এখন সময় রাত তিনটা বিশ মিনিট। অন্ধকারেও ঘড়ির কাটা অনুমান করা যাচ্ছে। আমি বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখলাম। ভেতরে ভ্যাপসা গরম। কাঁচ ঘোলা হয়ে আছে। হাতে পানি নিয়ে কাঁচ পরিষ্কার করলাম। কলের পানি ফ্লোরে পড়ে ছরছর শব্দ হচ্ছে। মাথার ওপর পুরনো এনার্জি বাল্বের অপরিচ্ছন্ন আলো। এই বাতির আলোয় চোখে যন্ত্রণা করে।
পানির একঘেয়ে শব্দ হয়েই যাচ্ছে। এনার্জি বাল্বের গোড়া থেকে একটা টিকটিকি তরতর করে নেমে আসছে। টিকটিকিটা স্বাভাবিকের তুলনায় লম্বা। পেটের ভেতর দলা দলা ফুলে উঠেছে। মনে হয় পেটে ডিম আছে। টিকটিকিটা যত নিচে নামছে ততই লম্বা মনে হচ্ছে। এত বড় কেন? এ গিরগিটি নয় তো?
বাথরুমের দরজা খুলে বের হতেই গা ছমছম করে উঠলো। বাইরে বাতি দেওয়া হয়নি। স্ট্রিট লাইটের কিছু হলুদ আলো জানালার ফাঁক গলে ভেতরে আসছে। চারদিকে তরল অন্ধকার। সিঁড়ির গোড়ায় খট জাতীয় শব্দ হলো। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। প্রতিরাতে কোত্থেকে যেন একটা বিড়াল আসে। গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করে। ময়লার ঝুড়ি কাত করে ফেলে দিয়ে ময়লা খায়। সিঁড়ির গোড়ায় খট শব্দ বিড়ালেরই। ভয় পাওয়ার মতো কিছু না। তবু ভয় পাচ্ছি। ঘটনাটা মনে করে ভয় পাচ্ছি। আমি যে ঘরটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেটাকে এর আগে কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। দোচালা টিনের ঘর। মাঝখানে বেড়া দিয়ে দুই রুম করা হয়েছে। একপাশে টিন কেটে সামান্য দরজা। আমরা এক ঘরে আছি। পাশের ঘর খালি। একটি মেয়ে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করছে। তবে তার চিৎকার জোরালো হচ্ছে না। মেয়েটিকে আমি একই সঙ্গে চিনি এবং চিনি না। পুরুষটিকেও চিনি না। লোকটার হাতে একটা স্টিলের ছুরি। বাতির আলোয় চকমক করছে। লোকটিকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।
বেড়ার টিন ঘেঁষে একটা চৌকি পাতা। তারা দুজনই সেটাতে বসে আছে। বিছানায় ময়লা চাদর। মেয়েটা প্রাণপণ বাঁচতে চাইছে। তার মুখে কাতর অসহায়ত্ব।
পুরুষ লোকটা থাবা গেড়ে বসে আছে। তাকে দেখাচ্ছে হিংস্র নেউলের মতো। সুযোগ পেলেই ঝাপিয়ে পড়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করবে । তার চোখেমুখে বিভৎস ক্রোধ। আমি এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। লোকটা আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ করছে না। সে কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না?
হঠাৎ করেই মনে হলো মেয়েটিকে আমি চিনি। সে আমার স্ত্রী। তার নাম অরিন। আমি আদর করে অরু ডাকি। আমার মাথায় খুন চেপে বসলো। আমি এই জানোয়ারটার ওপর লাফিয়ে পড়লাম। তার হাত পা ভীষণ বলশালী। লোহার মতো শক্ত। দীর্ঘক্ষণ আমরা রুদ্ধশ্বাস লড়ে গেলাম। সে বারবার আমার গলা টিপে ধরে। আমি দম বন্ধ হতে হতে বেঁচে যাই। একবার আমি তাকে নিচে ফেলে বুকের ওপর হাঁটু গেড়ে বসলাম। এবার আর নড়াচড়া করতে পারছিল না। তার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকলাম। বাম দিকে তলপেটে একটা আঘাত করলাম। অনেকখানি কেটে ফাঁক হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে লোকটা নিস্তেজ হয়ে এলো। এতসব ঘটলো বোবাসিনেমার মতো। আমরা এত চিৎকার চেচামেচি ধস্তাধস্তি করলাম, কিন্তু কোনো শব্দই পাওয়া গেলো না। বা কেউ ছুটে এলো না। আমার গায়ে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। বুকের ওপর ছিটা-ছিটা রক্ত। নিজেকে অপরিচিত মনে হচ্ছে।
আমি তার বুকের ওপর থেকে নেমে পড়লাম। ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাতেই আমার ভুল ভাঙলো। এ তো আমার স্ত্রী অরু না! আমার বড় বোন শীলা। কী অদ্ভুত!
আমি গত শুক্রবার দুপুরে তার ঘরে ভাত খেয়েছি। ঝাল করে মুরগীর মাংস রেঁধেছিলেন। ফেরার সময় রিকশা ভাড়া দিয়েছেন।
শীলা আপা কোনো কথা বলছেন না। নিথর পড়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকাতে গিয়ে ভীষণ চমকে উঠলাম। যাকে আমি একটু আগে খুন করে ফেলেছি, সে আমার দুলাভাই। শীলা আপার বর। তাদের একটা ছেলে আছে। নাম নিখাদ। ক্লাস টু-তে পড়ে। ছেলেটা এখানে নেই। আমি গভীর খাদে পড়লাম। আতঙ্কে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসছে। এই লাশ লুকাবো কোথায়? পুলিশ আমাকে ধরে ফেলবে।
হঠাৎ করেই পাশের ঘরটিতে হুড়মুড় করে কিছু লোক ঢুকলো। এদের আমি চিনি না। শুধু একজনকে চিনি। তার নাম জামাল। অটোরিকশা আছে তার। মেয়ের নামে গাড়ির নাম। সানজিদা পরিবহন। একবার তার গাড়িতে চড়ে আমরা নদী দেখতে গিয়েছিলাম। যেতে আসতে পাঁচশ টাকা ভাড়া। সে ঈদের কথা বলে সাতশ টাকা নিয়ে নিলো। জামাল ভাইয়ের সঙ্গে তার স্ত্রী শাহিদাও এসেছেন। তারা এসে মুহূর্তেই সবাই জেনে গেলো, আমি দুলাভাইকে মেরে ফেলেছি। সবাই বিস্ময়ে হা হা করে উঠলো। এ কী ভয়ঙ্কর!
জামাল ভাই হজরত ইউনুস নবীর দোয়ার মতো ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন। সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন একথা যেন কেউ না জানে। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আমি আর জামাল ভাই মুখোমুখি বসে পরিকল্পনা করছি , লাশ কোথায় লুকানো যায়! ঘরের বাইরে চারদিকে উঁচু উঁচু ঘাস। কোথাও গর্ত খুড়তে গেলে পুলিশ নির্ঘাত বুঝে ফেলবে। বাইরের রাস্তায় এখনো দুই একজন মানুষ চলাচল করছে। দূরে কোথাও ফেলতে গেলে কেউ দেখলেই জানতে চাইবে, কী এটা?
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। কেউ জানবে না বলেও কত মানুষ জেনে গেলো। আস্তে আস্তে সকাল হয়ে এলো। আমরা লাশ লুকিয়ে ফেলার কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলাম না। কিছু একটা করা লাগে বলেই সকাল বেলা বাইরে মুরগির খোয়াড়ের পাশে একটা গর্ত করতে শুরু করলাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুরগির বিষ্ঠা পড়ে আছে। বিকট দুর্গন্ধ। পাশের বাড়ির খোকা আমাদের বললো, গান্ধার মইধ্যে আপনেরা কী করেন?
আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। বিড়বিড় করে বললাম, জামাল ভাই! এই ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে।
তখনই ঘুম ভাঙলো। দোয়া আয়াতুল কুরসিটা জানতাম। এখন ভুলে গেছি। নীল আলোর ডিমলাইট জ্বলছে। ঘরময় সিনেমার জোছনার মতো আলো। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। পাশ ফিরে অরুর দিকে তাকালাম। কী স্নিগ্ধ মুখ! হালকা হলুদ রঙের থ্রি পিসের ভেতর ফুলের মতো ফুটে আছে অরু। এক হাত এলিয়ে দিয়েছে আমার বালিশে। স্বপ্নের শীলা আপা অথবা অরুর গায়েও কি হলুদ রঙের থ্রি পিস ছিল? মনে করতে পারছি না।
আমি দেয়াল হাতড়ে বাথরুমে গেলাম। চশমাটা পড়ার টেবিলে ফেলে এসেছি। অনুমান করে বাতি জ্বাললাম। কল ছেড়ে চোখে পানি দিলাম। আয়নায় মুখ দেখলাম। ভেতরে ভ্যাপসা গরম। বাথরুমের কাঁচ ঘোলা। অপরিচ্ছন্ন আলোর এনার্জি বাল্বের নিচ থেকে একটা অস্বাভাবিক রকমের টিকটিকি তরতর করে নেমে আসছে।
সকাল হতে বেশি বাকি নেই। বেড়ালটা খুট খুট করেই যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তাড়িয়ে আসি। অন্যদিন দেখামাত্রই তাড়িয়ে দেই। আজ যেতে পারছি না। প্রতিদিন সকালে বুয়া এসে মুখ অন্ধকার করে সিঁড়ি থেকে ময়লা পরিষ্কার করে। আর বিড়ালের মা বাপ তুলে অভিশাপ দেয়। ফাঁকে ফাঁকে সুক্ষ্ণভাবে আমাদেরও দেয়। আমরা কেন আরেকটু সচেতন হই না। আল্লাহ পাক মানুষকে দুইটা চোখ কেন দিছে? পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই সেই চোখের, হাত পায়ের সঠিক ব্যবহার করে না। শুধু অন্যের ওপর চেপে বসে থাকতে চায়, এই জাতীয় কথাবার্তা। এতটাই সুক্ষ্ণ যে, আমরা বুঝেও কিছু বলতে পারি না। কিছু বললে শাড়ির আঁচল মুখে তুলে ভীষণ অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলে, ছি ছি ভাইজান! আপনে রাগ করতেছেন কেন? আপনি আমার বড় ভাইয়ের সমতুল্য। আপনার পায়ের নিচে আমার বেহেশত। আমি আপনাকে কোন সাহসে গালি দেই?
—ফুলির মা, আমি তোমার থেকে তেরো বছরের ছোট। তোমার ফুলির বয়স আমার কাছাকাছি।
ফুলির মা আবারো ভীষণ অবাক হয়। কেউ বয়সে ছোট হয়েও জ্ঞান বুদ্ধিতে সে বড় ভাই হতে পারে এই বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখে। আমি সরে যাই। সেই বক্তব্যে অতিষ্ঠ হয়ে মা ফুলির মাকে কড়া গলায় ধমক দেয়। মার সঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক হয়। এভাবেই চলে যায় দিন।
একযুগেরও বেশি সময় ধরে ফুলির মা আমাদের বাসায় কাজ করে। শুরুর দিকে প্রতিমাসেই তাকে তাড়ানো নিয়ে কথা হতো। কিন্তু আস্তে সে আমাদের বাসায় শেকড় গেড়ে বসে। এখন বাসায় তার ক্ষমতা আমার মায়ের কাছাকাছি। আমরা সবাই তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হই। শুধু অরু তাকে দেখে আনন্দ পায়। গত ঈদে সবার অজান্তে ফুলির মাকে একটা শাড়ি কিনে দিলো। ফুলির মা সবার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, শাড়িটা কেমন দেখলেন? জলজলা রঙ। রইদের ভেতরে আঁচলের পাইড় ঝিলিক মাইরা ওঠে। আম্মাজি দিছে। কাউরে বলতে নিষেধ করছে। আপনাকে বিশ্বাস কইরা বললাম।
সকাল বেলা খেতে বসেছি। মায়ের বাতের ব্যথাটা আজ আবার চাড়া দিয়ে উঠেছে। মা খেতে আসবেন না। আব্বা একটা নতুন বই ধরেছেন। নবীজির সুন্নতের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক কী কী মিল পাওয়া গেলো, এই নিয়ে বই। খুবই নাকি ইন্টারেস্টিং। তিনিও আসবেন না। খেতে বসেছি আমি আর অরু। রাতের বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। একটা দুঃস্বপ্নকে এতটা প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। এই নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না ।
অরুর চুল এলোমেলো। মনে হয় শরীর খারাপ। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও কথা মুখে আটকে যেতে যেতে চাইলো।
অরু আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললো, তোমার চোখ লাল কেন? এমন কটকটে লাল। কী হয়েছে দেখি! চোখ বড় করো।
—আমি ভয়ঙ্কর অবসেশনে ভুগছি অরু।
—কী বলছো তুমি?
—হু, রাতে ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখি। দিনের বেলা জেগে জেগে সেগুলো আবার দেখি। চলচ্চিত্রের মতো না। পুরোটা স্বপ্ন, স্বপ্নের ভয়ার্ত চিৎকার, রক্তের ছিটা সব গুলিয়ে মাথার ভেতর এক অদ্ভুত চিত্রকল্প তৈরি হয়।
—কবে থেকে এমন হচ্ছে?
—আমি বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে চিরকাল আমি এমনই ছিলাম।
—তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই?
—আমি কোথাও বেরুতে ভয় পাই। মনে হয় স্বপ্নের সেসব পরিচিত রাস্তা, দুর্বাঘাস আর উঁচুনিচু পথ দিয়েই হাঁটছি।
এমন সময় ফোন বাজলো। ফোন বাজার শব্দে আমার সবসময় গা জ্বালা করে। জন্মের পর থেকে একই টোন শুনে আসছি। আজ তেমন কিছু মনে হলো না।
অরু ফোন উঠিয়ে বললো, হ্যালো, বড় আপা!
আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। বড় আপার কথা শুনতে পাচ্ছি না। শুধু অরুরটা শুনতে পাচ্ছি।
—ও তো বাসায়ই আছে। খেতে বসেছে।
—না, কোথাও যাবে না। অরু ফোন থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, এই তুমি আজকে কোথাও যাবে?
আমি না সুচক মাথা নাড়লাম।
—আচ্ছা আপা বলে দেব। মা’র শরীর বেশি ভালো না। সেই পুরান সমস্যা। বাতব্যথা। তিন বেলা গরম পানিই দেই আপা। ফুলির মা না থাকলে আমিই পানি গরম করি। আচ্ছা আপা রাখবো। আচ্ছা আসব একদিন। ও কোথাও বের হতেই চায় না। শুধু বলে টাকা নাই। আমার থেকে রিকশা ভাড়া চায়। আচ্ছা আপা। আল্লাহ হাফেজ।
অরু ফোন নামিয়ে রেখে বললো, বড় আপা তোমাকে যেতে বলেছে।
—কোথায়?
—দুলাভাইয়ের অফিসে। সন্ধ্যার আগে আগে যাবা।
—কী সংবাদ?
—জানি না। যেতে বলেছে, যাবা।
—শুধু শুধু কেন যেতে বলবে?
—এমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছ কেন? দুলাভাই তোমাকে কত ভালোবাসে জানো না? গত সপ্তাহেই তো টাকা দিলো।
—হু।
—যাবে না কি যাবে না? না গেলে বলো, ফোন করে বলে দেই।
অরু খেতে খেতে অনেক কথা বলে। আমি খাই নিঃশব্দে। আজকেও ও অনেক কথাই বললো। আমার কান দিয়ে কিছুই ঢুকলো না। একসময় বিরক্ত হয়ে বললো, শুধু শুধু হু হু করছো কেন?
বলতে ভুলে গেছি, আমার দুলাভাইয়ের নাম কাশেম। ফকিরাপুল পানির টাংকির গলিতে অফিস। এখানে আসলেই ছাপাখানার কালির গন্ধ নাকে আসে। সুন্দর গন্ধ। দুলাভাইয়ের অফিস এমন কিছু সুন্দর না। একটা টেবিল, তিনটা চেয়ার আর একটা মক্কা শরিফের পেইন্টিং, এই নিয়ে অফিস। আজকাল অফিসঘর থাইগ্লাস করা থাকে। দুলাভাইর অফিস থাই গ্লাস করা। তবে এসি নেই। ঘর্ঘর শব্দে সবুজ রঙের একটা ফ্যান ঘুরে। শব্দ শুনলে মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে খুলে পড়ে দুলাভাইয়ের হালকা টাকপড়া মাথা থেতলে দেবে।
আমি কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দুলাভাই নিচের দিকে তাকিয়েই বললেন, কেমন আছ জহির। তোমার জন্য পেপসি আনিয়ে রেখেছি। পেপসি খাও। গ্লাস লাগবে?
—না।
—বাসা থেকে বের হয়েছো কখন?
—সোয়া চারটায়।
—তোমাদের সংসার কেমন যাচ্ছে?
—ভালোই।
—তোমাকে এমন মনমরা লাগছে কেন? কোনো সমস্যা?
—না না।
—তোমাদের ঝগড়া টগড়া প্রতিদিনই হচ্ছে, না কি?
—না তেমন না।
—তেমন না কেন? হওয়ার তো কথা। মেয়েরা আর যাই করুক, বেকার স্বামী তারা একদমই পছন্দ করে না। এটা জানো তো?
—জানি।
দুলাভাই খাতাপত্র উল্টাতে থাকলেন। অন্যান্য দিনের মতোই। সবসময় এমনই হয়। আমি হিম শীতল পেপসির বোতল খুলে গলায় ঢাললাম। গিলতে গিয়ে সামান্য শব্দ হলো। আমি সেই শব্দেই কেঁপে উঠলাম।
—জহির।
—জি।
—তোমাকে একটা কাজের জন্য ডেকেছি। ভেবো না অযথা বসিয়ে রেখেছি। তোমার আপা একদিন বললো, তুমি নাকি বলছ আমি সবকাজ শেষ করে পরে তোমার সাথে কথা বলি। তুমি নাকি একা একা অসহায়ের মতো বসে থাকো। তোমার এই ধারণা ঠিক না। আজকে আগে আগে সব রেডি করে রেখেছি। এই কালো সুটকেসটা দেখতে পাচ্ছ না? এটা নিয়ে যেতে হবে। বুঝতে পারছো?
—হু।
—তুমি তো দেখি এখনো মন খারাপ করে আছ। বিষয়টা কী? বোকা নাকি তুমি, বিয়ের শুরুর দিকে এমন হয়ই।
—না, মন খারাপ না।
—তাহলে শোনো, তোমাকে এখন যেতে হবে একটা হ্যাং আউটে। বনশ্রীর ডি ব্লকে। ঠিকানা আমি তোমাকে লিখে দিচ্ছি।
—সন্ধ্যায় ওইদিকে প্রচুর জ্যাম হয়।
—বুদ্ধি থাকলে জ্যাম হয় না। মোটরসাইকেল রাইড চালু হয়েছে, শুনছ না? মোটরসাইকেলে যাবা। ওরা তোমাকে আধাঘণ্টায় পৌঁছে দেবে। যেতে পারবে না?
—পারব।
আমি দুলাভাইর অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে দৈনিক বাংলা মোড়ের দিকে যাচ্ছি। সেখান থেকে বাসে উঠব। অবসেশন জেঁকে বসতে শুরু করেছে। রাতের স্বপ্নটা আবারও ফিরে এসেছে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে অতি শৈশবে দেখা আরও একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। আমার মেজো মামি তার থলথলে স্তন চেপে ধরেছেন আমার মুখে। আমার সারাশরীর কামড়ে আঁচড়ে দিচ্ছেন। আমার ছোট্ট পুরুষাঙ্গটি এত জোরে চেপে ধরছেন যেন এখনই অঙ্গটি খসে পড়বে। ভয়ে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসছে। আমি চিৎকার করতে পারছি না।
ঢাকার এই ব্যস্ত মহাসড়কে দাঁড়িয়ে কোনটা স্বপ্ন, কোনটা সত্যি আমি পৃথক করতে পারছি না। বড় হয়ে অনেকবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তুমি কি আমাকে কখনো একসপ্তাহের জন্য নানাবাড়ি রেখে এসেছিলে?
মা বলেন, কতই তো রেখে আসলাম। যা জ্বালাতন তুই করেছিস, তার দশ ভাগের একভাগও তোর বড় আপা করে নাই।
শৈশবের স্বপ্নটির আরেকটি সুন্দর দৃশ্য মাথায় ভাসছে। একটি ছোট্ট রান্নাঘর। শাড়ি পরে একটা বছর তিরিশের মেয়ে একটা একটা করে পরোটা ভেজে দিচ্ছে। আমি পিঁড়িতে বসে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে খাচ্ছি।
আমার আরও কত একান্ত স্বপ্ন আছে। এরা ঘুরেফিরে একই কনসেপ্টে বারবার আসে। কিছু যৌনতা ঘেঁষে একটা ভয়ঙ্কর সমাপ্তি হয়। দুলাভাই বনশ্রী যেতে বলেছেন। কোত্থেকে বাসে উঠবো বুঝতে পারছি না। অবসন্নতায় শরীর ভারী হয়ে উঠেছে। চোখ মুদলেই দেখি দুলাভাই, একটি টিনের ঘর, দুর্বাঘাস!