০১
ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে আয়েসি ঢঙে দুলে দুলে একটা বাস এগিয়ে আসছে। পেছনে ধুলোর মেঘ। থামার জন্য বাসটি ব্রেক করলেও থামে না। ব্রেকের ক্যাঁচকোচ শব্দ তুলে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে তবেই থামে। এরপর ধীরে ধীরে ধুলোর মেঘের মধ্যেই হারিয়ে যায়।
ধুলো পরিষ্কার হতে লাল ছইওয়ালা একজোড়া প্লাস্টিকের স্যান্ডেল-পরা পা বাসের দরজায় দেখা যায়। পা দুটি লাফ দিয়ে নেমে আসে নিচে। বাসের হেলপার রঙিন নকশা করা টিনের একটা তোরঙ্গ পায়ের মালিকের হাতে ধরিয়ে দেয়। ভার সইতে না পেরে একদিকে কাত হয়ে যায় তোরঙ্গ। এলোমেলো গুটিকয়েক পা ফেলে বাক্স ও নিজের টাল সামলায় লাল স্যান্ডেলের মালিক। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই দুলতে শুরু করে বাস। ফৎ-ফৎ-ফড়াৎ করে মনুষ্য শরীরের বায়ু নিষ্কাশনের মতো বিকট শব্দ তুলে একরাশ কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসে। সেই কালো ধোঁয়া টাল সামলে সদ্য মুখতুলে দাঁড়ানো লাল স্যান্ডেলের মালিকের মুখের কালির প্রলেফ মেখে দেয়। এরপর হেলে দুলে চলতে শুরু করে।
১৪/১৫ বছর হবে লাল স্যান্ডেলের মালিকের বয়স। তার মাথায় চড়ে টিনের তোরঙ্গটি ঢেউ তুলে এগিয়ে চলে। বড় রাস্তা ছেড়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটি মেঠোপথে পা রাখতেই খুশিতে ঝলমল করে ওঠে তার মুখ। দূর দীগন্তে গভীর হয়ে উঠেছে গাছের রহস্যময় ঘনত্ব। সেটাই ওদিকে একটা গ্রামের অস্তিত্বের কথা জানান দিচ্ছে। সেদিকে চেয়ে বাসের কালিতে কালিয়ে যাওয়া মুখটিতে সাদা একপাটি দাঁত নিঃশব্দে ঝকমকিয়ে ওঠে। চোখ দুটিতে ছলকে ওঠে খুশির আভা।
বাড়িতে পৌঁছতে হলে এই পথে মাইলদুয়েক হাঁটতে হবে তাকে। চড়চড়িয়ে ওঠা রোদের প্রচণ্ড তাপে অল্প সময়েই আকাশি নীল জোব্বা পিঠের কাছটাতে ভিজে যায়। তোরঙ্গের নিচে মাথায় নারকেলের মালার মতো সাদা গোল টুপি। তার ফাঁক বেয়ে ঘাম চুইয়ে পড়ে কানের পেছনে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ঘাম মোছার জন্য পালাক্রমে হাত নামাতে হচ্ছে তাকে। মাথায় ওজনদার তোরঙ্গ থাকায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে পা। টাল সামলে নিয়ে আবারও ধুলোর মধ্যে থপথপে পা ফেলে তোরঙ্গে ঢেউ তুলে হাঁটা। ধুলোর আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লাস্টিকের লাল জুতা চাকচিক্য হারিয়ে ধূসর ম্লান হতচ্ছাড়া চেহারা পেয়ে যায়।
গলায় আচমকা টান পড়ায় ঘাস চিবানো থেমে গিয়ে বিজাতীয় একটা শব্দ বের হয়ে আসে ছাগলের গলা দিয়ে।
চলতে চলতে পথের ধারে একটি ঝাঁকড়া আম গাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। গাছটিকে ভালো করে দেখে। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আবার চলতে শুরু করে। ইতোমধ্যে জোব্বার বুকের কাছটাতেও খানিকটা ভিজে গেছে। মাথার ঘামে ভিজে কালিমাখা মুখটি বেশ বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মুখে হাসি ধরে রেখে হাঁটতে থাকে সে। টিনের তোরঙ্গও চলে ঢেউ তুলে। সাদা পায়জামা ধুলো লেগে গোড়ালির কাছে ধূসর হয়ে ওঠে। টিনের তোরঙ্গের ছায়া পড়ে পথে। নিজের ছায়া মাড়িয়ে এগিয়ে চলে সে। ছায়া মাড়িয়ে চলতে চলতে মজা করে ছড়া কাটে:
আল্লাতালা রোদ বেশি দিয়ে, বাতাস দিলো কম
টিনের বাক্স মাথায় নিয়ে চলে নূরালম
রোদের তাপে ঘাম হচ্ছে, ভিজে যাচ্ছে জুব্বা
খেতে মজা লাগে আমার পাউরুটি-মুরাব্বা
পথের পাশে জলাশয় দেখে থামে সে। তাকিয়ে থাকে পানির দিকে। হালকা বাতাসে ছোট-ছোট ঢেউ ওঠে পানিতে। রোদ লেগে চিক চিক করছে কচি ঢেউগুলো। সেই চিকচিকে বর্ণচ্ছটায় লাল জুতার মালিক নূর আলমের চোখও চকচক করে ওঠে। তোরঙ্গের ছায়া পড়া মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে ওঠে। আবার হাঁটতে থাকে সে। বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে পথে একটি বটগাছ পড়ে। দূর থেকে সেদিকে তাকিয়ে নূর আলমের চাহনিতে সামান্য চঞ্চলতা প্রকাশ পায়। চাহনিতে কিসের যেন প্রত্যাশা। গাছের আড়াল থেকে একটা ছাগলের পেছনের অংশ দেখা যাচ্ছে। বিড় বিড় করে ছড়া কাটতে থাকে নূর আলম, সেই সঙ্গে হাঁটার গতিও বেড়ে যায়। গাছের কাছাকাছি গিয়ে এলোমেলো হয়ে যায় ছড়া।
ঘামে ভিজে যাচ্ছে আমার পাউরুটি-মুরাব্বা
কামড়ে খেতে ইচ্ছে করে আকাশ রঙের জুব্বা
আমাকে মাথায় নিয়ে বাক্সটা ঘামে কুল কুল
ছাগল নিয়ে বসে আছে নিশ্চয় ব্যাটা অতুল!
গাছের আড়াল থেকে তার বয়সী একটি ছেলে বেরিয়ে আসে। ডান হাতের তর্জনিতে প্যাঁচানো দড়ির অন্য প্রান্ত কালো একটা ছাগলের গলায়। অন্য হাতে একগোছা ঘাস। ছাগলটির মুখ ছাপাখানার মেশিনের মতো অনবরত চলছে। গালভরা ঘাস তার। লম্বাটে ঠোঁটের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আছে সবুজ রসালো ঘাস। মানুষ গাল ভরে খাবার খায়। কিন্তু এই ছাগলটি মানুষের সেই বিশেষ অভ্যেস কিভাবে আয়ত্ত করেছে, তা গবেষণার বিষয়।
মাথায় টিনের তোরঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নূর আলম। কালিমাখা মুখে ঘামের বিচিত্র কারুকার্য। হঠাৎ চিনে ওঠা মুশকিল। কিন্তু প্রাণবন্ত দু’টি চোখ আর দু’কান প্রসারিত ঝকমকানি দাঁতের এই হাসি খুবই পরিচিত অতুলের। বহুদিন পর বন্ধুকে সামনে পেয়ে কী করবে, বুঝতে পারে না। হঠাৎ ‘তালবেলেম’ বলে চিৎকার করে নূর আলমকে জড়িয়ে ধরে। গলায় আচমকা টান পড়ায় ঘাস চিবানো থেমে গিয়ে বিজাতীয় একটা শব্দ বের হয়ে আসে ছাগলের গলা দিয়ে।
অতুলের আবেগী আচরণের ঢেউ আছড়ে পড়ায় অপ্রস্তুত নূর আলম টাল সামলাতে পারে না। তোরঙ্গ ছিটকে পড়ে একপাশে। দুই বন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে যায়। ধুলোয় মাখামাখি হয়ে উঠে বসে। তারপর দুদ্দাড় করে নূর আলমের শরীর থেকে ধুলো ঝাড়তে শুরু করে অতুল। অতুলের ধুলোমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে নূর আলম। নূর আলমের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে অতুলও। নিস্তরঙ্গ জীবনের সাবলিলতায় হঠাৎ এই উৎপাতে হতভম্ব হয়ে পড়ে ছাগলটি। বিচলিত ভাব ফুটে ওঠে তার হাবভাবে। কিছু বুঝতে না পেরে জোরে ভ্যা করে ডেকে ওঠে। ছাগলের সেই ডাক শুনে দুই বন্ধু আবারও হাসিতে ফেটে পড়ে।
একটু পর দেখা যায় টিনের তোরঙ্গটি ছাগলের পিঠে চাপিয়ে ধুলোময় পথ ধরে বাড়ির দিকে চলেছে দুই বন্ধু। দুজনে তোরঙ্গের দুপাশ ধরে আছে। তোরঙ্গ পিঠে তুলে দেওয়ায় খুবই নারাজ ছাগল। চেহারায় তার স্পষ্ট ক্ষোভ। অতুল মাঝে মাঝে মুখে ঘাস গুঁজে দিচ্ছে। তারপরও তোরঙ্গ বয়ে নিয়ে যেতে গাইগুই করছে ছাগলটি। তবে দুই বালকের পাল্লায় পড়ে ছাড় পেলো না সে। গাইগুই করলেও বাক্স পিঠে নিয়েই চলতে হলো তাকে।
দুই.
নূর আলমদের সাংসারিক অবস্থা ঘাসের ডগায় শিশিরের মতোই টলমলে। অন্যের জমিতে বর্গা খাটে নূর আলমের বাবা নূরুজ্জামান। সংসারটা চলে যায় কোনোমতে। পাড়ার লোকের পরামর্শে ছেলেটিকে ১২ মাইল দূরে দারুল উলুম মাদ্রায় ভর্তি করিয়েছে। সেখানে ছেলের সব খরচ মেটাতে উপার্জনের প্রায় অর্ধেক চলে যায় তার। তা যাক, ছেলেটার তো এলেম শিক্ষা হবে! এই ভেবে তার মনে সবসময় একটা স্বস্তি কাজ করে।
তাছাড়া সবাই বলে, ‘কুরআনে হাফেজ হলে বাপের মৃত্যুর পর ছেলে নিজেই কুরআন পড়ে দোয়া-দুরুদ পড়ে লাশ কবরে নামাবে। সেই ছোয়াবের জোরেই তো নুরুজ্জামান কবরে বেহেস্তের বাগান পাবে। আখেরে নিশ্চিত বেহেস্ত।’ এসব কথা নুরুজ্জামানের মনে শক্তি জোগায়। সেজন্য পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুল বাদ দিয়ে ১২ মাইল দূরে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছে। একমাত্র ছেলেকে এতদূরে পাঠাতে চায়নি নূর আলমের মা সুকবাসী। অনেক কান্নাকটি করেছে। কিন্তু ওসব দিকে মন দিতে গেলে তো আর চলে না। মেয়ে মানুষ জগৎ সংসারের বোঝেটা কী! ক’দিন কান্নাকাটি করবে বড়জোর, তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
হলোও তাই। সুকবাসী এখন আর কাঁদে না। বরং ছেলের সুরেলা কণ্ঠে কোরআনের আয়াত শোনার আগ্রহ নুরুজ্জামানের চেয়ে তারও কম নয়। ছেলের জন্য গর্বই হয় এখন তার। অমন সুন্দর সুরেলা কণ্ঠে ক’জন কোরআন পড়তে পারে! আর দেখে পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। চোখ বন্ধ করলেই সব দেখতে পায় ছেলে। নূর আলমকে মাদ্রাসায় দেওয়ার সিদ্ধান্তকে তাই এখন সে সঠিক বলেই মনে করে। ৩/৪ মাস পর কয়েক দিনের জন্য বাড়ি আসে নূর আলম। অভাবের সংসার হলেও ছেলের জন্য এটা-সেটা গুছিয়ে রাখে সুকবাসী। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর ছেলেকে খাওয়ায়। সে সময় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে সুকবাসীর। শান্তির একটা শিহরণ বয়ে যায় সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে। সন্তানের সঙ্গে মায়ের এই নিবিড় স্নেহ-মমতার গভীর রহস্য অশিক্ষিত গ্রাম্য সহজ সরল এই নারীর চেতনার বাইরের বস্তু।
সেদিন সন্ধ্যায় একচালা ঘরের বারান্দায় খেজুরের চাটাই বিছিয়ে ছেলেকে নিয়ে বসে ছিল সুকবাসী। একটা টিনের বাটি সামনে। পাশে একটা টিনের মগে পানি। বাটিতে নাড়ুর মতো করে বানানো গুড় মাখানো খানিকটা চালভাজা। তাই একটা করে মুখে দিচ্ছে নূর আলম আর গভীর মমতা নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সুকবাসী। কেরোসিনের কুপি বাতির আলোয় কেমন যেনো অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ছেলেকে।
খেতে খেতে নূর আলম জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বা কনে গেছে মা? আগে কখনো বাড়ি আসতি এত দেরি দেখিনি।’ সুকবাসী বলে, ‘আজ মাঠ থেকে সুজা মোড়লের বাড়ি যাওয়ার কথা। কদিন বাদেই বকরা ঈদ। সেজন্যি টাকা আনতি গেছে বুদায়। সারা মাস তো মোড়লের জমিতিই কাজ কইল্লো।’ ছেলে বলে, ‘তালি কি এবার বেশি টাকা পাবে আব্বা? বেশি টাকা পালি খুব মজা হবে মা’। মা হালকা একটু ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘কী মজা হবে রে?’ খুশিতে উদ্ভাসিত হয় নূর আলমের চেহারা। মুখের চালভাজা চিবুতে চিবুতে সে বলে, ‘এবার তালি সবার জন্যি নতুন কাপড় কিনা যাবে। তুমার শাড়ি, আব্বার পাঞ্জাবি-লুঙ্গি আর আমার জন্যি একটা জামা।’
বাড়িতে ঢুকছিল নূরুজ্জামান। ছেলের কণ্ঠ শুনে ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে পড়ে। মা-ছেলের কথা শুনে হাসি হাসি হয়ে ওঠে তার সদা গম্ভীর মুখটি। একটু আগের আলাপটি কানে গেছে তার। সুকবাসী বলে, ‘জামা! জামা দিয়ে কী করবি তুই? তোর জন্যি তো জুব্বা আর পায়জামা বানাতি দিয়ে এইচে তোর আব্বা।’ চালভাজা চিবানো থেমে যায় নূর আলমের, ‘বানাতি দিয়ে এইচে!’ অবিশ্বাসে কেঁপে যায় নূর আলমের কণ্ঠ।
একটা হাহাকার যেনো বুক চিরে বেরিয়ে এসে দমকা বাতাসের মতো বয়ে যায়। নূর আলমের কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়ে,‘সারা বছর এই জুব্বা পরে থাকতি আর ভাল্লাগে না। মাদ্রাসায় সব সুমায় পরে থাকতি হয়। বাড়ি আসলিও পরে থাকি। এই নীল রঙ দেখলি এখন মনে হয় সারা দুনিয়া নীল হয়ে গেচে। আর যেনো কোনো রঙ নেই। আমার প্যান্ট আর জামা পত্তি ইচ্ছে করে মা। রঙিন একটা জামা!’ কথাগুলোর সঙ্গে ব্যথাভরা কাতর একটা আবেদন বেরিয়ে আসে নূর আলমের বুকের গভীর থেকে।
ছেলের আবদার শুনে স্তম্ভিত হয় সুকবাসী। কী সর্বনেশে কথা ছেলের! একজন তালবেলেম হয়ে রঙিন জামা আর প্যান্ট পরবে! গ্রামের সবাই বলবে কী! মনের সেই আশঙ্কাই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে সুকবাসীর। বলে, ‘এসব বলতি নেই বাপ। তুমি একজন তালবেলেম মানুষ। তুমার একটা সনমান আছে না! গ্রামের সবাই কিরাম ভালোবাসে তুমাকে। তুমার কুরান পড়া শুনে বুড়োরা পর্যন্ত কেন্দে দেয়। তুমার এই জুব্বার একটা আলাদা সনমান আছে। আর তুমি কিনা রঙিন জামা পত্তি চাও? তুমি রঙিন জামা পরে ঘুরে বেড়ালি সেই সনমান আর থাকপে? কও বাপ?’
সুকবাসী ভালো করেই জানে নিজেদের আর্থিক অসঙ্গতির কথা। বছরে দুটো জুব্বা ও পায়জামা বানিয়ে দেওয়া হয় ছেলেকে। এর বেশি কিছু করার সামর্থ্য তাদের নেই। আলাদা করে একটা জামা কিনতে গেলে নুরুজ্জামানের কত কষ্ট হবে তা তার অজানা নয়। তাই প্রসঙ্গ ঘোরাতে ছেলের কাছে কোরআন তেলাওয়াত শুনতে চায় সে। বলে, ‘এবার তুমাদের নতুন কী শিকোয়ছে বাপ? পতিবার তো শুনাও, এবার একটু শুনাবা না?’
তেলাওয়াতের ধ্বনি বাতাসে মিশে গিয়ে সস্নেহে মাথায় হাত বোলানোর মতো করে গাছের পাতাগুলোকে এলোলায়িত করে দিয়ে বয়ে চলে যায়।
নূর আলমের মনের ভেতরের ঝড় বাইরের আচরণে কিছুই টের পায় না সুকবাসী। শান্ত ও সংযতভাবে টিনের মগটা হাতে তুলে নেয় নূর আলম। পানির দিকে তাকিয়ে থাকে একটা মুহূর্ত। তারপর ছোট ছোট চুমুকে পান করতে থাকে। ততক্ষণে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। নফছকে দমন করে মনের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার শিক্ষা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছে সে। কিন্তু সে তো অন্যের কাছে মনের কথা প্রকাশ করেনি। করেছে নিজের মায়ের কাছে। একান্ত আপনজনের কাছেও নফছকে দমন করতে হবে! তার মনের ছোট্ট অলিন্দে প্রচণ্ড একটা ঝড় বয়ে যায়। হুজুরের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে নূর আলমের, ‘নফছ হইলো শয়তানের তাল্লুক। নফছ মানুষকে বেপথে নে যায়। তাই সদা সবকিছু থেকে নিজের নফছকে দমন করিবে। কখনই নফছকে জয়ী হইতে দিবে না। বুঝে এসেছে?’
শেষ একটা চুমুকে মগের পানি শেষ করে নূর আলম। মুখে তার একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে। সমুদ্র মন্থনের তোলপাড় অন্তরে তালাবন্ধ রেখে, কালকুট পানের পর মহাদেবের নীলকণ্ঠী হয়ে ওঠার ব্যথাভরা হাসির মতোই স্মিত এ হাসি। নূর আলমের হাসির ভিন্ন অর্থ করে সুকবাসী। সে ভাবে, তার কথায় খুশি হয়েছে ছেলে। অশিক্ষিত হয়েও দুটো জ্ঞানের কথা বলতে পারার সুখ অন্তরের ভেতর-বাইরে দোলা দিয়ে যায় তার।
তেলাওয়াতের আগে একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে নূর আলমের মুখ। প্রস্তুত হয়ে সুরা আর রহমানের অংশ বিশেষ তেলাওয়াত শুরু করে। অনেকেই প্রশংসা করে তার তেলাওয়াতের। মনকে ঠাণ্ডা করার জন্যই যেনো গলায় সুরের ঢল নামে তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই তেলাওয়াতের মধুর একটা দ্যোতনা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। চোখ বন্ধ করে দুলে দুলে তেলাওয়াত করতে থাকে সে। অচেনা শব্দগুলোর রহস্যময় মাহাত্ম্যের কথা ভেবে শঙ্কা মিশ্রিত শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে সুকবাসীর সমগ্র অস্তিত্ব। আপন জঠরে বেড়ে ওঠা নিজ সত্ত্বার অংশ এই কিশোর ছেলেটিকে হঠাৎ করে খানিকটা অচেনা মনে হয় তার। গর্ব অনুভব হয়, মুগ্ধ হয়ে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সুকবাসী। এ সময় পায়ে পায়ে বাড়ি ঢোকে নুরুজ্জামান। কথা না বলে স্ত্রীর পাশে বসে পড়ে সে। সুকবাসী তার দিকে তাকালে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ থাকার ইঙ্গিত দেয়। কুপির অস্পষ্ট আলোয় দুজনের চেহারায় আত্মতৃপ্তির হাসি ভুবন আলোকিত করে উজ্জ্বল হয়ে লেগে থাকে।
একটা জামার সখ নূর আলমের বহুদিনের। মাদ্রাসায় যাওয়ার পর থেকে আর জামা পরেনি সে। আকাশী নীল রঙের জোব্বা আর সাদা পায়জামা তার মাদ্রাসার ইউনিফর্ম। এটাই তাকে সারাবছর পরে থাকতে হয়। বাড়ি আসলেও এই পোশাকই পরতে হয়। কারণ আলাদা আর কোনো পোশাক নেই তার। সমবয়সীরা যখন শার্ট-প্যান্ট পরে চলাফেরা করে সে চেয়ে থাকে তাদের পোশাকের দিকে। রঙ আর সৌন্দর্যের বিশ্লেষণ চলে তার মনের গহীনে। নিজেকে তাদের যায়গায় রেখে কল্পনা করে মনে মনে খানিকটা শান্তি পায় সে। কিন্তু বাস্তবে যখন আকাশি নীল জোব্বার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে, মুখের হাসি চৈতি বাতাসে শিমুল তুলোর মতো ছন্দহারা হয়ে হারিয়ে যায়। গ্রামের লোকজনও এখন আর তাকে এ পোশাক ছাড়া কল্পনা করতে পারে না। সবার কাছে সে এখন ছোট হুজুর।
তার যে বয়স, সে বয়সে কত রঙিন স্বপ্ন থাকে মনে। কিন্তু মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে যেনো শৈশবটাকেই হারিয়ে ফেলেছে নূর আলম। চাইলেই আর আগের মতো অতুলের সঙ্গে আমগাছের ডালে বসে দুলতে বা জলাশয়ে দাপিয়ে বেড়াতে পারে না। ঘুড়ি ওড়ানো, লাটিম বা মার্বেল খেলা এখন স্বপ্নেরও অগোচর। কৃত্রিম একটা গাম্ভীর্যের আড়ালে রাখতে হয় নিজেকে। সে না চাইলেও গ্রামের লোক বা অন্যরা তাকে বাধ্য করে সেই মুখোশের মধ্যে থাকতে। এসব ভালো লাগে না নূর আলমের। বয়সের ধর্ম মেনে সেও দূরন্ত হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু যেখানে পোশাকের স্বাধীনতাই নেই, সেখানে আচরণের লাগাম কী করে ছেড়ে দেবে সে?
সংসারের অভাবের কথা নূর আলমেরও অজ্ঞাত নয়। তাই সে ভেবেছিল আগে থাকতেই জুব্বার বদলে বাবাকে একটা জামার কথা বলবে। একটা জোব্বা প্রায় নতুনই আছে। সেটা দিয়েই চালিয়ে নেবে ভেবেছিল। আশা ছিল বাবাকে বললে নিশ্চয়ই ফেলবে না সে কথা। কিন্তু বাবা আগেই জোব্বা বানাতে দিয়েছে শুনে তার সেই আশার কিশলয় মুহূর্তে শুকিয়ে ঝরে গেলো। মনের ভেতরে এসব তোলপাড় নিয়েই অভ্যেসবশত নির্ভুলভাবে তেলাওয়াত করে যেতে থাকে নূর আলম। তেলাওয়াতের ধ্বনি বাতাসে মিশে গিয়ে সস্নেহে মাথায় হাত বোলানোর মতো করে গাছের পাতাগুলোকে এলোলায়িত করে দিয়ে বয়ে চলে যায়।
চলবে…