কিস্তি-২
০৩.
পরদিন সকালে নূর আলমদের ঘরের আশপাশে একটা কালো ছাগলের আনাগোনা দেখা যায়। একবার এ কোনায়, খানিক পর অন্য কোনায়। এর খানিক বাদে ছাগলটাকে নূর আলমদের বাড়ির উঠোনে দেখা যায়। ছাগলের দড়ির একপ্রান্ত অতুলের ডান হাতের তর্জনিতে জড়ানো। অন্য হাতে এক তোড়া কাঁঠাল পাতা। ব্যাংকের জমানো টাকা কৃপণ মানুষ যেভাবে রয়ে সয়ে খরচ করে, তেমনিভাবে সেখান থেকে দু’য়েকটা করে পাতা বরাদ্দ পাচ্ছে ছাগলটি। ‘নূরা ওই নূরা, বাড়ি আচিস?’ বলে ডেকে ওঠে অতুল। সঙ্গে সঙ্গে ছাগলটি ‘ভ্যাউমমমমমম’ করে গলার ভেতর থেকে একটা কম্পনময় শব্দতরঙ্গ বের করে। অতুলের সঙ্গে সেও যে উপস্থিত আছে, সেটা জানান দিতেই যেন এই প্রচেষ্টা।
ঘরের ভেতর থেকে খালি গায়ে বেরিয়ে আসে নূর আলম। অতুলকে দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে, ‘আসছি’। এরপর আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। জোব্বার বোতাম লাগাতে লাগাতে উঠোনে নামে। দরজাটা টেনে লাগিয়ে দিয়ে মাথার টুপি ঠিক করতে করতে অতুলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। ছোট্ট উঠোনের এক কোনায় ইস্টিমারের মতো ধোঁয়া উগরাচ্ছিল চুলাটি। উবু হয়ে বসে মুখে চোঙ্গা লাগিয়ে চুলায় অনবরত ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল সুকবাসী। চোখে ধোঁয়া লাগায় পানি বেরিয়ে এসেছে। ধোঁয়ার আক্রমণ থেকে চোখ বাঁচতে অন্য দিকে তাকিয়ে জীর্ণ আঁচলে চোখ মুছে নেয় সে। চোখ পরিষ্কার হতে বাড়ি থেকে অতুলের ছাগলের লেজটিকে ধীর গতিতে বের হয়ে যেতে দেখে সে। ‘তাড়াতাড়ি ফিরিস বাপ’ বলে বাতাসে ধ্বনি ছড়ায় সুকবাসী। যার উদ্দেশ্যে বলা সে শুনতে পেয়েছে কি না, যাচাই করতে কান পাতে। প্রত্যাশিত জবাব না পেলেও বাতাসে ভেসে ‘উমমমম’ জাতীয় একটা শব্দ তার কানে আসে। ছাগলের গলার গভীর থেকে উৎপন্ন এই শব্দ তাকে নিশ্চিত করে কি না, বোঝা যায় না। চোঙ্গা নিয়ে আবার ধোঁয়ার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। দু-চারটি ফুঁ দিতেই ধোঁয়ার আড়ালে আগুনের কমলা শিখার নাচানাচি দেখা যায়। বিজয়ীনী গর্বে সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখের বদলে এবার আঁচলে নাক মুছে নেয় সুকবাসী।
চারদিকে ডালপালা আর ঝুরি ছড়িয়ে দীর্ঘ বছরের আয়েসি আয়ু নিয়ে নিজেকে এখনো বিকশিত করে চলেছে গাঁয়ের বুড়ো বট গাছটি। কতশত মানুষের কত রকমের স্মৃতি তার সঙ্গে নিজেও সে হিসাব জানে না। পাতায় পাতায় কেবলই মর্মরিত হয়ে চলে নতুনত্বের স্পন্দন। অতুলের সঙ্গে সেই বটতলায় গিয়ে বসে নূর আলম। ছড়িয়ে থাকা একটা ডালে বসে ওপর-নিচ দুলতে থাকে। ছাগলটিকে অদূরেই বেঁধে রেখে দৌড়ে গিয়ে একটা ঝুরি ধরে ঝুলতে থাকে অতুল। তারপর সেই ঝুরি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। বেশ খানিকটা উঠে ঝুরি ধরে প্রায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঝুরিটা তাকে নিয়ে এপাশ ওপাশ যেতে আসতে থাকে। কাণ্ড দেখে হাসে নূর আলম। তার ভেতরেও একটা আলোড়ন স্পন্দিত হয়। পাশের ঝুরিটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে তাকে উদ্দেশ করে চোখ টিপ্পনি কাটে অতুল। বলে, ‘কিরে তালবেলেম, ভুলে গেলি সব?’ আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নূর আলম। বন্ধুর স্পন্দন অচেনা নয় অতুলের। জানে ইচ্ছে আছে ষোলো আনা। কিন্তু কোনো এক অচেনা অদৃশ্য দেয়াল তাকে ছেলেমানুষি প্রবৃত্তিতে মত্ত হতে বাধা দিচ্ছে। সেটা ধরতে পারছে না অতুল। ঝাঁকি দিয়ে দোলার গতি বাড়িয়ে নেয় সে। মুখ দিয়ে ‘আঁআআউউউউ’ শব্দে প্রলম্বিত একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে তার। মুখে দু’কান বিস্তৃত হাসি। বন্ধুকে প্রলুব্ধ করার প্রয়াস। এগুলো তাদের আরও কম বয়সী সময়ের সাংকেতিক লেনদেন। এখন টারজানের ডাক দিয়েছে অতুল। এ ডাক কিভাবে ফেরাবে নূর আলম সেটাই দেখার বিষয়।
অতুলের দিকে করুণ চোখে তাকায় নূর আলম। আরেকবার তাকায় নিজের জোব্বার দিকে। অতুল এবার বুঝতে পারে কোন দেয়ালে বাধা পাচ্ছে নূর আলম। মাদ্রাসা থেকে ফেরার পর কয়েকদিন এমন আচরণ করে সে। সবকিছুতে দ্বিধাগ্রস্ত ভাব। তারপর যখন সব স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করে, তখন আবার মাদ্রাসায় চলে যায়। ঝুরি থেকে নেমে আসে অতুল।
বন্ধুকে দেয়াল পার হতে সাহায্য করার প্রয়াসে নিজের কোমরের গামছা খুলে নেয়। বলে, ‘খুলে ফেল জোব্বাটা।’ নূর আলম আঁৎকে ওঠে, ‘কী বলচিস তুই?’ এবার কণ্ঠে দৃঢ়তা অতুলের, ‘যা বলচি কর।’ তার সে হুকুম উপেক্ষা করতে পারে না নূর আলম। দ্বিধার সঙ্গে ধীরে ধীরে খুলে ফেলে জোব্বা। এবার অতুল নিজের গামছার দুই প্রান্ত নূর আলমের দুই বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে ঘাড়ের কাছে গিঁঠ দেয়। পাঞ্জাবির ওপরে পরা কোটির মতো অস্থায়ী একটা কোটি তৈরি হয়ে যায়। পরনে ঢোলা পায়জামা, গায়ে গামছার কোটি, মাথায় গোল টুপি। সব মিলিয়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে।
নিজের শিল্পকর্ম দেখে হাসে অতুল। বলে, ‘চল ব্যাটা এবার।’ জোব্বার ভেতর থেকে বেরিয়ে খোলস বদলানো সাপের মতো চনমনিয়ে ওঠে নূর আলম। বিশেষভাবে তৈরি একটা পোশাকের ক্ষমতার গভীরতা বোঝার জ্ঞান না হলেও শরীর থেকে সেটা খুলে ফেলার পর মন হাল্কা হয়ে যায় নূর আলমের। দৌড়ে অতুলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। এক লাফে ঝুরি ধরে দোল খেয়ে উঠে পড়ে। অনায়াসে দাঁড়িয়ে দোল খেতে থাকে। মুখে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের হাসি। মাথার টুপিটা বাতাস লেগে খুলে পড়ে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মাথায় দেয় অতুল। তারপর বন্ধুকে অনুসরণ করে। শৈশবের মতো কৈশোরেও উচ্ছ্বলতার আবেগে ভেলা ভাসায় দুজন। ঝুরিতে ঝোলা দুই কিশোরের ছন্দবদ্ধ যাতায়াত এক অদ্ভুত ঐকতান তৈরি করে। দূর থেকে তাদের চলমান শিল্পকর্মের মতো দেখায়।
ঝুরিতে দুলে আগুপিছু করতে করতে কথপোকথন চলে। অতুল বলে, ‘জানিস, কাল রাতি একটুও ঘুমুতি পারিনি নন্দী।’ নূর আলম বলে, ‘কেন?’ অতুলের জবাব, ‘পিটির ব্যতায়’। এবার নূর আলমের কণ্ঠে বিস্ময়, ‘পিটির ব্যতায়!’
—হুম, কাল তোর ওই ভারি বাক্স ওর পিটি করে নিয়ে গিলাম না! তাই ওর পিটি ব্যতা হইচে। সারা রাত ঘুমুতি পারিনি। আমারও ঘুমুতি দেয়নি। খালি ডাকাডাকি করেচে। ব্যানবেলা পিটি তেল মালিশ করে দুয়ার পর তাই এট্টু ঘুমোয়চে।
—ও, তাই বলি ওর পিট এত চকচক কচ্চে কিসির জন্যি।
নূর আলমের বুঝদারি জবাব শুনে মাথা দোলায় অতুল। বলে, ‘কী ছিল রে বাক্সে? অত ভারী কেন?
—কিতাব, এবার অনেকদিন ছুটি তো তাই নিয়ে আসলাম সঙ্গে করে। তা নন্দী কী তোসসাথে ঘুমোয়? কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নূর আলম।
—‘হ্যায়’, সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে চুপ করে যায় অতুল।
—ভৃঙ্গির সাথে তো এবার দেখাই হচ্চে না। খুব ঘরকুনো হয়ে গেচে মনে হচ্চে, বাড়িত্তে বেরোয় না নাকি? হাসি হাসি মুখে বলে নূর আলম। কালবৈশাখীর আগে প্রকৃতি যেমন থমকে যায় নূর আলমের কথা শুনে কিছুটা তেমনই থমকে গেলো অতুল। ঝোলাঝুলি বাদ দিয়ে ঝুরি থেকে টপ করে নেমে পড়ে সে। ধীরে ধীরে ছাগলটির কাছে গিয়ে বসে। পরম স্নেহে ছাগলের গায়ে হাত বোলাতে থাকে। এমন কিছু ঘটবে বুঝতে পারেনি নূর আলম। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। ঝুরি থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় অতুলের কাছে।
—কী হইচে রে? ইরাম কচ্চিস ক্যান? ভৃঙ্গির কিছু হইচে? প্রশ্নগুলো একনাগাড়ে করে নূর আলম। চুপ করে থাকে অতুল। তার কাঁধে হাত রাখে নূর আলম।
—শ্যালে নে গেচে, শ্যালের পেটে গেচে আমার ভৃঙ্গি। ছলছলে চোখে জবাব দেয় অতুল।
—ইন্নালিল্লাহ, শ্যালে নে গেচে! অতবড় ছাগল শ্যালে নে গেলো কী করে? টের পাসনি? বিস্ময় ধ্বনির সঙ্গে খানিকটা হাহাকারও বেরিয়ে আসে নূর আলমের কণ্ঠ চিরে। মাথা নাড়ে অতুল। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল টপ করে পড়ে পরনের কাপড়ে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর তৃষা ঘেরা সুক্ষ্ম সুতোর তন্তুজালে দ্রুত মিলিয়ে যায় জলের ফোঁটাটি। হাতের চেটোয় চট করে চোখ মুছে ফেলে অতুল। ঝরা পাতার মতো এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে মুখে।
ভৃঙ্গি গেচে তো কী হইচে? নন্দী তো রইচে। ভগবানের কাচে কয়ে রাকলাম। নিচ্চয় ভগবান এর একটা বিহিত করবে।
—একমাস আগের ঘটনা। পত্তেকদিনির মতো সেদিনও নন্দী-ভৃঙ্গিকে সন্ধ্যার সুমায় পেটভরে খাওয়ায়ে গোইল ঘরে বেইন্দে থুলাম। সকালে উটে দেকি শুদু নন্দী রইচে, ভৃঙ্গির কোনো চিন্নোই নেই। বাবা-মা আর আমি মিলে সারা গিরাম খুজিচি, পাইনি। তবে শ্যালেদের মদ্দি এট্টা মোছোলমান শ্যাল ছেলো।
অবাক হয়ে যায় নূর আলম—মোছোলমান শ্যাল? শ্যাল আবার মোছোলমান হয় নাকি? বুকা মার্কেট কনেগার।
ম্লান হাসি চোখ ছোঁয় না অতুলের। মুখের অলিন্দে কেবল আপন মনের খেয়ালে আঁকিবুকি কেটে যেতে থাকে। বলে, গোইল ঘরের দোরের পাশে একটা গোল টুপি পাইলাম, তাতে ছাগলের পায়ের ছাপ লেগে ছিল। মনে হয় ঘাড়ে তুলে নুয়ার সুমায় ভৃঙ্গির লাথি লেগে পড়ে গিলো। মুক বেন্দে নিলো মনে হয়, তা না হলি তো ডাক শুনতি পাত্তাম। চুপচাপ চলে যাওয়ার বান্দাতো ভৃঙ্গি না। সেইদিন সন্দ্যের পর মোছোলমান শ্যালের চিহারাডাও দেকলাম। কিন্তু চিনতি পারিনি, পরে চিনলাম।
—বলিস কী? উত্তেজিত হয়ে ওঠে নূর আলম।
শান্ত সমাহিত মুখভঙ্গিতে বলে যেতে থাকে অতুল—সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর সন্দ্যের সুমায় বাবা আর আমি বসে ছিলাম বারান্দায়। এমন সুমায় এলো সেই শ্যাল। সাথে একটা হিন্দু শ্যালও ছিল।
নূর আলমের চোয়াল ঝুলে পড়ে। শিয়াল আবার হিন্দু বা মুসলমান হয় কী করে! অতুলের কথাগুলো ধাঁধার মতো লাগে তার কাছে। মস্তিষ্কের সেলগুলো ধাঁধার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত উঠলে চোখ দুটো খাবি খাওয়া মাছের মতো হয়ে ওঠে। সেই চোখ নিয়ে সে অতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
গ্রামের নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে জীবনে যুবকদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হলো তাসের আসর। সারাদিন মাঠেঘাটে খাটাখাটনির পর সন্ধ্যার দিকে নদীর পাড়ের ছাপড়ায় গিয়ে হাজির হয় গ্রামের কয়েকজন যুবক ছেলে ছোকরা। এমনিতে তাসের আসরেই তাদের বিনোদনের তৃষ্ণা মিটে যায়। কিন্তু সেদিন সেই আসরেই নতুন এক উত্তেজনা রঙ ছড়ায় মুজিতের কথায়। কথায় কথায় সে একটা পিকনিকের প্রস্তাব দেয়। বারুদের স্তূপে দেশলাইয়ের একটা কাঠি পড়লো যেনো। সামান্য স্ফুলিঙ্গ মুহূর্তে ডালপালা ছড়িয়ে দাবানল হয়ে উঠলো। নানা রকমের নকশার পশরা বসে গেলো চোখের নিমেষে। দুয়েক কথায় শুরু হয়ে সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে যায় মধ্য রাতের একটু আগে। দশচক্রে যেখানে ভগবানই ভূত হয়ে যান, সেখানে তরুণ রক্তের খলবলানিতে কিছু অন্যায় ন্যায় হয়ে উঠবে এটাই যেনো নিয়তি। নিজের আপন ভাইয়ের মতো নন্দী-ভৃঙ্গিকে আদর করে অতুল। যুবকদের কেউ কেউ সে কথা ভালো করেই জানে। প্লানের সময় তাই দুয়েকজন দুর্বল গলায় ভেটো দিলেও শেষ মেষ অন্যদের তোপের মুখে রাজি হতে বাধ্য হয়। সে রাতেই উধাও হয়ে যায় অতুলের ভৃঙ্গি।
সেদিন সন্ধ্যার পর ক্লান্ত শরীরে ভাঙা মন নিয়ে মনোরঞ্জন আর অতুল অধোবদনে বারান্দায় বসে আছে। সন্ধ্যার লালিমা শেষ হলে কালচে আলো প্রকৃতির পরতে পরতে নিজের জাল বিছিয়ে দিচ্ছিল। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে তুলসী পূজো শেষ করে আবার ঘরে ঢুকে যায় মাধবী। বাপ-ছেলের কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। ছেলের কষ্টেই মনোরঞ্জন জর্জরিত হয়ে আছে। ছাগল ছানা দুটোকে বাড়িতে আনার পর অতুলই তাদের সমস্ত দায়িত্ব নেয়। খাওয়ানো নাওয়ানো সব নিজের হাতেই করে। ক্রমে অবলা জন্তু দুটোর প্রতি তার অন্তর স্নেহ ভালোবাসায় টইটম্বুর হয়ে যায়। মনুষ্য হৃদয়ের এই মহত্ত্বের জন্যই হয়তো মানবজাতীকে আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা দিয়েছেন বিধাতা। কিন্তু যে মানুষের হৃদয়ে এতো স্নেহ ভালোবাসা থাকে, সেই মানুষের অন্তরেই কেনো হিংস্রতা বাসা বাঁধে তা বুঝে ওঠে কার সাধ্যি।
বারান্দার খুঁটিতে বাঁধা রয়েছে নন্দী। সামনে ঘাস-পাতা কিছু না থাকায় অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে তাকে। থেকে থেকে ‘ম্যাএএ’ ধ্বনি বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে। কারো কোনো খেয়াল নেই সেদিকে। ছেলের মনের অবস্থা পুরোপুরি না বুঝতে পারলেও সারাদিনের দুশ্চিন্তা আর ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে অবসন্নতায় আচ্ছন্ন ছিল মনোরঞ্জন। ঘর থেকে কূপি হাতে বেরিয়ে আসে মাধবী। বারান্দার এক কোনে রেখে ছেলের পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ‘চিন্তে করিসনে বাপ, আমরা কেউই চেরদিন ইকেনে থাকপো না। ভৃঙ্গি গেচে তো কী হইচে? নন্দী তো রইচে। ভগবানের কাচে কয়ে রাকলাম। নিচ্চয় ভগবান এর একটা বিহিত করবে।’
এমন সময় দুই যুবককে দেখা গেলো উঠোনের প্রান্তে। তাদের দুজনের হাতে কী যেন রয়েছে। আবছা আলোয় স্পষ্ট বোঝা যায় না।
—রঞ্জন দা বাড়ি আচো?
সুখি সুখি কণ্ঠের হাঁকডাকে নড়েচড়ে বসে মনোরঞ্জন। বলে, কিডা, মুজিত নাকি?
—হ্যায় দাদা। তড়িৎ জবাব মুজিতের।
—‘সাতে ওডা কিডা? আবছা আলোয় ঠাহর করতে না পেরে তীক্ষ্ম চাহনির বাতি জ্বালিয়ে চেনার চেষ্টা করে মনোরঞ্জন। গলায় তাই সামান্য সন্দেহের রেশ রয়ে যায়।
—আমি, আমি গো দাদা। তোয়াজ মাখানো আবদেরে একটি কণ্ঠ সাড়া দেয়। কিঞ্চিৎ ঝাঁঝের সঙ্গে অসন্তোষ প্রকাশ করে মনোরঞ্জন, আমিডা আবার কিডা? নাম বলতি কী হয়?
এমন সময় কূপী বাতির ফিকে আলোর বৃত্তে প্রবেশ করে যুবক।
—ও বলাই! তা এই সন্দ্যে রাতি তুমরা কী মনে করে?
—কিছু না দাদা, এমনি আলাম। আইজ এট্টা পিকনিক কল্লাম তো, তাই ভাবলাম তুমাগের জন্যি এট্টু নে আসি। খুকার জন্যি এট্টু খেচুড়ি আর গুস্ত, তা অবশ্য তুমরা সবাই মিলিই খাতি পারবা।
রান্না করা ভৃঙ্গির মাংস যেন হঠাৎই প্রাণ পেয়ে গেছে। ছাগশিশুর উৎফুল্ল দাপাদাপি উপলব্ধি করে সে পেটের আনাচে কানাচে। গা গুলিয়ে ওঠে তার।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে হাতের গামলাটি বারান্দায় রাখে বলাই। সেটার পাশে নিজের হাতের গামলাটি রাখতে রাখতে মুজিত বলে, তা বেশি বড় খাসি কিনতি পাল্লাম না দাদা। চান্দা যা ধরিলাম তা সব উঠিনি। সব উঠলি বড় দেকে একটা কিনা যেতো। বুজলে দাদা, পিকনিক করার বাতিক আচে ষোলো আনা কিন্তুক চান্দা দিতি চায় না কেউ। কি যে সব ছেলে পেলে। যেগ্গে, গামলা দুডো আজুড় করে দিলি এট্টু ভালো হতো বৌদি। সবাই বসে রইচে…।
কথার ঝাঁপি খুলে দিয়ে অনবরত বকবকিয়ে যেতে থাকে মুজিত। অর্থহীন সেই প্যাচাল ভালো লাগে না কারোরই। মাধবী দ্রুত গামলা খালি করে দেয়। এরপর বিনয়ের অবতার হয়ে যায় বলাই আর মুজিত। গলে যাওয়া সাবানের মতো লেপ্টে থাকার ছ্যাঁচড়ামিতে পিননিকের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে যেতে থাকে।
তাদের এই অতি ভক্তির কোনো কারণ খুঁজে পায় না মনোরঞ্জন। বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠে তার মন। হঠাৎ সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে নন্দীর ওপরে। স্বজন হারানোর ব্যথা না কি ক্ষুধার তাড়নায় খানিক পরপর ছাগলটি ডেকে উঠছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল না। আচমকা ঝাঁঝের সঙ্গে বিস্ফোরিত হয় মনোরঞ্জন। বলে, ওই অতুল, ওডা ওরাম করে ভ্যাবায়ে মচ্চে কিসিজজন্যি? থামা ওডারে, নালি এক বাড়িতি মাথা ফাটায় দুবানে। মন মিজাজ খারাপ আছে বলো।
মনোরঞ্জনের শান্ত পুকুরের মতো মেজাজ মূহূর্তে এমন ভয়ঙ্কর ঢেউ তোলা সাগর হয়ে উঠবে তা মুহূর্তকাল আগেও কেউ আঁচ করতে পারেনি। অতুল দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ছাগলের দড়ি ধরে সেটিকে চোখের আড়ালে নিয়ে যায়। কূপিটা তুলে নিয়ে ঘরে ঢোকে মাধবী। কথার ট্রেন এভাবে থেমে যাবে বুঝতে পারেনি মুজিত। আচমকা কড়া ব্রেক মারার ঝাঁকুনিটা সামলাতে গিয়ে সাজানো কথা মালার শব্দ লহরীতে ঠোকাঠুকি লেগে যায় তার। সেগুলো সাজিয়ে নেওয়ার আগেই রাস্তা মাপতে শুরু করে বলাই। বাধ্য হয়ে তার পিছু নেয় মুজিত। হঠাৎ এসে ভর করা আড়ষ্ঠতা তখনো কাটেনি তার।
পরের দিন সকালে বমির শব্দে ঘুম ভাঙে মনোরঞ্জনের। চোখ ডলতে ডলতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে সে। উঠোনের এক কোনায় ধনুক বক্রতায় বাঁকানো শরীরে বমির দমক সামলাচ্ছে অতুল। উদ্বিগ্ন চোখে ছেলেকে এক হাতে ধরে রেখেছে মাধবী। অন্যহাতে জল ভর্তি ঘটি। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় মনোরঞ্জন—কি হইচে, বমি কচ্চে কিসিজজন্যি? উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করে সে। মাধবীর হাত থেকে ঘটিটা ছিনিয়ে নিয়ে আজলা ভরে পানি নিয়ে ছেলের মাথায় ঝাপটা দেয়। বমি থেমে গেছে অতুলের। চোখদুটো লাল হয়ে রয়েছে তার। কানায় কানায় ভর্তি গ্লাসের কিনারা উপচানো টলটলায়মান জলের বাড়বাড়ন্ত তার চোখে। ছলছলে সেই চোখ তুলে তাকায় বাপের দিকে। নীরবে ডান হাত বাড়িয়ে দেয়। সেখানে ৪/৫ হাত লম্বা একটা দড়ি গোল পাকিয়ে রাখা। দড়িতে সামান্য রক্ত লেগে আছে।
—পিকনিকির উকেনে পাইচি। কোনোমতে কথাগুলো বলে অতুল। তারপর ঝরঝর করে নেমে আসে দুচোখের ঝর্ণাধারা।
দড়ি দেখেই মুখ বিকৃত হয়ে যায় মনোরঞ্জনের। সেটা যে ভৃঙ্গির গলার দড়ি তা আর তাকে ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হয় না। অনেক দিনের চেনা এই দড়ি। গত রাতে খিচুড়ি-মাংস দিয়ে বেশ আরাম করে চারটি খেয়ে বিষণ্ন মনের ওপর সান্ত্বনার পট্টি লাগিয়ে অবসন্ন শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল মনোরঞ্জন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ে। সকালে উঠে এই রূঢ় বাস্তবতা তাকে বিমূঢ় করে দেয়। রান্না করা ভৃঙ্গির মাংস যেন হঠাৎই প্রাণ পেয়ে গেছে। ছাগশিশুর উৎফুল্ল দাপাদাপি উপলব্ধি করে সে পেটের আনাচে কানাচে। গা গুলিয়ে ওঠে তার।
চলবে…