী কী করা উচিত নয়, এই আলাপচারিতায় কেটে গেলো সারাদিন।
বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করা গ্রামবাসীরা অতীতে অতি অল্পকিছু বিষয়েই একমত হতে পেরেছিল। তবে আজকের ঘটনায়, তারা বিনাদ্বিধায় সম্পূর্ণরূপে একমত হলো যে, ‘দোষ ব্যায়াজ্ঞিনমাইয়াফোয়া ইবের’!